১৯. কিরীটীর ওখান থেকে বের

কিরীটীর ওখান থেকে বের হয়ে সুহাস মিত্র একটু অন্যমনস্ক হয়েই যেন বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগুতে থাকে। মিত্রানীর কথাই সে ভাবছিল বোধ হয়, হঠাৎ বাস স্ট্যান্ডের কাছাকাছি আসতেই কাজলের ডাক শুনে সুহাস থমকে দাঁড়াল।

সুহাস—

কে! ও তুমি! বাড়ি ফিরে যাওনি–

না। তোমার অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে ছিলাম এতক্ষণ—

আমার অপেক্ষায়! কেন?

তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল—

কথা! কি কথা—

এই রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে কথা হতে পারে না।

কিন্তু রাত অনেক হয়েছে—তোমাকে তো আবার ফিরতে হবে ট্রেনে–

সেজন্য তোমাকে চিন্তা করতে হবে না—

কথাটা কি খুব জরুরী? জিজ্ঞাসা করলো সুহাস।

জরুরী না হলে প্রায় এক ঘণ্টা এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করতাম। চল, ঐ পার্কটায় গিয়ে বসা যাক—

সুহাস একটু চুপ করে থেকে বললে, বেশ চল–

দশ পনেরো গজ দূরেই রাস্তাটা যেখানে সামান্য একটু বেঁকেছে—সেখান থেকে রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গিয়েছে—একটা যাওয়ার একটা আসার—মাঝখানে ট্রামের লাইন—

একটা ট্রাম উল্টো দিকে ঘন্টি বাজাতে বাজাতে চলে গেল, একটা বাস এসে দাঁড়িয়েছে—ঐ সময়ও যাত্রীতে একেবারে যেন ঠাসাঠাসি।

দুজনে ট্রাম-রাস্তা পার হয়ে একটা পার্কের মধ্যে এসে ঢুকল। গ্রীষ্মের সময় বলেই হয়ত তখনো পার্কের মধ্যে বেশ কিছু মানুষজন রয়েছে। দুজনে এগিয়ে গেল আরো কিছুটা—একটা খালি বেঞ্চ দেখে দুজনে পাশাপাশি বসলো।

কিছুটা সময় দুজনেই চুপচাপ, দুজনেই যেন যে যার ভাবনার মধ্যে তলিয়ে আছে।

সুহাস—হঠাৎ কথা বললো কাজল, এতদিনে আমি বুঝতে পারছি—

কি বুঝতে পারছো কাজল!

আই ওয়াজ এ ফুল–নচেৎ কথাটা আমার আরো আগেই বোঝা উচিত ছিল।

কি বলতে চাও তুমি কাজল স্পষ্ট করে বল।

বলবার তো আর কিছু নেই—

কিছুই যদি নেই তো এভাবে এখানে আমাকে টেনে নিয়ে এলে কেন?

কাজল বলতে লাগল, অবিশ্যি ব্যাপারটা যে আমি একেবারে অনুমান করতে পারি নি তা নয়—কিন্তু মনকে সান্ত্বনা দিয়েছি—না, হতে পারে না। তাছাড়া আমি ভেবেছিলাম——মিত্রানীর মনটা অন্য জায়গায় বাঁধা আছে—ওরা পরস্পরকে ভালবাসে যখন তখন আমি কিছুটা নিশ্চিত

কি বলছো তুমি কাজল, আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। মিত্রানী কাকে ভালবাসত—আর কেই বা মিত্রানীকে ভালবাসত—

কিন্তু সে ভুল আজ আমার ভেঙে গেছে। বুঝতে পারছি মিত্রানীর আরো অ্যাডমায়ারার ছিল—তাকে ভালবাসার জন্য আরো কেউ ছিল।

কাজল, সত্যিই বলছি তোমার হেঁয়ালি আমি একটুও বুঝতে পারছি না—

এই রকম কিছু যে আজ তোমার কাছ থেকে আমায় শুনতে হবে আমি জানতাম—

কাজল, অনেক রাত হয়ে গিয়েছে—আমাকে বাসায় ফিরতে হবে—আমি চললাম—

যাবে তো নিশ্চয়ই—তোমাকে আমি আটকাবো না কিন্তু মন তোমার অনেক, আগেই অন্য জায়গায় বাঁধা পড়েছে কথাটা আমাকে এতকাল জানতে দাওনি কেন! কেন আমাকে নিয়ে তুমি খেলা করেছো?

বিরক্তিভরা কণ্ঠে সুহাস বললে, খেলা তোমাকে নিয়ে আমি কোনদিনই করিনি কাজল, বোঝবার শক্তি থাকলে তুমি অনেক আগেই সেটা বুঝতে পারতে–

তা পারতাম হয়ত কিন্তু এও তুমি জেনো সুহাসবাবু, তোমার মুখোশটা আমি খুলে দেবো–

কাজল!

হ্যাঁ—আমি যতটুকু জানি সব কিরীটীবাবুকে বলবো।

কি বলবে?

আদালতে কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়ালেই সেটা বুঝতে পারবে—একটা বিষাক্ত জ্বালায় যেন কথাগুলো উচ্চারণ করে কাজল উঠে পড়ে হন হন করে গেটের দিকে এগিয়ে গেল।

আর সুহাস যেন কেমন বিমূঢ় হয়ে বেঞ্চটার উপরে বসে রইলো।

 

সকাল সকালই পরের দিন কিরীটী আর সুব্রত বের হলো। থানায় যখন ওরা এসে পোঁছাল, তখন সোয়া আটটা মত হল—গ্রীষ্মের তাপদাহ তখনো শুরু হয়নি। থানাতেই অপেক্ষা করছিলেন সুশীল নন্দী।

কিরীটী বললে, সুশীলবাবু, চলুন আগে বটানিক্যাল গার্ডেনে গিয়ে স্পটটা ঘুরে আসি। •

বেশ চলুন—সুশীল নন্দী উঠে দাঁড়ালেন।

উইক ডে–বটানিক্যাল গার্ডেনে তেমন লোকজন বড় একটা নেই। কয়েকজন আমেরিকান টুরিস্ট ঘুরে বেড়াচ্ছিল—হাতে তাদের ক্যামেরা দুজনের।

সুশীল নন্দীই সঙ্গে করে নিয়ে এলেন ওদের ঠিক যেখানে মিত্রানীর মৃতদেহটা আবিষ্কৃত হয়েছিল। একটা ঝোপের মত—তারই সামনে খানিকটা খোলা জমি—কিরীটী তাকিয়ে দেখে। তারপর এক সময় সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার ধারে যায়—জায়গাটা গঙ্গার ধার থেকে প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ গজ দূরে হবে। এবং গঙ্গার ধার থেকে বিশেষ করে ঐ ঝোপটার জন্য জায়গাটা নজরে পড়ে না।

কিরীটী ঘড়ি দেখে একটু দ্রুতই গঙ্গার ধার থেকে জায়গাটায় এগিয়ে গেল—ঠিক। জানবার জন্য কতক্ষণ আন্দাজ লাগতে পারে ঐখানে পৌঁছাতে।

সুশীলবাবু—

বলুন!

বায়নাকুলারটা আর বেতের টুপিটা কোথায় কুড়িয়ে পাওয়া গিয়েছিল জানেন?

সুশীল নন্দীই জায়গা দুটো দেখিয়ে দিলেন।

হুঁ। ভাঙা চুড়ির টুকরোগুলো?

ঐ যে বায়নাকুলারটা যেখানে পাওয়া যায় সেইখানেই—

কিরীটীর মনে হলো মৃতদেহটা যেখানে আবিষ্কৃত হয়, সেখান থেকে জায়গাটা হাত দশেক দূরেই হবে।

হুঁ। চলুন, এবার থানায় যাওয়া যাক।

গাড়িতে উঠে সুশীল নন্দী বললেন, জায়গাটা দেখে কিছু অনুমান করতে পারলেন?

একটা ব্যাপার বোঝা যাচ্ছে—

কি বলুন তো!

হত্যাকারী বুঝতে পেরেছিল ঐ ঝোপের দিকে আসতে হলে গঙ্গার ধার থেকে ঐ পথটাই সহজ হবে এবং সেই অনুমানেই—কিরীটী থেমে গেল হঠাৎ ঐ পর্যন্ত বলে।

সুশীল নন্দী বললেন, কিন্তু তাতে কি এসে গেল—ওরা অন্য পথও তো ধরতে পারত—-

তা পারত, তবে ঐটাই সামনে ছিল। আর সহজ পথ ছিল। কি জানেন সুশীলবাবু, সেদিনকার যাবতীয় ঘটনাই একটা অ্যাকসিডেন্ট বলতে পারেন—

মানে!

মানে অ্যাকসিডেন্টালি সব কিছুই যেন সেদিন খুনীর ফেবারে এসে গিয়েছিল–

সুব্রতর কাছে ঐ মুহূর্তে সমস্ত ব্যাপারটা যেন অকস্মাৎ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল কিরীটীর আগের কথায় সে নিঃশব্দে কিরীটীর কথা শুনতে থাকে।

কিরীটী বলতে লাগল, প্রথমত ধরুন, সেদিনকার ধুলোর ঘূর্ণিঝড়, আবহাওয়া অফিসের সেদিনের সকালের ফোরকাস্টে অবিশ্যি ছিল বিকেলের দিকে বজ্রবিদ্যুৎসহ একপশলা ঝড়বৃষ্টি হবে—যদিও সেটা সেদিন ঠিক হয়েছিল কিন্তু নাও তো হতে পারত-সেদিক দিয়ে বিচার করে দেখতে গেলে খুনী জাস্ট টুক এ চান্স—এবং চান্সটা সে পেয়ে গেল ফোরকাস্ট মতো আবহাওয়া ঠিক মুহূর্তে তার ফেবারে পেয়ে। দ্বিতীয়ত ঐ ঘূর্ণিঝড় হবার দরুন তাকে, মানে খুনীকে আর কষ্ট করতে হলো না-মিত্রানী নিজেই তার হাতের মুঠোর মধ্যে এসে গেল। তৃতীয়ত ওরা স্থির করছিল চাদনী রাত আছে, কাজেই সন্ধ্যা উতরাবার পর তারা ওখান থেকে ফিরবে—যেমন করে হোক খুনী সেটা অনুমান করতে পেরেছিল এবং তাই যদি শেষ পর্যন্ত হতো তো সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে গঙ্গার ধার থেকে ফেরার পথে তাকে কার্যসিদ্ধি করতে হতো—

তাহলেই ভেবে দেখুন সুশীলবাবু—যদিও খুনীর সবটাই ছিল পূর্বপরিকল্পিত—এবং তার ডিটারমিনেশন—তবু সব কিছু ঘটনাচক্রে তার ফেবারে আসায় ব্যাপারটা সহজই হয়ে গিয়েছিল শেষ পর্যন্ত তার কাছে—অ্যাকসিডেন্টালি সে হত্যা করবার চান্সটা পেয়ে গিয়েছিল। ভাল কথা, কাউকে এই কদিন ঐ জায়গাটার আশেপাশে দেখা গিয়েছে কি?

হ্যাঁ—গতকাল দুপুরে আমার লোকেরা যারা পালা করে সর্বক্ষণ নজর রাখছিল। নির্দেশমত—একজনকে দেখেছে–

কি রকম দেখতে লোকটা, বয়স কত–

বয়স হবে লোকটার তেত্রিশ-চৌত্রিশের মধ্যে–পরনে একটা সাদা প্যান্ট ও সিল্কের শার্ট—চোখে রঙিন কাঁচের চশমা—একটা ট্যাক্সি করে এসেছিল লোকটা—কয়েক মিনিট জায়গাটার আশেপাশে ঘুরে আবার সে ট্যাক্সি করে চলে যায়—

ট্যাক্সিট্যাক্সির নম্বরটা রেখেছিল কি আপনার লোক?

না—

পালিয়ে গেল—আপনার নাকের ডগা দিয়ে সুশীলবাবু!

কে পালিয়ে গেল নাকের ডগা দিয়ে—

হত্যাকারী। মিত্রানীর ঘোষালের হত্যাকারী—

বলেন কি?

হ্যাঁ—কিন্তু থাক—একটা ব্যাপারে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম সুশীলবাবু হত্যাকারী ওদেরই একজন।

গাড়ি ইতিমধ্যে থানার সামনে পৌঁছে গিয়েছিল।

সুশীল নন্দী একটা সীল করা কাগজের প্যাকেট কিরীটীর সামনে টেবিলের ওপর এনে নামিয়ে রাখল। বললে, এর মধ্যে মিত্রানীর শাড়ি-সায়া-ব্রেসিয়ার-ব্লাউজ সব কিছু আছে।

প্যাকেটটা খুলতে খুলতে কিরীটী বললে, সেই বেতের টুপিটা ও বায়নাকুলারটাও আনুন—আর একবার দুটো বস্তু ভাল করে দেখবো।

সুশীলবাবু সেগুলো আলমারি থেকে বের করে এনে টেবিলের ওপর রাখলেন।

মিত্রানীর পরনে ছিল সেদিন একটা নীল রঙের মুর্শিদাবাদী সিল্কের শাড়ি। শাড়ির কিছুটা অংশ মনে হয় টানা-হাচড়াতে ফেঁসে গিয়েছে, শাড়িটা পুরোনো বলেই বোধ হয়।

ব্লাউজের বোতামগুলো একটা বাদে বাকী নেই—ব্লাউজটা দেখতে দেখতে একটা কি যেন টেনে তুললো ব্লাউজ থেকে কিরীটী।

একটা মাঝারী সাইজের কর্কশ চুল, রঙটা কটা–

চুলটা পকেট থেকে একটা ছোট লেন্সের ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে তারই সাহায্যে পরীক্ষা করতে করতে কিরীটী বললে, এক টুকরো কাগজ দেখি সুশীলবাবু

সুশীল নন্দী একটা প্যাডের কাগজ ছিড়ে দিলেন।

সেই কাগজের মধ্যে সযত্নে চুলটা রেখে কিরীটী ওদের দিকে তাকিয়ে বললে, হত্যাকারী খুবই সতর্কতা অবলম্বন করেছিল সুব্রত, এবং সব কিছু সেদিন তার ফেবারে থাকলেও নির্মম নিয়তি তাকে ফেবার করেনি শেষ পর্যন্ত।

সুব্রত হাসতে হাসতে বললে, সে তো তখুনি আমি বুঝেছিলাম কিরীটী, যখন তুই। ব্যাপারটা হাতে নিয়েছিস।

সুশীলবাবু!

কিরীটীর ডাকে সুশীল নন্দী কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে সাড়া দিলেন, বলুন—

আপনার কিছু সক্রিয় সাহায্য চাই এবার আমার—

বলুন কি করতে হবে?

আপনি আজ সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে আসুন, তখন বলবো কি সাহায্য আপনার নিকট আমি চাই—তবে এইটুকু আমি বলতে পারি—মিত্রানীর হত্যাকারী আর এখন অস্পষ্ট নেই—এবং মনে হয় রহস্যের শেষ জটটাও খুলে যাবে সহজেই

সুব্রত বললে, কিছুটা বোধ হয় আমিও অনুমান করতে পেরেছি কিরীটী। কিন্তু আমি ভাবছি–

কি?

তাহলে কি সবটাই অভিনয়–

না—অভিনয় নয়, সত্য। চল্ এবার ওঠা যাক।

সুব্রত বুঝলো এখনো মীমাংসার শেষ সূত্রটি কিরীটী তার হাতের মধ্যে পায়নি। যদিও হত্যাকারী একটা স্পষ্ট আকার নিয়েছে তার মনের মধ্যে, কিরীটী মুখ খুলতে চায় না।