১০. পরের দিন রাত্রে

পরের দিন রাত্রে। দশটা বাজতে তখনও কিছু সময় বাকি আছে।

বেলতলায় শিবতোষের বাড়ির তিনতলার সেই ঘর। আসবাবপত্র যেমন যেখানে ছিল তেমনি আছে। কেবল সে-রাত্রের মত ফুলের সমারোহ নেই। ঘরের মধ্যে যেন একটা করুণ স্তব্ধতা বিরাজ করছে। ঘরের মধ্যস্থলে একটি চেয়ারের উপরে দীপিকা উপবিষ্ট। এবং সে-রাত্রে ঘরে ছিল উজ্জ্বল আলোআজ একটি মাত্র আলো ঘরের কোণে জ্বলছে। দীপিকার পূর্বস্মৃতি এখনো ফিরে আসেনি। সে এখনো নিজীব। নিজের থেকে কোন কথা বলে না, হাসে না, কাঁদে না, এমন কি ক্ষুধা পেলে খাওয়ার কথাও বলতে পারে না। ডাঃ বর্মণ শিবতোষকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, দীপিকাকে কোন নার্সিং হোমে ভর্তি করে দেবার জন্য। শিবতোষও অসম্মত ছিলেন না, কিন্তু কিরীটী তাঁকে বলেছিল, কটা দিন অপেক্ষা করুন, তারপর ডাঃ বর্মণ যেমন বলেছেন তাই করা যাবে। তাছাড়া দীপিকাও সর্বক্ষণ শান্ত চুপচাপই রয়েছে, বরং কিছুদিনের জন্য কিরীটীর পরামর্শে দীপিকার দেখাশোনার জন্য দুজন নার্স রাখা হয়েছিল রাত্রি ও দিনের জন্য। আর স্বাতীকেও যেতে দেয়নি কিরীটী। স্মৃতি দিল্লীতে থাকে, সে তার স্বামীর সঙ্গে দিল্লী চলে গিয়েছে।

পরেশ ভৌমিক নিজেও বলেছেন, কিরীটীবাবু যতদিন বলবেন তুমি বরং তোমার বৌদির সঙ্গে এই বাড়িতে থাক।

ঘরের মধ্যে চেয়ারে উপবিষ্ট দীপিকার পাশেই দাঁড়িয়েছিল রাত্রির নার্স ও স্বাতী। কিরীটী ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিল আর ঘন ঘন নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল।

বাথরুমের মধ্যে আলো জ্বলছে—মেথরের যাতায়াতের দরজাটা বাথরুমের মধ্যে খোলাই রাখা হয়েছে—কিরীটীর নির্দেশমত।

বাথরুমের মধ্যে মৃদু পদশব্দ শোনা গেল।

কিরীটী বাথরুমের দরজার দিকে তাকাল, শিখেন্দু এসে ঘরে প্রবেশ করল।

আসুন, শিখেন্দুবাবু! পরেশবাবু নির্মলবাবু সঞ্জীববাবু তাঁরা আসেন নি? কিরীটী প্রশ্ন করল।

বলে দিয়েছি, সবাই তো বলেছে আসবে ঠিক দশটাতেই। শিখেন্দু মৃদু গলায় জবাব দিল। ঘরের কোণে রক্ষিত স্ট্যাণ্ডের একটিমাত্র আলোর জন্য অত বড় ঘরটা যেন ঠিক ভালভাবে আলোকিত হয়ে উঠতে পারেনি। দীপিকা যেখানে বসেছিল, তারই অল্প দূরে চারটি চেয়ার রাখা ছিল। কিরীটী শিখেন্দুকে বলল, ঐ যে শিখেন্দুবাবু, চেয়ার রয়েছে, বসুন।

শিখেন্দু একবার কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল, তারপর নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে ডানদিককার শেষ চেয়ারটায় বসল।

বাথরুমের আলোটা কিন্তু উজ্জ্বল।

শিখেন্দু আসবার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই পরেশ আর নির্মল এসে ঘরে ঢুকল। তারা ঘরে ঢুকেই যেন থমকে দাঁড়াল। দুজনেই চারদিকে তাকাল।

বসুন। পরেশবাবু নির্মলবাবু, শিখেন্দুবাবুর পাশেই বসুন। সঞ্জীববাবু কই? তিনি এলেন না?

জবাব দিল পরেশ, সে তো আমাদের আগেই বের হয়েছে। এখনও এল না কেন বুঝতে পারছি না তো। কিন্তু আমাদের আজ রাত্রে এভাবে সকলকে আসতে বলেছেন কেন কিরীটীবাবু?

আজ এখানে এই ঘরে সনাক্তকরণ করব।

নির্মল শুধাল যেন প্রায় বোজা গলায়, সনাক্ত করবেন!

হ্যাঁ।

কাকে?

হত্যাকারীকে—

কিরীটীর ওপ্রান্ত হতে শব্দটা উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় সঞ্জীব এসে ঘরে প্রবেশ করল। কথাটা তারও কানে যায়। সঙ্গে সঙ্গেই সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।

বসুন, সঞ্জীববাবু!

সঞ্জীব চারদিকে একবার তাকাল, তারপরই নজরে পড়ল অল্প দূরে চারটি চেয়ার। তার তিনটিতে পাশাপাশি বসে শিখেন্দু, পরেশ ও নির্মল। নির্মলের পাশের চেয়ারটা খালি।

সঞ্জীব বসে না, কেমন যেন ইতস্তত করে।

কি হল সঞ্জীববাবু, বসুন! নির্মলবাবুর পাশের চেয়ারটায় বসুন। ওটা আপনার জন্যই রাখা আছে।

সঞ্জীব কেমন যেন শিথিল পায়ে এগিয়ে গিয়ে চেয়ারটার উপর বসে পড়ল।

শিখেন্দুবাবু পরেশবাবু নির্মলবাবু সঞ্জীববাবু আপনারা চারজন নির্বাণীতোষের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, কিরীটী বলতে থাকে, আর আপনাদের পাঁচজনেরই সঙ্গে পরিচয় ছিল ঐ যে সামনে বসা দীপিকা দেবী আজ যিনি নির্মম এক নিষ্ঠুরতায় অতীতের স্মৃতি হারিয়ে একেবারে বলতে পারেন বোবা হয়ে গিয়েছেন, বেঁচে নেই—জীবন্মৃত–

সবাই চুপ, কারো মুখেই কথা নেই।

কিরীটী আবার বলল, আমি আশা করেছিলাম হত্যাকারীকে আপনারা ধরিয়ে দেবেন, কারণ দীপিকাকে আপনারা সকলেই মনে মনে এক সময় বাসনা করেছেন

না, না। সঞ্জীব বলে ওঠে।

পরেশ প্রতিবাদ জানায়, মিথ্যা বলিস না সঞ্জীব, আমরা পাঁচজনেই মনে মনে দীপাকে চেয়েছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দীপা নির্বাণীর গলাতেই মালা দিয়েছিল, কারণ দীপা ভালবাসত একমাত্র নির্বাণীকেই।

কিরীটী বলল, ঠিক। এবং সহজভাবেই ব্যাপারটা নেওয়া উচিত ছিল আপনাদের, কিন্তু তা নিতে পারলেন না—

সঞ্জীব বলে ওঠে, বিশ্বাস করুন কিরীটীবাবু, সহজভাবেই নিয়েছিলাম অন্তত আমি ব্যাপারটা–

তাই যদি হবে সঞ্জীববাবু, আপনি আমার কাছে মিথ্যে স্টেটমেন্ট দিলেন কেন?

মিথ্যে স্টেটমেন্ট দিয়েছি!

হ্যাঁ, দিয়েছেন।

না। সত্যিই বলেছি।

কিন্তু সঞ্জীবের কথা শেষ হল না, এক নীলবসনা নারী খোলা দরজাপথে ঘরে এসে ঢুকল।

সঞ্জীব ঘেমে গিয়েছে ততক্ষণে। বাকি তিনজনের মুখেও কোন কথা নেই। কেবল দীপিকা মাথা নীচু করে বসে আছে।

নীলবসনা নারী সোজা বাথরুমের মধ্যে গিয়ে ঢুকল, তারপরই হঠাৎ দপ দপ করে ঘরের সব কটা আলো জ্বলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে দীপিকা মুখ তুলল।

কিরীটী বললে, আসুন, বের হয়ে আসুন!

সেই নীলবসনা নারী একপ্রকার ছুটেই বাথরুম থেকে বের হয়ে দীপিকার সামনে দিয়ে দুই ঘরের মধ্যবর্তী দরজাপথে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকল—আর সঙ্গে সঙ্গে অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ গলায় চেচিয়ে উঠল দীপিকা, ধর ওকে, ধর বলতে বলতে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মেঝেতে।

কিরীটী দীপিকাকে পরীক্ষা করে বললে, নার্স, অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন, আসুন ধরুন ওঁকে, তুলে বিছানায় শুইয়ে দিই।

কিরীটী মাথার দিকটা ধরল, নার্স ও স্বাতী পায়ের দিক ধরে দীপিকাকে তুলে শয্যায় শুইয়ে দিল।

যান, পাশের ঘরে ডাঃ বর্মণ আছেন তাঁকে ডেকে আনুন।

সবাই চুপ, সবাই যেন বোবা। ডাঃ বর্মণকে ডাকতে হল না, তিনি নিজেই এসে ঘরে ঢুকলেন।

আপনার পেসেন্টকে পরীক্ষা করে দেখুন ডাক্তার!

ডাঃ বর্মণ দীপিকার পাল্টা একবার পরীক্ষা করলেন, তারপর শান্ত গলায় বললেন, She is alrightমনে হচ্ছে মিঃ রায়, আপনার experiment successful! জ্ঞান ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে ওঁর পূর্বস্মৃতি আবার ফিরে পাবেন। নার্স সোডিয়াম গার্ডিনল ইনজেকশনটা এঁকে দিয়ে দাও। রেডি করাই আছে পাশের ঘরে ট্রের ওপরে। নার্স চলে গেল পাশের ঘরে এবং সিরিঞ্জটা হাতে নিয়ে এসে ইনজেকশনটা দিয়ে দিল। ঠিক আছে, ডাঃ বর্মণ বললেন, now let her sleep for 2/3 hours! ঘুম ভাঙবার পর নিশ্চয়ই আমরা দেখতে পাব উনি পূর্বস্মৃতি ফিরে পেয়েছেন। আমি কি চলে যাব এবারে, মিঃ রায়? আমার কিন্তু নাটকের শেষ দৃশ্যটা দেখতে ইচ্ছে করছে if you allow me please!

থাকুন আপনি। তপনবাবু? বলে উচ্চকণ্ঠে ডাকল কিরীটী।

নীলবসনা নারী ঘরে এসে ঢুকল।

আপনি ঐ মেয়ের পোশাক ছেড়ে নিজের জামাকাপড় পরতে পারেন এবারে।

তপন চলে গেল আবার পাশের ঘরে।

সবাই নিবক, সবাই বোবা। যেন পাথর চার বন্ধু শিখেন্দু, পরেশ, নির্মল, সঞ্জীব।

এবারে সঞ্জীববাবু বলুন,সে রাত্রে কেন নারীর বেশ ধরে এখানে এসেছিলেন?

একটু কৌতুক করবার জন্য—ক্ষীণ গলায় বললে সঞ্জীব।

কৌতুক!

হ্যাঁ, কথা ছিল আমি বাথরুমের মধ্যে লুকিয়ে থাকব-নির্বাণী ও দীপা ঘরে এসে খিল দিলে আমি বাথরুম থেকে বের হয়ে আসব। এসে—

বলুন, থামলেন কেন?

নির্বাণীর সঙ্গে অভিনয় করে চলব, এই তোমার যদি মনে ছিল নির্বাণী, আমাকে ভালবেসে মজাতে গিয়েছিলে কেন? Just a fun—কিরীটীবাবু, just a fun!

আপনার ঐfun বা কৌতুকের পরিকল্পনাটা আপনার অন্যান্য বন্ধুরা জানতেন? বলেছিলেন তাঁদের?

জানত–সবাই জানত, পরামর্শ করেই আমরা পরিকল্পনাটা করেছিলাম।

সে-রাত্রে কখন এসেছিলেন আপনি?

রাত তখন সাড়ে এগারোটার পরই হবে, সঞ্জীব বললে, বোধ হয় পৌনে বারোটা।

কোন্ পথ দিয়ে আপনি ওপরে গিয়েছিলেন?

বাগানের দিকে বাড়ির পিছনে মেথরদের যাঅয়াতের ঘোরানো লোহার সিঁড়ি দিয়ে।

কি–কি বললেন? ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে পিছন দিককার?

হ্যাঁ।

কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে উঠে যদি দেখতেন বাথরুমের দরজা বন্ধ, তবে বাথরুমে ঢুকতেন কি করে?

শিখেন্দু বলেছিল, দরজাটা সে খুলে রেখে দেবে

কিন্তু আমি—আমি দরজাটা খুলে রাখবার কথা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। মনেই ছিল না কিরীটীবাবু কথাটা। বিশ্বাস করুন, আমি দরজা খুলে রাখিনি।

জানি আপনি রাখেননি, নির্বাণীতোষ নিজেই খুলে রেখেছিলেন সন্ধ্যা থেকে—কিরীটী বললে।

পরেশ বলল, নিবণী খুলে রেখেছিল!

হ্যাঁ।

কিন্তু কেন? সে তো জানত না আমাদের প্ল্যানটা?

বলতে পারেন তাঁর নির্মম ভাগ্যই তাঁকে দিয়ে দরজাটা খুলিয়ে রেখেছিল সে-রাত্রে। কিন্তু সঞ্জীববাবু, আপনি বাথরুমে ঢুকে কি দেখেছিলেন? বলুন, গোপন করবেন না কারণ আমি জানি আপনি কি দেখেছিলেন। কিরীটীর স্বর স্পষ্ট ও কঠিন।

সঞ্জীবের সমস্ত মুখ যেন রক্তহীন ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে। সে কেমন অসহায় বোবা দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে আছে। সে কথা বলতে পারছে না। ঠোঁট দুটো তার কাঁপছে, আমি–আমি—

আমি বলছি, আপনি কি দেখেছিলেন, সঞ্জীববাবু, আপনার বন্ধু রক্তাক্ত অবস্থায় বাথরুমের মেঝেতে পড়ে আছেন বলুন, তাই দেখেননি?

হ্যাঁ। সেই দৃশ্য দেখে আমি এমন ঘাবড়ে যাই যে—

যে পথে এসেছিলেন সেই পথেই পালিয়ে যান আবার পরমুহূর্তেই!

হ্যাঁ।

কোথায়, কোথায় যান সোজা বেলতলার বাড়ি থেকে?

ক্লাবে। সেখান থেকে বেশ বদলে মেসে যাই।

তাই ফিরতে আপনার মেসে সে-রাত্রে এত দেরি হয়েছিল, তাই না?

হ্যাঁ।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, পৌনে এগারোটায় যদি নির্বাণীতোেষ ওপরে গিয়ে থাকেন, তিনি খুন হয়েছেন সঙ্গে সঙ্গে। বাথরুমে ঢুকে মাথা ধরার জন্য যখন কোডোপাইরিন ট্যাবলেট হাতে জলের গ্লাস নিয়ে বেসিনের সামনে গিয়ে বেসিনের ট্যাপ থেকে জল ভরছিলেন, ঠিক সেই সময়েই অতর্কিতে পিছন থেকে ছোরার আঘাতে—

পরেশ বললে, তবে কি

হ্যাঁ পরেশবাবু, বাথরুমের স্ক্রিনের আড়ালে হত্যাকারী যেন ওৎ পেতে দাঁড়িয়ে প্রস্তুত হয়ে ছিল, কারণ সে জানত নির্বাণীতোষ ওপরে আসবে এবং বাথরুমেও আসাটা তার স্বাভাবিক শোবার আগে

কে–কে সেই হত্যাকারী। শিখেন্দু ভাঙা গলায় যেন চঁচিয়ে উঠল।

এখনও—এখনও বুঝতে পারলেন না শিখেন্দুবাবু, নির্বাণীতোষের হত্যাকারী কে?

কে?

সে জানত নির্বাণীতোষের শয়নঘরের দরজা বন্ধ, তাই পিছনের বারান্দা দিয়ে বাথরুমের খোলা দরজাপথে ঘরে ঢুকে শয়নঘরের দরজাটা খুলে দিয়েছিল এবং বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল! আপনি—শিখেন্দুবাবু, ইট ওয়াজ ইউ! অ্যাণ্ড ইট ওয়াজ দি মোস্ট আনকাইণ্ডেস্ট অফ ইউ!

অকস্মাৎ ঘরের মধ্যে যেন একটা মৃত্যুর স্তব্ধতা নেমে এসেছে।

পালাবার চেষ্টা করবেন না শিখেন্দুবাবু, কারণ বাড়ি ঘিরে রেখেছে পুলিসে। সন্দেহটা প্রথম থেকেই আপনাকে ঘিরেই আমার মনের মধ্যে দানা বেঁধে উঠেছিল। সে-রাত্রে ফোনে সংবাদ পেয়ে এখানে এসে সব দেখেশুনে কিন্তু একটা—একটা ব্যাপার সব কিছুকে যেন জট পাকিয়ে দিচ্ছিল, ঐ জটটা আমি কিছুতেই খুলতে পারছিলাম না।

কিন্তু জটটা খুলে গেল গতসন্ধ্যায় স্বাতীদেবীর স্বীকারোক্তির পরে এবং জটটা হচ্ছে—আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না বাথরুমের দরজাটা বন্ধ ছিল কেন, ওটা তো–

কিরীটীর কথা শেষ হল না, শিখেন্দুর দেহটা চেয়ার থেকে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে গেল। সশব্দে হঠাৎ।

কি হল, কি হল! সকলেই বলে ওঠে।

ছুটে গেল সবাই শিখেন্দুর ভূলুষ্ঠিত দেহটার কাছে। শিখেন্দুর দেহটা শেষবারের মত আক্ষেপ করে তখন একেবারে স্থির হয়ে গিয়েছে।

বীরেন মুখার্জী পাশের ঘর থেকে ছুটে এসেছেন ততক্ষণে। ডাঃ বর্মণই পরীক্ষা করে বললেন, হি ইজ ডেড

বীরেন মুখার্জী বললেন, ডেড!

হ্যাঁ, খুব সম্ভবত পটাশিয়াম সায়ানাইড-ডাঃ বর্মণ বললেন।

কিরীটী ক্লান্ত গলায় বললে, এ একপক্ষে ভালই হল। নিদারুণ অপমান আর লজ্জার হাত থেকে উনি নিজেকে সরিয়ে দিলেন।

বীরেন মুখার্জী বললেন, কিন্তু আসামী ফাঁকি দিল–

ধরলেও আপনারা প্রমাণ করতে পারতেন না মিঃ মুখার্জী যে শিখেই নির্বাণীতোষকে সে-রাত্রে হত্যা করেছিল!

কেন?

প্রমাণ—প্রমাণ পেতেন কোথায়? কারণ হত্যার আগে বা পরে কেউ ওকে বাথরুমের মধ্যে দেখেছে, এমন কথা তো বলতে পারত না হলফ করে। ইট ওয়াজ এ মাস্টার প্ল্যান। নিজের দীর্ঘদিনের বন্ধু নির্বাণীতোষকে নিজের পথ থেকে সরাবার জন্য শিখেন্দুবাবু যে প্লান করেছিলেন সেটা ছিল একেবারে নিখুঁত। কিন্তু হত্যা করবার পর স্মৃতিভ্রংশ দীপিকার দিকে তাকিয়েই বুঝতে পেরেছিল তার সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। দীপিকাকে লাভ করা তার কোন দিনই সম্ভব হবে না। যোগ-বিয়োগে প্রকাণ্ড ভুল হয়ে গিয়েছে—আর সেই হতাশার বেদনা, আশাভঙ্গের দুঃখটাই যেন আমি সে-রাত্রে এখানে এসে ওর চোখেমুখে দেখেছিলাম। যেটা মনে হয়েছিল তখুনি আমার, বন্ধুবিচ্ছেদ বা বন্ধুর মৃত্যুজনিত দুঃখ নয় সেটা। অন্য কিছু সামথিং এলস! আমার মনে সন্দেহও তখুনি উঁকি দেয় ওকে ঘিরে—কিন্তু এ ঘরে আর নয়, চলুন পাশের ঘরে যাওয়া যাক। বীরেনবাবু, ডেড় বডিটা এ ঘর থেকে সরাবার ব্যবস্থা করুন।

পাশের ঘরে বসেই কিরীটী তার কাহিনী বলে যেতে লাগল। কাহিনীর শেষাংশ—

বলছিলাম না, ইট ওয়াজ এ মাস্টার প্ল্যান দীপিকাকে না পাওয়ার দুঃখে শিখেন্দু ভেতরে ভেতরে উন্মাদ হয়ে উঠেছিল, তার ভালবাসা, চাওয়া ব্যর্থ হল—নির্বাণীতোেষ তার ঈপ্সিতাকে তার চোখের সামনে থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল! কোন কোন ক্ষেত্রে নারী বা পুরুষের বিশেষ কোন পুরুষ বা নারীকে ঘিরে ভালবাসা বা কামনা কতখানি স্বার্থপর কতখানি তীব্র হতে পারে এবং তার ফলে তারা যে কতখানি হৃদয়হীন ও নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে পারে তারই জাজ্বল্যমান প্রমাণ দিয়ে গেল আমাদের শিখেন্দু।

দীপিকা তার হাতের বাইরে চলে যাওয়ায় শিখেন্দুর মনের অবস্থাটাও ঠিক তাই হয়েছিল। সে মনে মনে নির্বাণীকে পথ থেকে সরাবার প্ল্যান করে। প্ল্যানটা একেবারে নিখুঁত। নির্বাণীতোষকে প্যাণ্ডেল থেকে উপরে চলে যেতে বলে, তাঁর মাথার যন্ত্রণা বলায়। নির্বাণীতোষ ভিতরে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেও পিছনের সিঁড়ি দিয়ে সম্ভবত ওপরে চলে যায় এবং বাথরুমে নির্বাণীর আগেই গিয়ে পৌঁছয়।

নির্বাণী কোডোপাইরিন খাবার জন্য বাথরুমে গ্লাস হাতে এসে ঢুকল এবং যখন সে ট্যাপ থেকে গ্লাসে জল ভরছে, শিখেন্দু পেছন থেকে তাকে ছোরা মারল। নির্বাণী পড়ে গেল। হাতের গ্লাসটা বেসিনের মধ্যে পড়ে চিড় খেয়ে গেল, ট্যাপটা ভোলাই রইল। শিখেন্দু পালাল আবার ঐ লোহার সিঁড়ি দিয়েই। নির্বাণীর রক্তাক্ত ছোরাবিদ্ধ মৃতদেহটা পড়ে রইল। তারপর কিছুক্ষণ বাদে ওপরে এলো দীপিকা। সে সম্ভবত ঘরে ঢুকে ঘরে আলো জ্বলছে দেখে—অথচ তার স্বামীকে ঘরের কোথাও না দেখে তাকে অনুসন্ধান করতে গিয়ে বাথরুমে গিয়ে ঢোকে। আমার মনে হয়েছে শিখেন্দু হত্যা করে চলে যাবার আগে পিছনের সিঁড়ি দিয়ে বাথরুমের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে যায়, অবিশ্যি এটাও অনুমান। যাই হোক, স্বামীকে খুঁজতে খুঁজতে বাথরুমের দরজা খোলা দেখে দীপিকা বাথরুমেই ঢোকে এবং আলো জ্বালায়। আর ঠিক সেই মুহূর্তে বাথরুমে পূর্ব প্ল্যান মত নীল শাড়ি পরে সঞ্জীববাবু ঢোকেন। তার পরেও আমার অনুমান, হয়তো দীপিকাদেবীর দুটো ব্যাপারই একই সঙ্গে চোখে পড়ে, শাড়ি পরা সঞ্জীববাবু ও তাঁর স্বামীর রক্তাক্ত ছোরাবিদ্ধ ভূলুণ্ঠিত মৃতদেহটা। স্বামীর মৃতদেহ ও শাড়ি পরা সঞ্জীববাবুকে চিনতে পেরে এবং দুটোকে একই ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে তাঁর মনে হয়—অ্যাণ্ড শী ফেনটেড, ড্রপড অন দি ফ্লোর! সঞ্জীববাবু নিশ্চয়ই বলতে পারবেন, তাই ঘটেছিল কিনা।

সঞ্জীব মৃদু কণ্ঠে বললে, হ্যাঁ। প্রথমেই বাথরুমে ঢুকে দীপার সঙ্গে আমার চোখাচোখি ও তার পরই দুজনেরই আমাদের একসঙ্গে নজরে পড়ে মৃতদেহটা। দীপিকা চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় আর আমি সঙ্গে সঙ্গে যে পথে বাথরুমে এসেছিলাম সেই পথেই পালাই তাড়াতাড়ি।

আপনার পালাবার সময় কেউ আপনাকে দেখেছিল?

বোধ হয় শিখেন্দু দেখতে পেয়েছিল, সে তখন নীচে প্যাণ্ডেলেই ছিল। সে ও দীপিকা দুজনেই যদি ভাবে যে আমিই নির্বাণীকে হত্যা করেছি—তাই আমি সেদিন রাত্রে আদৌ আসিনি এখানে আপনাকে বলেছিলাম।

কিরীটী বললে, এখন বুঝতে পারছি আমার আর একটি অনুমানও ঠিক, নীলবসনা কোন নারীই সে রাত্রে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠেনি।

তবে গোকুল যে তার জবানবন্দিতে বলেছিল–বীরেন মুখার্জী বললেন।

গোকুলকে ডাকুন তো!

গোকুলকে ডাকা হল। কিরীটী বললে, গোকুল তুমি মিথ্যা বলেছ।

কি মিথ্যা বলেছি বাবু? গোকুল যেন রীতিমত ভয় পেয়ে গেল।

সে-রাত্রে ভেতরের সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় নীল শাড়ি পরা বৌ ওঠেনি, তাই নয় কি? তবে তুমি ঐ কথা বলেছিলে কেন?

আজ্ঞে–আমি দেখিনি। শিখেদাদাবাবু আমায় বলতে বলেছিলেন তাই পরে ভেবেছিলাম, সত্যি কথাটা বলব কিন্তু ভয়ে বলতে পারিনি। শিখেন্দুদাদাবাবুও বলেছিলেন, সত্যি কথা বলতে গেলে আবার পুলিস আমাকে সন্দেহ করবে—

এখন বলুন তো সঞ্জীববাবু, নারীর বেশে সে-রাত্রে নির্বাণীতোষের ঘরে হানা দেবার প্ল্যানটা কার?

জবাব দিল পরেশ, শিখেন্দুর। সে-ই প্ল্যানটা করেছিল।

এখন তোবুঝতে পারছেন আপনারা, আসলে কোন কৌতুক সৃষ্টির জন্যই নয়—সঞ্জীববাবুর ঘাড়ে হত্যার অপরাধটা চাপানোর জন্যই শিখেন্দু ঐ প্ল্যানটা করেছিল, সত্যিই মাস্টার প্ল্যান! কিন্তু সেদিন যদি ব্যাপারটা একবারও আপনারা কেউ আমাকে খুলে বলতেন, তবে হয়ত সেইদিনই মীমাংসায় আমি পৌঁছতে পারতাম। শিখেন্দুর মনেও সন্দেহ জাগত না,সে পটাশিয়াম সায়ানাইড খাবারও সুযোগ পেত না।

সঞ্জীবকে বাঁচানোর জন্য আমরা মুখ খুলিনি—শিখেন্দুই.পরামর্শ দিয়েছিল। নির্মল ও পরেশ বললে।

কিন্তু তবু দেখলেন তো, পাপ কখনো চাপা থাকে না। শিখেন্দুর দুটি মাত্র মারাত্মক ভুলের জন্যই তার অমন নিখুঁত চতুর প্ল্যানটাও ভেস্তে গেল, পাপ প্রকাশ হয়ে পড়ল।

বীরেন মুখার্জী বললেন, দুটি মারাত্মক ভুল!

হ্যাঁ, কিরীটী বললে, প্রথম ভুল চিৎকার শোনার পর ওপরে এসে শিখেন্দুর বাথরুম দিয়ে ঘরে ঢুকে বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে শোবার ঘরের দরজাটা খুলে দেওয়া এবং দ্বিতীয়, দীপিকার অচৈতন্য দেহটা বাথরুম থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া। বাথরুমের দরজাটা যদি সে না বন্ধ করে দিত, আমাদের অন্ধকারেই হাতড়াতে হত কোন্ পথ দিয়ে হত্যাকারী পালালো সে ব্যাপারে এবং সেই সঙ্গে নীলবসনা নারীর ব্যাপারটাও একটা সত্যের আবরণ নিয়ে থেকে যেত। কিন্তু হত্যাকারী নিজের ভুলের জালে নিজেই জড়িয়ে আমার মনে সন্দেহের উদ্রেক করে দিল। অথাৎ ঐ বাথরুমের বন্ধ দরজা ও দীপিকার শোবার ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা দীপিকার অচৈতন্য দেহটা দেখে শিখেন্দুর মনের দীর্ঘদিনের লালসা তাকে ঘিরে হঠাৎ প্রবল হয়ে ওঠে, সে নিজেকে আর দীপিকাকে স্পর্শ করার লোভটা থেকে সামলাতে পারে না। তাকে বাথরুমের মেঝে থেকে তুলে বুকে করে পাশের ঘরে নিয়ে যায় এবং প্রমাণ করে দিয়েছিল সেটাই আমার কাছে দীপিকার প্রতি শিখেন্দুর গোপন তীব্র আকর্ষণটা। তাছাড়া ভেবে দেখুন মিঃ মুখার্জী, নির্বাণীতোষকে ঐ ভাবে হত্যা করার সুযোগ ঐ রাত্রে সকলের সন্দেহ বাঁচিয়ে একমাত্র নির্বাণীর বন্ধুদের মধ্যে শিখেন্দুরই বেশী ছিল, কারণ সে ছিল এ-বাড়ির সকলের পরিচিত, স্নেহের জন—বিশ্বাসের জন, একপ্রকার ছেলের মত এবং এ-বাড়ির গলিখুঁজি সব তার নখদর্পণে। প্যাণ্ডেলের ভেতরই ছিল লোহার ঘোরানো সিঁড়িটা মেথরদের দোতলা-তিনতলায় যাতায়াতের এবং প্যাণ্ডেলে উপস্থিত থেকে শিখেন্দু সব কিছুর ওপরেই নজর রাখতে পেরেছিল সর্বক্ষণ।

নির্বাণীতোষের নিজের শিখেন্দুর প্রতি ভালবাসা, স্নেহ ও বিশ্বাস এবং সর্বোপরি এ-বাড়ির প্রত্যেকের তার প্রতি ভালবাসা ও বিশ্বাসের সুদৃঢ় বর্মটা গায়ে দিয়ে অনায়াসেই সে সকলের সন্দেহ থেকে দূরে যেতে পারত, ঘটনাচক্রে সে-রাত্রে আমি এখানে শিবতোষবাবুর আহ্বানে না এসে পড়লে হয়ত নির্বাণীতোষের হত্যাকারী চিরদিন অন্ধকারেই থেকে যেত।

বীরেন মুখার্জী বললেন, কিন্তু দীপিকাদেবী জ্ঞান ফিরে পাবার পর?

তখনো তিনি বলতেন কিনা সন্দেহ। এবং আজ যে ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তাঁর ঘুমোননা মনের ওপরে একটা শক-এর আলোর ঝাপটা ফেলার, সেরকম কিছু না ঘটলে কবে যে তাঁর অহল্যার ঘুম ভাঙত তাই বা কে জানে! অবিশ্যি জেগে উঠে সব যখন তিনি জানতে পারবেন, নতুন করে আঘাত পাবেন এবং প্রচণ্ড আঘাতই পাবেন। সে কথা জেনেও আমি এই ব্যবস্থা করেছি, কারণ যতই আঘাত লাগুক তিনি তাঁর স্বামীর হত্যাকারীকে তো অন্তত চিনতে পারবেন।

ঐ ঘরে এসে কাহিনীর শেষাংশ শুরু করবার আগে কিরীটী নীচের তলা থেকে শিবতোষবাবুকে ডাকিয়ে আনিয়েছিল। তিনি সব শুনে যেন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। কিরীটীর বলা শেষ হবার পর মৃদু কণ্ঠে কেবল বললেন, আশ্চর্য, শিখেন্দু–!

শিবতোষবাবুর চোখে জল।

কারো মুখেই কোন কথা নেই। ভোরের আলো জানলাপথে তখন ঘরে এসে পড়েছে। কিন্তু পাশের ঘরে শয্যায় তখনো ওষুধের প্রভাবে দীপিকা আঘোরে ঘুমোচ্ছ। পরম নিশ্চিন্তেই যেন ঘুমোচ্ছে।