১২. কলিকাতার কর্মকঠোর, কোলাহলমুখর, বাস্তব জগতে

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

কলিকাতার কর্মকঠোর, কোলাহলমুখর, বাস্তব জগতে প্রত্যাবর্তন করিয়া গত কয়েকদিনের জীবনকে নিতান্ত স্বপ্ন বলিয়া মনে হইল অপুর। একথা কি সত্য—গত শুক্ৰবাব বৈশাখী পূর্ণিমার শেষরাত্রে সে অনেক দূরের নদী-তীরবর্তী এক অজানা গ্রামের অজানা গৃহস্থবাটীর মেয়েকে বলিয়াছিল—আমি এ বছর যদি আর না আসি অপর্ণা?…

প্রথমবার মেয়েটি একটু হাসিয়া মুখ নিচু করিয়াছিল, কথা বলে নাই।

অপু আবার বলিয়াছিল—চুপ করে থাকলে হবে না, তুমি যদি বলল আসব, নইলে আসব না, সত্যি অপর্ণা। বলল কি বলবে?

মেয়েটি লজ্জারমুখে বলিয়াছিল—বা রে, আমি কে? মা রয়েছেন, বাবা রয়েছেন, ওদের আপনি ভারি

—বেশ আসব না তবে। তোমার নিজের ইচ্ছে না থাকে—

–আমি কি সে কথা বলেছি?

–তা হলে?

–আপনার ইচ্ছে যদি হয় আসতে, আসবেন-না হয় আসবেন না, আমার কথায় কি হবে?

ও কথা ইহার বেশি আর অগ্রসর হয় নাই, অন্য সময় এ ক্ষেত্রে হয়তো অপুর অত্যন্ত অভিমান হইত, কিন্তু এ ক্ষেত্রে কৌতূহলটাই তাহার মনের অন্য সব প্রবৃত্তিকে ছাপাইয়া উঠিয়াছে–ভালোবাসার চোখে মেয়েটিকে সে এখনও দেখিতে পারে নাই, যেখানে ভালোবাসা নাই, সেখানে অভিমানও নাই।

সেদিন বৈকালে গোলদিঘির মোড়ে একজন ফেরিওয়ালা চাঁপাফুল বেচিতেছিল, সে আগ্রহের সহিত গিয়া ফুল কিনিল। ফুলটা আঘ্রাণের সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু মনের মধ্যে একটা বেদনা সে সুস্পষ্ট অনুভব করিল, একটা কিছু পাইয়া হারাইবার বেদনা, একটা শূন্যতা, একটা খালি-খালি ভাব…মেয়েটির মাথার চুলের সে গন্ধটাও যেন আবার পাওয়া যায়…

অন্যমনস্কভাবে গোলদিঘির এক কোণে ঘাসের উপর অনেকক্ষণ একা বসিয়া বসিয়া সেদিনের সেই রাতটি আবার সে মনে আনিবার চেষ্টা করিল। মেয়েটির মুখখানি কি রকম যেন?…ভারি সুন্দর মুখ…কিন্তু এই কয়দিনের মধ্যেই সব যেন মুছিয়া অস্পষ্ট হইয়া গিয়াছে—মেয়েটির মুখ মনে আনিবার ও ধরিয়া রাখিবার যত বেশি চেষ্টা করিতেছে সে, ততই সে মুখ দ্রুত অস্পষ্ট হইয়া যাইতেছে। শুধু নতপল্লব কৃষ্ণতারা চোখদুটির ভঙ্গি অল্প অল্প মনে আসে, আর মনে আসে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের সে স্নিগ্ধ হাসিটুকু। প্রথমে ললাটে লজ্জা ঘনাইয়া আসে, ললাট হইতে নামে ডাগর দুটি চোখে, পরে কপোলে…তারপরই যেন সারা মুখখানি অল্পক্ষণের জন্য অন্ধকার হইয়া আসে…ভারি সুন্দর দেখায় সে সময়! তারপরই আসে সেই অপূর্ব হাসিটি, ওরকম হাসি আর কারও মুখে অপু কখনও দেখে নাই। কিন্তু মুখের সব আদলটা তো মনে আসে না—সেটা মনে আনিবার জন্য সে ঘাসের উপর শুইয়া অনেকক্ষণ ভাবিল, অনেকক্ষণ প্রাণপণে চেষ্টা করিয়া দেখিলনা কিছুতেই মনে আসে না—কিংবা হয়তো আসে অতি অল্পক্ষণের জন্য, আবার তখনই অস্পষ্ট হইয়া যায়। অপর্ণা কেমন নামটি?…।

জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি প্রণব কলিকাতায় আসিল। বিবাহের পর এই তাহার সঙ্গে প্রথম দেখা। সে আসিয়া গল্প করিল, অপর্ণার মা বলিয়াছেন—তাহার কোন্ পুণ্যে এ রকম তরুণ দেবতার মতো রূপবান জামাই পাইয়াছেন জানেন না—তাহার কেহ কোথাও নাই শুনিয়া চোখের জল রাখিতে পারেন নাই।

অপু খুশি হইল, হাসিয়া বলিল—তবু তো একটা ভালো জামা গায়ে দিতে পারলাম না, সাদা পাঞ্জাবি গায়ে বিয়ে হল—দূর!…না খেয়ে-দেয়ে একটা সিল্কের জামা করালুম, সেটা গেল ছিড়ে-ছুটে, তখন তুমি এলে তোমার মামার বাড়িতে নিয়ে যেতে, তার আগে আসতে পারলে না—আচ্ছা সিল্কের জামাটাতে আমায় কেমন দেখাতো?

–ওঃ-সাক্ষাৎ অ্যাপোলো বেলভেডিয়ার…ঢের ঢের হামবাগ দেখেছি, কিন্তু তোর জুড়ি খুঁজে পাওয়া ভার-বুঝলি?

–না—কিন্তু একটা কথা। অপর্ণার মা কি বলেন তাহা জানিতে অপুর তত কৌতূহল নাইঅপর্ণা কি বলিয়াছে—অপর্ণা?…অপর্ণা কিছু বলে নাই?…হয়তো কেনারাম মুখুজ্যের ছেলের সঙ্গে বিবাহ না হওয়াতে মনে মনে দুঃখিত হইয়াছে—না?

প্রণবের মামা এ বিবাহে তত সন্তুষ্ট হন নাই, স্ত্রীর উপরে মনে মনে চটিয়াছেন এবং তাঁহার মনে ধারণা-প্রণবই তাহার মামিমার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করিয়া নিজের বন্ধুর সঙ্গে বোনের বিবাহ দেওয়াইয়াছে। নাম নাই, বংশ নাই, চালচুলা নাই—চেহারা লইয়া কি মানুষ ধুইয়া খাইবে…কিন্তু এসব কথা প্রণব অপুকে কিছু বলিল না।

একটা কথা শুনিয়া সে দুঃখিত হইল।—কেনারাম মুখুজ্যের ছেলেটি নিজে দেখিয়া মেয়ে পছন্দ করিয়াছিল। অপর্ণাকে বিবাহ করিবার অত্যন্ত আগ্রহ ছিল তাহার—কিন্তু হঠাৎ বিবাহ-সভায় আসিয়া কি যেন গোলমাল হইয়া গেল, সারারাত্রি কোথা দিয়া কাটিল, সকালবেলা যখন একটু হুঁশ হইল, তখন সে দাদাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল—দাদা, আমার বিয়ে হল না?

এখনও তাহার অবশ্য ঘোর কাটে নাই…বাড়ি ফিরিবার পথেও তাহার মুখে ওই কথা—এখন নাকি সে বন্ধ উন্মাদ! ঘরে তালা দিয়া রাখা হইয়াছে।

অপু বলিল—হাসিস কেন, হাসবার কি আছে?…পাগল তো নিজের ইচ্ছেয় হয় নি, সে বেচারির আর দোষ কি? ও নিয়ে হাসি ভালো লাগে না।

রাত্রে বিছানায় শুইয়া ঘুম হয় না—কেবলই অপর্ণার কথা মনে আসে। প্রণব এ কি করিয়া দিল তাহাকে? সে যে বেশ ছিল, এ কোন্ সোনার শিকল তাহার মুক্ত, বন্ধনহীন হাতে-পায়ে অদৃশ্য নাগপাশের মতো দিন দিন জড়াইয়া পড়িতেছে? লাইব্রেরিতে বসিয়া কেবল আজকাল বাংলা উপন্যাস পড়ে—দেখিল, তাহার মতো বিবাহ নভেলে অনেক ঘটিয়াছে, অভাব নাই।

পূজার সময় শ্বশুরবাড়ি যাওয়া ঘটিল না। একে তো অর্থাভাবে সে নিজের ভালো জামা-কাপড় কিনিতে পারিল না, শ্বশুরবাড়ি হইতে পূজার তত্ত্বে যাহা পাওয়া গেল, তাহা পরিয়া সেখানে যাইতে তাহার ভারি বাধ-বাধ ঠেকিল। তাহা ছাড়া অপর্ণার মা চিঠির উপর চিঠি দিলে কি হইবে, তাহার বাবার দিক হইতে জামাইকে পূজার সময় লইয়া যাইবার বিশেষ কোন আগ্রহ দেখা গেল না বরং তাহার নিকট হইতে উপদেশপূর্ণ পত্র পাওয়া গেল যে, একটা ভালো চাকুরি যেন সে শীঘ্র দেখিয়া লয়, এখন অল্প বয়স, এই তো অর্থ উপার্জনের সময়, এখন আলস্য ও ব্যসনে কাটাইলে…এমনি ধরনের নানা কথা। এখানে বলা আবশ্যক, এ বিবাহে তিনি অপুকে একেবারে ফাঁকি দিয়াছিলেন, কেনারাম মুখুজ্যের ছেলেকে যাহা দিবার কথা ছিল তাহার সিকিও এ জামাইকে দেন নাই।

 

ছুটি পাওয়া গেল পুনরায় বৈশাখ মাসে। পূর্বদিন রাত্রে তাহার কিছুতেই ঘুম আসে না, কি রকম চুল ছাঁটা হইয়াছে, আয়নায় দশবার দেখিল। এই সাদা পাঞ্জাবিতে তাহাকে ভালো মানায় না, এই তসরের কোটটাতে?

অপর্ণার মা তাহাকে পাইয়া হাতে যেন আকাশের চাঁদ পাইলেন। সেদিনটা খুব বৃষ্টি, অপু নৌকা হইতে নামিয়া বাড়ির বাহিরের উঠানে পা দিতেই কে পূজার দালানে বসিয়াছিল, ছুটিয়া গিয়া বাড়ির মধ্যে খবর দিল। এক মুহূর্তে বাড়ির উপরের নিচের সব জানালা খুলিয়া গেল, বাড়িতে ঝিবৌয়ের সংখ্যা নাই, সকলে জানালা হইতে মুখ বাড়াইয়া দেখিতে লাগিলেন—মুষলধারায় বৃষ্টিপাত অগ্রাহ্য করিয়া অপর্ণার মা উঠানে তাহাকে লইতে ছুটিয়া আসিলেন, সারা বাড়িতে একটা আনন্দের সাড়া পড়িয়া গেল।

ফুলশয্যার সেই ঘরে, সেই পালঙ্কেই রাত্রে শুইয়া সে অপর্ণার প্রতীক্ষায় রহিল।

এক বৎসরে অপর্ণার এ কি পরিবর্তন! তখন ছিল বালিকা—এখন ইহাকে দেখিলে যেন আর চেনা যায় না! লীলার মতো চোখ ঝলসানো সৌন্দর্য ইহার নাই বটে, কিন্তু অপর্ণার যাহা আছে, তাহা উহাদের কাহারও নাই। অপুর মনে হইল দু-একখানা প্রাচীন পটে-আঁকা তরুণী দেবীমূর্তির, কি দশমহাবিদ্যা বোড়শী মূর্তির মুখে এ-ধরনের অনুপম, মহিমময় স্নিগ্ধ সৌন্দর্য সে দেখিয়াছে। একটু সেকেলে, একটু প্রাচীন ধরনের সৌন্দর্য…সুতরাং দুষ্প্রাপ্য। যেন মনে হয় এ খাটি বাংলার জিনি, এই দুর পল্লীপ্রান্তরের নদীতীরের সকল শ্যামলতা, সকল সরসতা, পথপ্রান্তে বনফুলের সকল সরলতা হানিয়া ও মুখ গড়া, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া বাংলার পত্নীর চুত-বকুলবীথির ছায়ায় ছায়ায় কত অপরাহু নদীঘাটের যাওয়া-আসার পথে এই উজ্জ্বলশ্যামবর্ণা, রূপসী তরুণী বধূদের লক্ষ্মীর মতো আলতা রাঙা পদচিহ্ন কতবার পড়িয়াছে মুছিয়াছে, আবার পড়িয়াছে ইহাদেরই মেহ-প্রেমের, দুঃখসুখের কাহিনী, বেহুলা-লখিন্দরের গানে, ফুল্লরার বারোমাস্যায়, সুবচনীর ব্রতকথায়, বাংলার বৈষ্ণবকবিদের রাধিকার রূপবর্ণনায়, পাড়াগাঁয়ের ছড়ায়, উপকথায়, সুয়োরানী দুয়োরানীর গল্পে!…

অপু বলিল—তোমার সঙ্গে কিন্তু আড়ি, সারা বছরে একখানা চিঠি দিলে না কেন?

অপর্ণা সলজ্জ মৃদু একটু হাসিয়া চুপ করিয়া রহিল। তারপর একবার ডাগর চোখ দুটি তুলিয়া স্বামীর দিকে চাহিয়া চাহিয়া দেখিল। খুব মৃদুস্বরে মুখে হাসি টিপিয়া বলিল—আর আমার বুঝি রাগ হতে নেই?…

অপু দেখিল—এতদিন কলিকাতায় সে জারুল কাঠের তক্তপোশে শুইয়া অপর্ণার যে মুখ ভাবিত—আসল মুখ একেবারেই তাহা নহে—ঠিক এই অনুপম মুখই সে দেখিয়াছিল বটে ফুলশয্যার রাত্রে, এমন ভুলও হয়!

–পুজোর সময় আসি নি তাই?-তুমি ভাবতে কি না?—ও-সব মুখের কথা, ছাই ভাবতে!

—না গো না, মা বললেন, তুমি আসবে ষষ্ঠীর দিন, ষষ্ঠী গেল, পুজো গেল, তখনও মা বললেন তুমি একাদশীর পর আসবে—আমি–

অপর্ণা হঠাৎ থামিয়া গেল, অল্প একটু চাহিয়া চোখ নিচু করিল।

অপু আগ্রহের সুরে বলিল—তুমি কি, বললে না?

অপর্ণা বলিল—আমি জানি নে, বলব না—

অপু বলিল—আমি জানি আমার সঙ্গে বিয়ে হওয়াতে তুমি মনে মনে–

অপর্ণা স্নেহপূর্ণ তিরস্কারের সুরে ঘাড় বাঁকাইয়া বলিল—আবার ওই কথা?…ওসব কথা বলতে আছে? ছিঃ-বলো না–

—তা কই, তুমি খুশি হয়েছ, একথা তো তোমার মুখে শুনি নি অপর্ণা–

অপর্ণা হাসিমুখে বলিল—তারপর কতদিন তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে গো শুনি?–সেই আর-বছর বোশেখ আর এ বোশেখ–

—আচ্ছা বেশ, এখন তো দেখা হল, এখন আমার কথার উত্তর দাও?

অপর্ণা কি-একটা হঠাৎ মনে পড়িবার ভঙ্গিতে তাহার দিকে চাহিয়া আগ্রহের সুরে বলিলতুমি নাকি যুদ্ধে যাচ্ছিলে, পুলুদা বলছিল, সত্যি?–

–যাই নি, এবার ভাবছি যাবো—এখান থেকে গিয়েই যাবো–

অপর্ণা ফিক করিয়া হাসিয়া বলিল—আচ্ছা থাক গো, আর রাগ করতে হবে না, আচ্ছা তোমার কথার কি উত্তর দেব বলো তো?—ওসব আমি মুখে বলতে পারব না–

—আচ্ছা, যুদ্ধ কাদের মধ্যে বেধেছে, জানো?…

–ইংরেজের সঙ্গে আর জার্মানির সঙ্গে আমাদের বাড়িতে বাংলা কাগজ আসে! আমি পড়ি যে!

অপর্ণা রুপার ডিবাতে পান আনিয়াছিল, খুলিয়া বলিল—পান খাবে না?…

বাহিরে এক পশলা বৃষ্টি হইয়া গেল। এতটুকু গরম নাই, ঠাণ্ডা রাতটির ভিজা মাটির সুগন্ধে ঝিরঝিরে দক্ষিণ হাওয়া ভরপুর, একটু পরে সুন্দর জ্যোৎস্না উঠিল।

অপু বলিল—আচ্ছা অপর্ণা, চাঁপাফুল পাওয়া যায় তো কাউকে কাল বলো না, বিছানায় রেখে দেবে? আছে চাপাগাছ কোথাও?…

—আমাদের বাগানেই আছে। আমি কাউকে বলতে পারব না কিন্তু তুমি বলো কাল সকালে ওই নৃপেনকে, কি অনাদিকে…কি আমার ছোট বোনকে বলল

–আচ্ছা কেন বল তো চাঁপাফুলের কথা তুললাম?…

অপর্ণা সলজ্জ হাসিল। অপুর বুঝিতে দেরি হইল না যে, অপর্ণা তাহার মনের কথা ঠিক ধরিয়াছে। তাহার হাসিবার ভঙ্গিতে অপু একথা বুঝিল। বেশ বুদ্ধিমতী তো অপর্ণা!…

সে বলিল—হ্যাঁ একটা কথা অপর্ণা, তোমাকে একবার কিন্তু নিয়ে যাব দেশে, যাবে তো?

অপর্ণা বলিল-মাকে বলল, আমার কথায় তো হবে না…

-তুমি রাজি কি না বলল আগে—সেখানে কিন্তু কষ্ট হবে। অপু একবার ভাবিল—সত্যি কথাটা খুলিয়াই বলে। কিন্তু সেই পুরাতন গর্ব ও বাহাদুরির ঝোঁক!—বলিল—অবিশ্যি একদিন আমাদেরও সবই ছিল। যেখানে থাকতুম—আমাদের পৈতৃক দেশ—এখন তো-দোতলা মস্ত বাড়ি—মানে সবই—তবে শরিকানী মামলা আর মানে ম্যালেরিয়ায়-বুঝলে না? এখন যেখানে থাকি, সেখানে দু-খানা মেটে চালাঘর, তাও মা মারা যাওয়ার পর আর সেখানে যাই নি, তোমাদের মতো ঝি-চাকর নেই, নিজের হাতে সব করতে হবে তা আগে থেকেই বলে রাখি। তুমি হলে জমিদারের মেয়ে–

অপর্ণা কৌতুকের সুরে বলিল—আছিই তো জমিদারের মেয়ে। হিংসে হচ্ছে বুঝি? একটু থামিয়া শান্ত সুরে বলিল—কেন একশবার ওকথা বলো?…তুমি কাল মাকে বাবাকে বলে রাজি করাও, আমি তোমার সঙ্গে যেখানে নিয়ে যাবে যাবো, গাছতলাতেও যাবো, আমি তোমার সব কথা জানি, পুলুদা মায়ের কাছে বলছিল, আমি সব শুনেছি। যেখানে নিয়ে যাবে, নিয়ে চলল, তোমার ইচ্ছে, আমার তাতে মতামত কি?

রাত্রে দুজনে কেহ ঘুমাইল না।

 

বধূকে লইয়া সে রওনা হইল। শ্বশুর প্রথমটা আপত্তি তুলিয়াছিলেন—নিয়ে তো যেতে চাইছ বাবাজী, কিন্তু এখন নিয়ে গিয়ে তুলবে কোথায়? চাকরি-বাকরি ভালো কর, ঘর-দোর ওঠাও, নিয়ে যাবার এত তাড়াতাড়িটা কি?

সিঁড়ির ঘরে অপর্ণার মা স্বামীকে বলিলেন-হাগা, তোমার বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়ে যাচ্ছে দিন দিন-না কি? জামাইকে ও-সব কথা বলেছ? আজকালকার ছেলেমেয়েদের ধরন আলাদা, তুমি জানো না। ছেলেমানুষ জামাই, টাকাকড়ি, চাকরি-বাকরি ভগবান যখন দেবেন তখন হবে। আজকালের মেয়েরা ও-সব বোঝে না, বিশেষ করে তোমার মেয়ে সে ধরনেরই নয়, ওর মন আমি খুব ভালো বুঝি। দাও গিয়ে পাঠিয়ে ওকে জামাইয়ের সঙ্গেওদের সুখ নিয়েই সুখ।

উৎসাহে অপুর রাত্রে ঘুম হয় না এমন অবস্থা, কাল সারাদিন অপর্ণাকে লইয়া রেল স্টিমারে কাটানো–উঃ!…শুধু সে আর অপর্ণা, আর কেউ না। রাত্রে অস্পষ্ট আলোকে অপর্ণাকে ভালো করিয়া দেখিবারই সুযোগ হয় না, দিনে দেখা হওয়া এ বাড়িতে অসম্ভব—কিন্তু কাল সকালটি হইতে তাহারা দুজনে-মাঝে আর কোন বাধা ব্যবধান থাকিবে না!

কিন্তু স্টিমারে অপর্ণা রহিল মেয়েদের জায়গায়। তিন ঘণ্টা কাল সেভাবে কাটিল! তার পরেই রেল।

এইখানেই অপু সর্বপ্রথম গৃহস্থালি পাতিল স্ত্রীর সঙ্গে। ট্রেনের তখনও অনেক দেরি। যাত্রীদের রান্না খাওয়ার জন্য স্টেশন হইতে একটু দূরে ভৈরবের ধারে ছোট ছোট খড়ের ঘর অনেকগুলি তারই একটা চার আনায় ভাড়া পাওয়া গেল। অপু দোকানে খাবার কিনিতে যাইতেছে দেখিয়া বধু বলিল—তা কেন? এই তো এখানে উনুন আছে, যাত্রীরা সব বেঁধে খায়, এখনও তত তিন-চার ঘণ্টা দেরি গাড়ির, আমি রাঁধব।

অপু ভারি খুশি। সে ভারি মজা হইবে! এ কথাটা এতক্ষণ তাহার মনে আসে নাই। মহা উৎসাহে বাজার হইতে জিনিসপত্র কিনিয়া আনিল। ঘরে ঢুকিয়া দেখে ইতিমধ্যেই কখন বধু স্নান সারিয়া ভিজা চুলটি পিঠের উপর ফেলিয়া, কপালে সিন্দুরের টিপ দিয়া লাল-জরিপাড় মটকার শাড়ি পরিয়া ব্যস্তসমস্ত অবস্থায় এটা-ওটা ঠিক করিতেছে। হাসিমুখে বলিল—বাড়িওয়ালি জিজ্ঞেস করছে উনি তোমার ভাই বুঝি? আমি হেসে ফেলতেই বুঝতে পেরেছে, বলেছে—জামাই! তাই তো বলি!—আরও কি বলিতে গিয়া অপর্ণা লজ্জায় কথা শেষ করিতে না পারিয়া হাসিয়া ফেলিল।

অপু মুগ্ধনেত্রে বধুর দিকে চাহিয়া ছিল। কিশোরীর তনুদেহটি বেড়িয়া স্ফুটনোম্মুখ যৌবন কি অপূর্ব সুষমায় আত্মপ্রকাশ করিতেছে। সুন্দর নিটোল গৌর বাহু দুটি, চুলের খোঁপার ভঙ্গিটি কি অপরুপ! গভীর রাত্রে শোবার ঘরে এ পর্যন্ত দেখাশোনা, দিনের আলোয় স্নানের পরে এ অবস্থায় তাহার স্বাভাবিক গতিবিধি লক্ষ করিবার সুযোগ কখনও ঘটে নাই-আজ দেখিয়া মনে হইল অপর্ণা সত্যই সুন্দরী বটে।

কাঁচা কাঠ কিছুতেই ধরে না, প্রথমে বধু, পরে সে নিজে, ফুঁ দিয়া চোখ লাল করিয়া ফেলিল। প্রৌঢ়া বাড়িওয়ালি ইহাদের জন্য নিজের ঘরে বাটনা বাটিতে গিয়াছিল। ফিরিয়া আসিয়া দুজনের দুর্দশা দেখিয়া বলিল—ওগো মেয়ে, সরো বাছা, জামাইকে যেতে বললো। তোমাদের কি ও কাজ মা? সরো আমি দি ধরিয়ে।

বধূ তাগিদ দিয়া অপুকে স্নানে পাঠাইল। নদী হইতে ফিরিয়া সে দেখিল—ইহার মধ্যে কখন বধূ বাড়িওয়ালিকে দিয়া বাজার হইতে রসগোল্লা ও ছানা আনাইয়াছে, রেকাবিতে পেঁপে কাটা, খাবার ও গ্লাসে নেবুর রস মেশানো চিনির শরবত। অপু হাসিয়া বলিল—উঃ, ভারি গিন্নিপনা যে!…আচ্ছা, তরকারিতে নুন দেওয়ার সময় গিন্নিপনার দৌড়টা একবার দেখা যাবে।

অপর্ণা বলিল—আচ্ছা গো দেখোপরে ছেলেমানুষের মতো ঘাড় দুলাইয়া বলিল—ঠিক হলে কিন্তু আমায় কি দেবে?

অপু কৌতুকের সুরে বলিল—ঠিক হলে যা দেব, তা এখুনি পেতে চাও?

–যাও, আচ্ছা তো দুষ্ট!

একবার সে রন্ধনরত বধূর পিছনে আসিয়া চুপি চুপি দাঁড়াইল। দৃশ্যটা এত নতুন, এত অভিনব ঠেকিতেছিল তাহার কাছে! এই সুঠাম, সুন্দরী পরের মেয়েটি তাহার নিতান্ত আপনার জনএকমাত্র পৃথিবীতে আপনার জন! পরে সে সন্তর্পণে নিচু হইয়া পিঠের উপরে এলানো চুলের গিঁঠটা ধরিয়া অতর্কিতে এক টান দিতেই বধূ পিছনে চাহিয়া কৃত্রিম কোপের সুরে বলিলউঃ! আমার লাগে না বুঝি?…ভারি দুষ্টু তো …রান্না থাকবে পড়ে বলে দিচ্ছি যদি আবার চুল ধরে টানবে—

অপু ভাবে, মা ঠিক এই ধরনের কথা বলিত—এই ধরনের স্নেহ-প্রীতি-ঝরা চোখ। সে দেখিয়াছে, কি দিদি, কি রানুদি, কি লীলা, কি অপর্ণা—সকলেরই মধ্যে মা যেন অল্পবিস্তর মিশাইয়া আছেন—ঠিক সময়ে ঠিক অবস্থায় ইহারা একই ধরনের কথা বলে, চোখে মুখে একই ধরনের স্নেহ ফুটিয়া ওঠে।

একটি ভদ্রলোক অনেকক্ষণ হইতে প্লাটফর্মে পায়চারি করিতেছিলেন। ট্রেনে উঠিবার কিছু পূর্বে অপু তাঁহাকে চিনিতে পারিল, দেওয়ানপুরের মাস্টার সেই সত্যেনবাবু। অপু থার্ড ক্লাসে পড়িবার সময়ই ইনি আইন পাশ করিয়া স্কুলের চাকুরি ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছিলেন, আর কখনও দেখা হয় নাই। পুরাতন ছাত্রকে দেখিয়া খুশি হইলেন, অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করিলেন, অন্যান্য ছাত্রদের মধ্যে কে কি করিতেছে শুনিবার আগ্রহ দেখাইলেন।

তিনি আজকাল পাটনা হাইকোর্টে ওকালতি করিতেছেন, চালচলন দেখিয়া অপুর মনে হইল—বেশ দু-পয়সা উপার্জন করেন। তবুও বলিলেন, পুরানো দিনই ছিল ভালো, দেওয়ানপুরের কথা মনে হইলে কষ্ট হয়। ট্রেন আসিলে তিনি সেকেন্ড ক্লাসে উঠিলেন।

অপর্ণাকে সব ভালো করিয়া দেখাইবার জন্য শিয়ালদহ স্টেশনে নামিয়া অপু একখানা ফিটন গাড়ি ভাড়া করিয়া খানিকটা ঘুরিল।

অপু একটা জিনিস লক্ষ করিল; অপর্ণা কখনও কিছু দেখে নাই বটে, কিন্তু কোনও বিষয়ে কোনও অশোভন ব্যগ্রতা দেখায় না। ধীর, স্থির, সংযত, বুদ্ধিমতী—এই বয়সেই চরিত্রগত একটা কেমন সহজ গাম্ভীর্য-যাহার পরিণতি সে দেখিয়াছে ইহারই মায়ের মধ্যে; উছলিয়া-পড়া মাতৃত্বের সঙ্গে চরিত্রের সে কি দৃঢ় অটলতা।

মনসাপোতা পৌঁছিতে সন্ধ্যা হইয়া গেল। অপু বাড়িঘরের বিশেষ কিছু ঠিক করে নাই, কাহাকেও সংবাদ দেয় নাই, কিছু না—অথচ হঠাৎ স্ত্রীকে আনিয়া হাজির করিয়াছে। বিবাহের পর মাত্র একবার এখানে দুদিনের জন্য আসিয়াছিল, বাড়িঘর অপরিষ্কার, রাত্রিবাসের অনুপযুক্ত, উঠানে ঢুকিয়া পেয়ারা গাছটার তলায় সন্ধ্যার অন্ধকারে বধু দাঁড়াইয়া রহিল, অপু গরুর গাড়ি হইতে তোরঙ্গ ও কাঠের হাতবাক্সটা নামাইতে গেল। উঠানে পাশের জঙ্গলে নানা পতঙ্গ কুস্বর করিয়া ডাকিতেছে, ঝোপে ঝোপে জোনাকির ঝাক জ্বলিতেছে।

কেহ কোথাও নাই, কেহ তরুণ দম্পতিকে সাদরে বরণ ও অভ্যর্থনা করিয়া ঘরে তুলিয়া লইতে ছুটিয়া আসিল না, তাহারাই দুজনে টানাটানি করিয়া নিজেদের পেঁটরা তোরঙ্গ মাত্র দেশলাইয়ের কাঠির আলোর সাহায্যে ঘরের দাওয়ায় তুলিতে লাগিল। সে আজ কাহাকেও ইচ্ছা করিয়াই খবর দেয় নাই, ভাবিয়াছিল—মা যখন বরণ করে নিতে পারলেন না আমার বৌকে, অত সাধ ছিল মার-তখন আর কাউকে বরণ করতে হবে না, ও অধিকার আর কাউকে বুঝি দেব?

অপর্ণা জানিত তাহার স্বামী দরিদ্র কিন্তু এ রকম দরিদ্র তাহা সে ভাবে নাই। তাহাদেব পাড়ার নাপিত-বাড়ির মতো নিচু, ছোট চালাঘব। দাওয়ার একধারে গরু বাছুর উঠিয়া ভাঙিযা দিয়াছে…ছাঁচতলায় কাঁই-বীচি ফুটিয়া বর্ষার জলে চারা বাহির হইয়াছে…একস্থানে খড় উড়িয়া চালের বাখারি ঝুলিয়া পড়িয়াছে…বাড়ির চারিধারে কি পোকা একঘেয়ে ডাকিতেছে…এরকম ঘবে তাহাকে দিন কাটাইতে হইবে?…অপর্ণার মন দমিয়া গেল। কি করিয়া থাকিবে সে এখানে? মায়ের কথা মনে হইল…খুড়িমাদের কথা মনে হইল…ছোট ভাই বিনুর কথা মনে হইল, কান্না ঠেলিয়া বাহিরে আসিতে চাহিতেছিল…সে মরিয়া যাইবে এখানে থাকিলে…।

অপু খুঁজিয়া-পাতিয়া একটা লণ্ঠন জ্বালিল। ঘবের মাটির মেঝেতে পোকাষ খুঁড়িযা মাটি জড়ো করিয়াছে। তক্তপোশের একটা পাশ ঝাড়িয়া তাহার উপর অপর্ণাকে বসাইল…সবে অপর্ণাকে অন্ধকার ঘবে বসাইয়া লণ্ঠনটা হাতে বাহিরে হাতবাক্সটা আনিতে গেল …অপর্ণার গা ছম ছম করিয়া উঠিল অন্ধকারে…পরক্ষণেই অপু নিজের ভুল বুঝিযা আলো হাতে ঘরে ঢুকিয়া বলিল–দ্যাখো কাণ্ড, তোমাকে একা অন্ধকারে বসিয়ে রেখে-থাক লণ্ঠনটা এখানে

অপর্ণার কান্না আসিতেছিল।…

আধঘণ্টা পরে ঝাড়িয়া-ঝুড়িয়া ঘরটা একরকম রাত্রি কাটানোর মতো দাঁড়াইল। কি খাওয়া যায় রাত্রে? রান্নাঘর ব্যবহারের উপযোগী নাই তো বটেই, তা ছাড়া চাল, ডাল, কাঠ কিছুই নাই। অপর্ণা তোরঙ্গ খুলিয়া একটা পুটুলি বার করিয়া বলিল—ভুলে গিয়েছিলাম তখন, মা নাড় দিয়েছিলেন এতে বেঁধে—অনেক আছে—এই খাও।

অপু অপ্রতিভ হইয়া পড়িয়াছিল। সংসার কখনও করে নাই—এই নতুন নিতান্ত আনাড়ি অপর্ণাকে এ অবস্থায় এখানে আনা ভালো হয় নাই, সে এতক্ষণে বুঝিয়াছে। অপ্রতিভের সুরে বলিল-রানাঘাট থেকে কিছু খাবার নিলেই হত—তোমাকে একা বসিয়ে রেখে যাই কি করে নইলে ক্ষেত্র কাপালির বাড়ি থেকে চিড়ে আর দুধ—যাব?…

অপর্ণা ঘাড় নাড়িয়া বারণ করিল।

 

তেলিদের বাড়িতে কেউ ছিল না, তিন-চারি মাস হইতে তাহারা কলিকাতায় আছে, বাড়ি তালাবন্ধ, নতুবা কাল রাত্রে ইহাদের কথাবার্তা শুনিয়া সে-বাড়ির লোক আসিল। সকালে সংবাদ পাইয়া ও-পাড়া হইতে নিরুপমা ছুটিয়া আসিল। অপু কৌতুকের সুরে বলিল—এসো, এসো নিরুদিদি, এখন মা নেই, তোমরা কোথায় বরণ করে ঘরে তুলবে, দুধে-আলতার পাথরে দাঁড় করাবে, তা না তুমি সকালে পান চিবুতে চিবুতে এলে। বেশ যা হোক।

নিরুপমা অনুযোগ করিয়া বলিল–তুমি ভাই সেই চৌদ্দ বছরে যেমন পাগলটি ছিলে, এখনও ঠিক সেই আছে। বৌ নিয়ে আসছে তা একটা খবর না, কিছু না। কি করে জানব তুমি এ অবস্থায় একজন ভদ্রলোকের মেয়েকে এই ভাঙা ঘরে হুপ করে এনে তুলবে? ছি ছি, দ্যাখ তো কাণ্ডখানা? রাত্রে যে রইলে কি করে এখানে, সে কেবল তুমিই পারো।

নিরুপমা গিনি দিয়া বৌ-এর মুখ দেখিল।

অপু বলিল-তোমাদের ভরসাতেই কিন্তু ওকে এখানে রেখে যাব নিরুদি। আমাকে সোমবার চাকুরিতে যেতেই হবে। নিরুপমা বৌ দেখিয়া খুব খুশি, বলিল—আমি আমাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রেখে দেব বৌকে, এখানে থাকতে দেব না! অপু বলিল—তা হবে না, আমার মায়ের ভিটেতে সন্ধে দেবে কে তাহলে? রাত্রে তোমাদের ওখানে শোবার জন্যে নিয়ে যেয়ো। নিরুপমা তাতেই রাজি। চৌদ্দ বছরের ছেলে যখন প্রথম চেলি পরিয়া তাহাদের বাড়ি পূজা করিতে গিয়াছিল, তখন হইতে সে অপুকে সত্য সত্য স্নেহ করে, তাহার দিকে টানে। অপু ঘরবাড়ি ছাড়িয়া চলিয়া যাওয়ায় সে মনে মনে খুব দুঃখিত হইয়াছিল। মেয়েরা গতিকে বোঝে না, বাহিরকে বিশ্বাস করে না, মানুষের উদ্দাম ছুটিবার বহির্মুখী আকাঙ্ক্ষাকে শান্ত সংযত করিয়া তাহাকে গৃহস্থালি পাতাইয়া, বাসা বাঁধাইবার প্রবৃত্তি নারীমনের সহজাত ধর্ম, তাহাদের সকল মাধুর্য, স্নেহ, প্রেমের প্রয়োগনৈপুণ্য এখানে। সে শক্তিও এত বিশাল যে খুব কম পুরুষই তাহার বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া জয়ী হইবার আশা করিতে পারে। অপু বাড়ি ফিরিয়া নীড় বাঁধাতে নিরুপমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিল।

কলিকাতায় ফিরিয়া অপুর আর কিছু ভালো লাগে না, কেবল শনিবারের অপেক্ষায় দিন গুনিতে থাকে। বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে যাহারা নব-বিবাহিত তাহাদের সঙ্গে কেবল বিবাহিত জীবনের গল্প করিতে ও শুনিতে ভালো লাগে। কোনওরকমে এক সপ্তাহ কাটাইয়া শনিবার দিন সে বাড়ি গেল। অপর্ণার গৃহিণীপনায় সে মনে মনে আশ্চর্য না হইয়া পারিল না। এই সাত-আট দিনের মধ্যেই অপর্ণা বাড়ির চেহারা একেবারে বদলাইয়া ফেলিয়াছে। তেলি-বাড়ির বুড়ি ঝিকে দিয়া নিজের তত্ত্বাবধানে ঘরের দেওয়াল লেপিয়া ঠিক করাইয়াছে। দাওয়ায় মাটি ধরাইয়া দিয়াছে, রাঙা এলামাটি আনিয়া চারিধারে রঙ করাইয়াছে, নিজের হাতে এখানে তাক, ওখানে কুলুঙ্গি গাঁথিয়াছে, তক্তপোশের তলাকার রাশীকৃত ইদুরের মাটি নিজেই উঠাইয়া বাহিরে ফেলিয়া গগাবর-মাটি লেপিয়া দিয়াছে। সারা বাড়ি যেন ঝকঝক তক তক করিতেছে। অথচ অপর্ণা জীবনে এই প্রথম মাটির ঘরে পা দিল। পূর্ব গৌরব যতই ক্ষুন্ন হউক, তবুও সে ধনীবংশের মেয়ে, বাপ-মায়ের আদরে লালিত, বাড়ি থাকিতে নিজের হাতে তাহাকে কখনও বিশেষ কিছু করিতে হইত না।

মাসখানেক ধরিয়া প্রতি শনিবারে বাড়ি যাতায়াত করিবার পর অপু দেখিল তাহার যাহা আয় ফি শনিবার বাড়ি যাওয়ার খরচ তাহাতে কুলায় না। সংসারে দশ-বারো টাকার বেশি মাসে এ পর্যন্ত সে দিতে পারে নাই। সে বোঝে—ইহাতে সংসার চালাইতে অপর্ণাকে দস্তুরমতে বেগ পাইতে হয়। অতএব ঘন ঘন বাড়ি যাওয়া বন্ধ করিল।

ডাকপিয়নের খাকির পোশাক যে বুকের মধ্যে হঠাৎ এরুপ ঢেউ তুলিতে পারে, ব্যগ্র আশার আশ্বাস দিয়াই পরমুহূর্তে নিরাশা ও দুঃখের অতলতলে নিমজ্জিত করিয়া দিতে পারে, পনেরো টাকা বেতনের আমহার্স্ট স্ট্রীট পোস্টাফিসের পিওন যে একদিন তাহার দুঃখ-সুখের বিধাতা হইবে, এ কথা কবে ভাবিয়াছিল? পূর্বে কালেভদ্রে মায়ের চিঠি আসিত, তাহার এজন্য এরূপ ব্যগ্র প্রতীক্ষার প্রয়োজন ছিল না। পরে মায়ের মৃত্যুর পর বৎসরখানেক তাহাকে একখানি পত্রও কেহ দেয় নাই। উঃ, কি দিনই গিয়াছে সেই এক বৎসর! মনে আছে, তখন বোজ সকালে চিঠির বাক্স বৃথা আশয় একবার করিয়া খোঁজ করিয়া হাসিমুখে পাশের ঘরের বন্ধুকে উদ্দেশ করিয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিত—আরে, বীরেন বোসের জন্যে তো এ বাসায় আর থাকা চলে না দেখছি!—রোজ রোজ যত চিঠি আসে তার অর্ধেক বীরেন বোসের নামে!

বন্ধু হাসিয়া বলিত–ওহে পাঁচজন থাকলেই চিঠিপত্র আসে পাঁচদিক থেকে। তোমার নেই কোনও চুলোয় কেউ, দেবে কে চিঠি?

বোধ হয় কথাটা রূঢ় সত্য বলিয়াই অপুর মনে আঘাত লাগিত কথাটায়। বীরেন বোসের নানা ছাদের চিঠিগুলি লোলুপ দৃষ্টিতে চাহিয়া চাহিয়া দেখিত—সাদা খাম, সবুজ খাম, হলদে খাম, মেয়েলি হাতের লেখা পোস্টকার্ড, এক-একবার হাতে তুলিয়া লোভ দমন করিতে না পারিয়া দেখিয়াছেও ইতি তোমার দিদি, ইতি তোমার মা, আপনার স্নেহের ছোট বোন সুশী, ইত্যাদি। বীরেন বোস মিথ্যা বলে নাই, চারিদিকে আত্মীয় বন্ধু থাকিলেই রোজ পত্র আসে—তাহার চিঠি তো আর আকাশ হইতে

পড়িবে না? আজকাল আর সে দিন নাই। পত্র লিখিবার লোক হইয়াছে এতদিনে।

জন্মাষ্টমীর ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার কথা, কিন্তু দিনগুলো মাসের মতো দীর্ঘ।

 

অবশেষে জন্মাষ্টমীর ছুটি আসিয়া গেল। এডিটারকে বলিয়া বেলা তিনটার সময় আফিস হইতে বাহির হইয়া সে স্টেশনে আসিল। পথে নব-বিবাহিত বন্ধু অনাথবাবু বৈঠকখানা বাজার হইতে আম কিনিয়া উর্বশ্বাসে ট্রাম ধরিতে ছুটিতেছেন। অপুর কথার উত্তরে বলিলেন—সময় নেই, তিনটে পনেরো ফেল করলে আবার সেই চারটে পঁচিশ, দুঘণ্টা দেরি হয়ে যাবে বাড়ি পৌঁছতে আচ্ছা আসি, নমস্কার।

দাড়িটা ঠিক কামানো হইয়াছে তো?

মুখ রৌদ্রে, ধুলায় ও ঘামে যে বিবর্ণ হইয়া যাইবে তাহার কি? কি গাধা-বোট গাড়িখানা, এতক্ষণে মোটে নৈহাটি? বাড়ি পৌঁছিতে প্রায় সন্ধ্যা হইতে পারে। খুশির সহিত ভাবিল, চিঠি লিখে

তো যাচ্ছি নে, হঠাৎ দেখে অপর্ণা একেবারে অবাক হয়ে যাবে এখন

বাড়ি যখন পৌঁছিল, তখনও সন্ধ্যার কিছু দেরি। বধূ বাড়ি নাই, বোধ হয় নিবুপমাদেব বাড়ি কি পুকুরের ঘাটে গিয়াছে। কেহ কোথাও নাই। অপু ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া পুঁটলি নামাইয়া রাখিয়া সাবানখানা খুঁজিয়া বাহির করিয়া আগে হাত মুখ ও মাথা ধুইয়া ফেলিযা তাকের আয়না ও চিরুনির সাহায্যে টেরি কাটিল। পরে নিজের আগমনের সকল চিহ্ন বিলুপ্ত করিয়া বাড়ি হইতে বাহির হইয়া গেল।

আধঘণ্টা পরেই সে ফিরিল। বধূ ঘরের মধ্যে প্রদীপের সামনে মাদুব পাতিয়া বসিয়া কি বই পড়িতেছে। অপু পা টিপিয়া টিপিয়া তাহার পিছনে আসিয়া দাঁড়াইল। এটা অপুর পুরানো রোগ, মায়ের সঙ্গে কতবার এরকম করিয়াছে। হঠাৎ কি একটা শব্দে বধূ পিছন ফিরিয়া চাহিয়া ভয়ে ধড়মড় করিয়া উঠিবার চেষ্টা করিতে অপু হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল।

বধূ অপ্রতিভেব সুরে বলিল—ওমা তুমি! কখন-ই–তোমার তো—

অপু হাসিতে হাসিতে বলিল—কেমন জব্দ! আচ্ছা তো ভীতু!

বধূ ততক্ষণে সামলাইয়া লইয়া হাসি মুখে বলিল—বা রে, ওই রকম করে বুঝি আচমকা ভয় দেখাতে আছে? কটার গাড়িতে এলে এখন–তাই বুঝি আজ ছ-সাত দিন চিঠি দেওয়া হয় নি।

আমি ভাবছি–

অপু বলিল—তারপর, তুমি কি রকম আছ, বলো? মায়ের চিঠিপত্র পেয়েছ?

-তুমি কিন্তু রোগা হয়ে গিয়েছ, অসুখ-বিসুখ হয়েছিল বুঝি?

-আমার এবারকার চিঠির কাগজটা কেমন? ভালো না? তোমার জন্যে এনেছি পঁচিশখানা। তারপর রাত্রে কি খাওয়াবে বলো?

-কি খাবে বলল? ঘি এনে রেখেছি, আলুপটলের ডালনা করি—আর দুধ আছে—

 

পরদিন সকালে উঠিয়া অপু দেখিয়া অবাক হইল, বাড়ির পিছনের উঠানে অপর্ণা ছোট ছোট বেড়া দিয়া শাকের ক্ষেত, বেগুনের ক্ষেত করিয়াছে। দাওয়ার ধারে ধারে গাঁদার চারা বসাইয়াছে। রান্নাঘরের চালায় পুঁইলতা লাউলতা উঠাইয়া দিয়াছে। দেখাইয়া বলিল,–আজ পুইশাক খাওয়াব আমার গাছের! ওই দোপাটিগুলো দ্যাখো? কত বড়, না? নিরুপমা দিদি বীজ দিয়েছেন। আর একটা জিনিস দ্যাখো নি? এসো দেখাব

অপুর সারা শরীরে একটা আনন্দের শিহরণ বহিল। অপর্ণা যেন তাহার মনের গোপন কথাটি জানিয়া বুঝিয়াই কোথা হইতে একটা ছোট চাপা গাছের ডাল আনিয়া মাটিতে পুঁতিয়াছে, দেখাইয়া বলিল—দ্যাখো কেমন হবে না এখানে?

–হবে না আর কেন? আচ্ছা, এত ফুল থাকতে চাপা ফুলের ডাল যে পুঁততে গেলে?

অপর্ণা সলজ্জমুখে বলিল—জানি নে-যাও।

অপু তো লেখে নাই, পত্রে তো এ কথা অপর্ণাকে জানায় নাই যে, মিত্তির বাড়ির কম্পাউন্ডের চাঁপা ফুল গাছটা তাহাকে কি কষ্টই না দিয়াছে এই দু-মাস! চাপা ফুল যে হঠাৎ তাহার এত প্রিয় হইয়া উঠিয়াছে, এ কথাটি মনে মনে অনুমান করিবার জন্য এই কর্মব্যস্ত, সদা হাসিমুখ মেয়েটির উপর তাহার মন কৃতজ্ঞতায় ভরিয়া উঠিল।

অপর্ণা বলিল—এখানে একটু বেড়া দিয়ে ঘিরে দেবে? মাগো, কি ছাগলের উৎপাতই তোমাদের দেশে! চারাগাছ থাকতে দেয় না, রোজ খেয়েদেয়ে সারা দুপুর কঞ্চি হাতে দাওয়ায় বসে ছাগল তাড়াই আর বই পড়ি—দুপুরে রোজ নিরুদি আসেন, ও বাড়ির মেয়েরা আসে, ভারি ভালো মেয়ে কিন্তু নিরুদিদি।

আজ সারাদিন ছিল বর্ষা। সন্ধ্যার পর একটানা বৃষ্টি নামিয়াছে, হয়তো বা সারা রাত্রি ধরিয়া বর্ষা চলিবে। বাহিরে কৃষ্ণাষ্টমীর অন্ধকার মেঘে ঘনীভূত করিয়া তুলিয়াছে। বধূ বলিল—রান্নাঘরে এসে বসবে? গরম গরম সেঁকে দি। অপু বলিল—তা হবে না, আজ এসো আমরা দুজনে একপাতে খাবো! অপর্ণা প্রথমটা রাজি হইল না, অবশেষে স্বামীর পীড়াপীড়িতে বাধ্য হইয়া একটা থালায় রুটি সাজাইয়া খাবার ঠাঁই করিল।

অপু দেখিয়া বলিল,—ও হবে না, তুমি আমার পাশে বসো, ওরকম বসলে চলবে না। আরও একটু—আরও-পরে সে বাঁ-হাতে অপর্ণার গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলিল—এবার এসো দু-জনে খাই–

বধূ হাসিয়া বলিল—আচ্ছা তোমার বদখেয়ালও মাথায় আসে, মাগো মা! দেখতে তো খুব ভালোমানুষটি!

লাভের মধ্যে বধুর একরূপ খাওয়াই হইল না সেরাত্রে। অন্যমনস্ক অপু গল্প করিতে করিতে থালার রুটি উঠাইতে উঠাইতে প্রায় শেষ করিয়া ফেলিল—পাছে স্বামীর কম পড়িয়া যায় এই ভয়ে সে বেচারি খান-তিনের বেশি নিজের জন্য লইতে পারিল না। খাওয়া-দাওয়ার পর অপর্ণা বলিল— কই, কি বই এনেছ বললে, দেখি?

দু-জনেই কৌতুকপ্রিয় সমবয়সি সুস্থমন, বালকবালিকার মতো আমোদ করিতে, গল্প করিতে, সারারাত জাগিতে, অকারণে অর্থহীন বকিতে দুজনেরই সমান আগ্রহ সমান উৎসাহ। অপু একখানা নতুন-আনা বই খুলিয়া বলিল—পড়ো তো এই পদ্যটা?

অপর্ণা প্রদীপের সলতেটা চাপার কলির মতো আঙুল দিয়া উসকাইয়া দিয়া পিলসুজটা আরও নিকটে টানিয়া আনিল। পরে সে লজ্জা করিতেছে দেখিয়া অপু উৎসাহ দিবার জন্য বলিল—পড়ো না, কই দেখি?

অপর্ণা যে কবিতা এত সুন্দর পড়িতে পারে অপুর তাহা জানা ছিল না। সে ঈষৎ লজ্জাজড়িত স্বরে পড়িতেছিল—

গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কুলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা–

অপু পড়ার প্রশংসা করিতেই অপর্ণা বই মুড়িয়া বন্ধ করিল। স্বামীর দিকে উজ্জ্বলমুখে চাহিয়া কৌতুকের ভঙ্গিতে বলিল-থাকগে পড়া, একটা গান করো না।

অপু বলিল, একটা টিপ পরো না খুকি! ভারি সুন্দর মানাবে তোমার কপালে—

অপর্ণা সলজ্জ হাসিয়া বলিল—যাও—

সত্যি বলছি অপর্ণা, আছে টিপ?–

—আমার বয়সে বুঝি টিপ পরে? আমার ছোট বোন শান্তির এখন টিপ পরবার বয়স তো

কিন্তু শেষে তাহাকে টিপ পরিতেই হইল। সত্যই ভারি সুন্দর দেখাইতেছিল, প্রতিমার চোখের মতো টানা, আয়ত সুন্দর চোখ দুটির উপর দীর্ঘ, ঘনকালো, জোড়াভুরুর মাঝখানটিতে টিপ মানাইয়াছে কি সুন্দর! অপুর মনে হইল—এই মুখের জন্যই জগতের টিপ সৃষ্টি হইয়াছে-প্রদীপের স্নিগ্ধ আলোয় এই টিপ-পরা মুখখানি বারবার সতৃষ্ণ চোখে চাহিয়া দেখবার জন্যই।

অপর্ণা বলে—ছাই দেখাচ্ছে, এ বয়সে কি টিপ মানায়? কি করি পরের ছেলে, বললে তো আর কথা শুনবে না তুমি!

-না গো পরের মেয়ে, শোনো একটু সরে এসো তো—

ভারি দুই-এত জ্বালাতনও তুমি করতে পার!…

অপু বলিল—আচ্ছা, আমায় দেখতে কেমন দেখায় বলো না সত্যি-কেমন মুখ আমার? ভালল, না পেঁচার মতো?

অপর্ণার মুখ কৌতুকে উজ্জ্বল দেখাইল-নাক সিটকাইল, বলিল—বিশ্রী, পেঁচার মতো।

অপু কৃত্রিম অভিমানের সুরে বলিল—আর তোমার মুখ তো ভালো, তা হলেই হয়ে গেল। যাই, শুইগে যাই-রাত কম হয় নি কাল ভোরে আবার–

বধূ খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।

এই রাত্রিটা গভীর দাগ দিয়া গিয়াছিল অপুর মনে। মাটির ঘরের আনাচে-কানাচে, গাছপালায় বাঁশবনে, ঝিম্ ঝিম্ নিশীথের একটানা বর্ষার ধারা। চারিধারই নিস্তব্ধ। পূর্বদিকের জানালা দিয়া বর্ষাসজল বাদল রাতের দমকা হাওয়া মাঝে মাঝে আসে—মাটির প্রদীপের আলোতে, খড়ের ঘরের মেঝেতে মাদুর বিছাইয়া সে ও অপর্ণা!

অপু বলিল—দ্যাখো আজ রাত্রে মায়ের কথা মনে হয়—মা যদি আজ থাকতেন?

অপর্ণা শান্ত সুরে বলিল—মা সবই জানেন, যেখানে গিয়েছেন, সেখান থেকে সবই দেখছেন। পরে সে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া চোখ তুলিয়া স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া বলিল—দ্যাখো, আমি মাকে দেখেছি।

অপু বিস্ময়ের দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে চাহিল। অপর্ণার মুখে শান্ত, স্থির বিশ্বাস ও সরল পবিত্রতা ছাড়া আর কিছু নাই।

অপর্ণা বলিল—শোনো, একদিন কি মাসটায়, তোমার সেদিন চিঠি এলো দুপুর বেলা। বিকেলে আঁচল পেতে পানচালার পিড়েতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি-সেদিন সকালে উঠোনের ওই লাউগাছটাকে পুঁতেছি, কঞ্চি কেটে তাকে উঠিয়েছি, খেতে অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে, বুঝলে? স্বপ্নে দেখছি-একজন কে দেখতে বেশ সুন্দর, লালপেড়ে শাড়িপরা, কপালে সিঁদুর, তোমার মুখের তো আদল, আমায় আদর করে মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বলছেন—ও আবাগীর মেয়ে, অবেলায় শুয়ো না, ওঠো, অসুখ-বিসুখ হবে আবার? তারপর তিনি তার হাতের সিদুরের কৌটো থেকে আমার কপালে সিঁদুর পরিয়ে দিতেই আমি চমকে জেগে উঠলাম—এমন স্পষ্ট আর সত্যি বলে মনে হল যে, তাড়াতাড়ি কপালে হাত দিয়ে দেখতে গেলাম সিদুর লেগে আছে কিনা-দেখি কিছুই না— বুক ধড়াস করে উঠল—চারদিকে অবাক হয়ে চেয়ে দেখ সন্ধে হয়ে গিয়েছে-বাড়িতে কেউ নেই—খানিকক্ষণ না পারি কিছু করতে হাত পা যেন অবশ—তারপরে মনে হল, এ মা-আর কেউ না, ঠিক মা। মা এসেছিলেন এয়োতির সিঁদুর পরিয়ে দিতে। কাউকে বলি নি, আজ বললাম তোমায়।

বাহিরের বর্ষাধারার অবিশ্রান্ত রিম্ ঝিম্ শব্দ, একটা কি পতঙ্গ বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে তান রাখিয়া একটানা ডাকিয়া চলিয়াছে, মাঝে মাঝে পুবে-হাওয়ার দমকা, অপর্ণার মাথার চুলের গন্ধ। জীবনের এই সব মুহূর্ত বড় অদ্ভুত। অনভিজ্ঞ হইলেও অপু তাহা বুঝিল। হঠাৎ ক্ষণিক বিদ্যুৎচমকে যেন অন্ধকার পথের অনেকখানি নজরে পড়ে। এমন সব চিন্তা মনে আসে, সাধারণ অবস্থায়, সুস্থ মনে সারা জীবনেও সে-সব চিন্তা মনে আসিত না।…কেমন একটা রহস্য…আত্মার অদৃষ্টলিপি…একটা বিরাট অসীমতা…।

কিন্তু পরক্ষণেই চোখ জলে ভরিয়া আসিল। সে কোনও কথা বলিল না। কোন মন্তব্য প্রকাশ করিল না, কেহই কোন কথা বলিল না।

খানিকটা পরে সে বলিল, আর একটা কবিতা পড়ো—শুনি বরং।

অপর্ণা বলিল–তুমি একটা গান করো–

অপু রবিঠাকুরের গান গাহিল একটা, দুইটা, তিনটা। তারপর আবার কথা, আবার গল্প। অপর্ণা হাসিয়া বলিল—আর রাত নেই কিন্তু ফরসা হয়ে এল–

—ঘুম পাচ্ছে?—

–না। তুমি একটা কাজ করো না? কাল আর যেয়ো না—

অফিস কামাই করব? তা কি কখনও চলে?

ভোর হইয়া গেল। অপর্ণা উঠিতে যাইতেছিল, অপু কোন্ সময় ইতিমধ্যে তাহার আঁচলের সঙ্গে নিজের কাপড়ের সঙ্গে গিঁট বাঁধিয়া রাখিয়াছে, উঠিতে গিয়া টান পড়িল। অপর্ণা হাসিয়া বলিল—ওমা তুমি কি! আচ্ছা দুষ্ট তো…এখুনি হারানের মা কাজ করতে আসবে বুড়ি কি ভাববে বলল দিকি? ভাববে, এত বেলা অবধি ঘরের মধ্যে—মাগো মা, ছাড়ো, লজ্জা করেছিঃ!

অপু ততক্ষণে অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া শুইয়া পড়িয়াছে।

—ছাড়ো, ছাড়ো, লক্ষ্মী ছিঃ—এখুনি এলো বলে বুড়ি, পায়ে পড়ি তোমার ছাড়ো অপু নির্বিকার।

এমন সময় বাহিরে হারানের মায়ের গলা শোনা গেল। অপর্ণা ব্যস্তভাবে মিনতির সুরে বলিল—ওই এসেছে বুড়ি—ছাড়া ছিঃ–লক্ষ্মীটি—ওরকম দুষ্টুমি করে না—লক্ষ্মী–

হারানের মা কপাটের গায়ে ধাক্কা দিয়া বলিল—ও বৌমা, ভোর হয়ে গিয়েছে। ওঠো, ওঠো, ঘড়া ঘটিগুলো বার করে দেবে না?

অপু হাসিয়া উঠিয়া আঁচলের গিঁট খুলিয়া দিল।

অফিস কামাই করিয়া সে-দিনটা অপু বাড়িতেই রহিয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *