গল্পগ্রন্থ
উপন্যাস
অগ্রন্থিত
নাটক
ছড়া

নাচ

নাচ

রবিবারের দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল।

বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেনের ওপর থেকে নীচের ঘর কটিতেও এখন সবাইকার একটু গড়িয়ে নেবার সময়।

রবিবারের দুপুরের খ্যাটিটা নেহাত মন্দ হয়নি। অন্তত অ্যাকিউট অ্যাঙ্গল-এ শুরু করে একেবারে পুরো অবটিউস না হোক, রাইট অ্যাঙ্গল-এ শেষ করতে হয়েছে। সবাইকে।

এরপর, এই থেকে-থেকে দমকা বৃষ্টির দিনে একটু গা-হাত-পা ছড়িয়ে নেওয়া ছাড়া আর কী করা যেতে পারে!

এমন একটা মধুর ঘুমের আমেজের সময় নীচে ওই বেয়াড়া কড়া নাড়া কীসের? একটা সাইকেলের বেলের আওয়াজও যেন পাওয়া গেছে তার আগে।

টেলিগ্রাম নাকি! গৌরই প্রথম উঠে বসল।

টেলিগ্রাম! টেলিগ্রাম আবার কার আসবে?

না, সাইকেলের বেল নয়, নীচে কড়া-ই নাড়ছে কেউ। সুতরাং টেলিগ্রাম বোধহয় নয়। কী তাহলে?

বারান্দায় গিয়ে রেলিং-এর ধার থেকে উকি দেবার আগেই হাঁকটাও শোনা গেল, রেজেস্টিরি আছে, বাবু!

রেজেস্টিরি মানে রেজেস্ট্রি চিঠি! কার নামে আবার রেজেস্ট্রি চিঠি এল? পিয়নকে ওপরে ডাকলেই হয়, কিন্তু তার তর সইল না। বাহাত্তর নম্বরে রেজেস্ট্রি করা চিঠি আসা প্রায় একটা আজব ঐতিহাসিক ঘটনা। সুতরাং কার নামে এল জানবার আগ্রহে হুড়মুড় করে সবাই নীচে নেমে গেলাম।

রেজেস্ট্রি নয় ঠিক, পিয়ন বই দিয়ে পাঠানো চিঠি। গুরুত্ব বোঝাতে পিয়ন রেজিস্টিরি বলেছে। তা রেজেস্ট্রির চেয়ে পিয়ন দিয়ে পাঠানো চিঠি তো বাহাত্তর নম্বরের পক্ষে আরও তাজ্জব ব্যাপার! ব্যস্ত হয়ে তাই চিঠিটা কার জানতে চাইলাম।

কার? কার নামে চিঠি?

গানোসাবাবু? পিয়ন বেশ একটু দ্বিধাভরে জানাল।

গানোসাবাবু? গানোসাবাবুর চিঠি এখানে কী জন্য?

আমরা একটু কড়া গলায় জিজ্ঞাসা করতেই পিয়ন থতমত খেয়ে বললে, নেহি নেহি, সির্ফ গানোসাবাবু নেহি, গানোসা মাডোস বাবু।

আমাদের, না পিয়নের, কার মাথা সত্যি খারাপ হয়ে গেছে? বেছে বেছে আমাদের এই বাহাত্তর নম্বরেই কি যত উদ্ভুট্টে কাণ্ড ঘটে!

কী বলছ কী? একটু ধমক দিয়েই বললাম, মাডোসবাবু-টাবু এখানে কেউ নেই। কোথাকার কার চিঠি এখানে এনে হাজির করেছ?

লেকিন ঠিকানা তো হিয়েকে লিখা হ্যায়!—পিয়ন তার ভুল স্বীকার করতে রাজি নয়,—দেখিয়ে না!

লেফাফাটা হাতে করে দেখলাম।

পিয়ন ঠিক কথা বলেছে। ঠিকানায় কোনও ভুল নেই। একেবারে স্পষ্ট বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেন।

গৌরটা সব কিছুতেই হড়বড়ে। হঠাৎ পিয়নের হাত থেকে তার খাতাটা নিয়ে পকেট থেকে কলম বার করে খস খস করে সই করতে লেগে গেল।

আরে! আরে! করছিস কী! আমরা সবাই হাঁ হাঁ করে উঠলাম, কার না কার চিঠি সই করে নিচ্ছিস?

কিন্তু ততক্ষণে সই হয়ে গেছে। গৌর চিঠিটা আমার হাত থেকে টেনে নিয়ে অম্লান বদনে পকেটে ফেলে ওপরের সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়ে বললে, ঠিকানা যখন ঠিক আছে তখন ও নামের গোলমালে কিছু আসে যায় না। ও আমাদেরই কারও। হবে।

এরপর আর আপত্তি কে করবে! একমাত্র যে করতে পারত সেই পিয়ন বাহাদুর ঝামেলা মিটে যাবার জন্যই বোধহয় খুশি মনে এই ব্যবস্থা মেনে নিয়ে তখন রওনা দিয়েছে।

গৌরের পিছু পিছু সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে কিন্তু থামতে হল।

কী ব্যাপার হে! নীচে হঠাৎ গুলতানি কেন এমন সময়ে?

কাণ্ডটা একটু বেমক্কাই হয়ে গেছে। জবাব দেবার খুব উৎসাহ বোধহয় কারও ছিল তাই। কিন্তু এ গলা অমান্য করবে কার ঘাড়ে এমন ক-টা মাথা!

স্বয়ং ঘনাদা তাঁর টঙের ঘরের ছাদের ফালি থেকে হাঁক দিয়েছেন।

আজ্ঞে, গুলতানি কিছু না। এ ব্যাপারের নাটের গুরু বলে গৌরই আমাদের হয়ে দায়টা সামলাল, একটা রেজেস্ট্রি চিঠি এসেছে।

এরপর সবাই একেবারে একসঙ্গে কেটে পড়া। আড্ডাঘরে যেতে গেলে বারান্দা দিয়ে যাবার সময় টঙের ছাদে পাহারায় খাড়া ঘনাদার নজর এড়ানো যায় না। সবাই তাই গুটি গুটি সিঁড়ির সামনেকার শিশির-গৌরের কামরাতেই গিয়ে ঢুকেছি প্রায় পা টিপে টিপে।

ঘনাদা আর যাই করুন, এ-ঘরে ঢু দিতে এসে নিজের মাথা কাটা যেতে দেবেন না।

ঘনাদাকে এড়িয়ে থাকার এত গরজ, কিন্তু কেন?

গরজ এই কারণে যে, মনে মনে সকলেরই একটা সন্দেহ তখন বেশ জোরে খোঁচা দিতে শুরু করেছে।

সন্দেহটা যে মিথ্যে নয় ঘরের ভেতর গিয়ে চিঠির খামটা খুলে ফেলার পরই টের পাওয়া গেল।

আমরা নেহাত আহাম্মক, তাই গোড়াতেই বুঝতে না পেরে অমন একটি দারুণ অপকর্ম করে ফেলেছি।

গানোসা মাডোস যে আসলে একমেবাদ্বিতীয় ধাশ্যাম দাস এইটুকু আমাদের কারও মাথায় এল না? এ তো সেই হরে কর কমবা জিওবা রুদে রকার খানার আরেক উদাহরণ। গানো সাম ডোস টাইপ করার দোষে হয়ে গেছে গানোসা মাডোস। আর আমরা ওই গানোসা মাডোস-এর ধোঁকায় পড়ে স্বয়ং ঘনাদার চিঠিই হাতিয়ে বসে আছি! – সব দোষ অবশ্য গৌরের। গানোসা মাডোসএর মানে না হয় বুঝিসনি, কিন্তু অমন হড়বড়িয়ে শুধু ঠিকানার জোরেই অন্যের নামের চিঠি সই করে নেবার কী দরকার ছিল? আর নিয়েছিলি নিয়েছিলি, সেটা সাত তাড়াতাড়ি খুলতে গেলি কী বলে?

চিঠিটা না খুললে তবু ঘনাদার হয়ে যেন সই করে নিয়েছি বলে তাঁর হাতে দেওয়া যেত। এখন কোন মুখে তাঁর কাছে যাব এ খোলা চিঠি নিয়ে?

কিন্তু গানো সাম ডোস বলে হঠাৎ এ চিঠি ঘনাদাকে লিখলই বা কে? লিখেছেই বা কী?

খোলাই যখন হয়েছে তখন চিঠিটা আর না পড়ে পারা যায়?

নিজেদের বিবেককে একটা করে কড়া ধমক শুধু দিলাম—পরের ভাঁড় যদি ভুলে ভেঙেই থাকি, তার রস দু-ফোঁটা গলায় গেলে কসুর কি আর বাড়বে।

কিন্তু চিঠি দেখে তো চক্ষুস্থির। এমন আজগুবি চিঠি ঘনাদাকে পাঠাবার মানে কী? তাও আবার পিয়ন বই মারফত!

চিঠিটা ইংরেজিতে লেখা। আসলে চিঠিই তাকে বলা যায় না। ওপরে শুধু ডিয়ার ভস বলে সম্বোধন। তার নীচে আবোল-তাবোল একটা যেন নকশা কেটে তার পাশে সংকেত চিহ্নের মতো নাইন এ এম অর্থাৎ, সকাল নটা আর পরের রবিবার চ্যালেঞ্জ লেখা। সব শেষে সই হল Ah ar! চিঠিটা সবসুদ্ধ এই–

নাচ - ১

এ নির্ঘাত কোনও পাগলের কাণ্ড ভাবতে পারতাম, কিন্তু ঘনশ্যাম দাসকে গানো সাম ভোস শুধু নয়, গানোসা মাডোস করে লেখায় আমাদের বাহাত্তর নম্বর সম্বন্ধে একটু-আধটু ওয়াকিবহাল কারও যেন কারসাজি এ চিঠির পেছনে আছে বলে সন্দেহ হল। বিশেষ করে এই চ্যালেঞ্জ কথাটায় একটা বেয়াড়া ইশারা যেন লুকিয়ে আছে।

কিন্তু কেন, কীসেরই বা এ আজগুবি চ্যালেঞ্জ! এমন চ্যালেঞ্জ করেছেই বা কে?

সই করা নাম তো দেখা গেল Ah ar!

এ আবার কী রকম নাম? নামের ধাঁধা নাকি? ওই আহ আর-এর ভেতরেই নামের হদিস দেওয়া আছে?

আকাশ-পাতাল ভেবে তো সে হদিস পেলাম না। সবাই এবার চেপে ধরলুম শিবুকে। রোজ তো সে কাগজ পেন্সিল ডিকশনারি নিয়ে ক্রসওয়ার্ড পাজল অর্থাৎ শব্দ চৌকি নিয়ে বসে, এই আহ্-আর-এর মানেটা আর বার করতে পারবে না!

পারবে নিশ্চয়। কাগজ পেন্সিল আর গোটা তিনেক ডিকশনারি সাজিয়ে নিয়ে শিবু যে-রকম তন্ময় হয়ে বসে মাথার চুলগুলো আঙুলে জড়িয়ে টানতে শুরু করল, তাতে মাস দুয়েকের মধ্যে উত্তরটা সে যে ঠিক বার করে ফেলবে এ আশা অনায়াসে করা যেতে পারে। অবশ্য ততদিন তার মাথায় টানবার মতো চুল যদি কিছু বাকি থাকে!

শিবু নয়, ধাঁধার ভেদ করল হঠাৎ শিশির।

পেন্সিল চোষা আর চুল টানার ঘটা দেখে শিবুকে তখন আমরা তাড়া লাগাচ্ছিলাম। কী রে, এখনও হল না?

শিবু তাতে প্রায় অক্ষর-তত্ত্ব নিয়ে একটা বক্তৃতাই শুরু করে ফেলেছিল, এক-একটা অক্ষরের কী গভীর মানে আর কী লম্বা ইতিহাস তা জানিস? এই A অক্ষরটাই ধর না। রোম্যান হরফটা এসেছে গ্রিক থেকে, গ্রিকরা নিয়েছে সেই আদি ফিনিসীয়দের আলেফ গোছের উচ্চারণের অক্ষর থেকে! সে অক্ষর ঠিক আরবি আলেফ নয়। ফিনিসিয়ানদের স্বরবর্ণ ছিল না, সব ব্যঞ্জন। গ্রিকরা তাকে স্বরবর্ণ বানিয়ে নাম দিয়েছে আলফা—

এতদূর পর্যন্ত কোনও রকমে বরদাস্ত করেছি। থান ইট আর কোথায় পাব! হাতের কাছে একটা ডিকশনারিই তুলে শাসাতে হয়েছে। তাতে আমাদের মতো বর্বরদের প্রতি প্রায় ঘনাদার মতোই করুণার দৃষ্টিতে চেয়ে শিবু বলেছে, তাই বলছিলাম প্রত্যেকটি অক্ষরের হিসেব কষে এ ধাঁধার উত্তর বার করা অত সোজা নয়।

সোজা না হলে উলটোটাই হোক! নেহাত সস্তা কথার প্যাঁচ কষে শিশির হঠাৎ নিজেই চমকে উঠেছে! আরে! উলটো করলেই তো জবাব!

কী রকম? আমরা সন্দিগ্ধ হয়ে জিজ্ঞাসা করেছি।

Ah ar-কে উলটে পড়ো, শিশির সোৎসাহে বলেছে, কী হয়—Raha তো?

রাহা! আমাদের সেই রাহা! শিবুর মাসতুতো ভাই?

আমাদের বেয়াদবির শাস্তি দিতে ঘনাদা যাকে বোমের কাসিম সাজিয়ে প্রায় কাঁদিয়ে ছেড়েছিলেন মহাশূন্যের ঢিল আমদানি করে?

আমাদের মুখগুলো হাই-পাওয়ার বালব-এর মতো জ্বলে উঠেই কিন্তু ফিউজ হয়ে গেল যেন হঠাৎ।

রাহা, সেই রাহা আমাদের কাছে দেওয়া কথা শেষ পর্যন্ত রেখেছে! কাজ যা করেছে তা জব্বর! ওই খুদে চিঠিতে মোক্ষম একটি যা ছেড়েছে তা চেহারায় ধানী পটকা, কিন্তু বহরে মেগাটন বোমা।

এই কথা-ই সে আমাদের দিয়েছিল। ঘনাদার কাছে সেদিনকার সেই নাজেহাল হওয়া সে ভোলেনি। বলেছিল, ঘনাদাকে সর্ষে ফুল দেখাবার মতো সেকালের শোধ সে নেবেই পরের বার কলকাতায় ফিরে।

কথা সে রেখেছে। কিন্তু আনন্দে ধেই নৃত্য করার বদলে আমরা যে চোখে। অন্ধকার দেখছি।

কেন, কী হল, বোঝাতে গেলে বলতে হয় যে বৈশাখের খাঁ খাঁ রোদে-পোড়া, ফটি-ফাটা মাঠের জন্য চাওয়া বৃষ্টি অঘ্রানের পাকা ধানের খেত ভাসালে যা হয় হয়েছে তা-ই। মৌ-কা মতো পেলে যা দিয়ে বাজি মাত করা যেত তাই আমাদের সব পাকা খুঁটি এমন কাঁচিয়ে দিতে বসেছে।

ঘনাদার সঙ্গে আমাদের যে আপাতত অটুট সন্ধি চলেছে।

বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেনে এখন সুবর্ণ শান্তির যুগ।

মধুর এই সম্পর্ক এক ফোঁটা সন্দেহের ছোঁয়াচেই যে বিষিয়ে উঠবে! ঘনাদা আর আমাদের ক্ষমা করবেন? তিনি তো ধরেই নেবেন এটা আমাদের বেশরম বেইমানি। মখমলের দস্তানার মধ্যে আমরা যেন বিষের ছুরি লুকিয়ে চালিয়েছি। মার্কিন চর যেন আঁতাতের সুযোগ নিয়ে ক্রেমলিন উড়িয়ে দেবার ফন্দি করেছে। কিংবা রুশ রাজদূত হোয়াইট হাউসের মেহমান হয়ে টাইম বোমা বসাবার তাল খুঁজছে।

না, আশা-ভরসা আর কিছু নেই। বাহাত্তর নম্বরের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আহ্ আর-এর চিরকুট চিঠিটি প্রকাশ পেলেই কালাপানিতে আবহাওয়ার নিম্নচাপ শুরু হয়ে যাবে, তারপর তুমুল তুফান।

অথচ আমাদের অবস্থা এখন এগুলে গর্দান, পেছুলে জান! ঘনাদাকে এ চিঠি দিলেই তো সর্বনাশ। আর জোর করে লুকোতে চাইলেও তাই। ঘুণাক্ষরে যখন জেনেছেন তখন আর কি এ চিঠি তাঁর হাতে তুলে না দিয়ে পার পাব!

তবু যদি আমাদের ভাগ্যে ভুলে গিয়ে থাকেন এই ক্ষীণ আশায় ভর করে বিকেলের আড্ডাঘরে গিয়ে ধুকধুকে বুক নিয়ে জমায়েত হলাম। যথাসময়ে ঘনাদার আবির্ভাব ও মৌরসি পাট্টার আসন গ্রহণ। শিশিরের সিগারেট নিবেদন, লাইটার প্রজ্বলন, ও ঘনাদার টাটানগরকে লজ্জা দেওয়া ধূম উদগীরণ।

তারপরই সেই অমোঘ বজ্রপাত।

কার রেজিষ্ট্রি চিঠি এল হে আজ দুপুরে?

যতক্ষণ সম্ভব, ঠিক ঝোপে কোপ না পড়তে দিয়ে আসল প্রশ্নটা এড়িয়ে বলা হল—আজ্ঞে রেজেস্ট্রি নয়। পিয়ন-বই দিয়ে পাঠানো একটা চিঠি।

আমিও তো তাই ভাবি—ঘনাদার মুখে যা ফুটে উঠল অন্য কারও বেলা সেটাকে মুচকি হাসি বলা হত—রবিবারে রেজেস্ট্রি চিঠি পাঠাচ্ছে, আমাদের ডাক বিভাগের এত কাজের আঠা কবে থেকে হল।

ঘনাদা থামলেন। সিগারেটে আর-একটা টান পড়ল। ট্রেনটা অ্যাকসিডেন্ট বাঁচিয়ে লাইন পালটাল কি?

বৃথা আশা। একমুখ ধোঁয়ার সঙ্গেই মারাত্মক প্রশ্নটা বেরিয়ে এল, চিঠিটা কার তা তো বললে না!

ঘরে যেন ভ্যাকুয়াম। আমরা সব বোবা কাঠের পুতুল। কারও নিশ্বাস পড়ছে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুখ খুলতেই হল।

আজ্ঞে, আপনারই চিঠি! গৌরই পকেট থেকে চিঠিটা প্রায় আড়ষ্ট হাতে বার করে ঘনাদার সামনের টেবিলে ধরে দিয়ে একটু সাফাই গাইবার চেষ্টা করলে, আজেবাজে কার বাঁদরামি বলে এ-চিঠি দিয়ে আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি।

গৌরের সাফাইটা ধবধবে সাদার বদলে আমাদের কাছেই ম্যাড়মেড়ে পাঁশুটে ঠেকল।

আমারই চিঠি! ভুরু দুটো একটু বেশি রকম কুঁচকে ঘনাদা তখন পকেট থেকে বার করে চশমা জোড়া চোখে লাগিয়ে ফেলেছেন।

টেবিল থেকে চিঠিটা তিনি তুলে নিলেন, আমাদেরও নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। চোখের পাতা পর্যন্ত না ফেলে আমরা তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে। বিস্ফোরণ তো হবেই, কিন্তু সেটা কোন মাপের? চীন কি ফ্রান্সের, না রুশ বা মার্কিন বোমার? তার ফল-আউট, মানে তেজ-ঠাসাছাই বা ছড়াবে কতদূর?

প্রচণ্ড ধাক্কাটা একটু ভোঁতা করবার জন্য যতদূর সম্ভব পুরু নরম গদির ব্যবস্থা অবশ্য করে রেখেছি। বারান্দায় একটু আড়ালে ট্রের ওপর প্লেট সাজিয়ে বনোয়ারি এক পায়ে খাড়া আছে। এ-ঘরে ঘনাদার গলা এক পর্দা উঠতে না উঠতে ঘরে ঢুকে তাঁর টেবিলে সবচেয়ে বড় প্লেটটা নামিয়ে দেবে। তাতে জোড়া চিংড়ির কাটলেট যেন হাসছে! সে হাসির মায়ায় ঘনাদার মেজাজের পারা কিছুটা কি আর নামবে না?

কিন্তু এ কী তাজ্জব ব্যাপার! জোড়া কাটলেটের আগে ঘনাদা-ই যে হাসছেন। প্রথমে মুচকে, তারপর বেশ একটু দন্ত বিকশিত করে।

হতভাগা!

হাসি মুখ থেকে বেরিয়েছে বলেই বাঁচোয়া। তবু চমকে উঠতে হল। কিন্তু এ স্নেহের ভৎসনা কাকে? আমরা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। না, আমাদের কারও সে ভাগ্য নয়। তাহলে এ কি রাহা-রই প্রাপ্য? রাহার সব চালাকি ধরে ফেলে তিনি তাকে চিনেও ফেলেছেন!

হতভাগার চ্যালেঞ্জের সাধ এখনও মিটল না! ঘনাদার মুখে প্রশ্রয় আর করুণার হাসি।

না, এ তো রাহা বলে মনে হচ্ছে না! কে তবে?

যে-ই হোক, ব্যাপারটা আমাদের কাছে তো হঠাৎ মরা নদীতে বান, বাঁজা ডাঙায় ধান, ভরাড়ুবি হতে হতে একেবারে মানিক মুক্তোর চড়ায় ঠেকা।

বনোয়ারিটাএখনও করছে কী? তারই বা কী দোষ? ঘনাদার গলাও চড়েনি, সেও নড়েনি।

নিজে থেকেই সুতরাং ডাক দিয়ে আনাতে হয়। স্টাইলের একটু খুঁত থাকে বটে, কিন্তু লক্ষ্য ভেদ হয় ঠিকই। টেবিলের ওপর প্লেটটা ঘনাদা যেন দেখেও না দেখতে পেয়ে শুরু করেন।

 

বিছানা থেকেই হেলিকপ্টারটার আওয়াজ পেলাম। রোটর অর্থাৎ চরকি-পাখা চালিয়ে উঠতে শুরু করেছে। হেলিকপ্টার তো আর চুপি চুপি চালানো যায় না। গেলে তাই চালাত আহারা। তবে ভয় তার কিছু নেই। যেখানে আমায় বন্দি করে রেখে গেছে সেখান থেকে বার হওয়াই আমার পক্ষে অসম্ভব, তা আওয়াজ পাবার পর হেলিকপ্টার নামা-ওঠার মাঠ পর্যন্ত ছুটে গিয়ে ধরা!

ঘুটঘুটে অন্ধকারে শুধু আওয়াজ শুনেই হেলিকপ্টারটা কতদূর উঠে কোন দিকে যাচ্ছে বোঝবার চেষ্টা করলাম—

 

বোঝবার চেষ্টা করতে করতে ঘনাদার অন্যমনস্কভাবে একটা প্লেটে যেন ভুলে হাত পড়ে যায়। দেড়খানা কাটলেট সেখান থেকে উধাও হবার পর হেলিকপ্টারটা কোন দিকে গেছে বুঝে তিনি যেন তাঁর সেই বন্ধ করা ঘরেই ছোট একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলেন, যা বুঝলাম তাতে আশা করবার আর কিছু নেই।

হতাশ হয়েই ঘনাদা একেবারে চুপ। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে আমরাও ব্যাকুল উদ্বিগ্ন।

শিবুই নিদানটা বার করে ফেলে বলে, আরেকটা কাটলেট দেবে, ঘনাদা!

আরেকটা?—ঘনাদা যেন বর্তমান মর্ত্যভূমিতে নেমে এসে প্লেটের দিকে প্রথম দৃষ্টি দেন—তিন শত্তুর বলে না?

একটা নয়, দুটো কাটলেট অগত্যা আনতে হয় বনোয়ারিকে। এরকম ইমারজেন্সির জন্য আমাদের অবশ্য মজুত করাই ছিল।

বাকি আড়াইখানা কাটলেট আর তার সঙ্গে দু পেয়ালা কফি শেষ করার আগে ঘনাদার হেলিকপ্টার চলে যাওয়ার হতাশা কাটে না।

বনোয়ারি প্লেট সরিয়ে নিয়ে যাবার পর শিশিরের ইতিমধ্যেই বাজেয়াপ্ত টিন থেকে নিজেই একটি সিগারেট বার করে ধরিয়ে ঘনাদা তাঁর বন্দিদশায় ফিরে যাবার ফুরসত পান।

 

নিজের অবস্থাটা বোঝবার চেষ্টা করলাম। অজানা ছোটখাটো দ্বীপের মতো একটা চর। তার চারিদিকে যোজনের পর যোজন বান-ভাসা নদীর অগাধ থই থই জল। মৈমনসিংহের হাওড়ের রাজসংস্করণের মতো সে বিশাল জলকে ঘিরে আবার সম্পূর্ণ অচেনা অজানা এমন বিরাট দুর্ভেদ্য ভয়ংকর জঙ্গল যে, সভ্য মানুষের পা পড়া দূরে থাক, তার মাপজোখ পরিচয় মানচিত্রেও ওঠেনি এখনও।

এই চরের মাঝে একটা যেমন-তেমন করে কাদা-মাটিতে ভোলা খুপরি গোছের জংলা আগাছায় ছাওয়া ঘরে মাথা আর পায়ের দিকে পোঁতা দুটো মোটা খুঁটিতে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় আমি পড়ে।

দেশটা হল দক্ষিণ আমেরিকার বলিভিয়া, জায়গাটা তারই উত্তর-পুবের বেনি নদীর জলা বাদার অজানা অগম্য অঞ্চল-শুধু বলিভিয়ার নয়, ব্রেজিল-এরও গহন গভীর অরণ্য যাকে ঘিরে রেখেছে।

আহারা এই জায়গার মাঝখানে এমনই নিরুপায় অবস্থায় আমায় বেঁধে রেখে চলে গেল! নিরুপায় অবস্থায় বেঁধে রাখা নিয়ে কিছু বলবার নেই, কারণ শর্তটা তাই ছিল। কিন্তু তার চলে যাওয়াটা অবিশ্বাস্য শয়তানি। সে রকম কোনও কড়ারই ছিল না।

আহারার সঙ্গে মাত্র কিছুদিন আগে পরিচয় হয়েছে। যাচ্ছিলাম বলিভিয়ার আজব ট্রেনে সান্টাক্রুজ থেকে পুয়ের্তো সুয়ারেজ-এ। সে ট্রেন আমাদের হাওড়া-আমতা রেলওয়েরই নিকটজ্ঞাতি।

ইচ্ছে করলে বলিভিয়ার জাতীয় এয়ারলাইন লয়েড এইরিও বলিভিয়ানোর প্লেনেও যেতে পারতাম। ভাড়া আমাদের দেশের হিসেবে শ-খানেক টাকা। কিন্তু তার চেয়ে এই লঝঝড় রেলপথই পছন্দ করেছি দেশটা আর দেশের মানুষকে ভাল করে চেনার সুবিধের জন্য শুধু নয়, এই সস্তা মোেট মাত্র কুড়ি টাকা ভাড়ায় ঢিমে তালের ট্রেনের টহলেই দুরন্ত উত্তেজনার খোরাক অনেক বেশি মিলতে পারে বলে।

মিললও তাই। ট্রেনে আমি থার্ড ক্লাসের যাত্রী। থার্ড ক্লাস হল খোলা একটা ওয়াগন গোছের। রোদ বৃষ্টি থেকে বাঁচতে চাও তো নিজেই ওপরে কাপড় কি ক্যাম্বিস টাঙিয়ে ছাউনি করে নাও। আলো হাওয়ার অভাব নেই। প্রাণ ভরে দুধারের দৃশ্য দেখারও কোনও বাধা নেই। এর ওপর আর সামান্য কিছু দিলেই সেকেন্ড ক্লাসের বন্ধ বুক-চাপা একটা খুপরি কামরায় দুঃখভোগের চালিয়াতি দেখানো যেত, আর তার ওপর টাকা দশ দিলেই ফার্স্ট ক্লাসের কাঠের কামরায় স্রেফ কাঠের বেঞ্চির আরাম। সব দিক দিয়ে তাই থার্ড ক্লাসই সেরা বোধ হয়েছে, অবশ্য ফোর্থ ক্লাস বাদে। সেটার আবার টিকিটও লাগে না, একটু শুধু হুশিয়ার থাকতে হয় ঘুমের ঢুলুনিতে পড়ে না যাওয়ার জন্য। হাওড়া-আমতার খেলনা-ট্রেনে গাড়ির ছাদে এ ফোর্থ ক্লাসের নমুনা আমাদের দেখা আছে।

থার্ড ক্লাসে যাওয়া শুধু যে নিজে থেকেই বেছে নিয়েছিলাম তা বোধহয় নয়, তার পেছনে নিয়তির অলক্ষ্য হাত নিশ্চয় ছিল, ইগ্নাসিওর সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবার জন্যই।

ইগ্নাসিও থার্ড নয়, ফোর্থ ক্লাসের যাত্রী, তবে তার জায়গা আমারই সামনের সেকেন্ড ক্লাস কামরার মাথায়। সেখান থেকে উঠতে নামতে দিনে অনেকবারই তার সঙ্গে চোখাচোখি হয়। কেমন একটা বোকা বোকা ভালমানুষ চেহারা। দেখা হলেই আমার দিকে চেয়ে হাঁদার মতো হাসে। যে দেশে ধলার চেয়ে আমার মতো কালাই বেশি সেখানে বিদেশি বলে চিনতে পারে বলে মনে হয় না। তবে আমার পোশাক-আশাক ঠিক থার্ড ক্লাসের সঙ্গে মিল খায় না বলেই বোধহয় একটু অভব্যের মতো যখন-তখন তার ফোর্থ ক্লাসের উচ্চাসন থেকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে।

দু-দশ ঘণ্টার যাত্রা তো নয়, সান্টাক্রুজ থেকে পুয়ের্তো সুয়ারেজ চারশো মাইলের বেশি না হলেও এ ট্রেনে লাগে চার দিন। সেটাও টাইম টেবলের ছাপা সময়। আমাদের লেগেছিল পাক্কা পাঁচ দিন।

এই পাঁচ দিনের যাত্রায় ইগ্নাসিওর সঙ্গে দ্বিতীয় দিনেই আলাপ হয়ে গেল। আলাপ করলে সে নিজে থেকেই। হাঁদার মতো হাসতে হাসতে হঠাৎ একবার জিজ্ঞাসা করে বসল, তুমি ফার্স্ট ক্লাসে যাচ্ছ না কেন! আমার বন্ধু ফার্স্ট ক্লাসে যাচ্ছে।

এই আলাপটুকুতেই ইগ্নাসিওর বুদ্ধির দৌড় বুঝে ফেলেছি। একেবারে হাঁদারাম যাকে বলে, কিন্তু ভারী সরল হাসিখুশি চেহারা। এরকম লোকের ওপর আপনা থেকে মায়া হয়।

হেসে তাই জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার বন্ধু যাচ্ছে বলে আমি যাব কেন!

বাঃ! অকাট্য যুক্তি দিলে ইগ্নাসিও, তোমার পোশাক যে আহারার মতো। থার্ড ক্লাসে কেউ এ-পোশাকে যায়!

পোশাকের কথাটা চাপা দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার বন্ধুর নাম তাহলে আহারা! তা বন্ধু হয়ে সে একা ফাস্ট ক্লাসে যাচ্ছে কেন? তোমাকেও তো নিতে পারত!

কেমন করে নেবে? ইগ্নাসিও বন্ধুর হয়ে ওকালতি করলে, আমার কাছে টিকিটের পয়সা নেই, তাই তো গাড়ির ছাদে যাচ্ছি।

কোথায়, যাচ্ছ কোথায়? ইগ্নাসিওর বন্ধুর বিরুদ্ধে আর কিছু না বলে জিজ্ঞাসা করলাম।

যাচ্ছি পুয়ের্তো সুয়ারেজ-এ গর্বভরে জানালে ইগ্নাসিও, সেখানে আমাদের গাঁয়ের বাড়িতে একটা পুরনো দলিল আছে। সেটা কিনে নিয়ে বন্ধু আমায় অনেক টাকা দেবে। তখন আমি জামাকাপড় কিনে বন্ধুর সঙ্গে ফার্স্ট ক্লাসে ফিরব, জানো!

খুব ভাল কথা, উৎসাহ প্রকাশ করে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কিন্তু দলিলটা কীসের?

কী-সব টিনের খনি-টনির, ইগ্নাসিও তাচ্ছিল্যভরে বললে, ঠাকুরদাদার কোন ঠাকুরদাদার নাকি ছিল বলে গল্পই শুনেছি শুধু। এক দামড়িও কখনও পাইনি। হ্যাঁ, আমার নাম ইগ্নাসিও ব্যারোসো, তা জান? এই দেখো আমার কার্ড। আমার বয়স আঠারো।

কার্ডটা সে আমার হাতে গুঁজেই দিল।

মাথা নেই মুণ্ডু নেই বেমক্কা এই নিজের পরিচয় দেওয়ার ঘটায় আমি অতি কষ্টে হাসি চেপে কার্ডটা দেখলাম। ছেঁড়া ময়লা একটা ফিকে গোলাপি কার্ড। এই আইডেন্টিফিকেশন কার্ড না থাকলে বলিভিয়ায় কেউ চাকরি-বাকরি পায় না, ভোট দিতে পারে না, এমনকী বিয়ে পর্যন্ত আটকে থাকে। কার্ডটা দেখলাম সাত বছর আগেকার। তখনকার বয়স লেখা আছে আঠারো। তারপর থেকে ভদ্রলোকের এক কথা।

এই ইগ্নাসিও ব্যারোসো। তার বন্ধু আহারার সঙ্গেও আলাপ হল সেই দিনই। নাম শুনে যেমন চেহারা দেখেও তেমনই তাদি জাতের পরিচয়টা ঠিক বোঝা যায় না। বলিভিয়ায় নানা দেশের লোকের মধ্যে চিনা ও জাপানিরাও কয়েক পুরুষ বসত করে আসছে। আহারার চেহারায় চিনের ছাপই একটু যেন বেশি।

বেঁটে খাটো ইস্পাতের গোলার মতো চেহারা। ব্যবহারে অমায়িক ভদ্র শুধু নয়, বেশ একটু মিশুক। ইগ্নাসিওর কী দলিল কিনতে যাচ্ছে জিজ্ঞাসা করায় প্রথমে একটু চমকে ভুরু কোঁচকালে, তারপর হেসে বললে, ইগ্নাসিও এর মধ্যে সব বলেছে বুঝি! ছেলেটার পেটে কোনও কথা থাকে না। আমি না থাকলে কবে কোন ঠগবাজের হাতে পড়ত!

হ্যাঁ, আপনাকে তো ও বন্ধু বলে! তারিফ জানিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলাম, কিন্তু কী যেন টিনের খনির দলিলের কথা বলছিল?

যার দলিল সে-খনি এতদিন আছে কিনা তারই ঠিক কী! তাচ্ছিল্যভরে বললে আহারা, তবে পুরনো দলিল বলছে, তাই একবার দেখে ওকে কিছু দাম ধরে দেব বলেছি।

আহারা খুব সরল আন্তরিকভাবেই কথাটা বলেছিল। মানুষটার ওপর একটু বিশ্বাসই জন্মেছে তাতে। সে বিশ্বাস একটু চিড় খেয়েছে তার পরদিন।

যেমন লঝঝড় লাইন তেমনি ফঙ্গবেনে ইঞ্জিন। পরের দিন ঘোর এক জঙ্গলের মাঝে ট্রেনটা হঠাৎ মাঝ রাস্তায় বন্ধ হয়ে গেছে। বেশ ভয়াবহ অবস্থা। এদিকে ওদিকে একশো মাইলের মধ্যে কোনও স্টেশন তো নেই, কোনও বসতিও না। ওই রেল লাইনটুকুই শুধু ভরসা। ট্রেন অচল হলে যাকে বলে একেবারে অকূল পাথারে, লাইন ধরে হাঁটা ছাড়া কোনও উপায় নেই।

সেই আলোচনাই করছিলাম। এমন সময় আহারা হঠাৎ একটু যেন উপহাসের সুরেই জিজ্ঞাসা করেছে, ধরুন এ লাইনটাও যদি না থাকত, এ অজানা জঙ্গলের মধ্যে ছেড়ে দিলে বার হতে পারতেন?

আহারার আসল মতলব তখনও সত্যিই বুঝিনি। হেসে বলেছি, তা বাজি রাখলে পারতাম বোধহয়।

বেশ! রাখলাম বাজি! আহারা নিজের বাঁ হাতটা চিত করে তাতে একটা ঢাপড় দিয়েছে।

কিন্তু আমি রাখছি না। আমি একটু অবাক আর বিরক্ত হয়ে বলেছি, খামোকা ওরকম বাজি রাখতে যাব কেন?

মুখ দিয়ে যখন উচ্চারণ করেছেন বাজি আপনাকে রাখতেই হবে! আহারা জুলুমবাজের মতো বলেছে।

না, রাখব না। আমি সত্যি চটে গিয়ে শক্ত হয়ে মাথা নেড়েছি।

কথা দিয়ে বাজি না রাখলে আমরা কী করি, জানেন? মুখে হাসি আর গলায় হিংস্র শাসানি নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছে আহারা।

কী?

এই! বলে আহারা হঠাৎ এসে আমায় ধরেছে আর দুটো ডিগবাজি খেয়ে আমি সাত হাত দূরে ছিটকে চিৎপাত হয়ে পড়েছি।

আহারা আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে এবার বলেছে, এর নাম জুদো! কেমন, বাজি এবার রাখবেন?

নাঃ, লোকটার যেন বড় বেশি গরজ! ব্যাপারটা তাই তলিয়ে দেখা উচিত মনে হয়েছে।

যেন ভাঙা হাড়গোড় নিয়ে অতি কষ্টে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ককিয়ে বলেছি, আর বাজি না রেখে পারি! হাড়গোড়গুলো তাহলে যে আর খুঁজে পাব না।

এই তো মরদের মতো কথা। আহারা আমার পিঠে একটা চাপড় মেরে ধনুক করে দিয়ে বলেছে, পুয়ের্তো সুয়ারেজ-এ পৌঁছেই আমি আপনাকে আমার হেলিকপ্টারে এক জায়গায় নিয়ে যাব, সেখানেই পরীক্ষা হবে।

যে কথা সেই কাজ। পুয়ের্তো সুয়ারেজ-এ পৌঁছে ইগ্নাসিওর ভিটেবাড়ির পুরনো দলিলটা একবার দেখতে পর্যন্ত না দিয়ে আহারা আমায় নিয়ে তার হেলিকপ্টারে রওনা হয়েছে। ইগ্নাসিওকে বলে দিয়েছে তার দলিল নিয়ে সে যেন সুয়ারেজ-এ অপেক্ষা করে।

আমার সঙ্গে কড়ার যা হয়েছে তা এই—আমায় অজানা এক জঙ্গলের মাঝে নামিয়ে হাত-পা বেঁধে এক জায়গায় ফেলে রেখে সে হেলিকপ্টার নিয়ে কাছেই এক জায়গায় সাতদিন অপেক্ষা করবে। সাতদিনের মধ্যে আমি যদি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে সবচেয়ে কাছের বড় জনপদে পৌঁছোতে পারি তাহলে আমার জিৎ। জিতি বা হারি হেলিকপ্টার নিয়ে সে আমার ওপর নজর রাখবে ও শেষ পর্যন্ত আমায় তুলে নিয়ে ফিরে যাবে।

আহারা তার বদলে গোড়াতেই বেইমানি করেছে। কেন যে করেছে তা তখন জানতে আমার বাকি নেই। অতিরিক্ত উৎসাহে হাত-পায়ের বাঁধন তাই খুলতে আমার দেরি হয়নি।

কিন্তু তারপর? হেলিকপ্টারে নামবার সময় ওপর থেকে জায়গাটার একটা ধারণা করে নিতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু শূন্য থেকে দেখা ছবি মাটির ওপর অনেক সময়ে ভুল হদিসই দেয়। এ চরম নির্বাসন থেকে মুক্তি পাব কেমন করে?

মুক্তির উপায় হল একেবারে আশাতীতভাবে। হতাশ হয়ে দ্বীপের মতো চরটার মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ ক-টা মৌচাকের সন্ধান পেয়ে গেছি। খিদের জ্বালায় তারই একটা খুঁচিয়ে ভাঙতে গিয়ে ভাঙা আর হয়নি। তার বদলে পকেট থেকে নোটবই আর পেনসিল বার করে নকশা কাটতে শুরু করেছি পাগলের মতো।

কী ভাগ্যি, নোটবই আর পেনসিলটা পকেটে ছিল। ঘণ্টা কয়েক ধৈর্য ধরে গোটা দুয়েক নকশা একেবারে নিখুঁত করে এঁকে ফেলেছি।

খিদের কথা ভুলে আপনি নকশা আঁকলেন? আমরা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করি, কী সে নকশা?

ওই তোমাদের পিয়ন বই-এ পাঠানো চিঠির মতোই! ঘনাদা হেসে বললেন, তবে একটু আলাদা।

ঘনাদা আমাদের হাতের চিঠিটাই টেনে নেন। তারপর শিশিরের কলমটা চেয়ে নিয়ে দুটো এই রকম নকশা–

নাচ - ২

ঘন ঘন করে এঁকেই ফেলে দেন আমাদের সামনে।

এ নকশায় হল কী? আমাদের গলা প্রায় ধরা।

হল আর কী! ঘনাদা যেন উদাসীন, সাত দিনের জায়গায় দুদিনে সে নির্বাসনের চর থেকে বেরিয়ে মাদ্রে দে দিয়স আর বেনি নদী যেখানে মিলেছে। সেখানকার মোরেনো শহরে পৌঁছে সেখান থেকে সরকারি প্লেনে পরের দিনই পুয়ের্তো সুয়ারেজ পৌঁছে গেলাম।

যা ভেবেছিলাম তাই। শহর থেকে ইগ্নাসিওর বাড়ি গিয়ে দেখি, আহারা তাকে নিয়ে তার হেলিকপ্টারে সান্টাক্রুজ রওনা হবার জন্য প্রায় তৈরি।

আমায় দেখেই যেমন তাজ্জব তেমনই খাপ্পা।

আপনি! আপনি তাহলে বার হতে পেরেছেন? তা এখানে এসেছেন কেন? আহারার গলার আওয়াজে দাঁতের ঘর্ষণের শব্দ মেশানো।

এখানে আসতে হল বাজির টাকাটা নিতে! মোলায়েম করে বললাম।

টাকার কথা কিছু হয়নি, কথাগুলো আহারা প্রায় যেন গুলির মতো ছুড়ে মেরে হেলিকপ্টারটা চালাতে গেল।

টাকার কথা না হয়ে থাকলে, আরও ভাল! আমি আহারাকে ধরে ফেলে হাসি মুখে বললাম, বাজি জিতে একটা অন্য কিছু লাভ তো হওয়া চাই। টাকার বদলে ইগ্নাসিওর দলিলটা দেখলেই আমি সন্তুষ্ট হব।

তাহলেই সন্তুষ্ট হবি! জুদোর শিক্ষাটা বড় তাড়াতাড়ি ভুলে গেছিস মনে হচ্ছে! আহারা জুদোর কড়া প্যাঁচ কষল।

গজ দশেক দূর থেকে যত্ন করে তুলে থুবড়ে-পড়া মুখের ধুলোমাটি রুমাল বার করে ঝেড়ে দিতে দিতে বললাম, এর নাম কারাটে। জুদোর বাবা বলে জাপানে। এখন ইগ্নাসিওর দলিলটা দেখাতে আর আপত্তি আছে?

আপত্তি কেন থাকবে?আহারা এবার কাঁদো কাঁদো হয়ে আর-এক মানুষ। আমার হাতে দলিলটা চটপট দিয়ে বলতে লাগল, বোকা পেলে কে না ঠকাতে চায়। ওর বংশের প্রায় ভুলে যাওয়া টিনের খনিটা জলের দরে কিনে নেবার তালে ছিলাম। আপনি যখন ওর মুরুব্বি হয়েছেন তখন ন্যায্য দামই দেব।

 

তা-ই দিয়েছিল আহারা। সই-সাবুদ হবার পর শুধু মিনতি করে জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন করে সেই চর থেকে পথ খুঁজে বার হলাম!

হদিস সেই চরেই রেখে এসেছি। তাকে বলেছিলাম—খুঁজলে পেতে পারো।

হন্যে হয়ে তারপর সে খুঁজেছিল নিশ্চয়। পেয়েও ছিল সেই ফেলে আসা নকশা-আঁকা চিরকুটগুলো।

অনেক বছর ধরে মাথা খুঁড়ে সে চিরকুটের মানে সে বার করতে পেরেছে মনে হয় তার এই চিঠি থেকে। আমার কাছে সে বাহাদুরি জাহির করতে আর এতদিন বাদে আমার কতটা খেয়াল আছে একবার বাজিয়ে নেবার জন্য এ নকশা-আঁকা চিঠি পাঠানো। চালাকি করে আবার নকশার ভেতরে চাকের ছ-কোনা খোপগুলোও এঁকে দিয়েছে। তবে চিঠি তারই লেখা হলেও নিজে সে যাচাই করতে এ শহরে এসেছে। বলে মনে হয় না। বলিভিয়া ছেড়ে আর একবার কারাটের সুখ পেতে এখানে আসবার শখ কি সাহস তার হবে না। তার কোনও সাকরেদ-টাকরেদই এ চিঠির হদিস দেওয়া জায়গায় হাজির থাকবে মনে হয়।

জায়গাটা কোথায়? আমাদের সন্দিগ্ধ জিজ্ঞাসা।

নকশায় যদি ভুল না করে থাকে, ঘনাদা আমাদের প্রতি যেন কৃপা করে বললেন, তাহলে বাহাত্তর নম্বরকে ঘাঁটি ধরে সকাল নটায় সূর্যের সঙ্গে অবটিউস অ্যাঙ্গল-এ নীলমণির বাজারটাই হবে। সেইখানেই পরের রবিবার সকালে ন-টায় কারও অপেক্ষা করার কথা।

ঘনাদা কি গুল মারতে মারতে নিজের মাথায় সত্যিই গোল বাধিয়ে বসলেন! সূর্যের সঙ্গে অবটিউস অ্যাঙ্গল। এ সব কী প্রলাপ?

ওই নকশার মধ্যে এত কাণ্ড? আমরা একটু কড়া হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম, এ নকশার হদিস তো বলিভিয়ায় আপনার সেই ফেলে দিয়ে আসা চিরকুট থেকেই আপনার আহারা পেয়েছে। কিন্তু আপনি পেলেন কোথায়? সেই মৌচাক থেকে! তা থেকে মধু খেতে গিয়ে নকশা করলেন কী আর তা থেকে পালাবার পথের হদিস বা পেলেন কী করে?

নকশা করলাম–নাচ! ঘনাদা আমাদের দিকে অনুকম্পাভরে চাইলেন।

নাচ?

হ্যাঁ, নাচ, মৌমাছিদের! ঘনাদা ধৈর্য ধরে ব্যাখ্যা করলেন, মৌমাছিরা রোঁদে। বেরিয়ে কোথাও মধুর সন্ধান পেলে চাকের আর সবাইকে তা জানায় নানা ধরনের নাচ দিয়ে। এক এক নাচের নকশায় এক এক রকম ইঙ্গিত। যেমন কাছাকাছি চারিদিকেই মধুভরা ফুল থাকলে এই নাচ।

নাচ - ৩

আর অন্তত একশো গজের চেয়ে বেশি দূর-দূরান্তরের ফুলের হদিস দিতে তারা যে নাচ নাচে, তখনকার আকাশে সূর্যের অবস্থানের সঙ্গে তাদের নাচের নকশায় মাঝের রেখা আর গতির অ্যাঙ্গল অর্থাৎ কোণ মেপে তা বুঝতে হয়। যেমন এই নাচের বেলা মাঝখানের ফুটকি দেওয়া রেখাটাকে সূর্যের বলে ধরে নিয়ে জোড়া ডিমের মতো নকশার তির মার্কা লাইনটার সঙ্গে তার অ্যাঙ্গলটা দিয়ে ফুলের মাঠের হদিস মেলে। ওই নকশা অনুসারে ফুলের খেত হবে মৌচাক থেকে এই দিকে মৌমাছিরা যত ধীরে ধীরে নাচবে ফুলের মাঠ তত দূর বলে বুঝতে হবে।

নাচ - ৪

যেখানে আমায় বন্দী করেছিল তার চারিদিকেই প্রায় অপার জলা। কিন্তু মৌমাছিদের নাচ থেকেই আমি বুঝেছিলাম এক দিকে কোথাও শক্ত ডাঙা আছে। নাচ থেকে কোন দিকে তা খুঁজতে হবে তারও হদিস পেয়েছিলাম।

ঘনাদা আমাদের হতভম্ব মুখগুলোর দিকে করুণাভরে চেয়ে সিগারেটের টিনটা নিয়ে উঠে গেলেন এবার। যেতে যেতে আসল কথাটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে যেতে ভুললেন না, আমার ঘড়িটার কথা ভুলো না শিশির।

হাতঘড়ি কি দেওয়াল ঘড়ি নয়—নিজের মর্যাদার উপযুক্ত একটি ট্যাকঘড়ির শখ হয়েছে ঘনাদার। আমাদের সেটি খুঁজে এনে দিতে হবে।

ঘনাদার সঙ্গে আমাদের বর্তমান সুদীর্ঘ সন্ধির এই হল রহস্য।

 

হ্যাঁ, পরের রবিবার সকাল নটায় নীলমণির বাজারে গিয়ে আহারা নয়, রাহাকে পেয়েছিলাম।

সে যেমন, আমরাও তেমনই তাজ্জব!

আহারা-ই তাকে পাঠিয়েছে কি না, প্রায় জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলাম।