০৪. গিরিবালা, ও গিরিবালা

গিরিবালা, ও গিরিবালা–ঘুমন্ত রেখার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে আবদুল খালেক ডাকে, তোমার এতো রাগ কেন গিরিবালা?

একটা হাত ঠেলে দেয় রেখা। বোঝা গেল, সে এততক্ষণ ঘুমায়নি; চোখ বন্ধ করে পড়ে ছিল।

।আমাকে শুতে দেবে না বুঝি–

রেখা একপাশে সরে গিয়ে জায়গা করে দেয়। বললে, না এলেই হতো! হারিকেনের সবটুকু তেল শেষ করে তবে শান্তি হয়েছে তোমার–

আবদুল খালেক শুয়ে বললে, তুমি শুধু রাগ করো, আগের মতো আর আমাকে ভালোবাসে না

ইস্‌ মাঝরাতে ওনার একেবারে উপচে উঠছে। কি লাভ ওইসব ছাইভস্ম করে, তোমার এক একটা পাগলামি দেখলে গা রি রি করে জ্বলে আমার!

কি করবো, করতে হচ্ছে—

করতে হচ্ছে মানে?

আরে মালেক, মালেক, ওই হারামজাদাই তো আমাকে ফাঁসিয়েছে। ডায়েরি করে পাগল করে তুলেছে কিছুকাল যাবৎ। লেখক মানুষ, বুঝলে না, সবকিছুই ও কাজে লাগায়—

রেখা বিরক্ত হয়ে বললে, এতে তোমার কি লাভ?

বন্ধুর কাজে লাগলাম, নিজেরও কিছুটা সময় কাটলো—

রেখা বললে, সময় কাটানোটা তোমার জন্যে এখন একটা মস্ত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, বুঝতে পারছি–

আবদুল খালেক বললে, কেন যে তুমি সবকিছু বুঝতে যাও—

রেখা বললে, আমি খুব খারাপ!

তা বলি নি–আবদুল খালেক রেখাকে জড়িয়ে ধরে বললে, তোমার কাজ শুধু আমাকে ভালোবাসা, জীবনভর ভালোবেসে বেসে একদম পচিয়ে দেয়া–

দিন দিন তুমি ছোকরা হচ্ছো!

ছোকরা তো আছিই, একটা মাত্র ছেলে, নবছরের বিবাহিত জীবন, টুকটুকে বৌ, বুড়োটা হলাম কিভাবে?

রেখা পাশ ফিরে শুয়ে বললে, দয়া করে এখন আমাকে ঘুমোতে দাও। তোমার ইচ্ছে না হয় বসে বসে যা ইচ্ছে তাই করো গে—

আবদুল খালেক বললে, তোমার ভাবগতিক ভালো ঠেকছে না হে। হপ্তাটা মাঠে মারা যাবে নাকি?

চুপ করে শুয়ে থাকো—

ধমকাচ্ছো কেন এমন?

বলছি তো আমারূ র্শীর ভালো নেই—

শরীর, না মন?

কোন্ খবরটা রাখো তুমি! পরশু দুপুর থেকে যা খারাপ যাচ্ছে শরীর–

মাসের মাঝখানে হঠাৎ?

কি করে বলবো! কিভাবে যে কেটেছে সারাটা দিন!

আমাকে বললানি তো?

কি লাভ তোমাকে বলে? কোনো ব্যবস্থা করতে? কবে আমার ব্যাপার নিয়ে তুমি মাথা ঘামিয়েছিলে?

তবু বলা উচিত ছিল তোমার—

কেন আগেও তো এমন হয়েছে, নতুন কিছু তো আর নয়, আমার ব্যাপার নিয়ে খামোখা তোমার মাথা ঘামানোর দরকার নেই—

কিছু একটা ভাবল আবদুল খালেক। একটা সিগ্রেট ধরালো। বললে, আমি কি বলি জানো, তোমার ঐ ট্যাবলেট-ফ্যাবলেট এবার বাদ দাও। আর কতো, অনেক তো হলো—

তোমার কি, তুমি তো বলেই খালাস। তারপর কিছু একটা হয়ে গেলে?

হোক না, মন্দ কি! ছেলেপিলেয় ঘর ভরে যাক। বাগান হয়ে যাক। আমরা তো সব মিলে সাত ভাইবোন ছিলাম, মরে হেজে শেষ পর্যন্ত ঠেকেছিল চারে—

ঝক্কি সামলাতে পারবে? খাওয়াতে পারবে?

এইসব মন খারাপ করা কথা কেন তোলো রেখা?

মন খারাপ হয় কেন, নিজের গাঁটের ওজন বুঝবে না! ছেলে বলতে একটা, তা-ও কিভাবে মানুষ হচ্ছে। মানুষ হবে না ছাই। শহরে থাকলে একটা ভালো ইস্কুলে যেতো, সবকিছু শিখতো। এখানো ধুলোকাদা মাখছে, সারাদিন ইচ্ছেমতো গড়াগড়ি খাচ্ছে, চাষাভুষাদের ছেলেমেয়েদের কাছে শিখবেটা কি!

আবদুল খালেক বললে, এইতালো, কাদামাটি চিনুক, ধুলোবালি চিনুক।।

হ্যাঁ, তাতে তোমার মুখ উজ্বল হবে—

হঠাৎ কি মনে করে আবদুল খালেক বললে, রানিবুবুর চিঠির উত্তর দিয়েছিলে?

না!

সে কি কথা, তুমি না বললে তুমি জবাব দেবে।

তুমিও তো পারতে।

আমি পারলে আর তোমাকে বলতাম না, কখনো চিঠির উত্তর আমি দিতে পেরেছি? হচ্ছে—হবে, দিচ্ছি-দেববা করে শেষ পর্যন্ত কোনোদিন আমার উত্তর লেখা হয়ে ওঠে না। তোমার কিন্তু উচিত ছিল। রানিবুবুর অমন জ্বলজ্যান্ত ছেলেটা মারা গেল, যাওয়া তো হলোই না, এমনকি চিঠির উত্তরও না, খুব খারাপ হলো ব্যাপারটা।

রেখা বললে, তুমি তো দেখছি সবই বোঝ, উচিত-অনুচিত জ্ঞান তোমার টনটনে, লেখ না কেন, ধরে রেখেছে কেউ তোমাকে?

আবদুল খালেক বললে, জীবন কি রকম বদলে যায়, কি আশ্চর্য দ্যাখো। রেখা কিভাবে সবকিছু বদলে যায়।

একসময় এক বিছানায় গলা জড়াজড়ি করে শুয়েছি, এক পাতে খেয়েছি, চোখের আড়াল হইনি কেউ কারো, অথচ আজ রূপকথা, আদ্যিকালের গপ্পো। টিপু ভাইজানকেও কতোদিন দেখিনি, পাঁচ বছর হলো। এখন আর মনেই পড়ে না।

তোমার পেয়ারের ভাবী তো খবর নিতে পারে, তিনি না হয় ব্যস্ত মানুষ, ডাক্তারিতে ডুবে থাকেন। একসময় তো খুব মাখামাখি ছিল তোমার সঙ্গে।

কেন যে তুমি ওভাবে কথা বলো— আবদুল খালেক দুঃখিত হয়ে বললে, গুরুজনদের ব্যাপারে অশ্রদ্ধা, থাকতে নেই, এতে নিজের ওজনই হাল্কা হয়। এরাই বোধহয় সবচেয়ে দুঃখী–

রেখা আর কোনো কথা না বলায় অস্বস্তি বোধ করে আবদুল খালেক। সে বললে, আগে তো লিখতোই। কটা উত্তর আমরা লিখেছি। আরবের মতো একটা রুভূমিতে পড়ে আছে, ওদেরও তো কতো সমস্যা থাকতে পারে, কতোটুকুই বা আমরা জানি, কিই-বা আমরা জানি—

রেখা বললে, প্রথম প্রথম তো খুব বড়মানুষি দেখাতে পেরেছিল। কেউ এলেই এটা সেটা পাঠাতে, এখন চিঠি লিখেও পোছে না।

এক এক সময় এইরকম থাকে। মনে হয় কাউকে ছাড়া কারো চলবে না, সব সম্পর্কই দামী, সবকিছু রক্ষে করে চলতে হবে। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় যে যার সংসারের ভেতর নাকঅব্দি ডুবে গেছে, চোখ ফিরিয়ে তাকাবার উপায়ও তার নেই। এই নিজেদের দিকেই দ্যাখো না, ইচ্ছে থাকলেও কোন্ কাজটা আমরা করতে পারছি

রেখা বললে, বড়দের একটা আলাদা কর্তব্য থাকে। টিপু ভাইজানের কি উচিত ছিল না আমাদের খোঁজখবর রাখার? তোমাদের প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের ছোট ছেলে তো সৌদি আরবে গেল সেদিন, মাত্র বছরখানেক। কি না পাঠিয়েছে এর মধ্যে। টিভি থেকে শুরু করে থ্রি-ইন-ওয়ান, ঘড়ি কি না। ওনার তো আর কোনো অভাব ছিল না, তবুও তো পাঠিয়েছে। আসলে মন থাকা দরকার। তুমি কি মনে কর তোমাকে কেউ খুব গ্রাহ্যের মধ্যে একটা আনে?

আবদুল খালেক হেসে বললে, তোমার ইস্কুল আলাদা, এই আর কি?

রেখা বললে, তা গিরিবালা মাগীটা কে শুনি, হঠাৎ তার কথা মনে পড়লো কেন?

আবদুল খালেক বাইরের দিকে হাত বাড়ালো। বললে, বাইরে আকাশ বলে একটা কিছু আছে, তা জান তো! সেখানে একটা চাঁদ আছে, গোল চাঁদ। ঐ চাঁদের ভেতর হাঁটুমুড়ে কতোকাল ধরে বসে আছে। চরকায় সুতো কাটছে বসে বসে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *