০৩. রাত প্রায় পৌনে দশটা

রাত প্রায় পৌনে দশটা।

ডাইনিং সেলুন প্রায় খালি হয়ে এসেছে তখন। কয়েকটা টেবিলে সামান্য কয়জন যাত্রী এদিক ওদিক ছড়িয়ে তাদের রাতের খানা শেষ করে কফির পেয়ালা নিয়ে বসেছে। কারো কারো সেই সঙ্গে চলেছে ধূমপান।

দ্রুত ধাবমান মেল ট্রেনের কাঁচের জানালা-পথে শীতের স্তব্ধ রাত্রির চতুর্দশীর চঁাদের আলো যেন অলসভাবে গা এলিয়ে পড়ে আছে।

মধ্যে মধ্যে এক-একটা স্টেশন মেল গাড়িটা অতিক্রম করে চলেছে। স্টেশনের আলো চকিতে যেন দেখা দিয়ে আবার দৃষ্টিপথের আড়ালে চলে যাচ্ছে।

ওরা দুজনেও ইতিমধ্যে খানা শেষ করে কফি নিয়ে বসেছিল। বেয়ারারা একে একে টেবিল পরিষ্কার করে ডিশ-প্লেট, কাঁটা-চামচ তুলে নিয়ে যাচ্ছে কেবল তারই মৃদু শব্দ মধ্যে মধ্যে শোনা যায়।

যে সময়ের কথা বলছি তখনো করিডোর ট্রেনের প্রচলন হয়নি।

কাজেই খানা শেষ হয়ে গেলেও গাড়ি আসানসোল না পৌঁছানো পর্যন্ত ওদের ডাইনিংকারেই থাকতে হবে।

কিরীটী!

উঁ—

ঐ রঞ্জিত কাপুর লোকটা—ওকে দেখেছিস আগে? মীনাক্ষীর ভগ্নীপতি?

না। তবে যে সম্পর্কটার কথা ওদের পরস্পরের বললে সেটাও আমার সত্য বলে। মনে হয় না।

আমারও তাই মনে হচ্ছে।

কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা।

কি? তোর ব্যাপারটা ওদের জানা?

নিঃসন্দেহে। যেভাবেই হোক, প্রতিপক্ষ টের পেয়েছে যে আমি দিল্লী কেন্যাচ্ছি এবং কবে, কখন যাচ্ছি।

তোর অনুমান যদি সত্য হয় তো তাই দেখতে পাচ্ছি।

যে কারণে প্লেনে না গিয়ে ট্রেনে চলেছি, সেটা দেখছি মাঠেই মারা গেল।

আমার মনে হয় গতবার যখনু তুই দিল্লী গিয়েছিলি তখনই ওরা জানতে পেয়েছিল কোনমতে—

কিরীটী কোন জবাব দিল না।

সে যেন কি ভাবছিল।

সুব্রত আবার বললে, ওদের অজ্ঞাতে ব্যাপারটা থাকলে তুই হয়ত কাজের কিছুটা সুবিধা পেতিস।

কিরীটী মৃদু হেসে বললে, এখনো কোন অসুবিধা হবে না। যতটা সতর্ক থাকতাম তার চাইতে বেশীই থাকব কিন্তু গাড়ি বোধ হয় আসানসোল এলো—ইয়ার্ডের আলো দেখা যাচ্ছে।

একজন বেয়ারা কফির শূন্য কাপগুলো তুলে নিতে এসেছিল, তাকেই সুব্রত জিজ্ঞাসা করে, আসানসোল আর কেতনা দূর?

আসানসোল গাড়ি আগয়ি সাব—

মিনিট দশেকের মধ্যে সত্যিই গাড়ির গতি হ্রাস পায়—বাইরের আলো আরো উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেয়।

বিল মিটিয়ে দিয়ে ওরা উঠে পড়ল।

গাড়ি থামতেই ওরা ডাইনিং-কার থেকে নামল।

কনকনে শীত বাইরে।

তবু তারই মধ্যে দেখা যায় প্ল্যাটফর্মে যাত্রীর ভিড়, ভেন্ডারদের চিৎকার—গরম চায়-গরম পুরি—পান সিগ্রেট–

ওরা এসে যখন কামরায় ঢুকলো—কাপুর উপরের একটা বার্থে আপাদমস্তক কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে। বোধ হয় ঘুমিয়েও পড়েছে। শকুন্তলা কিন্তু তখনো শোয়নি, নীচের বার্থে একটা কালো রংয়ের গরম রাত্রিবাস গায়েবার্থের উপর বিস্তৃত শয্যায় বসে একটা কি বই পড়ছে।

ওদের ঢুকতে দেখে বললে, খাওয়া হলো রায় সাহেব।

হ্যাঁ। কাপুর সাহেব দেখছি শুয়ে পড়েছেন।

হ্যাঁ। ওর নেশাটা বোধ হয় একটু বেশীই হয়েছিল, খানা খেয়েই শুয়ে পড়েছে। ওর তো এতক্ষে মধ্যরাত্রি।

সুব্রত বললে, আপনি যে শোননি?

ট্রেনে চট করে আমার ঘুম আসে না।

সুব্রত তার সুটকেস খুলে রাত্রিবাসটা বের করে কামরা থেকে বের হয়ে গেল।

ল্যাভেটরিতে গিয়ে রাত্রিবাস গায়ে চাপিয়ে সুব্রত মিনিট পনেরো বাদে যখন কামরায় ফিরে এলো, কিরীটী উঠে দাঁড়াল হাতে রাত্রিবাসটা নিয়ে।

কিরীটীর রাত্রে স্নান করা অভ্যাস, তা সে কি গ্রীষ্ম কি শীত। স্নান না করলে রাত্রে তার ঘুমই হয় না।

ফিরে এসে দেখলো কিরীটী, সুব্রত শুয়ে পড়েছে আগাগোড়া কম্বলটা মুড়ি দিয়ে। শকুন্তলাও শুয়ে পড়েছে।

রাতও অনেক হয়েছে।

কিরীটী বার্থে উঠে আলোটা নিভিয়ে দিয়ে গায়ে কম্বলটা টেনে দিল।

চলন্ত ট্রেনে কিরীটীরও তেমন বড় একটা ভাল ঘুম কোনদিনই হয় না। তবু সে চোখ বুজে ঘুমোবার চেষ্টা করে।

ঘুমিয়ে পড়েছিল কিরীটী।

যখন ঘুম ভাঙল চারিদিকে বেশ আলো ফুটে উঠেছে।

কামরার বন্ধ কঁচের শার্সি ভেদ করে কামরার মধ্যে আলো এসে পড়েছে-তবে সেটা খুব স্পষ্ট নয়। ঝাপসা ঝাপসা।

বালিশের উপর থেকে মাথাটা সামান্য তুলে নীচের দিকে তাকাল। ট্রেনের গতি তখন ক্রমশ হ্রাস হয়ে আসছে।

ট্রেন বোধ করি মোগলসরাই এলো।

গরম ড্রেসিং গাউনটা গায়ে জড়িয়ে কিরীটী উপরের বার্থ থেকে নীচে নামল। নীচের দুটো বার্থে শকুন্তলা আর সুব্রত ঘুমোচ্ছ।

উপরের বার্থে ঘুমোচ্ছে কাপুর।

স্টেশন ইয়ার্ডে অনেক আলো দেখা যাচ্ছে।

কিরীটী চায়ের পিপাসা বোধ করে। বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে কামরার মধ্যে যখন কিরীটী ফিরে এলো—দেখলো কামরার মধ্যে একমাত্র সুব্রত ছাড়া অন্য দুজন নেই।

মোগলসরাই স্টেশনে ট্রেন থেমেছে।

কিরীটী বাইরে গিয়ে দুজনের মতো চায়ের অর্ডার দিয়ে যখন কামরার মধ্যে ফিরে এলো-দেখলো কাপুর আর শকুন্তলা বসে চা পান করছে।

সুব্রত তখনো ঘুমোচ্ছে।

শকুন্তলা আর রঞ্জিত কাপুর দুজনাই বললে, গুডমর্নিং, মিঃ রায়।

গুড মর্নিং।

চা চলবে নাকি? শকুন্তলা শুধায়।

আপনারা খান—আমি চায়ের কথা বলে এসেছি।

সুব্রত কম্বলের তলা থেকেই কথা বলে ওঠে, বলেছিস?

হুঁ। তোর ঘুম ভাঙল? কিরীটী প্রশ্ন করে।

সুব্রত বললে, অনেকক্ষণ!

 

বেলা দুটো নাগাদ ট্রেন কানপুরে এসে পৌঁছায়।

কথা ছিল শকুন্তলা একাই কানপুরে নেমে যাবে কিন্তু রঞ্জিত কাপুরও নেমে গেল।

সুব্রত প্রস্তুত হয়েই ছিল। ওরা গাড়ি থেকে নামার কিছু পরেই সুব্রতও সুটকেসটা নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল।

কিরীটী একাই গাড়ির কামরায়—আর কোন যাত্রী ছিল না।

ট্রেন ছাড়ার পর কিছুক্ষণ কিরীটী চলন্ত গাড়ির জানালা-পথে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে-তারপর সকালে এলাহবাদে স্টেশনে কেনা সংবাদপত্রটা টেনে নেয় আবার নতুন করে চোখ বুলাবার জন্য।

দ্বিতীয় পৃষ্ঠা ওল্টাতেই হঠাৎ একটা ভাঁজ-করা কাগজ বের হয়ে পড়লো। একটু। কৌতূহলের বশেই ভাঁজ করা কাগজটা খুলে ধরতেই কিরীটী যেন একটা চমক অনুভব করে।

ভাঁজ করা কাগজ মাত্র নয়, একটা চিঠি।

সংক্ষিপ্ত ইংরাজীতে লেখা। বেশ পরিষ্কার করে গোটা গোটা ইংরাজীতে লেখা। লেখাগুলো সামান্য যেন কেঁপে কেঁপে গিয়েছে।

মিঃ রায়,

যারা আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন তারা যেমন আলেয়ার পিছনে ছুটছেন— আপনাকেও ঠিক তেমনি ছুটে মরতে হবে। আপনার ক্ষমতা আছে আমরা জানি, কিন্তু পেনিট্রেশন করার চেষ্টা করলে বিপদকেই ডেকে আনা হবে জানবেন। আর তাছাড়া যে কাজের জন্য আপনি যাচ্ছেন সেটা এখন সকলেরই নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে।

–এক্স

কিরীটী বার দু-তিন আগাগোড়া চিঠিটা পড়লো।

হাতের লেখা থেকে ঠিক স্পষ্ট বোঝা যায় না—হাতের লেখাটা মেয়ের না পুরুষের; খানিকটা মেয়েলী ধাঁচের লেখা বটে আবার পুরোপুরি মেয়েলীও নয়—পুরুষের হাতের লেখা হওয়াও আশ্চর্য নয়।

বেশ তাড়াতাড়ি লেখা হয়েছে।

কিন্তু লেখাটা কখন কাগজের মধ্যে এলো?

চিঠিটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিল কিরীটী।

এখন আরো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা সত্যিই খুব সহজ নয়। দপ্তর থেকে যে গোপনীয় দলিলটা চুরি গিয়েছে সেটার মূল্য বা গুরুত্ব সম্পর্কে এখনো বিশেষ কিছু জানে না কিরীটী। তবে দলিলটার যে বিশেষ একটা মূল্য আছে সেটা সে বুঝেছিল, নচেৎ অন্তত সে-ব্যাপারে দিল্লীতে তার ডাক পড়তো না এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরও অতখানি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতো না।

বিশেষ কোন আলোচনারই সুযোগ পায়নি গতবারে কিরীটী।

এবং এটাও সে বুঝতে পারছে, দলিলটা চুরি যাওয়ার ব্যাপারে সরকার-পক্ষ যে তার সাহায্যের জন্য তাকে আহ্বান জানিয়েছেন সেটা অন্তত প্রতিপক্ষের অজানা নেই আর।

অতএব তাকে এবার খুব সাবধানে অগ্রসর হতে হবে।

 

সকালের দিকে কিরীটী দিল্লী স্টেশনে অবতরণ করল।

তাকে নিয়ে যাবার জন্য হয়ত গাড়ি এবং তোক এসেছিল, কিন্তু কিরীটী সে সম্পর্কে কোন খোঁজখবরই নিল না—স্টেশন থেকে বের হয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ট্যাক্সিওয়ালাকে বলল, সোজা রায়সিনহা রোডে যেতে।

মনে মনে স্থির করেছিল সে, সোজা গিয়ে আপাতত তার বন্ধু দেবেশের ওখানেই উঠবে।

তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।