যবনিকা পতন

যবনিকা পতন

লোকে কয় অভিনয় কভু নিন্দনীয় নয়, নিন্দার কারণ শুধু অভিনেতাগণ-বলে গেছেন নটগুরু গিরিশচন্দ্র। অভিনেতৃত্ব নিন্দার কারণ তো বটেই তার চেয়েও কিছু বেশিই বরং; বিতান্ত মারাত্মকভাবেই কথাটা ফলে গেল।টবর পুলকেশের জীবনে। সে নিজেই যেন উদাহরণস্বরূপ হয়ে দাঁড়ালো মহাকবির ঐ মহাবাক্যের।।

অভিনয় করার শখ তার বাল্যকালের থেকে। পেশাদারী রঙ্গমঞ্চে একটা সুযোগ পাবার জন্যে কতো না ঘোরাঘুরি করেছে একসময়; কিন্তু দুঃখের বিষয়, নেপথ্যে কোলাহল কিংবা জনতার একজনের ভূমিকার চেয়ে বেশিদূর আর এগুতে পারেনি। অবশেষে বিরক্ত হয়ে পাটের মত পার্ট পাবার আশায় যাত্রাদলে গিয়ে যোগ দিল সে।

যাত্রাপালায় এক আধটা পাট পেলেও তার পাট অব শীচই একটা বাধা হয়ে দাঁড়ালো–সংলাপাংশেই মার খেলে শেষটায়। মদ কি গাঁজা খাওয়ার হেতু নয়, হয়তো কানে একটু খাটো বলেই যাত্রার আসরে সে বেহুশ হয়ে পড়ল একদিন। অভিনয়ের শিক্ষানবিশির সূচনাতেই তার অভিনেতা-জীবন বিষিয়ে দিল সেই ঘটনায়।

প্রম্পটিং ঠিক ঠিক শুনে সেটা সঠিকভাবে ওগরাতে পারাটাই নবিশ (কিংবা নডি)দের অভিনয়-পটুতার গোড়ার কথা। নহুসের প্রেতাত্মা কাঁদিহে এই কথাটা বলতে গিয়ে সে বলেছিল বেহুশের প্রেতাত্মা কাঁদিছে। কথাটা নাকি ঠিক হয়নি। কিন্তু কেন যে হয়নি তা তার বোধগম্যের বাইরে। যাত্রাদলের অধিকারীকে সে তর্ক করে বোঝাতে গিয়েছিল যে, নহুস মানেও যা বেহুশ মানেও তাই। ওটা বলায় তার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি, তারতম্য হয়নি এমন কিছু প্রেতাত্মার কোনো হুশ থাকবার কথা নয়, এইটেই এখানে আসল কথা।

অধিকারী আর কথা না বাড়িয়ে পত্রপাঠ আসর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন তাকে।

আসর থেকে সরে আসতে হলেও অভিনয় থেকে সরবে না এই হচ্ছে তার প্রতিজ্ঞা। যে মাটিতে পড়ে লোক ওঠে তাই ধরে—এই অভিনয় ধরেই সে উঠবে, বাঁচবে, বিখ্যাতও হবে হয়তো বা কোনোদিন।

না, মুক্তাঙ্গনেই সে অভিনয় করবে এর পর থেকে। মুক্তাঙ্গন রঙ্গমঞ্চে নয়, পৃথিবীর মুক্ত অঙ্গনে।

কিন্তু কিছু টাকা তো চাই। পকেটে একটা কানাকড়িও নেই। অধিকারী তো মাইনে না দিয়েই ভাগিয়েছেন। কলকাতার পথে-ঘাটে ঘোরাফেরা করতেও পয়সা লাগে—ঘোরালো অভিনয়ের কথা তো পরে। পৃথিবীর অঙ্গন চারধারেই বিমুক্ত বটে, কিন্তু একটা টাকা ধার দেবার লোক কোনোবারেই নেইকো।

অগত্যা, সে তার এক কম্পাউণ্ডার বন্ধুর কাছে গিয়ে, না, কোনো টাকাকড়ি নয়, এক ফালি ব্যাণ্ডেজ মাত্র ধার চাইল কেবল। তারপর তার সাহায্যেই সেইটে নিজের মাথায় বেঁধে নিয়ে একটা নামকরা হাসপাতালের গেটে গিয়ে গাট হয়ে বসল সে।

একটু পরেই এক পথচারী এইভাবে ম্লানমুখে তাকে সেখানে বসে থাকতে দেখে সদয় হয়ে শুধালেন, কী হে! হাসপাতালে অ্যাডমিশন পাওনি বুঝি?

না স্যর। সেরে যাবার পর তারা বার করে দিয়েছে আজ আমায়।

হয়েছিল কী? কী করে চোট লাগল তোমার মাথায়?

আজ্ঞে, ট্রাম থেকে পা ফসকে পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে গেল আমার। কার, স্বরে সে জানায়।

বিচিত্র নয়! যা ভিড় বাপু ঐ ট্রাম-বাসে আজকাল। ঝুলতে খুলতে যেতে একদিন আমিও তো প্রায় পড়ে যাই আর কি! পড়ে গেলে আমারও ঠিক ঐ দশাই হতো। কি, মারা যেতাম কিনা তাই বা কে বলবে! বলতে গিয়ে শিউরে উঠলেন ভদ্রলোক। তা, এখানে বসে আছো কেন এমন করে? বাড়ি যাও।

আজ্ঞে, ছাড়া পেয়েছি বটে, কিন্তু বাড়ি যাবার গাড়ি ভাড়া তো কাছে নেই, তাই… বলে সে চুপ করে বসে থাকে।

বাড়ি কোথায় তোমার?

খিদিরপুরের দিকটায়, সেই মোমিনপুরেই। আনা চার পাঁচ পেলেই আমি ট্রামে কি বাসে চেপে চলে যেতে পারি।

আবার ট্রাম! এই ব্যাণ্ডেজবাঁধা মাথা নিয়ে—অ্যাঁ? ফের সর্বাঙ্গ-শিহরণ হলো দ্রলোকের : এবার পড়লে আর তোমার বাঁচন নেই বাপু! তুমি বরং একটা ট্যাকসি নিয়ে চলে যাও তার চেয়ে।

পুলকেশ কোনো জবাব দেয় না। তাকে যেন আরো বেশি ম্লান দেখায়। আরো যেন সে দমে যায় কথাটায়।

মোমিনপুর যেতে হলে কত পড়বে ট্যাসিতে? যাইনি কখনো তো। আচ্ছা, এই নাও, পাঁচ টাকা ধরো। সদয় ভদ্রলোক পুলকেশের অনিচ্ছুক হাতে নোটখানা ধরিয়ে দিয়ে বলেন, নাও, নিতে কোনো কুষ্ঠাবোধ কোরো না। তুমি আজ আমায় খুব শিক্ষা দিয়েছ ভাই! তোমার দশা আমারো তো হতে পারত কোনোদিন। বাঁচিয়ে দিয়েছ তুমি আমায়। তার বিনিময়ে এই সামান্য পাঁচ টাকা মাত্র তোমায় দিলাম…না, আমি আর কোনোদিন ওই ট্রামে বাসে চাপছি না। অন্ততঃ ভিড়ের সময় ওই ভাবে ঝুলতে ঝুলতে তো কখনই নয়।

রোমাঞ্চিত হতে হতে বিদায় নিলেন ভদ্রলোক।

অন্তরে পুলকিত হলেও পুলকেশ আরও বেশি বিষণ্ণতর হয়ে বসে রইল। সেইখানেই। তার পরেও।

একটু পরে আরেক শিকার এসে পড়ল তার অভিনয়ের আসরে। তাঁকে তেড়ে গিয়ে ধরতে হলো না, তিনিই নিজগুণে ধরা দিলেন তার ফাঁদে।

সব শুনেটুনে একটা টাকা তার হাতে দিয়ে বললেন—নাও, বাড়ি যাও এবার। তার আগে কোথাও কিছু খেয়েটেয়ে নিয়ে, কেমন? তোমার ট্রামভাড়ার চাইতে কিছু বেশিই দিলাম সেইজন্যে।

এই করে এক বেলায়ই তার মন্দ রোজগার হলো না। তারপর রোদ একটু চড়ে উঠতেই চাড়া দিয়ে উঠল সেভার ভার মুখ ফেলে…বেশ ভার ভার পকেট নিয়ে।

সেরা এক হোটেলে গিয়ে খানাপিনা সেরে একটা সিনেমা দেখতে বেরিয়ে পড়ল পুলকেশ। মনের পুলকেই!

এমনি করে খোশখেয়ালে চলতে লাগল খাসা তার। দিনের পর দিন এই অভিনয় করেই।

ভালো ব্যবসা ফেঁদেছে সে! পালাযার আপিস থেকে বিদায় নিয়ে পালা করে নিত্য, নতুন এই যাত্রার পালা তার—শহরের বিভিন্ন আরোগ্যশালার মুক্তাঙ্গনে। অভিনয় নিয়ে ব্যবসা করে অনেকে, ব্যবসার অভিনয়ও করে বিস্তর-জনা, কিন্তু অভিনয় আর ব্যবসা একাকার করে একাধারে এই টু পাইস উপায় করতে একমাত্র সে-ই পেরেছে।

এই ব্যবসায় বাড়তি খরচাও নেই এখন। আপিস ভাড়া, কর্মচারীর বেতন ইত্যাদি লাগে না। হাসপাতাল বানিয়েছেন সরকার বাহাদুর, তার সামনের ফুটপাথ সবাইকার, সেই ফাঁকা ফুটপাথেই তার আপিস খোলা। ইস্টাব্লিশমেন্ট খরচা কিছু নেই, আর ওভারহেড এপেন, সধরতে গেলে, মাথার এই ব্যান্ডেজ।

এই মূলধন নিয়েই তার ফলাও কারবার।

মাথার ব্যাণ্ডেজটা কেবল পরিষ্কার করতে হয় মাঝে-সাঝেযাতে হাসপাতালের টাটকা-ছাড়া-পাওয়ার মতই তাকে দেখায়। সার্ক কিংবা লা পাউডার দিয়ে সাফ করতে হয় দু তিন দিন অন্তর—নিজের পক্ষে এইটুকুই তার সাফাই-এতখানিই মেহ্নত। তারপর দিনভোব এনতার লাক্সারি। রেস্তরাঁয় খাও, সিনেমায় যাও—ইতস্ততঃ গতিবিধি করো তোমার প্রাণ চায়।

হাসপাতালও কিছু কম নেই কলকাতায়। সরকারী বড় বড় হাসপাতাল কয়েকটা তো রয়েছেই, তাছাড়াও, শহরের এখানে সেখানে আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে বেসরকারী হোট মাঝারি আরো অনেকগুলো। দৈনন্দিন তার যাত্রাপালা পালটে পালা করে সেইসব মুক্তাঙ্গনের আসরে গিয়ে বসলেই হলো। শহরে সহৃদয় বোকা লোকের অভাব নেই বিশেষ।

নতুন নতুন ভূমিকায় নব নব রূপ ধরে অভিনয় করার প্রয়োজন সে অনুভব করেনি। একই দর্শক বা দাতার দুবাব দর্শনদানের সম্ভাবনা বিরলই ছিল। কলকাতার রাস্তায় নিজের তাড়াহুড়ায় ব্যস্ত সবাই! কে কার দিকে নজর দেয়? কে কাকে মনে করে রাখে? তাছাড়া তার নিজের নজব বেজায় সাফ, একব্যক্তিকে দুবার দোহন করে ধরা পড়ার ভয় ছিল না তার। এই বিরাট শহরে পঞ্চাশ লাখ লোক, একজনের ওপর দুবার কোপ মাবে এমন ব্যাড লাক হবার সাধ্য কি? বকরিদ-পরবের পরদিন কোন মুর্গি কি বরি-র বেঁচে থাকার মতই সেটা অবাস্তব।

শহরের প্রান্তে প্রান্তে তার অজান্তে ছোটখাট আরও কতো শিকারক্ষেত্র রয়ে গেছে। অচেনা এলাকায় ঘুরতে ঘুরতে একদিন এমনি একটা নজরে পড়ে গেল তার। প্রথমে সে খেয়াল করেনি, কিন্তু তার সামনে দিয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স গাড়ি সেখানে গিয়ে সেঁধুতেই সে ঠাওর করে দেখল, হ্যাঁ, একটা হাসপাতাল গোহেরই তো বটে ওই বাড়িটা।

ব্যান্ডেজ মাথায় বাঁধাই ছিল তার, শীর্ষদেশে তাই নিয়ে সে ঘুরে বেড়াত আজকাল, কোথায় কী তাক লেগে যায় কখন। কলকাতার পথেঘাটে তো টাকা ছড়ানো; ভালো করে তাকালেই হয় একবার। কিন্তু কোনো হাসপাতালের সামনে ছাড়া আর কোথাও কারো কাছে তার ওই মাথা খেলিয়ে সে হাত পাতে না যেও। বড়ো বড়ো গাইয়ে আসরের বাইরে গায় নাকি কখনো? অভিনয়সজা মাথায় আর অভিনয়বৃত্তি তার মজার। ভাবল, এই ফাঁকে একটুখানি বসে এখানে দু পয়সা উপায় করে নিলে মন্দ কী?

বসেহে খানিকক্ষণ, এমন সময় এক ভদ্রলোক হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন তার কাছে এসে-এখানে এমন করে বসে আছে যে বাপু?

আজ্ঞে, এই হাসপাতাল থেকে আজ ছাড়া পেয়েছি কিনা, বাড়ি যাবার গাড়িভাড়া কাছে নেই আমার, তাই…।

ও! সেইজন্যেই? তা কদ্দিন ছিলে এখানে?

দিন পনেরো থাকতে হয়েছে মশাই। ট্রাম থেকে পড়ে গিয়ে মাথাটা দু ফাঁক হয়ে গেছল আমার!

বটে? বলে অদূরে কী যেন দেখতে পেয়ে একটু আশান্বিত হয়েই তিনি বললেন-আচ্ছা, তোমার বাড়ি যাবার ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি এক্ষুনি।

একটা পুলিস ভ্যান যাচ্ছিল এখন সেখান দিয়ে সেই সময়। হাত বাড়িয়ে গাড়িটাকে থামিয়ে, কাছে গিয়ে কী যেন তিনি বললেন তার ড্রাইভারকে।

যাও, ওঠোগে। ও-ই তোমায় বাড়িতে পৌঁছে দেবে এখন। পয়সা লাগবে না।

উঠতে হলো পুলকেশকে। নিখুঁত অভিনয়ের প্রয়োজনেই উঠতে হলো। অভিনয়ে যেমন প্রবেশ আছে, অবস্থান আছে, তমনি তার অঙ্গহিসেবে প্রস্থানও রয়েছে যে। অভিনয় সবাঙ্গীণ করতে হলে সেটাকে বাদ দেওয়া যায় না।

থানায় যেতেই যেন হাসির ধুম পড়ে গেল তাকে নিয়ে। বড় দারোগা মেজ দারোগা ছোট দারোগা সবাই হাসলেন খুব খানিক। এত হাসাহাসি তার খারাপ লাগলো তার। হাসপাতালেব সদ্য ছাড়া পাওয়া মাথায় চোট খাওয়া হতভাগ্য এক রুগী—তাকে দেখে এমন হাসবার কী আছে! হাসির অভিনয় তো করছিল না সে, করুণ-রসের ভূমিকাই তো ছিল তার। কিন্তু এই হাসির ধাক্কায় তা যেন ভূমিসাৎ হবার যোগাড়! পুলিসের লোকের কোনো রসকস নেই বলে যে, তা মিথ্যে নয়। সত্যি, এমন হৃদয়হীন হয় তারা যে…

হাসির চোট থামলে একজন তাকে জিজ্ঞেস করলেন—এমনধা, গর্ব করা তোমার ঠিক হয়নি বাপু হে! এই গর্ব তোমার কতদিনের?

গর্ব! কিসের গর্ব স্যর? কাঁচুমাচু হয়ে সে জানতে চায়।

পুরুষমানুষের কি গর্ব করা সাজে ভাই? এমনধারা গর্ব করা কি উচিত হয়েছে তোমার? সত্যি, তুমিই বলো না! আরেকজনের তলব।

আমি তো কোনো গর্ব করিনি হুজুর। তার করুণ সুর আরো যেন করুণতর শোনায় কেমন।

করোনি তো ওখানে মরতে গিয়েছিলে কেন? আবার এক চোট হাসি।

এই গর্বটা তোমার কতদিনের হে? শুনি তো একবার। আরেকজনের জিজ্ঞাসা। আরেক হাসির ধুম।

আমার গর্ব! গর্ব কোথায় দেখলেন স্যর আমার?

ছি ছি ছি! গর্ব কেবল মেয়েদেরই শোভা পায়…তুমি পুরষ-মানুষ হয়ে এই গর্ব করতে গেছ…সাতপুরুষে এমন কাণ্ড দেখিনি শুনিনি। বলেন ওসি পুলকেশকে : ভিক্ষে করবে করো কিন্তু তাই বলে কি কেউ বৃথা গর্ব করে ভিক্ষে করে নাকি?

ঠিক কথা সার। ভিখিরির আবার গর্ব কিসের। সায় দেয় সে তাঁর কথায়: গর্ব করেও ভিক্ষে করতে নেই, ভিক্ষে করেও গর্ব করা ঠিক নয় কারণ ভিক্ষে করাটা। গর্বের কিছু নয়।

তোমার এই গর্বটাই তোমার এই পতনের কারণ হলো, বুঝেছ?

পতনের কারণ হলো? পুলকেশ শুনে অবাক হয়।

তিনি জানানঃ হ্যাঁ, এর জন্যে হাজতে তো যাচ্ছই এখন–হয়তো বা জেলে যেতেও হতে পারে।

জেল! জেল কিসের জন্যে হুজুর? এবার যেন সে চমকে ওঠে: গর্ব করলে পতন হয় জানি, কিন্তু তাই বলে কি জেল? তাছাড়া, আমি যখন মোটেই কোনো গর্ব করিনি….

গর্ব করলে পতন হয় এটা যখন জানো…

অন্য একজন অফিসার মাঝখান থেকে ফোড়ন কাটেন—মেয়েদের বেলা অবশ্যি পতন বার পরই গর্বটা হয়ে থাকে…

তখন এটাও তোমার জানা উচিত ছিল যে, অধঃপতনের শেষ সীমায় জেল ফাটক অনিবার্যই।

গর্ব দূরে থাক আমি গর্বের কোনো ভানও করিনি স্যর…তবুও সে বলতে চায়।

আরে, গর্ব যদি তোমার নাই হয়ে থাকে তাহলে ওই বাড়িটার ধারে কাছে গিয়েছিল। কেন? দশ মাসের গর্ব হলেই তো যায় ওখানে কেউ…

তোমার এই গর্বটা ক মাসের ছিল হে? অন্য একজনের ওপর-টিনী। —নাকি তোমার গর্বপাতের জন্যেই গিয়েছিলে সেখানে?

গর্বপাতের কথাটায় পুলকেশের কোথায় যেন খটকা লাগে কেমন। ভাষাটা যেন কেমনতরো। তব সে খট করে কিছু বুঝতে পারে না। ওর গর্ভে আরো যে কী নিহিত আছে তার কোনো আঁচ পায় না সে। কিন্তু না আঁচালে, সে যে বিচ্ছিরি কিছু করে বসেছে তা সে বিশ্বাস করবে কী করে? তবু কিছু টের না পেয়েই সেই নাটের মধ্যে আরো সে এগিয়ে যায়

আপনারা গর্ব গর্ব বলছেন বটে হজুর কিন্তু আমি তো নিজের কোনো গর্ব দেখতে পাচ্ছি না। গর্ব কাকে বলে—গর্বের মানে কী, তাই আমি জানি না এখনো।

গর্ব কাকে বলে জানো না? বলে তিনি নিজের বিপুল উঁড়ির দিকে তার নজর টানেন—এই যে! এই হচ্ছে এর মানে। তুমি এটা জানো না?…একেই বলে থাকে গর্ব।

আপনার গর্বের কারণ আছে। আপনি পদস্থ কর্মচারী, আপনার গর্ব হতে পারে কিন্তু আমি সামান্য নগণ্য লোক, এহেন কথা বলে এমন করে আমায় অপদস্থ করা আপনাদে উচিত নয় কখননা। দয়া করে তা করবেন না স্যর। এই আমার বিনীত অনুরোধ।

পুলকেশ বিনয়ে গলে পড়লেও দারোগাবাবুদের আদৌ পুলকিত দেখা যায় না। তিনি খাপ্‌পা হয়ে ওঠেন—কী গর্ব গর্ব করছো তখন থেকে! গর্ব কাকে বলে জানো না? গর্বের মানে কী, তাও বুঝি তোমার জানা নেই? গর্ব বানান করতে পারো? নাকি, তাও একদম জানো না?

আচ্ছা গাধা তো! অপর দারোগার টিটকিরি : নাকি গাধা সেজে ন্যাকামো করা হচ্ছে এখানে।

লম্বকর্ণটাকে আচ্ছা করে ধোলাই দিয়ে ভাগিয়ে দিন স্যর। এই পাগলের নামে কেস করে আর কী হবে? কোর্টে পাঠালে তো সেখানে হাসাহাসি পড়ে যাবে একচোট। আর এমন অপদার্থকে পাঠানোর চোটটা শেষে সামলাতে হবে এই আমাদের।

লম্বকর্ণ-গালটায় পুলকেশের প্রাণে লাগে। কানে সে একটুখানি খাটো হতে পারে, কিন্তু তাই বলে তার কানকে সম্মা বলা, কেবল তার কানেরই নয়, তার নিজেরও যেন মানের লাঘব। দস্তুরমন মানহানি।

কিসের কেস হুজুর? সে জানতে চায় : কেন আমায় দায়রায় সোপর্দ করবেন? কিসের দায়ে? আমি তো কোনো কসর করিনি আপনাদের কাছে।

চিটিং কে। আবার কিসের দায়? চিটিং চার্জ রয়েছে তোমার নামে। চিটিংবাজি করলে জেলে যেতে হয় তা জানো না?

চিটিংঝজি? কাকে আমি চিট করতে গেলাম স্যর? এবার সে দস্তুরমতই হতভম্ব হয়।

কেন পাবলিককে। গর্বের কোনো কারণ না থাকলেও গর্ব করা–গর্ব বানিয়ে ভিক্ষে করা—সেটা কি একটা চিটিংবাজি নয়? নয়তো কী তাহলে?

এখনো আমি মুক্তকণ্ঠে বলছি স্যর, কারো কাছে আমি কোনো গর্ব করিনি।

ফের গর্ব গর্ব করছে, গর্ব বানান করো তো…

গ আর ব-য়ে রেফ…

গ আর ব-য়ে রেফ? আস্ত একটা গবেট তুমি…। তারপর তিনি প্রাঞ্জল করেন? গ আর ভ-য়ে রেফ দিলেই গর্ভ হয়। মেয়েদের হয়ে থাকে। পুরুষদের কখনই হয় না, হতে পারে না। তুমি যে-হাসপাতালের সামনে গিয়ে বসেছিলে, যেখান থেকে খালাস পেয়েছে বলছিলে তুমি, মেয়েরাই সেখানে গিয়ে থাকে কেবল। সেখানে গিয়ে খালাস হয়; দশ মাস হলেই যায়…এই এমনিতরটা হলেই…

বলে আবার তিনি নিজের সুবিপুল সুবিন্যস্ত খুঁড়ির দৃষ্টান্তে নিজেকে উদাহরণস্থল করেন।

থানায় এসে, অ্যাদুর এগিয়ে, এতক্ষণ পরে জানল পুলকেশ—যে কথা ঘুণাক্ষরেও জানা ছিল না তার নিজের প্রয়োগনৈপুণ্য প্রকট করে অভিনয়শিল্পের solo-কলা দেখাতে গিয়ে যেখানে সে আজ বসেছিল, হাসপাতাল হলেও আসলে সেটা একটা মেটার্নিটি হোম।

গব্‌বোযন্ত্রণা আর কাকে বলে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *