২১-৩০. হাশিম সাহেব মুসলিম লীগের সভাপতি হতে চাইলেন

২১.

হাশিম সাহেব মুসলিম লীগের সভাপতি হতে চাইলেন। কারণ, মওলানা আকরম খাঁ সাহেব পদত্যাগ করেছিলেন। শহীদ সাহেব রাজি হন নাই। মওলানা সাহেবকে অনুরোধ করে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করিয়েছিলেন। হাশিম সাহেব রাগ করে লীগ সেক্রেটারি পদ থেকে ছুটি নিয়ে বর্ধমানে চলে গিয়েছিলেন। যখন তিনি কলকাতা আসতেন মিল্লাত প্রেসেই থাকতেন। হাশিম সাহেব এই সময় ছাত্র ও যুবকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অনেক হারিয়ে ফেলেছিলেন। আমাদের অনেকেরই মোহ তার উপর থেকে ছুটে গিয়েছিল।

সে অনেক কথা। তিনি কলকাতা আসলেই শহীদ সাহেবের বিরুদ্ধে সমালোচনা করতেন। এর প্রধান কারণ ছিল মিল্লাত কাগজকে দৈনিক করতে সাহায্য না করে তিনি দৈনিক ইত্তেহাদ কাগজ বের করেছিলেন—নবাবজাদা হাসান আলী সাহেবের ব্যবস্থাপনা এবং আবুল মনসুর আহমদ সাহেবের সম্পাদনায়। মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের দৈনিক আজাদও ক্ষেপে গিয়েছিল শহীদ সাহেবের উপর। কারণ, পূর্বে একমাত্র আজাদ ছিল মুসলমানদের দৈনিক। এখন আর একটা কাগজ বের হওয়াতে মওলানা সাহেব যতটা নন তার দলবল খুব বেশি রাগ করেছিল।

১৯৪৬ সালের শেষের দিকে ভারতের রাজনীতিতে এক জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার বদ্ধপরিকর, যে কোনোমতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে। ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব মুসলিম লীগ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু কংগ্রেস প্রথমে গ্রহণ করে পরে পিছিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও কংগ্রেসকে নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে বড়লাট লর্ড ওয়েভেল ঘোষণা করলেন। লর্ড ওয়েভেল মুসলিম লীগের সাথে ভাল ব্যবহার না করায়, মুসলিম লীগ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগদান করতে অস্বীকার করে। কংগ্রেস পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে সরকারে যোগদান করে। যদিও লর্ড ওয়েভেল ঘোষণা করেছিলেন, মুসলিম লীগের জন্য পাঁচটা মন্ত্রিত্বের পদ খালি রইল, ইচ্ছা করলে তারা যে কোন মুহূর্তে যোগদান করতে পারে। সরকারে যোগদান না করে একটু অসুবিধায় পড়েছিল মুসলিম লীগ। শেষ পর্যন্ত জনাব সোহরাওয়ার্দী লর্ড ওয়েভেলের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং মুসলিম লীগ যাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগদান করতে পারে সেই সম্বন্ধে আলোচনা করেন। মি. জিন্নাহ তাকে অনুমতি দিয়েছিলেন আলোচনা চালাতে। শেষ পর্যন্ত জিন্নাহ-ওয়েভেল আলোচনা করে মুসলিম লীগ সরকারে যোগদান করতে রাজি হয়। অক্টোবর মাসের শেষের দিকে লিয়াকত আলী খান, আই আই চুন্দ্রিগড়, আবদুর রব নিশতার, রাজা গজনফর আলী খান এবং যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল মুসলিম লীগের তরফ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন ভারত সরকারে যোগদান করেন। মুসলিম লীগ যদি কেন্দ্রীয় সরকারে যোগদান না করত তবে কংগ্রেস কিছুতেই পাকিস্তান দাবি মানতে চাইত না।

১৯৪৭ সালের জুন মাসে ঘোষণা করা হল ভারতবর্ষ ভাগ হবে। কংগ্রেস ভারতবর্ষকে ভাগ করতে রাজি হয়েছে এই জন্য যে, বাংলাদেশ ও পাঞ্জাব ভাগ হবে। আসামের সিলেট জেলা ছাড়া আর কিছুই পাকিস্তানে আসবে না। বাংলাদেশের কলকাতা এবং তার আশপাশের জেলাগুলিও ভারতবর্ষে থাকবে। মওলানা আকরম খাঁ সাহেব ও মুসলিম লীগ নেতারা বাংলাদেশ ভাগ করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করলেন। বর্ধমান ডিভিশন আমরা না-ও পেতে পারি। কলকাতা কেন পাব না? কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা বাংলাদেশ ভাগ করতে হবে বলে জনমত সৃষ্টি করতে শুরু করল। আমরাও বাংলাদেশ ভাগ হতে দেব না, এর জন্য সভা করতে শুরু করলাম। আমরা কর্মীরা কি জানতাম যে, কেন্দ্রীয় কংগ্রেস ও কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ মেনে নিয়েছে এই ভাগের ফলা? বাংলাদেশ যে ভাগ হবে, বাংলাদেশের নেতারা তা জানতেন না। সমস্ত বাংলা ও আসাম পাকিস্তানে আসবে এটাই ছিল তাদের ধারণা। আজ দেখা যাচ্ছে, মাত্র আসামের এক জেলা—তাও যদি গণভোটে জয়লাভ করতে পারি। আর বাংলাদেশে মুসলিম সংখ্যাগুরু জেলাগুলি কেটে হিন্দুস্থানে দেওয়া হবে। আমরা হতাশ হয়ে পড়লাম। কলকাতার কর্মীরা ও পশ্চিমবঙ্গের কর্মীরা এসে আমাদের বলত, তোমরা আমাদের ছেড়ে চলে যাবে, আমাদের কপালে কি হবে খোদাই জানে! সত্যই দুঃখ হতে লাগল ওদের জন্য। গোপনে গোপনে কলকাতার মুসলমানরা প্রস্তুত ছিল, যা হয় হবে, কলকাতা ছাড়া হবে না। শহীদ সাহেবের পক্ষ থেকে বাংলা সরকারের অর্থমন্ত্রী জনাব মোহাম্মদ আলী ঘোষণা করেছিলেন, কলকাতা আমাদের রাজধানী থাকবে। দিল্লি বসে অনেক পূর্বেই যে কলকাতাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে একথা তো আমরা জানতামও না, আর বুঝতামও না।।

এই সময় শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেব মুসলিম লীগের তরফ থেকে এবং শরৎ বসু ও কিরণশংকর রায় কংগ্রেসের তরফ থেকে এক আলোচনা সভা করেন। তাদের আলোচনায় এই সিদ্ধান্ত হয় যে, বাংলাদেশ ভাগ না করে অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করা যায় কি না? শহীদ সাহেব দিল্লিতে জিন্নাহর সাথে সাক্ষাৎ করে এবং তার অনুমতি নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। বাংলাদেশের কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতারা একটা ফর্মুলা ঠিক করেন। বেঙ্গল মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি এক ফর্মুলা সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করে। যতদূর আমার মনে আছে, তাতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে। জনসাধারণের ভোটে একটা গণপরিষদ হবে। সেই গণপরিষদ ঠিক করবে বাংলাদেশ হিন্দুস্থান না পাকিস্তানে যোগদান করবে, নাকি স্বাধীন থাকবে। যদি দেখা যায় যে, গণপরিষদের বেশি সংখ্যক প্রতিনিধি পাকিস্তানে যোগদানে পক্ষপাতী, তবে বাংলাদেশ পুরাপুরিভাবে পাকিস্তানে যোগদান করবে। আর যদি দেখা যায় বেশি সংখ্যক লোক ভারতবর্ষে থাকতে চায়, তবে বাংলাদেশ ভারতবর্ষে যোগ দেবে। যদি স্বাধীন থাকতে চায়, তাও থাকতে পারবে। এই ফর্মুলা নিয়ে জনাব সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসু দিল্লিতে জিন্নাহ ও গান্ধীর সাথে দেখা করতে যান। শরৎ বসু নিজে লিখে গেছেন যে জিন্নাহ তাঁকে বলেছিলেন, মুসলিম লীগের কোনো আপত্তি নাই, যদি কংগ্রেস রাজি হয়। ব্রিটিশ সরকার বলে দিয়েছে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ একমত না হলে তারা নতুন কোনো ফলা মানতে পারবেন না। শরৎবাবু কংগ্রেসের নেতাদের সাথে দেখা করতে যেয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছিলেন। কারণ, সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল তাঁকে বলেছিলেন, “শরৎ বাবু পাগলামি ছাড়েন, কলকাতা আমাদের চাই।” মহাত্মা গান্ধী ও পণ্ডিত নেহেরু কোন কিছুই না বলে শরৎ বাবুকে সরদার প্যাটেলের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আর মিস্টার প্যাটেল শরৎ বাবুকে খুব কঠিন কথা বলে বিদায় দিয়েছিলেন। কলকাতা ফিরে এসে শরৎ বসু খবরের কাগজে বিবৃতির মাধ্যমে একথা বলেছিলেন এবং জিন্নাহ যে রাজি হয়েছিলেন একথা স্বীকার করেছিলেন।

যুক্ত বাংলার সমর্থক বলে শহীদ সাহেব ও আমাদের অনেক বদনাম দেবার চেষ্টা করেছেন অনেক নেতা। যদিও এই সমস্ত নেতারা অনেকেই তখন বেঙ্গল মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ছিলেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে এই ফর্মুলা গ্রহণ করেছিলেন। জিন্নাহর জীবদ্দশায় তিনি কোনোদিন শহীদ সাহেবকে দোষারোপ করেন নাই। কারণ, তার বিনা সম্মতিতে কোনো কিছুই তখন করা হয় নাই। যখন বাংলা ও আসাম দুইটা প্রদেশই পাকিস্তানে যোগদান করুক, এর জন্যই আমাদের আন্দোলন ছিল, তখন সমস্ত বাংলা পাকিস্তানে আসলে ক্ষতি কি হত তা আজও বুঝতে কষ্ট হয়। যখন বাংলাদেশ ভাগ হবে এবং যতটুকু পাকিস্তানে আসে তাই গ্রহণ করা হবে এটা মেনে নেওয়া হয়েছেতখন সে প্রশ্ন আজ রাজনৈতিক কারণে মিথ্যা বদনাম দেয়ার জন্যই ব্যবহার করা হয়। বেশি চাইতে বা বেশি পেতে চেষ্টা করায় কোন অন্যায় হতে পারে না। যা পেয়েছি তা নিয়েই আমরা খুশি হতে পারি। খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব ১৯৪৭ সালের ২২শে এপ্রিল ঘোষণা করেছিলেন, যুক্ত বাংলা হলে হিন্দু মুসলমানের মঙ্গলই হবে’। মওলানা আকরম ঋ সাহেব মুসলিম লীগের সভাপতি হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন, “আমার রক্তের উপর দিয়ে বাংলাদেশ ভাগ হবে। আমার জীবন থাকতে বাংলাদেশ ভাগ করতে দেব না। সমস্ত বাংলাদেশই পাকিস্তানে যাবে।” এই ভাষা না হলেও কথাগুলির অর্থ এই ছিল। আজাদ কাগজ আজও আছে। ১৯৪৭ সালের কাগজ বের করলেই দেখা যাবে।

এই সময় বড়লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন তলে তলে কংগ্রেসকে সাহায্য করছিলেন। তার ইচ্ছা ছিল তিনি ভারত ও পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল একসাথেই থাকবেন। জিন্নাহ রাজি হলেন না, নিজেই পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হয়ে বসলেন। মাউন্টব্যাটেন সম্বন্ধে বোধহয় তার ধারণা ভাল ছিল না। মাউন্টব্যাটেন ক্ষেপে গিয়ে পাকিস্তানের সর্বনাশ করার চেষ্টা করলেন। যদিও র্যাডক্লিফকে ভার দেওয়া হল সীমানা নির্ধারণ করতে, তথাপি তিনি নিজেই গোপনে কংগ্রেসের সাথে পরামর্শ করে একটা ম্যাপ রেখা তৈরি করেছিলেন বলে অনেকের ধারণা। জিন্নাহ গভর্নর জেনারেল হোক, এটা আমরা যুবকরা মোটেও চাই নাই। তিনি প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হবেন, পরে প্রেসিডেন্ট হবেন, এটাই আমরা আশা করেছিলাম। লর্ড মাউন্টব্যাটেন পাকিস্তানের বড়লাট থাকলে এতখানি অন্যায় করতে পারতেন কি না সন্দেহ ছিল! এটা আমার ব্যক্তিগত মত। জিন্নাহ অনেক বুদ্ধিমান ছিলেন আমাদের চেয়ে, কি উদ্দেশ্যে নিজেই গভর্নর হয়েছিলেন তা তিনিই জানতেন।

 

২২.

পাকিস্তান হওয়ার সাথে সাথেই ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়েছিল। বিশেষ করে জনাব সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে দিল্লিতে এক ষড়যন্ত্র শুরু হয়। কারণ, বাংলাদেশ ভাগ হলেও যতটুকু আমরা পাই, তাতেই সিন্ধু, পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের মিলিতভাবে লোকসংখ্যার চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা বেশি। সোহরাওয়ার্দীর ব্যক্তিত্ব, অসাধারণ রাজনৈতিক জ্ঞান, বিচক্ষণতা ও কর্মক্ষমতা অনেককেই বিচলিত করে তুলেছিল। কারণ, ভবিষ্যতে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চাইবেন এবং বাধা দেওয়ার ক্ষমতা কারও থাকবে না। জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দীকে ভালবাসতেন। তাই তাঁকে প্রথমেই আঘাত করতে হবে। এদিকে সাম্প্রদায়িক গোলমাল লেগেই আছে কলকাতায়। অন্যদিকে পার্টিশন কাউন্সিলের সভা। কংগ্রেস কলকাতায় ছায়া মন্ত্রিসভা গঠন করেছে। আর একদিকে গোপনে শহীদ সাহেবকে নেতৃত্ব থেকে নামিয়ে নাজিমুদ্দীনকে বসাবার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে কলকাতা ও দিল্লিতে। পাঞ্জাব ভাগ হল, সেখানে নির্বাচনের প্রশ্ন আসল না। নবাব মামদোত পূর্ব পাঞ্জাবের লোক হয়েও পশ্চিম পাঞ্জাবের প্রধানমন্ত্রী হলেন। লিয়াকত আলী খান ভারতবর্ষের লোক হয়েও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেন। আর সোহরাওয়ার্দী পশ্চিমবঙ্গের লোক হয়ে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে হলে আবার তাঁকে নির্বাচন করতে হবে বলা হল। যেখানে সমগ্র বাংলাদেশের মুসলিম লীগ এমএলএরা সর্বসম্মতিক্রমে শহীদ সাহেবকে নেতা বানিয়েছিলেন এবং তিনি প্রধানমন্ত্রী আছেন—এই অবস্থার মধ্যে দিল্লি থেকে হুকুম আসল আবার নেতা নির্বাচন হবে। শহীদ সাহেব শাসন চালাবেন, মুসলমানদের রক্ষা করবেন, না ইলেকশন নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। সিলেটের গণভোটেও শহীদ সাহেবকে যেতে হল। আমাদের মত হাজার হাজার কর্মীকে সিলেটে তিনি পাঠালেন। টাকা বন্দোবস্ত করতে হয়েছিল তাকেই বেশি। এস, এম, ইস্পাহানী সাহেব বেঙ্গল মুসলিম লীগের কোষাধ্যক্ষ হিসাবে বহু টাকা দিয়েছিলেন, আমার জানা আছে। কারণ, শহীদ সাহেব তার সাথে যখন আলোচনা করেন ৪০ নম্বর থিয়েটার রোডে, তখন আমি উপস্থিত ছিলাম। আমরা যখন সিলেটে পৌঁছালাম এবং কাজের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লাম, তখন শহীদ সাহেব সিলেটে আসেন। আমার সাথে তার সাক্ষাৎ হয় করিমগঞ্জ মহকুমায় এক বিরাট জনসভায়। আমিও সেই সভায় বক্তৃতা করেছিলাম।

মওলানা তর্কবাগীশ, মানিক ভাই (ইত্তেফাঁকের সম্পাদক), ফজলুল হক ও আমি পাঁচশত কর্মী নিয়ে একদিন সিলেটে পৌঁছি। আমাদের জন্য সিলেটের গণভোট কমিটির কিছুই করতে হয় নাই—শুধু কোন এলাকায় কাজ করতে হবে, আমাদের সেখানে পৌঁছিয়ে দিতে হয়েছে। যাবতীয় খরচপত্রের ব্যবস্থা শহীদ সাহেব করে দিয়েছিলেন। কারো মুখাপেক্ষী আমাদের হতে হবে না। শামসুল হক সাহেব ঢাকা থেকেও বহু কর্মী নিয়ে সেখানে পৌঁছে ছিলেন। শহীদ সাহেবের অনুরোধে দানবীর রায়বাহাদুর আর. পি. সাহা হিন্দু হয়েও কয়েকখানা লঞ্চ সিলেটে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এই লঞ্চগুলি ব্যবহার করা হয়েছিল মুসলিম লীগ কর্মী এবং পাকিস্তানের পক্ষে। কারণ, যানবাহন খুবই প্রয়োজন ছিল। শহীদ সাহেবের বন্ধু ছিলেন রায়বাহাদুর, তাঁর কথা তিনি ফেলতে পারেন নাই। রায়বাহাদুর আজও পাকিস্তানী। মির্জাপুর হাসপাতাল, ভারতেশ্বরী হোমস গার্লস হাইস্কুল, কুমুদিনী কলেজ তারই দানে টিকে আছে।

 

২৩.

সিলেট গণভোটে জয়লাভ করে আমরা কলকাতায় ফিরে এলাম। দেখি, মুসলিম লীগের এক দল ঠিক করেছেন নাজিমুদ্দীন সাহেবকে শহীদ সাহেবের সাথে নেতা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করাবেন। কেন্দ্রীয় লীগ দিল্লি থেকে হুকুম দিয়েছেন ইলেকশন করতে। জনাব আই আই চুন্দ্রিগড় কেন্দ্রীয় লীগের পক্ষ থেকে এই নির্বাচনে সভাপতিত্ব করবেন। এদিকে দু’দেশের সম্পদের ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে যে গোলমাল চলেছে, সেদিকে কারো খেয়াল নাই। নেতা নির্বাচন নিয়ে সকলেই ব্যস্ত। নাজিমুদ্দীন সাহেব নির্বাচনের সময় নমিনেশন দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন লন্ডন ও দিল্লিতে। শহীদ সাহেব সমস্ত নির্বাচনটা নিজে চালিয়েছিলেন, টাকা পয়সার বন্দোবস্ত করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি একদিনের জন্যও বিশ্রাম পান নাই। কলকাতা, নোয়াখালী ও বিহারের দাঙ্গা বিধ্বস্তদের সহায়তা দান, মুসলিম লীগের সংগঠন, দিল্লি, কলকাতা দৌড়াদৌড়ি সকল কিছুই তাঁকে করতে হয়েছিল। আর যখন পাকিস্তান কায়েম হয়েছে তখন নেতা হবার জন্য আর একজনকে আমদানি করা যে কত বড় অন্যায় সেকথা ভবিষ্যৎ বিচার করবে। শহীদ সাহেবের বিরোধীদের প্রপাগান্ডা হল তিনি পশ্চিম বাংলার লোক; তিনি কেন পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী হবেন? শহীদ সাহেব তো কোনোদিন দুই গ্রুপ চিন্তা করেন নাই, তাই নাজিমুদ্দীন সাহেবের সমর্থকদেরও নমিনেশন দিয়েছিলেন, মন্ত্রী করেছিলেন, পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি, চিফ হুইপ, স্পিকার অনেক পদই দিয়েছিলেন। এরা সকলেই তলে তলে শহীদ সাহেবের বিরুদ্ধাচরণ করছিলেন। অন্যদিকে, পশ্চিম বাংলার মুসলিম লীগ এমএলএরা ভোট দিতে পারবেন না, কারণ তারা হিন্দুস্তানে পড়ে গিয়েছেন। তার নিজের দল হাশিম সাহেবের নেতৃত্বে ঘরে বসে আছেন, শহীদ সাহেবকে সমর্থন করবেন না। হাশিম সাহেব কোনো কর্মীকে নির্দেশ দিলেন না। অনেককেই নিষেধ করে দিলেন এবং তলে তলে বলে দিলেন, শহীদ সাহেবকে সমর্থন না করতে। শহীদ সাহেবের এদিকে ভ্রুক্ষেপ নাই। কোন চেষ্টাই করছেন না। কাউকেই অনুরোধ করছেন না, ভোট দিতে। তাঁকে বললে, তিনি বলতেন, “ইচ্ছা হয় দিবে, না হয় না দিবে, আমি কি করব?”

শহীদ সাহেবের পক্ষে মোহাম্মদ আলী, জনাব তোফাজ্জল আলী, ডা, মালেক, মিস্টার সবুর খান, আনোয়ারা খাতুন, ফরিদপুরের বাদশা মিয়া, রংপুরের খয়রাত হোসেন কাজ করছিলেন। শহীদ সাহেবের দলের চিফ হুইপ মফিজউদ্দিন আহমেদ সাহেব গোপনে গোপনে নাজিমুদ্দীন সাহেবের দলে কাজ করছিলেন। মন্ত্রী জনাব শামসুদ্দিন আহমদ (কুষ্টিয়া) চেষ্টা করছিলেন শহীদ সাহেবের বিপক্ষে। একমাত্র ফজলুর রহমান সাহেব—তখন মন্ত্রী ছিলেন, শহীদ সাহেবকে বলেছিলেন, তার পক্ষে নাজিমুদ্দীন সাহেবকে ভোট দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নাই। আমার কথাটা ভাল লেগেছিল। যা হোক, এর পরেও শহীদ সাহেবের পক্ষে ভোট বেশি ছিল। শেষ পর্যন্ত সিলেট জেলার সতেরজন এমএলএ কলকাতা পৌঁছাল, তারাও ভোট দিবেন। ভা, মালেক সিলেট গিয়েছিলেন, শহীদ সাহেবের পক্ষে কাজ করতে। তাকে সিলেটের এমএলএরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন শহীদ সাহেবের প্রোগ্রাম কি?

ডা. মালেক বলেছিলেন, প্রথম কাজ হবে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করা। ফল হল উল্টা, তিনজন এমএলএ ছাড়া আর সকলেই ছিলেন সিলেটের জমিদার। তাঁরা ঘাবড়িয়ে গিয়েছিলেন। হোটেল বিল্টমোরে তাঁদের রাখা হয়েছিল। আমরা এদের শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ধরে এনেছিলাম। শহীদ সাহেবের কাছে সিলেটের এমএলএরা দাবি করলেন, তিনটি মন্ত্রিত্ব দিতে হবে সিলেটে। শহীদ সাহেব বললেন, “আমি কোন ওয়াদা করি না। তাঁদের যা প্রাপ্য তাই পাবেন।” অন্যদিকে নাজিমুদ্দীনের পক্ষে ওয়াদা দেয়া হয়েছিল। দু’একজন ছাড়া সিলেটের এমএলএরা নাজিমুদ্দীন সাহেবকে ভোট দিলেন, তাতে শহীদ সাহেব পরাজিত হলেন। যেদিন নির্বাচন হবে তার পূর্বের দিন রাত দুইটার সময়–আমি তখন শহীদ সাহেবের বাড়িতে, শহীদ সাহেব বারান্দায় শুয়ে আছেন। ডা. মালেক এসে বললেন, “আমাদের অবস্থা ভাল মনে হচ্ছে না, কিছু টাকা খরচ করলে বোধহয় অবস্থা পরিবর্তন করা যেত।” শহীদ সাহেব মালেক সাহেবকে বললেন, “মালেক, পাকিস্তান হয়েছে, এর পাক ভূমিকে নাপাক করতে চাই না। টাকা আমি কাউকেও দেব না, এই অসাধু পন্থা অবলম্বন করে নেতা আমি হতে চাই না। আমার কাজ আমি করেছি।” মালেক সাহেব বললেন, “ঠিক, ঠিক বলেছেন স্যার, আমারও ঘৃণা করে।” সেইদিন থেকে শহীদ সাহেবকে আমি আরও ভালবাসতে শুরু করলাম। শহীদ সাহেব ইহজগতে নাই, তবে মালেক ভাই আজও জীবিত আছেন। আমরা তিনজনই তখন ছিলাম, আর কেউ ছিল না।

আমার মনে আছে শহীদ সাহেবকে সকালবেলা আমি বলেছিলাম, “আমাদের এমএলএদের ওরা ভাগিয়ে নিয়ে শাহাবুদ্দীন সাহেবের বাড়িতে রেখেছে। আপনি কলকাতা মুসলিম লীগকে খবর দেন, আমরা ওদের কেড়ে আনব, আমাদের কাছে ওরা দাঁড়াতে পারবে না। শহীদ সাহেব হেসে দিয়ে বললেন, “না দরকার নাই, মানুষ হাসবে। তুমি ছেলেমানুষ বুঝবা না।” কলকাতায় তখনও দাঙ্গা চলছিল। ইচ্ছা করলে কারফিউ জারি করে নির্বাচন কয়েকদিনের জন্য বন্ধ করে দিতে পারতেন। কারণ, তখনও তিনি প্রধানমন্ত্রী আছেন। পদের লোভ যে তার ছিল না, এটাই তার প্রমাণ। কোনোমতে পদ আঁকড়িয়ে থাকতে হবে, এটা তিনি কোনোদিন চাইতেন না। আর ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন না। পাকিস্তানের রাজনীতি শুরু হল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। জিন্নাহ যতদিন বেঁচেছিলেন প্রকাশ্যে কেউ সাহস পায় নাই। যেদিন মারা গেলেন ষড়যন্ত্রের রাজনীতি পুরাপুরি প্রকাশ্যে শুরু হয়েছিল।

 

২৪.

নাজিমুদ্দীন সাহেব নেতা নির্বাচিত হয়েই ঘোষণা করলেন, ঢাকা রাজধানী হবে এবং তিনি দলবলসহ ঢাকায় চলে গেলেন। একবার চিন্তাও করলেন না, পশ্চিম বাংলার হতভাগা মুসলমানদের কথা। এমনকি আমরা যে সমস্ত জিনিসপত্র কলকাতা থেকে ভাগ করে আনব তার দিকেও ক্ষেপ করলেন না। ফলে যা আমাদের প্রাপ্য তাও পেলাম না। সরকারি কর্মচারীরা ঝগড়া গোলমাল করে কিছু কিছু মালপত্র স্টিমার ও ট্রেনে তুলতে পেরেছিলেন, তাই সম্বল হল। কলকাতা বসে যদি ভাগ বাটোয়ারা করা হত তাহলে কোনো জিনিসের অভাব হত না। নাজিমুদ্দীন সাহেব মুসলিম লীগ বা অন্য কারোর সাথে পরামর্শ না করেই ঘোষণা করলেন ঢাকাকে রাজধানী করা হবে। তাতেই আমাদের কলকাতার উপর আর কোনো দাবি রইল না। এদিকে লর্ড মাউন্টব্যাটেন চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়েছিলেন, কলকাতা নিয়ে কি করবেন? মিশন উইথ মাউন্ডব্যাটেন’ বইটা পড়লে সেটা দেখা যাবে। ইংরেজ তখনও ঠিক করে নাই কলকাতা পাকিস্তানে আসবে, না হিন্দুস্তানে থাকবে। আর যদি কোনো উপায় না থাকে তবে একে ‘ফ্রি শহর’ করা যায় কি না? কারণ, কলকাতার হিন্দু-মুসলমান লড়বার জন্য প্রস্তুত। যে কোন সময় দাঙ্গাহাঙ্গামা ভীষণ রূপ নিতে পারে। কলকাতা হিন্দুস্তানে পড়লেও শিয়ালদহ স্টেশন পর্যন্ত পাকিস্তানে আসার সম্ভাবনা ছিল। হিন্দুরা কলকাতা পাবার জন্য আরও অনেক কিছু ছেড়ে দিতে বাধ্য হত।

এই বইতে আরও আছে, একজন ইংরেজ গভর্নর হয়ে ঢাকা আসতে রাজি হচ্ছিল, কারণ ঢাকায় খুব গরম আবহাওয়া। তার উত্তরে মাউন্টব্যাটেন যে চিঠি দিয়েছিলেন। তাতে লেখা ছিল, ‘পূর্ব পাকিস্তানে দুনিয়ার অন্যতম পাহাড়ি শহর, থাকার কোন কষ্ট হবে না। অর্থাৎ দার্জিলিংও আমরা পাব। তাও নাজিমুদ্দীন সাহেবের এই ঘোষণায় শেষ হয়ে গেল। যখন গোলমালের কোনো সম্ভাবনা থাকল না, মাউন্টব্যাটেন সুযোগ পেয়ে যশোর জেলায় সংখ্যাগুরু মুসলমান অধ্যুষিত বনগা জংশন অঞ্চল কেটে দিলেন। নদীয়ায় মুসলমান বেশি, তবু কৃষ্ণনগর ও রানাঘাট জংশন ওদের দিয়ে দিলেন। মুর্শিদাবাদে মুসলমান বেশি কিন্তু সমস্ত জেলাই দিয়ে দিলেন। মালদহ জেলায় মুসলমান ও হিন্দু সমান সমান তার আধা অংশ কেটে দিলেন, দিনাজপুরে মুসলমান বেশি, বালুরঘাট মহকুমা কেটে দিলেন যাতে জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং হিন্দুস্তানে যায় এবং আসামের সাথে হিন্দুস্তানের সরাসরি যোগাযোগ হয়। উপরোক্ত জায়গাগুলি কিছুতেই পাকিস্তানে না এসে পারত না। এদিকে সিলেটে গণভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ করিমগঞ্জ মহকুমা ভারতবর্ষকে দিয়েছিল। আমরা আশা করেছিলাম, আসামের কাছাড় জেলা ও সিলেট জেলা পাকিস্তানের ভাগে না দিয়ে পারবে না। আমার বেশি দুঃখ হয়েছিল করিমগঞ্জ নিয়ে। কারণ, করিমগঞ্জে আমি কাজ করেছিলাম গণভোটের সময়! নেতারা যদি নেতৃত্ব দিতে ভুল করে, জনগণকে তার খেসারত দিতে হয়। যে কলকাতা পূর্ব বাংলার টাকায় গড়ে উঠেছিল সেই কলকাতা আমরা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলাম। কেন্দ্রীয় লীগের কিছু কিছু লোক কলকাতা ভারতে চলে যাক এটা চেয়েছিল বলে আমার মনে হয়। অথবা পূর্বেই গোপনে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। সোহরাওয়ার্দী নেতা হলে তাদের অসুবিধা হত তাই তারা পিছনের দরজা দিয়ে কাজ হাসিল করতে চাইল। কলকাতা পাকিস্তানে থাকলে পাকিস্তানের রাজধানী কলকাতায় করতে বাধ্য হত, কারণ পূর্ব বাংলার লোকেরা দাবি করত পাকিস্তানের জনসংখ্যায়ও তারা বেশি আর শহর হিসাবে তদানীন্তন ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ শহর কলকাতা। ইংরেজের শাসনের প্রথমদিকে কলকাতা একবার সারা ভারতবর্ষের রাজধানীও ছিল।

 

২৫.

এই সময়ে আরও কয়েকটা ঘটনা ঘটে আমাদের কর্মীদের মধ্যে। আমাদের যে মিল্লাত প্রেসটা ছিল—সেটা হাশিম সাহেব পরিচালনা করতেন। কথা উঠল, সেটা কি করা যায়? হাশিম সাহেব পূর্বেই দেনা হয়ে পড়েছেন বলে একটা রঙিন মেশিন বিক্রি করে দেন, তাতে দায়দেনা শোধ হয়ে যায়। তিনি শামসুল হক সাহেবকে ঢাকা থেকে ডেকে নিয়ে বললেন, “কলকাতার কর্মীরাও অনেকে ঢাকা চলেছে, আমি পাকিস্তানে যাব না। তোমরা সেটা ঢাকায় নিয়ে একে কেন্দ্র করে দলটা ঠিক রাখ, আর কাজ চালিয়ে যাও।” শামসুল হক সাহেব আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করে রাজি হলেন, ঢাকার লীগ অফিস ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে প্রেসটা বসানো হবে। মিল্লাত কাগজ চলবে, আমরা এক একজন এক একটা বিভাগের ভার নেব। শামসুল হক সাহেব ঢাকায় এসে সবকিছু ঠিক করে কলকাতা গেলেন। হাশিম সাহেব আবার কলকাতার কর্মীদের বললেন, “তোমরা তো কলকাতায় থাকলে, তোমাদেরই বোধহয় প্রেসটা থাকা দরকার। কারণ, হিন্দুস্তানে তোমরা কিইবা করবা! যাদের বাড়ি পাকিস্তানে পড়েছে তাদের আর প্রয়োজন কি, পাকিস্তান তো হয়েই গেছে। কলকাতার কর্মীরা বলে বসল, ঠিকই তো কথা। যখন হক সাহেব এই কথা শুনলেন, কিছুই না বলে ফিরে এলেন। আমি তখন হাশিম সাহেবের কাছে বেশি যাই না। কারণ, তিনি আমাকে শহীদ সাহেবের সমর্থক বলে বিশ্বাস করতেন না, আর আমিও শহীদ সাহেবের সাথে তার ব্যবহার সমর্থন করি না। একে আমি বিশ্বাসঘাতকতা বলতাম।

একদিন নূরুদ্দিন, নূরুল আলম ও কাজী ইদ্রিস সাহেব আমাকে ডেকে পাঠালেন বেঙ্গল রেস্টুরেন্টে, আমার বাসার কাছে। জিজ্ঞাসা করলাম, “ব্যাপার কি? এরা আমাকে বলল, “সর্বনাশ হয়ে গেছে, হাশিম সাহেব প্রেস বিক্রি করে ফেলতে চান, আমরা চাঁদা তুলে প্রেস করেছি, মুখ দেখাব কি করে?” আমি বললাম, “আমি কি করব?” সকলে বলল, “তোমাকে বাধা দিতে হবে।” বললাম, “আমি কেন বাধা দেব? আমি পাকিস্তানে চলে যাব। আর কবে দেখা হবে ঠিক নাই। আমার প্রয়োজন কি? তোমরা হাশিম সাহেবের খলিফা, আমার নাম তো পূর্বেই কাটা গেছে, আর কেন?” সকলে বলল, “তুমি বললেই আর ভয়েতে বিক্রি করবে না।” বললাম, “ঠিক আছে আমি অনুরোধ করতে পারি।”

পরের দিন মিল্লাত প্রেসে গিয়ে হাশিম সাহেবের সাথে দেখা করি। পাশের ঘরে আমার সহকর্মীরা চুপ করে বসে আছে; শুনবে আমাদের কথা। আমি খুব শান্তভাবে তাঁকে বললাম, “প্রেসটা নাকি বিক্রি করবেন?” বললেন, “উপায় কি, প্রত্যেক মাসেই লোকসান যাচ্ছে, কি করি? আর চালাবে কে?” আমি বললাম, “খন্দকার নূরুল আলম তো ম্যানেজার হয়ে এতকাল চালাল। খরচ কমিয়ে ফেলল। সেটা বিক্রি করে দিলে কর্মচারীদের থাকবে কি? আর আমরা মুখ দেখাতে পারব না। সমস্ত বাংলাদেশ থেকে চাঁদা তুলেছি, লোকে আমাদের গালি দিবে।” হাশিম সাহেব হঠাৎ রাগ করে ফেললেন এবং বললেন, “আমাকে বেচতেই হবে, কারণ দেনা শোধ করবে কে?” আমি বললাম, “কয়েক মাস পূর্বে যে প্রেসটা বিক্রি হল তাতে দেনা শোধ হয় নাই?” তিনি ভীষণ রেগে গেলেন, আমারও রাগ হল। উঠে আসার সময় বলে এলাম, “প্রেস বিক্রি করতে গেলে আমি বাধা দেব, দেখি কে আসে এই মিল্লাত প্রেসে?” হাশিম সাহেব খুব দুঃখ পেলেন আমার কথায়। পরের দিন ঐ সমস্ত বন্ধুরা আবার আমার কাছে এসে বলল, “হাশিম সাহেব বানা খান না। শুধু বলেন, মুজিব আমাকে অপমান করল!’ তুই আবার দেখা কর, আর বলে দে, যা ভাল বোঝেন করেন।” আমি বললাম, “তোমরা খেলা পেয়েছ!”

আমি শহীদ সাহেবের কাছে এখন রোজই যাই। তার সাথে মাঝে মাঝে সভা সমিতিতে যাই—যেখানে সাম্প্রদায়িক সম্ভাব সৃষ্টির জন্য সভা হয়। শহীদ সাহেবকে বললাম, সকল ইতিহাস। তিনি আমার উপর রাগ করলেন, কেন আমি খারাপ ব্যবহার করলাম হাশিম সাহেবের সাথে! কত বড় উদার ছিলেন শহীদ সাহেব। আমি হাশিম সাহেবের কাছে যেয়ে বললাম, “আপনি মনে কিছু করবেন না, আমার এভাবে কথা বলা অন্যায় হয়েছে। আপনি যা ভাল বোঝেন তাই করুন। আমার কিছুই বলার নাই।” হাশিম সাহেব হিন্দুস্তানে থাকবেন, আমি চলে আসব পাকিস্তানে। আমার বাড়িও পাকিস্তানে। আমি। যাওয়াতে তিনি খুশি হয়েছিলেন। তার সাথে ভিন্ন মত হতে পারি, কিন্তু তার কাছ থেকে যে রাজনীতির শিক্ষা পেয়েছি, সেটা তো ভোলা কষ্টকর। আমার যদি কোনো ভুল হয় বা অন্যায় করে ফেলি, তা স্বীকার করতে আমার কোনোদিন কষ্ট হয় নাই। ভুল হলে সংশোধন করে নেব, ভুল তো মানুষের হয়েই থাকে। আমার নিজেরও একটা দোষ ছিল, আমি হঠাৎ রাগ করে ফেলতাম। তবে রাগ আমার বেশি সময় থাকত না।

আমি অনেকের মধ্যে একটা জিনিস দেখেছি, কোন কাজ করতে গেলে শুধু চিন্তাই করে। চিন্তা করতে করতে সময় পার হয়ে যায়, কাজ আর হয়ে ওঠে না। অনেক সময় করব কি করব না, এইভাবে সময় নষ্ট করে এবং জীবনে কোন কাজই করতে পারে না। আমি চিন্তাভাবনা করে যে কাজটা করব ঠিক করি, তা করেই ফেলি। যদি ভুল হয়, সংশোধন করে নেই। কারণ, যারা কাজ করে তাদেরই ভুল হতে পারে, যারা কাজ করে না তাদের ভুলও হয় না।

 

২৬.

এই সময় শহীদ সাহেবের সাথে কয়েক জায়গায় আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। মহাত্মা গান্ধীর সাথে শহীদ সাহেব হিন্দু-মুসলমান শান্তি কায়েম করার জন্য কাজ করছিলেন। তখন মুসলমানদের উপর মাঝে মাঝে আক্রমণ হচ্ছিল। সেদিন রবিবার ছিল। আমি সকালবেলা শহীদ সাহেবের বাসায় যাই। তিনি আমাকে বললেন, “চল, ব্যারাকপুর যাই। সেখানে খুব গোলমাল হয়েছে। মহাত্মা গান্ধীও যাবেন। আমি বললাম, “যাব স্যার। তার গাড়িতে উঠলাম, নারকেলডাঙ্গা এলাম। সেখান থেকে মহাত্মাজী, মনু গান্ধী, আভা গান্ধী ও তার সেক্রেটারি এবং কিছু কংগ্রেস নেতাও সাথে চললেন। ব্যারাকপুরের দিকে রওয়ানা করলাম। হাজার হাজার লোক রাস্তার দু’পাশে ভিড় করেছে, তাদের শুধু এক কথা, বাপুজী কি জয়’। ব্যারাকপুরে পৌঁছে দেখি, এক বিরাট সভার আয়োজন হয়েছে। মহাত্মাজী রবিবার কারও সাথে কথা বলেন না, বক্তৃতা তো করবেনই না। মনু গান্ধী ও আভা গান্ধী ‘আলহামদু’ সূরা ও কুলহু’ সূরা পড়লেন। তারপরে রামবন্দনা গান গাইলেন। মহাত্মাজী লিখে দিলেন, তার বক্তৃতা সেক্রেটারি পড়ে শোনালেন। সত্যই ভদ্রলোক জাদু জানতেন। লোকে চিৎকার করে উঠল, হিন্দু-মুসলমান ভাই ভাই। সমস্ত আবহাওয়ার পরিবর্তন হয়ে গেল এক মুহূর্তের মধ্যে।

এর দু’দিন পরেই বোধহয় ঈদের নামাজ হল। মুসলমানরা ভয় পেয়ে গেছে ঈদের নামাজ পড়বে কি পড়বে না? মহাত্মাজী ঘোষণা করলেন, যদি দাঙ্গা হয় এবং মুসলমানদের উপর কেউ অত্যাচার করে তবে তিনি অনশন করবেন। মহল্লায় মহল্লায় বিশেষ করে হিন্দি ভাষাভাষী লোকেরা শোভাযাত্রা বের করে শ্লোগান দিতে লাগল, মুসলমানকে মাত মারো, বাপুজী অনশন কারেগা। হিন্দু-মুসলমান ভাই ভাই।’ ঈদের দিনটা শান্তিতেই কাটল। আমি আর ইয়াকুব নামে আমার এক ফটোগ্রাফার বন্ধু পরামর্শ করলাম, আজ মহাত্মাজীকে একটা উপহার দিব। ইয়াকুব বলল, “তোমার মনে আছে আমি আর তুমি বিহার থেকে দাঙ্গার ফটো তুলেছিলাম?” আমি বললাম, “যা মনে আছে।” ইয়াকুব বলল, “সমস্ত কলকাতা ঘুরে আমি ফটো তুলেছি। তুমি জান না তার কপিও করেছি। সেই ছবিগুলি থেকে কিছু ছবি বেছে একটা প্যাকেট করে মহাত্মাজীকে উপহার দিলে কেমন হয়।” আমি বললাম, “চমৎকার হবে। চল যাই, প্যাকেট করে ফেলি।” যেমন কথা, তেমন কাজ। দুইজনে বসে পড়লাম। তারপর প্যাকেটটা এমনভাবে বাঁধা হল যে, কমপক্ষে দশ মিনিট লাগবে খুলতে। আমরা তাকে উপহার দিয়েই ভাগব। এই ফটোর মধ্যে ছিল মুসলমান মেয়েদের স্তন কাটা, ছোট শিশুদের মাথা নাই, শুধু শরীরটা আছে, বস্তি, মসজিদে আগুনে জ্বলছে, রাস্তায় লাশ পড়ে আছে, এমনই আরও অনেক কিছু। মহাত্মাজী দেখুক, কিভাবে তার লোকেরা দাঙ্গাহাঙ্গামা করেছে এবং নিরীহ লোককে হত্যা করেছে।

আমরা নারকেলডাঙ্গায় মহাত্মাজীর ওখানে পৌঁছালাম। তাঁর সাথে ঈদের মোলাকাত করব বললাম। আমাদের তখনই তাঁর কামরায় নিয়ে যাওয়া হল। মহাত্মাজী আমাদের কয়েকটা আপেল দিলেন। আমরা মহাত্মাজীকে প্যাকেটটা উপহার দিলাম। তিনি হাসিমুখে গ্রহণ করলেন। আমরা অপরিচিত সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নাই। তবে বুঝতে পারলাম, তার নাতনী মনু গান্ধী আমার চেহারা দেখেছে ব্যারাকপুর সভায়, কারণ আমি শহীদ সাহেবের কাছে প্লাটফর্মে বসেছিলাম। আমরা উপহার দিয়ে চলে এলাম তাড়াতাড়ি হেঁটে। শহীদ সাহেব তখন ওখানে নাই। বন্ধু ইয়াকুবের এই ফটোগুলি যে মহাত্মা গান্ধীর মনে বিরাট দাগ কেটেছিল তাতে সন্দেহ নাই। আমি শহীদ সাহেবকে পরে এ বিষয়ে বলেছিলাম।

আমাদের পক্ষে কলকাতা থাকা সম্ভবপর না, কারণ অনেককে গ্রেফতার করেছে। জহিরুদ্দিনের বাড়ি তল্লাশি করেছে। আমাদেরও ধরা পড়লে ছাড়বে না। ভাগতে পারলে বাঁচি। একটা অসুবিধা ছিল, আমি ও আমার ভগ্নিপতি আবদুর রব সাহেব একটা রেস্টুরেন্ট করেছিলাম পার্ক সার্কাসে। সে বাড়ি গিয়েছে, আমার বোন ও রেণুকে পৌঁছে দিতে। আসতে দেরি করছে। আমি দেখাশোনা করি না, ম্যানেজার সব শেষ করে দিচ্ছে। তাকে টেলিগ্রাম করে দিয়ে আমি রওয়ানা করব ঠিক করলাম। শহীদ সাহেবের কাছে বিদায় নিতে গেলাম। তাকে রেখে চলে আসতে আমার মনে খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমার মন বলছিল, কতদিন মহাত্মাজী শহীদ সাহেবকে রক্ষা করতে পারবেন? কয়েকবার তার উপর আক্রমণ হয়েছে। তাঁকে হিন্দুরা মেরে ফেলতে চেষ্টা করছে। বিজ্ঞান কলেজের সামনে তার গাড়ির উপর বোমা ফেলে গাড়িটা পুড়িয়ে দিয়েছিল। তিনি কোনোমতে রক্ষা পেয়েছিলেন। শহীদ সাহেবকে বললাম, “চলুন স্যার পাকিস্তানে, এখানে থেকে কি করবেন?” বললেন, “যেতে তো হবেই, তবে এখন এই হতভাগা মুসলমানদের জন্য কিছু একটা না করে যাই কি করে? দেখ না, সমস্ত ভারতবর্ষে কি অবস্থা হয়েছে, চারদিকে শুধু দাঙ্গা আর দাদা। সমস্ত নেতা চলে গেছে, আমি চলে গেলে এদের আর উপায় নাই। তোমরা একটা কাজ কর দেশে গিয়ে, সাম্প্রদায়িক গোলমাল যাতে না হয়, তার চেষ্টা কর। পূর্ব বাংলায় গোলমাল হলে আর উপায় থাকবে না। চেষ্টা কর, যাতে হিন্দুরা চলে না আসে। ওরা এদিকে এলেই গোলমাল করবে, তাতে মুসলমানরা বাধ্য হয়ে পূর্ব বাংলায় ছুটবে। যদি পশ্চিম বাংলা, বিহার ও আসামের মুসলমান একবার পূর্ব বাংলার দিকে রওয়ানা হয়, তবে পাকিস্তান বিশেষ করে পূর্ব বাংলা রক্ষা করা কষ্টকর হবে। এত লোকের জায়গাটা তোমরা কোথায় দিবা আমার তো জানা আছে। পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্যই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হতে দিও না।” বললাম, “ঢাকা যেতে হবে, শামসুল হক সাহেব খবর দিয়েছেন। রাজনৈতিক কর্মীদের একটা সভা হবে। পরে আবার একবার এসে দেখা করব।” বললেন, “এস।”

নূরুদ্দিন এল না, কারণ সামনেই তার এমএ পরীক্ষা। পরীক্ষার পরই চলে আসবে। নূরুদ্দিনের নানা অসুবিধা, তার স্ত্রী তখন মেডিকেল কলেজে পড়ে। তাকেও আনতে হবে।

আমি ভাবতাম, পাকিস্তান কায়েম হয়েছে, আর চিন্তা কি? এখন ঢাকায় যেয়ে ল’ ক্লাসে ভর্তি হয়ে কিছুদিন মন দিয়ে লেখাপড়া করা যাবে। চেষ্টা করব, সমস্ত লীগ কর্মীদের নিয়ে যাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা না হয়।

 

২৭.

আব্বা, মা ও রেণুর কাছে কয়েকদিন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা এলাম। পূর্বে দু’একবার এসেছি বেড়াতে। পথ ঘাট ভাল করে চিনি না। আত্মীয়স্বজন, যারা চাকরিজীবী, কে কোথায় আছেন, জানি না। ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে প্রথমে উঠব ঠিক করলাম। শওকত মিয়া মোগলটুলী অফিসের দেখাশোনা করে। মুসলিম লীগের পুরানা কর্মী। আমার বন্ধুও। শামসুল হক সাহেব ওখানেই থাকেন। মুসলিম লীগ ও অন্যান্য দলের কর্মীদের সভা ডেকেছেন শামসুল হক সাহেব—রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে। আমাকে খবর দিয়েছেন পূর্বেই। তাই কয়েকদিন পূর্বেই এসে হাজির হতে হল। ঘোড়ার গাড়ি ঠিক করলাম, ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে পৌঁছে দিতে। দেখলাম, রসিক গাড়ওয়ান মোগলটুলী লীগ অফিস চেনে। আমাকে বলল, “আপনি লীগ অফিসে যাইবেন, চলেন সাব আমি চিনি।” পয়সাও বেশি নিল বলে মনে হল না। অনেক গল্প শুনেছি এদের সম্পর্কে। কিন্তু আমার সাথে দরকষাকষিও করল না। শামসুল হক সাহেব ও শওকত সাহেব আমাকে পেয়ে খুবই খুশি। শওকত আমাকে নিয়ে কি যে করবে ভেবেই পায় না। তার একটা আলাদা রুম ছিল। আমাকে তার রুমেই জায়গা দিল। আমি তাকে শওকত ভাই বলতাম। সে আমাকে মুজিব ভাই বলত। তিন-চার দিন পরেই কনফারেন্স হবে। বহু কমী এসেছে বিভিন্ন জেলা থেকে। অনেকেই মোগলটুলীতে উঠেছে। শামসুল হক সাহেব বললেন, “জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না, কোথায় কনফারেন্স করব? সরকার নাকি এটাকে ভাল চোখে দেখছে না। আমাদের কনফারেন্স যাতে না হয় সেই চেষ্টা করছে এবং গোলমাল করে কনফারেন্স ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে।” আমি বললাম, “এত তাড়াতাড়ি এরা আমাদের ভুলে গেল হক সাহেব।” হক সাহেব হেসে দিয়ে বললেন, “এই তো দুনিয়া!”

।বিকালে হক সাহেব আমাদের নিয়ে বসলেন—কনফারেন্সে কি করা হবে সে সম্বন্ধে আলোচনা করতে। একটা যুব প্রতিষ্ঠান গঠন করা দরকার, যাতে তরুণ কর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে না যান। আমি হক সাহেবকে বললাম, “যুব প্রতিষ্ঠান একটা করা যায়, তবে কোনো টী মুসলিম লীগের সভ্য আছি।” হক সাহেব বললেন, “আমরা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ছি না।” হক সাহেব খুবই ব্যস্ত, হল ঠিক করার জন্য। শেষ পর্যন্ত ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস-চেয়ারম্যান খান সাহেব আবুল হাসানাত সাহেবের বাড়িতে কনফারেন্স হবে ঠিক হল। বিরাট হল এবং লন আছে। তিনি রাজি হলেন, আর কেউই সাহস পেলেন না আমাদের জায়গা দিতে।

কনফারেন্স শুরু হল। জনাব আতাউর রহমান খান ও কামরুদ্দিন সাহেবও এই কনফারেন্স যাতে কামিয়াব হয় তার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। কামরুদ্দিন সাহেবের সাথে আমার পূর্বেই পরিচয় ছিল। আতাউর রহমান সাহেবের সাথে এই প্রথম পরিচয় হয়। প্রথম অধিবেশন শেষ হওয়ার পরে সাবজেক্ট কমিটি গঠন হল। আমাকেও কমিটিতে রাখা হল। আলোচনার মাধ্যমে বুঝতে পারলাম, কিছু কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন কর্মীও যোগদান করেছে। তারা তাদের মতামতও প্রকাশ করতে শুরু করেছে। প্রথমে ঠিক হল, একটা যুব প্রতিষ্ঠান গঠন করা হবে, যে কোন দলের লোক এতে যোগদান করতে পারবে। তবে সক্রিয় রাজনীতি থেকে যতখানি দূরে রাখা যায় তার চেষ্টা করা হবে। এই প্রতিষ্ঠানকে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য করতে হবে। এই প্রতিষ্ঠানের নাম হবে ‘গণতান্ত্রিক যুবলীগ।’ আমি বললাম, এর একমাত্র কর্মসূচি হবে সাম্প্রদায়িক মিলনের চেষ্টা, যাতে কোনো দাঙ্গাহাঙ্গামা না হয়, হিন্দুরা দেশ ত্যাগ না করে-যাকে ইংরেজিতে বলে কমিউনাল হারমনি, তার জন্য চেষ্টা করা। অনেকেই এই মত সমর্থন করল, কিন্তু কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন দলটা বলল, আরও প্রোগ্রাম নেওয়া উচিত, যেমন অর্থনৈতিক প্রোগ্রাম। আমরা বললাম, তাহলে তো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হয়ে যাবে। অনেক আলোচনার পরে ঠিক হল, একটা সাব-কমিটি করা হবে, তারা কর্মসূচি প্রণয়ন করবেন এবং গণতান্ত্রিক যুবলীগের কার্যনির্বাহী কমিটির কাছে তা পেশ করবেন। সে কর্মসূচি তারাই গ্রহণ করা বা না করার অধিকারী থাকবেন। সতেরজন সদস্য নিয়ে কমিটি করা হল এবং কো-অপ্ট করার ক্ষমতা দেওয়া হল। হিসাব। করে দেখা গেল আমাদের মতাবলম্বী লোকই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন লোকও কয়েকজন কমিটির সভ্য হলেন। কয়েকদিন পরে কার্যকরী কমিটির এক সভায় ড্রাফট কার্যসূচি পেশ করা হল, যাকে পরিপূর্ণ একটা পার্টির ম্যানিফেস্টো বলা যেতে পারে। আমি ভীষণভাবে বাধা দিলাম এবং বললাম কোনো ব্যাপক কার্যসূচি এখন গ্রহণ করা হবে না। একমাত্র কমিউনাল হারমনির জন্য কর্মীদের ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া আর কোনো কাজই আমাদের নাই। দুই মাস হল দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন কোন দাবি করা উচিত হবে না। মিছামিছি আমরা জনগণ থেকে দূরে সরে যাব। কমিউনিস্ট নেতারা তখন ভারতবর্ষে শ্লোগান দিয়েছে, স্বাধীনতা আসে নাই, সংগ্রাম করে স্বাধীনতা আনতে হবে। আমাদের দেশের কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন সহকর্মীরা সেই আদর্শই কর্মসূচির মধ্যে গ্রহণ করতে চায়। এই সকল কর্মসূচি নিয়ে এখনই জনগণের কাছে গেলে আমাদের উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলবে এবং যে কাজ এখন বিশেষ প্রয়োজন, সাম্প্রদায়িক মিলনের কথা বললেও লোকে আমাদের কথা শুনতে চাইবে না। প্রথম সভায় পাস করতে পারল না, আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলাম। তবে হক সাহেব মধ্যপন্থা অবলম্বন করায় আমাদের অসুবিধা হতে লাগল।

 

২৮.

এই সময় আমি কিছুদিনের জন্য কলকাতায় যাই। আমাদের রেস্টুরেন্টটা বিক্রি হয়েছে। কি না, না হলে ঢাকায় কোনো দোকানের সাথে বদল করা যায় কি না সে বিষয়টা দেখতে। কলকাতায় যেয়ে দেখি, রব সাহেব রেস্টুরেন্ট বিক্রি করে দিয়েছে। যাক বাচা গেল। শহীদ সাহেব পূর্ব পাঞ্জাব, দিল্লি, জয়পুর, আলোয়ার ঘুরে কলকাতায় এসেছেন; তিনি খুবই চিন্তিত, এই সমস্ত জায়গায় ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানে তিনিই একমাত্র মুসলিম নেতা যিনি সাহস করে এই সমস্ত জায়গায় গিয়ে সচক্ষে সকল অবস্থা দেখে এসেছেন। আমাকে দেখে খুবই খুশি হলেন এবং বললেন, “সত্যিই পূর্ব বাংলার মুসলমানরা কত সভ্য ও ভাল, কোনো দাঙ্গাহাঙ্গামা হচেছ না। তবে হিন্দুরা চলে আসছে, এরাই বিপদ ঘটাবে। আমি শীঘ্রই পূর্ব বাংলায় যাব এবং কয়েকটা সভা করব, যাতে হিন্দুরা না আসে।” শহীদ সাহেব ঢাকা হয়ে খাজা নাজিমুদ্দীনের সাথে পরামর্শ করে বরিশালে সভা করতে যাবেন ঠিক হল।

আমি চলে এলাম ঢাকায়। বরিশালে এক বিরাট সভার আয়োজন হল। শহীদ সাহেব ঢাকায় এসে নাজিমুদ্দীন সাহেবের কাছেই থাকতেন। আমরা স্টিমারে বরিশাল রওয়ানা করলাম। কলকাতা থেকে প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষও এসেছেন। বরিশালে বিকালে সভা শুরু হল, কয়েকজন বক্তৃতা করেছেন। আমাকেও বক্তৃতা করতে হবে, রাত তখন আট ঘটিকা। হবে, এমন সময় একটা টুকরা কাগজ আমার হাতে দিল। আমি শহীদ সাহেবের পাশে বসেছিলাম। তাতে রব সাহেব (আমার ভগ্নিপতি) লিখেছে, “মিয়া ভাই, আব্বার অবস্থা খুবই খারাপ, ভীষণ অসুস্থ। তোমার জন্য বিভিন্ন জায়গায় টেলিফোন করা হয়েছে, যদি দেখতে হয় রাতেই রওয়ানা করতে হবে। হেলেন লেখকের ছোটবোন চলে গিয়াছে তোমাদের বাড়িতে। আমি শহীদ সাহেবকে চিঠিটা পড়ে শোনালাম। তিনি আমাকে রওয়ানা করতে হুকুম দিলেন। তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে প্লাটফর্ম থেকে নেমে রব সাহেবকে দেখলাম, দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞাসা করলাম, “কখন খবর পেয়েছ?” বলল, “গতকাল খবর পেয়েছি। হেলেন রওয়ানা হয়েছে, আমি তোমার জন্য দেরি করছি। কারণ, জানি শহীদ সাহেব যখন আসবেন, তুমিও আসবে।” আমি সোজা মালপত্র নিয়ে রওয়ানা করলাম স্টেশনে আর আধা ঘণ্টা সময় আছে স্টিমার ছাড়তে। স্টিমার ধরতে পারলে আবার আগামীকাল রাতে স্টিমার ছাড়বে।

আমি স্টিমারে চড়ে বসলাম, সমস্ত রাত বসে রইলাম। নানা চিন্তা আমার মনে উঠতে লাগল। আমি তো আমার আব্বার বড় ছেলে। আমি তো কিছুই বুঝি না, কিছুই জানি না সংসারের। কত কথা মনে পড়ল, কত আঘাত আব্বাকে দিয়েছি, তবু কোনোদিন কিছুই বলেন নাই। সকলের পিতাই সকল ছেলেকে ভালবাসে এবং ছেলেরাও পিতাকে ভালবাসে ও ভক্তি করে। কিন্তু আমার পিতার যে স্নেহ আমি পেয়েছি, আর আমি তাঁকে কত যে ভালবাসি সে কথা প্রকাশ করতে পারব না।

ভোরবেলা পাটগাতি স্টেশনে স্টিমার এসে পৌঁছাল। আমার বাড়ি থেকে প্রায় আড়াই মাইল হবে। স্টেশন মাস্টারকে ও অন্যান্য লোকদের জিজ্ঞাসা করলাম, তারা কিছু জানে। কি না আমার আব্বার কথা? সকলেই এক কথা বলে, “আপনার আব্বার খুব অসুখ শুনেছি।” নৌকায় গেলে অনেক সময় লাগে। মালপত্র স্টেশন মাস্টারের কাছে রেখে হেঁটে রওয়ানা করলাম। মধুমতী নদী পার হতে হল। সোজা মাঠ দিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা করলাম। পথঘাটের বালাই নাই। সোজা চষা জমির মধ্য দিয়ে হাঁটলাম। বাড়ি পৌঁছে দেখি আব্বার কলেরা হয়েছে। অবস্থা ভাল না, ডাক্তার আশা ছেড়ে দিয়ে বসে আছে। আমি পৌঁছেই “আব্বা বলে ডাক দিতেই চেয়ে ফেললেন। চক্ষু দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা। আমি আব্বার বুকের উপর মাথা রেখে কেঁদে ফেললাম; আব্বার হঠাৎ যেন পরিবর্তন হল কিছুটা। ভাক্তার বলল, নাড়ির অবস্থা ভাল মনে হয়। কয়েক মুহূর্তের পরেই আব্বা ভালর দিকে। ডাক্তার বললেন, ভয় নাই। আব্বার প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। একটু পরেই প্রস্রাব হল। বিপদ কেটে যাচ্ছে। আমি আব্বার কাছে বসে রইলাম। এক ঘন্টার মধ্যেই ডাক্তার বললেন, আর ভয় নাই। প্রস্রাব হয়ে গেছে। চেহারাও পরিবর্তন হচ্ছে। দুই তিন ঘণ্টা পরে ডাক্তার বাবু বললেন, আমি এখন যাই, সমস্ত রাত ছিলাম। কোনো ভয় নাই বিকালে আবার দেখতে আসব।

আমি বাড়িতে রইলাম কিছুদিন। আব্বা আস্তে আস্তে আরোগ্য লাভ করলেন। যে ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত তাদের মত হতভাগা দুনিয়াতে আর কেউ নাই। আর যারা বাবা মায়ের স্নেহ আর আশীর্বাদ পায় তাদের মত সৌভাগ্যবান কয়জন!

 

২৯.

আমি ঢাকায় এলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি, আইন পড়ব। বই পুস্তক কিছু কিনলাম। ঢাকায় এসে শুনলাম গণতান্ত্রিক যুবলীগের এক সভা হয়ে গেছে। কার্যকরী কমিটির নতুন সভ্য কো-অপ্ট করা হয়েছে। পূর্বে ছিলাম সতেরজন এখন হয়েছি চৌত্রিশজন। কারণ, আমাদের সংখ্যালঘু করার ষড়যন্ত্র। আমাদের অনেকে নোটিশও পায় নাই। অন্য কোনো কাগজ না ছাপলেও কলকাতার ইত্তেহাদ কাগজ আমাদের সংবাদ ছাপত। ইত্তেহাদেও নোটিশ ছাপানো হয় নাই। আমি আপত্তি তুললাম এবং বললাম, সতেরজন সদস্য, কেমন করে আরও সতেরজন কো-অপ্ট করতে পারে? সভা ডাকা হোক। কিছুদিন পরে খবর পেলাম, ময়মনসিংহে সভা ডাকা হয়েছে। সকলে নোটিশ পেয়েছে, আমাকে দেওয়া হয় নাই। নোয়াখালীর আজিজ মোহাম্মদ ঢাকা সিটি মুসলিম লীগের সেক্রেটারি ছিলেন, তিনি নোটিশ পেয়ে আমাকে বললেন, আগামী দিনই সভা হবে সকাল নয়টায়। দেখলাম আমরা তিনজন সভ্য ঢাকায় আছি। আজিজ সাহেব, ঢাকার শামসুল হুদা সাহেব (এখন। কনভেনশন মুসলিম লীগ করেন) ও আমি। ঠিক করলাম তিনজনই যাব এবং বাধা দিব। অন্য কোনো জেলায় খবর দেওয়ার সময় হবে না। রাতেই আমাদের রওয়ানা করতে হবে। কারণ একটা মাত্র ট্রেন ছাড়ে রাত দশটায়, ভোর তিনটায় পৌঁছায় ময়মনসিংহ। ভোর পর্যন্ত আমরা স্টেশনেই ছিলাম। হক সাহেবের কোনো খবর নাই। তিনি সভায় আসেন নাই। আমরা সভায় উপস্থিত হলাম এবং বৈধতার প্রশ্ন তুললাম। আমাকে ও অনেককে নোটিশ দেওয়া হল না কেন? তারা একটা ম্যানিফেষ্টো করে এনেছেন। আমরা বললাম, নোটিশ দিয়ে সভা ডাকা হোক ঢাকায় এবং সেখানে ম্যানিফেস্টো গ্রহণ করা হবে কি হবে না ঠিক করা হবে। এত তাড়াহুড়া করা উচিত হবে না। আর আমরা কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে যোগদান করতে পারি না। কারণ মুসলিম লীগের এখনও কাউন্সিল সদস্য আমরা। অনেক তর্কবিতর্ক হল, তারপর যখন দেখলাম যে, কিছুতেই শুনছে না, সকলেই প্রায় কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন বা তাদের সমর্থকরা উপস্থিত হয়েছে তখন বাধ্য হয়ে আমরা সভা ত্যাগ করলাম। আর বলে এলাম, মুসলিম লীগের কোনো কর্মী আপনাদের এই ষড়যন্ত্রে থাকবে না। যুবলীগও আজ থেকে শেষ। আপনাদের ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা আমাদের জানা আছে। আমাদের নাম কোথাও রাখবেন না।

মোগলটুলীতে যুবলীগের অফিস ছিল। আমরা বোর্ডটা নামিয়ে দিলাম। এর মধ্যেই তারা ম্যানিফেস্টো ছাপিয়ে ফেলেছে। অফিসেও নিয়ে এসেছে। শওকত মিয়াই এই অফিসের কর্তা। তিনি হুকুম দিলেন, যুবলীগের সকল কিছু এখান থেকে নিয়ে যেতে। কে নিবে? কাউকেও দেখা গেল না। পুলিশ অফিসে তল্লাশি দিল। আমাদের নামও আইবি খাতায় উঠল। ১৫০ নম্বর মোগলটুলী থেকে পাকিস্তানের আন্দোলন হয়েছে, সেই লীগ অফিসেই এখন গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারীরা পাহারা দিতে শুরু করল গোপনে গোপনে। আমরা সকলে শহীদ সাহেবের ভক্ত ছিলাম। এটাই আমাদের দোষ। আমরা সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য যাতে বজায় থাকে তার চেষ্টাই করতে থাকলাম।

মানিক ভাই তখন কলকাতায় ইত্তেহাদ কাগজের সেক্রেটারি ছিলেন। আমাদের টাকা পয়সার খুবই প্রয়োজন। কে দিবে? বাড়ি থেকে নিজেদের লেখাপড়ার খরচটা কোনোমতে আনতে পারি, কিন্তু রাজনীতি করার টাকা কোথায় পাওয়া যাবে? আমার একটু স্বচ্ছল অবস্থা ছিল, কারণ আমি ইত্তেহাদ কাগজের পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি ছিলাম। মাসে প্রায় তিনশত টাকা পেতাম। আমার কাজ ছিল এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে টাকা পয়সা আদায় করা, আর ইত্তেহাদ কাগজ যাতে চলে এবং নতুন এজেন্ট বিভিন্ন জায়গায় নিয়োগ করা যায় সেটা দেখা। বেশি দিন ছিলাম না। তবু অসুবিধা হওয়ার কথা না, কারণ কাগজে নাম আছে, টাকা বাড়ি থেকেও কিছু পাওয়া যাবে।।

নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের নাম বদলিয়ে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ করা হয়েছে। শাহ আজিজুর রহমান সাহেবই জেনারেল সেক্রেটারি রইলেন। ঢাকায় কাউন্সিল সভা না করে অন্য কোথাও তারা করলেন গোপনে। কার্যকরী কমিটির সদস্য প্রায় অধিকাংশই ছাত্র নয়, ছাত্র রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন। ১৯৪৪ সালে সংগঠনের নির্বাচন হয়েছিল, আর হয় নাই। আমরা ঐ কমিটি মানতে চাইলাম না। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ও জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। তারা এই প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত নয়। আমি ছাত্রলীগ কর্মীদের সাথে আলাপ-আলোচনা শুরু করলাম। আজিজ আহমেদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, আবদুল হামিদ চৌধুরী, দবিরুল ইসলাম, নইমউদ্দিন, মোল্লা জালালউদ্দিন, আবদুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মতিন খান চৌধুরী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং আরও অনেক ছাত্রনেতা একমত হলেন, আমাদের একটা প্রতিষ্ঠান করা দরকার। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি তারিখে ফজলুল হক মুসলিম হলের এ্যাসেম্বলি হলে এক সভা ডাকা হল, সেখানে স্থির হল একটা ছাত্র প্রতিষ্ঠান করা হবে। যার নাম হবে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। নইমউদ্দিনকে কনভেনর করা হল। অলি আহাদ এর সভ্য হতে আপত্তি করল। কারণ সে আর সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান করবে না। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নাম দিলে সে থাকতে রাজি আছে। আমরা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম এবং বললাম, “এখনও সময় আসে নাই। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দেশের আবহাওয়া চিন্তা করতে হবে। নামে কিছুই আসে যায় না। আদর্শ যদি ঠিক থাকে, তবে নাম পরিবর্তন করতে বেশি সময় লাগবে না। কয়েক মাস হল পাকিস্তান পেয়েছি। যে আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তান পেয়েছি, সেই মানসিক অবস্থা থেকে জনগণ ও শিক্ষিত সমাজের মত পরিবর্তন করতে সময় লাগবে।”

প্রতিষ্ঠানের অফিস করলাম ১৫০ নম্বর মোগলটুলী। মুসলিম লীগ নেতারা কয়েকবার চেষ্টা করেছেন এই অফিসটা দখল করতে, কি শওকত মিয়ার জন্য পারেন নাই। আমরা মুসলিম লীগ ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ নাম দিয়ে সাইন বোর্ড লাগিয়ে দিয়েছিলাম। এখন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অফিসও করা হল। শওকত মিয়া টেবিল, চেয়ার, আলমারি সকল কিছুই বন্দোবস্ত করল। তাকে না হলে, আমাদের কোন কাজই হত না তখন। আমরা যে কয়েকজন তার সাথে মোগলটুলীতে থাকতাম, আমাদের খাওয়া থাকার ভার তার উপরই ছিল। মাসে যে যা পারতাম, তার কাছে পৌঁছে দিতাম। সেই দেখাশোনা করত।

ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠান গঠন করার সাথে সাথে বিরাট সাড়া পাওয়া গেল ছাত্রদের মধ্যে। এক মাসের ভিতর আমি প্রায় সকল জেলায়ই কমিটি করতে সক্ষম হলাম। যদিও নইমউদ্দিন কনভেনর ছিল, কিন্তু সকল কিছুই প্রায় আমাকেই করতে হত। একদল সহকর্মী পেয়েছিলাম, যারা সত্যিকারের নিঃস্বার্থ কর্মী। পূর্ব পাকিস্তান সরকার প্রকাশ্যে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগকে সাহায্য করত। আর আমাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা লাগিয়ে দিত। অন্যদিকে বাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব মুসলিম লীগ ন্যাশনাল গার্ড ভেঙে দিতে হুকুম দিলেন। জহিরুদ্দিন, মির্জা গোলাম হাফিজ এবং আরও কয়েকজন আপত্তি করল। কারণ, পাকিস্তানের জন্য এবং পাকিস্তান হওয়ার পরে এই প্রতিষ্ঠান রীতিমত কাজ করে গিয়েছে। রেলগাড়িতে কর্মচারীর অভাব, আইনশৃঙ্খলা ও সকল বিষয়ই এই প্রতিষ্ঠান কাজ করেছে। হাজার হাজার ন্যাশনাল গার্ড ছিল। এদের দেশের কাজে না লাগিয়ে ভেঙে দেওয়ার হুকুমে কর্মীদের মধ্যে একটা ভীষণ বিদ্বেষ ভাব দেখা গেল। ন্যাশনাল গার্ডের নেতারা সম্মেলন করে ঠিক করলেন তারা প্রতিষ্ঠান চালাবেন। জহিরুদ্দিনকে সালারে-সুবা করা হল। জহিরুদ্দিন ঢাকায় আসার কিছুদিন পরেই তাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হল মোগলটুলী অফিস থেকে। মোগলটুলীতেই ন্যাশনাল গার্ডের অফিস করা হয়েছিল। তিনতলা বাড়ি, অনেক জায়গা ছিল। দেড় মাস কি দুই মাস পরে জহিরুদ্দিন মুক্তি পেল। অনেক নেতা ভয় পেয়ে গেল। মিস্টার মোহাজের, যিনি বাংলার ন্যাশনাল গার্ডের সালারে-সুবা ছিলেন তাকে নাজিমুদ্দীন সাহেব কি বললেন, জানি না। তিনি খবরের কাগজে ঘোষণা করলেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে, ন্যাশনাল গার্ডের আর দরকার নাই। এই রকম একটা সুপ্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান জাতীয় সরকার দেশের উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার না করে দেশেরই ক্ষতি করলেন। এই সংগঠনের কর্মীরা যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করেছেন, অনেক নেতার চেয়েও বেশি। অনেকে আমাদের বললেন, এদের দিয়ে যে কাজ করাব, টাকা পাব কোথায়? এরা টাকা চায় নাই। সামান্য খরচ পেমেই বৎসরের পর বৎসর কাজ করতে পারত। আস্তে আস্তে এদের আনসার বাহিনীতে নিয়োগও করতে পারতেন। এদের অনেক দিন পর্যন্ত ট্রেনিংও দেওয়া হয়েছিল। আমাদের এই সমস্ত নেতাদের লীলাখেলা বুঝতে কষ্ট হয়েছিল। ন্যাশনাল গার্ডদের বেতনও দেওয়া হত না। ন্যাশনাল গার্ড ও মুসলিম লীগ কর্মীদের মধ্যে যে প্রেরণা ছিল পাকিস্তানকে গড়বার জন্য তা ব্যবহার করতে নেতারা পারলেন না।।

জনগণ ও সরকারি কর্মচারীরা রাতদিন পরিশ্রম করত। অনেক জায়গায় দেখেছি একজন কর্মচারী একটা অফিস চালাচ্ছে। একজন জমাদার ও একজন সিপাহি সমস্ত থানায় লীগ কর্মীদের সাহায্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করছে। জনসাধারণ রেলগাড়িতে যাবে টিকিট নাই, টাকা জমা দিয়ে গাড়িতে উঠেছে। ম্যাজিকের মত দুর্নীতি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

আস্তে আস্তে সকল কিছুতেই ভাটি লাগল, শুধু সরকারের নীতির জন্য। তারা জানত, কি করে একটা জাগ্রত জাতিকে দেশের কাজে ব্যবহার করতে হয় এবং জাতিকে গঠনমূলক কাজে লাগান যায়। হাজার হাজার কর্মী এদিক ওদিক ছিটকে পড়ল। কাজও ছিল এবং কর্মীও ছিল কিন্তু তাদের ব্যবহার করা হল না। এর একটা বিশেষ কারণ হল, যাদের কাছে ক্ষমতা এল তারা জনসাধারণের ওপর আস্থা রাখতে পারেন নাই। কারণ, জনসাধারণের সাথে এদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। যে কয়েকজন লোক প্রদেশের শাসন ক্ষমতা হাতে পেলেন, তারা সকলেই প্রায় ইংরেজ ঘেঁষা নেতা ছিলেন। ইংরেজকে তেল দিয়ে স্যার, খান বাহাদুর, খান সাহেব উপাধি নিয়েছেন। এরা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করতে শুরু করলেন ইংরেজ আমলের আমলাতন্ত্রের উপর। আমলাতন্ত্রের কর্ণধাররা যা বলতেন তাই শুনতেন। এই সকল কর্মচারীরা অনেকেই ইংরেজকে খুশি করার জন্য গায়ে পড়ে প্রমোশনের লোভে স্বাধীনতার জন্য যে সমস্ত নিঃস্বার্থ কর্মী সংগ্রাম করেছে তাদের উপর অকথ্য অত্যাচার করেছেন, যার ভূরি ভূরি প্রমাণ আজও আছে।

স্বাধীনতা পাওয়ার সাথে সাথে এরা অনেকেই দুই তিন ধাপ প্রমোশন পেলেন এবং এতে মাথা অনেকের খারাপ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। আর স্যার ও খান বাহাদুরের দল এদের হাতের পুতুলে পরিণত হল। স্বাধীন দেশের স্বাধীন জনগণকে গড়তে হলে এবং তাদের আস্থা অর্জন করতে হলে যে নতুন মনোভাবের প্রয়োজন ছিল তা এই নেতৃবৃন্দ গ্রহণ করতে পারলেন না। এদিকে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান মুসলিম লীগকে তাদের হাতের মুঠায় নেবার জন্য এক নতুন পন্থা অবলম্বন করলেন। পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পরে মুসলিম লীগও দুই ভাগ হল। এক ভাগ রইল ভারতবর্ষে নাম হল। নিখিল ভারত মুসলিম লীগ, আরেক ভাগের নাম হল পাকিস্তান মুসলিম লীগ।

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বড়লাট হওয়ার ফলে আর মুসলিম লীগের সভাপতি থাকতে পারেন নাই। তাই চৌধুরী খালিকুজ্জামান সাহেবকে পাকিস্তান মুসলিম লীগের ভার দেওয়া হল। তিনি পাকিস্তান মুসলিম লীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠান ভেঙে দিয়ে একটা এডহক কমিটি গঠন করলেন। পাঞ্জাবও ভাগ হয়েছিল, কিন্তু পাঞ্জাব মুসলিম লীগ ভাঙলেন না। সিন্ধুও না, সীমান্তও না, একমাত্র বাংলাদেশ। কারণ, এখানে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সমর্থক বেশি। তাই নতুন করে লীগ গঠন করতে হবে নাজিমুদ্দীন সাহেবের সমর্থকদের নিয়ে। মওলানা আকরম খাঁ সাহেবকে চিফ অর্গানাইজার করলেন। আমরা তাড়াতাড়ি একশত বারজন কাউন্সিল সদস্যের দস্তখত নিয়ে একটা রিকুইজিশন সভা আহ্বান করার দাবি করলাম। মোহাম্মদ আলী, তোফাজ্জল আলী, ডাক্তার মালেক, আবদুস সালাম খান, এম. এ. সবুর, আতাউর রহমান খান, কামরুদ্দিন, শামসুল হক, আনোয়ারা খাতুন, খয়রাত হোসেন ও অনেকে এতে দস্তখত করলেন। আমি ঘুরে ঘুরে দস্তখত জোগাড় করলাম। দু’একটা জেলায়ও আমাকে যেতে হয়েছিল। রিকুইজিশন সভার জন্য যে কয়েকজন সদস্যের দরকার তাদের দস্তখত নিয়ে নোটিশ তৈরি করা হল। মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের কাছে পৌঁছাতে হবে এই নোটিশটা। কেউই যেতে রাজি হল না। শেষ পর্যন্ত আমার উপরই ভার পড়ল। এই সময় আমাদের আলোচনা সভা জনাব তোফাজ্জেল আলী সাহেবের বাড়িতেই হত। কি করি আমারও লজ্জা করতে লাগল তার সামনে যেয়ে নোটিশটা দিতে। আমি শেষ পর্যন্ত তার কলতাবাজার আজাদ অফিসে হাজির হলাম। খবর দিলে তিনি আমাকে কামরায় ডেকে পাঠালেন। আমি তাঁকে সালাম করে তার হাতে নোটিশ দিলাম এবং তিনি যে নোটিশটা পেলেন তা লিখে দিলে খুশি হব বললাম। মওলানা সাহেব লিখে দিলেন। তিনি আমার সাথে খুব ভাল ব্যবহার করলেন এবং কেমন আছি জিজ্ঞাসা করলেন। আমি তার কাছ থেকে ভাগতে পারলে বাচি। তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়ে ছুটলাম।

পরের দিন আজাদ কাগজে তিনি নোটিশটা এবং যারা দস্তখত করেছে তাদের নাম ছেপে দিলেন এবং এক বিবৃতির মারফত ঘোষণা করলেন যে, রিকুইজিশন সভা আহ্বান করার ক্ষমতা কারও নাই, কারণ পুরানা প্রতিষ্ঠান ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এখন তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের এডহক কমিটির সভাপতি। অর্থাৎ আমরা কেউই আর মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সভ্য নই। এভাবে মুসলিম লীগ থেকেও আমরা বিতাড়িত হলাম। অনেকেই চুপ করে গেল, আমরা রাজি হলাম না। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে দেখব।

 

৩০.

ফেব্রুয়ারি ৮ই হবে, ১৯৪৮ সাল। করাচিতে পাকিস্তান সংবিধান সভার (কন্সটিটিউয়েন্ট এ্যাসেম্বলি) বৈঠক হচ্ছিল। সেখানে রাষ্ট্রভাষা কি হবে সেই বিষয়ও আলোচনা চলছিল। মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ লীগ সদস্যেরও সেই মত। কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবি করলেন বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক। কারণ, পাকিস্তানের সংখ্যাগুরুর ভাষা হল বাংলা। মুসলিম লীগ সদস্যরা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। আমরা দেখলাম, বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমুদ্দুন মজলিস এর প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। আমরা সভা করে প্রতিবাদ শুরু করলাম। এই সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমুদ্দুন মজলিস যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে একটা রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করল। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কিছু শাখা জেলায় ও মহকুমায় করা হয়েছে। তদুন মজলিস একটা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান যার নেতা ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাশেম সাহেব। এদিকে পুরানা লীগ কর্মীদের পক্ষ থেকে জনাব কামরুদ্দিন সাহেব, শামসুল হক সাহেব ও অনেকে সংগ্রাম পরিষদে যোগদান করলেন। সভায় ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চকে বাংলা ভাষা দাবি’ দিবস ঘোষণা করা হল। জেলায় জেলায় আমরা বের হয়ে পড়লাম। আমি ফরিদপুর, যশোর হয়ে দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশালে ছাত্রসভা করে ঐ তারিখের তিন দিন পূর্বে ঢাকায় ফিরে এলাম। দৌলতপুরে মুসলিম লীগ সমর্থক ছাত্ররা আমার সভায় গোলমাল করার চেষ্টা করলে খুব মারপিট হয়, কয়েকজন জখমও হয়। এরা সভা ভাঙতে পারে নাই, আমি শেষ পর্যন্ত বক্তৃতা করলাম। এ সময় জনাব আবদুস সবুর খান আমাদের সমর্থন করছিলেন। বরিশালের জনাব মহিউদ্দিন আহমদ তখন নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সদস্য, মুসলিম লীগ ও সরকারের পুরা সমর্থক। কাজী বাহাউদ্দিন আহমদ আমাদের দলের নেতা ছিলেন। আমি কলেজেই সভা করেছিলাম। মহিউদ্দিন সাহেব বাধা দিতে চেষ্টা করেন নাই। ঢাকায় ফিরে এলাম। রাতে কাজ ভাগ হলকে কোথায় থাকব এবং কে কোথায় পিকেটিং করার ভার নেব। সামান্য কিছু সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাড়া শতকরা নব্বই ভাগ ছাত্র এই আন্দোলনে যোগদান করল। জগন্নাথ কলেজ, মিটফোর্ড, মেডিকেল স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বিশেষ করে সক্রিয় অংশগ্রহণ করল। মুসলিম লীগ ভাড়াটিয়া গুণ্ডা লেলিয়ে দিল আমাদের উপর। অধিকাংশ লোককে আমাদের বিরুদ্ধে করে ফেলল। পুরান ঢাকার কয়েক জায়গায় ছাত্রদের মারপিটও করল। আর আমরা পাকিস্তান ধ্বংস করতে চাই এই কথা বুঝাবার চেষ্টা করল।

১১ই মার্চ ভোরবেলা শত শত ছাত্রকর্মী ইডেন বিল্ডিং, জেনারেল পোস্ট অফিস ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করল। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে কোনো পিকেটিংয়ের দরকার হয় নাই। সমস্ত ঢাকা শহর পোস্টারে ভরে ফেলা হল। অনেক দোকানপাট বন্ধ ছিল, কিছু খোলাও ছিল। পুরান ঢাকা শহরে পুরাপুরি হরতাল পালন করে নাই। সকাল আটটায় জেনারেল পোস্ট অফিসের সামনে ছাত্রদের উপর ভীষণভাবে লাঠিচার্জ হল। একদল মার খেয়ে স্থান ত্যাগ করার পর আরেকদল হাজির হতে লাগল। ফজলুল হক হলে আমাদের রিজার্ভ কর্মী ছিল। এইভাবে গোলমাল, মারপিট চলল অনেকক্ষণ। নয়টায় ইডেন বিল্ডিংয়ের সামনের দরজায় লাঠিচার্জ হল। খালেক নেওয়াজ খান, বখতিয়ার (এখন নওগাঁর এডভোকেট), শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এম. এ. ওয়াদুদ গুরুতররূপে আহত হল। তোপখানা রোডে কাজী গোলাম মাহাবুব, শওকত মিয়া ও আরও অনেক ছাত্র আহত হল। আবদুল গনি রোডের দরজায় তখন আর ছাত্ররা অত্যাচার ও লাঠির আঘাত সহ্য করতে পারছে না। অনেক কর্মী আহত হয়ে গেছে এবং সরে পড়ছে। আমি জেনারেল পোস্ট অফিসের দিক থেকে নতুন কর্মী নিয়ে ইডেন বিল্ডিংয়ের দিকে ছুটেছি, এর মধ্যে শামসুল হক সাহেবকে ইডেন বিন্ডিংয়ের সামনে পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। গেট খালি হয়ে গেছে। তখন আমার কাছে সাইকেল। আমাকে গ্রেফতার করার জন্য সিটি এসপি জিপ নিয়ে বার বার তাড়া করছে, ধরতে পারছে না। এবার দেখলাম উপায় নাই। একজন সহকর্মী দাঁড়ান ছিল তার কাছে সাইকেল দিয়ে চার পাঁচজন ছাত্র নিয়ে আবার ইডেন বিল্ডিংয়ের দরজায় আমরা বসে পড়লাম এবং সাইকেল যাকে দিলাম তাকে বললাম, শীঘ্রই আরও কিছু ছাত্র পাঠাতে। আমরা খুব অল্প, টিকতে পারব না। আমাদের দেখাদেখি আরও কিছু ছাত্র ছুটে এসে আমাদের পাশে বসে পড়ল। আমাদের উপর কিছু উত্তম মধ্যম পড়ল এবং ধরে নিয়ে জিপে তুলল। হক সাহেবকে পূর্বেই জিপে তুলে ফেলেছে। বহু ছাত্র গ্রেফতার ও জখম হল। কিছু সংখ্যক ছাত্রকে গাড়ি করে ত্রিশ-চল্লিশ মাইল দূরে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে আসল। কয়েকজন ছাত্রীও মার খেয়েছিল। অলি আহাদও গ্রেফতার হয়ে গেছে। তাজউদ্দীন, তোয়াহা ও অনেককে গ্রেফতার করতে পারে নাই। আমাদের প্রায় সত্তর-পঁচাত্তরজনকে বেঁধে নিয়ে জেলে পাঠিয়ে দিল সন্ধ্যার সময়। ফলে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠল। ঢাকার জনগণের সমর্থনও আমরা পেলাম।

তখন পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার অধিবেশন চলছিল। শোভাযাত্রা রোজই বের হচ্ছিল। নাজিমুদ্দীন সাহেব বেগতিক দেখলেন। আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে। ওয়াদুদ ও বখতিয়ার দুজনই ছাত্রলীগ কর্মী, তাদের ভীষণভাবে আহত করে জেল হাসপাতালে রাখা হয়েছে। এই সময় শেরে বাংলা, বগুড়ার মোহাম্মদ আলী, তোফাজ্জল আলী, ডা. মালেক, সবুর সাহেব, খয়রাত হোসেন, আনোয়ারা খাতুন ও আরও অনেকে মুসলিম লীগ পার্টির বিরুদ্ধে ভীষণভাবে প্রতিবাদ করলেন। আবার শহীদ সাহেবের দল এক হয়ে গেছে। নাজিমুদ্দীন সাহেব ঘাবড়িয়ে গেলেন এবং সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলাপ করতে রাজি হলেন।

আমরা জেলে, কি আলাপ হয়েছিল জানি না। তবে সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে কামরুদ্দিন সাহেব জেলে আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং বললেন, নাজিমুদ্দীন সাহেব এই দাবিগুলি মানতে রাজি হয়েছেন: এখনই পূর্ব পাকিস্তানের অফিসিয়াল ভাষা বাংলা করে ফেলবে। পূর্ব পাকিস্তান আইনসভা থেকে সুপারিশ করবেন, যাতে কেন্দ্রে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হয়। সমস্ত মামলা উঠিয়ে নিবেন, বন্দিদের মুক্তি দিবেন এবং পুলিশ যে জুলুম করেছে সেই জন্য তিনি নিজেই তদন্ত করবেন। আর কি কি ছিল আমার মনে নাই। তিনি নিজেই হোম মিনিস্টার, আবার নিজেই তদন্ত করবেন এ যেন এক প্রহসন।

আমাদের এক জায়গায় রাখা হয়েছিল জেলের ভিতর। যে ওয়ার্ডে আমাদের রাখা হয়েছিল, তার নাম চার নম্বর ওয়ার্ড। তিনতলা দালান। দেওয়ালের বাইরেই মুসলিম গার্লস স্কুল। যে পাঁচ দিন আমরা জেলে ছিলাম সকাল দশটায় মেয়েরা স্কুলের ছাদে উঠে শ্লোগান দিতে শুরু করত, আর চারটায় শেষ করত। ছোট্ট ছোট্ট মেয়েরা একটু ক্লান্তও হত না। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই,’ বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই,’ ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’—নানা ধরনের শ্লোগান। এই সময় শামসুল হক সাহেবকে আমি বললাম, “হক সাহেব ঐ দেখুন, আমাদের বোনেরা বেরিয়ে এসেছে। আর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে পারবে না।” হক সাহেব আমাকে বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ, মুজিব।”

আমাদের ১১ তারিখে জেলে নেওয়া হয়েছিল, আর ১৫ তারিখ সন্ধ্যায় মুক্তি দেওয়া হয়। জেলগেট থেকে শোভাযাত্রা করে আমাদের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে নিয়ে যাওয়া হল। ১৩ তারিখ সন্ধ্যায় কারাগারের ভিতর একটা গোলমাল হয়। একজন অবাঙালি জমাদার আমাদের ওয়ার্ডে তালা বন্ধ করতে এসেছে। আমরা আমাদের জাগায় এই সময় বসে থাকতাম। জমাদার সাহেব এক দুই গণনা করে দেখতেন, আমরা সংখ্যায় ঠিক আছি কি না। হিসাব মিললে বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দিতেন। সন্ধ্যার সময় জেলখানার সমস্ত কয়েদিদের গণনা করে বাইরে থেকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে বন্ধ করা হয়। জমাদার কয়েকবার গণনা করলেন, কিন্তু হিসাব ঠিক হচ্ছে না। পাশের আরেকটা রুমেও আমাদের কিছু ছাত্র ছিল, তাদের গণনা ঠিক হয়েছে। ছোট ছোট কয়েকজন ছাত্র ছিল, তারা কারও কথা শুনতে চাইত না। গণনার সময় এক জায়গা ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যেত। আমি ও শামসুল হক সাহেব সকলকে ধমকিয়ে বসিয়ে রাখতাম। আমরা দুইজন ও আবদুল মান্নান (এখন নবকুমার হাইস্কুলের হেডমাস্টার) এই তিনজনই একটু বয়সে বড় ছিলাম। খাওয়ার ভাগ বাটোয়ারার ভার মান্নান সাহেবের উপরই ছিল। হিসাব যখন মিলছে না তখন জমাদার সাহেব রাগ করে ফেললেন এবং কড়া কথা বললেন। এতে ছাত্ররা ক্ষেপে জায়গা ছেড়ে উঠে পড়ল এবং হৈচৈ শুরু করল। আমি ও হক সাহেব আবার সকলকে এক জায়গায় বসিয়ে দিলাম। জমাদার সাহেব গণনা করলেন এবং হিসাব মিলল। কিন্তু দরজার বাইরে যেয়ে তিনি হঠাৎ বাঁশি বাজিয়ে দিলেন এবং পাগলা ঘণ্টা বেজে গেল। পাগলা ঘণ্টার অর্থ বিপদ সংকেত। এ অবস্থায় জেল সিপাহিরা যে যে অবস্থায় থাকুক না কেন, বন্দুক লাঠিসোটা নিয়ে ভিতরে আসে এবং দরকার হলে মারপিট শুরু করে। এই সময় আইন বলে কিছুই থাকে না। সিপাহিরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে, যদিও সুবেদার হাওলাদার তাদের সাথে থাকে। জেলার ও ডেপুটি জেলার সাহেবরাও ভিতরের দিকে ছুটতে থাকেন।

আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না, কি হয়েছে। যে বাঙালি সিপাহি আমাদের ওখানে ডিউটিতে ছিল সে তালা বন্ধ করে ফেলেছে। জমাদার তার কাছে চাবি চাইল। সে চাবি দিতে আপত্তি করল। এ নিয়ে দুইজনের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হল, আমরা দেখতে পেলাম। সিপাহি চাবি নিয়ে এক দৌড়ে দোতলা থেকে নিচে নেমে গেল। জমাদারের ইচ্ছা ছিল দরজা খুলে সিপাহিদের নিয়ে ভিতরে ঢুকে আমাদের মারপিট করবে। জেলার, ডেপুটি জেলার বা সুপারিনটেনডেন্ট সাহেব ভিতরে আসবার পূর্বেই আমরা বুঝতে পেরে সকলকে তাড়াতাড়ি যার যার জায়গায় বসতে বলে শামসুল হক সাহেব ও আমি দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাদের না মেরে ভিতরে যেন কেউ না আসতে পারে এই উদ্দেশ্যে। এ কথাও সকলকে বলে দিলাম যে, আমরা মার না খাওয়া পর্যন্ত কেউ হাত তুলবে না। যদি আমাদের আক্রমণ করে এবং মারপিট করে তখন টেবিল, চেয়ার, থালা, বাটি যা আছে তাই দিয়ে প্রতিরোধ করতে হবে। হক সাহেব ও আমি দুইজনই একগুয়ে ছিলাম। দরকার হলে সমানে হাতও চালাতে পারতাম, আর এটা আমার ছোট্টকাল থেকে বদ অভ্যাসও ছিল। সিপাহি যদি চাবি না নিয়ে ভাগত তবে আমাদের মার খেতে হত, সে সম্বন্ধে সন্দেহ ছিল না। কারণ, আমরা তো একটা রুমে বন্ধ। এর মধ্যে বহু সিপাহি চলে এসেছে, তারা অসভ্য ভাষায় গালাগালি করছিল। এমন সময় জেলার সাহেব ও ডেপুটি জেলার জনাব মোখলেসুর রহমান আমাদের গেটে এসে দাঁড়িয়ে সিপাহিদের নিচে যেতে হুকুম দিলেন। কিছু সময়ের মধ্যে জেল সুপারিনটেনডেন্ট মি, বিলও এসে হাজির হলেন এবং ঘটনা শুনে সিপাহিদের যেতে বললেন। সুপারিনটেনডেন্ট সাহেবকে শামসুল হক সাহেব সমস্ত ঘটনা বললেন

এই বিল সাহেবই ১৯৫০ সালে রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে রাজবন্দিদের উপর গুলি করে কয়েকজন দেশপ্রেমিককে হত্যা করেছিলেন। পরে আমরা বুঝতে পারলাম একটা ষড়যন্ত্র হয়েছিল, আমাদের মারপিট করার জন্য। পরের দিন ডেপুটি জেলার মোখলেসুর রহমান সাহেব আমাদের জেলের আইনকানুন ও নিয়ম সম্বন্ধে অনেক কিছু বললেন। আমি যদিও কয়েকদিন হাজত খেটেছিলাম ছোটবেলায়, তবু জেলের আইনকানুন কিছুই বুঝতাম না, আর জানতাম না। দু’একখানা বই পড়ে যা কিছু সামান্য জ্ঞান হয়েছিল জেল সম্বন্ধে। একথা সত্য, আইনকানুন ছাত্ররা একটু কমই মানত জেলখানায়। শামসুল হক সাহেব, মান্নান সাহেব ও আমি—এই তিনজনই সকলকে বুঝিয়ে রাখতাম। এদের মধ্যে অনেকে স্কুলের ছাত্রও ছিল। নয় কি দশ বছরের একটা ছেলেও ছিল আমাদের সাথে। তার বাবা তার সাথে জেলগেটে দেখা করতে এসেছিল এবং তাকে বলেছিল, “তোকে আজই বের করে নিব।” ছেলেটা তার বাবাকে বলেছিল, অন্যান্য ছাত্রদের না ছাড়লে আমি যাব না।” সে যখন এই কথা ফিরে এসে আমাদের বলল, তখন সকলে তাকে আদর করতে লাগল এবং তার নামে জিন্দাবাদ’ দিল। তার নাম আজ আর আমার মনে নাই, তবে কথাগুলো মনে আছে। ভীষণ শক্ত ছেলে ছিল। গ্রেফতারকৃত একজন ছাত্রেরও মনোবল নষ্ট হয় নাই। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যে কোনো ত্যাগ তারা স্বীকারে প্রস্তুত ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *