1 of 4

২.০৫ সিন্দাবাদের পঞ্চম সমুদ্র-যাত্রা

সিন্দাবাদের পঞ্চম সমুদ্রযাত্রা

নাস্তাপানি সেরে আবার বৃদ্ধ সিন্দবাদ তার জীবন কাহিনী বলতে শুরু করলো :

আমার চতুর্থ অভিযানের পর বেশ কিছুকাল আমি ইয়ার বন্ধুদের নিয়ে ফুর্তি করে দিন কাটাতে থাকলাম। কালক্রমে সবই ফিকে হয়ে আসে। সেই নিদারুণ দুখকষ্ট আর অনুভব করতে পারি না। শুধু মনে থাকে বিশাল ঐশ্বর্যপ্রাপ্তির ছবিগুলো। অন্তর থেকে তাগিদ। আসে—বাণিজ্যে যাও, সিন্দবাদ বেরিয়ে পড়, ঘরের কোণে বন্দী হয়ে থাকা তোমার ধর্ম নয়।

বাগদাদের বাজার থেকে দামী দামী দুষ্প্রাপ্য জিনিসপত্র সংগ্রহ করলাম। একখানা আনকোরা নতুন জাহাজ কিনে বোঝাই করলাম। সব। অভিজ্ঞ একজন কাপ্তেনকে মোটা মাইনেয়। বহাল করলাম। এবার আমি সঙ্গে নিলাম চাকর নফর বান্দা। এরা আমাকে দেখাশুনা করবে, জাহাজের কাজ কাম করবে। যারা জাহাজে ওঠার আগে ভাড়া চুকিয়ে দেয়। সেইরকম কিছু বাছাই করা সওদাগর নিলাম।

দিনক্ষণ দেখে, আল্লাহ নাম করে বসরোহর বন্দর থেকে যাত্রা করলাম আমরা। চলার পথে অনেক শহর বন্দর আসে। আমরা যথারীতি সওদা ফিরি করি। আমাদের দেশের জিনিস তাদের কাছে বিক্রি করি। তাদের দেশের দুষ্প্রাপ্য জিনিস কিনে নিই। অন্য দেশে চড়া দামে বিক্রি হবে-এই আশায়।

চলতে চলতে একদিন এক দ্বীপের নিশানা দেখতে পেলাম। মনে হলো, জন-বসতি নাই। শুধু বন জঙ্গল আর ধূ করা প্রান্তর। আরো কাছে আসতে মাস্তুলের উপরে উঠে দেখলাম দুই গোলাকৃতি গম্বুজের মতো সাদা দুটি অদ্ভুত বস্তু। বুঝতে কষ্ট হলো না-এ হচ্ছে রক পাখীর ডিম। এমন বিচিত্র বস্তু দেখার সৌভাগ্য ক’জনের হয়? সঙ্গী সাখীরা বললো, আমরা গল্প শুনেছি, আপনার মুখে, এবার যখন সুযোগ এসে গেলো; জাহাজটা একবার ভেড়ান, দেখে আসি।

দ্বীপের কিনারে ভিডিয়ে জাহাজটা নোঙর করা হলো। আমি ছাড়া সকলেই মহাউল্লাসে নেমে গেলো। আমি বললাম, আমার তো দেখা জিনিস। আমি আর যাবো না, জাহাজেই থাকছি। আপনারা দেখে আসুন। আর তা ছাড়া জাহাজখানা একেবারে অরক্ষিত রেখে সবাই মিলে দল বেঁধে নেমে যাওয়াও ঠিক না।

একটু বাদে সঙ্গীরা ফিরে এসে যা বর্ণনা দিলো, শুনে ভয়ে আমার হৃৎপিণ্ড কাঁপতে লাগলো। ডিম দুটো ওরা সবাই মিলে ঠেলে এক চুল নড়াতে পারেনি। শেষে বিরাট দু’খানা পাথরের চাই জুড়ে মেরেছিলো। পাথরের আঘাতে ডিম দুটো ভেঙ্গে একপ্রকার গোলা-পদার্থনির্গত হতে থাকে। শেষে বেরিয়ে আসে রক পাখীর দুটো কচি বাচ্চা।

আমি বললাম, কী সর্বনাশ করেছেন, আপনারা। এখুনি ওদের মা-বাবা আমাদের খতম করে ফেলবে। রক পাখীরা সাধারণত মানুষের কোনও ক্ষতি করে না। কিন্তু একবার যদি তারা বুঝতে পারে, তাদের অনিষ্ট করার জন্য চেষ্টা করছে। কেউ—তার আর রক্ষা নাই। আর একমুহূর্ত এখানে নয়। এখনি নোঙর ওঠাও। জাহাজ ছাড়ো।

তাড়াহুড়ো করে নোঙর তুলে আমরা জাহাজ মাঝদরিয়ায় নিয়ে এলাম। মনে হলো এ যাত্রা বুঝি বিপদ কেটে গেলো; কিন্তু না। সবে তখন আমরা খানা-পিনা পাকাতে আরম্ভ করেছি এমন সময় দূর আকাশে দুখণ্ড কালো মেঘ দেখলাম। ভয় হলো; হয়তো তুফান উঠবে। কিন্তু না, সে আমাদের ভুল। মেঘ নয়, দুটি রক পাখী শোঁ শোঁ করে নিচের দিকে নেমে আসছে। তাদের পায়ে ধরা দু’খানা বিশালাকৃতির পাথরের চাই। তার যে কোনও একখানা আমাদের জাহাজের চাইতেও বড়।

আমাদের তো হাত পা ঠাণ্ডা হওয়ার জোগাড়। একটা পাখি একখানা পাথর তাক করে ছেড়ে দিলো। আমাদের কাপ্তেন ছিলো চৌকস। ক্ষিপ্র হাতে সে হাল ঘুরিয়ে নিমেষে জাহাজখানা বেশ খানিকটা সরিয়ে নিয়ে যেতে পারলো। যে জায়গায় জাহাজখানা ছিলো সেখানে থাকলে পুরো উদ্ভট পাথরের চাইটা এসে পড়তো জাহাজের ঠিক মাঝখানে। যাই হোক, প্রথম ফাড়াটা কাটলো। পাথরটা পড়লো একটু দূরে জলের উপর। বিরাট একটা পুকুরের মতো গর্ত হয়ে গেলো সমুদ্রের জল। কিন্তু সে মুহূর্তের জন্য মাত্র। তারপর চারপাশ থেকে উত্তাল জলরাশি এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো সেই গর্তের ওপর। প্রচণ্ড ঢেউ-এর সৃষ্টি হলো। আমাদের জাহাজ দুলতে থাকলো।

আমরা তখন আতঙ্কিত হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। আর একটি রক এর পায়ে আর এক খণ্ড পাথর আছে। সে তাক করছে—জাহাজের ওপরে ফেলবে। আমাদের কাপ্তেনের শ্যেন চক্ষু তার পায়ের দিকে নিবদ্ধ। পা দুটো আলগা করতেই তীর বেগে নেমে আসতে থাকে পাথরখানা। কাপ্তেন হালে মোচড় দিতে থাকে। জাহাজখানা প্রায় ঘুরিয়ে ফেলেছিলো সে। কিন্তু একটুর জন্য সর্বনাশ ঘটে গেলো। জাহাজের এক দিকের গলুই-এর উপর প্রচণ্ডভাবে আঘাত করে জলে পড়ে গেলো পাথরখানা। আর সঙ্গে সঙ্গে জাহাজখানার সামনের খানিকটা অংশ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো। বাকী আমরা যারা পাথর চাপা পড়লাম না, তাদেরও বাঁচার কোনও নিশ্চয়তা রইলো না। কারণ মুহূর্তের মধ্যেই জাহাজখানার সলিলসমাধি ঘটে গেলো। কে কোথায় গেলো বলতে পারবো না, আমি একখণ্ড ভাঙ্গা জাহাজের কাঠ ধরে ভাসতে লাগলাম। অনেক কসরৎ করে কাঠের তক্তগটার উপরে উঠে বসে দুই পা দিয়ে দাঁড় কাটতে কাটতে চলতে থাকলাম। এইভাবে চলতে চলতে এক সময় এক দ্বীপের কিনারে এসে ভিড়লাম। শরীরে শক্তি বলে আমার কিছু নাই। কোনওরকমে কুলে নেমে বালির বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। এইভাবে ঘণ্টাখানেক মড়ার মতো অসাড় হয়ে পড়ে থাকার পর উঠে দাঁড়িয়ে দ্বীপটার ভিতরে ঢুকে পড়লাম।

একটু এগোতেই মনোরম এক উদ্যানে এসে পড়ি। গাছে গাছে সোনার বর্ণের পকা ফল, নানারকম রঙের বাহারী সব ফুল, সুন্দর সুন্দর পাখি, রূপের মতো ঝকঝকে ঝর্ণার আর মখমলের মতো ঘাসের গালিচা। দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো। গাছের ফল আর ঝর্ণার জল খেয়ে তৃপ্ত হলাম।

এমন সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

তিনশো সাততম রজনীতে আবার সে শুরু করে :

সন্ধ্যার কালো ছায়া নেমে না আসা পর্যন্ত আমি সেই বাগিচার তৃণশয্যায় শুয়ে শুয়ে বিশ্রাম করলাম। এতক্ষণ বেশ ভালোই কাটছিলো। কিন্তু রাত্রির অন্ধকারে সেই অচেনা অজানা দ্বীপে নিজেকে বড় অসহায় মনে হলো। ভয়ে গা ছমছম করতে লাগলো। যদিও আমার চারপাশে নানা সৌন্দর্যের সমারোহ, তবু আমি ক্রমশ ভীত শঙ্কিত হতে থাকলাম। সুতরাং ঘুম এলো না চোখে। সারাটা রাত একরকম জেগে জেগেই কেটে গেলো। ভোরের দিকে একটু তন্দ্রাভাব হয়েছিলো। তার মধ্যে দেখলাম বিশ্ৰী সব দুঃস্বপ্ন।

সকাল হতে অনেকটা সুস্থির হতে পারি। ঠিক করলাম, আজ আমি দ্বীপটা ঘুরে ঘুরে দেখবো। কিছু দূর যেতেই একটা ছোট্ট জলপ্রপাত চোখে পড়লো। তার এক পাশে একটা সাঁকে। সেই সাঁকোর এক প্রান্তে প্রায় উলঙ্গ একটি বৃদ্ধ মানুষ বসে ছিলো। গাছের পাতার আচ্ছাদনে কোনরকমে সে লাজ নিবারণ করেছে। আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাতে লাগলো। ভাবলাম, আমারই মতো কোনও হতভাগ্য, হয়তো জাহাজ ডুবি হয়ে সর্বস্ব খুইয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, শেখ সাহেব, আপনার এই দশা কেন? কী হয়েছিলো?

কিন্তু সে কোনও জবাব দিলো না। হাতের আর চোখের ইশারা করে কি যেন বোঝাতে চাইলো। বেশ কিছুক্ষণ পরে আমি ওর মনের কথা বুঝতে পারলাম। ও বোঝাতে চাইছে, আমার চলার শক্তি নাই। তুমি আমাকে কাঁধে করে ঐ বাগানে ঝর্ণার ধারে নিয়ে যেতে পোর? আমার খুব তেষ্টা পেয়েছে।

আমি বোঝালাম, এ আর বেশি কথা কী! এসো, তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি।

বুড়ো অক্ষম মানুষের উপকার করলে পরকালের কাজ হয়। বৃদ্ধকে আমি কাঁধের ওপর বসিয়ে নিলাম। দুহাত দিয়ে সে আমার গলাটা জড়িয়ে ধরে বসে রইলো। সেই বাগিচার ঝর্ণার পাশে এসে ওকে নামাতে চেষ্টা করি, কিন্তু লোকটা আমাকে শক্ত করে চেপে ধরে থাকলো। হাত দিয়ে আমার গলাটা এমনভাবে পেচিয়ে ধরলো; মনে হলো, এখুনি আমি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরে যাবো। প্রাণপণে তার হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু না, তার হাতের লোহার মতো পেশী একচুল সরানো গেলো না। তবে কি, লোকটা আমাকে শ্বাস রোধ করে মেরে ফেলে। দেবে? মৃত্যুর আতঙ্কে আমি শিউরে উঠলাম। তারপর আর মনে নাই। কখন আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গেছি, বলতে পারবো না। যখন জ্ঞান ফিরলো, দেখি, লোকটা তখনও আমার ঘাড়ের উপর বসে আছে। শুধু তফাৎ এই, আমাকে অচৈতন্য দেখে হাতটা একটু আলগা করেছিলো সে। কিন্তু যেই আমার সাড়া পেলো আবার সে বিজুবেডিতে চেপে ধরলো আমার গলা। আমি ছাড়াবার প্রাণপণ চেষ্টা করি। কোনওরকমে নিজেকে মুক্ত করেছি মাত্র, এমন সময় সে প্রচণ্ড এক লাথি মারলে আমার পেটে। আমি যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠি। সে আমাকে উঠে দাঁড়াতে ইশারা করলো। ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আবার সে লাফিয়ে উঠলো আমার ঘাড়ে। পা দু’খানা ঝুলিয়ে দিলো আমার বুকের ওপর। হাত দিয়ে এঁটে ধরলো আমার গলা। তারপর ইশারা করলো-ফলের গাছের তলায় নিয়ে যেতে। আমি নিরুপায়। সে বৃদ্ধ হলে হবে কি, তার গায়ে অসুরের বল। তা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আমার নাই।

আমার কাঁধে চেপে সে গাছের নিচে এসে ফল ছিঁড়ে খেলো। আমাকে ইশারা করে ঝর্ণার কাছে নিয়ে গেলো। ঝর্ণার জল খেয়ে আবার সে আমাকে অন্য দিকে নিয়ে চললো। এইভাবে সারাদিন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাকে নাস্তানাবুদ করতে থাকলো। আমি তার হাতের খেলার পুতুল হয়ে, তার ইচ্ছা পূরণ করতে লাগলাম। রাত্ৰিবেলায় সে আমাকে চেপে ধরে শুয়ে রইলো। কিছুতেই নিস্কৃতি পেলাম না।

এইভাবে দিনের পর দিন সেই জানোয়ারটা আমার ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালাতে থাকে। আমি ভেবে পাই না, কি ভাবে এই বাঁদরটার হাত থেকে রক্ষণ পাবো।

একদিন ওকে কাঁধে নিয়ে চলতে চলতে এক দ্রাক্ষা কুঞ্জে ঢুকে পড়লাম। থোকা থোকা পাকা আঙুরের অরণ্য। আমার মাথায় একটা ফন্দী এলো। পাশেই দেখলাম, একটা লাউ গাছ। একটা পাকা লাউ-এর বশ ছিঁড়ে এনে তার ভেতর থেকে কুরে কুরে বিচি। আর শাসগুলো বের করে ফেলে দিলাম। তারপর আঙুর ছিঁড়ে এনে ভরলাম সেই লাউ-এর খোলে। মুখটা ভালো করে বন্ধ করে একটা গর্ত খুঁড়ে পুতে রাখলাম। কয়েক দিন পরে আঙুরগুলো পচে পচে গাজলা কাটতে থাকে। আমি লাউ-এর খোলটা তুলে এনে খুলে দেখলাম, বেশ টলটলে মদ তৈরি হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে কয়েক চুমুক খেয়ে নিলাম। খুব বেশী খেলাম না। একটু পরেই মদের ক্রিয়া শুরু হলো। ধীরে ধীরে শরীরটা আমার হাল্কা তুলোর মতো মনে হতে লাগলো। ঘাড়ের ওপর অত বড় যে বোঝা-তখন আর তেমন ভার বলেই মনে হলো না। স্মৃর্তিতে নেচে উঠলো আমার মন। আনন্দে ধেই ধেই করে নাচতে লাগলাম।

আমার এই অস্বাভাবিক অবস্থা এবং অসাধারণ বল দেখে সে ঘাবড়ে গেলো। কিন্তু সে মুহূর্তমাত্র। তারপর আমাকে একটা গোত্তা মেরে ইশারা করলো-ঐ লাউ-এর খোলের জিনিসটা খাবে সে। তার ধারণা হয়েছিলো, ঐ পদার্থটা খেয়েই আমার শরীরের তাগিদ অনেক বেড়ে গেছে। এইভাবে আমি শক্তিধর হতে থাকলে সে হয়তো আমাকে আর কাবু করে রাখতে পারবে না। তাই, সে-ও আরও শক্তি সঞ্চয় করতে চায়।

আমি হাসলাম। লাউ-এর মদটা ওর হাতে দিলাম। প্রথমে অল্প একটু চেখে দেখলো। বেশ মিষ্টি মিষ্টি টকটক বঁঝালো বস্তু। ঢকঢ়ক করে সবটা সে উজাড় করে গলায় ঢেলে দিলো। অতখানি কড়া মদ পেটে পড়ার পর দারুণ ক্রিয়া শুরু হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে নেশায় বুদ হয়ে গেলো। হাত পায়ের বাঁধন আলগা হয়ে পড়লো। এই সুযোগে প্রচণ্ড এক ঝাকানী দিয়ে আমি তাকে মাটিতে ফেলে দিলাম। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু টাল সামলাতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো। আমার মাথায় তখন প্রতিশোধের খুন চেপে উঠেছে। একখানা পাথরের চাই তুলে এনে ওর মাথায় ছুঁড়ে মারলাম। লোকটা গোঙাতে লাগলো। এবার আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে পাথরখানা দিয়েবাড়ি মারতে তার মাথার খুপরীটা খুলে ফেললাম।

এইভাবে সেদিন সেই শয়তানের হাত থেকে রেহাই পেলাম।

রাত্রি শেষ হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

তিনশো আটতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

বুড়োটাকে হত্যা করার পর আমার দেহের বল আর মনের স্মৃর্তি দশ গুণ বেড়ে গেলো। আমি মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে সমুদ্র সৈকতের দিকে এগিয়ে গেলাম। তখন সবে মাত্র একখানা জাহাজ কিনারায় ভিড়ে নোঙর করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজের কাপ্তেন এবং অন্যান্য যাত্রীরা নেমে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা এই দ্বীপে নামলেন কেন? এখানে তো কোনও জন-বসতি নাই!

কাপ্তেন বললো, জানি। কিন্তু এখানে একটা ঝর্ণা আছে। তার জল বড় মিষ্টি। আমরা জল আর ফল সংগ্রহ করতে যাচ্ছি। কিন্তু তুমি? তুমি এখানে কি করে এলে?

আমি আমার দুর্ভাগ্যের কাহিনী সবটুকুই সংক্ষেপে বললাম।

কাপ্তেন চোখ কপালে তুলে বললো, সর্বনাশ! তুমি ঐ শয়তান বুড়োটার খপ্পরে পড়েছিলে? যে-সব নাবিক একবার তার পাল্লায় পড়েছে—জান নিয়ে আর ফিরতে পারেনি। শয়তানটার দাবনাতে এত জোর-দুই পায়ের চাপেই মানুষকে মেরে ফেলতে পারে। তোমার এই জোয়ান বয়স, আর তাগড়াই স্বাস্থ্য—তাই তুমি সামলাতে পেরেছ। তা না হলে তার হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া শক্ত ছিলো। ঐ বুড়ো শয়তানটা ‘সমুদ্রের আতঙ্ক’ নামে কুখ্যাত ছিলো। যাক, তাকে মেরে ফেলে তুমি অনেক মানুষের প্রাণ বাঁচালে।

কাপ্তেন আমাকে তার জাহাজে নিয়ে গেলো। আমার পরনের পোশাক আশাক প্রায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলো। সে আমাকে নতুন সাজপোশাক দিলো পরতে।

জাহাজ ছেড়ে দিলো। অনেক দিন চলার পর এক সুন্দর বন্দরে ভিড়লো আমাদের জাহাজ। স্থানীয় লোকদের জিজ্ঞেস করে জানলাম, জায়গাটার নাম বাঁদর-শহর। তার কারণ, হাজার হাজার অদ্ভুত জাতের বাঁদর বাস করে এই শহর বন্দরের গাছে গাছে।

একজন সওদাগরকে সঙ্গে নিয়ে আমি তীরে নামলাম। ইচ্ছা ছিলো, শহরের কোথাও যদি একটা কাজ-কাম জোগাড় করতে পারি। বন্দর পিছনে রেখে আমরা শহরের পথে এগিয়ে যেতে থাকি। আমার সঙ্গী সওদাগরটি বড় সদাশয় মানুষ। আমাকে একটা কাপড়ের থলে দিয়ে বললো, পাথরের নুডিতে ভরে নাও থলেটা। শহরের সদর ফন্টকে চলো, সেখানে দেখবে, তোমার মত আরও অনেকে থলে ভর্তি পাথরের নুডি নিয়ে অপেক্ষা করছে। এক এক করে আরও অনেকে এসে দাঁড়াবে সেখানে। সবারই হাতে থলে ভর্তি পাথরের নুডি। তারপর ওরা যেখানে যাবে, ওদের সঙ্গে সঙ্গে তুমিও যাবে। ওরা যা করবে তুমিও তাই করবে। দেখবে তোমার অনেক লাভ হবে।

সওদাগরের কথা মতো থলেটা বোঝাই করলাম পাথরের নুডিতে। কাঁধে করে নিয়ে চললাম শহরের সদর ফটকের সামনে। সওদাগরের কথাই ঠিক, কিছু লোক দাঁড়িয়েছিলো। সেখানে। সকলেরই কাঁধে আমার মতো একটা করে নুডি বোঝাই থলে। কিছুক্ষণের মধ্যে আরও অনেকে এসে জড়ো হলো। তাদের কাঁধে একটা থলে। আমরা সকলে সংঘবদ্ধ হয়ে পাহাড়ের দিকে এগোতে থাকলাম। এক জায়গায় এসে দেখি, অসংখ্য লম্বা লম্বা গাছ। এগুলোকে এরা নারকেল গাছ বলে। গাছের মাথায় বেশ বড় বড় কাঁদি কাঁদি এক জাতের ফল। এর ওপরের খোসটা বেজায় শক্ত। কিন্তু ভিতরে মিষ্টি জল আর ধবধবে সাদা সন্দেশের মতো শাঁস। এদেশের লোকের খুব প্রিয় খাদ্য। একে এরা নারকেল বলে। এই নারকেল গাছের মাথায় বাঁদরের বাসা।

আমরা সবাই মিলে পাথরের নুড়ি ছুঁড়ে ছুঁড়ে বাঁদর খেপাতে লাগলাম। বদরগুলো পাথরের আঘাত পেয়ে রাগে ফুঁসতে থাকে। নারকেল ছুঁড়ে ছুঁড়ে আমাদের মারে। কিন্তু আমরা তাদের তাক বুঝে পাশ কাটাই। নারকেলগুলো এক এক করে থলোয় ভরে নিই। এইভাবে থলেটা বোঝাই হয়ে গেলে সে দিনের মতো ফিরে আসি। শহরের বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করি। বেশ ভালো দামেই বিক্রি হয়। এ এমন সওদা-সবটাই লাভের।

এইভাবে প্রতিদিন সকালে আমরা দল বেঁধে বাঁদর খেপাতে যাই। ফিরে আসি নারকেল বোঝাই বস্তা নিয়ে। বাজারে বিক্রি করে পয়সা রোজগার করি।

কয়েক দিনে বেশ কিছু জমে গেলো। এবার আমরা মুক্তো-সমুদ্রে যাত্রা করবো। হিসেব করে। দেখলাম, আমার জাহাজের ভাড়া জোগাড় হয়ে গেছে। এর পরে যেসব নারকেল সংগ্রহ করে। আনলাম সেগুলো আর এই শহরে বিক্রি না করে জাহাজে এনে তুললাম। আমাদের যাত্রা পথে যে সব বন্দর পড়বে সেখানে আরও ভালো দামে এগুলো বিক্রি হবে।

হলোও তাই। এইভাবে হাতে কিছু পয়সা জমিয়ে ফেললাম। এর পর আমরা মুক্তো সমুদ্রে এসে মুক্তো সন্ধান করতে থাকি। কোনও কোনও ঝিনুকের খোলে মুক্তো পাওয়া যায়। কিন্তু সকলের ভাগ্যে মুক্তো মেলে না। আমার নসীব সাধ দিলো। যতগুলো ঝিনুক খুলি তার বেশিরভাগেই মুক্তো পাই।

হাতে অনেক টাকা এসে গেলো। বাড়ির জন্য মন চঞ্চল হয়ে উঠলো। আমি আর সেখানে অপেক্ষা করলাম না। একখানা নৌক ভাড়া করে বসারহয় এসে পৌঁছলাম। সেখান থেকে বাগদাদ নিজের দেশে এসে নামলাম।

এর পর আত্মীয় পরিজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে সুখে স্বচ্ছন্দে দিন কাটাতে থাকলাম।

এই হলো আমার পঞ্চম সমুদ্র যাত্রার কাহিনী।

বৃদ্ধ সিন্দবাদ ক্ষণকালের জন্য থামালো। তারপর কুলি সিন্দাবাদের হাতে একশোটা মোহর গুঁজে দিয়ে সবাইকে বললো, এসো, এবার আমরা খানা পিনা সেরে নিই। কাল আবার তোমাদের শোনাবো। আমার আর এক অভিযানের কাহিনী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *