ঋগ্বেদ ১০।০৯৫

ঋগ্বেদ ১০।০৯৫
ঋগ্বেদ সংহিতা ।। ১০ম মণ্ডল সূক্ত ৯৫
পুরুরবা ও উর্বশী ঋষি। তাঁহারাই দেবতা(১)।

১। (পুরুরবার উক্তি) -হে পত্নি! তোমার চিত্ত কি নিষ্ঠুর! অতি শীঘ্র চলিয়া যাইও না, আমাদিগের উভয়ের কিঞ্চিৎ কথোপকথন আবশ্যক হইতেছে। এক্ষণে মনের কথা যদি উভয়ে প্রকাশ করিয়া না বলা হয়, ভবিষ্যতে সুখের বিষয় হইবেক না।

২। (উর্বশীর উক্তি) -তোমার সহিত বাক্যালাপ করিয়া আমার কি হইবে? আমি প্রথম উষার ন্যায় (২) চলিয়া আসিয়াছি। হে পুরুরবা, আপন গৃহে ফিরিয়া যাও। বায়ুকে যেমন ধারণ করা যায় না, তুমিও তেমনি আমাকে ধারণ করিতে পারিবে না।

৩। (পুরুরবার উক্তি) -তোমার বিরহে আমার তূণীর হইতে বাণ নির্গত হয় নাই, জয় লাভ হয় নাই। আমি যুদ্ধে গমনপূর্বক শতসহস্র গাভী আনয়ন করিতে পারি নাই। রাজকাৰ্য্য বীরশূন্য হইয়াছে, ইহার কোন শোভা নাই; আমার সৈন্যগণ সিংহনাদ করিবার চিন্তা এককালে ত্যাগ করিয়াছে।

৪। (উর্বশীর উক্তি)- হে উষাদেবি! সেই উৰ্বশী শ্বশুরকে ভোজনের সামগ্রী দিতে যদি ইচ্ছা করিতেন, তাহা হইলে সন্নিহিত গৃহ হইতে শয়ন গৃহে যাইতেন, তথায় দিবারাত্রি স্বামির নিকট রম সুখ সম্ভোগ করিতেন।

৫। হে পুরুরবা! তুমি প্রতিদিন তিনবার আমাকে রমণ করিতে। কোনও সপত্নীর সহিত আমার প্রতিদ্বন্দিতা ছিল না, আমাকেই নিয়ত সন্তুষ্ট করিতে। তোমার গৃহে আমি আগমন করিলাম, তুমি আমার রাজা, তুমি আমার অশেষ সুখের বিধাতা হইলে।

৬। (পুরুরবার উক্তি)-সুজূর্ণি, শ্রেণি, সুপ্ন, আপি, হ্রদে চক্ষু, গ্রন্থিনী, চরণ্যু, আমার এই যে কয় মহিলা ছিল, তুমি আসিবার পর তাহারা আর আমার নিকট বেশভূষা করিয়া আসিত না। গাভীগণ গৃহে যাইবার সময় যেমন শব্দ করে, তাহারা আর সেরূপ শব্দ করিয়া আমার গৃহে আসিত না।

৭। (উর্বশীর উক্তি)-পুরুরবা যখন জন্মগ্রহণ করিলেন, দেব মহিলারা দেখিতে আসিল, নিজ ক্ষমতায় যাহারা গমন করে, সেই নদী পর্যন্ত সংবর্ধনা করিল। হে পুরুরবা! দেবতারা দস্যু বধ উপলক্ষে তোমাকে তুমুল যুদ্ধে পাঠাইবার জন্য সংবর্ধনা করিতে লাগিলেন (৩)।

৮। (পুরুরবার উক্তি) –পুরুরবা নিজে মনুষ্য হইয়া যখন অপ্সরাদিগের দিকে অগ্রসর হইলেন, তখন তাহারা আপন রূপ ত্যাগ করিয়া অন্তর্হিত হইল। যেমন হরিণী ভয় পাইয়া পলায়ন করে, অথবা রথেযোজিত ঘোটেকেরা যেমন ধাবমান হয়, তদ্রুপ তাহারা চলিয়া গেল।

৯। (উর্বশীর উক্তি)-পুরুরবা নিজে মনুষ্য হইয়া দেবলোকবাসিনী অপ্সরাদিগের সঙ্গে যখন কথা কহিতে এবং তাহাদিগের শরীর স্পর্শ করিতে অগ্রসর হইলেন, তখন তাহারা অদৃষ্ট হইল, নিজ শরীর দেখাইল না, ক্রীড়াসক্ত ঘোটকদিগের ন্যায় পলায়ন করিল।

১০। (পুরুরবার উক্তি)- যে উৰ্বশী আকাশ হইতে পতনশীল বিদ্যুতের ন্যায় ঔজ্জ্বল্য ধারণ করিয়াছিল এবং আমার সকল মনোরথ পূর্ণ করিয়াছিল, তাহার গর্ভে মনুষ্যের ঔরসে সুশ্রী পুত্র জন্ম গ্রহণ করিল। উৰ্বশী তাহাকে দীর্ঘায়ু করুন।

১১। (উৰ্বশীর উক্তি) -হে পুরুরবা! তুমি পৃথিবীর পালনের জন্য পুত্রের জন্মদান করিলে, আমার গর্ভে নিজ বীৰ্য পাতিত করিলে। সর্বদা আমি তোমাকে কহিয়াছি যে, কি হইলে আমি তোমার নিকট থাকিব না, কারণ আমি তাহা জানিতাম। তুমি তাহা শুনিলে না; এক্ষণে পৃথিবী পালন কার্য পরিত্যাগ করিয়া কেন বৃথা বাক্যব্যয় করিতেছ।

১২। (পুরুরবার উক্তি) -তোমার পুত্র কবেই বা আমার প্রতি প্রীতি প্রদর্শন করিবে। আর যদি আমার নিকটে আসে, তাহা হইলে সে কি রোদন করিবে না? অশ্রুপাত করিবে না? পরস্পর প্রীতিযুক্ত স্ত্রী পুরুষের বিচ্ছেদ ঘটাইতে কাহার ইচ্ছা হয়? তোমার শ্বশুরের গৃহে যেন অগ্নি প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল, অর্থাৎ তোমার বিরহ সন্তাপ অসহ্য।

১৩। (উর্বশীর উক্তি) -আমি তোমার কথার উত্তরে কহিতেছি; পুত্র তোমার নিকট যাইয়া অশ্রুপাত, বা ক্রন্দন করিবে না। আমি উহার মঙ্গল চিন্তা করিব। আমার গর্ভে যে পুত্র উৎপাদন করিয়াছ, তাহাকেতোমার নিকট প্রেরণ করিব। হে নির্বোধ! গৃহে ফিরিয়া যাও। আমাকে আর পাইবে না।

১৪। (পুরুরবার উক্তি)—তবে তোমার প্রণয়ী (আমি) অদ্য পতিত হউক, আর কখনও যেন উথিত না হয়। সে যেন বহু দূরে দূর হইয়া যাউক। সে যেন নিঃঋতির অঙ্কে শয়িত হউক, বলবান্ বৃকগণ তাহাকে ভক্ষণ করুক।

১৫। (উৰ্বশীর উক্তি)-হে পুরুরবা! এরূপে মৃত্যু কামনা করিও না; উচ্ছিন্ন যাইও না, দুর্দান্ত বৃকেরা তোমাকে যেন ভক্ষণ না করে। স্ত্রীলোকের প্রণয় স্থায়ী হয় না। স্ত্রীলোকের হৃদয় আর বৃকের হৃদয় দুই এক প্রকার।

১৬। আমি পরিবর্তিতরূপে ভ্রমণ করিয়াছি, মনুষ্যদিগের মধ্যে চারি বৎসর রাত্রিবাস করিয়াছি (৪), দিনের মধ্যে একবার কিঞ্চিৎমাত্ৰ ঘৃত পান করিয়া তাহাতেই ক্ষুধা নিবৃত্তিপূৰ্ব্বক ভ্রমণ করিয়াছি।

১৭। আমি বসিষ্ঠ অর্থাৎ সূর্য্য, অন্তরিক্ষ পূর্ণকারিণী আকাশপ্রিয়া উর্বশীকে আমি আলিঙ্গন করিতেছি। তোমার সুকৃতের সুফল যেন তোমার নিকট বর্তমান থাকে। হে উর্বশী! ফিরিয়া আইস, আমার হৃদয়দগ্ধ হইতেছে।

১৮। (উর্বশীর উক্তি)- হে ইলাপুত্ৰ পুরুরবা! এই সকল দেবতা তোমাকে বলিতেছেন যে, তুমি মৃত্যুজয়ী হইবে, স্বকীয় হোমদ্রব্যদ্বারা দেবতাদিগের পূজা করিবে, তুমি স্বর্গে যাইয়া আমোদ আহলাদ করিবে।

————

(১) এই সূক্তে উৰ্বশী ও পুরুরবার বৈদিক উপাখ্যান আখ্যাত হইয়াছে। পুরুরবা অপ্সরা উর্বশীর সহিত কিছুকাল বসবাস করিয়াছেন, উর্বশী এক্ষণে পুরুরবাকে ছাড়িয়া যাইতেছেন। আমরা পূর্বেই বলিয়াছি, উর্বশীর আদি অর্থ ঊষা, পুরুরবার আদি অর্থ সূর্য্য। সূৰ্য্য উদয় হইলে উযা আর থাকে না।

(২) উর্বশীর আদি অর্থ উষা, তাহা সেন এই উপমাদ্বারা কবির মনে অস্পষ্টরূপে উদ্রেক হইতেছে।

(৩) সূর্য্যরূপ ইন্দ্রই দস্যুরূপ অন্ধকারকে হনন করেন। পুরুরবার সূর্য্যের সহিত একতা এই ঋকদ্বারা কতক পরিমাণে সূচিত হইতেছে।

     “That Pururavas is an appropriate name of a solar hero requires hardly any proof. Pururavas mwant endued with much light; for though rava is generally used of sound, yet the root ru, which means originally to cry, is also applied to color in the sense of a loud or crying colour, i.e., red(Sanscrit Ravi, sun). Besides Pururavas calls himself Vasishtha (১৭ ঋক), which, as we know, is a name of the sun; and if he is called Aida (১৮ ঋক), the son of Aida, the same name is elsewhere (Rig Veda III, 29, 3) given to Agni, the fire.”—Max Muller’s Selected Essays (1881), vol. I, pp. 407, 408.

     “I therefore accept the common Indian explanation by which this name (Urvasi) is derived from Uru, wide and a root. As to pervade, and thus compare Uru-asi with another frequent epithet of the dawn, Uruki.”—Ibid, p. 405.

(৪) মূলে “অবসং রাত্রীঃ শরদঃ চতস্রঃ” আছে। মক্ষমূলর অনুবার করিয়াছেন।– “I dwelt with thee four nights of the autumn.”