০৯. ঐদিনই বিকেলের দিকে

ঐদিনই বিকেলের দিকে।

খোলা জানলাপথে মৃদু মৃদু প্রথম বসন্তের হাওয়া আসছে।

কৃষ্ণা আর কিরীটী তাদের বসবার ঘরে বসে গল্প করছিল। জংলী এসে ঘরে ঢুকল, বাবুজী!

কিরে?

একজন ভদ্রমহিলা আর একজন ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।

কোথা থেকে এসেছে? নাম কি?

বলতে বললেন শিবতোষবাবুর মেয়ে।

যা, এই ঘরে নিয়ে আয়।

একটু পরে ঢুকল স্বাতী ও দামী সিল্কের সুট-পরিহিত সুদর্শন এক ভদ্রলোক, বয়স আটাশ-ঊনত্রিশ হবে।

আসুন।

নমস্কার। আমার নাম পরেশভৌমিক, স্বাতী আমার স্ত্রী,কলকাতা হাইকোর্টে আমি প্র্যাকটিস করি। বার-এট-এল। আপনিই তো মিঃ রায়!

হ্যাঁ বসুন, নমস্কার।

ওঁরা দুজন বসলেন। তারপর পরেশ ভৌমিক বললেন, দেখুন মিঃ রায়, আপনি হয়ত আমাদের দুজনের এভাবে আসায় একটু অবাকই হয়েছে, ভাবছেন কেন এলাম—

না না, তা কেন—

এসেছি এইজন্য যে, আমার স্ত্রী স্বাতী সেদিন আপনার কাছে যে স্টেটমেন্ট দিয়েছিল তার মধ্যে একটা মিথ্যা ছিল, শুনে আমি ওকে নিয়ে এলাম, মিথ্যাটা সংশোধন করে নেবার জন্য।

মিথ্যা স্টেটমেন্ট! কিরীটী তাকাল পরেশ ভৌমিকের মুখের দিকে।

হ্যাঁ, স্বাতীয়ে বলেছিল, ওদের বৈমাত্রেয় ভাই, ঐদিন উৎসবের রাত্রে—

কিরীটী বাধা দিয়ে বললে, হ্যাঁ, উনি বলেছিলেন ওঁদের বৈমাত্রেয় ভাই আশু মল্লিককে কখনও উনি বেলতলার বাড়িতে আসতে দেখেননি। উনি যে সত্য গোপন করেছিলেন সেটা আমি বুঝতে পেরেছি পরে।

পেরেছেন বুঝতে?

হ্যাঁ, আগের কথা বলতে পারি না, তবে উৎসবের রাত্রে যে আশু মল্লিক এসেছিলেন সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। আর এও বুঝেছিলাম, অন্য কোনদিন না দেখলেও সে রাত্রে উনি বুঝতে পেরেছিলেন ঐ অচেনা আগন্তুকই ওঁর বৈমাত্রেয় ভাই। আপনার যদি আপত্তি না থাকে স্বাতীদেবী, এবার বলুন সে-রাত্রে কখন কোথায় দেখেছিলেন তাঁকে আর চিনতেই বা পারলেন কি করে তাঁকে যে তিনি আপনাদের বৈমাত্রেয় ভাই?

বল স্বাতী, আমাকে যা বলেছ তা ওঁকে বল। ব্যাপারটা একটা জঘন্য মাডার কেস, প্রত্যেক সমাজ-সচেতন ব্যক্তিরই কর্তব্য দেশের আইনকানুনকে সাহায্য করা নিজ নিজ সাধ্যমত। ইট ইজ ইওর ডিউটি, স্পিক আউট!

স্বাতী তখন যা বললে—

রাত সাড়ে দশটা নাগাদ সে একবার উপরে গিয়েছিল, দু-চার-পাঁচ মিনিট হয়ত আগেই। দীপিকার চশমাটা আনতে ওপরের ঘর থেকে। বৌ সাজাবার পর দীপিকা চশমাটা পরতে ভুলে গিয়েছিল। পরে তাকে ঘরে এনে বসিয়ে দেবার ঘন্টা-তিনেক পরে কষ্ট হতে থাকায় শেষ পর্যন্ত স্বাতীকে বলে ওপরে গিয়ে চশমাটা নিয়ে আসার জন্য। সেই চশমাটা আনতেই স্বাতী ওপরে গিয়েছিল। ঘরের দরজা খোলা এবং ঘরে আলো জ্বলতে দেখে স্বাতী একটু অবাকই হয়। হঠাৎ ওর কানে আসে ঘরের মধ্যে তার দাদা যেন কার সঙ্গে কথা বলছে।

দাদার কথা নিশ্চয়ই শুনেছিলেন আপনি? কিরীটীর প্রশ্ন।

হ্যাঁ, দাদা যেন কাকে বলছিল, নিশ্চয়ই দেব দাদা, তোমার আশীর্বাদ দীপাকে আমি নিজেই পরিয়ে দেব। কিন্তু তুমিও তো নিজের হাতে তাকে দিতে পার, সে সব জানে—তাকে ডেকে আনব নীচে থেকে?

তারপর?

জবাব এল ভারী গম্ভীর গলায়, না না—তার কোন দরকার নেই ভাই। তুমি তাকে দিও আমার নাম করে। এ বাড়িতে কোনদিনই আমি আসতাম না, আসব না-ই ভেবেছিলাম, কিন্তু তোমার চিঠি পেয়ে আসতেই হল।

এবার আমি যাব। বড়দা বললেন শুনতে পেলাম।

দাদা?

বল? বড়দার গলা।

বাবাকে তুমি ত্যাগ করেছ বড়মার ওপরে অন্যায় করেছিলেন বলে। সে ব্যাপারে আমি কিছুই বলতে চাই না, কিন্তু আমরা ভাইবোনেরা তো কোন অপরাধ করিনি তোমার কাছে?

আমাদের কেন ত্যাগ করলে?

বড়দার গলা শোনা গেল আবার, তোমাদের তো আমি ত্যাগ করিনি ভাই। ত্যাগ করলে কি আসতাম আজ তোমার চিঠি পেয়ে। কিন্তু আর নয় ভাই, এবারে আমি যাব।

স্বাতী বললে, তখনি দরজার পাশ থেকে উঁকি দিয়ে বড়দাকে আমি দেখি। দাদা বড়দাকে প্রণাম করল। বড়দা দাদার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন।

তারপর?

বড়দা বললেন দাদাকে, আসার কথা যেন কেউ না জানতে পারে নির্বাণী।

কেউ জানবে না দাদা।

না, বোনেদেরও বলল না।

না, বলব না। আমি তুমি আসবে ফোনে সেদিন হাসপাতালে বলার পরই এই ঘরের রাথরুমের দরজাটা খুলে রেখে দিয়েছিলাম আজ সন্ধ্যাবেলাতেই। চল ঐ পথ দিয়েই তোমায় বের করে দেব। স্বাতী তার কথা শেষ করে একটু থামল, তারপর আবার বললে, আর একটা কথাও আপনার জানা দরকার কিরীটীবাবু।

বলুন?

বড়দা বৌদিকে দেবার জন্য দাদার হাতে যে প্রেজেনটেশনটা দিয়ে গিয়েছিলেন, একটা সোনার হার, সেটা আমার কাছেই আছে।

আপনার কাছে?

হ্যাঁ, দাদা বড়দাকে নিয়ে বের হয়ে যাবার পর ঘরে ঢুকে আমি একটা ভেলভেটের কেস বিছানার ওপর পড়ে থাকতে দেখে সেটা তুলে নিই।

তারপর?

নীচে নিয়ে এসেছিলাম বৌদির গলায় পরিয়ে দেব বলে, কিন্তু লোকজনের আসা-যাওয়ার জন্য সুযোগ পাইনি। সেটা আমার কাছেই আছে। কথাগুলো বলে স্বাতী কেমন যেন ইতস্তত করতে থাকে। মনে হয় কিরীটীর, স্বাতীর যেন আরো কিছু বলার আছে কিন্তু বলতে পারছে না।

আর কিছু বলবেন স্বাতীদেবী?

কিরীটীবাবু!

বলুন?

দাদাকে বড়দা খুন করতে পারে বলে আপনার বিশ্বাস হয়?

না। আপনার দাদাকে আশুবাবু খুন করেননি।

আঃ, আপনি আমাকে বাঁচালেন কিরীটীবাবু। আমার স্বামীর ধারণা বিষয়ের লোভে বড়দাই দাদাকে–

পরেশবাবু, নির্বাণীবাবুর হত্যাকারী আশু মল্লিক নন।

আপনি বুঝতে পেরেছেন কে হত্যাকারী? পরেশ ভৌমিক জিজ্ঞাসা করলেন।

পেরেছিলাম গতকালই, এখন নিঃসন্দেহ হলাম।

কে–কে হত্যাকারী?

ক্ষমা করবেন মিঃ ভৌমিক, সবটাই আমার অনুমান এখনও। অনুমানের ওপর নির্ভর করে তো একজনের হাতে হাতকড়া পরানো যায় না। প্রমাণ-প্রমাণের দরকার, কাজেই যতক্ষণ না সেই প্রমাণ আমার হাতে আসছে কিছুই বলতে পারব না।

অতঃপর স্বাতী ও পরেশ ভৌমিক বিদায় নিল। একটু পরে কৃষ্ণা ঘরে ঢুকে দেখল, কিরীটী ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে।

ওরা কি বলতে এসেছিল গো? কৃষ্ণা শুধাল।

ওরা যা বলে গেল, মানে স্বাতীদেবী, অর্থ হচ্ছে হতভাগ্য নির্বাণীতোষ নিজেই তার হত্যাকারীর আসবার পথটা খুলে রেখেছিল।

সে কি!

হ্যাঁ। সত্যিই ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! জান সে রাত্রে আশু মল্লিক তার ভাতৃবধূকে আশীর্বাদ করতে এসেছিল।

আশু মল্লিক, সত্যি-সত্যিই এসেছিল তাহলে?

হ্যাঁ, কিন্তু—

কি?

দুভাগ্যই বলতে হবে। বাপ ও ছেলের মধ্যে পুনর্মিলনের যে ক্ষীণ সম্ভাবনাটুকু ছিল, নির্বাণীতোষের মৃত্যুতে তাও আর রইল না। বাপ ও ছেলের মধ্যে যে সেতুটা গড়ে উঠছিল, সেটা বোধ হয় চিরদিনের মতই ভেঙে গেল।

তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে যেন আরও কিছু সংবাদ আছে! কৃষ্ণা বলল।

হ্যাঁ কৃষ্ণা, হত্যাকারী আর অস্পষ্ট নেই—সে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আমার সামনে এতক্ষণে। সন্দেহটা আমার গোড়া থেকেই হয়েছিল–কিন্তু ঐ নীলবসনা নারী, সে-ই সব যেন কেমন গোলমাল করে দিচ্ছিল।

নীলবসনা নারী কে ছিল বুঝতে পেরেছ?

অনুমান করতে পেরেছি বৈকি, এবং তার আইডেনটিফিকেশানেরও সব ব্যবস্থা করেছি। অহল্যার ঘুম ভাঙানোর জন্য কিন্তু এখন মনে হচ্ছে—

কি গো?

অহল্যার ঘুম ভাঙা মানেই তো নিদারুণ আর এক আঘাত তার বুক পেতে নিতে হবে।

তোমার কি মনে হয় হত্যাকারীকে সে চিনতে পেরেছিল?

সম্ভবত নয়। কারণ হত্যাকারী সে-সময় তার ধারেকাছেও ছিল না।

তবে?

ঐ ভাবে আকস্মিক স্বামীর রক্তাক্ত ছোরাবিদ্ধ মৃতদেহটাই তাকে এমন আঘাত হেনেছিল যে সেটা সে সহ্য করতে পারেনি। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায় ওঁ মনের ভারসাম্য হারায়।

ঐ সময় ঘরের কোলে টেলিফোনটা বেজে উঠল।

কিরীটী এগিয়ে গিয়ে ফোনের রিসিভারটা তুলে নিল, কিরীটী রায়—

আমি শিখেন্দু বলছি।

হ্যাঁ, হ্যাঁ বলুন! সংবাদ পেয়েছেন?

হ্যাঁ।

নবীন অপেরাতেই দেখা পেলেন?

না। সেখান থেকে তার ঠিকানা যোগাড় করে কুমোরটুলিতে তার বাসায় গিয়ে দেখা করি। পাইকপাড়া স্পোর্টস ইউনিয়ন ক্লাবের এক সময় মেম্বার ছিল তপন শিকদার। সে-সময় ওদের ক্লাবে বরাবরই রোল করেছে। তারপর বছর দুই হল তপন নবীন অপেরায় জয়েন করেছে

আপনি সে-রাত্রির কথা বলুন।

সে-রাত্রে সঞ্জীব তাদের ক্লাবের বহ্নিশিখা বইতে আদৌ নামেনি—

তাই নাকি!

হ্যাঁ। অথচ প্লের দিন স্থির হয়ে গিয়েছে, তাই তখন সে তপন শিকদারকে গিয়ে ধরে রোলটা করে দেবার জন্য।

তারপর?

তপন একশো পঁচিশ ডিমাণ্ড করে। শেষটায় একশোতে রাজী করায় সঞ্জীব কে পঞ্চাশ টাকা অ্যাডভান্স করে দেয়, কথা ছিল বাকি টাকা সে প্লে শেষ হবার পর পাবে। ওদের ক্লাবের সেক্রেটারী সেকথা জানত না। তিনি ভেবেছিলেন, তপন শিকদার ক্লাবের একসময় মেম্বার ছিল, বিনি পয়সাতেই একটা রাত্রি প্লে করে দিচ্ছে—তাই প্লের পর টাকা চাওয়ায় সেক্রেটারী তাকে টাকা দেয়নি। বলেছিল, সঞ্জীবের সঙ্গে কথা বলে টাকা দেবে—

ঠিক আছে, বাকি যা বলেছিলাম তার ব্যবস্থা করেছেন?

হ্যাঁ।

নীল শাড়ি যোগাড় হয়েছে?

সে হয়ে যাবে।

তা হলে মনে থাকে যেন, কাল রাত দশটায় যেমন বলেছি, তপনবাবুকে নীল শাড়ি পরিয়ে নিয়ে আসবেন শিবতোষবাবুর বেলতলার বাড়িতে।

বেশ।

শুধু আপনি একা নয় কিন্তু—

তবে?

সঞ্জীববাবু, নির্মলবাবু ও পরেশবাবুকেও সঙ্গে আনবেন।

তাদের কি বলব?

বলবেন আমি আসতে বলেছি, কাল রাত দশটায় নির্বাণীবাবুদের বেলতলার বাড়িতে। আরও একটা কথা, সদর দিয়ে কিন্তু বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করবেন না।

তবে? কোথা দিয়ে ঢুকব?

বাড়ির পেছনে যে গোপন লোহার সিঁড়িটা আছে, সেই সিঁড়ি দিয়ে সোজা আপনারা নির্বাণীবাবুর শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকবেন তিনতলায়। বাথরুমের দরজা খোলা থাকবে, বারান্দার ভেতর দিয়ে ঢুকবেন।

শিখেন্দু কোন সাড়া দেয় না।

শিখেন্দুবাবু, বুঝতে পেরেছেন প্ল্যানটা আমার?

পেরেছি। কিন্তু এসব কেন করছেন তা তো বললেন না!

আমার স্থির বিশ্বাস—

কি?

যে আয়োজন আমরা করেছি, তাতে করে অহল্যার ঘুমও ভাঙবে–হত্যাকারীর মুখোশটাও তার মুখ থেকে খুলে যাবে।

আপনি সত্যিই তাই মনে করেন কিরীটীবাবু?

এখন আর কথা নয় শিখেন্দুবাবু, আমার কিন্তু কাজ এখনো বাকি আছে। সেগুলো আমায় শেষ করতে হবে। কাল দেখা হবে রাত দশটায়।