০২. পাশাপাশি পিঁড়ে বিছিয়ে বসে দুটি ভাইবোন

পাশাপাশি পিঁড়ে বিছিয়ে বসে দুটি ভাইবোন—হাসু ও মায়মুন। জয়গুন পান্তা বেড়ে ছেলে ও মেয়ের সামনে দুটো থালা এগিয়ে দিয়ে নিজেও একটা নিয়ে বসে। মায়মুন আড়চোখে হাসুর থালার দিকে চায়। রোজ সে এমনি চেয়ে দেখে। রোজই হাসুকে বেশী করে খেতে দেয় মা। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস তার হয় না। জয়গুন বুঝতে পেরে নিজের পাতের একমুঠো ভাত দিয়ে বলে—বিছমিল্লা বুইল্যা মোখে দে। দেখবি এই দুগগায়ই প্যাট ভইরা যাইব।

—বিছমিল্লা।

হাসুও বলে—বিছমিল্লা।

প্যাচপেচে পান্তাভাত পোড়া মরিচ মেখে কালো করে নেয়। খেতে খেতে জয়গুন সারাদিনের কাজের ফরমাস করে যায় মায়মুনকে। ঘর ঝাট দেয়া, থালাবাসন মাজা, পানি আনা ইত্যাদি।

—ভাত আছে আর, মা? হাসু বলে।

ভাতের হাঁড়িটা হাসুর থালার ওপর উপুড় করে ঢেলে জয়গুন বলে—খাইয়া নে, পরাণ ঠাণ্ডা অইব।

শুধু পানিতে থালা ভরে যায়। মায়মুনের পাতে তার আবাটা ঢেলে দিয়ে লবণ দিয়ে। ঘেঁটে চুমুক দেয় হাসু।

খাওয়ার পরে জয়গুন পানের ডিবা নিয়ে বসে। পেট ভরে দুটি ভাত খেতে না পেলেও পানটা একটু মুখে দিলে তবু ভালো লাগে।

হাসু কোষার পানি সেচে ডাকে—মা, শিগগির। গাড়ী কইলাম আইয়া পড়ল বইল্যা।

জয়গুন বাশের চোঙা থেকে পঁচটা টাকা বের করে নেয়। এই টাকা কটিই তার মুলধন। ময়মনসিং থেকে সন্তায় চাল এনে সে গায়ে বিক্রি করে। এই করে টাকা প্রতি এক সের সোয়া সের মুনাফা হয় প্রতি খেপে। আচঁলে সব ক’টি টাকা বেঁধে চটের দুটো ঝুলি হাতে বেরিয়ে পড়ে সে তারপর।

 

দশ বছরের মেয়ে মায়মুন। কিন্তু সাত বছরের বেশী বলে মনে হয় না। হাঁটতে গেলে পাক খেয়ে পড়ে যাবে মনে হয়। একা একা কাজ করতে ভালো লাগে না ওর। কিন্তু কাজের কোনোটা বাকী রাখলে চুল এক গাছও মাথায় থাকবে না, সে জানে। শীর্ণ শরীরটাকে টেনেটুনে কোনো রকমে মাজা-ঘসা করে, বদনা ভরে ভরে সাত আটবারে পানির কলসীটা ভরে সে।

আজ হাঁস দুটো ছাড়তে গিয়ে খাঁচার নিচে ডিম দেখে মায়মুনের আনন্দ আর ধরে না। তাদের হাঁস ডিম দিয়েছে আজ নতুন। কি সাদা আর বড় বড়! দুহাতে দুটো ডিম নিয়ে সে নাচতে আরম্ভ করে। লাফাতে লাফাতে সে বাইরে আসে। দৌড়ে যায় শফির মা-র ঘরে। ডাকে—মামানি গো, অ-মামানি, দাহ কি সোন্দর আণ্ডা। আমাগ আঁসে পাড়ছে। উল্লাস যেন সে ধরে রাখতে পারে না।

—দেহি দেহি বলে মামী হাত পেতে ডিম দুটো নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। তারপর হেসে বলে—ভালো আণ্ডা অইত। পয়লা বারের অইলেও ডাঙর-ডোঙর অইছে! আষ্ট পয়সা কইর‍্যা বেচতে পারবি এক একটা।

—না গো মামানি, এই আণ্ডা বেচ্‌তাম না।

—খাবি?

—ওহোঁ। বাচ্চা ফুডাইমু।

—বেইশ, বেইশ! মামী উৎসাহ দিয়ে বলে।

ডিম দুটো তুষের হাঁড়ির মধ্যে রেখে মায়মুন বাড়ীর এদিক ওদিক খুঁজে গাছের শুকনো ডাল ভাঙে। আজ তার কাজ করতে খারাপ লাগে না। আর দিনের চেয়ে অনেক বেশী লাকড়ি যোগাড় করে ফেলল সে।

বিকেলবেলা মায়মুন বড়শী নিয়ে তেঁতুলতলা গিয়ে বসে। যাবার আগে আণ্ডা দুটো আর একবার দেখে যায় দুই চোখে। সন্ধ্যা পর্যন্ত ও বসে থাকে বড়শী নিয়ে। পিঠালী সব শেষ। হয়ে যায়। কিন্তু মাছ ওঠে মাত্র একটা টেংরা, তিনটে পুঁটি আর কয়েকটা ডানকানা। মাছগুলো যেন ওর চেয়েও চালাক হয়ে গেছে।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ঘরে সঁঝবাতি দেখিয়ে আবার নিবিয়ে দেয় মায়মুন। আবছা অন্ধকারে বসে মাছ কয়টা কুটে লবণ দিয়ে রাখে।

রাত ন’টা দশটা পর্যন্ত অন্ধকারে ওকে একা বসে থাকতে হয় প্রায়ই। মায়মুনের বড় ভূতের ভয়। কোনো কোনো দিন সে শফির মার ঘরে গিয়ে কেচ্ছা শোনে। তার পান ছেঁচে দেয়। কিন্তু আজ সে দুপুর বেলা বেরিয়ে গেছে, এখনো ফেরেনি। ভিক্ষে করে খায় সে। মাঝে মাঝে বাড়ীও আসে না। মায়মুন দোরের ঝাপ বন্ধ করে দিয়ে চুপ-চাপ পড়ে থাকে।

রাত গোটা নয়ের সময় হাসু আর হাসুর মা আসে। শব্দ পেয়ে মায়মুন মাথার ওপর থেকে কাঁথা সরিয়ে ভয়ে ভয়ে চোখ মেলে।

মায়মুন এবার লাফ দিয়ে ওঠে। খুশীতে আটখান হয়ে সে বলে—মা, মা, আমাগ আঁসে আণ্ডা পাড়ছে। বলতে বলতে সে বের করে আনে ডিম দুটো। হাসু খুশী হয়ে ওঠে। হাতে নিয়ে দেখে, কী সুন্দর সাদা আর বড়।

হাসু বলে—কাইল অই আণ্ডা বিরান খাইম মা,পান্তা ভাত দিয়া।

—ই–স! বাচ্চা ফুডাইমু আমি। প্রতিবাদ করে বলে মামুন।

জয়গুন বলে—ওহোঁ। পয়লা দিনের আণ্ডা। আণ্ডা দুইডা জুম্মার ঘরে দিয়া আবি নামাজের দিন।

ভাই-বোন দুজনেরই মুখের হাসি মিলিয়ে যায়।

জয়গুন তাড়াতাড়ি চুলো ধরায়। রাতের জন্য মুঠ মেপে ছয়মুঠো ও ভোরের জন্য আরো ছয়মুঠো চাল নিয়ে সে হাঁড়ি বসায় চুলোর ওপর। ছেলেকে হুকুম দেয় কয়েকটা কুমড়ো পাতা তুলে আনতে। নিজে সে যায় না। বাচ্চা-কাচ্চার মা, রাত-বিরাতে গাছের ফল-পাতা ছিঁড়তে নেই।

ভাত ফুটিয়ে মায়মুনের ধরা মাছ কয়টা রাঁধতে দেরী হয় না।

তিনটি বাসনে ভাত বাড়ে জয়গুন, আর আন্দাজ করে—হাঁড়িতে কতটা আছে। ফেনটাও ভাগাভাগি করে নেয়। খেতে খেতে হাসু বলে—ফেনডাত খুব ঘন মা, মিডা মিডা লাগে।

—নয়া আউশ যে। এর লাইগ্যাইত আউশ চাউল আনলাম। দরেও হস্তা। ফেনডাও অয় ভালা। কিন্তু ভাতে বাড়ে না এক্কেরেই। অ্যাঁরে হাসু, নারাণগঞ্জে চাউল কি দর দেখলিরে আইজ?

—ট্যাহায় দেড় সের, মা।

—কি পোড়ার দ্যাশ দ্যাখ দেহি! উত্তুরে এডুক হস্তা না অইলে হুকাইয়া তেজপাতা অইয়া যাইতাম না? আইজ আড়াই সের ভাও আনলাম। আমন চাউল দুইসের কইরা।

–আমি একদিন তোমার লগে উত্তুরে যাইমু মা।

—ওহোঁ কাম কামাই দিয়া তোমার উত্তুরে যাওনের দরকার নাই বাজান।

খাওয়া শেষ হলে জয়গুন হাঁড়ির ভাতগুলোতে পানি ঢেলে রাখে। ছেলেমেয়ের জন্যে তেলচিটে একটা লম্বা বালিশ নামিয়ে দেয়। হাসু ও মায়মুন শুয়ে পড়ে। জয়গুন পানের ডিবাটা নিয়ে বসে এবার। আজ আর পানের ডিবা নেয়ার কথা মনে ছিল না তার। গাড়ীর মধ্যে ছমুর মা-র কাছ থেকে চেয়ে একবার মুখে দিয়েছে একটু। আর সারা দিনের মধ্যে সে পান খায়নি। তবু হাসু অনুযোগ দেয়—পান খাওয়া ছাইড়্যা দ্যাও, মা। পান আর আনতাম না আমি। চাইর পয়সা কি কম?

পান খাওয়া সে অনেক কমিয়েছে। চার পয়সার পানে দু’দিন যায় আজকাল। পান চিবোতে চিবোতে সে সারাদিনের দুঃখ-কষ্ট ভুলে যেতে চেষ্টা করে।

রাত অনেক হয়েছে। কুপিটা নিবিয়ে সে শুয়ে পড়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *