৩১-৪০. ১৬ তারিখ সকাল দশটায়

৩১.

১৬ তারিখ সকাল দশটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রসভায় আমরা সকলেই যোগদান করলাম। হঠাৎ কে যেন আমার নাম প্রস্তাব করে বসল সভাপতির আসন গ্রহণ করার জন্য। সকলেই সমর্থন করল। বিখ্যাত আমতলায় এই আমার প্রথম সভাপতিত্ব করতে হল। অনেকেই বক্তৃতা করল। সংগ্রাম পরিষদের সাথে যেসব শর্তের ভিত্তিতে আপোস হয়েছে তার সকলগুলিই সভায় অনুমোদন করা হল। তবে সভা খাজা নাজিমুদ্দীন যে পুলিশি জুলুমের তদন্ত করবেন, তা গ্রহণ করল না; কারণ খাজা সাহেব নিজেই প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আমি বক্তৃতায় বললাম, “যা সংগ্রাম পরিষদ গ্রহণ করেছে, আমাদেরও তা গ্রহণ করা উচিত। শুধু আমরা ঐ সরকারি প্রস্তাবটা পরিবর্তন করতে অনুরোধ করতে পারি, এর বেশি কিছু না।“ ছাত্ররা দাবি করল, শোভাযাত্রা করে আইন পরিষদের কাছে গিয়ে খাজা সাহেবের কাছে এই দাবিটা পেশ করবে এবং চলে আসবে। আমি বক্তৃতায় বললাম, তার কাছে পৌঁছে দিয়েই আপনারা আইনসভার এরিয়া ছেড়ে চলে আসবেন। কেউ সেখানে থাকতে পারবেন না। কারণ সংগ্রাম পরিষদ বলে দিয়েছে, আমাদের আন্দোলন বন্ধ করতে কিছুদিনের জন্য। সকলেই রাজি হলেন।

এক শোভাযাত্রা করে আমরা হাজির হয়ে কাগজটা ভিতরে পাঠিয়ে দিলাম খাজা সাহেবের কাছে। আমি আবার বক্তৃতা করে সকলকে চলে যেতে বললাম এবং নিজেও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে চলে আসবার জন্য রওয়ানা করলাম। কিছু দূর এসে দেখি, অনেক ছাত্র চলে গিয়েছে। কিছু ছাত্র ও জনসাধারণ তখনও দাঁড়িয়ে আছে আর মাঝে মাঝে শ্লোগান দিচ্ছে। আবার ফিরে গিয়ে বক্তৃতা করলাম। এবার অনেক ছাত্রও চলে গেল। আমি হলে চলে আসলাম। প্রায় চারটায় খবর পেলাম, আবার বহু লোক জমা হয়েছে, তারা বেশিরভাগ সরকারি কর্মচারী ও জনসাধারণ, ছাত্র মাত্র কয়েকজন ছিল। শামসুল হক সাহেব চেষ্টা করছেন লোকদের ফেরাতে। মাঝে মাঝে হলের ছাত্ররা দু’একজন এমএলএকে ধরে আনতে শুরু করেছে মুসলিম হলে। তাদের কাছ থেকে লিখিয়ে নিচ্ছে, যদি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে না পারেন, তবে পদত্যাগ করবেন। মন্ত্রীরাও বের হতে পারছেন না। বাজা সাহেব মিলিটারির সাহায্যে পেছন দরজা দিয়ে ভেগে গিয়েছিলেন। বহু লোক আবার জড়ো হয়েছে। আমি ছুটলাম এ্যাসেম্বলির দিকে। ঠিক কাছাকাছি যখন পৌঁছে গেছি তখন লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করতে শুরু করেছে পুলিশ। আমার চক্ষু জ্বলতে শুরু করেছে। পানি পড়ছে, কিছুই চোখে দেখি না। কয়েকজন ছাত্র ও পাবলিক আহত হয়েছে। আমাকে কয়েকজন পলাশী ব্যারাকের পুকুরে নিয়ে চোখে মুখে পানি দিতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ পরে একটু আরাম পেলাম। দেখি মুসলিম হলে হৈচৈ। বাগেরহাটের ডা. মোজাম্মেল হক সাহেবকে ধরে নিয়ে এসেছে। তিনি এমএলএ। তাঁকে ছাত্ররা জোর করছে লিখতে যে, তিনি পদত্যাগ করবেন। আমাকে তিনি চিনতেন, আমিও তাকে চিনতাম। আমি ছাত্রদের অনুরোধ করলাম, তাকে ছেড়ে দিতে। তিনি লোক ভাল এবং শহীদ সাহেবের সমর্থক ছিলেন। অনেক কষ্টে, অনেক বুঝিয়ে তাঁকে মুক্ত করে বাইরে নিয়ে এলাম। একটা রিকশা ভাড়া করে তাঁকে উঠিয়ে দিলাম। হঠাৎ খবর এল, শওকত মিয়া আহত হয়ে হাসপাতালে আছে। তাড়াতাড়ি ছুটলাম তাকে দেখতে। সত্যই সে হাতে, পিঠে আঘাত পেয়েছে। পুলিশ লাঠি দিয়ে তাকে মেরেছে। আরও কয়েকজন সামান্য আহত হয়েছে। সকলকে বলে আসলাম, একটু ভাল হলেই হাসপাতাল ত্যাগ করতে। কারণ, পুলিশ আবার গ্রেফতার করতে পারে।

সন্ধ্যার পরে খবর এল ফজলুল হক হলে সংগ্রাম পরিষদের সভা হবে। ছাত্ররাও উপস্থিত থাকবে। আমার যেতে একটু দেরি হয়েছিল। তখন একজন বক্তৃতা করছে আমাকে আক্রমণ করে। আমি দাঁড়িয়ে শুনলাম এবং সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। তার বক্তৃতা শেষ হলে আমার বক্তব্য বললাম। আমি যে আমতলার ছাত্রসভায় বলেছিলাম, কাগজ দিয়েই চলে আসতে এবং এ্যাসেম্বলি হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে সকলকে চলে যেতে অনুরোধ করেছিলাম এবং বক্তৃতাও করেছিলাম, একথা কেউ জানেন কি না? যা হোক, এখানেই শেষ হয়ে গেল, আর বেশি আলোচনা হল না এবং সিদ্ধান্ত হল আপাতত আমাদের আন্দোলন বন্ধ রাখা হল। কারণ, কয়েকদিনের মধ্যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথম ঢাকায় আসবেন পাকিস্তান হওয়ার পরে। তাঁকে সম্বর্ধনা জানাতে হবে। আমরা ছাত্ররাও সম্বর্ধনা জানাব। প্রত্যেক ছাত্র যাতে এয়ারপোর্টে একসাথে শোভাযাত্রা করে যেতে পারে তার বন্দোবস্ত করা হবে।

রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন শুধু ঢাকায়ই সীমাবদ্ধ ছিল না। ফরিদপুর ও যশোরে কয়েক শত ছাত্র গ্রেফতার হয়েছিল। রাজশাহী, খুলনা, দিনাজপুর ও আরও অনেক জেলায় আন্দোলন হয়েছিল। নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ চেষ্টা করেছিল এই আন্দোলনকে বানচাল করতে, কিন্তু পারে নাই। এই আন্দোলন ছাত্ররাই শুরু করেছিল সন্দেহ নাই। কিন্তু এই আন্দোলনের পরে দেখা গেল জনসাধারণও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে বদ্ধপরিকর—বিশেষ করে সরকারি কর্মচারীরাও একে সমর্থন দিয়েছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে একদল গুণ্ডা আক্রমণ করলে পলাশী ব্যারাক থেকে সরকারি কর্মচারীরা এসে তাদের বাধা দিয়েছিল। যার ফলে শুরা মার খেয়ে ভাগতে বাধ্য হয়েছিল। পরে দেখা গেল, ঢাকা শহরের জনসাধারণের মনোভাবের অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। সরকার থেকে প্রপাগান্ডা করা হয়েছিল যে, কলকাতা থেকে হিন্দু ছাত্ররা পায়জামা পরে এসে এই আন্দোলন করছে। যে সত্তর-পঁচাত্তরজন ছাত্র বন্দি হয়েছিল তার মধ্যে একজনও হিন্দু ছাত্র ছিল না। এমনকি যারা আহত হয়েছিল তার মধ্যেও একজন হিন্দু ছিল না। তবু তখন। থেকেই যুক্ত বাংলা ও ভারতবর্ষের দালাল, কমিউনিস্ট ও রাষ্ট্রদ্রোহী’—এই কথাগুলি বলা শুরু হয়, আমাদের বিরুদ্ধে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে। এমনকি সরকারি প্রেসনোটেও আমাদের এইভাবে দোষারোপ করা হত।

বাংলা পাকিস্তানের শতকরা ছাপ্পান্ন ভাগ লোকের মাতৃভাষা। তাই বাংলাই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। তবুও আমরা বাংলা ও উর্দ দুইটা রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছিলাম। পাঞ্জাবের লোকেরা পাঞ্জাবি ভাষা বলে, সিন্ধুর লোকেরা সিন্ধি ভাষায় কথা বলে, সীমান্ত প্রদেশের লোকেরা পশতু ভাষায় কথা বলে, বেলুচরা বেলুচি ভাষায় কথা বলে। উর্দু পাকিস্তানের কোনো প্রদেশের ভাষা নয়, তবুও যদি পশ্চিম পাকিস্তানের ভায়েরা উর্দু ভাষার জন্য দাবি করে, আমরা আপত্তি করব কেন? যারা উর্দু ভাষা সমর্থন করে তাদের একমাত্র যুক্তি হল উর্দু ইসলামিক ভাষা’। উর্দু কি করে যে ইসলামিক ভাষা হল আমরা বুঝতে পারলাম না।

দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আরব দেশের লোকেরা আরবি বলে। পারস্যের লোকেরা ফার্সি বলে, তুরস্কের লোকেরা তুর্কি ভাষা বলে, ইন্দোনেশিয়ার লোকেরা ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় কথা বলে, মালয়েশিয়ার লোকেরা মালয়া ভাষায় কথা বলে, চীনের মুসলমানরা চীনা ভাষায় কথা বলে। এ সম্বন্ধে অনেক যুক্তিপূর্ণ কথা বলা চলে। শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মভীরু মুসলমানদের ইসলামের কথা বলে ধোকা দেওয়া যাবে ভেবেছিল, কিন্তু পারে নাই। যে কোনো জাতি তার মাতৃভাষাকে ভালবাসে। মাতৃভাষার অপমান কোনো জাতিই কোনো কালে সহ্য করে নাই। এই সময় সরকারদলীয় মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুর জন্য জান মাল কোরবানি করতে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু জনসমর্থন না পেয়ে একটু ঘাবড়িয়ে পড়েছিলেন। তারা শেষ ‘তাবিজ’ নিক্ষেপ করলেন। জিন্নাহকে ভুল বোঝালেন। এরা মনে করলেন, জিন্নাহকে দিয়ে উর্দুর পক্ষে বলাতে পারলেই আর কেউ এর বিরুদ্ধাচরণ করতে সাহস পাবে না। জিন্নাহকে দলমত নির্বিশেষে সকলেই শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর যে কোন ন্যায়সঙ্গত কথা মানতে সকলেই বাধ্য ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের জনমত কোন পথে, তাকে কেউই তা বলেন নাই বা বলতে সাহস পান নাই।

১৯ মার্চ জিন্নাহ ঢাকা আসলে হাজার হাজার লোক তাকে অভিনন্দন জানাতে তেজগাঁ হাওয়াই জাহাজের আড্ডায় হাজির হয়েছিল। আমার মনে আছে, ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিল। সেদিন আমরা সকলেই ভিজে গিয়েছিলাম, তবুও ভিজে কাপড় নিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা করার জন্য এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করেছিলাম। জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানে এসে ঘোড় দৌড় মাঠে বিরাট সভায় ঘোষণা করলেন, “উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। আমরা প্রায় চার পাঁচ শত ছাত্র এক জায়গায় ছিলাম সেই সভায়। অনেকে হাত তুলে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিল, মানি না। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে বক্তৃতা করতে উঠে তিনি যখন আবার বললেন, “উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে”—তখন ছাত্ররা তাঁর সামনেই বসে চিৎকার করে বলল, না, না, না। জিন্নাহ প্রায় পাঁচ মিনিট চুপ করেছিলেন, তারপর বক্তৃতা করেছিলেন। আমার মনে হয়, এই প্রথম তার মুখের উপরে তার কথার প্রতিবাদ করল বাংলার ছাত্ররা। এরপর জিন্নাহ যতদিন বেঁচেছিলেন আর কোনোদিন বলেন নাই, উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।

ঢাকায় জিন্নাহ দুই দলের ছাত্রনেতাদের ডাকলেন। বোধহয় বাংলা ভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদেরও ডেকেছিলেন। তবে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের দুইজন করে প্রতিনিধির সাথে দেখা করলেন। কারণ, তিনি পছন্দ করেন নাই, দুইটা প্রতিষ্ঠান কেন হবে এই মুহূর্তে! আমাদের পক্ষ থেকে মিস্টার তোয়াহা আর শামসুল হক সাহেব ছিলেন, তবে আমি ছিলাম না। জিন্নাহ আমাদের প্রতিষ্ঠানের নামটা পছন্দ করেছিলেন। নিখিল পূর্ব পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের নাম যখন আমাদের প্রতিনিধি পেশ করেন, তখন তারা দেখিয়ে দিলেন যে, এদের অধিকাংশ এখন চাকরি করে, অথবা লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। তখন জিন্নাহ তাদের উপর রাগই করেছিলেন। শামসুল হক সাহেবের সাথে জিন্নাহর একটু তর্ক হয়েছিল, যখন তিনি দেখা করতে যান বাংলা রাষ্ট্রভাষা করার বিষয় নিয়ে—শামসুল হক সাহেব আমাকে এসে বলেছিলেন। শামসুল হক সাহেবের সৎ সাহস ছিল, সত্য কথা বলতে কাউকেও ভয় পেতেন না।

জিন্নাহ চলে যাওয়ার কয়েকদিন পরে ফজলুল হক হলের সামনে এক ছাত্রসভা হয়। তাতে একজন ছাত্র বক্তৃতা করেছিল, তার নাম আমার মনে নাই। তবে সে বলেছিল “জিন্নাহ যা বলবেন, তাই আমাদের মানতে হবে। তিনি যখন উদুই রাষ্ট্রভাষা বলেছেন তখন উর্দুই হবে।“ আমি তার প্রতিবাদ করে বক্তৃতা করেছিলাম, আজও আমার এই একটা কথা মনে আছে। আমি বলেছিলাম, “কোন নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তার প্রতিবাদ করা এবং তাকে বুঝিয়ে বলার অধিকার জনগণের আছে। যেমন হযরত ওমরকে (রা.) সাধারণ নাগরিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি বড় জামা পরেছিলেন বলে। বাংলা ভাষা শতকরা ছাপ্পান্নজন লোকের মাতৃভাষা, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সংখ্যাগুরুদের দাবি মানতেই হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। তাতে যাই হোক না কেন, আমরা প্রস্তুত আছি।” সাধারণ ছাত্ররা আমাকে সমর্থন করল। এরপর পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও যুবকরা ভাষার দাবি নিয়ে সভা ও শোভাযাত্রা করে চলল। দিন দিন জনমত সৃষ্টি হতে লাগল। কয়েক মাসের মধ্যে দেখা গেল, নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কোনো সমর্থক রইল না। কিছু নেতা রইল, যাদের মন্ত্রীদের বাড়ি ঘোরাফেরা করা আর সরকারের সকল কিছুই সমর্থন করা ছাড়া কাজ ছিল না।

 

৩২.

ভাষা আন্দোলনের পূর্বে মোহাম্মদ আলী, তোফাজ্জল আলী এবং ডা, মালেক সাহেবের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ এমএলএদের মধ্যে এক গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ, খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব শহীদ সাহেবের কোনো সমর্থককে মন্ত্রিত্ব দেন নাই। এমনকি পার্লামেন্টারি সেক্রেটারিও করেন নাই। তাদের সংখ্যাও কম ছিল না। প্রায়ই তোফাজ্জল আলী সাহেবের বাড়িতে এদের সভা হত। দেখা গিয়েছিল, এদের সমর্থক সংখ্যা এমন পর্যায়ে এসে পড়েছে যে, ইচ্ছা করলে নাজিমুদ্দীন সাহেবের বিরুদ্ধে অনাস্থা দিলে পাস হয়ে যেতে পারে। এদের পক্ষ থেকে দুই একজন এমএলএ কলকাতায়ও গিয়েছিল, শহীদ সাহেবকে আনতে। শহীদ সাহেব ঢাকায় পৌঁছালেই অনাস্থা প্রস্তাব এরা পেশ করবে বলে কথাবার্তা চলেছিল। কিন্তু শহীদ সাহেব রাজি হন নাই। তিনি এদের বলেছিলেন, “আমি এখন গোলমাল সৃষ্টি করতে চাই না। নাজিমুদ্দীন সাহেবই কাজ করুক।” আরও বলেছিলেন, “সেই পুরানা এমএলএদের কথা বলছ? কিছুদিন পূর্বে আমার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। আজ আবার নাজিমুদ্দীন সাহেবের বিরুদ্ধে ভোট দিবে, কাল আবার আমার বিরুদ্ধে দিতে পারে। এ সমস্তের দরকার নাই, আমার অনেক কাজ এবং সে কাজ আমি না করলে মুসলমানদের ভারত ত্যাগ করতে হবে এবং লক্ষ লক্ষ লোক মারা যাবে। আমার একমাত্র চেষ্টা ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে এবং পাকিস্তানে মুসলমান-হিন্দুদের মধ্যে স্থায়ী একটা শান্তি কায়েম করতে পারি কি না?”

এদিকে জিন্নাহ সাহেব মোহাম্মদ আলী সাহেবকে ডেকে এক ধমক দিলেন, দল সৃষ্টি করার জন্য। আর বললেন, রাষ্ট্রদূত হয়ে বার্মায় যেতে। মোহাম্মদ আলী, তোফাজ্জল আলী সাহেবের বাড়িতে এসে আমাদের সমস্ত ঘটনা বললেন এবং তিনি যে বার্মা যেতে রাজি হয়েছেন, সেকথাও জানালেন। কিছুদিন পরে ডা, মালেকও মন্ত্রিত্ব পাবেন বলে ঠিক হল। শেষ পর্যন্ত তোফাজ্জল আলী সাহেব বাকি ছিলেন। তিনি একদিন আমাকে বললেন, “মুজিব দেখলে তো, মোহাম্মদ আলী সাহেব চলে গেলেন, ডা, মালেকও মন্ত্রী হয়ে যাচ্ছে, আমাকেও ডেকেছে মন্ত্রিত্ব নিতে। কি করি বল তো? একলা তো আর বাইরে থেকে কিছু করা যাবে না। তোমার মত আমার নেওয়া দরকার।” আমি দেখলাম, তাকে বাধা দিয়ে আর কি হবে? সকলেই তো নাজিমুদ্দীন সাহেবের দলে মিলে গেছে। আমি তাকে বললাম, “তবুও তো আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এজন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর কেউ তো জিজ্ঞাসাও করল না। কি আর আপনি একলা করতে পারবেন, মন্ত্রিত্ব নিয়ে নেন, আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। যে আদর্শ ও পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করেছি, সে আদর্শ কায়েম না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালাব।” তিনি যে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এই ভদ্রতার জন্য তাকে আমি শ্রদ্ধা করেছি এবং তার সাথে আমার সম্বন্ধ কোনোদিন নষ্ট হয় নাই। তিনিও আমাকে সকল সময়ই ছোট ভাইয়ের মত দেখেছেন। যদিও পরে আমরা দুইজন দুই রাজনৈতিক দলে ছিলাম।

মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের বিবৃতির পরে আর আমরা মুসলিম লীগের সদস্য থাকলাম না। অর্থাৎ আমাদের মুসলিম লীগ থেকে খেদিয়ে দেওয়া হল। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, মুসলিম লীগকে একটা প্রগতিশীল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। টাঙ্গাইলে দুইটা আইনসভার আসন খালি হয়েছিল। আমাদের ইচ্ছা ছিল, নাজিমুদ্দীন সাহেবের বিরুদ্ধে লোক দেওয়া যায় কি না? মওলানা ভাসানী সাহেব আসাম থেকে চলে এসে টাঙ্গাইলের কাগমারীতে বাস করছিলেন। তাঁর শরণাপন্ন হলাম। কিন্তু মওলানা সাহেব এক সিট নিজে এবং এক সিট নাজিমুদ্দীন সাহেবকে দিয়ে নির্বাচন করে এমএলএ হলেন। পরে নির্বাচনী হিসাব দাখিল না করার জন্য মওলানা সাহেবের নির্বাচন বেআইনি ঘোষণা হয়েছিল।

আমাদের ভাষা আন্দোলনের সময় মওলানা সাহেব সমর্থন করেছিলেন। টাঙ্গাইলে মুসলিম লীগ কর্মীদের এক সভা ডাকা হল, কি করা যায় ভবিষ্যতে! আলোচনা হবার পরে ঠিক হল, আরেকটা সভা করা হবে নারায়ণগঞ্জে। সেখানে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হবে। মওলানা ভাসানী, আবদুস সালাম খান, আতাউর রহমান খান, শামসুল হক সাহেব আরও অনেক মুসলিম লীগ কর্মী ও নেতা যোগদান করবেন বলে ঠিক হল। সভার আয়োজন করেছিল সালমান আলী, আবদুল আউয়াল, শামসুজ্জোহা ও আরও অনেকে। খান সাহেব ওসমান আলী এমএলএও সমর্থন দিয়েছিলেন। সভার পূর্বে ১৪৪ ধারা জারি করা হল। আমরা পাইকপাড়া ক্লাবে সভা করলাম। বিভিন্ন জেলার অনেক নেতাকর্মী উপস্থিত হয়েছিলেন। এই সময় শামসুজ্জোহার উপর মুসলিম লীগের ভাড়াটিয়া গুণ্ডারা আক্রমণ করেছিল। দুঃখের বিষয়, এই কর্মীরাই নারায়ণগঞ্জে মুসলিম লীগ গঠন করেছিল এবং পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। এখন যারা এদের উপর আক্রমণ করেছিল তাদের প্রায় সকলেই পাকিস্তান ও মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ছিল। প্রত্যেক জেলা ও মহকুমায় মুসলিম লীগ ভেঙে দিয়ে এডহক কমিটি গঠন করেছিল। প্রায় সমস্ত জায়গায় মুসলিম লীগ কমিটিতে শহীদ সাহেবের সমর্থক বেশি ছিল বলে অনেক লীগ ও পাকিস্তানবিরোধী লোকদের এডহক কমিটিতে নিতে হয়েছিল। কিন্তু জনসাধারণ মুসলিম লীগ বলতে শুধু পুরানা লীগ কর্মীদেরই বুঝত।

মওলানা ভাসানী সাহেবের সভাপতিত্বে এই সভা হল। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, প্রথমে দুইজন প্রতিনিধি করাচিতে জনাব খালিকুজ্জামান সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করবেন এবং আমাদের দাবি পেশ করবেন। আমাদের দাবি ছিল, পুরানা মুসলিম লীগকে কাজ করতে দেওয়া হোক। যদি না শোনেন, তবে আমাদের রসিদ বই দেওয়া হোক এবং যাতে নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় তার বন্দোবস্ত করা হোক। দেখা যাবে, জনসাধারণ কাদের চায়? তখনকার দিনে করাচি যাওয়া এত সোজা ছিল না। কলকাতা-দিল্লি হয়ে করাচি যেতে হত। ঠিক হল, জনাব আতাউর রহমান খান এবং বেগম আনোয়ারা খাতুন এমএলএ যাবেন করাচিতে। তারা করাচিতে গেলেন এবং চৌধুরী খালিকুজ্জামানের সাথে সাক্ষাৎ করলেন এবং আমাদের দাবিদাওয়া পেশ করলেন। খালিকুজ্জামান সাহেব বলে দিলেন, “পুরানা কথা ভুলে যান, যারা খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেবকে সমর্থন করবেন, তারাই মুসলিম লীগের সদস্য থাকবেন।” রসিদ বইয়ের কথায় বললেন, “কাগজ পাওয়া যায় না, তাই রসিদ বই পাওয়া কষ্টকর। আকরম খাঁ সাহেব ও পূর্ব পাকিস্তান এডহক কমিটিকে বলবেন, তারা যদি ভাল মনে করেন তবে পাবেন।” দুইজনই ফিরে এলেন এবং আমাদের কাছে বললেন, মিছামিছি কতগুলি টাকা খরচ করা হল, কোনো কাজ হল না। খালিকুজ্জামান সাহেব ভাল করে কথা বলতেও চান নাই।

শহীদ সাহেবও এই সময় ঢাকা আসলেন এবং মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও আরও কয়েক জায়গায় সভা করলেন, তাতে ফল খুব ভাল হল। হিন্দুদের দেশত্যাগ করার যে একটা হিড়িক পড়েছিল তা অনেকটা বন্ধ হল এবং পশ্চিম বাংলা ও বিহার থেকেও মুসলমানরা অনেক কম আসতে লাগল। এই সমস্ত সভায় এত বেশি জনসমাগম হত এবং শহীদ সাহেবকে অভ্যর্থনা করার জন্য এত লোক উপস্থিত হত যে তা কল্পনা করাও কষ্টকর। এতে নাজিমুদ্দীন সাহেবের সরকার ঘাবড়িয়ে গিয়েছিলেন। এবার শহীদ সাহেব নবাবজাদা নসরুল্লাহ সাহেবের বাড়িতে উঠেছিলেন। নবাবজাদা শহীদ সাহেবকে সমর্থনও করতেন এবং শ্রদ্ধাও করতেন। শহীদ সাহেবকে বিদায় দিলাম গোপালগঞ্জ থেকে। সবুর সাহেব খুলনায় শহীদ সাহেবকে অভ্যর্থনা করলেন। কারণ, সবুর সাহেব তখনও শহীদ সাহেবের কথা ভুলতে পারেন নাই। তাঁকে সমর্থন করতেন এবং আমাদেরও সাহায্য করতেন। শহীদ সাহেব খুলনায় হিন্দু-মুসলমান নেতাদের নিয়ে এক ঘরোয়া বৈঠক করলেন এবং সাম্প্রদায়িক শান্তি যাতে বজায় থাকে সে সম্বন্ধে সকলকে চেষ্টা করতে বললেন। গোপালগঞ্জে বিরাট সভায় শহীদ সাহেব ও আমাকে খালি গলায়ই বক্তৃতা করতে হয়েছিল। কারণ মাইক্রোফোন জোগাড় করতে পারি নাই। খুলনা থেকে যে আনব সে সময়ও আমাদের হাতে ছিল না, কারণ তিনি হঠাৎ প্রোগ্রাম করেছিলেন।

এইবার যখন শহীদ সাহেব পূর্ব পাকিস্তানে এলেন, আমরা দেখলাম সরকার ভাল চোখে দেখছে না। পূর্বে সরকারি কর্মচারীরা শহীদ সাহেবের থাকবার বন্দোবস্ত যাতে ভালভাবে হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতেন। কিন্তু এবার তারা দূরে দূরে থাকতে চায়। দু’একজন গোপনে বলেই ফেলেছিল, “উপরের হুকুম, যাতে তারা সহযোগিতা না করে।” গোয়েন্দা বিভাগের তৎপরতাও বেড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছিল। সত্যই পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্যই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা উচিত, তা না হলে যদি একবার মোহাজের আসতে শুরু করত, তাহলে অবস্থা কি শোচনীয় হত যারা চিন্তাবিদ তারা তা অনুধাবন করতে পারবেন। সংকীর্ণ মন নিয়ে যারা রাজনীতি করেন তাদের কথা আলাদা। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহার ও অন্যান্য প্রদেশগুলোতে এখনও লক্ষ লক্ষ মুসলমান রয়েছে—যাদের দান পাকিস্তান আন্দোলনে কারও চেয়ে কম ছিল না। তাদের কথা চিন্তা করে আমাদের শান্তি বজায় রাখা উচিত বলে আমরা মনে করতাম। সত্য কথা বলতে কি, পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমান শহীদ সাহেবের উপদেশ গ্রহণ করেছিল। ফলে কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা হয় নাই। এমনকি মুসলমানরা হিন্দুদের অনুরোধ করেছিল, যাতে তারা দেশ ত্যাগ না করে। আমি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য অনেক জায়গায় ঘুরেছি। আমার জানা আছে এ রকম অনেক ঘটনা। দুঃখের বিষয়, পশ্চিমবঙ্গের প্রগতিশীল হিন্দু ভাইরাও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে পারেন নাই। মুসলমানদের ঘরবাড়ি, জানমাল ধ্বংস করেছে অনেক জায়গায়।

 

৩৩.

এই সময় খাদ্য সমস্যা দেখা দিয়েছিল কয়েকটা জেলায়। বিশেষ করে ফরিদপুর, কুমিল্লা ও ঢাকা জেলার জনসাধারণ এক মহাবিপদের সম্মুখীন হয়েছিল। সরকার কর্ডন প্রথা চালু করেছিল। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় কোনো খাদ্য যেতে দেওয়া হত না। ফরিদপুর ও ঢাকা জেলার লোক, খুলনা ও বরিশালে ধান কাটবার মরশুমে দল বেঁধে দিনমজুর হিসাবে যেত। এরা ধান কেটে ঘরে উঠিয়ে দিত। পরিবর্তে একটা অংশ পেত। এদের দাওয়াল’ বলা হত। হাজার হাজার লোক নৌকা করে যেত। আসবার সময় তাদের অংশের ধান নিজেদের নৌকা করে বাড়িতে নিয়ে আসত। এমনিভাবে কুমিল্লা জেলার দাওয়ালরা সিলেট জেলায় যেত। এরা প্রায় সকলেই গরিব ও দিনমজুর। প্রায় দুই মাসের জন্য ঘরবাড়ি ছেড়ে এদের যেত হত। যাবার বেলায় মহাজনদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে সংসার খরচের জন্য দিয়ে যেত। ফিরে এসে ধার শোধ করত। দাওয়ালদের নৌকা খুবই কম ছিল। যাদের কাছ থেকে নৌকা নিত তাদেরও একটা অংশ দিতে হত। যখন এবার দাওয়ালরা ধান কাটতে গেল, কেউ তাদের বাধা দিল না। এরা না গেলে আবার জমির ধান তুলবার উপায় ছিল না। একসাথেই প্রায় সব ধান পেকে যায়, তাই তাড়াতাড়ি কেটে আনতে হয়। স্থানীয়ভাবে এত কৃষাণ একসাথে পাওয়া কষ্টকর ছিল। বহু বৎসর যাবৎ এই পদ্ধতি চলে আসছিল।

ফরিদপুর, ঢাকা ও কুমিল্লা জেলার হাজার হাজার লোক এই ধানের উপর নির্ভর করত। দাওয়ালরা যখন ধান কাটতে যায়, তখন সরকার কোনো বাধা দিল না। যখন তারা দুই মাস পর্যন্ত ধান কেটে তাদের ভাগ নৌকায় তুলে রওয়ানা করল বাড়ির দিকে তাদের বুভুক্ষ মা-বোন, স্ত্রী ও সন্তানদের খাওয়াবার জন্য, যারা পথ চেয়ে আছে, আর কোনো মতে ধার করে সংসার চালাচ্ছে—কখন তাদের, স্বামী, ভাই, বাবা ফিরে আসবে ধান নিয়ে, পেট ভরে কিছুদিন ভাত খাবে, এই আশায়—তখন নৌকায় রওয়ানা করার সাথে সাথে তাদের পথ রোধ করা হল। ‘ধান নিতে পারবে না, সরকারের হুকুম’, ধান জমা দিয়ে যেতে হবে, নতুবা নৌকাসমেত আটক ও বাজেয়াপ্ত করা হবে। সহজে কি ধান দিতে চায়? শেষ পর্যন্ত সমস্ত ধান নামিয়ে রেখে লোকগুলিকে ছেড়ে দেওয়া হল। এ খবর পেয়ে আমার পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভব হল না। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ করলাম। সভা করলাম, সরকারি কর্মচারীদের সাথে সাক্ষাৎও করলাম কিন্তু কোনো ফল হল না। এদিকে খোন্দকার মোশতাক আহমদ এই কর্ডনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা শুরু করেছে বলে আমি খবর পেলাম। অনেক সভা-সমিতি, অনেক প্রস্তাব করলাম কোনো ফল হল না। এই লোকগুলি দিনমজুর। দুই মাস পর্যন্ত যে শ্রম দিল, তার মজুরি তাদের মিলল না। আর মহাজনদের কাছ থেকে যে টাকা ধার করে এনেছিল এই দুই মাসের খরচের জন্য, খালি হাতে ফিরে যাওয়ার পরে দেনার দায়ে ভিটাবাড়িও ছাড়তে হল।

এ রকমের শত শত ঘটনা আমার জানা আছে। এদিকে ফরিদপুর, ঢাকা ও কুমিল্লা জেলার অনেক নৌকার ব্যবসায়ী ছিল যারা বড় নৌকায় করে ধান-চাউল ঐ সমস্ত জেলা থেকে এনে বিক্রি করত, তাদের ব্যবসাও বন্ধ হল এবং অনেক লোক নৌকায় খেটে খেত তারাও বেকার হয়ে পড়ল। এদের মধ্যে অনেকেই আজ রিকশা চালায়। একমাত্র গোপালগঞ্জ মহকুমার কয়েক হাজার লোক খুলনা, যশোর ও অন্যান্য জায়গায় রিকশা চালিয়ে এবং কুলির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করার চেষ্টা করতে লাগল। আমরা যখন ভীষণভাবে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলাম, সরকার হুকুম দিল ধান কাটতে যেতে আপত্তি নাই। তবে ধান আনতে পারবে না। নিকটতম সরকারি গুদামে জমা দিতে হবে এবং সেই গুদাম থেকে কর্মচারীরা একটা রসিদ দেবে, দাওয়ালরা দেশে ফিরে এসে সেই পরিমাণ ধান নিজের জেলার নিকটতম গুদাম থেকে পাবে। দাওয়ালরা ধান কাটতে না গেলে একমাত্র খুলনা জেলায়ই অর্ধেক জমির ধান পড়ে থাকবে, একথা সরকার জানত। ১৯৪৮ সালের শেষে অথবা ১৯৪৯ সালের প্রথম দিকে এই হুকুম সরকার দিল। দুঃখের বিষয়, ধান গুদামে নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু অধিকাংশ দাওয়াল ফিরে এসে ধান পায় নাই। কোন রকম পাকা রসিদ ছিল না, সাদা কাগজে লিখে দিয়েই ধান নামিয়ে রাখত। সেই রসিদ নিয়ে দেশের গুদামে গেলে গালাগালি করে তাড়িয়ে দিত। অথবা সামান্য কিছু ব্যয় করলে কিছু ধান পাওয়া যেত। এতে দাওয়ালরা সর্বস্বান্ত হয়ে গেল।

এই সময় একটা ঘটনা ঘটে গেল খুলনায়। ফরিদপুর জেলার দাওয়ালদের প্রায় দুইশত নৌকা আটক করল ধানসমেত। তারা রাতের অন্ধকারে সরকারি হুকুম না মেনে ‘আল্লাহু আকবর’, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিয়ে নৌকা ছেড়ে দিল ধান নিয়ে। দশ-পনের মাইল চলার পরে পুলিশ বাহিনী লঞ্চ নিয়ে তাদের ধাওয়া করে বাধা দিল, শেষ পর্যন্ত গুলি করে তাদের থামান হল। দাওয়ালরাও বাধা দিয়েছিল, কিন্তু পারে নাই। জোর করে নদীর পাড়ে এক মাঠের ভিতর সমস্ত ধান নামান হয়েছিল এবং লোকদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। যদিও সরকারি গুদামে সে ধান ওঠে নাই। পরের দিন ভীষণভাবে বৃষ্টি হয়ে সে ধান ভেসে যায়। আমি খবর পেয়ে খুলনা এলাম, তখনও অনেক নৌকা আটক রয়েছে ধানসহ। এই সময় দাওয়ালদের নিয়ে সভা করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বাড়িতে শোভাযাত্রা সহকারে উপস্থিত হলাম। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন প্রফেসর মুনীর চৌধুরীর বাবা জনাব আবদুল হালিম চৌধুরী। তিনি আমার সাথে আলাপ করলেন এবং বললেন, তাঁর কিছুই করার নাই, সরকারের হুকুম। তবে তিনি ওয়াদা করলেন, সরকারের কাছে টেলিগ্রাম করবেন সমস্ত অবস্থা জানিয়ে। আমি দাওয়ালদের নিয়ে ফিরে আসলাম। আমি নিজেও টেলিগ্রাম করলাম। দাওয়ালদের বললাম, ভবিষ্যতে যেন তারা এভাবে আর ধান কাটতে না আসে, একটা বোঝাপড়া না হওয়া পর্যন্ত। খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব তখন বড়লাট। কারণ, জিন্নাহ মারা যাবার পরে তাঁকে গভর্নর জেনারেল করা হয়েছিল।

 

৩৪.

এই সময় আরেকটা অত্যাচার মহামারীর মত শুরু হয়েছিল। জিন্নাহ ফাভ’ নামে সরকার একটা ফান্ড খোলে। যে যা পারে তাই দান করবে এই হল হুকুম। জিন্নাহ ফান্ডে’ টাকা দিতে কেউই আপত্তি করেছে বলে আমার জানা নাই। যাদের অর্থ আছে তারা খুশি হয়েই দান করেছে। অনেক গরিবও ‘জিন্নাহ ফান্ডে’ টাকা দিয়াছে। কিন্তু কিছু সংখ্যক অফিসার সরকারকে খুশি করার জন্য জোরজুলুম করে টাকা তুলতে শুরু করেছিল। যে মহকুমা অফিসার বেশি তুলতে পারবেন, তিনি ভেবেছেন তাড়াতাড়ি প্রমোশন পাবেন।

আমার মহকুমায় এটা ভীষণ রূপ ধারণ করেছিল। খাজা সাহেব গোপালগঞ্জ আসবেন ঠিক হয়েছে। তখনকার মহকুমা হাকিম সভা করে এক অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করেছেন। যেখানে ঠিক করেছে যে গোপালগঞ্জ মহকুমায় প্রায় ছয় লক্ষ লোকের বাস, মাথাপ্রতি এক টাকা করে দিতে হবে, তাতে ছয় লক্ষ টাকা উঠবে। আর যাদের বন্দুক আছে, তাদের আলাদাভাবে দিতে হবে। ব্যবসায়ীদের তো কথাই নাই। বড় নৌকাথতিও প্রত্যেককে দিতে হবে। তিনি সমস্ত ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টদের হুকুম দিয়েছেন, যে না দিবে তাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। চারিদিকে জোরজুলুম শুরু হয়েছে। চৌকিদার, দফাদার নেমে পড়েছে। কারও গরু, কারও বদনা, থালা, ঘটিবাটি কেড়ে আনা হচ্ছে। এক ত্রাসের রাজত্ব। জনাব ওয়াহিদুজ্জামান সাহেবই নাজিমুদ্দীন সাহেবকে দাওয়াত করে এনেছেন। এখন তিনি মুসলিম লীগে আছেন। গোপালগঞ্জ মুসলিম লীগ যারা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত করেছেন, এখন আর তারা নাই। এডহক কমিটি করা হয়েছে। মহকুমা হাকিম সাহেবের সাথে যোগসাজশে তারা কাজ করেছে।

আমি খুলনা থেকে গোপালগঞ্জ পৌঁছালাম। গোপালগঞ্জ শহরে স্টিমার যায় না। দুই মাইল দূরে হরিদাসপুর নামে একটা ছোট্ট স্টেশন পর্যন্ত আসে। হরিদাসপুর থেকে নৌকায় গোপালগঞ্জ যেতে হয়। আমি একটা নৌকায় উঠলাম। মাঝি আমাকে চিনতে পেরেছে। নৌকা ছেড়ে দিয়ে আমাকে বলে, “ভাইজান, আপনি এখন এসেছেন, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে। পাঁচজন লোক আমরা, হুকুম এসেছে পাঁচ টাকা দিতে হবে। দিনভর কোনোদিন দুই টাকা, কোনোদিন আরও কম টাকা উপার্জন করি, বলেন তো পাঁচ টাকা কোথায় পাই? গতকাল আমার বাবার আমলের একটা পিতলা বদনা ছিল, তা চৌকিদার টাকার দায়ে কেড়ে নিয়ে গেছে।” এই কথা বলে কেঁদে ফেলল। সমস্ত ঘটনা আমাকে আস্তে আস্তে বলল। মাঝির বাড়ি টাউনের কাছেই। সে চালাক চতুরও আছে। শেষে বলে, “পাকিস্তানের কথা তো আপনার কাছ থেকেই শুনেছিলাম, এই পাকিস্তান আনলেন!” আমি শুধু বললাম, “এটা পাকিস্তানের দোষ না।”

গোপালগঞ্জ নেমে আমার বাসায় পৌঁছার সাথে সাথে অনেক লোক এসে জমা হতে লাগল, আর সকলের মুখে একই কথা। ব্যবসায়ীরা এল বিকালে কয়েকজন, পুরানা মুসলিম লীগের নেতারা এলেন। আমি বিকেলেই সমস্ত মহকুমায় আমার পুরানা সহকর্মীদের খবর দিলাম, পরের দিন প্রায় সকলে এসে হাজির হল। এক আলোচনা সভা করলাম। আমি বললাম, “আমাদের বাধা দিতে হবে। এটা সরকারের ট্যাক্স না। লোকে ট্যাক্স দিতে বাধ্য, কিন্তু কোন আইনে চাঁদা জোর করে তুলতে পারে?” আমি পৌঁছাবার পূর্বেই বোধহয় তিন লাখ টাকার মত তুলে ফেলেছে। সঠিক হিসাব দিতে পারব না। মহকুমা হাকিম ও মুসলিম লীগ এডহক কমিটি ঠিক করেছে যে টাকা অভ্যর্থনায় খরচ হবে তা বাদ দিয়ে। বাকি সমস্ত টাকা খাজা সাহেবকে তোড়ায় করে দেওয়া হবে জিন্নাহ ফান্ডের জন্য। যদি সম্ভব হয় কিছু টাকা মসজিদের জন্য রাখা হবে। গোপালগঞ্জে একটা ভাল মসজিদ করা হচ্ছিল।

আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, এ টাকা নিতে দেওয়া হবে না। তাঁর অভ্যর্থনায় যা ব্যয় হয়, তা বাদে বাকি টাকা মসজিদ আর গোপালগঞ্জে কলেজ করার জন্য রেখে দিতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে, আমরা বাধা দেব। দরকার হয় সভায় গোলমাল হবে। এ খবর চলে গেল সমস্ত মহকুমায়। টাকা তোলা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। আমার পৌঁছার সাথে সাথে জনসাধারণের সাহস বেড়ে গেল। গোপালগঞ্জের জনসাধারণ আমাকেই দেখেছে পাকিস্তান আন্দোলন করতে। এরা আমাকে ভালবাসে। আমার সাথে এক যুবক কর্মীবাহিনী ছিল, যারা আমার হুকুম পেলে আগুনেও ঝাপ দিতে পারত।

খাজা সাহেব পৌঁছাবার দুই দিন পূর্বে মহকুমা হাকিম জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সাথে পরামর্শ করলেন এবং আমাকে গ্রেফতার করা যায় কি না অনুমতি চাইলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিষেধ করে বলে দিলেন, তিনি একদিন পূর্বেই উপস্থিত হবেন এবং আমার সাথে আলাপ করবেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন মি. গোলাম কবির। তিনি খুবই বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ছিলেন, কলকাতা থেকে আমাকে চিনতেন। আমাকে তুমি বলে কথা বলতেন, আর আমিও কবির ভাই’ বলতাম। তিনি গোপালগঞ্জে এসেই আমাকে খবর দিলেন। তাঁর সাথে দেখা করতে যেয়ে দেখি, জেলার পুলিশ সুপারিনটেনডেন্টও উপস্থিত আছেন। আমি তাঁকে সকল বিষয় বললাম এবং আমাদের দাবিগুলি পেশ করলাম। তিনি আমাকে বললেন, “গভর্নর জেনারেল রাজনীতিবিদ নন, তিনি রাষ্ট্রপ্রধান। কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সাথেও জড়িত নন। তিনি তো অতিথি, তাকে অসম্মান করা কি উচিত হবে? আমি বললাম, “কে বলেছে আপনাকে, যে তাকে অসম্মান করতে চাই! তাঁকে সকলেই অভ্যর্থনা করবে, শুধু এটুকু কথা তাঁর সাথে আলোচনা করে আমাকে জানিয়ে দেন যে, তিনি হুকুম দিবেন এই অত্যাচার করে টাকা তোলার ব্যাপারে তদন্ত করবেন এবং দোষীকে শাস্তি দিবেন। দ্বিতীয়ত, টাকা তাঁকেই দেওয়া হবে, আমরা কোনো দাবি করব না; শুধু তিনি টাকাটা কলেজ করতে দিয়ে দেবেন। তিনিই আমাদের কলেজ করে দিবেন।” কবির সাহেব আমাকে বললেন, “তুমি কথা দাও, কোনো গোলমাল হবে না।” আমি বললাম, “কবির ভাই, আপনি পাগল হয়েছেন। আমি জানি না যে, তিনি প্রধানমন্ত্রী নন, এখন বড়লাট হয়েছেন। কোনো গোলমাল হবে না, আমাদের পক্ষ থেকে। আপনি তার সাথে পরামর্শ করে আমাকে জানিয়ে দিবেন সকাল দশটার মধ্যে, যাতে সকলে মিলে ভালভাবে তাঁকে অভ্যর্থনা করতে পারা যায়।”

পরের দিন সকালবেলা খাজা সাহেবের বজরা গোপালগঞ্জ এল এগারটার সময়। আমাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হল তার বজরায়। খাজা সাহেব পাশের রুমে বসেছিলেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কবির সাহেব তার পক্ষ থেকে আমাকে বললেন, আমার দাবিগুলি ন্যায়সঙ্গত। তিনি নিশ্চয়ই বিবেচনা করে দেখবেন। গোপালগঞ্জ শহরে কলেজ নাই। একটা কলেজ হওয়া দরকার, তিনি স্বীকার করলেন।

এর মধ্যে আর একটা ঘটনা হয়ে গেল। জনসাধারণ মনে করেছে আমাকে গ্রেফতার করে নিয়া গিয়েছে, কারণ পুলিশ কর্মচারী তার সরকারি কাপড় পরে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। কর্মীরা স্লোগান দিতে শুরু করে এবং পুলিশ কর্ডন ভেঙে অগ্রসর হতে থাকে। পুলিশ লাঠিচার্জ করে বসেছে, ভীষণ গোলমাল শুরু হয়েছে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে খবর দিল, আমাকে ঘটনাস্থলে পাঠাতে। আমি দৌড়াতে দৌড়াতে সেখানে উপস্থিত হলাম এবং সকলকে বললাম, “আমাকে গ্রেফতার করে নাই। খাজা সাহেব আমাদের দাবিগুলি বিশেষভাবে বিবেচনা করে দেখবেন।” আমি খাজা সাহেবকে দাওয়ালদের অসুবিধার কথা বলবার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটকে অনুরোধ করেছিলাম। কবির সাহেব নিজেও খুব চিন্তিত ছিলেন দাওয়ালদের ব্যাপার নিয়ে। কারণ ফরিদপুরে যে দুর্ভিক্ষ হবে সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ ছিল না।

বিরাট সভা হল, সকলেই গভর্নর জেনারেলকে অভ্যর্থনা করলেন। তিনি মসজিদটার দ্বার উদ্ঘাটনও করেছিলেন। খাজা সাহেব তদন্ত করেছেন কি না জানি না, তবে টাকা তিনি নেন নাই। কলেজ করার জন্য দিয়ে গিয়েছিলেন। জিন্নাহ ফান্ডের নামে টাকা তোলা হয়েছিল বলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নামেই কলেজ করা হয়েছিল। আজও কলেজটা আছে, ভালভাবে চলছে।

 

৩৫.

দিনটা আমার ঠিক মনে নাই। তবে ঘটনাটা মনে আছে ১৯৪৮ সালের ভিতর হবে। সোহরাওয়ার্দী সাহেব ঢাকায় এসেছিলেন এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে এক ছাত্রসভায় বক্তৃতা করেছিলেন। তখন ময়মনসিংহের সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব সহ-সভাপতি ছিলেন হলের (এখন সৈয়দ নজরুল সাহেব পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। আমি জেলে থাকার জন্য ভারপ্রাপ্ত সভাপতি)। শহীদ সাহেবের বক্ততা এত ভাল হয়েছিল যে, যারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করতেন তারাও ভক্ত হয়ে পড়লেন। এদিকে মন্ত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় বা হলের কাছেও যেতে পারতেন না। শহীদ সাহেব যখন পরে আবার ঢাকায় আসলেন, তখন কতগুলি সভার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল যাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কায়েম থাকে। প্রথম সভার জায়গা ঠিক হল টাঙ্গাইল। স্টিমারে মানিকগঞ্জ হয়ে যেতে হবে, পথে আরও একটা সভা হবে। শামসুল হক সাহেব সভার বন্দোবস্ত করেছিলেন। শহীদ সাহেব প্লেন থেকে ঢাকায় নেমে সোজা বেগম আনোয়ারা খাতুন এমএলএ ছিলেন, তাঁর বাড়িতে আসলেন। সেখানেই দুপুরবেলা খেলেন। সন্ধ্যায় বাদামতলী ঘাট থেকে জাহাজ ছাড়বে। মওলানা ভাসানী ও আমি সাথে যাব। আমরা শহীদ সাহেবকে নিয়ে জাহাজে উঠলাম। মওলানা সাহেবও উঠেছিলেন। জাহাজ ছয়টায় ছাড়বার কথা, ছাড়ছে না। খবর নিয়ে জানলাম, সরকার হুকুম দিয়েছে না ছাড়তে। প্রায় দুই ঘন্টা জাহাজ ঘাটে বসে রইল। কাদের সর্দার, জনাব কামরুদ্দিন সাহেবও উপস্থিত ছিলেন। রাত আটটায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও ডিআইজি পুলিশ শহীদ সাহেবের হাতে একটা কাগজ দিলেন, তাতে লেখা, তিনি ঢাকা ত্যাগ করতে পারবেন না। তবে যদি কলকাতা ফিরে যান, সরকারের আপত্তি নাই। তিনি ঢাকায় যে কোনো জায়গায় থাকতে পারেন তাতেও আপত্তি নাই। শহীদ সাহেব জাহাজ ছেড়ে নেমে আসলেন, আমিও তার মালপত্র নিয়ে সাথে সাথে এলাম। কোথায় থাকবেন? আর কেইবা জায়গা দেবেন? কোন হোটেলও নাই। বেগম আনোয়ারার সাহস আছে, কিন্তু তাঁদের বাড়িটায় জায়গা নাই। আতাউর রহমান, কামরুদ্দিন সাহেবের বাড়িরও সেই অবস্থা। কামরুদ্দিন সাহেব ক্যাপ্টেন শাহজাহান ও তার স্ত্রী বেগম নূরজাহানের সাথে সাক্ষাৎ করলেন, কারণ তাদের বাড়িটা সুন্দর এবং থাকার মত ব্যবস্থাও আছে। বেগম নূরজাহান (এখন প্রফেসর) বললেন “এ তো আমাদের সৌভাগ্য। শহীদ সাহেবকে আমি বাবার মত ভক্তি করি। আমাদের বাড়িতেই থাকবেন তিনি, নিয়ে আসুন।” সেইদিন এই উপকার বেগম নূরজাহান না করলে সত্যিই দুঃখের কারণ হত। পাকিস্তান সত্যিকারের যিনি সৃষ্টি করেছিলেন, সেই লোকের থাকার জায়গা হল না। দুই দিন শহীদ সাহেব ছিলেন তার বাসায়, কি সেবাই না ভদ্রমহিলা করেছিলেন, তা প্রকাশ করা কষ্টকর। মেয়েও বোধহয় বাবাকে এত সেবা বস্মতে পারে না। ক্যাপ্টেন শাহজাহানও যথেষ্ট করেছেন। দুই দিন পরে শহীদ সাহেবকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জে জাহাজে তুলে দিলাম। আমি সাথে যেতে চেয়েছিলাম এগিয়ে দিতে। তিনি রাজি হলেন না। বললেন, “দরকার নাই। আর লোকজনও আছে আমার অসুবিধা হবে না।” আমি বিছানা করে সকল কিছু গুছিয়ে দিয়ে বিদায় নিতে গেলে বললেন, “তোমার উপরও অত্যাচার আসছে। এরা পাগল হয়ে গেছে। শাসন যদি এইভাবে চলে বলা যায় না, কি হবে!” আমি বললাম, “স্যার, চিন্তা করবেন না, অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার শক্তি খোদা আমাকে দিয়েছেন। আর সে শিক্ষা আপনার কাছ থেকেই পেয়েছি।”

এই অত্যাচারের প্রতিবাদ করার মত ক্ষমতা তখন আমাদের ছিল না। আর আমরা প্রস্তুতও ছিলাম না। ছাত্ররা সামান্য প্রতিবাদ করেছিল। নেতৃত্ব দেওয়ার মত কেউ আমাদের ছিল না। আমরা যদি ঝাঁপিয়ে পড়তে পারতাম, নিশ্চয়ই সাড়া পেতাম। জনসাধারণ শহীদ সাহেবকে ভালবাসতেন। আমরা কয়েকজন প্রস্তাব করলে ঢাকার পুরানা নেতারা নিষেধ করলেন। আমরা ঢাকায় নতুন এসেছি, পরিচিত হতেও পারি নাই ভালভাবে। মওলানা ভাসানী ঐ জাহাজেই চলে গেলেন এবং সভায় যোগদান করেছিলেন। ঐদিন যদি শামসুল হক সাহেব ঢাকায় থাকতেন তবে আন্দোলন আমরা করতে পারতাম বলে আমার বিশ্বাস ছিল।

১৯৪৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মৃত্যুবরণ করেন এবং খাজা নাজিমুদ্দীনকে গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেন জনাব নূরুল আমিন সাহেব। এই সময়ও কিছু সংখ্যক এমএলএ শহীদ সাহেবকে পূর্ব বাংলায় এসে প্রধানমন্ত্রী হতে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি রাজি হন নাই। গণপরিষদে একটা নতুন আইন পাস করে শহীদ সাহেবকে গণপরিষদ থেকে বের করে দেওয়া হল।।

 

৩৬.

আমি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ সংগঠনের দিকে নজর দিলাম। প্রায় সকল কলেজ ও স্কুলে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠল। বিভিন্ন জেলায়ও শক্তিশালী সংগঠন গড়ে উঠতে লাগল। সরকারি ছাত্র প্রতিষ্ঠানটি শুধু খবরের কাগজের মধ্যে বেঁচে রইল। ছাত্রলীগই সরকারের অন্যায় কাজের প্রতিবাদ ও সমালোচনা করেছিল। কোন বিরুদ্ধ দল পাকিস্তানে না থাকায় সরকার গণতন্ত্রের পথ ছেড়ে একনায়কত্বের দিকে চলছিল। প্রধানমন্ত্রী জনাব লিয়াকত আলী খান সর্বময় ক্ষমতার মালিক হলেন। তিনি কোনো সমালোচনাই সহ্য করতে পারছিলেন না।

দুই চারজন কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন ছাত্র ছিল যারা সরকারকে পছন্দ করত না। কিন্তু তারা এমন সমস্ত আদর্শ প্রচার করতে চেষ্টা করত যা তখনকার সাধারণ ছাত্র ও জনসাধারণ শুনলে ক্ষেপে যেত। এদের আমি বলতাম, “জনসাধারণ চলেছে পায়ে হেঁটে, আর আপনারা আদর্শ নিয়ে উড়োজাহাজে চলছেন। জনসাধারণ আপনাদের কথা বুঝতেও পারবে না, আর সাথেও চলবে না। যতটুকু হজম করতে পারে ততটুকু জনসাধারণের কাছে পেশ করা উচিত।” তারা তলে তলে আমার বিরুদ্ধাচরণও করত, কিন্তু ছাত্রসমাজকে দলে ভেড়াতে পারত না।

এই সময় রাজশাহী সরকারি কলেজে ছাত্রদের উপর খুব অত্যাচার হল। এরা প্রায় সকলেই ছাত্রলীগের সভ্য ছিল। একুশজন ছাত্রকে কলেজ থেকে বের করে দিল এবং রাজশাহী জেলা ত্যাগ করার জন্য সরকার হুকুম দিল। অনেক জেলায় ছাত্রদের উপর অত্যাচার শুরু হয়েছিল এবং গ্রেফতারও করা হয়েছিল। ১৯৪৯ সালে জানুয়ারি অথবা ফেব্রুয়ারি মাসে দিনাজপুরেও ছাত্রদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। জেলের ভিতর দবিরুল ইসলামকে ভীষণভাবে মারপিট করেছিল—যার ফলে জীবনের তরে তার স্বাস্থ্য নষ্ট হয়েছিল। ছাত্ররা আমাকে কনভেনর করে জুলুম প্রতিরোধ দিবস’ পালন করার জন্য একটা কমিটি করেছিল। একটা দিবস ঘোষণা করা হয়েছিল। পূর্ব বাংলার সমস্ত জেলায় জেলায় এই দিবসটি উদযাপন করা হয়। কমিটির পক্ষ থেকে ছাত্রবন্দিদের ও অন্যান্য বন্দিদের মুক্তি দাবি করা হয় এবং ছাত্রদের উপর হতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহার করতে অনুরোধ করা হয়।

এই প্রথম পাকিস্তানে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির আন্দোলন এবং জুলুমের প্রতিবাদ। এর পূর্বে আর কেউ সাহস পায় নাই। তখনকার দিনে আমরা কোনো সভা বা শোভাযাত্রা করতে গেলে একদল গুণ্ডা ভাড়া করে আমাদের মারপিট করা হত এবং সভা ভাঙার চেষ্টা করা হত। ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবসে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়ও কিছু গুণ্ডা আমদানি করা হয়েছিল। আমি খবর পেয়ে রাতেই সভা করি এবং বলে দেই, গুণ্ডামির প্রশ্রয় দেওয়া হলে এবার বাধা দিতে হবে। আমাদের বিখ্যাত আমতলায় সভা করার কথা ছিল; কর্তৃপক্ষ বাধা দিলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের মাঠে মিটিং করলাম। একদল ভাল কর্মী প্রস্তুত করে বিশ্ববিদ্যালয় গেটে রেখেছিলাম, যদি গুণ্ডারা আক্রমণ করে তারা বাধা দিবে এবং তিন দিক থেকে তাদের আক্রমণ করা হবে যাতে জীবনে আর রমনা এলাকায় গুণ্ডামি করতে না আসে—এই শিক্ষা দিতে হবে। আশ্চর্যের বিষয় সরকারি দল প্রকাশ্যে গুণ্ডাদের সাহায্য করত ও প্রশ্রয় দিত। মাঝে মাঝে জগন্নাথ কলেজ, মিটফোর্ড ও মেডিকেল স্কুলের ছাত্ররা শোভাযাত্রা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে রওয়ানা করলেই হঠাৎ আক্রমণ করে মারপিট করত। মুসলিম লীগ নেতারা একটা ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করতে চেষ্টা করছিল যাতে কেউ সরকারের সমালোচনা করতে না পারে। মুসলিম লীগ নেতারা বুঝতে পারছিলেন না, যে পন্থা তারা অবলম্বন করেছিলেন সেই পন্থাই তাদের উপর একদিন ফিরে আসতে বাধ্য। ওনারা ভেবেছিলেন গুণ্ডা দিয়ে মারপিট করেই জনমত দাবাতে পারবেন। এ পন্থা যে কোনোদিন সফল হয় নাই, আর হতে পারে না—এ শিক্ষা তারা ইতিহাস পড়ে শিখতে চেষ্টা করেন নাই।

 

৩৭.

এই সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার নবীনগর থানার কৃষ্ণনগরে জনাব রফিকুল হোসেন এক সভার আয়োজন করেন—কৃষ্ণনগর হাইস্কুলের দ্বারোদঘাটন করার জন্য। আর্থিক সাহায্য পাওয়ার জন্য জনাব এম, এম, খান সিএসপি তখনকার ফুড ডিপার্টমেন্টের ডাইরেক্টর জেনারেল ছিলেন, তাঁকেই নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল, তিনি রাজিও হয়েছিলেন। সেখানে বিখ্যাত গায়ক আব্বাসউদ্দিন আহম্মদ, সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন আহম্মদ গান গাইবেন। আমাকেও নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। জনাব এন, এম, খান পাকিস্তান হওয়ার পূর্বে এই মহকুমায় এসডিও হিসাবে অনেক ভাল কাজ করার জন্য জনপ্রিয় ছিলেন। আমরা উপস্থিত হয়ে দেখলাম এন, এম. খান ও আব্বাসউদ্দিন সাহেবকে দেখবার জন্য হাজার হাজার লোক সমাগম হয়েছে। বাংলার গ্রামে গ্রামে আব্বাসউদ্দিন সাহেব জনপ্রিয় ছিলেন। জনসাধারণ তাঁর গান শুনবার জন্য পাগল হয়ে যেত। তার গান ছিল বাংলার জনগণের প্রাণের গান। বাংলার মাটির সাথে ছিল তাঁর নাড়ির সম্বন্ধ। দুঃখের বিষয়, সরকারের প্রচার দপ্তরে তাঁর মত গুণী লোকের চাকরি করে জীবিকা অর্জন করতে হয়েছিল। সভা শুরু হল, রফিকুল হোসেন সাহেবের অনুরোধে আমাকেও বক্তৃতা করতে হল। আমি জনাব এন. এম, ধানকে সম্বােধন করে বক্তৃতায় বলেছিলাম, আপনি এদেশের অবস্থা জানেন। বহুদিন বাংলাদেশে কাজ করেছেন, আজ ফুড ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর জেনারেল আপনি, একবার বিবেচনা করে দেখেন এই দাওয়ালদের অবস্থা এবং কি করে এরা বাঁচবে! সরকার তো বাবার দিতে পারবে না—যখন পারবে না, তখন এদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিতেছে কেন?” দাওয়ালদের নানা অসুবিধার কথা বললাম, জনসাধারণকে অনুরোধ করলাম, স্কুলকে সাহায্য করতে। জনাব খান আশ্বাস দিলেন তিনি দেখবেন, কিছু করতে চেষ্টা করবেন। তিনি সন্ধ্যায় চলে যাবার পর গানের আসর বসল। আব্বাসউদ্দিন সাহেব, সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন সাহেব গান গাইলেন। অধিক রাত পর্যন্ত আসর চলল। আব্বাসউদ্দিন সাহেব ও আমরা রাতে রফিক সাহেবের বাড়িতে রইলাম। রফিক সাহেবের ভাইরাও সকলেই ভাল গায়ক। হাসনাত, বরকতও ভাল গানই গাইত। এরা আমার ছোট ভাইয়ের মত ছিল। আমার সাথে জেলও খেটেছে। পরের দিন নৌকায় আমরা রওয়ানা করলাম, আশুগঞ্জ স্টেশনে ট্রেন ধরতে। পথে পথে গান চলল। নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তার নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে পাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে। তারই শিষ্য সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন তার নাম কিছুটা রেখেছিলেন। আমি আব্বাসউদ্দিন সাহেবের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, “মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।“ আমি কথা দিয়েছিলাম এবং কথা রাখতে চেষ্টা করেছিলাম।

 

৩৮.

আমরা রাতে ঢাকা এসে পৌঁছালাম। ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে যেয়ে শুনলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভোগী কর্মচারীরা ধর্মঘট শুরু করেছে এবং ছাত্ররা তার সমর্থনে ধর্মঘট করছে। নিম্ন বেতনভোগী কর্মচারীরা বহুদিন পর্যন্ত তাদের দাবি পূরণের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন-নিবেদন করেছে একথা আমার জানা ছিল। এরা আমার কাছেও এসেছিল। পাকিস্তান হওয়ার পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রেসিডেন্সিয়াল বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। এখন এটাই পূর্ব বাংলার একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্র অনেক বেড়ে গিয়েছিল। কর্মচারীদের সংখ্যা বাড়ে নাই। তাদের সারা দিন ডিউটি করতে হয়। পূর্বে বাসা ছিল, এখন তাদের বাসা প্রায়ই নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কারণ নতুন রাজধানী হয়েছে, ঘরবাড়ির অভাব। এরা পোশাক পেত, পাকিস্তান হওয়ার পরে কাউকেও পোশাক দেওয়া হয় নাই। চাউলের দাম ও অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। চাকরির কোনো নিশ্চয়তাও ছিল না। ইচ্ছামত তাড়িয়ে দিত, ইচ্ছামত চাকরি দিত।

আমি তাদের বলেছিলাম, প্রথমে সংঘবদ্ধ হোন, তারপর দাবিদাওয়া পেশ করেন, তা নাহলে কর্তৃপক্ষ মানবে না। তারা একটা ইউনিয়ন করেছিল, একজন ছাত্র তাদের সভাপতি হয়েছিল। আমি আর কিছুই জানতাম না। জেলায় জেলায় ঘুরছিলাম। ঢাকায় এসে যখন শুনলাম, এরা ধর্মঘট করেছে তখন বুঝতে বাকি থাকল না, কর্তৃপক্ষ এদের দাবি মানতে অস্বীকার করেছে। তবু এত তাড়াতাড়ি ধর্মঘটে যাওয়া উচিত হয় নাই। কারণ, এদের কোনো ফান্ড নাই। মাত্র কয়েকদিন হল প্রতিষ্ঠান করেছে। কিন্তু কি করব, এখন আর উপায় নাই। সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম, ছাত্ররা এদের প্রতি সহানুভূতিতে ধর্মঘট শুরু করে দিয়েছে। কর্মচারীরা শোভাযাত্রা বের করেছিল। ছাত্ররাও করেছিল। আমি কয়েকজন ছাত্রনেতাকে নিয়ে ভাইস-চ্যান্সেলর সাহেবের কাছে দেখা করতে যেয়ে তাকে সব বুঝিয়ে বললাম। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সকল কর্মচারীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দেবেন ঠিক করেছেন। বিকেলে আবার ফজলুল হক হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ভিপিদের নিয়ে সাক্ষাৎ করলাম এবং তাকে অনুরোধ করলাম, এই কথা বলে যে, “আপনি আশ্বাস দেন, ওদের ন্যায্য দাবি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আদায় করে দিতে চেষ্টা করবেন এবং কাউকেও চাকরি থেকে বরখাস্ত করবেন না এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কারও বিরুদ্ধে গ্রহণ করবেন না।“ অনেক আলোচনা হয়েছিল, পরের দিন তিনি রাজি হলেন। আমাদের বললেন, “আগামীকাল ধর্মঘট প্রত্যাহার করে চাকরিতে যোগদান করলে কাউকেও কিছু বলা হবে না এবং আমি কর্তৃপক্ষের কাছে ওদের ন্যায্য দাবি মানাতে চেষ্টা করব।”

আমরা তার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এলাম, তখন বিকাল তিনটা বেজে গিয়েছে। আমরা ওদের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করে ঘোষণা করলাম, কাল থেকে ছাত্ররা ধর্মঘট প্রত্যাহার করবে। কারণ বহু কর্মচারীও ধর্মঘট প্রত্যাহার করবে; ভাইস-চ্যান্সেলরের আশ্বাস পেয়ে তারা রাজি হয়েছে। অনেক কর্মচারী দূরে দূরে থাকে, সকলকে খবর দিতে বললাম, যতদূর সম্ভব। পরের দিন ছাত্ররাও ক্লাসে যোগদান করেছে; কর্মচারীরাও অনেকেই যোগদান করেছে। যারা বারটার মধ্যে এসে পৌঁছাতে পেরেছে তাদের কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেছে। আর যারা বারটার পরে এসেছে তাদের যোগদান করতে দেওয়া হয় নাই। অনেককে খবর পেয়ে নারায়ণগঞ্জ থেকেও আসতে হয়েছিল। শতকরা পঞ্চাশজন কর্মচারী দেরি করে আসতে বাধ্য হয়েছিল, কারণ বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর দিয়ে তাদের আনাতে হয়েছিল। আমাকে ও আমার সহকর্মীদের কাছে কর্মচারীরা এসে সব কথা খুলে বলল। একে একে আবার সকলে জড়ো হল। আমরা মিথ্যেবাদী হয়ে যাবার উপক্রম হলাম। সকলকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রেখে আবার আমরা ভাইস-চ্যান্সেলারের বাড়িতে উপস্থিত হলাম এবং বললাম, “কি ব্যাপার?” তিনি বললেন, “আমি যখন আগামীকাল কাজে যোগদান করতে বলেছি, তার অর্থ এগারটায় যোগদান করতে হবে, এক মিনিট দেরি হয়ে গেলে তাকে নেওয়া হবে না। আমরা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, তিনি বুঝেও বুঝলেন না। এর কারণ ছিল সরকারের চাপ। আমরা বললাম, সামান্য দু’এক ঘণ্টার জন্য কেন গোলমাল সৃষ্টি করলেন? তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না, আমরা তাঁকে আরও বললাম, “আপনি পূর্বেই তো বলতে পারতেন, এগারটার মধ্যেই যোগদান করতে হবে। আপনি তো বলেছিলেন, আগামীকালের মধ্যে যোগদান করতে চলবে।” তিনি আর আলোচনা করতে চাইলেন না। আমরা বলে এলাম, তাহলে ধর্মঘটও চলবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ছাত্র-কর্মচারীদের যুক্ত সভা হল। সভায় আমি সমস্ত ঘটনা বললাম এবং আগামীকাল থেকে ছাত্র-কর্মচারীদের ধর্মঘট চলবে, যে পর্যন্ত না এদের ন্যায্য দাবি মানে। শোভাযাত্রা হল, আবার পরের দিন সকাল এগারটায় শোভাযাত্রা শুরু হবে বলে ঘোষণা করা হল। এবার আমাকে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হল। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধার ও শিক্ষাবিদ সরকারের চাপে এই রকম একটা কথার মারপ্যাচ করতে পারে এটা আমার ভাবতেও কষ্ট হয়েছিল। রাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সভার পরে ঘোষণা করল, “বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করা হল। হল থেকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চলে যেতে হবে। আর যে সমস্ত কর্মচারী ধর্মঘটে যোগদান করেছে তাদের বরখাস্ত করা হল।” আমি সলিমুল্লাহ হলে ছিলাম। সেই মুহুর্তেই সভা ডাকা হল এবং সভায় ঘোষণা করা হল, হল ত্যাগ করা হবে না। ফজলুল হক হলেও সন্ধ্যায় এই ঘোষণা করা হয়। একটা কমিটি করা হয়েছিল, কর্মচারীদের জন্য একটা ফান্ড করা হবে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে টাকা তুলে সাহায্য করা হবে। কারণ, এদের প্রায় সকলেই বিশ-ত্রিশ টাকার বেশি বেতন পেত না। সংসার চালাবে কি করে? এদের মধ্যে কয়েকজনকে টাকা তোলার ভার দেওয়া হয়েছিল।

পরদিন দেখা গেল শতকরা পঞ্চাশজন ছাত্র রাতে হল ত্যাগ করে চলে গিয়েছে। তার পরদিন আরও অনেকে চলে গেল। তিন দিন পর দেখা গেল আমরা ত্রিশ-পঁয়ত্রিশজন সলিমুল্লাহ হলে আছি আর বিশ-পঁচিশজন ফজলুল হক হলে আছে। পুলিশ হল ঘেরাও করে রেখেছে। এক কামরায় আলোচনা সভায় বসলাম। আমাদের পক্ষে আর পুলিশকে বাধা দেওয়া সম্ভব হবে না। সকলে একমত হয়ে ঠিক হল, হল ত্যাগ করার এবং নিম্ন কর্মচারীদের জন্য টাকা তুলে সাহায্য করা, তা না হলে তারাও ধর্মঘট চালাতে পারবে না। চার দিন পরে আমরাও হল ত্যাগ করতে বাধ্য হলাম এবং চাঁদা তুলে এদের সাহায্য করতে লাগলাম। দশ-পনের দিন পর দেখা গেল এক একজন করে কর্মচারী বন্ড দিয়ে কাজে যোগদান করতে শুরু করেছে। এক মাসের মধ্যে প্রায় সকলেই যোগদান করল। ধর্মঘট শেষ হয়ে গেল। এই সময় আমি ও কয়েকজন কর্মী দিনাজপুর যাই। কারণ, কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করে জেলে রেখেছে এবং দবিরুল ইসলামকে জেলের ভিতর মারপিট করেছে। ১৪৪ ধারা জারি ছিল। বাইরে সভা করতে পারলাম না। ঘরের ভিতর সভা করলাম। আমরা হোস্টেলেই ছিলাম। আবদুর রহমান চৌধুরী তখন ছাত্রলীগের সেক্রেটারি ছিল। আমরা যখন ঢাকা ফিরে আসছিলাম বোধহয় আবদুল হামিদ চৌধুরী আমার সাথে ছিল। ট্রেনের মধ্যে খবরের কাগজে দেখলাম, আমাদেরসহ সাতাশজন ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করেছে। এর মধ্যে দিনাজপুরের দবিরুল ইসলাম, অলি আহাদ, মোল্লা জালালউদ্দিন (এখন এভভভাকেট), আবদুল হামিদ চৌধুরীকে চার বৎসরের জন্য আর অন্য সকলকে বিভিন্ন মেয়াদে। তবে এই চারজন ছাড়া আর সকলে বন্ড ও জরিমানা দিলে লেখাপড়া করতে পারবে। মেয়েদের মধ্যে একমাত্র লুলু বিলকিস বানুকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তিনি ছাত্রলীগের মহিলা শাখার কনভেনর ছিলেন। এক মাসের মধ্যে প্রায় সকল কর্মচারীই গোপনে গোপনে কাজে যোগদান করল। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, ছাত্ররা নাই। এই সুযোগে কর্তৃপক্ষ নিম্ন বেতনভোগী কর্মচারীদের মনোবল ভাঙতে সক্ষম হয়েছিল।

 

৩৯.

এই সময় বাইরে পুরানা লীগ কর্মী ও নেতারা আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে কি করা যাবে? একটা নতুন দল গঠন করা উচিত হবে কি না? আমার মত সকলকে বললাম, শুধুমাত্র ছাত্র প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করে রাজনীতি করা যায় না। সরকারি মুসলিম লীগ ছাড়া কংগ্রেসেরও একটা প্রতিষ্ঠান ছিল। তবে গণপরিষদে ও পূর্ব বাংলার আইনসভায় এদের কয়েকজন সভ্য ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এদের সকলেই হিন্দু, এরা বেশি কিছু বললেই রাষ্ট্রদ্রোহী’ আখ্যা দেওয়া হত। ফলে এদের মনোবল একেবারে ভেঙে গিয়েছিল। সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামারও ভয় ছিল। কংগ্রেসকে মুসলমান সমাজ সন্দেহের চোখে দেখত। একজন মুসলমান সভ্যও তাদের ছিল না। এদিকে মুসলিম লীগের পুরানা নামকরা নেতারা সকলেই সরকার সমর্থক হয়ে গিয়েছিলেন। মন্ত্রিত্ব, পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি কিছু না কিছু অনেকের কপালেই জুটেছিল। নামকরা কোনো নেতাই আর ছিল না, যাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো যায়।

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তখন সদ্য আসাম থেকে চলে এসেছেন। তাঁকে পূর্ব বাংলার জনসাধারণ তেমন জানত না। শুধু ময়মনসিংহ, পাবনা ও রংপুরের কিছু কিছু লোক তার নাম জানত। কারণ তিনি আসামেই কাটিয়েছেন। তবে শিক্ষিত সমাজের কাছে কিছুটা পরিচিত ছিলেন। একজন মুসলিম লীগের নেতা হিসাবে তিনি আসামের বাঙ্গাল খেদা’ আন্দোলনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এবং জেলও খেটেছিলেন। টাঙ্গাইলের লোকেরা তাকে খুব ভালবাসত। শামসুল হক সাহেব তাকে ভালভাবে জানতেন। কারণ, হক সাহেবের বাড়িও সেখানে। তিনি মওলানা সাহেবের সাথে পাকাপাকি আলোচনা করবেন ঠিক হল। পূর্বেও তিনি পুরানা মুসলিম লীগ কর্মীদের সভায় যোগদান করেছিলেন। কিছুদিনের জন্য তিনি আসাম গিয়েছিলেন। ফিরে আসলেই আমরা কর্মিসভা করে একটা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করব ঠিক হল। সীমান্ত প্রদেশের পীর মনকী শরীফ একটা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। তার নাম দিয়েছেন, আওয়ামী মুসলিম লীগ। সীমান্ত প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী খান আবদুল কাইয়ুম খান মুসলিম লীগ থেকে পুরানা কর্মীদের বাদ দিয়েছেন এবং অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়ে দিয়েছেন। অনেক লীগ কর্মীকে জেলে দিতেও দ্বিধাবোধ করেন নাই। এখন তিনি সীমান্ত শার্দুল’ বনে গিয়েছেন। পাকিস্তান আন্দোলনে সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গাফফার খান ও ডাক্তার খান সাহেবের মোকাবেলা করতে পারেন নাই। ফলে সীমান্ত প্রদেশে কংগ্রেস সরকার গঠন হয়। একমাত্র পীর মানকী শরীফই লাল কোর্তাদের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগকে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবু পীর সাহেবের জায়গাও মুসলিম লীগে হয় নাই। পীর মানকী শরীফ সভাপতি এবং খান গোলাম মোহাম্মদ খান লুথাের সাধারণ সম্পাদক হয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন।

 

৪০.

১৯৪৯ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে অথবা এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে টাঙ্গাইলে উপনির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। আমরা ঠিক করলাম, শামসুল হক সাহেবকে অনুরোধ করব মুসলিম লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়তে। শামসুল হক সাহেব শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন, কিন্তু টাকা পাওয়া যাবে কোথায়? হক সাহেবেরও টাকা নাই, আর আমাদেরও টাকা নাই। তবু যেই কথা সেই কাজ। শামসুল হক সাহেব টাঙ্গাইল চলে গেলেন, আমরা যে যা পারি জোগাড় করতে চেষ্টা করলাম। কয়েক শত টাকার বেশি জোগাড় করা সম্ভব হয়ে উঠল না। ছাত্র ও কর্মীরা ঘড়ি, কলম বিক্রি করেও কিছু টাকা দিয়েছিল।

এদিকে ছাত্রনেতাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর প্রতিবাদ করা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করেছে, ১৭ই এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে। ছাত্রলীগ ও অন্যান্য ছাত্র কর্মী—যারা ঢাকায় ছিল, ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে বসে এক সভা করে ঠিক করল যে, ১৭ তারিখ থেকে প্রতিবাদ দিবস পালন করা হবে। ছাত্ররা ধর্মঘট করবে যে পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ তাদের উপর থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহার না করে। কিছু সংখ্যক কর্মী টাঙ্গাইল রওয়ানা হয়ে গেল। বেশিরভাগ পুরানা লীগ কর্মী। মুসলিম লীগের মন্ত্রীরা ও এমএলএরা টাকা-পয়সা, গাড়ি, সকল কিছু নিয়েই টাঙ্গাইলে উপস্থিত হয়েছিল। মুসলিম লীগ প্রার্থী করটিয়ার বিখ্যাত জমিদার খুররম খান পন্নী—যার প্রজাই হল অধিকাংশ ভোটার। তার সাথে আছে সরকারি ক্ষমতা এবং অর্থবল। আমাদের প্রার্থী গরিব, কিন্তু নিঃস্বার্থ, ত্যাগী কর্মী; আর আছে আদর্শ ও কর্মক্ষমতা। তখন কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানও আমাদের পিছনে নাই। কর্মীরা পায়ে হেঁটে, না খেয়ে নির্বাচন শুরু করল। ঢাকায় ছাত্ররা ব্যস্ত ধর্মঘট নিয়ে। ঠিক হল সকলেই টাঙ্গাইল চলে যাবে, আমি ১৯ এপ্রিল টাঙ্গাইল পৌঁছাব।

১৬ এপ্রিল খবর পেলাম, ছাত্রলীগের কনভেনর নইমউদ্দিন আহমেদ, ছাত্রলীগের আরেক নেতা আবদুর রহমান চৌধুরী (এখন এডভোকেট)—ভিপি সলিমুল্লাহ হল, দেওয়ান মাহবুব আলী (এখন এডভোকেট) আরও অনেকে গোপনে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেয়ে বন্ড দিয়েছেন। যারা ছাত্রলীগের সভ্যও না, আবার নিজেদের প্রগতিবাদী বলে ঘোষণা করতেন, তাঁরাও অনেকে বন্ড দিয়েছেন। সাতাশজনের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই বন্ড দিয়ে দিয়েছে। কারণ ১৭ তারিখের মধ্যে বন্ড না দিলে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকবে না।

ছাত্রলীগের কনভেনর ও সলিমুল্লাহ হলের ডিপি বন্ড দিয়েছে খবর রটে যাওয়ার সাথে সাথে ছাত্রদের মনোবল একদম ভেঙে গিয়েছিল। আমি তাড়াতাড়ি কয়েকজনকে নিয়ে নইমউদ্দিনকে ধরতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু তাকে পাওয়া কষ্টকর, সে পালিয়ে গিয়েছিল। সে এক বাড়িতে লজিং থাকত। সন্ধ্যার কিছু পূর্বে তাকে ধরতে পারলাম। সে স্বীকার করল আর বলল, কি করব, উপায় নাই। আমার অনেক অসুবিধা। তার সাথে আমি অনেক রাগারাগি করলাম এবং ফিরে এসে নিজেই ছাত্রলীগের সভ্যদের খবর দিলাম, রাতে সভা করলাম। অনেকে উপস্থিত হল। সভা করে এদের বৃহিষ্কার করা হল এবং রাতের মধ্যে প্যামপ্লেট ছাপিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিলি করার বন্দোবস্ত করলাম। কাজী গোলাম মাহাবুবকে (এখন এডভোকেট) জয়েন্ট কনভেনর করা হয়েছিল। সে নিঃস্বার্থভাবে কাজ চালিয়েছিল।

তখন ভোরবেলায় আইন ক্লাস হত। আইন ক্লাসের ছাত্ররা ধর্মঘট করল। দশটায় পিকেটিং শুরু হল। ছাকমারা বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় শুয়ে পড়ল। একজন মাত্র ছাত্রী সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। তার নাম নাদেরা বেগম। প্রফেসর মুনীর চৌধুরীর ভগ্নি। নাদেরা একাই ছেলেদের সাথে দরজায় বসেছিল। মাত্র দশ-পনেরজন ছাত্র নিখিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সমর্থক। এই কয়েকজন বার বার ছাত্রদের উপর দিয়ে একবার ভিতরে একবার বাইরে যাওয়া-আসা করতে লাগল এবং এর মধ্যে একজন নাদেরাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিয়েছিল। সাধারণ ছাত্ররা এদের ওপর ক্ষেপে গেল। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম এবং সকলকে নিষেধ করলাম গোলমাল না করতে। আমি তাদের বললাম, “আপনারা ক্লাস করতে চান, ভিতরে যান, আমাদের আপত্তি নাই। তবে বার বার যাওয়াআসা করবেন না। আর আজেবাজে কথা বলবেন না।”

তারা আমার কথা না শুনে আবার বের হয়ে এল এবং ভিতরে ফিরে যেতে লাগল যারা পিকেটিং করছিল, তাদের উপর পা দিয়ে। আর আমি কিছু করতে পারলাম না, সাধারণ ছাত্র তখন অনেক জমা হয়েছে। তারা এদের আক্রমণ করে বসল। এরা পালিয়ে দোতলায় আশ্রয় নিল, যে যেখানে পারে। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে ক্রুদ্ধ ছাত্রদের বাধা দিলাম। যাহোক, ধর্মঘট হয়ে গেল। সভা হল, ধর্মঘট চলবে ঠিক হল। এ সময় ড. ওসমান গনি সাহেব সলিমুল্লাহ হলের প্রভোস্ট ছিলেন। তিনি এক্সিকিউটিভ কমিটি সভায় আমাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করতে অনুরোধ করলেন। তাঁকে সমর্থন করলেন, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম বী, কিন্তু কমিটির অন্যান্য সদস্য রাজি হলেন না। ১৮ তারিখে ধর্মঘট হয়েছিল, আবার ১৯ তারিখে ধর্মঘট হবে ঘোষণা করা হল। ছাত্রদের মধ্যে উৎসাহ কমে গেছে বলে আমার মনে হল। ১৮ তারিখ বিকালে ঠিক করলাম, ধর্মঘট করে বোধহয় কিছু করা যাবে না। তাই ১৮ তারিখে ছাত্র শোভাযাত্রা করে ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়িতে গেলাম এবং ঘোষণা করলাম, আমরা এখানেই থাকব, যে পর্যন্ত শাস্তিমূলক আদেশ প্রত্যাহার না করা হয়। একশজন করে ছাত্র রাতদিন ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়িতে বসে থাকবে। তাঁর বাড়ির নিচের ঘরগুলিও দখল করে নেওয়া হল। একদল যায়, আর একদল থাকে। ১৮ তারিখ রাত কেটে গেল, শুধু আমি জায়গা ত্যাগ করতে পারছিলাম না। কারণ শুনলাম, তিনি পুলিশ ডাকবেন। ১৯ তারিখ বিকাল তিনটায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, এসপি বিরাট একদল পুলিশ বাহিনী নিয়ে হাজির হলেন। আমি তাড়াতাড়ি সভা ডেকে একটা সংগ্রাম পরিষদ করতে বলে দিলাম। সকলের মত আমাকেও দরকার হলে গ্রেফতার হতে হবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পাঁচ মিনিট সময় দিলেন আমাদের স্থান ত্যাগ করে যেতে। আমি আটজন ছাত্রকে বললাম, তোমরা এই আটজন থাক, আর সকলেই চলে যাও। আমি ও এই আটজন স্থান ত্যাগ করব না। ছাত্র প্রতিনিধিদের ধারণা, আমি গ্রেফতার হলে আন্দোলন চলবে, কারণ আন্দোলন ঝিমিয়ে আসছিল। একে চাঙ্গা করতে হলে, আমার গ্রেফতার হওয়া দরকার। আমি তাদের কথা মেনে নিলাম। পাঁচ মিনিট পরে এসে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আমাদের গ্রেফতারের হুকুম দিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ (এখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) আটকা পড়েছে। তাকে নিষেধ করা হয়েছে গ্রেফতার না হতে। তাজউদ্দীন বুদ্ধিমানের মত কাজ করল। বলে দিল, “আমি প্রেস রিপোর্টার।” একটা কাগজ বের করে কে কে গ্রেফতার হল, তাদের নাম লিখতে শুরু করল। আমি তাকে চোখ টিপ মারলাম। আমাদের গাড়িতে তুলে একদম জেলগেটে নিয়ে আসল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *