০১. বাইরে ঝম্‌ ঝম্ করে বৃষ্টি

বাইরে ঝম্‌ ঝম্ করে বৃষ্টি পড়ছিল। কাল মধ্যরাত্রি থেকে বৃষ্টি নেমেছে। বিরামহীন বৃষ্টি। একটানা ঝরছে তো ঝরছেই।

রাস্তাঘাট জলমগ্ন। জলে চারিদিক থৈ থৈ করছে। রাস্তায় কোথাও গোড়ালি জল, কোথাও তার চাইতেও বেশী। সমস্ত আকাশটা মেঘে মেঘে একেবারে মসীবর্ণ। মসীবর্ণ আকাশ মধ্যে মধ্যে বিদ্যুতের ঝলকে ঝলসে ঝলসে উঠছিল। শুধু তো বৃষ্টি নয়, সেই বৃষ্টির সঙ্গে সোঁ সোঁ হাওয়া। এলোমেলো হাওয়া।

বেলা প্রায় দশটা হবে।

অবিশ্রান্ত জল হলেও যানবাহন ও মানুষজনের কিন্তু বিশ্রাম ছিল না—একমাত্র ট্রাম ব্যতীত অন্যান্য সবপ্রকার যানই চলাচল করছিল ঐ প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যেই। ছাতি মাথায় মানুষজনও পথে চলছিল।

এই দুর্যোগের মধ্যে কিরীটীর বাড়ি থেকে বাইরে বেরুবার একটুও ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু দক্ষিণ কলকাতার ডি.সি. মানিক চাটুয্যে তাকে নিষ্কৃতি দেয়নি। আসতেই হবে বলে তাকে বাড়ি থেকে টেনে বের করেছিল। কিরীটী তার গাড়ির পিছনের সিটে চারদিককার কাঁচ তুলে দিয়ে বসে ছিল।

হীরা সিং গাড়ি চালাচ্ছিল। রাস্তাঘাট জলমগ্নতার মধ্যে দিয়ে সন্তর্পণে গাড়ি চালাচ্ছিল হীরা সিং। সারকুলার রোডে ক্রিমেটোরিয়াম ছাড়িয়ে জোড়া গিজার পিছন দিকে একটা বাড়িতে তাকে যেতে হবে। মানিক চাটুয্যে তাকে বলেছে বড় রাস্তার উপরেই পুলিসের জীপ থাকবে, সে তাকে পথ দেখিয়ে আনবে।

কে এক নবাব সাহেবের বাড়িতে তার তৃতীয়া বেগমসাহেব নাকি নিহত হয়েছে, কেন কি বৃত্তান্ত কিছুই ফোনে জানায়নি মানিকবাবু আর কিছুই। কেবল বলেছে, আসুন, এলেই সব জানতে পারবেন, আপনার সাহায্য একান্ত প্রয়োজন।

কিরীটী এড়াবার চেষ্টায় ছিল। বলেছিল, হত্যা, না আত্মহত্যা?

আত্মহত্যা নয়, a pure and simple case of murder. আসুন একবার দয়া করে। আপনি কিছু ভাববেন না। ক্রিমেটোরিয়ামটা ছাড়ালেই জোড়া গিজার আগে বড় রাস্তার উপরে পুলিসের জীপ দেখতে পাবেন।

আসল ব্যাপারটা হচ্ছে কিরীটী ঐ মানিক ছেলেটিকে একটু স্নেহ করে। বয়স বেশী নয়। এখনো ত্রিশ হয়নি। কয়েক বছর মাত্র পুলিসের কাজে ঢুকেছে এবং ইতিমধ্যে ডি.এস.পি-র পদে উন্নীত হয়েছে। বেঁটেখাটো মানুষটা। রোগা পাতলা গড়ন।

বছরখানেক পূর্বে একটা বিচিত্র হত্যা-মামলার ব্যাপারে প্রথম ঐ মানিক চাটুয্যের সঙ্গে কিরীটীর পরিচয় হয়। সেই সময়ই কিরীটী ছেলেটির বুদ্ধি ও বিচারশক্তি দেখে চমৎকৃত হয়েছিল।

সেই মানিক চাটুয্যে যখন ডেকেছে ব্যাপারটার মধ্যে নিশ্চয়ই রহস্যের বৈচিত্র্য কিছু আছে। নচেৎ ঐ ঝড়বৃষ্টির মধ্যে এমন করে জরুরী তলব দিয়ে বিরক্ত করত না।

সারকুলার রোডের একটা বিশেষত্ব আছে। যত জলই হোক না কেন কলকাতা শহরের রাস্তাঘাট যতই জলে ড়ুবে যাক না কেন—এ রাস্তায় কখনোতেমন জল জমে না। ক্রিমেটোরিয়াম ছাড়াবার পরই জোড়া গিজার অল্প দূরে দেখা গেল একটা ক্যালকাটা পুলিসের জীপ দাঁড়িয়ে আছে।

কিরীটী আগে থাকতেই হীরা সিংকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল। হীরা সিং সোজা গিয়ে জীপটার পাশে গাড়ির ব্রেক কষল। অতঃপর সেই জীপ গাড়িই পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল।

পূবমুখো রাস্তাটা ধরে কিছু দূরে এগুবার পর একটা বাগান ও গেটওয়ালা পুরাতন বাড়ির মধ্যে ওরা পর পর এসে প্রবেশ করল। অনেকটা জুড়ে বাগান। মধ্যে মধ্যে তার বড় বড় দেবদারু গাছ। বৃষ্টি ও হাওয়ায় ওলটপালট করছিল গাছগুলো।

তিনতলা একটা বিরাট পুরাতন বাড়ি। গাড়িবারান্দার নীচে এসে গাড়ি দুটো আগে পিছে থামল। গাড়িবারান্দায় দুজন লাল পাগড়ি দাঁড়িয়েছিল।

কিরীটী গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতেই তাদের মধ্যে একজন কিরীটীকে সেলাম দিয়ে বললে, ডি.সি. সাহেব ভিতরে আছেন, যান।

যে সার্জেন্টটি জীপে অপেক্ষা করছিল কিরীটীর জন্য, সে-ই কিরীটীর গাড়ি দেখে জীপ। থেকে নেমে বষতি গায়ে এগিয়ে আসে।

কিরীটী প্রশ্ন করে, কত দূর?

এই কাছেই, চলুন।

অনেককালের পুরনো বাড়ি বলেই মনে হয়। এখানে-ওখানে দেওয়ালের প্লাসটার খসে পড়েছে। প্রথমেই একটা হলঘর। বিরাট আকারের হলঘর। মাথার উপরে সিলিং অনেক উঁচুতে।

সিলিং থেকে দুটি বড় ঝাড়বাতি ঝুলছে। ইলেকট্রিক আলো ও দুটো ফ্যানও আছে। দেওয়ালে বিরাট বিরাট কয়েকটি অয়েল পেনটিং টাঙানো ছিল। জাঁকজমক পোশাক পরা ছবির মানুষগুলো।

মেঝেতে পুরু কার্পেট বিছানো কয়েকটি পুরাতন আমলের গদী-মোড়া ভেলভেটের সোফা-সেটও আছে।

হলঘরের মধ্যে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই অন্দরের দরজাপথে মানিক চাটুয্যে এসে কক্ষে প্রবেশ করল।

এসেছেন মিঃ রায়! আসুন!

মানিক চাটুয্যের পরনে পুলিসের ইউনিফর্ম।

কি ব্যাপার মানিকবাবু?

একটি সুন্দরী মেয়ে নিহত হয়েছে।

কিরীটী মৃদু হাসল। তারপর বললে, খুব সুন্দর বুঝি—

না দেখলে ঠিক বুঝতে পারবেন না মিঃ রায়, চলুন আগে দেখবেন—

মানিক চাটুয্যে আগে আগে এগিয়ে যায়, কিরীটী তার পিছনে পিছনে অগ্রসর হয়।

হলঘরের পরেই একটা টানা বারান্দা। চারদিক ঘেরা বারান্দাটা।