1 of 2

১.২৩ পাত্রের শরীরে ক্যাটালেপ্‌সী উৎপাদন

এয়োবিংশ পাঠ
পাত্রের
শরীরে ক্যাটালেপ্‌সী উৎপাদন (Catalepsy)

সম্মোহন আদেশ পাত্রের শরীর ও মনের উপর কিরূপ অত্যাশ্চর্য রূপে প্রভাব বিস্তার করিতে পারে, ক্যাটালেপটিক ষ্টেট (Cataleptic State) উহার একটি উত্তম দৃষ্টান্ত। এই অবস্থায় মোহিত ব্যক্তির শরীর এরূপ কঠিন হইয়া যায় যে, তখন উহার উপর অত্যন্ত গুরু ভার বিশিষ্ট কোন পদার্থ চাপাইয়া দিলেও, সে উহা অক্লেশে ধারণ করিয়া রাখিতে পারে এবং তাহাতে তাহার শারীরিক বা মানসিক কোনরূপ অনিষ্ট হয় না। ক্যাটালেসী দুই প্রকার পূর্ণ’ ও ‘আংশিক। যখন পাস ও আদেশের সাহায্যে মোহিত ব্যক্তির সমস্ত শরীর কঠিন করিয়া দেওয়া হয়, তখন উহাকে পূর্ণ ক্যাটালেন্সী’ (complete catalepsy); আর যখন উহার কোন অংশ বিশেষকে উক্তাবস্থায় আনয়ন করা হয়, তখন উহাকে ‘আংশিক ক্যাটালেসী (partial catalepsy) বলে।

আংশিক ক্যাটালেপসী :–ইহা মোহিত ব্যক্তির শরীরের অংশ বিশেষে সহজেই উৎপাদিত হইতে পারে। আংশিক ক্যাটালেসী অল্প নিদ্রাতেও উৎপাদন করা যায়। কাৰ্যকারক পাত্রের ডান হাতখানা। আস্তে আস্তে উঠাইয়া খাড়া করিবে এবং ঐরূপ করিবার সময় তাহার নাসিকা-মূলে প্রখর দৃষ্টি স্থাপন পূৰ্ব্বক গম্ভীর ও আদেশ সূচক স্বরে বলিবে-“তোমার এই হাতখানা শক্ত হইতেছে,-হাতখানা ক্রমে ক্রমে খুব শক্ত হইয়া উঠিতেছে, ক্রমে ক্রমে খুব শক্ত আরও শক্ত হইয়া উঠিতেছে। ইহা এখন লোহার শলার মত শক্ত হইয়া খাড়া থাকিবে এবং যতক্ষণ আমি তোমাকে উহা নরম ও শিথিল করিতে না বলিব, ততক্ষণ উহা লোহার শলার মত শক্ত হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিবে এবং কিছুতেই নরম হইয়া পড়িয়া যাইবে না। শক্ত হচ্ছে-শক্ত হচ্ছে-আরও শক্ত হচ্ছে-খুব শক্ত হচ্ছে। এখন ইহ লোহার শলার মত খুব শক্ত হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিবে এবং কিছুতেই শিখিল হইয়া পড়িয়া যাইবে না।” কয়েকবার এইরূপ আদেশ প্রদান ও তৎসঙ্গে কয়েকটি স্পর্শযুক্ত নিম্নগামী পাস দিলেই, উহা অত্যন্ত শক্ত হইয়া ‘উৰ্দ্ধবাহুর” ন্যায় দাঁড়াইয়া থাকিবে। এই হাতখানাকে উক্তাবস্থায় ৫৭ মিনিট রাখার পর, আদেশ দিয়া উহাকে পূর্বের ন্যায় শিথিল করিয়া দিবে। সম্মোহনবিৎ ইচ্ছা করিলে ক্রমে ক্রমে তাহার অপর হাত ও পা গুলিও উত্তাবস্থায় আনয়ন করিতে পারে।

পূর্ণ ক্যাটালেপ্‌সী :–কাৰ্যকারক পাত্রের শরীরে পূর্ণ ক্যাটালেপসী উৎপাদনের চেষ্টা পাইবার পূৰ্ব্বে, তাহাকে শোওয়াইবার জণ্ঠ নিম্নোক্ত প্রণালীতে দুইখানা চেয়ার স্থাপন করিয়া রাখিবে। পাত্রের পায়ের গোড়ালীর অর্ধ ফুট উপর হইতে কাধ পর্যন্ত স্থান যতদূর, ততদূরে ঘরের মেঝেতে, পরস্পর বিপরীতাভিমুখী করিয়া দুইখানা শক্ত চেয়ার স্থাপন করিবে। ঐ চেয়ার দুই খানার হেলান দিবার কাষ্ঠখণ্ডের উপর দুইটি ছোট বালিশ স্থাপন করিবে এবং দুইটি যুবককে ঐ চেয়ার দুই খানার উপর ঘোড় সওয়ারের ন্যায় পরস্পর মুখামুখী হইয়া বসিতে বলিবে।

উক্ত উপদেশ মত যুবকদ্বয় চেয়ারে বসিলে পর, এই পরীক্ষাটির জন্য সোহনবিৎ একটি সবল ও সুস্থকায় যুবককে আহ্বান করিবে। সে, যাহার উপর বিভিন্ন রকমের কয়েকটি মায়া ও ভ্ৰম জন্মাইয়া কৃতকাৰ্য্য হইয়াছে, এরূপ ব্যক্তিকেই পাত্র মনোনীত করিবে। পাত্রকে তাহার হাত দুইখানা দুই পার্শ্বে ঝুলাইয়া দিয়া সরল ভাবে দাঁড় করাইবে। তৎপর তাহাকে সাধ্যমত তাহার শরীরটি কঠিন ও শক্ত করিতে বলিবে ও চক্ষু বুজিয়া একাগ্ৰমনে ঘুমের বিষয় ভাবিতে উপদেশ দিবে। পাত্র তাহার হাত, পা ও শরীরের অন্যান্য স্থানের মাংসপেশীগুলি যথা সম্ভব কঠিন ও শক্ত করিয়াছে কি না, কাৰ্যকারক তাহা স্বয়ং দেখিয়া লইবে। তাহার শরীর কঠিন হওয়ার পর, যখন সে চক্ষু বুজিয়া ঘুমের বিষয় ভাবিতে আরম্ভ করিবে, তখন সম্মোহনবিৎ বামহাত দ্বারা তাহার ঘাড়টি দৃঢ়রূপে ধরিয়া ডানহাত দ্বারা তাহার মাথা হইতে পা পর্যন্ত তাড়াতাড়ি কয়েকটি স্পর্শহীন নিম্নগামী পাস দিবে এবং তৎসঙ্গে গম্ভীর ও প্রভুত্বব্যঞ্জক স্বরে নিম্নোক্তরূপ আদেশ প্রদান করিবে। বলিবে—“ঘুম-ঘুমঘুম—গভীর নিদ্রা ও তোমার শরীর শক্ত হচ্ছে,-আরও শক্ত হচ্ছে।” এইরূপ দুই-তিনবার বলিয়া আবার বলিবে—“ঘুম-ঘুমঘুম—গভীর নিদ্রা; গাঢ় নিদ্রা—খুব শান্তিদায়ক নিদ্রা–অত্যন্ত আরামজনক নিদ্রা; তোমার শরীরের সমস্ত মাংসপেশীগুলি শক্ত ও কঠিন হচ্ছে—আরও কঠিন হচ্ছেখুব শক্ত হচ্ছে”। এইরূপ তিন-চারবার বলিবে এবং বলিবার সময় তাহার শরীরের মাংসপেশীগুলি এক একবার টিপিয়া দেখিবে যে, উহারা খুব শক্ত হইয়াছে কিনা? তৎপরে আবার বলিবে—“ঘুম-ঘুম—ঘুম—গভীর নিদ্রা; ঘুম-ঘুম-ঘুম—গভীর নিদ্রা; তোমার গভীর নিদ্রা হবে,-তোমার হৃদ্যন্ত্র স্বাভাবিক ভাবে কাৰ্য্য করিতে থাকিবে এবং তোমার সমস্ত শরীর লোহার শলার মত শক্ত হইয়া যাইবে।” দুই-তিনবার এইরূপ বলিয়া পুনরায় বলিবে—“এখন তোমার গভীর নিদ্রা হয়েছে, তোমার শরীর লোহার মত শক্ত হইয়া গিয়াছে এবং তোমার হৃদ্যন্ত্র স্বাভাবিক ভাবে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ভাবে কার্য করিতে থাকিবে এবং যতক্ষণ আমি তোমাকে এই অবস্থায় রাখি, ততক্ষণ ভোমার হৃদ্যন্ত্র সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ভাবে কার্য করিতে থাকিবে; এবং ইহাতে তোমার কিছুমাত্র কষ্ট হইবে না।” এই আদেশ দিবার পর তাহার শরীর খুব শক্ত হইলে, অপর দুইটি লোকের সাহায্যে তাহাকে ঐ চেয়ার দুই খানার উপর চিৎ করিয়া শোওয়াইবে; তাহার পা দুইখানা (হাঁটুর এক ফুট নীচের অংশ দ্বয়) এক চেয়ারের উপর চেয়ারের হেলান দিবার কাষ্ঠখণ্ডের উপর যে বালিশটি রহিয়াছে, তাহার উপর), তাহার ঘাড় (ঘাড়ের মূল হইতে নীচের দিকে চার ইঞ্চি দূরে যে অংশ, সেই অংশটি) অপর চেয়ারে স্থাপিত বালিশের উপর ও তাহার শরীরের মধ্যভাগ শূন্যের উপর থাকিবে। পাত্রকে উক্তরূপে শোওয়াইয়া, উপবিষ্ট যুবকদ্বয়কে তাহার শরীরটি দৃঢ়রূপে ধরিয়া রাখিতে বলিবে। পাত্রকে চেয়ারে শোওয়াইবার পর, একখানা মোটা কাপড় দ্বারা তাহার শরীরটি ঢাকিয়া দিয়া কাৰ্যকারক অপর একখানা চেয়ারে ভর করিয়া, আস্তে আস্তে তাহার শরীরের উপর উঠিয়া বসিবে অথবা দাঁড়াইবে। উক্তাবস্থায় দুই-তিন মিনিট অবস্থান করার পর, সে তাহার শরীরের উপর হইতে খুব সাবধানে তাড়াতাড়ি নামিয়া আসিয়া, নিম্নোক্ত নিয়মে তাহাকে তৎক্ষণাৎ প্রকৃতিস্থ করিয়া দিবে।

পাত্রকে প্রকৃতিস্থ করণ :–দুইটি লোকের সাহায্যে পাত্রকে চেয়ার হইতে নামাইবে এবং তাহাকে সোজা ভাবে দাঁড় করাইয়া, পূর্বের ন্যায়, বাম হাত দ্বারা তাহার ঘাড়টি দৃঢ়রূপে ধরিয়া রাখিবে। পাত্রের পশ্চাতে এমন ভাবে একখানা চেয়ার রাখিবে, যেন উহাতে তাহাকে বসাইতে পারা যায়। তৎপরে কাৰ্যকারক তাহার নাসিকামূলে প্রখর দৃষ্টি স্থাপন পূর্বক, ডান হাত দ্বারা খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটি স্পর্শহীন উৰ্দ্ধগামী পাস করিবে এবং তৎসঙ্গে খুব একাগ্রতার সহিত গম্ভীর স্বরে নিম্নোক্তরূপ আদেশ দিবে। বলিবে—“এখন তোমার শরীর আস্তে আস্তে নরম হচ্ছে-সমস্ত মাংসপেশীগুলি আস্তে আস্তে নরম ও শিথিল হচ্ছে—আস্তে-খুব আন্তে-শিথিল ও অবসন্ন হচ্ছে-অসার হয়ে পড়ছে।” দুই-তিনবার এইরূপ বলার পর, তাহার শরীর শিথিল হইলে তাহাকে চেয়ারে বসাইবে। তৎপরে বলিবে—“তোমার সমস্ত মাংসপেশীগুলি এখন শিথিল ও অবসন্ন হইয়া গিয়াছে,-তোমার সমস্ত শরীর অসার ও নিস্তেজ হইয়া পড়িয়াছে,এখন তুমি আবার ঘুমাইবে,—দুই মিনিটের জন্য আবার তোমার গভীর ঘুম হবে; ঘুম ঘুম-ঘুম —গভীর নিদ্রা;-গাঢ় নিদ্রা;-শান্তিজনক নিদ্রা।” এইরূপ দুই-তিনবার বলিলেই সে আবার ঘুমাইয়া পড়িবে। উহার দুই-তিন মিনিট পর “জাগ-জাগ—জাগ—ঘুম ভেঙ্গে গেছে” ইত্যাদি বলিয়া তাহাকে জাগ্রত ও প্রকৃতিস্থ করিয়া দিবে। এই অবস্থায় উপনীত পাত্রকে কখনও হাততালি দিয়া হঠাৎ জাগ্রত করিবেনা।

যে সকল লোক সুস্থকায় ও বলিষ্ঠ, যাহাদের হার্ট (heart) বা হৃদযন্ত্রের কোনরূপ ব্যারাম নাই ও যাহাদের শরীরে আংশিক ক্যাটালেন্সী খুব সহজে উৎপাদিত হয়, পূর্ণ ক্যাটালেন্সী উৎপাদন করিতে কেবল তাহাদিগকেই পাত্র মনোনীত করিবে। যাহাদের হৃদযন্ত্র স্বভাবতঃ দুৰ্বল বা কোন রূপ রোগগ্রস্ত তাহাদিগের উপর এই পরীক্ষা করিতে কদাপি চেষ্টা পাইবেনা। এই অবস্থায় উপনীত পাত্রকে অত্যন্ত সাবধানে নাড়াচাড়া করিবে এবং যাহাতে তাহার শরীরে হঠাৎ কোন রূপ চোটু না লাগে, তদ্বিষয়ে বিশেষ সতর্ক থাকিবে। পাত্রকে চেয়ারের উপর শায়িত করার পর, তাহার শরীরের মধ্যভাগ নীচের দিকে ঝুকিয়া বা নুইয়া পড়িলে, কাৰ্যকারক তাহার পিঠের নীচে হাত দিয়া উহাকে উপরের দিকে ঠেলিয়া দিবে এবং ঐরূপ করিবার সময় শক্ত—খুব শক্ত-লোহার শলার মত শক্ত হইয়া থাকিবে,-কিছুতেই বাঁকিয়া পড়িবেনা, কখনও নুয়ে পড়বে না” ইত্যাদি বলিবে। সম্মোহনবিৎ পাত্রের শরীরের উপর অবস্থান করিবার সময়, তাহার শরীর মুইয়া বা ঝুকিয়া না পড়িলেও, সে মাঝে মাঝে এক একবার ঐরূপ আদেশ দিবে। সে যে পর্যন্ত কয়েকটি বিভিন্ন প্রকৃতির লোককে এই অবস্থায় আনয়ন করিয়া অভিজ্ঞতা লাভ না করিবে, ততদিন সে পাত্রের উপর কেবল স্বয়ং একাকী আরোহণ করিবে এবং কখনও অপর কোন লোককে তাহার উপর উঠাইবার প্রয়াস পাইবে না। এই বিষয়ে তাহার অভিজ্ঞতা জন্মিবার পর, সে ইচ্ছা করিলে, উক্তাবস্থায় পাত্রের বুকের উপর ৬৭ মন ওজনের পাথরও ভাঙ্গিতে সমর্থ হইবে। এই অবস্থায় পাত্রকে কখনও দুই-তিন মিনিটের অধিক সময় রাখা সঙ্গত নয়।

কয়েক বৎসর পূর্বে বিলাতের একখানা সংবাদ পত্রে দেখিয়াছিলাম যে, সেখানে সম্মোহন ক্রীড়া প্রদর্শন কালীন ডি, ইভেন্‌স্ (নামটি আমার ঠিক স্মরণ নাই নামক একজন ক্রীড়া প্রদর্শক একটি যুবককে উক্ত পূর্ণ ক্যাটালেপটিক অবস্থায় আনয়ন করতঃ তাহার দ্বারা খেলা দেখাইয়াছিল; কিন্তু পরে আর তাহাকে জাগ্রত করিতে পারে নাই। তাহাতে ঐ মোহিত ব্যক্তি মৃত্যু মুখে পতিত হইয়াছিল। সেখানে তখন দর্শকদিগের মধ্যে কয়েকজন সম্মোহন বিদ্যাবিৎ ডাক্তারও (medical hypnotists) ছিলেন, কিন্তু তাহারাও লোকটিকে প্রকৃতিস্থ করিতে অপারগ হইয়াছিলেন। ফলে, উক্ত ক্রীড়া প্রদর্শক নরহত্যার দায়ে অভিযুক্ত হইয়াছিল। বিচারে যে তাহার কি হইল, তাহা আর জানা যায় নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *