০১. বুড়ো আঙুল চোষা

তখন আমার অভ্যেস ছিল বুড়ো আঙুল চোষার। কখনো পুকুরঘাটে, কখনো বারান্দার সিঁড়িতে, কখনো-বা জানালায় একা একা বসে কেবল আঙুল চুষতাম। আঙুলের নোনতা স্বাদ যে খুব ভালো লাগতো, ঠিক সে রকম কোনো ব্যাপার নয়। তখন ভালোলাগা বা মন্দলাগা এসবের কোনো ঝক্কি ছিল না, যতোটুকু মনে পড়ে; পৃথিবী যে গোল, একথা শুনে কানমাথা রীতিমতো ঝাঁ ঝাঁ করতো। সে একটা গোলমেলে বিষম ব্যাপার। ভাবতা আমরা তাহলে কোথায় আছি, কমলালেবুর তলার দিকে না ওপরের দিকে; তলার দিকের মানুষজনের তো টুপটাপ ঝরে পড়ার কথা।

একবার সাধুখাঁদের ছেলে পাঁচু কাচের চুড়ির একটা শেকল আমাকে উপহার দেয়, শেকলটি তার বোন ঝুমির। ঝুমির পুতুলের বাক্স থেকে সে ঐ জিনিসটি হাতিয়েছিল। শেকলটি আমি লুকিয়ে রাখতাম। আমার ধারণা ছিল অমন সুন্দর জিনিস খুব বেশি একটা নেই কারো কাছে।

ঝুমি প্রায়ই আমাদের বাগানে ঘোরাফেরা করতো। সামনাসামনি পড়ে গেলে মুখ নিচু করে পালাতে চাইতাম, চোখ তুলে কথা বলতে পারতাম না, ভয়ে বুকের ভেতর গুবগুব করতো। ঝুমি যেদিন জিগ্যেস করলে এ্যাই, পাঁচু তোকে কিছু দিয়েছে–সেদিন ভয়ে আমি কাঠ হয়ে গিয়েছিলাম। পরে বুঝেছিলাম ওটা ছিল নিছক কথার কথা, ঝুমি আমার কথা জানতো না।

সে যাক, রঙিন ভাঙা চুড়ির শেকল যে খুব সস্তাদরের, একথা আমি জেনেছিলাম আরো অনেক পরে।

এই ধরনের একটা বয়েস।

এটা ঠিক যে, আমার এই আঙুল চোষার ব্যাপারটা বাড়ির কারোই তেমন পছন্দের ছিল না, মার কাছে তো নয়ই। অনেক খোঁচা খেয়েছি এর জন্য। এই হাবলুটাকে নিয়ে হয়েছে আমার যতো ঝক্কি এই বলে আমার গাল থেকে আঙুল বের করে দিত মা। আমি তো জানিই, নচ্ছরটা আমাকে জ্বালাবে— রেগে গেলে মা বলতো, পেটে থাকতেও দিনরাত হেঁড়েমাথাটা কি কম জ্বালান জ্বালিয়েছে আমাকে।

দুটোর কোনোটাই বোধহয় মিথ্যে নয়। খুব সম্ভব আমি কমবেশি হাবাগোছেরই ছিলাম। ঠোঙার একটা নকুলদানা পড়ে গেলেও ধুলেমাটি থেকে তা কুড়িয়ে গালে পুরতাম। পুঁটি নামের যে আলতাপায়ে মেয়েটি রোজ আমাদের পুকুরঘাটে গুচ্ছের পেতল কাঁসার থালাবাসন নিয়ে বসতো, সেও আমার কাছে ছিল এক বিস্ময়ের বস্তু।

অনেকক্ষণ ধরে বসে সে পিতলের থালা বাসনে নুড়ো ডলতো আর পিনপি করে গান গাইতো, পকেটে চেন ঝুলিয়ে চোদ্দসিকের বাবুয়ানা–তার সে মাজাঘসা আর শেষই হয় । এর মধ্যে দুচারবার ডাক তো আসবেই, পুঁটি, অপুঁটি মরলো নাকি ছুঁড়ি!

যতোবারই ডাক আসবে তার সেই একই জবাব, যাইমা–

ধেড়ে মাছ ছিল একটা পুকুরে, রুই কি কাতলা, বয়েসের কোনো গাছপাথর ছিল না মাছটার; কি করে যেন সে ঠিকই টের পেত পুঁটি ঘাটে এসেছে। পুকুরের ঠিক মাঝখানে দুচারটে ঘাই মেরে, তারপর একডুবে সে সরাসরি ঘাটের কাছে হুপুস করে ভেসে উঠতো। পুঁটি হয়তো তখন ঝিনুক দিয়ে চেঁচে চেঁচে দুধের হাঁড়ির পোড়া সর খাচ্ছে। রাখ, তোর হ্যাংলামি আমি একদিন বার করবো, কি ছোঁচারে বাবা–মাছের সঙ্গে এইভাবে কথা শুরু করে দিত পুঁটি, এতো নোলা কেন? রোজ জ্বালাতন! রোজ জ্বালাতন!

বলতাম, তোমার কথা বোঝে?

ওমা, বুঝবে না কেন। পুঁটি পড়তো আকাশ থেকে। বলতো, আমিও তো ওর কথা বুঝি। ঐ যে বুড়বুড়ি তোলে, ঐসবই তো ওর কথা। কি বলে জানিস? বলে, ও পুঁটি, তুমি কি ভালো মেয়ে, তোমার মুটুকপরা রাজপুতুরের মতো টুকটুকে বর হবে, তুমি সোনার পালঙ্কে শুয়ে ঘুমুবে, হাজারগও দাসী-বাঁদী তোমার পা টিপবে, এখন তুমি আমাকে একটু সরের চাছি খেতে দাও

সত্যি তুমি সব কথা বোঝ?

সত্যি না তো কি মিথ্যে! রোজ রোজ কতো আশীৰ্বাদ করে আমাকে! আর করবে নাই বা কেন, সর খেতে কার না ভালো লাগে!

পুঁটির যে গাছ-গাছড়ার সঙ্গে কথা হয়, এও আমার নিজ চোখে দেখা। আকন্দগাছের গোড়ায় ঘটি উপুড় করে দিয়ে সে বলতো গাছভাই গাছভাই, এই দ্যাখো আমি তোমার গোড়ায় একঘটি জল দিলাম, আমার যেন খুব ভালো বর হয়, নইলে কিন্তু খুব খারাপ হবে, একটা ডালপালাও তোমার আস্ত থাকবে না–

শিমুলগাছ ছিল একটা, চুপি চুপি তার গোড়াতেও ঘটি উপুড় করা বাঁধাধরা কাজ ছিল। বলবে, কি থেকে কি আসে কি থেকে কি হয় তুই তার কি জানিস! সেই যে কাঁঠালে না দেগঙ্গায় শিমুল গাছের গোড়ায় একঘড়া সোনার মোহর পেয়েছিল এক মুচি, সে-কি আর এমনি এমনিই, গাছটাকে ভক্তি করতো বলেই তো পেয়েছিল। কম গয়নাগাটি লাগবে বিয়েতে। মাঝে মাঝে তো স্বপ্ন দেখিই, গাছটার গোড়ায় মাটির নিচে এই ইয়া বড় একটা লোহার সিন্দুক, একটা আলসে ময়াল সেটার ভেতরে শুয়ে শুয়ে পাহারা দিচ্ছে—

একদিন বললাম, পুঁটি সর খাওয়াবে—

পুঁটি মুখ কালো করে বললে, বলিহারি নোলা বাপু! খুব করে নজর দিস বুঝি রোজ। নোলাটাকে একটু কষতে পারিস না, কি হাঘরে! তাই তো ভাবি রোজ রোজ শুধু শুধু এমন পেট ব্যথা করে কেন!

পরে অবশ্য একটু নরোম হয়েছিল পুঁটি।

ঠিক আছে, তোকে একদিন পোড়া সর খাওয়াব, কিন্তু তার বদলে কি দিবি আমাকে?

কি আর দেবো, তুমি-ই বলো—

তোদের না, একটা পেতলের পটলচেরা কাজললতা আছে, দিতে পারবি আমাকে?

পারবো–

কাউকে বলতে পারবি না কিন্তু, আমার ছেলে হলে ধ্যাবড়া করে কপালে টিপ দিয়ে দিতে হবে না কাজলের, নৈলেপরে নজর লাগবে। কি আর এমন দাম ওটার! যদি পারিস, মাছের সঙ্গেও তোর বন্ধুত্ব পাতিয়ে দেবো।

পেতলের কাজললতার বদলে হাঁচিচাঁচা পোড়া সর দুএকবার ভাগ্যে জুটলেও মাছের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব জমে নি। ও যে কি বলতো, কিংবা সত্যি সত্যিই কিছু বলতো কি না আমি তার বিন্দুবিসর্গও কোনোদিন বুঝে উঠতে পারি নি।

তার মানে, হাবা তো হাবা, বেশ ভালো রকমেরই হাবাগোবা ছিলাম। হাবা আর হেড়েমাথার। আমার মাথাটা একটু বেটপ ধরনের বড়ই ছিল। আমার বড় বোন রানিবুবু আমার মাথায় টু মেরে যখন বলতো কাল সকালেই দেখবি তোর মাথায় দুটো শিং গজিয়েছে—তখন আমার হাত-পা আড়ষ্ট হয়ে যেতো ভয়ে, আমি হাউমাউ করে কান্নাকাটি জুড়ে দিতাম।

পায়ে কাঁটা ফুটেছিল, পুঁটি শুনে বললে, বের করতে পেরেছিলি তো সবটুকুন?

বললাম, মনে হলো তো সবটাই—।

না বেরুলে দেখিস কি হয়! দাঁত দিয়ে কিছুক্ষণ নিজের জিভ চুলকে নিয়ে পুঁটি বললে, শেষ পর্যন্ত চোখের মণি ফুটো করে নিজে নিজেই বেরুবে, তখন দেখবি ভোগান্তিটা কেমন—

ভয়ে হাত-পা পড়ে যাবার জোগাড়।

পুঁটি তখন ভরসা দিয়ে বললে, ভয়ের কিছু নেই, কাঁটা তাড়ানোরও মন্ত্র আছে, আগে বল কি দিবি?

ওষুধ মাড়ার একটা খল ছিল ঘরে, শ্বেত পাথরের ছোট্ট নৌকোর মতো; চুপি চুপি সেটাই খুঁজে দিই পুঁটির হাতে। সে তো মহাখুশি। সে যাত্রা কাটার হাত থেকে চোখটাকে এইভাবেই রক্ষা করা গেল।

বারান্দার চকচকে সিড়িতে বসে আঙুল চুষতে চুষতে রাস্তা দেখতাম। অনেক কিছুই আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল দেখতে দেখতে। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সব গাছ, কিছু কিছু ঘরবাড়ি, অল্পবিস্তর মানুষজন। যেমন ডালপুরিবুড়ো। ছোট্ট চুপড়িতে কচি কলাপাতার বিছানায় ডালপুরি সাজিয়ে দুপুরের পরপরই ডালপুর-হি ডালপুরহি হাঁক ছেড়ে চওড়া রাস্তার ধার ঘেঁষে সে হেঁটে যেতো। বুড়োটার পা জোড়া ছিল দেখবার মতো; ঠিক একজোড়া ধনুক, মনে হতো এক্ষণি মচকে পড়ে যাবে মানুষটা। মাথায় লাল টুকটুকে একটা গামছা রাখতো সে বিড়ে পাকিয়ে। শুনতাম লোকটা জাতে পোদ, কোনো এক সময় সে নাকি রণপায় চেপে ডাকাতি করে বেড়িয়েছে।

মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল, শনপাড়িওলার চেহারাও। দুই পাল্লার টিনের বাক্স গলায় ঝুলিয়ে ঠিক ভরদুপুরে সে হাঁক দিত। চোখে ধরার মতো ছিল তার সাজগোজের বহর। হাঁটু পর্যন্ত লম্বা কালো সিল্কের জামা, কোমরে আর গলায় রুপপার জরির নকশা খেলানো। একটা কানে আবার মাকড়ি। অমন বাবরি চুলও বড় একটা চোখে পড়তো না। শণপাপড়ি আর মিহিদানা একসঙ্গেই বিক্রি হতো।

ছিল কুলপিমালাইওলা, চিনেবাদামওলা, লাল মিঠাইওলা। বাঁশের সাজিতে ধামা কুলো পাখা এইসব মিঠাই সাজানো থাকতো। একহাতে সেই সাজি, আরেক হাতে একটা আমের ডাল, পাতার ফাঁকে ফাঁকে লাল লাল আম আর লিচুর লুকোচুরি, এই হলো লাল মিঠাইওলা।

চিনেবাদামওলার ঝকাও ছিল দেখবার মতো। গাঁদা না হয় জবা, একটা না একটা ফুল দিয়ে সেটা সাজানো থাকবেই, যেন লগনের ঝুড়ি, বাবুয়ানা করে বরবাড়ি থেকে আসছে।

কাছাকাছি কোথাও ছিল গোরা সৈন্যদের ছাউনি। মাঝে মাঝে হুসহাস করে উড়ে যেতো ইয়া ইয়া নাকভোতা ট্রাক, চালাতো নিগ্রোরা।

রাস্তার দিকে পা বাড়ালেই কানমলা খেতে হতো; সুযোগমতো ছোট ছেলেমেয়ে সামনে পেলেই নিগ্রোরা নাক কঁাচম্যাচ করে তাদের চিবিয়ে ফেলে, এইসব শুনতাম। তারা যেসব গাড়ি চালাতে লোকে সেগুলোর নাম দিয়েছিল হুদমো গাড়ি।

আমাদের বাড়ির একপাশে ছিল একটা বুড়ো ঝাউগাছ। গাছটার সারা গায়ে ঠেলে উঠেছিল ডুমো ডুমো কালো গাট। গাটের নিচে ফোকর। ফোকরে জমে থাকতো সুজির মতো কাঠের গুড়ো।

গাছটার মগডালে মাঝে মাঝে শকুন এসে বসতো। একবার কি হলো, হঠাৎ রাস্তার একপাশে জিপগাড়ি থামিয়ে দুমদাম ফায়ার শুরু করলে দুজন গোরা সৈন্য। ফটাফট জ্বালা-দরজা সব বন্ধ হয়ে গেল আমাদের ঘরের, লালমুখো লালমুখো—আমরা তো ভয়ে আধমরা।

পরে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখা গেল, লালমুখোরা উধাও, কেবল রাস্তার একপাশে রজনী ভেণ্ডারের  ছেলে পানু তুমুল হাত-পা নেড়ে চাকবাঁধা মানুষজনদের কিছু একটা বোঝাচ্ছে। বেশ বড় রকমের একটা ভিড়, আমাদের উঁচু বারান্দা থেকে পানুকে প্রায় দেখাই যায় না।

পানু একা সাহস করে সাহেবদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বুঝিয়েছিল, ভালচার ভালচার–

সাহেবদের সঙ্গে কঠিন ইংরেজি বলনেওলা লোক দেখা সেই প্রথম আমার। দুম করে হিরো হয়ে গেল পানু।

গুলি খেয়ে একটা শকুন মাটিতে পড়ে গিয়েছিল, এক খাবলা মাংস উড়ে গিয়েছিল বুকের এক পাশের। এমন জখমের পরও সপ্তাহখানেক বেঁচে ছিল; আমরা কাছাকাছি গেলেই সে ঝটপট করে কোনো রকমে কয়েক হাত দূরে ঝাপিয়ে পড়তো, শুকনো পাতার ডাঁই করে নিজেকে আড়ালে রাখতো। খুব কষ্ট পেয়ে মরেছিল শকুনটা। শেষের দিকে এমনভাবে গলা করে কাঁদতো, মনে হতো মানুষ।

হাইলেচা হাইলেচা, হাইলে হাইলে হাইলেচা–এই ধরনের একটা বিচিত্র গান ফেঁদে বসতো পানু, ভোরবেলা সৈন্যরা যেসব গান গেয়ে গেয়ে দলবেঁধে রাস্তায় দৌড়াতো তারই কিছু একটা নিজের সুবিধেমতো ভেজে নিয়েছিল সে। আমাদের দেখলেই কঠিন কঠিন সব ইংরেজির তুবড়ি ছোটাতো সে, জিনজার মানে আদা, মিনজার মানে মাদা, গিনজার মানে গাঁজা। খুব অবাক হতাম পানুর বিদ্যাবুদ্ধির বহর দেখে। ভীষণ লজ্জা করতো, কতো কিছুই না জানে পানু, এমন ছোট মনে হতো নিজেকে!

ঝুমি একবার আমাকে একটা ভাঙা তেশিরা কাচ দিয়েছিল, সেটার মালিক ছিল পাঁচু। খবরদার, পাঁচু জানতে পারলে কিন্তু কেড়ে নেবে— ঝুমি চুপি চুপি বলেছিল, আমার নাম করবি না কিন্তু কারো কাছে!

কাচটা ছিল অদ্ভুত। সেটার ভেতর দিয়ে দেখলে রাস্তাঘাট গাছপালা সব থাককাটা রঙধনুর মতো মনে হতো।

ছিল এইসব, এই নিয়ে খেলা।

পুকুরের সেই শানঘাট, কতো সময় যে কেটেছে সেখানে। হাড়িডোমেরা কেঁচড় ভেঙে গুচ্ছের ব্যাঙের ছাত-ঘাটের ওপর ঢেলে রেখে পানিতে নামতে, শানঘাটের গায়ে চরে বেড়ানো গুগলি শামুক তুলে তুলে ভরে ফেলতো কৌটো; গালে বুড়ো আঙুল পুরে কেবল এইসব দেখা, এই ছিল আমার কাজ। তারপর ঘাট ফাঁকা হয়ে গেলে গাল থেকে আঙুল বের করে বলতাম, মাছভাই, মাছভাই, আমি যেন খুব শিগগির লাল মিঠাইওলা হতে পারি। মাছভাই মাছভাই আমি যেন পানুদার মতো মিনজার মানে মাদা, গিনজার মানে গাজা প্লান্ডু মানে পেঁয়াজ, এইসব পটাপট বলতে পারি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *