1 of 2

২.০২ আহার-বিহার, মানসিক গুণাগুণ ইত্যাদি

দ্বিতীয় পাঠ
আহার
বিহার, মানসিক গুণাগুণ ইত্যাদি

যে সকল শিক্ষার্থী উচ্চশ্রেণীর সম্মোহনবিৎ হইবার অভিলাষী, তাহাদিগকে শক্তি লাভের জন্য যত্নবান হইতে হইবে। সকল নর-নারীর হৃদয়েই অল্পাধিক পরিমাণে সম্মোহন শক্তি নিহিত আছে এবং সংযম বা সাধনা দ্বারা তাহারা সকলেই উহা বর্ধিত করিতে পারে। এই সংযম বা সাধনা কাহার কাহার নিকট খুব কঠোর বলিয়া বোধ হইলেও এই শক্তি লাভের অন্য কোন উপায় নাই। প্রবাদ আছে, “সিদ্ধির পথ কুসুমাবৃত নয়”। অতএব এই বিষয়ে যাহার আন্তরিক স্পৃহা আছে, তাহাকে এই সংযমের ভিতর অবশ্য প্রবেশ করিতে হইবে।

শক্তিকামীর স্বাস্থ্য খুব ভাল হইবে; অন্যথায় সে ইহাতে সাফল্য লাভ করিতে পারিবেনা। রুগ্নাবস্থায় জীবনীশক্তি নিস্তেজ হইয়া পড়ে বলিয়া উহা শক্তি সাধনার পক্ষে মোটেই অনুকূল নয়। যৌবনকালে দেহের সৰ্বাবয়ব পুষ্ট এবং জীবনীশক্তির প্রাচুর্য ও প্রাখৰ্য্য বর্ধিত হয়, সেজন্য এই সাধনার উহাই প্রকৃষ্ট সময়। কিন্তু শরীর ও মন সুস্থ থাকিলে প্রৌঢ় ব্যক্তিরাও এই শিক্ষায় সমর্থ হইতে পারে; কেবল জীবনীশক্তির অল্পতা বশতঃ বৃদ্ধেরা ইহাতে অপারগ হয়।

ব্রহ্মচর্য

প্রথম শিক্ষার্থীকে ব্রহ্মচর্য-ব্ৰত অবলম্বন করিতে হইবে। ব্রহ্মচর্য্যের অর্থ বীৰ্য্য ধারণ এবং তৎসঙ্গে চিন্তা ও কর্মের নানা প্রকার সংযম। শুক্রই দেহের সার পদার্থ-কেবল তাহা নয়, উহার পোষক, বর্ধক এবং রক্ষকও বটে। এজন্যই প্রাচীন আর্য ঋষিগণ বলিয়াছেন, “মরণং বিন্দু পাতেন, জীবনং বিন্দু ধারণাৎ”। স্ত্রী-সহবাস বা অন্য কোন উপায়ে শুক্র ক্ষরণ দ্বারা জীবনীশক্তির যত বেশী অপচয় হয়, এমন আর কিছুতেই হয়না। এই শক্তি ক্ষয় নিবারণের জন্য তাহাকে বীৰ্য্য ধারণ করিতে হইবে। ব্রহ্মচর্য দ্বারা দেহ স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য্য যুক্ত হয় এবং সমধিক পরিমাণে মনের তেজ ও বল বৃদ্ধি পাইয়া থাকে। কামেন্দ্রিয়ের চালনায় যাহাদের কোন সংযম নাই তাহাদের মনঃশক্তি লাভের আশা সুদূরপরাহত।

 

আহার

ব্ৰহ্মচর্যের সহিত সাত্বিকাহারের খুব নিকট সম্বন্ধ; এজন্য শিক্ষাভিলাষীকে নিরামিষভোজী হইতে হইবে। যে সকল মনোবৃত্তি এই শক্তির স্মরণে বাধা জন্মায়, আমিষহারে সেই সকল বৃত্তি অধিক উত্তেজনা প্রবণ হয় বলিয়া শক্তি সাধনার পক্ষে নিরামিষই অধিকতর উপযুক্ত খাদ্য। নিরামিষ ভোজনে লোক দীর্ঘায়ু, স্বাস্থ্যবান, বলবান, কষ্ট-সহিষ্ণু, ধীর ও সাত্ত্বিক ভাবাপন্ন হয়; আর আমিষাহারিগণ অপেক্ষাকৃত অল্পায়ু, নানাপ্রকার কঠিন রোগ গ্রস্ত, অল্প শ্রমে কাতর, চঞ্চল ও অধিক পশু ভাবাপন্ন (with more animal propensities) হইয়া থাকে।

আহার সম্বন্ধে অধিকাংশ লোকই বড় অমনাযোগী। তাহারা যাহা পায় তাহাই খায়; শরীরের পক্ষে তাহা হিত কি অহিতকর সে বিষয়ে আদৌ লক্ষ্য করেনা। মানুষের ধাতু-প্রকৃতি বিভিন্ন বলিয়া সকলের পক্ষে একরূপ খাদ্য উপযোগী নয়। যে খাদ্য একজনের স্বাস্থ্য-বর্ধক অপরের পক্ষে তাহা অত্যন্ত অনিষ্টকর বলিয়া পরিত্যাজ্য। এজন্য শিক্ষার্থীকে স্বীয় প্রকৃতি অনুসারে তাহার খাদ্যাখাদ্য স্থির করিয়া লইতে হইবে। সাধারণতঃ যেরূপ দ্রব্যাদি আহার করিলে শরীরে কোন উদ্বেগ হয় না, শীঘ্র পরিপাক হইয়া যায়, তাহাই শরীর রক্ষার সম্পূর্ণ উপযোগী বলিয়া মনে করিবে। যে পরিমাণ খাদ্য উদরে স্থান পায়, তাহার অর্ধেক আহার করিবে; বাকী অর্ধাংশের এক ভাগ জল দ্বারা পূর্ণ করিয়া অবশিষ্টাংশ খালি রাখিবে; তাহাতে পরিপাক ক্রিয়া উত্তমরূপে সম্পন্ন হইবে। ক্ষুধা লাগিলেই খাইবে; কিন্তু কখনও বেশী খাইবে না। লোভের বশে অতিরিক্ত আহার করিলে তাহা হজম করিতে জীবনী শক্তির অপচয় হয় এবং অধিক চালনার দরুণ পরিপাক-যন্ত্রও ক্লান্ত হইয়া পড়ে। ক্রমাগত কিছুকাল এইরূপ করিতে থাকিলে উহারা উভয়েই দুৰ্বল হইয়া পড়ে এবং তাহার ফলে শরীরে নানা রোগের সৃষ্টি হয়। দিবসাপেক্ষা রাত্রির আহার অল্প হইবে এবং পাকস্থলীকে বিশ্রাম দেওয়ার জন্য মাসে অন্ততঃ দুই দিন উপবাস করিবে। আহারের সময় নির্দিষ্ট রাখিবে এবং খাদ্যদ্রব্যগুলিকে ধীরে ধীরে উত্তম রূপে চৰ্বণ করিয়া গিলিবে। কখনও ক্রোধ বা বিরক্তির সহিত আহার করিবেনা; কিম্বা তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করিবার চেষ্টা পাইবেনা। অধিক উষ্ম, অতিশয় শীতল, বাসি বা পচা জিনিষ (তাহা যত মুখরোচকই হউক) বাজারের খাবার, চা, বরফ, সোডা, লেমনেড়, এবং সর্বপ্রকার মাদক দ্রব্য বর্জন করিবে। অধিকাংশ রোগই আহারের দোষে জন্মিয়া থাকে, এজন্য স্বাস্থ্য রক্ষা বিষয়ে আহারের গুরুত্ব সর্বাপেক্ষা বেশী। যে সকল শিক্ষার্থী এই উপদেশগুলি পালন করিয়া চলিতে পারিবে, বৃদ্ধ বয়স পর্যন্তও তাহাদের স্বাস্থ্য ও কৰ্ম্ম-শক্তি অটুট থাকিবে, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।

 

শারীরিক পরিশ্রম

ভুক্ত দ্রব্যের শীঘ্র পরিপাক, সুনিদ্রা, দেহের জড়তা নাশ ও কর্মশক্তির উদ্দীপনার জন্য শারীরিক পরিশ্রম আবশ্যক। যে সকল শিক্ষার্থীর দৈহিক শ্রম কম হয়, তাহাদের মধ্যে যাহারা যুবক, তাহারা নিয়মিতরূপে পরিমিত মাত্রায় কোন ব্যায়ামাভ্যাস করিবে; আর যাহাদের বয়স ৪০ এর ঊর্ধ্বে তাহারা প্রত্যহ বিশুদ্ধ বায়ুতে ভ্রমণ করিবে। যুবকদিগের মধ্যেও যাহারা দুর্বল তাহদের পক্ষেও ভ্রমণ-ব্যায়ামই প্রশস্ত। আর যাহাদিগকে শারীরিক পরিশ্রমের কার্য করিতে হয়, তাহাদের ব্যায়ামের কোন আবশ্যকতা নাই। শারীরিক বা মানসিক কোন শ্রমই বেশী ভাল নয়। ব্যায়ামের উপযুক্ত সময় সকাল এবং সন্ধ্যা; এই সময় সবল যুবকেরা মুগুড়, ডাম্বেল, কুস্তি ইত্যাদি অভ্যাস করিবে, আর অপর ব্যক্তিরা খোল। মাঠের রাস্তায় বিশুদ্ধ বায়ুতে ভ্রমণ করিবে। তাহারা সূর্যোদয়ের পূর্বেই বেড়াইতে বাহির হইবে এবং সুবিধা হইলে পশ্চিম হইতে পূর্বদিকে চলিবে। সান্ধ্য ভ্রমণে এই নিয়ম পালনের আবশ্যকতা নাই। বেগে ভ্রমণের সময় হাত খোলা থাকিলে আঙ্গুলের অগ্রভাগ হইতে অধিক পরিমাণে জীবনী-শক্তি বহির্গত হইয়া যায়, এজন্য তখন হাত দুই খানা মুষ্টিবদ্ধ করিয়া চলিবে। ব্যায়ামের সময় ও পরিমাণ নির্দিষ্ট থাকা উচিৎ।

 

দৈহিক পরিচ্ছন্নতা

শিক্ষার্থীর বাসগৃহ যথা সম্ভব আলোক ও বাতাস যুক্ত হইবে এবং সে সর্বদা পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন থাকিবে, যেন সহজে ঘর্ম বাহির হইয়া যাইতে পারে। এজন্য সে দুই-চার দিন অন্তর অন্তর সমস্ত শরীরে সাবান মাখিয়া উহা শুকাইয়া লইবে, পরে অল্প অল্প গরম জল ঢালিয়া গামছা দ্বারা উহা উত্তমরূপে রগড়াইয়া ফেলিবে। ইহাতে শরীরে কোন দুর্গন্ধ থাকিলে তাহা নাশ হইবে এবং নোম কূপগুলির মুখও খুব পরিস্কৃত থাকিবে। মুখে দুর্গন্ধ হইলে উপযুক্ত দাঁতের মাজন বা দাঁতন ব্যবহার করিবে। হাত পায়ের নখ বড় হইলে উহাদের ভিতর নানা প্রকার দূষিত পদার্থ আশ্রয় গ্রহণ করে এবং সম্মোহন করিবার সময় জীবনীশক্তি প্রবাহের বাধা জন্মাইয়া থাকে; এজন্য খুব অল্প দিন অন্তর অন্তর নখগুলিকে ছোট করিয়া কাটিয়া ফেলিবে। শিক্ষার্থীর পোষাক-পরিচ্ছদ সুরুচি সঙ্গত ও পরিস্কৃত হইবে। ময়লা বস্ত্রাদি পরিধান করিলে যে শুধু মনের প্রফুল্লতা নষ্ট হয়, তাহা নয়, তদ্বারা অপরের মনেও ঘৃণার ভাব উদ্রেক হইয়া থাকে। এই সকল কারণে যদি তাহার উপর কাহারও অশ্রদ্ধা বা অভক্তি জন্মে, তবে সে তাহার উপর শক্তি প্রয়োগ করিয়া কখনও সাফল্য লাভে সমর্থ হইবেন। কাৰ্য-কুশল সম্মোহনবিদগণের পোষাক-পরিচ্ছদ, কথা-বার্তা, চাল-চলন, আচার-ব্যবহার ইত্যাদিতে বিশ্বাস, ভালবাসা, শ্রদ্ধা, ভক্তি ইত্যাদি আকৃষ্ট হইয়া থাকে এবং তাহাতেই তাহারা অধিকাংশ লোকের মনের উপর সহজে আধিপত্য করিতে সমর্থ হয়েন। যাহারা এই সকল বিষয় অবহেলা করে, তাহারা কখনও উচ্চশ্রেণীর কার্যকারক হইতে পারেনা।

 

মানসিক ব্যায়াম

শিক্ষার্থী দেহ সুস্থ রাখিবার জন্য যেমন পরিমিত মাত্রায় শারীরিক শ্রম করিবে, তাহার মনের উন্নতি সাধনের জন্যও তাহাকে সেইরূপ মানসিক ব্যায়াম করিতে হইবে। তজ্জন্য সে প্রতিদিন নিয়মিতরূপে কোন বস্তু বা বিষয়ের প্রতি মন স্থির করণ অভ্যাস করিবে। ইহার নামই ‘একাগ্রতা এবং এই একাগ্রতা হইতেই মনের যাবতীয় শক্তির স্ফুরণ হইয়া থাকে। একাগ্রতা অভ্যাসের নিমিত্ত কয়েকটি উত্তম অনুশীলন “চিন্তাপঠন বিদ্যায়” প্রদত্ত হইয়াছে; শিক্ষার্থীর সুবিধার নিমিত্ত নিম্নে ও তিনটি অনুশীলন প্রদান করা হইল।

(১) পাঁচ মিনিট কাল চলন্ত হাত-ঘড়ির সেকেণ্ডের কাঁটার গতি দৃষ্টি দ্বারা অনুসরণ করিবে। যতক্ষণ উহা করিতে থাকিবে, ততক্ষণ মুহূর্তের জন্যও অন্যমনস্ক হইবেনা।

(২) কোন পুস্তক হইতে একটি ছোট কঠিন বাক্য মনোনীত করতঃ উহার অর্থ বাহির করিবার চেষ্টা পাইবে। উহার প্রত্যেকটি শব্দের ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকার অর্থ হইতে পারে, তাহার খুব মনাযোগের সহিত চিন্তা করতঃ লেখকের অভিপ্রায় হৃদয়ঙ্গম করিবার প্রয়াস পাইবে। পাঁচ হইতে দশ মিনিট কাল এইরূপ অভ্যাস করিবে।

(৩) কোন একটি কাৰ্য্য আরম্ভের পূৰ্ব্বে চক্ষু বুজিয়া উহার সম্বন্ধে নিয়োক্ত রূপ চিন্তা করিবে। উহার উদ্দেশ্য—উপকারিতা ও অপকারিতা, কি প্রণালীতে কার্য করিলে উহা সুসম্পন্ন হইবে এবং তাহা অনুসরণের সুবিধা ও অসুবিধা ইত্যাদি। পাঁচ হইতে দশ মিনিট কাল এইরূপ অভ্যাস করিবে।

এই রকমের নানা প্রকার অনুশীলনের সাহায্যে শিক্ষার্থী তাহার একাগ্রতা শক্তি বর্ধিত করিতে যত্নবান হইবে। এতদ্ব্যতীত আত্মসোহনের সাহায্যে তাহাকে যাবতীয় মন্দ অভ্যাস পরিত্যাগ, অনিষ্টকর প্রবৃত্তি সমূহের দমন এবং সৎবৃত্তি নিচয়ের বিকাশ সাধন পূৰ্ব্বক সাধুভাবে জীবন যাপনে অভ্যস্ত হইতে হইবে। এই সকল বিষয়ের সংযম দ্বারা যেমন তাহার শক্তি শূরণের সাহায্য হইবে, তেমনি সে লোকের বিশ্বাস, প্রীতি, শ্রদ্ধা, ভক্তি ও সদেচ্ছা লাভ করিয়া বৈষয়িক এবং আধ্যাত্মিক জীবনেও যথেষ্ট উন্নতি সাধনে সমর্থ হইবে।

সংসারী লোকের পক্ষে এই সকল বিষয়ের খুব কঠোর সাধনা সম্ভব নয় বলিয়া, শিক্ষার্থীকে তাহার সাধ্য ও সুবিধানুসারে সাধনা করার ইঙ্গিত করা হইল। কিন্ত ইহা প্রত্যেক শিক্ষার্থীকেই বিশেষরূপে স্মরণ রাখিতে হইবে যে, আত্ম-সংযমই মনঃশক্তি লাভের মূল। সংযমে শক্তি বৃদ্ধি হয়, আর অসংযম বা অত্যাচারে উহা নষ্ট হইয়া যায়। সুতরাং যে যতখানি সাধনা করিতে পারিবে, তাহার সিদ্ধি লাভও ঠিক সেইরূপ হইবে। এই সকল সংযম সম্বন্ধে বহু তত্ত্ব “ইচ্ছাশক্তি”তে সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। শিক্ষাভিলাষী উক্তরূপে শরীর ও মন গঠন পূৰ্ব্বক শিক্ষারম্ভ করিলে তাহার সিদ্ধি লাভ খুব সহজ হইবে বটে, কিন্তু তত দিন তাহার ধৈৰ্য্য থাকিবে কি না সন্দেহ। এজন্য সে মেসমেরাইজ করিবার নিয়ম-প্রণালী শিক্ষার সঙ্গেই এই সংযম বা সাধনায় প্রবৃত্ত হইবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *