০৫. পরেশ চিরদিনই ডিটেকটিভ বইয়ের পোকা

পরেশ চিরদিনই ডিটেকটিভ বইয়ের পোকা। ইংরাজী বাংলা কোন ডিটেকটিভ বই-ই সে বাদ দেয় না এবং সুযোগ পেলেই ডিটেকটিভগিরি করে।

নির্মল কিন্তু চটে যায়। বললে, কি ইয়ার্কি হচ্ছে, এমন একটা সিরিয়াস ব্যাপার–

সেইজন্যই তো সিরিয়াসলি আমি প্রশ্নটা করেছি। পরেশ গম্ভীর হয়ে বলে।

শিখেন্দু এবারে বললে, নিবার্ণীর বাবা কিরীটী রায়কে ডেকেছেন তদন্ত করবার জন্য।

বলিস কি! পরেশ বললে।

হ্যাঁ, মনে হচ্ছে যেভাবেই হোক তিনি জানবেনই কে তাঁর ছেলেকে অমন করে খুন করে গেল।

ও আর দেখতে হবে না শিখেন্দু, কিরীটী রায়ের যখন আবির্ভাব ঘটেছে, আততায়ীর আর নিস্তার নেই। ইস, কাল রাত্রে অমন একটা ব্যাপার ঘটবে যদি জানতাম, তাহলে এত তাড়াতাড়ি নেমন্তন্ন খেয়ে ওখান থেকে চলে আসি!

শিখেন্দু উঠে পড়ল, স্নান সেরেই তাকে বেরুতে হবে। জামা কাপড় খুলে মাথায় তেল মেখে তোয়ালেটা কাঁধে ফেলে শিখেন্দু একতলার দিকে চলে গেল।

নির্মল আর সঞ্জীব দুজনই চুপচাপ বসে। কারও মুখে কোন কথা নেই।

পরেশ একবার ওদের মুখের দিকে তাকাল, তারপর পকেট থেকে চারমিনারের প্যাকেটটা। বের করে একটা সিগারেট ধরালো নিঃশব্দে।

সিগারেটে গোটা-দুই টান দিয়ে পরেশ বললে, ব্যাপারটা তোদের কি মনে হয় সঞ্জীব, নির্মল?

ওরা দুজনেই যুগপৎ পরেশের মুখের দিকে তাকাল। কেউ কোন কথা বললে না।

পরেশ আবার বললে, নির্বাণীকে কে অমন করে খুন করতে পারে বলে মনে হয় তোদের?

নির্মল ক্ষীণ গলায় বললে, কি করে বলব?

দেখ বাবা, সত্যি কথা বলি, আমরা সবাই অথাৎ তুই নির্মল সঞ্জীব শিখেন্দু আমি শ্রীমান পরেশ ইন্টারেসটেড পার্টি ছিলাম

মানে! নির্মল বললে।

মানে, সবাই আমরা মনে মনে চেয়েছি দীপাকে, কিন্তু মাঝখান থেকে দীপা হয়ে গেল নির্বাণীর। দীপা নির্বাণীর গলাতেই শেষ পর্যন্ত মালা দিল।

নির্মল চেচিয়ে ওঠে, হোয়াট ননসেন্স! বোকার মত কি সব যা-তা বলছিস পরেশ!

বোকা নয় বন্ধু। গোপন প্রেম, প্রেম থেকেই লালসা, লালসা থেকেই হিংসা এবং হিংসা থেকেই আক্রোশ ও তার পরিণতি হত্যা, দীপাকে না পাওয়ার জন্য–

তুই থামবি পরেশ! নির্মল আবার খিঁচিয়ে ওঠে।

আমি থামলেও কিরীটী রায় থামবে না বন্ধু। পরেশ বললে।

সঞ্জীব বললে, এমন একটা সিরিয়াস মুহূর্তে তোর ওই সব ভণ্ডামি আমার একটুও ভাল লাগছে না পরেশ, সত্যি!

কিন্তু তবু এটা সত্যি সঞ্জীব, তুই আমি নির্মল শিখে সবাই নির্বাণীর মত দীপাকে মনে মনে কামনা করেছি। দোষ নেই অবিশ্যি তাতে। একটি সুন্দরী আকর্ষণীয়া তরুণীর প্রতি আমাদের মত তরুণদের আকর্ষণ জাগাটা এমন কিছু দোষের নয়, র্যাদার ন্যাচারাল। তাছাড়া আমার কথাটা যে মিথ্যে নয়, সেটা নিশ্চয়ই তোমরা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।

সঞ্জীব বললে, তার মানে পরেশ তুই কি বলতে চাস! সঞ্জীবের গলার স্বরটা যেন একটু কেঁপে গেল।

বলতে চাই যা একটু আগেই তা তোদের বললাম।

ঐ সময় শিখেন্দু তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ঘরে পুনরায় প্রবেশ করে বললে, কি বললি রে পরেশ!

বলছিলাম, পরেশ বললে, তুই আমি নির্মল সঞ্জীব আমরা এই চারজনের মধ্যে—

কি? হাতে চিরুনিটা নিয়ে পরেশের মুখের দিকে তাকাল শিখেন্দু।

যে কেউ একজন, পরেশ বললে, কাল রাত্রে নির্বাণীকে হত্যা করতে পারি।

হাতের চিরুনি থেমে যায় শিখেন্দুর, সে যেন বজ্রাহত, পরেশের মুখের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ বোজা গলায় প্রশ্ন করলে, আমরাই কেউ কাল রাত্রে নির্বাণীকে হত্যা করেছি?

করেছি তা তো আমি বলিনি শিখেন্দু, তবে করতে পারতাম।

তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে! শিখেন্দু বললে।

মাথা আদৌ খারাপ হয়নি, আমরা সকলেই মনে মনে দীপাকে চেয়েছি, নির্বাণীও চেয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত সে-ই পেল দীপাকে—তাতে করে নির্বাণীর ওপরে একটা আক্রোশ আমাদের হওয়া স্বাভাবিক, যে আক্রোশের বশে হত্যাও করা যায়।

শিখেন্দু চুপ। একেবারে যেন বোবা।

হাতের চিরুনি হাতেই ধরা আছে তখন তার, সে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে পরেশের মুখের দিকে, পরেশ যেন হিংস্র নখর দিয়ে ওদের প্রত্যেকের মনের উপর থেকে একটা পদা ছিড়ে ওদের প্রত্যেককে নিজেদের মুখখামুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

পরেশ বলতে থাকে, দেখ, একমাত্র সঞ্জীব ছাড়া আমরা সকলেই কাল রাত্রে উৎসবে উপস্থিত ছিলাম। আমরা সকলেই ছিলাম নির্বাণীর বন্ধু, কাজেই আমাদের দ্বার ঐ বাড়িতে অবারিত ছিল। আমরা যদি ইচ্ছা করতাম, অনায়াসেই আমরা যে কেউ একজন আমাদের মধ্যে কোন এক ফাঁকে তিনতলায় গিয়ে বাথরুমের মধ্যে সুযোগর অপেক্ষায় আত্মগোপন করে থাকতে পারতাম।

তারপর? ক্ষীণ গলায় বলে উঠল সঞ্জীব ও শিখেন্দু।

তারপর কাজ শেষ করে, অনায়াসেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে পারতাম।

কিন্তু–, শিখেন্দু বললে, গোকুল দোতলার বারান্দায় ছিল, তিনতলায় কাল রাত্রে যে যে গিয়েছে সে বলেছে।

কারো পক্ষেই এটা সম্ভব নয় বন্ধু, সর্বক্ষণ সিঁড়ির দিকে নজর রাখা। আর এও সম্ভব নয়, র্যাদার অ্যাবসার্ডভাবো যে গোকুল সর্বক্ষণই তিনতলার সিঁড়ির দিকে চেয়ে ছিল! যেতে আসতে প্রত্যেককেই দেখেছে!

কিন্তু সঞ্জীব তো কাল উৎসব-বাড়িতে যায়ইনি।

শিখেন্দু বললে, তবে তাকে কি করে সন্দেহ করা যেতে পারে?

যায়নি সেটা সঞ্জীব বলেছে।

সঞ্জীব ঐ সময় বললে, আমি কি মিথ্যা বলেছি?

মিথ্যা তুমি বলেছ কি না বলেছ সেটাও প্রমাণসাপেক্ষ।

তার মানে? সঞ্জীব বেশ যেন একটু বিরক্তই হয়েছে মনে হল। আমি তো রাত্রে সে-সময় থিয়েটার করছিলাম।

কিরীটীবাবু শুনলে হয়ত বলবেন, ওটা তোমারমানে, তোমার ঐ সময়ে অনুপস্থিতিটার স্রেফ একটা অ্যালিবি, মানে

দেখ পরেশ, তোর ডিটেকটিভ বই পড়ে পড়ে মাথাটাই দেখছি বিগড়ে গেছে। নির্মল বললে, এই ধরনের সব লুজ টকস্ সময়বিশেষে কত সাংঘাতিক মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে জানিস!

সে তুই যাই বল্ নির্মল, সন্দেহের তালিকা থেকে আমরা তিনজন—বিশেষ করে নির্বাণীর বন্ধুদের মধ্যে বাদ পড়ব না।

ইডিয়ট! নির্মল বললে।

পরেশ কিন্তু নির্মলের গালাগালিটা গায়ে মাখে না। হাসতে থাকে।

মেসের ভৃত্য চরণ এসে ঘরে ঢুকল, আমাকে ডাকছিলেন শিখেন্দুবাবু?

হ্যাঁ, সামনের রু হটার কেবিন থেকে গরম দুটো টোস্ট আর এক কাপ চা নিয়ে এসো তো চরণ।

ঐ সঙ্গে আমার জন্যও এক কাপ চরণদাস, সঞ্জীব বললে।

চরণদাস ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

ঘরের আবহাওয়াটা যেন হঠাৎ কেমন থমথমে হয়ে গিয়েছে। কারও মুখেই কোন কথা নেই। এমন কি পরেশও যেন চুপচাপ।

আসলে পরেশের কথাগুলো যেন কেউই একেবারে উড়িয়ে দিতে পারছে না, মন থেকে একেবারে মুছে ফেলতে পারছে না।

সকলের মনের উপরেই যেন একটা কালো সন্দেহের ছায়া ফেলেছে। ছায়াটা কালে-কালো। শিখেন্দুর একটা কথা মনে পড়ল, কিরীটী তখন বারবার প্রশ্ন করেছিল, একবার নয় দুবার, সে গত রাত্রে তিনতলায় গিয়েছিল কিনা? সত্যিই সে যায়নি, তবে কিরীটীবাবু কেন ঐ প্রশ্নটা বার বার করেছিলেন। তবে কি পরেশের কথাই ঠিক!

কিরীটীবাবু তাকেও সন্দেহ করছেন।

শিখেন্দুর ভিতরটা যেন সহসা ঠাণ্ডা হিম হয়ে আসে। একটা অজ্ঞাত ভয় যেন তার মনের ওপর চেপে বসে। সে তার বন্ধুকে হত্যা করতে পারে ভাবতে পারলেন কি করে কিরীটীবাবু!

হ্যাঁ, দীপাকে সে ভালবেসেছিল, কিন্তু যে মুহূর্তে সে বুঝতে পেরেছিল নির্বাণী দীপাকে চায় এবং দীপাও নির্বাণীকে চায় সে তো সরে এসেছিল ওদের মধ্যে থেকে। খুশি মনেই সে বিয়ের উৎসবে যোগ দিয়েছিল।

পরেশই স্তব্ধতা ভঙ্গ করল, বেচারী নির্বাণীতোষ! প্রেমের পূজোয় একেবারে নির্বাণলাভ করে বসে রইল।

নির্মল চেঁচিয়ে ওঠে হঠাৎ অস্বাভাবিক গলায়, তুই থামবি পরেশ!

পরেশ বলল, একটা সিগারেট দে, গলাটা শুকিয়ে উঠেছে, একটু ধোঁয়া দেওয়া দরকার।

গলায় নয়, তোর মনে আগুন দেওয়া দরকার। নির্মল বললে।

সে সকলেরই একদিন দিতে হবে। পরেশ নির্বিকার কণ্ঠে বললে।