৩. টেলিগ্রামের থেকে চোখ তুলে

কল্পনা টেলিগ্রামের থেকে চোখ তুলে আমার মুখে তাকালো এবং আমার থেকে চোখ নামিয়ে ফের টেলিগ্রামের দিকে।

এক্ষুনি চলে এসো—পিসিমা। বিড় বিড় করলো সেঃ পিসিমা কেন ডেকেছেন আঁচ পাচ্ছে কিছু?

বিশেষ করে ভেবে অবশেষে আমি বলি, গম্ভীর মুখেই বলি—আমার যা মনে হয়—হয়তো খুব অদ্ভুত শোনাবে, তবু এরমকটাও হওয়া সম্ভব—এর মানে হচ্ছে, চলে এসো চটপট। তাই কী?

তোমার মুণ্ডু! কল্পনার মুখঝামটা শোনা যায়? পিসীমার ভালোমন্দ কিছু হওয়া তো সম্ভব নয়—কী বলে?

এক হিসেবে সেকথা সত্যি। শ্রীশ্রীপিসীমা ভালোমন্দের অতীত। অপর পক্ষে, যাঁরা নিরপেক্ষ বিচারক তাঁদের মতে পিসীমার ভালো কিছুই নেই-হতেও পারে না; বরং মন্দ বলতে যাকিছু আছে সমস্তই তাতে বর্তমান। এবং আরো আরো বহুৎ মন্দ তাঁর আবশ্যম্ভাবী। অবশ্যি, এটা দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য মাত্র।

কী করবে ভাবছো? কল্পনা জিজ্ঞেস করে। —যাবে?

ক্ষেপেছো! এই দারুণ বর্ষায় শিলং-এর কথা ভাবতেই আমার হৃৎকম্প হচ্ছে—সেখানে না গিয়েই। ওকথা ভুলে যাও।

এবং আমরা ভুলে গেলাম। সন্ধ্যে পর্যন্তই। ইতিমধ্যে বাংলা মুলুকের টেলিগ্রাফের তার আরেকবার মোড খেয়েছে—আর তার আর্তনাদ আরেকটি খাকি রঙের খামে সন্ধ্যের মুখে আমাদের শান্তিকুঞ্জে ভেসে এসেছে।

জবাব নেই কেন দাঁড়ি চলে এসো এক্ষুনি দাড়ি নাটকটা এনো দাঁড়ি জরুরী পিসিমা। এতগুলি দাঁডি তারবার্তা থেকে পাওয়া গেল—পিসিমার তারস্বরের সঙ্গে। হাতে স্বর্গ পাওয়ার মতই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পেলাম।

ওঃ! চেঁচিয়ে ওঠে কল্পনা : তাই তো! ঠিকই তো!

য়্যাঁহ?

পিসিমার বিখ্যাত লোকদের সঙ্গে মেলামেশার চিরকেলে বাতিক, ভুলে গেছ? সে মনে করিয়ে দেয়ঃ বোঝা যাচ্ছে, পিসিমার বাড়িতে—মানে, পিসিমা সম্প্রতি কোনো পায়াভারী কাউকে—মানে হোমরা চোমরা কেউ সেখানে অতিথি হয়ে এসেছেন।

এসেছেন তো কী হলো?

কল্পনা আমাকে ঘরের মধ্যে ঠেলে দেয় : বোকো না, যাও। জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও গে। নাটকটাও নিয়ে। পিসিমা, কোনো থিয়েটারওয়ালা কি ফি-ডিরেক্টর কাউকে গেরেপ্তার করেছেন, টের পাচ্ছো না?

আমি লাফিয়ে উঠলাম তৎক্ষণাৎ। এরকমটা হলে অবশ্যি আলাদা কথা—এবং তাহলে এপর্যন্ত পিসিমা সম্বন্ধে যা বক্রোক্তি করেছি তার প্রত্যেকটি কথা প্রত্যাহার করতে আমি প্রস্তুত। পিসিমা যদি কল-কৌশলে কোনো হোমরা চোমরাকে পাকডে আমার নাট্যকারু সম্পর্কে থিয়েটার ও সিনেমাজগতের এতাবৎ শোচনীয় মন্তব্য পালটে দিতে পারেন, তাহলে এত খরচ করে কষ্ট স্বীকার করে শিলং যাওয়ার মজুরি পুষিয়ে যায়—নিঃসন্দেহেই।

 

শিলংয়ের সুশোভন দৃশ্যপট দেখতে দেখতে বিকেল নাগাদ তো পিসিমার আবাসে পোঁছানো গেল। দরজায় পোঁছে, নিজেদের আমরা টান করে নিলাম, কৃষ্টিসুলভ দৃষ্টি এবং কৃচ্ছসাধ্য উজ্জ্বল এক প্রস্থ হাসি উভয়ের মুখে জোর করে ফুটিয়ে তুললাম। বৈকালিক। চা-পানে নিযুক্ত হোমরাও চোমরাও লোকের সামনে ঝোড়ো কাকের মত অনাথ আতুররূপে উপস্থিত হয়ে তো কোনো লাভ নেই।

কিন্তু হোমরাও চোমরাও কেউ ছিল না সেখানে। আরো খারাপ, চায়ের কোনো ব্যবস্থাও। তবু পিসিমা সেখানে ছিলেন। এবং দর্শনমাত্র প্রথম কথাই তিনি পাড়লেন?

নাটকটা এনেছো?

নিশ্চয়, কিন্তু কোথায় তোমার—

পড়ো, শুনি আগাগোড়া। হুকুম হোলো তার।–পড়ে শোনাও আগে।

অগত্যা, আমি পড়ে গেলুম-মায়, প্রস্তাবনা সমেত তিন অঙ্কে সম্পূর্ণ, অসংখ্য দৃশ্য-উপদৃশ্যে বিভক্ত, পেল্লায় নাটকটা এক নিঃশ্বাসে আগাগোড়া পড়ে যেতে হলো।

বইটা পড়বার সময়ে দু একটা চাপা হাসি আমার কানে এসেছিল—পিসিমার হাসিই-তৎক্ষণাৎ আমি চোখ তুলে তাকিয়েছি। কিন্তু পিসিমার বক্র হাস্য নজরে ঠেকতেই ব্রীড়ায় চোখ নামিয়ে নিতে হয়েছে।

অবশেষে নাটকের যবনিকা পড়লো। কষ্টদায়ক একটা থমথমে ভাব বিরাজ করতে থাকলো ঘরের মধ্যে। এই নিস্তব্ধতা স্বভাবতই যে কোনো নাট্যকারের পক্ষে নিরুৎসাহজনক।

আমি ভেবেছিলাম নাটকটা খুব গুরুগম্ভীর হবে। পিসিমাই স্তব্ধতা ভাঙলেন? আদর্শমূলক কিছু হবে। তা নয়। নেহাতই হালকা ব্যাপার।

আমি ইচ্ছে করেই এটা হাস্যকর করেছি। বললাম আমি : যাতে মানুষ তার এত দুঃখের মধ্যেও একটু হাসতে পায়, হালকা হতে পারে, স্ফূর্তি পায় খানিক—সেই জন্যেই।

তাতে লাভ?

মনের আনন্দে লিখেছি—অপরকে আনন্দ দেবার জন্যেই! লাভালাভ খতিয়ে টাকার জন্য লেখা নয়তো।

সেকথা ভালো।

পিসীমার কণ্ঠস্বরে এবার যেন একটু আশ্বাস মিললো। মনে হোলো বইটা নিতান্তই ব্যর্থ হবে না। বাংলার সুরুচিসম্মত আর কৃষ্টিসম্পন্ন দর্শকদের পাতে পড়বে হয়ত বা। এবং অর্থভাগ্য তেমন যদি নাও থাকে, যশের ভাগ জুটলেই আমার যথেষ্ট।

টাকা না পাই না পাবো। আমার নাম হলেই হলো। বললাম পিসিমাকে।

হতে পারত নাম, কিন্তু হালকা জিনিস হয়েই মাটি করেছে। বললেন পিসিমা প্রথমতঃ, এর ইংরিজি অনুবাদ করা, শক্ত হবে,

কেন, অনুবাদ আবার কিসের জন্যে?

সৈন্যদের জন্যই। সম্প্রতি এখানে-আসা আমেরিকান সৈন্যদের আমোদিত করার জন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে একটা ছোটখাট অভিনয়ের আয়োজন করেছি, বলিনি তোমায়?

না তো? আমি আকাশ থেকে পড়লাম—একেবারে হতাশ হয়ে।

বলবার সময় পেলাম কই? তোমরা আসা অবধি তো বসে বসে এই ছাই পাশ শুনছি। এর মধ্যে ফাঁক পেয়েছি বলবার? উলটে পিসিমারই অভিযোগ শুনতে হলো।

নাট্যকার-জীবনে এহেন কঠোর সমালোচনা অলভ্য নয়, ঘরে-বাইরে চার ধার থেকে কতোই শুনতে হয়েছে, নাটকের প্রতি আঘাত নিজের প্রতি আঘাত বিবেচনা করলেও একেবারে ভেঙে পড়লাম না। কেবল নাট্যকারেরাই এই অদ্ভুত ক্ষমতা রাখে—ভেঙে না পড়বার ক্ষমতা। তাহলেও বেশ একটু মচকে যেতে হলো? তা হলে তুমি বলছো সৈন্যদের জন্য এটা চলতে পারে?

সৈন্য সৈন্যই সই। যেখানে হোক, যেকেউ হোক—আমেরিকান, চীনেম্যান, নিগ্রো যেই হোক, কারো না কারো চক্ষুকর্ণে এই পরমাশ্চর্য জিনিস লাগুক এই আমার আকাঙ্ক্ষা।

ভেবে দেখি। আমার ধারণা ছিল আদর্শমূলক হবে তোমার বইটা—যার ছত্রে ছত্রে ভারতের নিজস্ব ভাবধারা তর তর বেগে বয়ে গেছে—এমন কিছু। বিদেশী সৈনিকদের কাছে তা ছাড়া কী আমরা দেখাতে পারি? আমাদের কাছে আর কী পাবার ওরা প্রত্যাশা রাখে?

বেশ, আমি এটাকে শুধবে গুরুগম্ভীর বানিয়ে দিচ্ছি। ভারতেব যত মৌলিক ভাবধারা এনে ফেলব—একেবারে মূল উপড়ে যার মূল্য হয় না। উপনিষয়ে থেকেও হ্যাচকা টান দেব, রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধীর থেকেও নেব কিছু। তারপর আমাদের বিবেকানন্দ তো পড়েই আছেন। সবার নিয়ে, সব মিলিয়ে একটা জগা-খিচুড়ি পাকাতে কতক্ষণ? তবে আমাকে সময় দিতে হবে। এটা লিখতে ছ হপ্তা লেগেছিল; মাস খানেক অন্ততঃ দিতে হবে আমায়। তবে লেখার সঙ্গে সঙ্গেই তুমি অনুবাদ করে যেতে পারো।

পাগল! তা হয় না। অত সময় হাতে নেই। আমেরিকান সৈন্যরা কি তোমার নাটকের জন্যে বসে থাকবে এখানে? তারা সবে এসেছে কয়েকদিন থেকেই কোথায় ফের চলে যাবে, তার কিছু ঠিক নেই। কাল থেকেই আমাদের রিহার্সাল শুরু।

তাহলে জানাশোনার মধ্যে যে সব মারাত্মক নাটক রয়েছে বঙ্গে বগী কি চন্দ্রগুপ্ত কি মিসরকুমারী—ওরই একটা নিয়ে লাগিয়ে দাওনা?

অসম্ভব। সত্যিকারের লেখকরা বইয়ের অভিনয়ের জন্য টাকা চেয়ে থাকে—তাদের রয়্যাটি দিতে হয়। পিসিমা দ্বিতীয়বার আমার হৃদয়ে আঘাত হানলেন।

সৈন্যদের জন্যেই হবে যদি গ্যারান্টি দাও তাহলে হয়তো না চাইতেও পারে।

আমি কিছু গ্যারান্টি দিতে রাজি নই। দাঁড়াও না, আগে তো পার্টগুলো কাকে কী দেয়া যায় ঠিক হোক। তারপরেই টের পাবে।

পরদিন প্রভাতে স্থানীয় অভিনয় শিল্পীরা পিসিমার কুটিরে সমবেত হলেন। যে সময়ে নেপথ্যে দাঁড়িয়ে নাট্যকার-সুলভ লজ্জায় আমি লাল হয়ে উঠছি, পিসিমা তাদের কাছে। আমার নাটকটির পরিশ্ম দিতে লেগেছেন। বইটার অখাদ্যতার জন্য যথেষ্ট মার্জনা ভিক্ষা করে অবশেষে বললেনঃ নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। এইটেকেই কোনো রকমে কেটে-হেঁটে খাড়া করতে হবে। নাট্যকার বলেছেন নিজেই সেসব ঠিক-ঠাক করে দেবেন—আজে বাজে সবকিছু বাদ দেবার সাথে সাথে একটা আদর্শমূলক মতবাদও এনে ফেলবে ভরসা দিয়েছেন।

তারপর পিসিমা–তাঁর স্বভাবসুলভ দক্ষতায়–নিজেকেই প্রযোজক, রঙ্গমঞ্চেব কর্তা, অভিনয়-শিক্ষক, সর্বাধ্যক্ষ এবং কার্যকরী-সমিতি নিযুক্ত করে স্বয়ং একাধারে সমস্ত হয়ে উপস্থিত প্রতিভাদের ভেতর থেকে অভিনেতা নির্বাচনে অগ্রসর হলেন।

সমস্তদিন ধরে বিদ্যুৎবেগে কাজ চলল। আমি বইটার হাস্যকর খোসালো অংশ বাদ দিয়ে জিনিসটাকে শাসালো করতে থাকি, পিসিমা সঙ্গে সঙ্গে বিলিতি বাক্যে রূপান্তরিত করেন আর কল্পনা তক্ষুনি তক্ষুনি টাইপ রাইটারে একসাথে একাধিক কপি বানিয়ে চলে। সন্ধ্যের মধ্যে সম্পূর্ণ বইটা দাঁড়িয়ে গেল——হাত-পা-মাথাকাটা কোমরভাঙা কোনো কিছুর পক্ষে যতটা দাঁড়ানো সম্ভব।

নাট্যকাররূপে আমার গৌরবলাভের আশা যখন রইল না, তখন অভিনেতারূপে চেষ্টা দেখলে কেমন হয়? অভিনয়ও আমি করতে পারি, আমার ধারণা ____ পাবেন। কিছু তাঁদের অসাধ্য নয়। আমি একবার এক নাট্যকারকে এক গ্রীনরুমে এক অভিনেত্রীর পা টিপতে দেখেছিলাম–সেটা তখন তিনি অভিনয়ই করছিলেন। কল্পনার কাছে থেকে একটা কপি হাতিয়ে নিয়ে এগিয়ে গেলাম আমি।

কী! মৎলব কী? জানতে চান পিসিমা।

আমি ভাবছি নায়কের ভূমিকাটা আমিই নেব।

অন্য কিছুর চেষ্টা দ্যাখো। বললেন পিসিমা। স্থানীয় লোকদের উৎসাহিত করাই আমার উদ্দেশ্য–নিজের ঘরের লোকদের না। এটাকে আমি আমার ঘরোয়া ব্যাপার বানাতে রাজি নই। তাছাড়া, তোমাকে সিনসিফটারের কাজে আমার দরকার।

এবারে আমি ভেঙে পড়লাম। নাটকের উরু ভেঙ্গেও আমার গুরুতর হানি হয়নি কিন্তু এবার—নাঃ, এই হচ্ছে উটের বোঝার ওপর খড়ের শেষ আঁটি–খরতর আঘাত। এবং নিজের পিসিমার নির্দয় হাত থেকে। ভাবতেও দুর্বিসহ। একবার এক অ্যামেচারী পালায় সিনসিফটার সেজেছিলাম, ও কাজ যে কতো ঝকমারির তা আমার অজানা না–কাজেই আবার সে পাল্লায় পড়তে হবে ভাবতেই আমি উটমুখো হয়ে উঠি।

আমাকে বাতিল করে দিয়ে পিসিমা স্থানীয় সজ্জনদের একজনকে জিজ্ঞেস করলেন : আপনি কোন্ পার্টটা নিতে চান বনমালীবাবু?

বিদূষক। বনমালীবাবু বললেন।

কিন্তু এ বইয়ে তো কোনো বিদূষক নেই। কাতরকণ্ঠে আমি প্রতিবাদ করি।

আমার বিদূষকের পার্ট আমার নিজেরই বানানো আছে। সগর্বে জানালেনবনমালীবাবু : মুখস্তই রয়েছে আমার। ইsটেজে দাঁড়িয়ে তাই গড় গড় করে আউড়ে যাব।

বেশ, বিদৃষকের পার্টই রইলো আপনার। প্রত্যেক দৃশ্যের আরম্ভে বিদূষক হয়ে আপনি সেইটে স্বগতোক্তি করবেন। ইংরেজিতে করবেন। ভালোই হবে বেশ। বললেন পিসিমা।

এবং তারপরে আরো ভালোও হলো, হতে থাকলো। অভিনেতাদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বইটাকে আরো যতদূর বেখাপ্পা করা যায় করা গেল। উচ্চাঙ্গের নাট্যকারিতা এবং সূক্ষ্ম কলাজ্ঞান নিয়ে এই আমাকেই করতে হলো সেই সব। কেবল বিদূষকই নয়, সকলের সখই মেটালাম। একজোড়া বাদশা-বেগমকেও ঝমঝমাঝম করে বইয়ের মধ্যে এনে ফেললাম। এবং সেই দ্বৈত সঙ্গীতেও কূল পাওয়া গেল না, চন্দ্রগুপ্ত থেকে চাণক্যের একটা দৃশ্যও টেনে আনতে হলো। নতুন ম্যারপ্যাচেই। (পিসিমা সকলের ঐক্য চান কি না! এবং) সেখানেই ফুরোলো না, একটি ছোট মেয়ের সুবিধার জন্য ছোটিসে দুনিয়ারে? বলে বেশ মোটাসোটা একটা হিন্দি গান ধরে পাকড়ে নিয়ে এসে নাটকের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো।

এবং ঠিক হলো সাদা বাংলাতে অভিনয় করাই সিধে হবে। বিদেশী সৈনিকরা যত বুঝতে পারবে না ততই বেশি আপ্যায়িত হবে, আর ততই আমাদের উচ্চ আদর্শ তাদের অভিভূত করবে। অতএব, সমস্ত বইটা আবার নতুন করে বাংলায় অনুবাদ করার ভার পড়লো আমার উপর।

করে দিলাম। অনুবাদ করতে গিয়ে আনকোরা আরেক নাটক হয়ে দাঁড়াল—তা হোক। এদেশী বেড়ালই কাবুলে বেড়াতে গেলে কাবুলিবেড়াল হয়ে যায়, তারপর ঘুরে ফিরে ফের বাংলায় এলে ম্যালেরিয়ায় ভুগে কাঠবেড়াল হয়ে পড়ে কে না জানে? নাটকের পরাকাষ্ঠা দেখে আমাকেও কাঠ হয়ে যেতে হলো।

তারপর কয়েকদিন ধরে রিহার্সাল চলবার পর কৃষ্ণকান্তি বাবু বললেনঃ আচ্ছা বইটা কোথায় আমরা ষ্টেজ করব, শুনি?

একটা কাজের কথাই তিনি বল্লেন, এতদিনে।

কেন, এখানকার টাউন হলে। বল্লেন পিসিমা। তাছাড়া আর কোথায় হবে?

তাহলে টাউন হলটা রিজার্ভ করে ফেলুন আগে। প্রত্যহই যেরকম সভা সমিতির হিড়িক চলেছে তাতে সহজে ও জায়গা খালি পাওয়া যায় না। একটা তারিখ নিয়ে রাখুন আগের থেকে।

আমি দেখলাম এই সুযোগ। সিনসিটারের দায় থেকে রেহাই পাবার এই যাক। অমনি বেঁকে দাঁড়ালাম: কবে তোমাদের টাউন হল পাওয়া যাবে তদ্দিন এখানে বসে থাকা আমার পক্ষে পোষাবে না। আমার অনেক কাজ কলকাতায়। জরুরী কাজ যত। এই শনিবারই আমায় যেতে হবে। বলে দিলাম পিসিমাকে।

তাহলে এই শুক্রবারটাই ঠিক করে ফ্যালো। যাও, এক্ষুনি টাউন হলের কর্তাদের সঙ্গে কথা কয়ে ঠিকঠাক করে এসো গে।

আমার ওপরেই পিসিমা ভার চাপান, বিশ্বের যত ভার—ভারবাহী এই একমাত্র কাঁধের ওপর।

কথা কইলাম গিয়ে। মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানের সঙ্গেই কথা কইতে হলো। শুনতে না শুনতেই ভয়ঙ্কর ঘাড় নাড়তে লাগলেন তিনি।

অসম্ভব। একেবারে অসম্ভব। আমি ভারী দুঃখিত। এই শুক্রবার তো হয় না। শুক্রবার কেন, সারা সপ্তাহে এবং আগামী সপ্তাহেও একদিনের জন্যেও টাউন হল খালি নেই। এবং বলতে কি, সৈন্যরাই এই শুক্রবার ওটা নিয়ে রেখেছে।

বটে?

আমেরিকান সোলজারদের একদল ছেলে আমোদ প্রমোদের পক্ষপাতী। স্থানীয় লোকদের আনন্দ দেবার জন্যে আমেরিকান তামাসা বলে কী একটা পালা তারা দেখাবে। একটা খুব চটুল, হালকা, হাসির জিনিস–যদুর আমি টের পেয়েছি–

এবার আমার হাসি পায়। হাসি পায়। হাসি পায় সত্যিই। আমার প্রাক্তন নাটকের সমস্ত হাসি আমাকে পায়।

ভালো কথা, একটা কথা মনে পড়লো চেয়ারম্যানের চেহারা মুহূর্তের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে: আপনারাও সৈন্যদের আনন্দ দিতে চান, তাই বল্লেন না? ওরা আনন্দ চায় না। যথেষ্ট আনন্দেই আছে, তবে এই অভিনয়ের ব্যাপারে একজন ওস্তাদ লোকের দরকার ছিল ওদের, বলছিল ওরা। সেদিক দিয়ে সম্ভব হলে আপনি ওদের একটু সাহায্য করুন না? করবেন? আঃ, বড় খুশি হলুম। না, না, অভিনয় নয়, সে সব না, এই সিসিফারের কাজ শুধু। সামান্য কাজ, এমন কিছু কষ্টকর না, দুঃসাধ্যও নয়, কিন্তু এর জন্যে লোক পাওয়া মুস্কিল। কী বলে আপনাকে যে আমার কৃতজ্ঞতা জানাবো। আমার একান্ত আন্তরিক ধন্যবাদ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *