কণ্ঠলগ্ন

কণ্ঠলগ্ন

ভারী সমস্যায় পড়েছি মশাই! গোবর্ধন আমার অধ্যবসায়ের মাঝখানে এসে বসল। গল্প লিখছিলাম।

কী সমস্যা? আমার নিস্পৃহ প্রশ্ন। তোমার সমস্যা তো তোর গুরুজনদেরই জানাতে হয়। তারাই তো আমার সমাধান করবেন। বাড়িতেই তো আছেন…তোমার দাদা…তোমার বৌদি…

সব কথা কি বলা যায় দাদাকে? গোবরার একটু লজ্জা-লজ্জা ভাব: দাদা কি তাহলে রক্ষে রাখবে নাকি? …আমি প্রেমে পড়েছি।

তাই নাকি হে?আমার চক্ষেরসমক্ষে যেন শরৎচন্দ্রের চরিত্রহীনের পুনর্মুদ্রণ প্রকাশিত হতে দেখলাম। নবোদিত দিবাকরের দিকে তাকিয়ে এতক্ষণে আমার একটু উৎসায়ে সঞ্চার হলো—তোমার বোদির প্রেমে পড়েই বুঝি?

ছি ছি ছি! কথাটায় গোবরা যেন কুঁকড়ে যায়—বৌদির প্রেমে কেউ পড়ে নাকি? বৌদি মায়ের মতন না?

তা বটে। সায় দিই আমি—বাচ্চা ছেলেরাই বৌদির প্রেমে পড়ে বটে! অবোধ বালক তো! যাহা পায় তাহা খায়। তোমার মতন এত বেশি বয়সে…তা বটে…বৌদি মা কেন, প্রায় পিসিমার মতই বলতে গেলে এখন।

বৌদির প্রেমে পড়ার সম্ভাবনাতে থনা হলেও ওর এই কথাটায় একটুখানি থই মেলে। কিন্তু বলতে কি, হর্ষবর্ধনের দিক থেকে আশ্বস্ত হলেও আমার উৎসাহ যেন উপে যায়। প্রায় উপেন্দ্রনাথের মতই আমি অস্তায়মান দিবাকরের দিকে কটাক্ষ করি। না, কেননা উপন্যাস নয়, উপন্যাসের মাল-মশলাও না। বৌদির পিসিমা হয়ে যাবার পর প্রেমের সীমান্তে পৌঁছে গেছি বলে আমার ধারণা হয়। আমি অন্য প্রসঙ্গে যাই–

তোমার দাদা কী করছেন এখন? আমি শুধাইঃ তোমার বৌদির কাছে ঘুর ঘুর করছেন তো?

কোনো কালেই নয়। সে বলে: যা করে থাকেন চিরকাল। জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরছেন। একা একা? আঁ, প্রকৃতিরসিক হয়ে গেল নাকি লোকটা, খটকা লাগে আমার।

না না একলা কেন? তার পাঞ্জাবী কটাক্টারের সঙ্গে ট্রাকে করে ঘুরছেন তো! গাছ বাছছেন, গাছ কাটাচ্ছেন, তারপরে ট্রাক বোঝাই করে কাঠ পাঠাচ্ছেন আমাদের কলকাতার কারখানায়। আমাদের কাঠের কারবার, জানেন না? ঐ কাঠের জন্যেই তো দাদার এই ঘাটশিলায় আসা।

তা জানি। তাঁর পাঞ্জাবী কন্ট্রাক্টারকেও জানি। জানি তার মেয়ে, কও। জানাই আমি। চমৎকার মেয়েটি। পাঞ্জাবী হলেও বাংলা বলে চমৎকার। শান্তিনিকেতনে ছিল কিনা।

বাঙালী মেয়ে বলেই মনে হয়—তাই না দাদা?

স্বাস্থ্যের দিক দিয়ে ঠিক না হলেও, তবে সৌন্দর্যের হিসেবে বলতে পারে বটে। সব সময় ঘোড়ায় চড়ে বেড়ায় মেয়েটা। আমি বলি : দাহিগড়ার দিকে গেছলাম সেদিন, আমার ভাইঝির শ্বশুরবাড়ি। আলাপ হয়েছিল সেইখানেই।

আলাপ হয়েছে আপনার সঙ্গে? এর মধ্যেই হয়ে গেছে? তির্যক দৃষ্টিতে সে আমার দিকে তাকায়।

এমনি আলাপ। এমন কিছু আলাপ নয়। আমি বলি? কিন্তু তোমার কথাটা তো বললে না? কার প্রেমে এমন করে পড়তে গেলে হঠাৎ?

বললাম তো। ঐ মেয়েটির প্রেমেই পড়েছি যে।

তাই নাকি হে? শুনে আমার তাজ্জব লাগে। কিন্তু ভেবে দেখলে বিস্ময়ের কী আছে, বিশ্ব জোড়া ফাঁদে অশ্বারোহিণীকে যদি এক গোবেচারীর সঙ্গে বাঁধে অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু তাহলেও পাঞ্জাবীকে গায় চড়ানো যায়, হাওয়ায় ওড়ানো যায়, অঙ্গে ধারণ, এমন কি পাগড়ির ন্যায় শিরোধার্য করতেও বাধা নেই, কিন্তু তাকে উদ্বাহবন্ধনে বাঁধা যায় কি? খটকাটা আমার ব্যক্ত করি।

আরে মশাই! ভাব করতেই পারছি না। বিয়ে তো ঢের পরের কথা। সে বলেঃ কী করে যে তার সঙ্গে ভাব জমাই তাইত হয়েছে সমস্যা।

ভাব করতে পারছ না?

কই আর পারছি!

কেন, পারছ না কেন?

কী করে রব! ঘোড়ার থেকে নামেই না যে মেয়েটা। কতো আর ঘোড়ার সঙ্গে তাল রেখে, ঘোড়র তাল সামলে আলাপ চালানো যায় বলুন!

ভাবনার কথাই বটে। প্রেম এমনিতেই ঘোরালো, তার মধ্যে যদি আবার ঘোড়া এসে আলো করেন তো অন্ধকার দেখতে হয় বইকি!

তাইত গোবরা ভায়া, ভাবনার কথাই দেখছি। ভালবাসার সীমান্তে গোধূলি লগ্ন, সেটা ঠিকই, কিন্তু তার আগে তো কণ্ঠলগ্ন বলে একটা রয়েছে। আগে গলায় গলায় ভাব না হলে আর তলায় তলায় না জমলে…শেষ পর্যন্ত কী কখনো বিয়ে হয়?

কী করে হবে গলায় গলায়? আমি একতলায়, সে রইল দোতলায়—দুজনে সমান স্তরের না হলে কী করে তা হবে? সমান সমান না হলে কি ভালোবাসা হয়? কথায় বলে সমানে সমানে ভালোবাসা। অন্ততঃ মাথায় মাথায় সমান তো হতেই হবে। কিন্তু পাশাপাশি না এলে তা কী করে হয় বলুন?

তা বটে! কাছাকাছি না এলে তো, ওই যে কী বলে ঐ কণ্ঠলগ্ন, তাও তো প্রায় আসবে না। আমি সায় দিই ওর কথায়।

তাহলে কী করবে ঠিক করেছ?

ভাবছি ঘোড়াটাকে খুন করে ফেলব। প্রতিদ্বন্দ্বীসুলভ প্রতিহিংস্রতা প্রকাশ পায় ওর—আমাদের মাঝখানে কোনো তৃতীয় পক্ষ রাখব না।

শুনে আমি চমকে যাই। প্রেম একটা যজ্ঞ হলেও তাকে রাজসূয় বলেই আমি জানি, রাজার মতন শুয়ে শুয়ে করবার জিনিস; কিন্তু প্রেমের জন্য অশ্বমেধ করতে যাওয়া…ঠিক গগাবর্ধনসুলভ না হলেও, হয়ত প্রেমিকের যোগ্য বলেই আমার মনে হয়।

কিন্তু সেটা করাটা কি ঠিক হবে? ঘোড়াকে খুন করলে ফাঁসি হয় কি না জানি, কিন্তু তোমার জেল হয়ে যাবে নির্ঘাত!

তাহলে কী করে কী করব! সে হতাশ হয়ে বলে: আর তো কোনো পথ দেখি

দাদা! মাঝখানে ঐ ঘোড়াতেই আটকাচ্ছে যে আমার। সখেদে সে জানায় : ঘোড়াতেই আমার গলদ হয়েছে। গোড়াতেই গলদ।

কিন্তু ঘোড়া থেকে খোঁড়া হলে চলবে কেন? আমি উৎসাহ দিই ওকে: যে মাটিতে পড়ে লোক ওঠে তাই ধরে। ওই ঘোড়া ধরেই তোমাকে এগুতে হবে ভাই!

ঘোড়া ধরে?

হ্যাঁ। ঐ ঘোড়ার কিস্তিতেই মাত করতে হবে তোমাকে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, জানো কি? সাত মি, লাভ মাই ডগ। তার মানে, কোনো মেয়ের সঙ্গে ভাব জমাতে হলে তার পেয়ারের কুকুরটিকেও ভালবাসতে হয় এক্ষেত্রেও, গোড়ায় তোমায় ঘোড়ার প্রেমে পড়তে হবে ভাই! ঘোড়ার থেকেই এগুতে হবে, তাহলেই তোমার পথ পরিষ্কার।

কী রকম? খুলে বলুন!

তুমি যদি ওর ঘোড়াটিকে ভালবাসো, তার সঙ্গে ভাব জমাতে যাও, মেয়েটি তাতে মোটেই অবাক হবে না। সন্দেহের চক্ষে দেখবে না তোমায়। ঈর্ষান্বিতও হবে না। কেননা, সেও তো তার ঘোড়াকে ভালবাসে, ভালবাসার পাত্র বলেই মনে করে। সুতরাং তোমাদের দুজনের অনুভূতি এক হয়ে গেল এইখানের নাম হলো গিয়ে সহানুভূতি। আর ওই সহানুভূতির থেকেই হয়ে থাকে ভালবাসার সূত্রপাত! বুঝতে পেরেছ?

গোবরার কতখানি বোধগম্য হয় সেই জানে, কিন্তু এক ঘাড় মাথা নেড়ে দেয়।

উৎসাহিত হয়ে আমি আরও বলি—ঘোড়া এগুলে মেয়েটাকেও এগুতে হবে; ঘোড়াও সঙ্গে সঙ্গে বাধ্য হয়েই—মেয়েটা কিছু ঘোড়া ছাড়া নয় যেকালে। ঘোড়া হাতে এলে মেয়েটি কি আর তোমার তফাতে থাকবে?

যা বলেছেন। হাসিখুশির মলাট হয়ে সে চলে যায়।

আমি কিন্তু ভাবনায় পড়ি। ভাব জমাতে গিয়ে ঘোড়ার হাতে হাতে না বলে পায়ে বলাই উচিত, বেচারা না অপঘাতে মারা যায়। এর আগে সে কোনো মানবের প্রেমে পড়েনি, কোনো মানবকও পড়েনি তার প্রেমে। কিন্তু এখন সেই প্রেমের দাবিই সইতে হবে প্রাণীটিকে। এই ধকল কি সইবে তার? এহেন বিটকেল ব্যাপার হয়ত সে বরদাস্ত নাও করতে পারে।

তবে কি না, প্রেমকে সর্বজয়ী বলে থাকে…সেইখানেই যা ভরসা! বিশ্বজয়ী প্রেম কি আর অশ্বজয়ী হতে পারে না?

তাহলেও, গোবরা যে কী কবে এগুবে তা আমি ভেবেই পাই না। ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওযা…মেয়েটির সঙ্গে ভাব জমানো, মনে হয় কষ্টসাধাই। বলতে কি, অসুবিধাটা আমি নিজেও যে বোধ করিনি তা নয়। মেয়েটি ভাব করবার মতই সত্যি, কিন্তু তার পথে ভাবনাও পদে পদে। ঘোড়ার সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে কাঁহাতক ভাব জমানো পোষায়? আর যদি গোড়াগুড়ির থেকেই তা করতে হয়…একটু কষ্টকর নয় কি? পথ কেবলই যে দুর্গম তাই না। রীতিমতন অশ্বক্ষুরলাঞ্ছিত। পরব্রহ্মের মত পরি-ব্রহ্মের পথও যদি ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা হয়, পাশাপাশি চলতে গিয়ে পাছে ঘোড়ার পায়ের চোট লাগে সেই ভয়ে পদে পদে হোঁচট খেয়ে চলতে হয়, তাহলে অবশ্যই বলতে হয়, হে দেবি, তোমার ক্ষুরে ক্ষুরে দণ্ডবৎ! আমি সটকালাম।

দিন কতক আর গোবরার দেখা নেই। অবশেষে একদিন দেখি সে কলার কাদি কাঁধে নিয়ে দাহিগড়ার দিকে চলেছে।

কোথায় চলেছ গোবরা ভায়া? আমি শুধাই : এত কলা কিসের জন্যে হে?

ভালবাসার জন্যে। সে সংক্ষেপে সারে।

প্রেমে শেষ পর্যন্ত দিতে হয় জানা কথা, কিন্তু তা কি এই কলার কাঁদিতে? ওর কথায় আমি বিস্ময় মানি।

প্রেমে বিস্তর হলা কলা আছে, জানি তা, প্রেম একটা কলাবিদ্যাও বটে, আমি বললাম। কিন্তু প্রেমিকাকে কি কেউ কলা দেখায় নাকি কখনো?

প্রেমিকাকে কেন মশাই, ঘোড়াটাকেই দেখাব তো! সে বলে: ঘোড়াটা ফল খেতে ওস্তাদ। কলা খাইয়ে খাইয়ে পটিয়েছি ঘোড়াটাকে। কলা দেখলেই সে দৌড়ে আসে। গোবরা তার পটিয়সী বিদ্যা প্রকাশ করে।

মেয়েটাও তার পিঠোপিঠি দৌড়য় তো? মানে, তার পিঠে চেপে মেয়েটাকেও আসতে হয় নিশ্চয়?

নিশ্চয়! মেয়েটাও যে হড়ার থেকে দুয়েকটা খায় না তা নয়।

কেমন? বলেছিলাম না? ঘোড়াকে পটাতে পারলে মেয়েটাও পটবে। ঘোড়ার সঙ্গে এগুতে হবে মেয়েকেও কেমন হল কিনা? কী কৌশলে ঘোড়াটাকে তুমি কাবু করবে আমি ভাবছিলাম, যাক তোমার কাজ হাসিল হয়েছে তাহলে। তোমাকে কলাকুশল বলতে হয় ভায়া।

ঘোড়াটাও আমার বেশ কলারসিক দাদা! গোবরার একগাল হাসি।–কিরকম পুরুষ্ট পুরুষ্ট মর্তমান কলা সব দেখছেন?

তা তো দেখছি! …মেয়েটাও তো তোমার কলা খায় বলছ আবার। তা মেয়েটাকে এইভাবে কলাৎকার করলেও তোমার আসল কাজ কদ্দুর এগুলো? গোধূলি লগ্নের দিকে কতটা এগিয়েছ শুনি?

বুঝতে পারছিনে ঠিক। মেয়েদের কিছু বোঝা যায় না দাদা! তবে মেয়েটার না হলেও ঘোড়াটার আমি হৃদয় জয় করেছি ঠিকই।

গোবরার হ্যত ঠিকে ভুল হয়নি। রমণীর মন সহস্র বর্ষের সাধনার ধন হলেও, এবং তার জন্যে কেউ কেউ সমরখন্দ আর বোখারা বিলিয়ে দিতে চাইলেও, কেউ আবাব ঘোড়ার জন্যও কি তাঁর রাজত্ব বিকিয়ে দিতে চাননি? হর্স! হর্স! মাই কিংডম ফব এ হর্স-বলেছিল কে? নিশ্চয় সে গোবর্ধনের চেয়ে কোনো অংশে নূ্যন ছিল না। ভালবাসার নানান রূপ-হাজার চেহারা। মোটের ওপর, হৃদয় একটা কারও পেলেই হলো! সেইটেই নেট লাভ! তা অশ্বিনী বা আ-মোহিণী যারই হোক না!

তারপর আর গোবরার দেখা পাই না। দেখা পেলাম হর্ষবর্ধনের।

কাঁচুমাচু মুখ করে তিনি হাজির।

গোবরাকে নিয়ে ভারী ভাবনায় পড়েছি মশাই! কাঁদো কাঁদো সুরে তিনি আওড়ান।

কী হয়েছে? অ্যাঁ?

কী যে তার হয়েছে তাই তো আমরা ঠাওর পাচ্ছিনে। সব সময় কেমন যেন আনমনা হয়ে থাকে। আর মাঝে মাঝে…

প্রেমে পড়েনি তো কারো?

কে জানে! কিছু তো বলে না। মাঝে মাঝে কেবল চিঁ হিঁ চিঁ হিঁ করে ওঠে। তিনি বললেন—প্রেমে পড়লে কি মানুষ চিঁ হিঁ চিঁ হিঁ করে নাকি?

চিঁ চিঁ করে বটে অনেকে, শুনেছি আমি। আমি বলি—তবে প্রেমের চিৎকার তো কতো রকমই হতে পারে। কিছু কি তার বলা যায়?

তার চালচলন কেমন ধারা যেন। এরকম বেচাল তার কখনো আমি দেখিনি। কি রকমের পাগলাটে পাগলাটে ভাব।

ঠিক সময়ে ওর বিয়ে না হওয়ার জন্যই এমনটা হয়েছে মনে হচ্ছে। যথাসময়ে যদি ওর গলায় একটাকে ঝুলিয়ে দিতেন… একজন কেউ কণ্ঠলগ্ন হলে আজ আর এমনটা হতে পারত না।

তা যখন হয়নি, এখন কী করা যায়? রাতবিরেতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ওর ওই চিহি চিহি করে ওঠাটাই আমার খারাপ লাগছে আরো। ওই বিটকেল আওয়াজে আমাদের ঘুম ভেঙে যায় মশাই! একটুও ঘুমোতে পারি না আমরা, না আমি না আমার স্ত্রী। পাশের ঘর থেকে দেয়াল ছুঁড়ে যেন তেড়ে আসে আওয়াজটা। আমার স্ত্রী বলছিলেন কোনো ঘোড়াভূতে ওকে ধরেছ হয়ত…?

মানুষ মরলেই তো ভূত হয় জানি। ঘোড়া মরলে কি ভূত হয় নাকি? ঘোড়াদের কি আত্মা আছে? বলে আমি ওঁকে অভয় দিই—না না, ওসব কিছু নয়টয়। ভূতটুত নয় কিছু।

কিন্তু তাহলেও আমার ভয় হয়, সেই ঘোডাটা ভালবেসে ওকে কামড়ে দেয়নি তো? কণ্ঠলগ্ন হয়ে ওর ঘাড়ে যদি দাঁত বসিয়ে দিয়ে থাকে তাহলে কুকুরে কামড়ালে যেমনটা লোক ঘেউ ঘেউ করে আর জলাতঙ্ক দাঁড়ায়…আমার কেমন যেন সন্দেহ হতে থাকে।

ঘাস দিয়ে দেখেছেন? ওর মুখের সামনে ঘাস ধরে দিয়ে দেখবেন তো, খায় কিনা। যদি খেতে না চায়, আর চিহি চিঁহি ডাক ছাড়ে…।

কী যা তা বলছেন! ঘাস খেতে চাইবে সে! ডাল ভাতই তার মুখে রোচে না আজকাল! খেয়ে খেয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে দিনকের দিন! কী যে হলো ছোঁড়াটার।

তাহলে ডাক্তার দেখান এক্ষুনি। দেহের নয়, ওর মনের চিকিৎসা করানো দরকার। এমন ডাক্তার যিনি মনোবিকলন করতে পারেন…।

মনোবিকলন! সে আবার কী মশাই? হর্ষবর্ধন হতবাক হন।

মনের কলকজা বিগড়ে গেলে যিনি মেরামত করতে জানেন এমন ডাক্তার। আমি বিশদ করি : গোবরা ভায়ার বিকল মনকে যিনি আগের মত অবিকল করে দিতে পারবেন আবার।

এমন কোনো ডাক্তার কি জানা আছে আপনার?

কলকাতার থেকে কদিন হলো একজন এখানে বেড়াতে এসেছেন বলে শুনেছি, তার কাছে নিয়ে যাওয়া যায় এখুনি।

গেলাম তার কাছে গোবরাকে নিয়ে সহর্ষবর্ধন।

দেখুন তো ডাক্তারবাবু, আমার ভাইয়ের কী হয়েছে। দিনরাত কী সব আবোল-তাবোল বকে। তিনি বলেন-আর মাঝে মাঝে…সময়ে বিয়ে দিইনি, সেইজন্যেই কিনা কে জানে!

কী হয়েছে আপনার? শুধান ডাক্তারবাবু গোবরাকে।

আমি প্রেমে পড়েছি! মুক্তকণ্ঠে জানিয়ে দেয় গোবরা।

সে আর অবাক হবার কি? বললেন ডাক্তার : আপনার বয়সে সকলেই প্রেমে পড়ে। তাতে দোষের কিছু দেখি নে।

কিন্তু আমি—আমি যে একটা ঘোডাকে ভালবেসেছি মশাই।

তাতে কী! তাতেই বা কী? লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবজন্তুদের ভালবাসে! কেউ পাখি, কেউ কুকুর, কেউ বা বেড়াল। ঘোড়ার প্রেমে পড়ে বাজি ধরে কত লোক ফতুর হয়ে যায় পর্যন্ত।

সে ভালবাসা নয় ডাক্তারবাবু! রীতিমতন গভীর প্রেম যাকে বলে। তার জন্যে প্রাণ কাঁদে আমার। রাত্তিবে সেই ঘোড়াটার আমি স্বপ্ন দেখি।

বটে? তা, সেটা মন্দা ঘোড়া না মাদী ঘোড়া?

আপনি পাগল হয়েছেন ডাক্তারবাবু? আমি পুরুষ মানুষ হয়ে একটা মদ্দা ঘোড়ার প্রতি আসক্ত হবো? বলেন কী আপনি? মেয়ে ঘোড়া আলবাৎ! আমার কি মাথা খারাপ হয়েছে নাকি? তাই আপনি ঠাউরেছেন আমায়…?

না, তা কেন ভাবব! তবে…

তবে আমার কী মনে হয় জানেন ডাক্তারবাবু? তাঁর কথার মাঝখানে বাধা দিয়েছেন দাদা : গোবরাটা ছোট বেলার থেকেই আমাকে ভীষণ ভালবাসে। ভ্ৰাতৃভক্ত বেজায়। আর আমার নাম হর্ষবর্ধন। আর জানেন তো——হর্ষ মানে হচ্ছে ঘোড়া…ছোঁড়াটা আমার প্রেমে পড়ে যায়নি তো? সেইটাই আমার সন্দেহ। সহর্ষ হয়ে তিনি জানান।

তা কী করে হবে! হতভম্ব হয়ে ঘাড় নাডেন ডাক্তার : হর্স মানে ঘোড়া বটে, কিন্তু যে ঘোডা ঘাস খায়…আপনি কি আর ঘাস খান? সেই হর্স কি আপনি নাকি?

তালগোল পাকিয়ে ডাক্তারেরই যেন মাথা খারাপ হয়ে যাবার মতন হয় তখন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *