2 of 4

২.০৮ সুন্দরী জুমুর‍্যুদ এবং আলী শার-এর কাহিনী

সুন্দরী জুমুর‍্যুদ এবং আলী শার-এর কাহিনী

তিনশো ষোলতম রজনীতে শাহরাজাদ। নতুন কাহিনী বলতে শুরু করে :

দুনিয়াজাদ এতক্ষণ নিচে গালিচার ওপর ঘাপটি মেরে শুয়ে ছিলো। এবার সে দিদির পাশে এসে বসে।

শাহরাজাদ শুরু করে–

অনেকাল আগের কথা। খোরশান শহরে এক ধনী ব্যবসায়ী থাকত। তার নাম ছিলো গ্লোরি। আলী শার নামে তার চাঁদের মত ফুটফুটে একটা ছেলে ছিলো। খুব বুড়ো হয়ে পড়ায় ব্যবসাদারের শরীরটাও অকেজো হয়ে পড়েছিলো। শেষ সময় ঘনিয়ে আসছে বুঝতে পেরে বুড়ো একদিন ছেলেকে ডেকে বলে, আমি তো চললাম, যাবার আগে তোকে কটা কথা বলে যাই।

ছেলে জিজ্ঞেস করে, —কী কথা আব্ববাজান?

ব্যবসায়ী বলে, -বাপজান, এ দুনিয়ার সঙ্গে কখনো যেন জড়িয়ে না পড়িস। বলতে গেলে সারা দুনিয়াটাই তো একটা কামারশালা। তোকে হয় পোড়াবে, নয়ত ওর আগুনের ফুলকিতে তোর চোখ দুটো কানা করে দেবে। আর তাও যদি না পারে তাহলে ধোঁয়ার চোটে দম বন্ধ করে। দেবে। তাই ত কবিরা বলেন–

জীবনের এই আঁধার পথে নেইকো বন্ধু নেইকো আশা।
কোথাও খুঁজে পাবে নাকে প্রাণ-পিয়াসী ভালোবাসা।
ভালো যদি বাসতে চাওরে, ভালোবাস নির্জনতা।
নির্জনতা একাই খাঁটি, তার নেইকো কোন আবিলতা।

অথবা

এই দুনিয়ার দেখবে ছবি? দুই পাশেতেই আঁকা সে কি?
হয়ত হবে!–তাই তো মোরা সবাই দেখি!
সামনেতে তার ভণ্ডামি আর আঁকা আছে মিথ্যা আচার
পেছনেতে মিথ্যা আঁকা, আর যা আছে তাই তো মেকি!

আর একজন কবি এ বিষয়ে কি বলেছেন শোনো–

ভ্ৰান্ত এক নিস্ফলতা এ পৃথিবী জামার মতন পরে আছে।
কোটের খোলস যেন। কোন দিন সেই শূন্য আঙ্গিনার মাঝে
বন্ধু যদি কদাচিৎ মিলে যায় আল্লার দয়ায়। দাওয়াই-এর মত
তাদের প্রলেপ দিও অতি সন্তপণে, সারে যেন পৃথিবীর ক্ষত।

আব্বাজানের কথা শুনে আলী শাহ বলে, -আমি তোমার কথাগুলো মনে রাখব। আর কিছু বলবে আব্বাজান?

বুড়ো বলে, -পারলে কারো ভালো করবি, তবে তার বদলে কিছু আশা করবি না। মনে রাখবি ভালো কাজ করার সুযোগ সব সময় আসে না।

—আমি মনে রাখব। আব্ববাজান।

–শোনো যে সব ধনদৌলত রেখে গেলাম, সেগুলো নষ্ট করবি না, উড়িয়ে দিবি না। এ দুনিয়ায় যার পয়সা আছে লোকে তাকেই মানুষ বলে মানে। একটা বয়েৎ শোনো–

সেদিন আমার বদ্যান্যতায় কুৎসা যারা করেছিলো
আজো তারা কুৎসা রটায়—যদিও আজ শিথিল মুঠোর পেশী।
সোনার খনি খুঁড়তে গিয়ে শত্রু যত হয়েছিলো
আজকে আমি দীন দরিদ্র, শত্রু তবু অনেক বেশী।

অভিজ্ঞতা যার বেশী তাকে কখনো অবহেলা করবি না। পাকা মাথার সঙ্গে পরামর্শ না করে কখনো বিদেশে যাবি না।

কবি বলেন–

সামনে থেকে দেখতে গেলে একটি কাচেই কাজ হবে।
পেছন থেকে দেখতে গেলে আরো একটি নিতে হবে।

আমার শেষ কথা-কখনো সরোব ছুবি না। দোজখের দোর হলো, সরাব। সরাব খেলে ভালোমন্দ জ্ঞান থাকে না। মাতালকে লোকে সব সময় ছোট নজরে দেখে। আমার কথাগুলো মনে রেখো বাপজান। অন্তর থেকে তোকে দোয়া করছি। এ দোয়া তোকে সবসময় ঘিরে থাকবে।

এক সঙ্গে এতগুলো কথা বলে বুড়ো হাঁপাতে থাকে, একটু চোখ বোজে। দেহের সমস্ত শক্তি জড়ো করে প্রার্থনার ভঙ্গীতে হাত দুখানি তোলার চেষ্টা করে। ঠোঁট দুটো কেঁপে কেঁপে মোনাজাত জানায়। আল্লাহর ওপর তার অসীম বিশ্বাসে সে যেন তাঁর পদপ্রান্তে পৌঁছতে পারে।

সময়। কবরের ফলকে আলী শার লিখে দিলো :

আমি যখন বেঁচে ছিলাম তখন ছিলাম ধূলি
কেমন করে ভুলি!
এখন আমি ধূলির মধ্যে ধূলি হলাম
এ যে অন্যরকম ধূলি!

বাবা মারা যাবার পর আলী শার দোকান দেখাশোনা করতে লাগলো। তার প্রতিটি উপদেশ সে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চললো কি? না, বরং বলতে গেলে, বাপের একটা নির্দেশও সে মানলো না। প্রথম থেকেই আত্মীয়স্বজন ও শুভাকাঙক্ষীদের সে এডিয়ে চলতে লাগলো। এসে জুটল। একদল সুযোগ-সন্ধানী লোক। বছর ঘুরে গেলো। এর মধ্যে আলী শার-এর অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কতকগুলো বদমাশ মাতোয়ালা ছোকরার কাছে নিজেকে যেন বিকিয়ে দিলো সে। এসব বদমাশদের প্রায় সব কাঁটার মা বা বোন দেহ বিক্রী করে পেট চালায়। ধীরে ধীরে ব্যভিচারের জোয়ারে ভেসে গেলো আলী শার। সরাবের সায়রে ক্রমেই সে নাকানি চোবানি খেতে থাকে। নানা পাপাচারে মনের চেহারাটাও তার পালটে গেলো। নিজেকে নিজে চোখ টেরে সে বলে, আব্ববাজানের ধনদৌলত সে ভোগ না করলে অন্যলোকে করবে। তাই অন্য লোককে করতে না দিয়ে সে নিজেই ভোগ করবে। ভোগের পরে এলো দুর্ভোগ। হাতের টাকা পয়সা শেষ হয়ে গেলো। রাতের খরচ মেটাতে একদিন দোকানটাও বিক্রী করে দিলো। শেষ পর্যন্ত বসতবাড়ি বেচিতে হলো, বেচলে হলো সমস্ত আসবাবপত্র। দামী পোশাকগুলোও বেহাত হয়ে গেলো। সব হারিয়ে এক সময় নিঃস্ব ফকীর বনে গেলো আলী শার।

এভাবে সব কিছু খুইয়ে নিজের অবিমৃশ্যকারিতার চেহারাটা তার চোখের ওপর স্পষ্ট হয়ে উঠল। আব্বাজানের কথাগুলো বড় যে বুকে বাজে এখন। এতদিন যারা বন্ধুবান্ধবের বেশে তার আশেপাশে ঘোরাফেরা করছিলো তারা সব সরে পড়তে লাগল নানান অজুহাত দেখিয়ে। দিনের খানাটাও আর জোটাতে পারে না আলী শার। ভিক্ষণ করা ছাড়া আর উপায় রইলো না তার। ভিক্ষার থালা নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দাঁড়াল আলী শার। ঘুরতে ঘুরতে বাজারের কাছে এসে পড়ে একদিন, দেখে কিছু লোক জটলা করছে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে! কি হয়েছে দেখার জন্য ভিড়ের মধ্যে ঢুকে দেখে ভিড়ের ঠিক মাঝখানে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে-বেশ ফুটফুটে সুন্দর দেখতে।

ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ চুপ করে গেলো।

 

তিনশ সতেরতম রজনীতে শাহরাজাদ। আবার বলতে শুরু করলো :

মেয়েটিকে বিক্রীর জন্য বাজারে আনা হয়েছে। ছোটখাট দেখতে মেয়েটি। ঠোঁট দুখানি যেন গোলাপের পাঁপড়ি। মুখখানি পানের মত। উজ্জ্বল রঙ। রোদের আলোয় চিকচিক ণ্ঠৈ তাকিয়ে আলী শার বুকটা টিপচিপ করে। গুরুভার নিতম্বটিকে পোশাকে ধরে রাখতে পারছে না। একমুঠো সরু কোমর। সব মিলিয়ে অপরূপ! আলী শার বিড়বিড় করে বলে—

কুঁচ-বরণ কন্যা সে যে কোকিল কালো কেশ।
নিঃশ্বাসে তার মৃগ-গন্ধ চাকন চুকুন বেশ।
তার কুচের ওপর দেখতে পাবে মুক্তামালার মঞ্জুরী
শিশির-গলা মুক্তা-ঝুরি কোন বেহেস্তের অন্সরী!
সেই বুকেতে তুষার ধবল চাঁদের কিরণ পড়ে—
তার রূপের আলোয় ভুবন কালো নয়ন নাহি সরে।

মেয়েটির রূপের মাদকতায় ডুবে যায় আলী শার। চার পাশের কথা, নিজের অবস্থা সব ভুলে মন্ত্রমুগ্ধের মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে মেয়েটাকে। ভীড়ের মধ্যে বাজারের ব্যবসায়ীরাই ছিলো সংখ্যায় বেশী! ওরা বলাবলি করছে একে বাঁদী করে নেওয়ার ক্ষমতা এখানে একমাত্র গ্লোরিদেরই আছে। তারা অবশ্য গ্লোরির ছেলের গোল্লায় যাওয়ার খবরটা তখনো শোনেনি।

মেয়েটিকে যে বেচিতে এনেছে তার প্রধান দালাল মেয়েটির পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ভিড়টা একবার ভালোভাবে দেখে নিয়ে সে চেঁচিয়ে বলতে থাকে, আসুন, এই মরুভূমির দেশের আমির, ওমরাহ, ব্যবসাদার সবাই এসে দেখুন। চাঁদের রানী আর গোলাপের রানী এই সুন্দরীর নাম—জুমুর‍্যুদ। কোন পুরুষ এখনো একে ছোঁয়নি। রাতে বিছানায় সব মেয়েকেই নিয়েই শোয়া যেতে পারে। কিন্তু এর মত মজা কেউ দিতে পারে না। এ যেন একঝুডি ফুল-যার গন্ধে নেশা ধরবে, মৌতাত লাগবে। নিন, নিন, নীলাম ডাকতে শুরু করুন। নীলামের নাম শুনে ভয় পাবেন না। যার যেমন খুশী দর হাঁকতে পারেন। আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে চাঁদের সালতানিয়তের মহারানী লজ্জাবতী কুমারী জুমুরুসদ-এখনো সে কোন পুরুষের সঙ্গে শোয়নি, —ফুলের মত শরীর-ডাকুন, ডাকুন–

প্রথমে এক ব্যবসায়ী চেঁচিয়ে বলে উঠল, —আমি পাঁচশ দিনার দরদিলাম। অন্য একজন সঙ্গে সঙ্গে বলল পাঁচশ দশ। ভিড়ের ভেতরে দাঁড়িয়ে ছিলো কুৎসিত চেহারার একটা বুড়ো, নাম রশিদ-আল দিন। তার নীল চোখের কোণে পিচুটি জমে শক্ত হয়ে আছে। ভীড় ঠেলে সে সামনে এসে দাঁড়াল। চিলের মত গলার আওয়াজ তুলে বলে, —ছয়শ। আর একজন ছয়শ দশ বলতেই বুড়োটি প্রায় লাফিয়ে উঠল, একহাজার দিনার।

যারা এতক্ষণ ডাকছিলো তারা চুপ করে গেলো। দালাল বিক্রেতার কাছে গিয়ে বলে, এক ঔষ্ট হাজার দিনারে কি মেয়েটাকৈ ছেড়ে দেবেন?

-হ্যাঁ ছেড়ে দেব। কিন্তু বেচে দেওয়ার একটা শর্ত আছে যে! মেয়েটাকে আমি কথা দিয়েছি ওর পছন্দমত লোকের কাছেই আমি ওকে বেচিতে পারব। তুমি মেয়েটাকে একবার জিজ্ঞেস করা।

মেয়েটির কাছে গিয়ে দালাল, বলে, -জুমুর‍্যুদ তুমি এই বৃদ্ধ রশিদ আল-দিনের কাছে বিক্রি হবে?

রশিদ আল-দিনকে জুমুর‍্যুদ একবার আড়াচোখে তাকিয়ে দেখে নিলো। দেখে বুড়োটা ওর দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে আছে। জুমুর‍্যুদ কেঁদে ফেলো, -দালাল তুমি কি এই বুড়োটাকে চেন্নানা? এই ভামটা দিনের আলো সহ্য করতে পারে না। দিনের বেলা তাই বাইরে বেরুতে পারে না।

ওর মত লোকেদের জন্য একটা কবিতা আছে, শোনো :

আমি তার রাঙা ঠোঁটে চুমু চেয়েছিলাম, সে
অপরাধ নেয়নি কো—শুধু এক উৰ্ব্ব গ্ৰীব জিরাফের বেশে
উদাসীন চোখ দুটি দিয়েছিলো মেলে—
রাঙা অধরের কোণ থেকে একটি জবাব শুধু পড়েছিলো হেলে
আমার প্রার্থনার-শ্বেত পাক কেশ আমি ভালোবাসি না যে—
তুলোর মত তারে লালা দিয়ে দ্রব করি রাঙা মোর অধীরের মাঝে।

দালাল বললো—তোমাকে কথা যখন দিয়েছি তখন তুমি এই বুড়োকে নাও পছন্দ করতে পার। তাছাড়া তোমার মত রূপ এক হাজার দিনারে পাওয়া যায় না। নিদেন পক্ষে দশ হাজার দিনার হওয়া উচিত।

ভিড়ের দিকে তাকিয়ে দালাল বলল—এই ভদ্রলোকের দেওয়া দামে আর কেউ নেবেন?

—আমি নেব।

জুমুর‍্যুদ দেখল, রশিদ আল-দিনের মত কুৎসিত নয়। ওর চোখের কোনায় পিচুটিও লেগে নেই। কিন্তু এ লোকটাও বুড়ো। যদিও বয়স লুকোবার জন্য চুল দাঁড়িতে কলপ মেখে আছে। জুমুর‍্যুদ চেঁচিয়ে ওঠে–ছিঃ ছিঃ ছিঃ, এই লোকটা! কি লজ্জা মাগো! এ বুড়োটা ছোড়া হওয়ার জন্য মুখে রঙ মেখেছে!

এই বলে সে একটা বয়েৎ ধরল–

আমি তোমার সঙ্গী হতাম, সত্যি বলি শোনো–
প্ৰাণের অর্ঘদিতাম তোমার পায়–
তোমায় আমি গুরু বলে নিতাম তুলে শিরে
যদি তোমার শ্মশ্র গুম্ফ থাকত সাদা হয়ে।
কিন্তু তুমি রঙ মেখেছ, লাল করেছ দাঁড়ি।
তোমার সাথে আর কি যেতে পারি?
তোমায় দেখে ভয় করে যে, করব কি আর বল–
তোমায় দেখে ঝরে যাবে প্ৰেম অমৃত ফল।

-বাঃ, বাঃ, কি অমৃতকথা বলছি গো! উচ্ছাসে বলে উঠল দালাল।

—তুমি সাচ্চা বাতই বলেছ।

দ্বিতীয়জন নাকচ হবার সঙ্গে সঙ্গে আরএকজন জুমুর‍্যুদকে কিনতে চাইলো। লোকটার একটা চোখ কানা। জুমুর‍্যুদ হেসে বলল-ওগো আমার এক চোখা নাগর শোনো :

মিথ্যেবাদী আর কানার মাঝে তফাৎ কিছু জান? জান না?
জানবে কেমন করে? কানা মানুষ মিথ্যেবাদী, মিথ্যেবাদী কানা।

এবার দালাল আরো একজনকে দেখাল। বেঁটে গোটাগোট্টা লোক! একগাল দাঁড়ি, তলপেট পর্যন্ত নেমে এসেছে। জুমুর‍্যুদ বলল–এই লোমওয়ালা লোকটার সঙ্গে যেতে বলছ? শোনো তবে :

বঁদিকে আর ডানদিকে তার গালপট্টা দাড়ি।
তাই দেখে হায় কাঁপতে কাঁপতে চুপসে গেলো নারী।

–চারজনকেই অপছন্দ? দালাল আর ধৈর্য রাখতে পারে না। নাঃ, এ আমার কৰ্ম্ম নয়! তোমার জিনিস তুমিই বাছো বাপু। এরা সব নামিদামী আর মান্যগণ্য ব্যবসায়ী–এদের মধ্য থেকে একজনকে তুমি পছন্দ করে নাও। তোমাকে সওদা করে তিনিওবাড়ি চলে যান।

মেয়েটি এবার ভিড়ের দিকে চোখ তুলে তাকাল। প্রত্যেকটি লোককে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। চোখ ঘুরতে ঘুরতে এসে আলী শারের ওপর আটকে গেলো। ভিড়ের মধ্যে যারা, দাঁড়িয়েছিলো তাদের সঙ্গে আলী শার রূপ বা স্বাস্থ্যের কোন তুলনাই হয় না। ওর দিকে আঙুল দেখিয়ে জুমুর‍্যুদ দালালকে বললো—একেই খুঁজছি। আমি, একেই আমার চাই। ও আমাকে কিনে নিক। ওকে দেখে আমার চোখে রঙ ধরেছে। কি সুন্দর মুখ! কি দারুণ স্বাস্থ্যু! ওর আলিঙ্গনের জন্য মনটা আমার আকুলি-বিকুলি করছে। ওর গরম রক্তের আঁচ আমার গায়ে এসে লাগছে, আমি ক্রমেই পাগল হয়ে উঠছি। ও যেন কেমন মিষ্টি হাওয়া! ওকে দেখেই বোধ হয় কবি বলেছেন :

আমার যারা যুবক ছিলাম, তোমরা যারা বৃদ্ধ।
তোমার দিকে চেয়ে চেয়ে সবাই হলো তৃপ্ত।
যৌবন রে, তুমি দেখ নয়ন মেলে
রূপটা তোমার ঢাকার তরে যাচ্ছে ফেলে ফেলে
হাজার হাজার ওড়না যত
এই দুনিয়ায় সব হারানো মানব শিশুর মত।

আর এক কবি বলেছেন :

প্রিয়, তুমি বুঝতে পার নাক?
এমনি করে রূপটাকে তাই লুকিয়ে রোখ।
এ রূপতো লুকিয়ে রাখার নয়।
এ রূপ যে বিশ্বভুবন ছড়িয়ে দিতে হয়
ভারি তোমার জঙ্ঘা দুটি, সরু তোমার কটি;
প্রিয়া-মিলন লাগি তোমার একটু কি নাই ত্বরা?
তোমার অঙ্গে আমার অঙ্গ মিশিয়ে দিতে কি সুখ!
প্রিয় যখন আসবে উঠে তখন আমার কি দুখ!
ক্ষুধার্তকে অন্নদান,
ঈশ্বর বিধান।
জীবহত্যা পুণ্য নয়।
এ কথা সর্বশাস্ত্ব কয়।
প্রিয়, হে প্রিয় আমার
তোমার বিহনে মোর জগত আঁধার।

ওকে দেখে কবিতা কি ফুরোতে চায়?

কোঁকড়া চুলের ওই যে হরিণ শিশু
গালেতে যার অস্ত রবির রঙ্গীন আলো
শপথ নিয়ে বলতে পারি
আমার ঘরে আসবে বলে কথা যে সে দিয়েছিলো।
সেই কথাটা বলতে গিয়ে লাজে
এখনো সে চক্ষু দুটি বন্ধ করে আছে।
মিলন শেষে, আছেই। আমার জানা
ও আমার সাথে করবে। প্রতারণা।
কিন্তু ধর…

দালাল মেয়েটার কবিতার তোড় দেখে অবাক হয়ে গেলো। বিক্রেতার কাছে গিয়ে কথাটা সে বলেই ফেলল।

বিক্রেতা হেসে বললো-মেয়েটার রঙ্গরস দেখে তোমরা তাজ্জব বনে যাবারই কথা। ওর রূপ তো দেখছো। মেয়েটা খালি যে অন্যের কবিতাই বলতে পারে তা না; ও নিজেও একজন কবি। সাতটা কলমে সাতটা কবিতা লিখতে পারে এক সঙ্গে। তাছাড়া ও সুন্দর দুটি হাতের কত গুণ আছে জান? রেশমী কাপড়ের ওপর সুন্দর সুন্দর নকসা তুলতে পারে ও। ওর হাতের তৈরী কাপেট বা পর্দা করতে ওর সময় লাগে মাত্র সাত থেকে আট দিন। ওকে যে কিনবে, কয়েক মাসের মধ্যেই তার দাম উশুল হয়ে যাবে।

এতগুণ মেয়েটার! দালাল বললো-এ। ধন যার ঘরে যাবে, সে কত ভাগ্যবান! মেয়েটা নিজেই এক অমূল্য রত্ন। ওকে পাহারা দিয়ে রাখতে হবে। আলী শার কাছে গিয়ে ওর হাত দু’খানা টেনে চুম্বন করে বললো—

ভোর হতে দেখে শাহরাজাদ চুপ করে গেলো।

 

তিনশ উনিশতম রজনীতে আবার শুরু করলো শাহরাজাদ :

দালাল বলে-তোমার নসিবকে হিংসে করতে হয়। কত লোক তো কিনতে চাইলো, সে তো চোখের সামনেই দেখলে। কেউ পারলো না। এই সুন্দরীর যে-সব জিনিস আছে, সে কথা কী আর বলব! হাজার হাজার দিনার দিলেও এসব জিনিস পাওয়া যায় না। শিকে যে শেষ পর্যন্ত তোমার ভাগ্যেই ছিড়ল! মেয়েটার যখন তোমাকেই পছন্দ তখন বিক্রেতা তোমার হাতেই তুলে দেবেন। ওকে। নিয়ে যাও মেয়েটিকে দোস্ত-জীবনে সুখ পাবে। ও ভাগ্যবতী!

এসব দেখেশুনে আলী শারের মাথা নীচু হয়ে যায়। ফুটে ওঠে মুখে অপ্রস্তুতের হাসি। কিছু যেন বিশ্বাস করতে পারছে না সে। কোথায় সে দাঁড়িয়ে আছে তা-ই বোঝার চেষ্টা করছে। ফিসফিস করে বলে, অদৃষ্টের কি পরিহাস! ওরা সবাই ভাবছে, মেয়েটাকে কেনার মতো যথেষ্ট পয়সা আমার আছে। হায় আল্লা! একটুকরো রুটির দাম যেখানে জিজ্ঞেস করতে পারি না, সেখানে .। এখানে আমার মুখ না খোলাই ভালো। সবার সামনে বেইজ্জত হই। আর কি! —ও মাথা নীচু করেই রইলো।

জুমুর‍্যুদ বলোল কটাক্ষে আলী শারকে ঘায়েল করতে চাইলো। মুখ ঘুরিয়ে ফিসফিস করে দালালের হাত ধরে বললো—ওর কাছে আমাকে নিয়ে চলো ওর সঙ্গে কথা বলব। আমাকে যাতে ও কিনে নেয়। তার জন্য ওকে আমি বোঝাব। আমি ওর সঙ্গেই যাব–আর কারুর সঙ্গে না—না—না।

দালাল কি আর করে! তাকে নিয়ে আলী শার কাছে দাঁড় করিয়ে দিলো। আলী শার সামনে যেন বেহেস্তের হুরী। জুমুর‍্যুদ বলে—ওগো আমার ভালোবাসা, তোমার যৌবন আমার শরীরে যে আগুন ধরিয়ে দিলো! দাম বলছি না কেন? আমাকে খুব দামী বলে মনে হলে না হয় দাম বেশীই বলো। আর কম মনে হলো কমই বলো। যাহোক একটা কিছু বলো। যে দাম দেবে তাতেই আমি চলে যাব। আমি শুধু তোমার সঙ্গেই যাব।

আলী শারের চোখ ফেটে জল আসে আর কি! মাথা ঝাঁকিয়ে সে বলে-বেচার দিব্যি তো কেউ দেয়নি, কেনার কথাই বা ওঠে। কেন?

–হাজার দিনার বেশী মনে হচ্ছে?

আলী শার মাথা ঝাঁকিয়ে চলে।

—ঠিক আছে, আট শতে কেনো। সাতশ? তাও না? থাক তুমি একশ দিনার দিয়ে দাও।

আলী শার বলে অত নেই আমার কাছে।

—কত কম পড়ছে? পুরো একশ দিনার না দিতে পারলে পরেই না হয় দিও। —জুমুর‍্যুদ হেসে আলী শার গায়ে ঢলে পড়ে।

শক্ত হয়ে যায় আলী শার। অক্ষম পুরুষের প্রাণে জ্বালা ধরে। জ্বালা চেপে রেখে সে বিলে—একশ দিনার তো দূরের কথা আমার কাছে এক কানা কডিও নেই। তুমি ফালতু সময় নষ্ট করছি। যাও, অন্য খদের দেখ।

ওর কাছে এক পয়সাও নেই সেটা জুমুর‍্যুদ বুঝলো। জুমুর‍্যুদ বললো।— ঠিক আছে। কেনার জন্যে তোমায় কোন পয়সা দিতে হবে না। আমার হাত ধরে এই জামাটা পরিয়ে দাও আর একখানা হাত দিয়ে আমার কোমর জড়িয়ে ধর। ব্যস, আমি তোমার হয়ে যাব। আমাকে যে তুমি নিলে এতেই তা বোঝা যাবে।

যন্ত্রচালিতের মত আলী শার জুমুর‍্যুদকে জামা পরিয়ে দিয়ে ডান হাতে তার কোমর জড়িয়ে ধরার জন্যে হাতখানা ঘুরিয়ে আনলে, আর ঠিক সেই সময় জুমুর‍্যুদ হঠাৎ একটা দিনার ভর্তি থলি তার হাতে গুঁজে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে–এতে এক হাজার দিনার আছে। মনিবকে নাশ দিয়ে দাও। বাকী একশ নিজের কাছে রাখি। সামনে কষ্টের দিন আসছে কাজে লাগবে তখন।

আলী শারও ওর কথা মত ন শ’ দিনার দিয়ে জুমুর‍্যুদকে ঘরে নিয়ে গেলো।

আলী সার দীনকুটির দেখে জুমুর‍্যুদ মোটেই অবাক হলো না। অপরিসর একখানি ঘর। আসবাবপত্র বলতে শত ছিন্ন ময়লা আর তেলচিটে একখানি মাদুর। মাদুরখানা যে কবে কেনা হয়েছিলো তা বলা মুশকিল। এছাড়া ঘরে আর কিছু নেই। একটা হাজার দিনারের থলি আলি শার হাতে দিয়ে জুমুর‍্যুদ বলে—এক্ষুণি বাজারে যাও। সুন্দর আসবাব আর একখানা চমৎকার কাপেট কিনবে। ভালো ভালো খাবার দাবার আনবে। শরাবও এনে ভালো দেখে। আর আনবে আমার জন্যে একখানা বড়সড় চৌকো দোমাস্কাস সিস্কের কাপড়ের টুকরো। বাজারের সেরা জিনিসটি কিনবে। কাপড়ের রংটা চাই টকটকে লাল। এক লাচি সোনালী সুতো, এক লাচি রুপালী সুতো আর নানান রং-এর সাত লাচি সুতো আনবে। দাঁড়াও আরো আছে। বড় বড় কয়েকটা সূচ আর আমার আঙ্গুলে পরার জন্য একটা টোপর। মনে থাকবে তো সব? ভুলো না যেন। যাও তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।

বেশ কিছুক্ষণ পর বাজার সেরে আলী শারবাড়ি ফিরলো। জুমুর‍্যুদ প্রথমেই মেঝেতে কাপেট বিছিয়ে ফেললো। তার ওপর তোশক পাতলো। বালিশ তাকিয়া সুন্দর করে সাজানো হলো। ঘরটার আগেই সে ঝেড়ে পুছে রেখেছিলো। এবারে মোমবাতি ধরালো। তেশকের ওপর পাতল সাদা ধবধবে চাদর।

সব কাজ। সারা হলে দু’জনে মনের আনন্দে খানাপিনা শুরু করলো পাশাপাশি বসে। শরাব খেলো, অনেক কথা, অনেক ভাবনা দু’জনে দুজনকে বললো। অবরুদ্ধ বাসনার উন্মেষ হতে লাগলো ধীরে ধীরে। এবার বিছানায় যাবার পালা। দুজনেই ক্লান্ত। নতুন বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো দুজনে। নতুন বিছানার নতুন গন্ধের মাঝে গভীর আবেগে একে অন্যকে জড়িয়ে কাছে টেনে নিলো। জুমুর‍্যুদের যৌবনে অনাত্মাত ফুল এই প্রথম নিবেদন করলো তার বাঞ্ছিতের কাছে। মুহূর্তের জন্যও ছাড়াছাড়ি হলো না। অচ্ছেদ্য বাহুবন্ধনে আরো গভীর কোন সুখের দেশে পাডি জমায় তারা। কিন্তু সুখের রাত যেন বড়ই ক্ষণস্থায়ী। রাত ভোর হয়ে এলো। এক জোড়া যুবক-যুবতী ভোরের আলোয় যেন স্নান করলো।

সূর্যের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে জুমুরাদ কাজে বসে গেলো। রাতের সুখটুকু গায়ে লেপটে রয়েছে। গাল দুটো একটু বেশী লালচে লাগছে। দামাস্কাস সিস্কের টুকরো দিয়ে কয়েক দিনের মধ্যে একটা বাহারি পর্দা তৈরী করে ফেললো সে। নানান পশুপাখীর নকসা কি সুন্দর করে তুলে ফেললো পর্দায়। পর্দার মাঝে বিরাট বিরাট গাছের ছবি। ডালগুলি ফলভারে নুয়ে পড়েছে। গাছের ছায়ায় বসে দুদণ্ড জিরোতে মন চায়। সমস্তটা মিলিয়ে এক অনবদ্য প্রাণবন্ত প্রকৃতির ছবি। এত বড় কাজটা তুলতে জুমুর‍্যুদের সময় লেগেছে মাত্র আট দিন। জুমুর‍্যুদের দক্ষতা দেখে আল্লাকে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালো আলী শার।

পর্দার কাজ শেষ হলে ভালো করে সেটাকে ভাঁজ করে নিলো জুমুর‍্যুদ; তারপর সেটা আলী শারের হাতে দিয়ে বললো-বাজারের কোন দোকানদারের কাছে এটা নিয়ে যাও। পশ্চাশ দিনারের কমে বেচো না যেন। সেই সঙ্গে আর একটা কথা ভালো করে শুনে যাও। একদম ভুলো না, অচেনা কোন ফেরীওয়ালার কাছে পর্দটাি বেচো না। বেচলে, আমাদের দুজনের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে। বুঝেছি? অনেক শত্ৰু আমাদের রয়েছে। সুযোগের অপেক্ষায় অনেকেই রয়েছে ওৎ পেতে। তাই, অচেনা কাউকে বেচাবে না, সাবধান!

কথাগুলি শুনলো আলী শার; তারপরে বাজারে গিয়ে চেনা একটি দোকানদারকে পঞ্চাশ দিনারে সেই সুন্দর পর্দটা বেচে দিলো।

ভোর হয়ে আসছে দেখে চুপ করে গেলো শাহরাজাদ।

 

তিনশো কুড়িতম রজনী :

পরের দিন গল্প শুরু করতে দেরী হয়ে গেলো অনেকটা। শাহরিয়ারের মনের তাপ জুড়োতেই মাঝ রাত প্রায় কাবার হয়ে এলো। দুনিয়াজাদ অধীর হয়ে বলে, কই, শুরু কর।

–হ্যাঁ বলছি।

ফেরা পথে অনেক সিস্কের কাপড় আর সোনালি-রূপালি সুতোর গুলি কিনে নিয়ে এলো আলী শার। এগুলি দিয়ে তৈরি হবে অনেক সুন্দর-সুন্দর পর্দা বা কাপোট। দেরী করলো না। জুমুর‍্যুদ; কাজ শুরু করে দিলো। ঠিক আট দিনের মাথায় সে একখানা বেশ চমৎকার কাপেট বুনে ফেললো। প্রথমটির চেয়ে এটি অনেক বেশী সুন্দর। এটিও বিক্ৰী হলো পঞ্চাশ দিনারে। এইভাবে সারা বছর ধরেই তারা কাজ করে গেলো। কাজের চাপে তাদের ভালোবাসার গায়ে এতটুকু জঙ ধরেনি; বরং, দিন-দিন তা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছে। প্রেম-সাগরের দুর্বর তুফানে ভেসে গিয়েছে তারা।

একদিন আলী শার একটা পোটলা নিয়েবাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। সেই পোটলাতে ছিলো। জুমুর‍্যুদের হাতে তৈরি একটা কর্পেট। বাজারে গিয়ে কিন্তু কোন ব্যবসাদারের কাছে বেচলো না; একটা দালাল ধরলো। তাকে সঙ্গে নিয়ে দালালটা দোকানে-দোকানে ঘুরে চেঁচাতে লাগলো। এমন সময় একজন খ্রীস্টান যাচ্ছিল তাদের পাশ দিয়ে। এই সব খ্রীস্টানরা সাধারণত বাজারে ঢোকার পথে এক জায়গায় দল বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে। কেনা-বেচার কাজে ক্রেতা-বিক্রেতাদের প্রয়োজনবোধে হাতে-পায়ে ধরতে পর্যন্ত তাদের বাধে না।

খ্রীস্টান দালালটা আলী শার দালালকে বললো-আমাকে কাপেটটা দাও। আমি তোমাকে ষাট দিনার দেব।

কিন্তু জুমুর‍্যুদের সতর্কবাণী আলী শার ভুলে যায় নি। লোকটা অচেনা তো বটেই। তার ওপরে সে খ্রীস্টান। খ্রীস্টানদের সে দু চোখে দেখতে পারত না, ঘৃণা করত। ওকে সে কাপেট বেচাবে না।

খ্রীস্টান ছাড়নেওয়ালা নয়। সে দাম চড়িয়ে দিয়ে বললো-একশ দিনার।

আলী শারের দালাল তার কানে-কানে বললো–এমন পয়মস্ত খদের ছেড়ে দেবেন না হুজুর।

আলী শার যাতে কাপেটা তাকেই বিক্রী করে এই জন্যে খ্রীস্টানটা অবশ্য আগেই তার দালালকে দশ দিনার ঘুষ দিয়ে রেখেছিলো। দালালটি তাকে এমনভাবে বিরক্ত করতে লাগলো যে বেচারা শেষ পর্যন্ত সেই খ্রীস্টানকেই একশ দিনারে কাপেটটা বেচে দিতে বাধ্য হলো। কিছুটা ভয়ও যে সে পেলো না সে কথা সত্যি নয়। ভয়ে-ভয়ে দিনারগুলি হাতে নিয়ে কাঁপতে-কাঁপতে বাজার থেকে বেরিয়ে এলো সে।

বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ এক সময় কী জানি কেন ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো আলী শার। খ্রীস্টানটা তার পিছু নিয়েছে। দাঁড়িয়ে পড়লো সে; তারপরে সে জিজ্ঞাসা করলো—এ মহল্লায় তো কোন খ্রীস্টান থাকে না; এদিকে কোন খ্রীস্টানকেও তো আসতে দেখিনি কোনদিন। তা, এপথে আপনার আগমন কেন?

খ্রীস্টান বললো-মাপ করবেন, মালিক। এই রাস্তার মোড়ে আমার একটা কাজ রয়েছে, তাই আসছি। আল্লাহ। আপনার মঙ্গল করুন।

কী আর বলবে আলী শার। বাড়ির দিকে সে হাঁটতে শুরু করে। বাড়ির মুখে এসে হঠাৎ কী মনে করে সে আবার পেছন ফিরে একবার তাকালো। কী ব্যাপার! খ্রীস্টানটা রাস্তার ওপর থেকে তারই দিকে এগিয়ে আসছে যে! ব্রাগে গরগর করে উঠল আলী শার; চেঁচিয়ে বললো।–ব্যাটা হতচ্ছাড়া কোথাকার! আমার তুই পিছু নিয়েছিস কেন?

খ্রীস্টানটি হাত কচলিয়ে বললো—আমি হঠাৎই এদিকে এসে পড়েছিলাম, মালিক। বিশ্বাস করুন, এটা নিছক একটা দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছু নয়। তেষ্টায় আমার ছাতি ফেটে যাচ্ছে। একটু পানি খাওয়াবেন? আল্লাহ। আপনাকে অনেক দেবেন।

আলী শার ভাবলো—কোন মুসলমান পাগলা কুকুরকে পানি দিতে পারবে না। এমন কথা আল্লাহ কোথাও বলেন নি। সেই জন্যে সে পানি আনার জন্যে দরজা ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলো। পানি নিয়ে ফিরে আসছে এমন সময় জুমুর‍্যুদের সঙ্গে দেখা। দরজা খোলার আওয়াজ পেয়েই জুমুর‍্যুদ ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছিলো। আলী শারকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে বললো-ফিরতে এত দেরী হলো কেন তোমার? খু-উ-ব ভাবনা হচ্ছিল আমার। কাপেটটা তুমি কোথায় বেচলে? কোন নামকরা দোকানদারকে, না, কোন অচেনা খদেরকে?

বেশ অস্বস্তিতে পড়লো আলী শার। কোনরকমে ঢোক গিলে জবাব দিলো সে—আজি বাজারে কী ভিড় তা তোমাকে কী বলব? তাই ত ফিরতে এত দেরী হয়ে গেলো। তবে কাপেটটা আমি এক চেনা দোকানদারকেই বেচেছি।

জুমুর‍্যুদ বললো-আল্লাহর নামে বলছি, আজ আমার মনটা কেমন ছ্যাক ছ্যাক করছে। তা তুমি পানি নিয়ে চললে কোথায়?

আলী শার বললো—দালালের বড় তেষ্টা পেয়েছে। আমার পিছু পিছু বেচারা তাইবাড়ি পর্যন্ত এসে পড়েছে।

আলী শার জবাবে খুব একটা খুশী হতে পারলো না জুমুর‍্যুদ। পানি নিয়ে বেরিয়ে গেলো আলী শার। উদ্বেগাকুল কণ্ঠে আবৃত্তি করলো জুমুর‍্যুদ–

হায়রে মুঢ় মানুষ তুমি ভাবিছ বুঝি
একটি চুমু হবে তোমার চিরদিনের পুঁজি?
ঠোঁটের ওপর আঙ্গুল দিয়ে
একটু দূরে দেখো তাকিয়ে
রাহুগ্রস্ত চাঁদের হাসি
কারে বেড়ায় খুঁজি।

পানি এনে আলী শার দেখলো খ্রীস্টানটি এরই ভেতরে খোলা দরজা দিয়ে সটান বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। তার চোখের ওপরে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো যেন। ক্ষেপে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো। সে-শালা কুত্তার বাচ্চা কুত্তা! আমার অনুমতি না নিয়ে আমারই ঘরের দাওয়ায় আসিস-তোর এত বড় সাহস।

খ্রীস্টানটি হাত কচলিয়ে বললো—আমার গোস্তাকি মাপ করুন হুজুর। হাঁটতে-হাঁটতে আমার পা দুটো এমনি টনটন করছিলো যে আর আমি দাঁড়াতে পারছিলাম না। তাইত বাধ্য হয়ে চৌকাঠের এদিকে এসে পড়েছি। অবশ্য দরজা বারান্দার মধ্যে তফাত-ই বা কতটুকু? তাই না? একটু জিরিয়ে নিয়ে চলে যাব। আমাকে জোর করে বার করে দেবেন না। আল্লাহও আপনার ওপরে জোর করবেন না।

এই বলে লোকটি আলী শারের হাত থেকে পানির পাত্রটি নিলো; তারপরে অনেকটা পানি ঢকঢ়ক করে খেয়ে পাত্রটি তার হাতে ফিরিয়ে দিলো।

আলী শার চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। লোকটি চলে না যাওয়া পর্যন্ত সে পেছন ফিরতে সাহস করলো না। কিন্তু ঘন্টাখানেকের ভেতরেও লোকটির ওঠার যখন কোন লক্ষণ দেখা গেলো না তখনই চেঁচিয়ে উঠে বললো—বাড়ি থেকে বেরোবি, না, মতলবটা তোর কী? বেরো, বেরো, এখনই বেরিয়ে যা।

লোকটি বললো-মালিক, এ-দুনিয়ায় এমন কিছু মানুষ আছেন ভালো কাজ করার জন্যে যাদের লোকে চিরকাল মনে রাখে। আপনি দেখছি তাঁদের মত ভাগ্যবানদের খাতায় নাম লেখাতে চান না। কোন এক কবি আপনাদের মত মানুষদের জন্যেই বিলাপ করে লিখেছেন—

যাদের মনটা ছিলো নদীড় দিলের মত
না চাইতেই সবাই পেত জল
আজ তারা নেই। আজকে মানুষ কৃপণ হলো যত।
পানি-পিয়াসী পথিক দেখে নাড়ছে তারা কল,
বলছে ডেকে, জল নিয়ে যাও শূন্য কলস ভরি
তার আগেতে বাপু তোমায় ফেলতে হবে কড়ি।

তেষ্টায় আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছিল। মেহেরবানি করে আপনি পানি দিয়েছেন। আমার তেষ্টা মিটেছে। কিন্তু ক্ষিদের জ্বালায় আমার জানা যায়—যায়। আপনাদের এটোকীটা কোথাও যদি কিছু পড়ে থাকে তাই আমাকে দিন না খানিক, সেটুকু পেলেও আমার যথেষ্ট হবে। আর তাও যদি ফেলে দিয়ে থাকেন তাহলে অন্তত এক টুকরো পোড়া রুটিই দিন, আর সেই সঙ্গে এক টুকরো পেয়াজ। আজ তাই আমার কাছে কাবাব বলে মনে হবে।

আলী শার তো ক্ষেপে লাল। সে চিৎকার করে বললো-না। আর একটা কথাও না, বেরোও—আভি নিকালো। এ-বাড়িতে আর কিছু পাবে না তুমি—ভাগো…ভাগো…

কিন্তু কিছুই হলো না। একভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো লোকটা; বললো।—মাপ করবেন, হুজুর। বাড়িতে আপনার সত্যিই যদি কিছু না থেকে থাকে তো একশটা দিনার তো রয়েছে। কাপেট বেচে সেগুলি আপনি পেয়েছেন। তাই থেকে কিছু খাবার কিনে দিন, খাই। দোকান তো পাশেই। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করবেন। কেউ অন্তত বলতে পারবে না যে আপনারবাড়ি থেকে শুধু হাতে আমি ফিরে গিয়েছি। আপনার আমার মধ্যে যে নুন-রুটি দেওয়া-নেওয়া হয়নি সেকথাও বলতে পারবে না কেউ।

আলী শার ভাবলো—এ ব্যাটা সত্যিকারী পাগল। গলা ধাক্কা দিয়ে ওকে রাস্তায় বার করে দিই; তারপরে দেব কুকুর লেলিয়ে। এই ভেবে, লোকটাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বাইরে বার করে দেওয়ার জন্যে যে-ই না সে হাতটা তুলেছে আমনি লোকটা বলে উঠলো—আমি আপনার কাছে চেয়েছি একটুকরো রুটি আর একটুকরো পেয়াজ। এর বেশী তো কিছু চাইনি। ওতেই আমার ক্ষিদে মিটে যাবে। আমার জন্যে। ওর বেশী। আপনি মোটেই খরচ করবেন না। জ্ঞানী ব্যক্তিরাও এর বেশী আরা কিছু চান না।

এক চিলতে শুকনো রুটি
তাই তা জ্ঞানী রাজার খানা।
শহর-বোঝাই সুখাদ্য খেয়েও
পেটুক জনের পেট ভরে না।

তিতিবিরক্ত হয়ে ভাবলো আলী শার-এ লোকটার হাত থেকে রেহাই নেই তার। এই ভেবে সে খাবারই কিনতে গেলো। বেরনোর আগে লোকটাকে এক পা-ও নড়াচড়া করতে নিষেধ করলো; তারপর দিয়ে গেলো দরজায় তালা! বাজার থেকে কিনে নিয়ে এলো মধুমাখানো ছানার পিঠে, শশা, কলা অরা গরম-গরম রুটি। চেঁচিয়ে বললো-এখন গেলো।

এত গালাগালিতেও মানুষটি চটলো না; বললো।—মালিক, আপনি সত্যিই মহানুভব! এত খাবার এনেছেন যে দশজনেও খেয়ে শেষ করতে পারবে না। আপনিও বসুন। এক সঙ্গে খাই।

আলী শার বললো—অত আদিখ্যেতা তোমাকে দেখাতে হবে না। তুমি একই গেলো। তা ছাড়া আমার ক্ষিদে নেই।

কিন্তু লোকটি নাছোড়বান্দা। সে বললো—সব জাতের মধ্যে একটা রীতি রয়েছে যে অতিথিদের সঙ্গে বসেই গৃহস্বামীকে খানা খেতে হয়। যে খায় না সে বেজন্ম।

ভোর হয়ে আসতেই গল্প থামিয়ে চুপ করে রইলো শাহরাজাদ।

 

তিনশো একুশতম রজনী :

আগের রাতের জের টানলো শাহরাজাদ।

খ্রীস্টানটির সঙ্গে কিছুতেই এঁটে উঠতে পারছিলো না আলী শার; কিছুতেই সে এড়াতে পারছিলো না লোকটাকে। অগত্যা তার পাশেই বসে পড়লো আলী শার, শুরু করলো খেতে। মনের মধ্যে তার তখন নানান চিন্তা। ভাবতে-ভাবতে আনমনা হয়ে যায় আলী শার। সেই সুযোগে লোকটা একটা কলা ছাড়িয়ে দু’খানা করে ফেললো। তারপরে আফিঙে জ্বাল দেওয়া একটা বড় ভাঙের ডালা সেই টুকরোর মধ্যে পুরে দিলো। এই ভাঙের টুকরো যেমন-তেমন একটা হাতিকে খাওয়ালে এক বছর তার ঘুম ভাঙার কথা নয়। সেই কলার গায়ে মধু মাখিয়ে তার ওপরে ছানার মোটা প্রলেপ দিয়ে আলী শারের হাতে তুলে দিয়ে লোকটা বললো—আপনার জন্যেই এটা আমি মনের মত করে তৈরি করেছি, মালিক। বিশ্বাসের প্রতিদান হিসাবে আপনাকে এটা আমি খেতে দিলাম। অনুগ্রহ করে খেয়ে নিন।

চমকে উঠলো আলী শার। তাড়াতাড়ি কলাটা হাতে তুলে নিয়ে সে, তারপর গিলে ফেললো গোগ্রাসে। পেটের মধ্যে যেতে-না-যেতেই হঠাৎ সে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। আলী শার জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে লোকটা চিতা বাঘের মত লাফিয়ে উঠলো; তারপরে রাস্তায় বেরিয়ে এলো নিঃশব্দে; জন কয়েক লোক একটা খচ্চর নিয়ে রাস্তার ধারে ঘাপটি মেরে বসেছিলো। তাদের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালো লোকটা। তাদের ভেতরে সেই বুড়ো লম্পট রশিদ আল-দিনও দাঁড়িয়েছিলো। খ্ৰীস্টানকে দেখে বুড়োর ফ্যাকাসে চোখ দুটো লালসায় চকচক করে উঠলো। জুমুর‍্যুদ নীলাম ডাকার দিন তাকে ঘৃণায় প্রত্যাখ্যান করেছিলো। সেইদনিই বুড়ো প্রতিজ্ঞা করেছিলো। যেমন করেই হোক, যে কোন মূল্যেই হোক জুমুর‍্যুদকে তাকে পেতেই হবে। আসলে লোকটা ছিলো। একজন গোঁড়া খ্রীস্টান। বাজারে ঠাঁই পাওয়ার জন্যেই ইসলামের ভেক নিয়েছিলো সে। সে জানত মুসলমানপ্রধান বাজারে এই কৌশল ছাড়া সে কোন পাত্তা পাবে। না। এই মাত্র সে খ্রীস্টানটা আলী শারকে অজ্ঞান করে ফেলে রেখে এসেছিলো সে এই রসিদের ভাই-নাম বরসুম।

আলী শারকে কেমন করে খতম করে এসেছে সে সব কথা বরস্সুম তার দাদাকে খুলে বললো। পরিকল্পনা মত সব কাজই হয়েছে। এবার শেষ করতে হবে বাকি কাজটুকু। সেই কাজ করার জন্যে সবাই তাড়াতাড়ি আলী শার বাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেলো। বেচারা আলী শার জুমুর‍্যুদের জন্যে বাড়ির ভেতরেই ছোট্ট একটা হারেম তৈরি করে দিয়েছিলো। লোকগুলো হুড়মুড় করে সেই হারেমের মধ্যে ঢুকে পড়লো। মুহূর্তের মধ্যে জুমুর‍্যুদের মুখে কাপড় বেঁধে দিলো দস্যুরা। বাইরে দাডিয়েছিলো খচ্চর। লোকগুলো সেই খচ্চরের পিঠে চাপিয়ে তাকে সোজা নিয়ে হাজির করলো রসিদের বাড়িতে। সব কাজই শেষ হয়ে গেলো খুব তাড়াতাড়ি।

জুমুর‍্যুদকে নিয়ে নীল চোখো বুড়ো তার শোয়ার ঘরে ঢুকলো। চোখমুখের আবরণ খসিয়ে নেওয়ার পরে জুমুর‍্যুদ দেখলো বুড়ো রসিদ তার গা ঘেঁসে বসে রয়েছে। বুড়োর চোখ দুটো তখন লালসায় চকচক করে উঠেছে। চোখের কোনে তার ড্যালা-পাকানো পিচুটি থিকথিক করছে।

বুড়ো বললো—সুন্দরী, এখন তুমি আমার মুঠোর মধ্যে। আলী শারের মত বুড়বাকের ক্ষমতা নেই আমার কাছ থেকে তোমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। আমার এই দু হাতের আলিঙ্গনের মধ্যে একদিন তুমি ধরা দেবে, সুন্দরী; আমার ভালোবাসার দুর্বর বেগও সহ্য করতে হবে তোমাকে। কিন্তু সে সব কথা এখন থাক। তার আগে ওই নোংরা ধর্মবিশ্বাস তোমাকে ছাড়তে হবে। হ্যাঁ, শপথ করেই ছাড়তে হবে। তারপরে তুমি হবে খ্রীস্টান-আমার মত। তারপরে বসতে পারবে আমার কোলে। আমার ইচ্ছেমত যদি না চলো, অথবা উলটো-পালটা কিছু করে বাস তাহলে তোমার ওপর এমন নির্মম অত্যাচার শুরু হবে যে সে কথা কোনদিনই তুমি ভুলতে পারবে না। জানালা দিয়ে দেখ! কী দেখছ? একটা ঘেয়ো কুকুর। অবাধ্য হলে, তোমার অবস্থাও হবে অবিকল ওইরকম।

জুমুর‍্যুদের সুন্দর গাল বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়লো। ঠোঁট দুটো থরথর করে কেঁপে উঠলো তার। সে বললো-ওরে বদমাশ। ঢেড়ে বুড়ো। আমাকে কেটে কুঁচি করে ফেললেও আমার ধর্ম আমি ছাড়ব না। আমার ওপরে যত ইচ্ছে তুই অত্যাচার করতে পারিস, যত ইচ্ছে তুই মারধোর করতে পারিস আমাকে—আল্লাহর নামে কসম খেয়ে বলছি আমাকে তুই কোনদিনই পাবি নে। ধেড়ে বোকা পাঠার মত কোনদিন তুই যদি আমার ঘাড়ে চেপে বসিস তাহলেও আমার মন তাতে কিছুতেই সায় দেবে না। তোর পাপ কোনদিন অপবিত্র করতে পারবে না আমাকে। আর তার জন্যে খোদাতাল্লা কোনদিনই তোকে ক্ষমা করবেন না।

শুধু কথায় চিঁড়ে ভিজিবে না বুঝতে পেরে বুড়ো তার কয়েকটা ক্রীতদাসকে ডেকে বললো—উপুড় করে শুইয়ে দে হারামজাদীকে। চেপে ধার-বেশ শক্ত করে চেপে ধরা।

তারপরে প্রকাণ্ড একটা চাবুক নিয়ে বুড়ো তাকে প্রচণ্ড জোরে মারতে থাকে। চাবুকটা কেটে কেটে তার পিঠের ওপরে বসে যায়। এক-একটা চাবুক পিঠে পড়ে আর জুমুর‍্যুদ যন্ত্রণায় চিৎকার করে বলতে থাকে-আল্লাহ ছাড়া কোন ঈশ্বর নেই। আল্লাহর রসুল হজরৎ মোহাম্মদ।

যতক্ষণ পারলো বুড়ো তাকে চাবুক মেরে চললো। তারপর হাত দুটো অবশ হয়ে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে সে বললো—একে তোরা রান্নাঘরে নিয়ে যা! তোদের সঙ্গে ও থাকবে। ওকে কোন খাবার বা সরাব দিবি নে। যা-নিয়ে যা হারামজাদীকে।

এদিকে বেচারা আলী শার পরের দিন পর্যন্ত অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলো। নেশা কেটে গেলে কিছুটা ধাতস্থ হলো সে; তারপরেই জুমুর‍্যুদ-জুমুর‍্যুদ বলে ডুকরে কেঁদে উঠলো। জবাব দেওয়ার কেউ ছিলো না-দিলোও না কেউ জবাব। অগত্যা নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো আলী শার। টলটে-টলতে ঘরের ভেতরে গেলো। ঘর শূন্য; জিনিসপত্র সব ছড়িয়ে রয়েছে চারধারে। জুমুর‍্যুদ নেই।

ধীরে ধীরে সব কথা মনে পড়ে গেল আলী শারের। মনে পড়ে গেলো খ্রীস্টান লোকটার কথা। সে বেশ বুঝতে পারলো সেই বদমাইস জুমুর‍্যুদকে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছে। তার প্রাণের প্রতিমাকে লোকটা এইভাবে ধরে নিয়ে গেলো। এ যে সে সহ্য করতে পারছে না, মেঝেতে পড়ে সে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো—দুহাত দিয়ে ছিঁড়তে লাগলো মাথার চুল। টেনে-টেনে ছিঁড়তে লাগলো গায়ের জামা। দুগাল বেয়ে তার ঝরে ঝরে পড়তে লাগলো চোখের জল। হায়রে আজ সে সর্বস্বাস্ত।

মনের আবেগ সামলাতে না পেরে সে দৌড়ে রাস্তায় বেরিয়ে গেলো। কুড়িয়ে নিলো দু’খানা বড়-বড় পাথর। রাস্তা দিয়ে পাগলের মত ছুটতে-ছুটতে সেই পাথর দুটো সে তার বুকে ঠুকতে লাগলো। মুখে তার এক বুলি—’ও জুমুর‍্যুদ, তোমাকে ওরা কোথায় ধরে নিয়ে গেলো। কোথায় ধরে নিয়ে গেলো!’ কিছুক্ষণের মধ্যেই রাস্তায় লোক জড় হয়ে গেলো; শিশুরা তাকে পাগল মনে করে হৈচৈ করতে করতে তার পিছু পিছু ছুটলো। যে সব বয়স্কেরা তাকে চিনত তারা তার দুঃখে। জানালো সহানুভূতি। ব্যাপারটা জানতে পেরে তারাও দুঃখ করে বলতে লাগলো-বেচারা গ্লোরির ছেলে! সত্যিই ওরা দুঃখের শেষ নেই আজ।

কোন দিকে যাবে বুঝতে না পেরে চারদিকে ছোটাছুটি করলো আলী শার। পাথর ঠুকে-ঠুকে বাঁজরা করে ফেললো তার বুকের পাঁজর। এইভাবে ছুটতে-ছুটিতে সে একটি সৌম্যদর্শনা বৃদ্ধার সামনে এসে দাঁড়ালো। তার এহেন অবস্থা দেখে বৃদ্ধ বললেন-বাছা, আল্লাহ তোমাকে শান্ত করুন, রক্ষা করুন তোমাকে। তোমার এ-দশা কেন হলো বাছা?

আলী শার বললো।–

প্রেম-হীনতাই অসুখ আমার
হে ডাক্তার,
আমার রোগের অন্য কারণ নাই।
ওই নারীকে আমি যে চাই–
দাও না ফিরে ওকে।
ও-যে আমার ব্যথার প্রলেপ
আনন্দ মোর শোকে।

বৃদ্ধটি পরম স্নেহে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। সে বেশ বুঝতে পারলো মানুষটি বিরহের আগুনে জ্বলে যাচ্ছে, পুড়ে যাচ্ছে। তাই সে বললো-বাছা, আমাকে সব তুমি খুলে বলো। ভয় বা সংকোচ করো না। কিসের কষ্ট তোমার। তোমাকে সাহায্য করার জন্যেই বোধ হয়। রসুল আল্লাহ আমাকে এই পথে পাঠিয়েছেন।

তার জীবনের কথা, খ্রীস্টান দালালের কথা সব তাঁকে খুলে বললো আলী শার। বৃদ্ধাও তার সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। তারপরে আলী শার দিকে তাকিয়ে বললো—তুমি এখনই বাজারে চলে যাও। সেখান থেকে ফেরি করার একটি ঝুডি কিনে আনবে; সেই সঙ্গে আনবে। নানান জাতের কাচের চুডি, দুল, আর পুতির মালা। বড়-বড় বাড়ির ঝি-চাকরানীদের এই সব বিক্ৰী করার জন্যে বুড়ি ফেরিওয়ালীনিরা যেমনবাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায় আমিও তেমনি ওই বুড়িটা মাথায় নিয়ে, সেইরকম বাড়ি-বাড়ি ঘুরে বেড়াব। এই শহরের কোনবাড়ি বাদ দেব না। জুমুর‍্যুদের হদিশ না পাওয়া পর্যন্ত বাড়ি-বাড়ি আমি ফেরি করব। আল্লাহর ইচ্ছায় সে আমাদের কাছেই ফিরে আসবে। তুমি আর ভেব না। জলদি বাজারে চলে যাও।

ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ থামালো।

 

তিনশো বাইশতম রজনী?

পরের দিন রাত্ৰিতে শাহরাজাদ। আবার শুরু করলো গল্প বলতে। আনন্দে চোখে জল বেরিয়ে এলো আলী শারের। বৃদ্ধার দুটো হাত ধরে চুমু খেলো সে। তারপরে সে যা যা চেয়েছিলো সব কিনে এনে দিলো বাজার থেকে। এর মধ্যে একজন রূপকার এসে তাঁকে ফেরিওয়ালীর সাজে সাজিয়ে দিয়ে গেলো। মুখে দেওয়া হলো তামাটে রঙের প্রলেপ, যেন দেখলেই মনে হয় রোদে ঘুরে-ঘুরে মুখটা পুড়ে গিয়েছে। মাথায় জড়ালো একখানা কাশ্মীরী শাল। পরলেন বিরাট একটা সিস্কের বোরখা। ঝুডিটা চাপালো মাথার ওপরে। হাতে নিলো একটা লাঠি। বয়সের সঙ্গে বেশ মানিয়ে গেলো চেহারাটা। তারপরে ঠকঠক করে তিনি বেরিয়ে পড়লেন। শহরের বিভিন্ন এলাকায় যত ব্যবসায়ী আর ইনামদার ছিলো তাদের হারেমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ঘুরতে-ঘুরতে এসে পৌঁছলো রসিদ আল-দিনের দরজার কাছে। হতচ্ছাড়া খ্রীস্টান রসিদ। আল্লাহ তাঁর দোজখে অনন্ত কাল ধরে তাকে পুডিয়ে মারবেন।

বৃদ্ধ যখন রসিদ আল-দিনের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো ঠিক সেই সময় অর্ধমৃত্যু জুমুর‍্যুদকে টেনে-হিঁচড়ে রান্নাঘরে ক্রীতদাসদের মধ্যে নিয়ে আসা হলো। বেচারার ওপরে এতক্ষণ ধরে অত্যাচার চলছিলো। প্রচণ্ড ঘুষির চোটে কপাল ফেটে গালের পাশ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছিল তার। যন্ত্রণায় তখন কাতরাচ্ছিল জুমুরুদা। কাতরানির শব্দ জানোলা দিয়ে বেরিয়ে তীর কানে এসে ঢুকলো।

কড়া নাড়লো বৃদ্ধা। একটি ক্রীতদাস এসে দরজা খুলে দিলো। র্তাকে অভিবাদন জানালো ক্রীতদাসটি। বৃদ্ধ বললো—বাছা, অনেক সুন্দর সুন্দর জিনিস রয়েছে আমার ঝুডিতে, তোমাদের এখানে এমন কেউ কি নেই যে কিছু জিনিস কিনতে পারে?

ক্রীতদাস বললো—আছে আছে। এমন লোক নিশ্চয় রয়েছে। আপনি আসুন। এই বলে সে বৃদ্ধটিকে সোজা রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে বসতে দিলো। তারপরে বাড়ির প্রায় সব দাসদাসীরাই ঘিরে দাঁড়ালো। তিনি চুডি, হার, দুলা এত সস্তায় বেচিতে আরম্ভ করলেন যে অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি অনেকেরই মন জয় করে ফেললেন।

তাদের খুশী করে তিনি দেখতে পেলেন একটু দূরে মাদুরে শুয়ে একটি মেয়ে কাতরাচ্ছে। সবই বুঝতে পারলো সে। এ সেই জুমুর‍্যুদ। একেই তো সে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে সে তার কাছে উঠে গেলো; তার পাশে বসে ফিসফিস করে তাকে বললো-বাছা, সর্বশক্তিমান আল্লাহ তোমার সব কষ্ট দূর করবেন! তোমাকে উদ্ধার করার জন্যে তিনিই আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়েছেন। তুমিই তো সেই গ্লোরির ছেলে আলী শারের প্রেমিকা ক্রীতদাসী জুমুর‍্যুদ!

তারপরে ছদ্মবেশে সেখানে ফেরওয়ালীর বেশে সে কেমন করে এসেছে সে সব কথা সে তাকে বললো। তারপরে বললো—কাল সন্ধ্যেবেলা পালানোর জন্যে তৈরি থেকে। এই রান্নাঘরের জানালার পাশেই থাকবে। এখান থেকে রাস্তা দেখা যায়। রাস্তার ওপাশে অন্ধকার থেকে শিস শুনলে তুমিও পালটা শিস দিয়ে। তারপরে পাঁচিল টপকে রাস্তায় লাফিয়ে পড়ে। সেইখানে আলী শার তোমার জন্যে অপেক্ষা করবে।

আনন্দে আত্মহারা হয়ে জুমুর‍্যুদ তার হাত দুটি ধরে চুমু খেলো।

রসিদেরবাড়ি থেকে বেরিয়ে বৃদ্ধ সরাসরি আলী শারকে সব কথা জানিয়ে বললো-কাল সন্ধ্যাবেলারসিদের বাড়ির জানালোর নিচে তুমি অবশ্যই গিয়ে দাঁড়াবে। আর যা-যা বললাম সেই সব ঠিক-ঠিক করবে। বুঝেছি?

আলী শার কী বলে যে বৃদ্ধাকে ধন্যবাদ জানাবে বুঝতে পারলো না। নিদেনপক্ষে একটা উপহার দিতে পারলেও হয়ত সে সোয়াস্তি পেত। কিন্তু উপহারের কোন প্রয়োজন ছিলো না তার। আল্লাহর নির্দেশেই সে সব করেছে।

তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বৃদ্ধ বিদায় নিলো। আগামীকাল যাতে সে সফল হতে পারে। সেজন্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানালো। জুমুর‍্যুদ তাকে যে সাবধান করেছিলো সে কথাটা মনে পড়ে গেলো আলী শারের। কী যে হয়ে গেলো! কী করে এখন সে জুমুর‍্যুদের কাছে মুখ দেখাবে?

পরের দিন অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে নির্ধারিত স্থানে হাজির হলো আলী শার। সুযোগের অপেক্ষায় চুপচাপ বসে রইলো। ধীরে-ধীরে এগিয়ে চললো রাত্রি। উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তায় গত দুটি রাত তার চোখের পাতা পড়ে নি। বসে থাকতে-থাকতে এক সময় সে ঘুমের কোলে ঢোলে পড়ে। তারপরে কোন আর জ্ঞান ছিলো না তার। প্রয়োজনের সময় যে জেগে থাকে ভাগ্য তার হাতে বাধা-ভগবানের রাজত্বে এইটাই নিয়ম।

কিন্তু ভবিতব্য কেউ এড়াতে পারে না। তা না হলে, ওই রাত্ৰিতেই এক দুর্ধর্ষ ডাকাত কেনই বা ওই অঞ্চলে হঠাৎ এসে পড়বে? আর এলোই যদি, তাহলে ডাকাতির সুযোগ-সুবিধে খুঁজে বার করার জন্যে কেনই বা সেদিন রসিদের বাড়ির পাশে ওৎ পেতে বসে থাকবে? এইভাবেই নিয়তি আলী শারকে ঘুম পাডিয়ে দেয়; আর এইভাবেই সে ডাকাতকেও টেনে আনে।

তার গায়ে কী যেন একটা লাগলো। চমকে উঠলো ডাকত। জিনিসটা আর কিছু নয়। আলী শার ঘুমন্ত দেহ। তার পরণে অনেক দামী পোশাক ছিলো। ডাকাতটা সেই সব পোশাক তার গা থেকে খুলে নিলো। হঠাৎ রসিদের বাড়ির একটা জানোলা খুলে যেতেই ডাকাতটা চমকে পাশে সরে গেলো। ওপরের দিকে তার মনে হলো একটি মেয়ে শিস দিয়ে যেন তাকে ডাকছে। ডাকাতটার লোভ গেলো বেড়ে। সে-ও একটা শিস দিলো। তারপরেই সে অবাক হয়ে দেখলো একটা মেয়ে জানালা বেয়ে দড়ি ধরে পাঁচিল টপকাচ্ছে। মেয়েটা লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ার আগেই ডাকতটা তাকে পিঠের ওপরে চাপিয়ে চৌ-চৌ দৌড় দিলো। ব্যাটার গায়ে অসুরের মত ক্ষমতা। বেচারা আলী শার যেমন ঘুমিয়েছিলো তেমনি ঘুমিয়ে রইলো। জানতেও পারলো না কিছু।

ডাকাতটা বেশ জোরেই দীেড়াচ্ছিল। তার পিঠে চড়ে যাচ্ছে জুমুর‍্যুদ তা বুঝতে পারে নি। তাই সে বাহককে লক্ষ্য করে বললো—তবে যে বুড়ির কাছে শুনলাম শোকে-দুখে তুমি একেবারে কাহিল হয়ে পড়েছ। কিন্তু এখন তো দেখছি আলী শার, ঘোড়ার চেয়েও জোরে দৌড়চ্ছ তুমি।

কোন উত্তর দিলো না ডাকাতটা। শুধু তার গতিটা বাড়িয়ে দিলো। চুলের মুঠি ধরে ঘাড়টা বাকিয়ে তার মুখটা দেখার চেষ্টা করলো জুমুর‍্যুদ। একী, ডাকাতটার চুলগুলো যে শনের মত শক্ত। তখনই সে বুঝতে পারলো তাকে অন্য কেউ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আঁতকে অস্থির হয়ে সে ডাকাতটার মুখে জোরে একটা ঘূসি মোরল, চিৎকার করে উঠলো-কে রে তুই? কী রে তুই? তখন শহর ছেড়ে তারা বিরাট একটা মাঠের মধ্যে এসে পৌঁছেছে। এখানে চিৎকার করলেও কেউ শুনবে না। চারিদিকে অন্ধকার আর নিস্তব্ধতা থম-থম করছে। ডাকাতটা তাকে পিঠ থেকে নামিয়ে বললো-আমি একজন কুর্দ। আমার নাম জোবান। আহমদ আল-দানাফ-এর দলে আমার চেয়ে গায়ে বেশী জোর আর কারও নেই; বদমাইসিতে আমার জুড়িদার সেখানে নেই বললেই হয়। আমাদের দলে আমার মত চল্লিশজন দুঃসাহসী বীর রয়েছে। অনেক দিন আমরা নরম তুলুতলে মাংস পাইনি। কালকের রাতটা আমাদের যে কী আনন্দে কাটবে তা তুমি নিজেই বুঝতে পারবে। তোমার জীবনে অত সুখ কোনদিন তুমি পাওনি সুন্দরী। সত্যি সত্যিই তুমি ইনামদার। কাল রাত্ৰিতে একের পর এক আমরা তোমার ওপরে চাপাব; তোমার তলপেটে সুড়সুড়ি দেব; তার পরেই তোমার ওই দুটি উরুর মাঝখানে অন্ধকারে ডুবে যাব। কেবল আমি একা নাই-আমরা সবাই-একজন একজন করে চল্লিশজন।

বাপস। বলে কী। কী সাংঘাতিক বিপদের মধ্যে পড়েছে সে। অবস্থাটা ভাবতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়লো জুমুরুদা। নিজের গালেই চড় মারতে লাগলো। কী ভুলই না সে করেছে! এসে পড়েছে একেবারে চল্লিশ জোড়া হাতের মধ্যে।

চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বেচারাকাঁদতে  শুরু করলো। অজস্ব চোখের জল তার গাল দুটি ছাপিয়ে ঝরতে লাগলো অঝোর ধারায়। সে বুঝতে পারে ঠিক এই মুহূর্তে তার জীবনে ভয়ানক একটি দুৰ্যোগ নেমে এসেছে। সে কোপে পড়েছে শয়তানের। বেশী চেঁচামেচি করে এখন আর লাভ নেই তার। শক্তি ফিরে পাওয়ার জন্যে পরমেশ্বরের কাছে সে মনে মনে প্রার্থনা করতে থাকে।

সে মনে মনে বলে-আল্লাহ ছাড়া আমার আর কোন দেবতা নেই। তার প্রতি রয়েছে আমার অচলা ভক্তি। তার নির্ধারিত ভাগ্য আমাদের মেনে নিতেই হবে। নিয়তির বিধান কেউ খণ্ডাতে পারে না।

ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ চুপ করে গেলো।

 

তিনশো তেইশতম রজনী?

রাত্ৰিতে আবার শুরু করলো শাহরাজাদ। সেই ভীষণদর্শন কুর্দ জোয়ান জুমুর‍্যুদকে পিঠে চাপিয়ে আবার ছুটতে শুরু করলো। ছুটতে ছুটিতে অনেকক্ষণ পরে পাহাড় ঘেরা একটা গুহার সামনে এসে থামালো। এই গুহাটি চল্লিশ চোরের প্রধান ঘাঁটি। ওদের দলের সর্দারও এইখানে থাকে। গুহার সামনে এসে জুমুর‍্যুদকে পিঠ থেকে নামিয়ে দিলো। জোয়ানের বুড়ো মা-ও এইখানে থাকে। দলের সকলকে দেখাশোনা করে, রান্নাবাটিনাও করে দেয়। তাদের। গুহার দায়িত্ব তারই হাতে।

জুমুর‍্যুদকে নামিয়ে দিয়ে জোয়ান তার মাকে হাঁক দিলো, মা বেরিয়ে এলে জুমুর‍্যুদকে তাঁর হাতে জমা দিয়ে জোয়ান বললো।–আমি না ফেরা পর্যন্ত এই হরিণ শিশুটিাকে দেখো। ইয়ার-দোস্তদের সঙ্গে দেখা করতে চললাম। কাল দুপুরের আগে ফিরতে পারব না। আজ রাত্রে কয়েক জায়গায় চুরি করতে হবে কিনা? ভালো করে তোয়াজ করো মেয়েটাকে। এতগুলো মানুষের ভালোবাসা সহ্য করার মত ওর তাগিদ চাইত।

এই বলে জোয়ান যেমন ছুটে এসেছিলো তেমনি দৌড়ে বেরিয়ে গেলো।

জোয়ান চলে যাওয়ার পর বুড়ি এক মগ জল এনে দিয়ে বললো-বাছা, কী সুখই না তোমার হবে! চল্লিশটা জোয়ান মদদ তোমাকে যখন দলাই-মালাই করবে। তখন কী আনন্দ-ই না পাবে। তুমি? অবশ্য ওদের মধ্যে সর্দারটারই তাগিদ সব চেয়ে বেশী। ও একা চল্লিশ জনের মহড়া নিতে পারে। ঈশ্বর তোমার রূপ আর যৌবন দুই-ই দিয়েছেন। ওদের মনে ধরবে তোমাকে। তোমার কপাল ভালো।

সব কথাই শুনলো জুমুর‍্যুদ; কোন কথার জবাব দিলো না। বোরখা খুলে মাথার নিচে রেখে শুয়ে পড়লো। সারারাত একটুও পারলো না ঘুমাতে। সমস্ত রাত ধরে নিজের মনকে শক্ত করলে সে। ভোরবেলা নিজের মনে মনে বললো-এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া শয়তানেরও সাধ্য নেই। এখানে থাকার কথাও ভাবা যায় না। চল্লিশটা দানো আমার দেহটাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে খাবে, আর তারই জন্যে আমি অপেক্ষা করে বসে থাকব? কতী নেহি। আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, আমার আত্মা, আমার দেহকে যেমন করে হোক রক্ষণ আমি করবই।

মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে সে বুড়ির সামনে এসে বললো।—ম, তোমার আদর-যত্ন আর বাড়ির বিশ্রামে শরীরটা আমার একেবারে তাজা হয়ে উঠেছে। লোকজনের আদর আপ্যায়ন করতে আর আমার অসুবিধে হবে না। কিন্তু এতক্ষণ আমরা কী করব বলত? তার চেয়ে বাইরে চলো। রোদে বসে তোমার মাথার উকুন বেছে দেব।

কথা শুনে বুড়ি তো আনন্দে একেবারে গদগদ; বলে—তুমি কী সোনা মেয়ে গো! ভালোই…

তারপরেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে-দেখ, এখানে আসা অবধি একদিনও জল ঢালতে পারিনি। আমার মাথাতো নয়—একখানা ধৰ্ম্মশালা, হ্যাঁ, হ্যাঁ-উকুনের অতিথিসালা। জন্তু জানোয়ারদের মাথায় যতো রকমের উকুন থাকে তারা সবাই আমার মাথায় বাসা বেঁধেছে—সাদা উকুন, কালো উকুন, বুড়ো উকুন, চ্যাপসা উকুন—উকুনে উকুনে একেবারে ছয়েল্লাকার। সৈন্য সামন্তের মত রাত্রি বেলা তারা সব দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়—ছড়িয়ে পড়ে সারা গায়ে। একটা দেখেছিলাম। আবার লেজওয়ালা, আর কী বিছি গন্ধ গো, উঁ! চলো চলো! আমাদের সঙ্গে যতদিন আছ বাছা, তোমার ভালোমন্দ সব আমি দেখব। কথা দিলাম।

এই বলে জুমুর‍্যুদকে সঙ্গে নিয়ে বুড়ি বাইরে এসে বসলো।

মাথার কাপড় সরিয়ে উকুন বাছতে বসলো জুমুর‍্যুদ। বুড়ি ঠিকই বলেছে। রাশি-রাশি উকুন তার মাথার উপরে কিলবিল করছে। কয়েক মুঠো উকুন তুলে বাইরে ফেলে দিলো সে। তারপরে শক্ত চিরুনী দিয়ে চুলের গোড়াশুদ্ধ দিলো আঁচড়িয়ে। আর একটা একটা উকুন তুলে দুই আঙুলের ভেতের ধরে মারতে থাকে মটমট করে। তারপরে চুলের ফাঁকে-ফাকে আঙুল দিয়ে আস্তে-আস্তে ইলিবিলি কাটতে থাকে। আরামে বুড়ি ঢুলতে থাকে। তারপর একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।

বুড়িকে ঘুমাতে দেখে আর দেরী করলো না সে। গুহার ভেতরে ঢুকে পুরুষের পোশাক পরলো। ডাকাতরা কেখেকে একটা বিশাল পাগড়ী চুরি করে এনেছিলো। সেটাকে সে চাপাল মাথার ওপরে। কাছেই একটা ঘোড়া খুঁডিয়ে খুঁডিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে ঘাস খাচ্ছিল। এটাকেও তারা চুরি করে এনেছিলো। ঘোড়াটাকে ধরে জিন লাগালো সে। তারপরে তার ওপরে উঠে আল্লাহর নাম নিয়ে দমে ছুটিয়ে দিলো ঘোড়াটা।

সারাদিন ছুটতে-ছুটতে নেমে এলো রাত। ঘোড়া থামিয়ে বিশ্রাম নিলো জুমুর‍্যুদ; ভোর হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে আবার ছুটিয়ে দিলো ঘোড়া। চলার ফাঁকে-ফাকে একটু থেমে কয়েকটা ফলমূল সে খেয়েছে মাত্র, ঘোড়াটাকেও দিয়েছে। ঘাস-বিছালি খেতে। আবার ছুটেছে ঘোড়া নিয়ে।

এগার দিনের দিন মরুভূমি ছাড়িয়ে সে এসে দাঁড়ালো ঘাসের দেশে। ভারি সবুজ দেখতে ঘাসগুলি। এরকম সবুজ ঘাস সচরাচর দেখা যায় না। এখানে খাবার জলও রয়েছে, রয়েছে বড়-বড় চোখ-জুড়ানো গাছের সারি। আবার গাছে-গাছে ফুটছে ফুল। গাছের ছায়া, ঝর্ণার জল, আর গোলাপের গন্ধ সব মিলিয়ে পরিবেশটি বেশ মনোরম। গাছে-গাছে পাখির ডাক, হরিণ শিশুর দৌড় ঝাপ, আর ঈশ্বরের জগতে বিচিত্র পশুর সমাবেশ স্থানটিকে নয়নাভিরাম করে তুলেছে। বসন্ত যেন এখানে চির-বিরাজমান।

এই মনোরম পরিবেশে ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে জুমুর‍্যুদ আবার ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো। কিছুটা দূরে একটা জঙ্গল। সেই জঙ্গলের মধ্যে একটা রাস্তা সোজা সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছে। সেই রাস্তা ধরে সে এগিয়ে চললো। চলতে-চলতে বিরাট এক শহর চোখে পড়লো। তার। শহরের মসজিদের চুড়াগুলি সূর্যের আলোতে ঝকমক করছিলো। অনেক দূর থেকেই সেই ঝকমকনি তার চোখে এসে লাগছিলো।

শহরের কাছাকাছি আসতেই জুমুর‍্যুদ শুনতে পেলো এক সঙ্গে অনেক লোক চেঁচাচ্ছে। শহরের ফটকের সামনে আসতেই তার মনে হলো লোকগুলো যেন বিজয়োল্লাস করছে। সে কাছে আসতেই দরজা খুলে গেলো। আমির, ওমরাহ, ইনামদার, আর বিভিন্ন দলের নেতারা তাকে সম্বর্ধনা জানালো। তাকে কুর্নিশ করে নিচু হয়ে শুয়ে মাটিতে চুমু খেলো তারা।

জুমুর‍্যুদ তো অবাক। রাজা বা বাদশাহরা দেশ জয় করে ফিরে এলে সাধারণত এই ধরনের সংবর্ধনা জানান হয়। জনতা একসঙ্গে চিৎকার করে ওঠে—আল্লাহ আমাদের সুলতানকে দিগ্বিজয়ী করুন। হে সুলতান, আপনার আগমনে প্রজাদের মঙ্গল হোক। আল্লাহ আপনার রাজ্যশাসন আরও জোরদার করে তুলুন।

এমন সময় হাজার-হাজার সৈন্য সারিবীন্দী হয়ে এগিয়ে আসে; সরিয়ে দিতে থাকে উৎফুল্প জনতাকে। সুসজ্জিত উটের পিঠে চেপে এগিয়ে এলো একজন ঘোষক, চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে সে সুলতানের শুভাগমন ঘোষণা করলো।

ছদ্মবেশী জুমুর‍্যুদ এসবের অর্থ বুঝতে পারে না। নগর প্রধান পাশে-পাশে তার ঘোড়ার লাগাম ধরে আসছিলো। তাকেই সে বাধ্য হয়ে জিজ্ঞাসা করে—মালিক, ব্যাপারটা কী বলুন তো? আমাকে নিয়েই বা কী করতে চান আপনারা?

জবাবে সামনে এগিয়ে এলো রাজপ্রাসাদের রক্ষী। আভুমি নত হয়ে কুর্নিশ করে বললো-জাঁহাপনা, আল্লাহর কী করুণা! তই তিনি আপনাকে এখানে পাঠিয়েছেন। তাকে সেলাম। এদেশের রাজমুকুট তিনিই আপনার মাথায় পরিয়ে দিয়েছেন। মঙ্গলময় আল্লাহ আপনার মত সুন্দর তরুণ সুলতানকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কী চকচক করছে আপনারুমুখ! যেন খাস তুকী এক যুবক। খোদাতাল্লাকে ধন্যবাদ! তিনি কোন ভিক্ষুককে পাঠাতে পারতেন, বা পাঠাতে পারতেন কোন সামান্য লোককে। কিন্তু তা তিনি পাঠাননি। এজন্যেও তাকে ধন্যবাদ। সেই ভিক্ষুক এলেও আমরা তাকেও সুলতান বলে মেনে নিতাম। র্তাকেও আমাদের এই রকমই সংবর্ধনা জানাতে হোত।

ভোরের আলো ফুটে উঠলো। চুপ করে গেলো শাহরাজাদও।

 

তিনশো চব্বিশতম রজনী :

পরের দিন রাত্ৰিতে শাহরাজাদ। আবার শুরু করলো গল্প

রাজপ্রাসাদের রক্ষী বলে গেলো-আপনি বোধহয় আমাদের দেশের রীতি শুনেছেন। আমাদের দেশের সুলতান যদি কোন পুত্র সন্তান না রেখে মারা যান যে পথ দিয়ে আপনি এলেন সেই পথের দিকে আমরা তাকিয়ে থাকি; ভাবি কবে, আল্লাহ আমাদের নূতন সুলতান পাঠাবেন। সুলতানের মৃত্যুর পরে যিনিই এই পথে প্রথম আসবেন ঠিক আপনার মত র্তাকেই আমরা সুলতান বলে বরণ করে নিই। তাঁকেও আমরা ঠিক এইভাবে কুর্নিশ করি। আমাদের পরম সৌভাগ্য আল্লাহ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আর সবচেয়ে সুন্দর সুলতানকে আমাদের রাজ্যে পাঠিয়েছেন। এমন সুন্দর আর সুঠাম চেহারার সুলতান আর কোনন্দনিই আমরা দেখিনি, বা শুনিনি।

জুমুর‍্যুদের মাথায় নানান ফন্দি ফিকির ঘুরে বেড়ায়। প্রাসাদ রক্ষীর কথা শুনে সে চট করে ঠিক করে নিলো যে সে এমন কিছু করবে না যাতে তার আসল রূপটা ধরা পড়ে যায়। তার মুখে তাই কোন ভাবান্তর দেখা দিলো না। সে সবাইকে ডেকে বললো—অনুচরবৃন্দ, আমার কথা আগে শোনো। আমি তুকী বটে; কিন্তু সামান্য বা অজ্ঞাতকুলশীল কোন বংশে আমার জন্ম হয়নি। সম্রান্ত পরিবারে আমার জন্ম। দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াব বলে আমি দেশ ছেড়েছি। অবশ্য, দেশ ছাড়ার আগে আত্মীয়স্বজনদের জন্যে আমার মনোমালিন্য কিছু হয়েছিলো। পথ আমাকে এক নূতন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। এই অভিজ্ঞতার সুযোগ আমি ছাড়তে রাজি নই। কথা দিলাম, আমি তোমাদের সুলতানের মুকুট পরব।

এই বলে সে সকলের আগে-আগে চলতে লাগলো। হর্ষধ্বনি আর বিজয়োল্লাসের মধ্যে দিয়ে সে শহরে এসে ঢুকলো। তারপরে শোভাযাত্রার সঙ্গে সে এসে দাঁড়াল রাজপ্রাসাদের প্রধান ফটকের সামনে। আমীর-ওমরাহ, প্রাসাদরক্ষী, সভাষীদেরা ঘোড়া থেকে তাকে নামিয়ে নিলো। সংবর্ধনার জন্যে বিরাট হলো ঘরে তাকে নিয়ে গেলো তারা। গায়ে চড়ালো রাজ পোশাক। মৃত সুলতানের মুকুট তার মাথার ওপরে পরিয়ে দিয়ে সবাই মাটিতে লুটিয়ে তাকে সম্মান জানালো। তারপর দাঁড়িয়ে উঠে পাঠ করলো আনুগত্যের শপথ বাক্য।

জুমুর‍্যুদ রাজ্য শাসন শুরু করলো। কোষাগারের দরজা খুলে দেওয়া হলো। বিলি করা হলো ধনদৌলত। বংশ পরম্পরায় বহু যুগ ধরেই রাজকোষ উপছে পড়ছিলো। রাজকোষের বেশীটাই সে বিলিয়ে দিলো সৈন্য আর দরিদ্রদের মধ্যে। দু’হাত তুলে তারা আশীর্বাদ করলো-’আমাদের সুলতান দীর্ঘজীবী হোন! বহুকাল ধরে তিনি আমদের শাসন করুন।’ বড়-বড় ওমরাহদের বিভিন্ন পদে ভূষিত করলো। আমীর, প্রাসোদরক্ষী, তাদের মহিষী আর হারেমের মেয়েদের সে জানালো তার শুভেচ্ছা। তুলে নিলো অনেক কর আর শুল্ক। মুকুব করে দিলো বকেয়া কর। বন্দীশালার দরজা খুলে দেওয়ার আদেশ দিলো। মুক্তি দিলো বন্দীদের। সমস্ত মাকেদ্দমা নিলো তুলে। ফলে, ছোট-বড় সকলের ভালোবাসা তার উপরে বর্ষিত হলো অবশ্য ওর পেছনে আরও বড় কারণ ছিলো। পুরুষ হয়েও সে হারেমের দরজা মাড়ায় না, এ-তো পয়গম্বর ছাড়া আর কেউ নয়! কী সংযম! আসল সত্যটা অবশ্য কারুরই জানার কথা নয়। রাত্রে তাকে পাহারা দিত দুটি বাচ্চা খোজা। ইচ্ছে হলে তারা ঘুমোতেও পারত। এরা ছাড়া রাত্রে আর কারও প্রবেশাধিকার ছিলো না। প্রজারা সুখেই ছিলো। সুখ ছিলো না জুমুর‍্যুদের মনে। দিন রাত সে আলীশার কথাই ভাবত। তার কথা মনে করে বড় দুঃখে দিন কাঁটাত জুমুর‍্যুদের। তার মনের অবস্থা কারুরই জানার কথা নয়। গোপনে-গোপনে সে আলী শারের অনুসন্ধান করে; কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। একান্তে চুপচাপ বসে কাঁদে। উপোস করে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানায় যাতে সে তার মনের মানুষকে খুঁজে পায়। সে সাচ্চা মুসুলমান। তাই তার স্থির বিশ্বাস আলী শারকে সে খুঁজে পাবেই। প্রতীক্ষায় একটা বছর কেটে যায়। তার। হারেমের রমণীরা হতাশায় ভেঙে পড়ে বলে-হায়, আমাদের কী দুৰ্ভাগ্য! আমাদের সুলতান জিতেন্দ্ৰিয় তপস্বী।

একটা বছর গেলো কেটে। জুমুর‍্যুদ একটা পরিকল্পনা তৈরি করলো। সেই পরিকল্পনাটি তাড়াতাড়ি যাতে কার্যকরী হয়। সেই জন্যে সে রাজ্যের উজির আর অন্যান্য মন্ত্রীদের ডেকে এনে বললো—আমার রাজ্যে যত রাজমিস্ত্রী আর প্রযুক্তিবিদ রয়েছে সবাইকে খবর দিন। এক প্যারাসাঙ (আনুমানিক সওয়া তিন মাইল)। লম্বা আর এক প্যারাসাঙ চওড়া একটা জায়গা সমান করে তার চারদিকটা ঘেরার ব্যবস্থা করুন। তার ঠিক মাঝখানে থাকবে বড় গম্বুজাকৃতি একটি প্রাসাদ। প্রাসাদের ভেতরে থাকবে একটি সিংহাসন। মেঝেতে বিছানো থাকবে সবচেয়ে সুন্দর লাল পারস্য দেশের একটা গালিচা। রাজ্যের প্রধানদের জন্যেও বসার ব্যবস্থা সেখানে থাকবে। তার নির্দেশতম সব কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলো। এইখানে শহরের আর প্রাসাদের সমস্ত গণ্যমান্য মানুষদের সে ডাকলো। বিরাট ভোজ হলো। এমন এলাহি ভোজ আগে কেউ কোনদিন দেখেনি; স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি। ঝর্নার মত সরাবও উপছিয়ে পড়লো। চারপাশে।

খানাপিনার শেষে জুমুর‍্যুদ সবাইকে বললো-প্রতিটি মাসের প্রথমে আমি আপনাদের এইখানে নিমন্ত্রণ করব। যোগ্যতা অনুযায়ী আপনারা এইখানে আসন গ্রহণ করবেন। সেই একই সময়ে আমার রাজত্বের সমস্ত প্রজারা আপনাদের সঙ্গেই ভোজের অনুষ্ঠানে যোগ দেবে। সমস্তই যিনি দেন। সেই খোদাতালাকে তারা ধন্যবাদ জানাবে ঘোষকের মারফৎ প্রচারিত হবে আমার এই নির্দেশ। যে অমান্য করবে। তার ফাঁসী হবে।

পরের মাসের প্রথমেই শহরের পথে-পথে ঘোষকের কণ্ঠ শোনা গেলো-ক্রেতা-বিক্রেতা, ধনী-নির্ধন, ক্ষুধার্ত-অক্ষুধার্ত, -আমাদের সুলতান সবাইকে তীর নূতন প্রাসাদে নিমন্ত্রণ করেছেন, সেখানে তোমরা খানাপিনা করবে। আর খোদাতালাকে ধন্যবাদ জানাবে। যে নিমন্ত্রনে যাবে না। তার ফাঁসী হবে। যে যেখানে ছিলো সবাই দোকান-পাট, কেনা-বেচা বন্ধ করে নিমন্ত্রণে চলে এলো; চলে এলো হাতের কাজ ফেলে। না এলে, গর্দান যাবে।

আছাড় খেয়ে পড়লো। সিংহাসন আলো করে বসে রয়েছেন সুলতান; তঁকে ঘিরে বসে রয়েছেন আমীর-ওমরাহের দল। নানা রকম খাবার পরিবেশন করা হলো প্রজাদের, ভেড়ার মাংস, বিরিয়ানি, দই আর চালের গুড়ো দিয়ে তৈরি কিস্ক নামে অপূর্ব এক রকমের খাবার। খাবার সময় সুলতান তাদের খুঁটিয়ে-খুটিয়ে দেখছিলো, প্রজারাও তা লক্ষ্য করতে ভোলে নি। খেতে-খেতে একজন তো তাদের পাশের লোককে ফিসফিস করে বলেই ফেলে-আল্লাহ কসম। আমার ভয় করছে। সুলতান আমার দিকে আমন করে তোকাচ্ছেন কেন?

যে যার আসনে বসে অমাত্যরা তাদের উৎসাহিত করতে লাগলেন—’খাও, খাও; বাছারা পেট পুরে খাও। কোন লজ্জা করো না। যে যত বেশী খাবে সে-ই তত সুলতানকে খুশী করতে পারেব।’ নিজেরাও তারা বলাবলি করতে থাকে—সুলতান আমাদের খুব ভালোবাসেন। আমাদের মঙ্গলের জন্যে তাঁর কত চিন্তা। এরকম সুলতান জীবনে আর কখনও দেখি নি আমরা।

এমন অপরূপ খাবার কোনদিন তারা যেন খায়নি–এইভাবে প্রতিটি খাবার তারা চেখে চোখে তারিফ করে খাচ্ছিল; কিন্তু তাদের ভেতরে একটা লোক ছিলো যে হচ্ছে সব চেয়ে পেটুক। সেই লোকটা থালার পর থালা টানছে আর নিঃশেষে তা উড়িয়ে দিচ্ছে। এই হাভাতে লোকটা হলো সেই খ্রীস্টান বরস্সুম। ওই লোকটাই তার দাদা রসিদ আল-দিন আর সাঙ্গাপাঙ্গদের সঙ্গে আলী শারকে অজ্ঞান করে জুমুর‍্যুদকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো। প্রচুর মাংস আর বিরিয়ানি খাওয়ার পরেও তার থালা সকলের আগেই শেষ হয়ে যাচ্ছিল। নিজের থালা শেষ করে। এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে দেখলে সে। ঘিয়ে সপসাপ করছে একথালা বিরিযানি একটু দূরে রাখা ছিলো। গরম মশলার গন্ধে মাতোয়ারা এই থালাটা তার নাগালের বাইরে থাকায় সে একজনের ঘাড়ের উপরে কাঁপিয়ে পড়লো; তারপরে যতটা পারলো মুঠো করে এক খামচা বিরিয়ানি নিয়ে গপ করে মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো। মনের আনন্দে চোখ দুটো বুজে এলো তার।

ভোর হয়ে আসছে দেখে চুপ করে গেলো শাহরাজাদ।

 

তিনশো পাঁচশতম রজনী?

পরের দিন রজনীতে আবার গল্প শুরু করলো শাহরাজাদ। যে লোকটি বরস্সুমের পাশে বসে খাচ্ছিল সে খোঁকিয়ে উঠলো তার রকম দেখে-’ছি-ছি। কী রকম হ্যাংলা গো তুমি। ওরকম লম্বা হাত বাড়িয়ে খাবারটা তুলে নিতে তোমার একটুও লজ্জা করলো না? পাতে যেটুকু পড়বে সেইটুকু খাওয়াই তো শিষ্টাচার-এটা তুমি জান না?’

আর একজন বললো-’অত যে খাচ্চ। পেট ছাড়লে তখন বুঝবে ঠেলা!’ একটা ভাঙখোর মজা করে বললো-আমার কাছে উঠে এসো বাপধন; আমার খাবারটা ভাগ করে খাব। আমি খাব। একমুঠো। বাকিটা সব তুমিই গেলো।

বরসুম চোখ পাকিয়ে বলে-ওরে গেজেল ভাঙখোরা। তোর দাঁতই নেই; ভালো মাংস খাবি কী করে? ওসব রান্না আমাদের মত ভদ্রলোকদের জন্য।

এই বলে সে ভাঙখোরের থালার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো; সঙ্গে-সঙ্গে সুলতানের চারটি রক্ষী তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লো; টেনে ফেলে দিলো তার মুখ থেকে মাংসের টুকরোটা। বরসুমকে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছিলো জুমুর‍্যুদ। তাকে চিনতে পেরে দেহরক্ষীরা সুলতানের কাছে ধরে নিয়ে এসে ঘাড় নিচু করে দাঁড় করিয়ে দিলো। সবাই তো হতভম্ব। ব্যাপারটা কী হলো! একজন চুপিচুপি পাশের লোককে বললো-‘হাড় কিপটে পেটুক হলে কী দশা হয় দেখ। অন্যের খাবার তুলে নেওয়াটা কি সোজা পাপ।’ সে ভাঙখোরটা মন্তব্য করলো—আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়েছেন। ভাগ্যিস আমার বিরিয়ানিটা নেওয়ার জন্য ওকে বলিনি। বললে, আরও কী সাংঘাতিক শাস্তি ও পেত। কে জানে।’ খানাপিনা থামিয়ে সবাই তার দিকে তাকিয়ে রইলো।

জুমুর‍্যুদের চোখে তখন আগুন জ্বলছে। স্বর যথাসম্ভব সংযত করে সে বলে-তোমার চোখ দুটো দেখছি নীল। এ চোখ পাপের চোখ। তোমার নাম কী? কী কর তুমি? তুমি তো এদেশের মানুষ নও। এদেশে এসেছি কেন?

খ্রীস্টান লোকটার মাথায় ছিলো একটা সাদা পাগড়ী। অবশ্য মাথার ওপরে সাদা পাগড়ী চাপালেই মুসলমান রেহাই পায় না। বরস্সুম বললো-মালিক সুলতান, আমার নাম আলী। আমি ফিতে তৈরি করে খাই। আপনার দেশে এই ব্যবসা করেই আমি দুবেলা দু’খানা রুটির যোগাড় করে বেঁচে আছি।

জুমুর‍্যুদ ওর একটা বাচ্চা খোজাকে বললো—আমার টেবিলে আল্লাহর দোয়া দেওয়া বালি রয়েছে। নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি। সেই সঙ্গে আমার কলামটাও নিয়ে আসবি।

জিনিসপত্র আনা হলে, জুমুর‍্যুদ সামনের টেবিলে খুব সাবধানে বালিগুলি বিছিয়ে দিলো। কলম দিয়ে কী সব যে আঁকিবুকি কাটলো। দেখা গেলো। সে একটা বাঁদর একেছে। সেই সঙ্গে টেনেছে কয়েকটা রেখা। সেগুলি ঠিক কী তা বোঝা গেলো না। চারপাশ চুপচাপ। কিছুক্ষণ ছবির দিকে একমনে তাকিয়ে রইলো জুমুর‍্যুদ। তারপরে সবাই শুনতে পায় এই ভাবে হঠাৎ সে চেঁচিয়ে উঠলো।–তুই একটা কুত্তা! সুলতানের সামনে দাঁড়িয়ে তুই মিথ্যে কথা বললি! তুই তো খ্রীস্টান, তাই না? তোর নাম বরস্সুম। এদেশে তুই এসেছিস একটা ক্রীতদাসীর খোজে। মেয়েটাকে তুই তারবাড়ি থেকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলি। শয়তান, এই সিদ্ধােবালির সামনে কিছুই লুকানো যায়। না। কুকুরের অধম তুই-স্বীকার কর তোর দোষ।

ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে-কাঁপতে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে বরসুম। জোড়হাত করে বলে-ক্ষমা করুন, হুজুর। দোয়া মাঙছি। আমি আপনার কাছে আর কিছু লুকাব না। ভগবান আপনাকে রক্ষা করবেন। সত্যি-সত্যিই আমি খ্রীস্টান। নিচু ঘরে আমার জন্ম। আমাদেরবাড়ি থেকে একটা ক্রীতদাসী পালিয়ে গিয়েছে। তাকেই খুঁজতে আমি এদেশে এসেছি। অবশ্য মেয়েটাকে আমিই চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলাম। অত্যাচারও তার ওপরে যথেষ্ট করা হয়েছে।

উপস্থিত প্রজাদের মধ্যে সবাই প্রায় ফিসফিস করে কথা বলতে লাগলো-আল্লাহর কসম, তামাম দুনিয়ায় এমন সবজান্ত সুলতান আর কোথাও আমরা দেখিনি। বালি দিয়ে কী চমৎকারই

না। তিনি সব বলে দিলেন।

জহ্লাদকে ডেকে বললো জুমুর‍্যুদ–শহরের বাইরে নিয়ে গিয়ে এর জ্যান্তি ছাল ছাড়িয়ে নেবে। সেই ছাল শুকনো করে শহরের দরজার গায়ে পেরেক দিয়ে দেবে সেঁটে। ওর দেহটা ঘুটে দিয়ে পোড়ানোর পরে সেটা ফেলে দেবে নর্দমায়।

আদেশ পালন করতে জহাদের দেরী হলো না। সেই শাস্তি অনুমোদন করে যে যার ঘরে ফিরে গেলে।

ঘটনাটা নিয়ে বারসুমের প্রতিবেশীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করলো। একজন বললো-’আল্লাহর কসম, বিরিয়ানির ওপরে আর কোনদিন লোভ দেখাব না। খেতে ভালো লাগিলেও, আর না বাবা!’ ভাঙখোর ভয়ে পেটটা চিপে ধরে বললো-’ওই শয়তান বিরিয়ানির হাত থেকে আল্লাহ আমাকে খুব বাঁচিয়েছেন।’ সেদিন সকলেই এক বাক্যে শপথ নিলো আর কোন দিন তারা ওই বিরিয়ানির ধার দিয়ে হাঁটবে না।

পরের মাসে প্রথম সপ্তাহে যথারীতি আবার ভোজের আয়োজন হলো। এবার বিরিয়ানির প্লেট থেকে সবাই দূরে গিয়ে বসলো। নিজের নিজের পাতের খানা আর সরাব খেয়ে তারা অবশ্য সুলতানকে খুশী করার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলো। সেই সঙ্গে আর একটা জিনিস দেখা গেলো নিজের পাত ছাড়া কেউ আর পরের পাতের দিকে নজর দিচ্ছে না।

ভোজ পুরোদমে চলছে এমন সময়ে সবাইকে ধাক্কা দিয়ে একটা ভীষণ-দর্শন লোক ভোজঘরে এসে ঢুকলো। এই লোকটাই কেবল বিরিয়ানির থালার সামনে বসলো। ভয়ে-ভয়ে সবাই দেখলো লোকটা দু’হাতে করে বিরিয়ানি খাচ্ছে।

সঙ্গে সঙ্গে জুমুর‍্যুদ চিনতে পারলো লোকটাকে। এ সেই ভীষণ চেহারার কুর্দ-চল্লিশ চোরের এক চোর। এদের সর্দার হলো আহমদ অলদানাফ। সেদিন দুপুরে মেয়েটাকে নিয়ে শোবে বলে সে দলবল নিয়ে গুহায় ফিরে এসেছিলো। মেয়েটা পালিয়ে গিয়েছে শুনে সে ভীষণ চটে গিয়ে নিজের হাতেই ঘুষি মেরে বলেছিলো—দুনিয়ায় যেখানেই থাক মেয়েটাকে সে ধরে আনবেই। সে যদি পাতাল বা গুটিপোকার মধ্যে লুকিয়ে থাকে তাহলেও তার রেহাই নেই। খুঁজতে-খুঁজতে সে এইখানে এসে পড়েছে। ভগবানের মোর একেই বলে। যাকে সে খুঁজে বেড়াচ্ছে সে-ই এখানকার সুলতান। ওর নিয়তিই শেষ পর্যন্ত ওকে এইখানে ‘টেনে আনলো-এইখানেই ওর মৃত্যু লেখা ছিলো।

ভোর হয়ে আসছে দেখে গল্প বলা থামিয়ে দিলো শাহরাজাদ।

 

তিনশ ছাব্বিশতম রজনী :

পরের দিন রাত্ৰিতে আবার শুরু হলো গল্প।

দেখে সবাই ভয়ে চিৎকার করে উঠলো—’আরে আরে, কর কী! কুর কী! তোমার জ্যািন্ত ছাল তুলে দেবে জহাদ। ওই পাপের খানায় হাত দিয়ে না বাপু; সাবধান’। চারপাশ থেকেই শব্দ শোনা যায়-আরে আরো গিদাধোড় কঁহাকার…

চারপোশ তাকিয়ে চোখ দুটো পাকিয়ে জবান দাঁত খিচিয়ে বললো।— থাম ব্যাটারা! বিরিয়ানি আমার খুব ভালো লাগে। ওই খেয়েই পেট ভরাব আজ।

পাশ থেকে একজন বললো-পেট ভরাবে? আর জ্যান্ত যখন গায়ের ছাল ছাড়িয়ে নেবে? খেয়েছ কি মরেছ। ফাঁসীতে লটকাতে হবে। তখন বুঝবে বিরিয়ানি খাওয়া কাকে বলে।

কে কার কথা শোনে? যে-হাতটা সে বিরিয়ানির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো সেই হাত দিয়েই সে থালাটা টেনে নিলো; থালার ওপরে ঝুঁকেও গন্ধ শুকলো প্রাণভরে। মুখ থেকে খানিকটা লালাও পড়লো গড়িয়ে তার কাছে বসেছিলো সেই ভাঙখোরটা। এসব দেখে তার নেশা গেলো ছুটে। সে তাড়া তাড়ি দূরে সরে গেলো। বাপরে! এসবের মধ্যে সে আর নেই।

কাকের পায়ের মত মিশেমিশে কালো জবানের দুটো হাত। খাবলা খাবল বিরিয়ানি তুলে নেওয়ার সময় সেই হাত দুটোকে মনে হচ্ছিল। উটের পায়ের মত। বিরাট বিরাট বলের মত করে দলা পাকিয়ে বিরিয়ানি হাতে তুলে নিয়ে গলার ভেতরে ছুঁড়ে দেয়; তারপরে কেঁৎ করে গিলে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে বিকট একটা আওয়াজ করে-মনে হবে গুহার ভেতরে ভীষণ একটা বাজ পড়লো বুঝি। সেই আওয়াজ প্রাসাদের গায়ে ধাক্কা লেগে প্রতিধ্বনি তোলে। থালাটার ওপরে চুর করে বিরিয়ানি সাজানো ছিলো। কয়েকটা খাবলা তুলে নেওয়ার পরে বিরাট একটা গর্ত দেখা গেলো। সেখানে। সকলেই দেখে সেই গর্তের নিচে থালাটা বেরিয়ে পড়েছে।

সেই ভাঙখোর চিৎকার করে উঠলো-ওরে বাবা! এক মুঠোয় যে সবটাই তুলে নিয়েছে রে! আল্লাহ আমায় বাঁচিয়েছেন। ভাগ্যিস আমাকে বিরিয়ানি করে পাঠাননি। ওর যে ছাল ছাড়ানো হবে সেটা ওর কপালেই লেখা রয়েছে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। উঃ! কী গোরাস যে বাবা। ওই গোরাসের বাছাধন, তুমি খতম!

কোন ভ্রূক্ষেপ নেই কুর্দ ডাকাতের। কে কী বলছে গায়ে মাখলো না সে। দ্বিতীয় গ্রাস তোলার জন্য হাতটা সে আবার ঢুকিয়ে দিলো বিরিয়ানির ভেতরে। খপ করে একটা আওয়াজ হলো। মুঠো ভর্তি করে দলা পাকাতে লাগলো বিরিয়ানিটা। গ্রাসটা মুখে পোরার ঠিক আগে জুমুর‍্যুদ রক্ষীকে বললো-ওই গ্রাসটা মুখে পোরার আগেই লোকটাকে আমার কাছে ধরে নিয়ে এসো।

রক্ষীরা ঝাঁপিয়ে পড়লো জবানের ওপরে। মুখ নিচু করে গ্রাসটা মুখে তুলছিলো বলে সে রক্ষীদের দেখতে পায়নি। হাত দুটো পিঠ মোড়া করে তাকে সুলতানের কাছে হাজির করা হলো। সবাই বলাবলি করতে লাগলো-কেমন সাজা! পইপই করে বারণ করলাম-ব্যাটা, বিরিয়ানি ছুসনে। শুনলে আমাদের কথা? এবার বোঝা ঠেলাটা, ওই অভিশপ্ত বিরিয়ানি যে ছোবে তারই সর্বনাশ হবে।

জুমুর‍্যুদ জিজ্ঞাসা করে-কী নাম তোমার? করা কী? আমাদের শহরে এসেছি কেন?

জবান বললো—আমার নাম আটুমান। পেশায় মালী। শহরে এসেছি কাজের খোঁজে।

সেই মন্ত্রপূত বালি আর কলম নিয়ে আয়-রক্ষীদের আদেশ দিলো জুমুর‍্যুদ।

বালি আর কলম এলো। আগের মতই বালির ওপরে আঁকাজোকা শুরু হলো। অনেকক্ষণ কী জানি কী সব হিসাব করে হঠাৎ জোরে চেঁচিয়ে উঠলো জুমুর‍্যুদ-মিথ্যেবাদী, তোর কপালে দুঃখ আছে। গুণে দেখলাম, তোর আসল নাম হচ্ছে জবান। তোর পেশা হলো চুরি, ডাকাতি, আর খুন করা। শুয়োরের বাচ্চা। ঠেঙিয়ে তোর মুখ থেকে সত্যি কথা বলাব।

জবান বুঝতে পারলো না যাকে সে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো এই সুলতানই মেয়ে! ভয়ে লোকটা কেমন নীল হয়ে গেলো। দাঁতে দাঁত লেগে একটা কটকট আওয়াজ বেরুতে লাগলো তার মুখ থেকে। ঠোঁট দু’খানা সামনে পড়েছে ঝুলে। সত্যি কথা বললে রেহাই পেতে পারে এই ভেবে সে বললো।—মৗলিক আপনি ঠিক কথাই বলেছেন। এখানে আসাটাই আমার ভুল হয়েছে বুঝতে পারছি। এই শহর ছেড়ে আমি সোজা বেরিয়ে যাব। কথা দিচ্ছি, আর কোনদিন এমুখে হব না।

জুমুর‍্যুদ বললো—তোর মত শয়তানকে বাঁচিয়ে রাখলে গুনাহ হবে। তুই মুসলমানের কুলাঙ্গার…একে বাইরে নিয়ে গিয়ে জ্যান্ত ছাল ছাড়িয়ে নে। লোকে যাতে দেখতে পায় এই ভাবে প্রাসাদের সামনে ওর চামড়াটা ঝুলিয়ে রাখবি। খ্রীস্টানের লাশটা যেভাবে পাচার করেছিলি এর লাশটাও সেইভাবে নর্দমায় ফেলে দিবি।

রক্ষীরা তাকে টানতে-টানতে বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় ভাঙখোরটা বিরিয়ানির দিকে േ করে বসলো, বললো—-ওরে বিরিয়ানি, গরম মশলা দেওয়া বিরিয়ানি, আর কোন দিন তোর মুখ আমি দেখব না। তুই মহাপাপী তোর সঙ্গে আমার আর কোন সম্পর্ক নেই। তোকে দেখে আমার ঘেন্না হয়। তোর মুখে আমি থুথু ফেলি।

ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ চুপ করে গেলো।

 

তিনশো সাতাশতম রজনী :

পরের দিন রাত্ৰিতে আবার শুরু করলো।

আগের মতই তৃতীয় ভোজের আয়োজন হলো। সিংহাসনে বসে আছেন সুলতান। চারপাশ ঘিরে পাত্র-মিত্ব-সভাসদ। সামনে প্রজারা প্রাণভরে আহার করছে, পান করছে সরাব, স্মৃর্তিতে চেঁচাচ্ছে! একটা জায়গা ছাড়া প্রাসাদের সারা কক্ষটাই গিয়েছে ভরে। বিরিয়ানির থালাটা যেখানে ছিলো সেখানে কেউ বসে নি। সব বসেছে পেছন করে। সাদা দাড়ীওয়ালা একটা লোক ঘরে ঢুকে বিরিয়ানির সামনে যে ফাঁকা জায়গাটা ছিলো সেইখানে বসে পড়লো। লোকটাকে চিনতে পারলো। জুমুর‍্যুদ। লোকটা হচ্ছে রসিদ আল-দিন। এই লোকটাই সাঙ্গপোঙ্গ নিয়ে তাকে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো।

রসিদ আল-দিন এখানে এলো কী করে? মেয়েটার খোঁজ করতে তার ভাই বর সুম তো আগেই এসেছিলো বেরিয়ে। একমাস কেটে গেলো। তবু তো ফিরলো না। ভাই-এর খোঁজ করতে তাই এবার সে নিজেই বেরিয়ে পড়লো। নিয়তিই তাকে টেনে আনলো এইখানে। আর এমনি কপাল যে ঘরে ঢুকেই সে বসে পড়লো বিরিয়ানির সামনে। জুমুর‍্যুদ ভাবে-আল্লাহর কী অদ্ভুত খেয়াল। সব বদমাইশ-এর ওই একই রা। কিন্তু এরকম হওয়া তো ঠিক নয়। প্রজাদেরও বিরিয়ানি খেতে হবে। আমি আজই আদেশ দেব যে খাবে না তার ফাঁসী হবে। কিন্তু তার আগে ওই বুড়ো শয়তানটাকে টিন্ট করে দিই।

রক্ষীদের বললো-বিরিয়ানির সামনে যে বুড়োটা বসে রয়েছে ওকে ধরে নিয়ে এসো।

টানতে টানতে রক্ষীরা বুড়োটাকে তার সামনে এনে হাজির করলো।

–কী তোমার নাম? পেশা কী? এদেশে এসেছি কেন?

রসিদ বললো—হে পুণ্যতম সুলতান, আমার নাম রুস্তম। আমার কোন পেশা নেই। নেশা আমার ঘুরে বেড়ানো। আমি দরবেশ।

আবার সেই বালি এলো; এলো কলম। আবার সেই আঁকাজোঁকা চললো। আবার কিছুক্ষণের জন্যে চুপচাপ সুলতান-ভগবাবেগে তন্ময়। তারপরেই সে চেঁচিয়ে উঠলো-দরবেশ না, শয়তান তুই! সুলতানের সামনে মিছে বাত! তোর নাম রসিদ আল-দিন। মেয়েদের ওপরে অত্যাচার করাই তোর নেশা; পরেরবাড়ি থেকে মেয়ে চুরি করাই তোর পেশা। বাইরে তুই মুসলমান সেজে বেড়াস; ভেতরে তুই পাকা খ্রীস্টান। নানান বন্দ কাজ করার ফলে নিজের ধর্মেও তুই পতিত। আমার প্রজাদের কাছে সব স্বীকার করা। নইলে ধড় থেকে তোর মুণ্ডটা নামিয়ে দেব।

মাথাটা বাঁচানোর তাগিদে সব কবুল করলো রশিদ।

জুমুর‍্যুদ রক্ষীদের বললো-লোকটার পা দুটো ওপর করে মাথাটা নিচের দিকে ঝুলিয়ে রোখ। এক একটা পাছায় হাজারটা করে জুতো মার।

জুতো মারা শেষ হলে জুমুর‍্যুদ বলে-আগের দুটো কুত্তার চামড়ার সঙ্গে এর চামড়াটা ঝুলিয়ে রোখ।

রশিদকে টেনে বার করে নিয়ে যাওয়ার পরে সবাই আবার খাবারে মন দিলো। সুলতানের দিব্যজ্ঞান আর বিচারের দক্ষতায় তারা মুগ্ধ।

দিন যায়। কিন্তু যাকে সে খুঁজে বেড়াচ্ছে সে কোথায়? জুমুরু্যদের মনে সুখ নেই। রাজপ্রাসাদে ফিরেও কিছুই ভালো লাগে না তার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপন মনেই সে বলে-আল্লাহ পরম করুণাময়, প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা যেন আমার থাকে।…হে ঈশ্বর, সর্বশক্তিমান তুমি। আমাকে করুণা কর। আমার আলী শারকে ফিরিয়ে দাও। এ-দুনিয়ায় আমার মত কত হতভাগিনী রয়েছে। হে আল্লাহ, তাদের মনে তুমি শান্তি দাও প্রভু।

আলী শারের স্মৃতিটা তাকে তুষের আগুনের মত দগ্ধ করছে। সারা রাত তার চোখে ঘুম নেই। চোখের জলে শেষ হয়ে যায় রাত। আবার আশায় সে পরের মাসের জন্যে বুক বঁধে।

সেই প্রাসাদ, সেই ভোজনকক্ষ, সেই প্রজাবৃন্দ, আর সেই একই পরিবেশ! আমাত্যপরিবৃত হয়ে সুলতান বসে বসে প্রজাদের ভোজন দৃশ্য দেখছে। জুমুর‍্যুদ দুরু দুরু বুকে বলে–আল্লাহ, যোশেফকে তুমিই তার বাবার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলে। আলী শারকে তুমি আমার কাছে এনে দাও। আলী শারকে এনে দাও তার এই ক্ষুদ্র বাঁদীর কাছে। ভুল পথে যারা চলে তুমিই তো তাদের ঠিক পথ দেখিয়ে দাও।

তার প্রার্থনা শেষ হতে-না-হতেই, ভোজনকক্ষে এক দিব্যাকান্তি যুবক এসে ঢুকলো। প্রশস্ত বুকের ছাতি তার, সিংহের মত সরু কোমর। চলার মধ্যে বেশ একটা সন্ত্রান্ত ভাব। পথশ্রমে যুবকটিকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ভেতরে ঢুকে চারদিকে সে একবার তাকালো। দেখলো, কোথাও কোন ফাঁকা জায়গা নেই। বাধ্য হয়ে সে বিরিয়ানির সামনেই বসে পড়লো। ভয় পেয়ে সকলে তার দিকে তাকালো।

আগস্তুককে দেখেই চিনতে পেরেছে জুমুরুদা। হঠাৎ কী যেন বলতে গিয়ে সে সামলে নিলো নিজেকে। ঠোঁট দু’খানা তার তখন থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছে। বুকটা করছে দুরু দুরু। পেটে দিচ্ছে মোচড়। হৃদপিণ্ডের শব্দটা কি কেউ শুনতে পাচ্ছে?

হ্যাঁ। এই আলী শার।

ভোর হয়ে এসেছে দেখে চুপ করে যায় শাহরাজাদ।

 

তিনশো আঠাশতম রজনী :

আবার রাত্রি এলো। আবার গল্প শুরু হলো শাহরাজাদের।

জাঁহাপনা, আলী শার যে জুমুর‍্যুদকে উদ্ধার করতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে-কথা নিশ্চয় আপনার মনে রয়েছে! এক ঘুমেই রাত কাবার হয়ে গেলো তার। পরের দিন দোকানদাররা যখন দোকানপাঠ খুলতে শুরু করেছে ঠিক সেই সময় ঘুম ভাঙলো তার। থ্যতমত খেয়ে গেলো। বেচারা। রাস্তায় শুয়ে আছে কেন? মাথায় হাত দিয়ে দেখে পাগড়ী নাই। গায়ে যে দামি কুর্তা ছিলো। সেটাও কোথায় আত্মগোপন করেছে। ধীরে-ধীরে সব কথা মনে পড়ে গেলো তার। দীর্ঘ নিঃশ্বাস একটা ফেলে সামনের বাড়িটার দিকে একবার সে তাকালো। তারপরে বিষণ্ণ মনেবাড়ি ফিরে গিয়ে সেই বৃদ্ধার কাছে সে সব খুলে বললো।

বৃদ্ধটি ফিরিওয়ালীর বেশে আবার বেরিয়ে গেলো; কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বললো—সে ওখানে নেই। কী আর করবে বাছা! সবই তোমার নসীব। ও মেয়েকে খুঁজে পাওয়ার আশা তুমি ছেড়ে দাও। আল্লাকে ডাক। তিনিই তোমার একমাত্র ভরসা। তোমার এই দুঃখে একমাত্র তিনিই তোমাকে শান্তি দিতে পারবেন। তোমার ভুলের জন্যেই এমন একটা কাণ্ড ঘটে গেলো।

চোখে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো আলী শারের। এখন মৃত্যুই তাকে চিরশান্তি দিতে পারে। বৃদ্ধার কোলে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সে কাঁদলো। কাঁদতে -কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। সেবাযত্ন করে বৃদ্ধ তার জ্ঞান ফেরালো। কিন্তু আলী শার বিছানা নিলো। রুচি নেই আহারে, সুখ নেই বিহারে, ঘুম নেই চোখে, কবরেই চলে যেতে হোত তাকে। কেবল বৃদ্ধারই সেবা যত্নে সেটা হয়নি। সব সময়েই সে তাকে সাহস দিত। একটা বছর বিছানায় শুয়ে ছিলো আলী শারী! একটা বছরই বৃদ্ধ তার সেবা করছে। বাড়াবাড়িটা কমলো বটে, কিন্তু দুর্বলতা গেলো না। আলী শারের রোগশয্যার পাশে বসে বৃদ্ধটি তাকে অনেক বিরহের কবিতা শুনিয়েছিলো। তাদের মধ্যে একটি হলো :

এই যে আমার হৃদয় জরা-জার
নয়ন-কোণে অশ্রুত ঝর-ঝর
আমার মনের আগুনটারে নিবিয়ে দিয়ে যায়।
আমার রঙিন সূতা টুকরো করে
আশার তীক্ষ্ণ অসির জোরে
সেই সাথে এক বেদন কাঁপায় মোরে
শাশ্বত এক রঙিন কামনায়।

অনেক-অনেক বিরহ-বিচ্ছেদের কবিতা শুনিয়ে বৃদ্ধাটি তাকে সান্ত্বনা দিতে চেয়েছে; কিন্তু আলী শার জানত জুমুর‍্যুদকে না পেলে ও কিছুতেই শান্তি পাবে না, বাঁচবে না কিছুতেই। দুর্বলতাও তাই তার কাটে না। ছেলেটিকে কী-ভাবে সুস্থ করে তুলবো এই কথা ভেবে-ভেবে সারা হলো বৃদ্ধা। এক সময় সে বললো-বাছা, এমনি ভাবে শুয়ে-শুয়ে কাতরালে জুমুর‍্যুদকে তুমি পাবে কেমন করে? পুরুষ মানুষ তুমি। শক্ত হও, দুর্বলতা দূর কর। শহরে-শহরে ঘুরে রোড়াও, ঘুরতে থাক দেশে-দেশে। তবেই তো একদিন-না-একদিন তাকে তুমি খুঁজে পাবে। এমন করে বিছানায় পড়ে থাকলে কোনদিনই তাকে তুমি পাবে না।’—এইভাবে রোজই তাকে উত্যক্ত করতে থাকে। মাঝে-মাঝে সাহসও যে দেন না সেকথাও সত্যি নয়।

তারপরে একদিন আলী শার আলস্য ছেড়ে সত্যি-সত্যিই উঠে বসে। আলী শারকে নিয়ে গোছল করিয়ে দেয়। বৃদ্ধা। পেস্তা দেওয়া সরবৎ খেতে দিলো তাকে। নিজের হাতে মুরগীর ঝোল। রান্না করে দেয়, এইভাবে মাসখানেক পরে ঘুরে বেড়ানোর মত শক্তি ফিরে এলো আলী শারের দেহে। মনে এলো বল। তারপরে বৃদ্ধার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একদিন আলী শার বেরিয়ে পড়লো জুমুর‍্যুদকে খুঁজতে। ঘুরতে-ঘুরতে হতাশ হতে-হাতে আজই সে এই শহরে এসে পৌঁছেছে। জুমুর‍্যুদ এখানকারই সুলতান। তারপরে সে বিরিয়ানির সামনে বসেছে।

বেশ ক্ষিদেও পেয়েছে তার। খাওয়ার জন্যে আস্তিন গুটিয়ে সে সামনের দিকে ঝুকে পড়েছে। খেতেও শুরু করেছে। বিরিয়ানি খেতে দেখে আশপাশের লোকেরা আঁৎকে উঠে তার দিকে তাকালো। ওটা খেতে সকলেই তাকে নিষেধ করলো। তাদের কথা তার কানো গেলো না। তখন সে ভাঙখোরটা বলে উঠল–সাবধান, সাবধান! ওদিকে তাকিয়ো না যাদু! মুখে দিয়েছ কি তোমার দফারফা। গায়ের চামড়া খুলে নিয়ে ফাঁসীতে লটকে দেবে। মরণ তোমার কেউ ঠেকাতে পারবে না!

আলী শার বললো-যে ভাবে আমার দিন কাটছে তাতে আমার কাছে মরণই অনেক ভালো। অত ডেকেও মরণকে পাই নি। আজ যদি তোমাদের কথা মত মৃত্যুই আমার হয়, ভালোই তো। বিশেষ করে সেই জন্যেই আমি এটা খাব।

আর কোন দিকে না তাকিয়েই সে বিরিয়ানিটা খেতে শুরু করলো।

জুমুর‍্যুদ সব লক্ষ্য করছিলো। ভাবছিলো—আহা বেচারা, পেট পুরে খেয়ে নিক। তারপরে ডাকিয়ে আনব।

তার ঠোঁট দু’খানা কেবল নড়তে থাকে। বিড়বিড় করে সে বলে-আল্লাহ তুমি এই বাঁদীর কথা শুনেছ। তারপরে সে রক্ষীদের বললো-ওই যে লোকটি বিরিয়ানি খাচ্ছে ওকে বেশ ভদ্রভাবে বলবে আমার কাছে এসে দুটো কথা শুনে যেতে।

আদেশ পেয়ে রক্ষীরা তার কাছে গিয়ে কুর্নিশ করে বললো–মালিক, আমাদের মহামান্য সুলতান আপনাকে স্মরণ করেছেন।

উঠতে উঠতে আলী শার বললো—তাই নাকি? চলে যাচ্ছি সুলতানের কথা অমান্য করা যায় না।

আলী শার এগিয়ে গেলো সুলতানের দিকে।

প্রজারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে শুরু করলো-আবার তাই হলো নাকি গো! এবারের লোকটা আগেকারগুলোর মত বিশ্ৰী নয়। কী জানি, কী হবে বাপু?

কেউ কেউ বললো-ওর ভেতরে পাপ থাকলে সুলতান ওকে পেট ভরে খেতে দিতেন না। আগের মত এক গোরাস। ব্যস। তারপরেই ফকা—বিলকুল ফাঁকা।

আর একজন বললো—দেখছ, প্রহরীরা কই ওকে তো টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গেলো না। লোকটা তো নিজের পায়েই হেঁটে গেলো। ওকে যথেষ্ট সম্মানও দেখাল প্রহরী। ব্যাপারটা কী!

সুলতানের সামনে গিয়ে মাটিতে চুমু খেলো আলী শার।

খুব ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করলো জুমুর‍্যুদ—গলাটা একটু যেন কেঁপে-কেঁপে উঠলো—ওহে যুবক, তোমার নাম কী? পেশাটা কী তোমার? এই শহরে এসেছি কেন?

আলী শার বললো—মহামান্য সুলতান, আমার নাম আলী শার। গ্লোরির ছেলে আমি। খোরেসানে আমার বাবা একজন বড় ব্যবসাদার ছিলেন। আমারও পেশা তাই। আমার দুর্ভাগ্য এদেশে আমাকে টেনে এনেছে!

ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ চুপ করে গেলো।

 

তিনশো উনত্রিশতম রজনী :

পরের দিন রাত্ৰিতে আবার শুরু করলেন শাহরাজাদ। আলী বললো-প্রিয়তমাকে হারিয়ে আমি এখন তার-ই খোঁজে দেশে-দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি। খুঁজতে-খুঁজতে শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছি। এই শহরে। তার মিষ্টি ডাক, মিষ্টি স্বপ্ন আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। কোথায় পাব তারে! দস্যুরা তাকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। দিকহারা এক জাহাজে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি যেন। কোথায় তাকে পাব কিছুই বুঝতে পাচ্ছি নে। এই না-পাওয়ার বেদনা যে কী, কী করে আপনাকে বোঝাবো জাঁহাপনা?

বলতে-বলতে দু’চোখ ছাপিয়ে জল ঝরতে লাগলো তার। দায়িতার বিরহে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে সে লুটিয়ে পড়লো মেঝের ওপরে।

খোজা ছেলে দুটি তার চোখেমুখে গোলাপ জলের ঝাপটা দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনলো তার।

জুমুর‍্যুদ বলে—মন্ত্রপূত বালি আর আমার কলমটা নিয়ে আয়।

আগের মতই টেবিলের ওপরে বালি ছিটিয়ে কলম দিয়ে সে নানা রকম আঁকজোক কাটিলো। নিজেকে সংযত করার জন্যে কিছুটা সময় সে নিলো। হাজার হোক সে সুলতান। তার চারপাশে হাজার-হাজার প্রজা, পাত্র-মিত্র আর আমাত্যেরা বসে রয়েছে। এতটুকু বেচাল হলেই মাটি হয়ে যাবে সব। অথচ, নিজেকে সামলে রাখাও যে ক্রমশ কষ্টকর হয়ে উঠেছে।

অনেকক্ষণ নিজের সঙ্গে লড়াই করে মুখ তুললো জুমুর‍্যুদ। সকলেই শুনতে পায় এমনিভাবে বেশ মিষ্টি করেই বললো-গ্লোরির ছেলে তুমি আলী শার। তুমি যে সাচ্চা মানুষ তা আমার গণনাতেই ধরা পড়েছে। তুমি যা বললে তার সবটুকুই ঠিক। আমি ভবিষ্যদ্বাণী করছি তোমার ভালোবাসার মানুষকে খুব শিগগিরই তুমি খুঁজে পাবে। আর দুঃখ করো না।

ভোজ শেষ হওয়ার পরে আলী শারকে গোছল ঘরে নিয়ে যাওয়ার হুকুম দিলো জুমুর‍্যুদ। গোছল শেষ হলে রাজকীয় পোশাকে সাজিয়ে আস্তাবলের সবচেয়ে ভালো একটা ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে আলী শারকে রাজপ্রাসাদে হাজির করার নির্দেশ দিয়ে চলে গেলো জুমুর‍্যুদ।

সুলতানের এ–হেন নির্দেশ শুনে প্রজারা তোওবা-তোওবা করতে লাগলো। বলে, ব্যাপারটা কী, অ্যা! এত খাতির, এত সম্মান!!–কেউ কেউ মন্তব্য করলো—’বুঝলে না চাচা! চাঁদপনা মুখ দেখে সুলতানের মন গলেছে। একি আর তোমার মুখ হে? এ ছাড়া আর কোন কারণ নেই।’ আর একজন মাথা নেড়ে বললো-’উন্থী ব্যাপারটা অত সোজা নয়, মিয়া। ওকে বিরিয়ানি খেতে তো তোমরা দেখেছ? অথচ ওই বিরিযানি ছুলেই কী কাণ্ডটাই না হচ্ছিল—তা তোমরা স্বচক্ষে দেখেছি। এর বেলাতেই সব ওলট-পালট হয়ে গেলো কেন? না, ব্যাপারটা মোটেই অতটা সোজা নয় হে, অতটা সোজা নয়।

মাথা নাড়তে-নাড়তে, নানান জল্পনা করতে-করতে সবাই বাড়ির পথ ধরলো।

রাতের অপেক্ষায় বসে রয়েছে জুমুর‍্যুদ। বসে-বসে ক্রমেই অধীর হয়ে উঠছে, হয়ে উঠছে অস্থির। কখন তাকে কাছে পাব। উঃ, কতকাল পরে আবার দু’জনে কাছাকাছি আসব।

পশ্চিম আকাশে ধীরে-বীরে ঢলে পড়লো সূর্য। শুরু হলো সন্ধ্যের আজান। মসজিদে প্রার্থনার জন্যে লোক চলাচল শুরু হলো। জুমুর‍্যুদের আর তাঁর সইছে না। পোশাক পালটিয়ে নরম বিছানায় সে গা এলিয়ে দিলো। পরণে তার স্বচ্ছ সেমিজ। অন্ধকারে থাকার জন্যে আলোর সামনে সে পর্দটিা দিলো টেনে। আলী শারকে নিয়ে আসার জন্যে শুয়ে শুয়েই সে নির্দেশ দিলো খোজা ছেলে দুটাকে।

সুলতানের এ-হেন অদ্ভুত ব্যবহারে অমাত্যরাও অবাক। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করলো-নিশ্চয় সুলতান ওই দরবেশটার প্রেমে পড়েছে। তবু যদি মেয়েছেলে হোত। আজ রাত্ৰিতে ওরা সম্ভবত এক জায়গাতেই থাকবে। কাল সকালে দেখবে ও নিৰ্ঘাত প্রধানমন্ত্রী অথবা সেনাধ্যক্ষ হয়ে গিয়েছে।

এদিকে আলী শারকে ভেতরে পৌঁছে দিয়ে খোজা দুটি দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেলো। আবছা অন্ধকারে সুলতান দেখতে পেলো মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আলী শার চুম্বন করছে। সুলতানও হাত তুলে তাকে অভিবাদন জানালো। সুলতানের মঙ্গলকামনা করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো আলী শার। ভাবলো, আগ বাড়িয়ে কিছু বলব না।

জুমুর‍্যুদ ভাবলো—আমার পরিচয় যদি এখনই দিই তাহলে ওতো আবেগের চোটেই মরে যাবে। তাই সে অন্ধকারে আলী শারের দিকে পেছন করে বসলো। ওহি ছোকরা, কাছে এগিয়ে এসো! গোছল করেছ?

–আজ্ঞে হ্যাঁ, মালিক।

–হাত-পা ভালো করে সাফ করেছ? সুগন্ধী তেল পেয়েছিলো? এখন তবিয়ৎ ভালো লাগছে তো।

—আজ্ঞে হ্যাঁ মালিক।

গোছালের পরে তোমার ক্ষিদে পেয়েছে তো? ওই দেখ, তোমার সামনেই একটা সোনার থালায় খানা রয়েছে—মুরগীর মাংস, তন্দুরী—সব পাবে। খনিকটা খেয়ে নাও।

পেট পুরে খেয়ে নিলো আলী শার।

এখন নিশ্চয় তোমার তেষ্টা পাচ্ছে? এইখানে নানা রকমের সরাব রয়েছে। যত পার খেয়ে নাও। তারপরে আমার কাছে এসে বস।

সব সরাবই চোখে দেখলো আলী শার। যতটা পারলো খেলো, তারপরে কাঁপতে-কাঁপতে সুলতানের বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো।

পিছন ফিরেই হাত ধরে সুলতান তাকে বিছানার ওপরে বসতে দিলো; তারপরে বললো-যুবক তুমি আমাকে খুব খুশি করেছ। তোমার মত সুন্দর মুখ আমি খুব পছন্দ করি। পায়ে বড় যন্ত্রণা হচ্ছে। একটু টিপে দেবে?

কামিজের আস্তিন গুটিয়ে নিচু হয়ে আলী শার সুলতানের পা টিপতে লাগলো দুলে দুলে। কিছুক্ষণ পরে সুলতান বললো—এবার পা আর উরু দুটো টিপে দাও।

পা আর উরুর কাপড় তুলে টিপতে গিয়ে আলী শার অবাক হয়ে যায়। অবাক কাণ্ড। পা আর উরুতে তো কোন লোম নেই। আর কী নরম তুলতুলে। মনে-মনে বললো—পুরুষ মানুষের পা এরকম হয়? আমি বাপু কোন পুরুষের পা এরকমটি দেখিনি!

–তুমি তো বেশ চমৎকার টিপতে পার ছোকরা! তোমার হাত বেশ পাকা দেখছি। আর একটু ওপরে টিপে দাও; এই কোমোরের কাছাকাছি।

আলী শারের হাত হঠাৎ ঘোমে উঠলো। ভয়ে-ভয়ে বললো-আমাকে মাপ করুন, মালিক। উরুর ওপরে কী রকম করে টিপে দেব বুঝতে পারছি নে। যতটুকু বুঝি ততটুকু করেছি।

ভোর হয়ে আসছে দেখে থেমে গেলো শাহরাজাদ।

 

তিনশো ত্রিশতম রজনী :

পরের দিন রাত্ৰিতে আবার গল্প বলতে শুরু করলো শাহরাজাদ।

আলী শারের কথায় যেন জ্বলে উঠলো সুলতান; একটু উঁচু গলাতেই বলে—আমার কথার অবাধ্য হচ্ছে, সাহস তো মন্দ নয়, যা বলছি করা। একটু দেরি হলেই আজ রাতে তোমার শিরশেছন্দ করা হবে। আমাকে তৃপ্তি দাও। তার বিনিময়ে তোমাকে সবচেয়ে বেশী স্নেহ করব, ভালোবাসব। আমীরের আমীর, সেনাধ্যক্ষের ওপরে বসিয়ে দেব তোমাকে। যা বলছি চট পট তামিল কর।

—কিন্তু জাঁহাপনা, আপনি ঠিক কী চাইছেন তাইত বুঝতে পারছিনে। কী ভাবে আপনার হুকুম তামিল করব বলে দিন।

তোমার পা-জামাটা খুলে ফেলো। আমার পাশে উপুড় হয়ে শোও।

হাঁটু গেড়ে হাত জড় করে আলী শার বললো-সারা জীবনে কখনও আমি এসব কাজ করিনি। আপনি যদি এসব কাজ করতে আমাকে বাধ্য করেন তাহলে আল্লাহর কাছে আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে। দয়া করে আমাকে রেহাই দিন। আমি এখনই এদেশ ছেড়ে চলে যাব।

প্রচণ্ড ক্রোধের ভান করে সুলতান বলে-আমার আদেশ, পা-জামা খোলো? আমার পাশে উপুড় হয়ে শোও। নইলে এখনই তোমার গর্দান যাবে। মাথা ঠাণ্ডা করে কাজ কর। কী সুন্দর তোমার চেহারা। তুমি আমার কাছে শোবে এসো। এর জন্যে তোমাকে অনুশোচনা করতে হবে r

কী আর করে আলী শার? সুলতানের আদেশ মত পা-জামা খুলে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো। তার পিঠের উপরে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে সুলতান। আবেগে জড়িয়ে ধরলো আলী শারকে।

আলী শার ভাবলো—এবার আমার শেষ। তারপরেই হঠাৎ সে চমকে উঠলো। পিঠের—‘রে তার গোলাকার কী যেন দুটি বস্তুর চাপ লাগছে যেন। সিস্কের মত নরম পেলাব। সে অনুভূতি। সুলতানের দেহ থেকে একটু একটু ঘাম বোধ হয় চুইয়ে পড়েছিলো। সেই ঘাম তার পিঠে লাগলো, হায় আল্লা, মেয়েদের মত এত নরম রোমাঞ্চকর সুলতানের দেহ। বেচারার প্রাণ তখন যায়-যায়। সে মড়ার মত চুপচাপ পড়ে রইলো।

প্রায় ঘণ্টাখানেক তার পিঠের ওপরে শুয়ে রইলো সুলতান। ওপাশ থেকে কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে বেচারা বেশ ঘাবড়ে গেলো। তারপরে একসময় পিঠ থেকে নেমে এলো সুলতান। এবার সুলতান আলী শারকে তার পিঠে চাপানোর চেষ্টা করলো। বেচারা আলী শার। এবারে আর তার নিস্তার নেই। তার মনে হলো সুলাতন পুরুষাঙ্গাহীন। এখন যদি প্রমাণিত হয় যে সে-ও ওই রকম পুরুষাঙ্গহীন তাহলে আর তাকে বাঁচানো যাবে না। কথাটা ভাবতে গিয়েই সে আরও ঘাবড়ে গেলো, সারা হয়ে গেলো। ভয়ে! দয়োদর করে ঘাম ঝরতে লাগলো তার।

আলী শারের তখন শেষ অবস্থা। এমন বিপাকেও কেউ পড়ে-ইয়া আল্লাহ! জোরে-জোরে নিঃশ্বাস পড়তে লাগলো তার। তার শরীরের ঘামে ভিজে গেলো সুলতানের দেহ।

সুলতান বললো-কই, তোমার হাতটা দাও।

প্রাণের মায়া বড় মায়া। ভয়ে-ভয়ে হাত খানা বাড়িয়ে দিলো আলী শার। অন্ধকারে যেখানে গিয়ে তার হাত পড়লো তাতেই সে চমকে উঠলো।

এতো পুরুষ নয়।–আলী শারের চিন্তার জগতে বিপর্যয় নেমে এসেছে ততক্ষণে। —এরকম আশ্চর্য ঘটনা আমার জীবনে কোনদিনই ঘটতে দেখিনি। বিদ্যুৎ চমকের মত কী করে যে কী হয়ে তা সে বুঝতে পারলো না। একটা উদগ্ব কামনা তাকে গ্রাস করে ফেললো।

সেই চরম মুহূর্তটির জন্যে জুমুরুগৃদ-ও অপেক্ষা করছিলো। এবার প্রচণ্ড জোরে সে হেসে উঠলো। ফুলে-ফুলে উঠলো তার দেহটা। সেই হাসির গমকে পিঠে থেকে হুমডি খেয়ে পড়ে গেলো আলী শার। হাসাতে-হাসতে জুমুর‍্যুদ বললো-মালিক, তোমার প্রিয়তমা বাঁদীকে তুমি চিনতে পারলে না।

কিছুই বুঝতে পারলো না আলী শার। কে মালিক, কে বাঁদীে—কিছুই মাথায় ঢুকলো না তার। জিজ্ঞাসা করলো—জাঁহাপনা, কিসের মালিক, বাঁদীই বা কে, কিছুই মালুম হচ্ছে না। আমার।

হেসে বললো জুমুর‍্যুদ-আলী শার, আমিই তোমার জুমুর‍্যুদ, আমাকে তুমি চিনতে পারছি না?

কথাটা শুনেই আকুল আগ্রহে চমকে উঠে পড়লো আলী শার; আপনার প্রাণ-পিয়াসী প্রিয়তমকে এবার চিনতে তার মোটেই দেরী হলো না। চিনতে পেরেই প্রচণ্ড আবেগে জড়িয়ে ধরলো তাকে। আদরে সোহাগে ভরিয়ে দিলো তার চোখ, মুখ, বুক, সারা দেহ।

জুমুর‍্যুদ বলে-কী গো মালিক, আর না-না করবে।

উত্তর দেওয়ার সময়টুকু পর্যন্ত আলী শারের এখন নেই। সিংহের মতই আলী শার তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লো। মুহূর্তের মধ্যে সব বাধা, সব দুশ্চিন্তা কেটে গেলো তার। জুমুর‍্যুদকে কোলের ওপরে তুলে নিলো সে। তাকে নিয়ে কী করবে। কী না কুরুবে কিছুই ভেবে পেলোনা সে। জুমুর‍্যুদের বুকের মধ্যেও তখন কামনার দাপদাপি চলছে। আলীশারের প্রচণ্ড, উদ্দাম উচ্ছ্বাসকে সে এতটুকু বাধা দিলো না, জৈব ক্ষুধায় তখন দুজনেই সমানভাবে ক্ষুধাতুর। দুটি দেহের পুনর্মিলনের অভিসার সারা রাত ধরেই চলতে থাকে তাদের। একজনের মুখ নিসৃত আওয়াজ আর একজনের নিশ্বাসের আর্তিতে চাপা পড়ে গেলো! সুলতানের শয়ন কক্ষ সেই বিচিত্র স্বরধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠলো।

সেই শব্দে প্রহরাধীন খোজা দুটি কেমন ভয় পেয়ে গেলো। সুলতান কোন বিপদে পড়েছেন বুঝতে পেরে ভয়ে ভয়ে তারা দরজার ফোকরে উঁকি দিতে লাগলো! সুলতানের পিঠটাই কেবল তাদের চোখে পড়লো। আবার দেখলো, সেই লোকটা সুলতানের আঁকড়ে ধরে রয়েছে। দুজনের শরীরই নড়ছে। মারামারি, কুস্তি হচ্ছে নাকি দু’জনের? দুজনের শরীর এমন ভাবে লেপটে রয়েছে যে কাচি দিয়ে না। কাটলে বোধ হয় তাদের আলাদা করা যাবে না। মাঝে-মাঝে কেঁপে-কেঁপে উঠছে তারা, ফুলে-ফুলে উঠছে।

রাত পুইয়ে আসছে দেখে চুপ করে গেলো শাহরাজাদ।

 

তিনশো একত্রিশতম রজনী :

পরের দিন রাত্ৰিতে আবার শাহরাজাদ গল্প বলতে শুরু করলো।

এসব দেখে ফুটো বন্ধ করে শেষ পর্যন্ত সরে এলো তারা। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করলো—আমাদের সুলতানকে মোটেই বেটা ছেলের মত লাগছে না, তাই না রে। যেন একটা মেয়েমানুষ। কেমন যেন করছেন দেখলি!

ব্যাপারটা তারা আর ঘাঁটাঘাটি করলো না। তবে আসল ব্যাপারটা মাথায় ঢোকেনি তাদের।

পরের দিন ভোরবেলা জুমুরুদুদ আবার সেই সুলতানের পোশাকই পরল। পাত্রমিত্ব সবাইকে ডেকে পাঠালো প্রাসাদের বাগানে। সবাই উপস্থিত হলে সে বললো—আমার প্রিয় বিশ্বাসী অনুচরবৃন্দ, আমি যে-পথ দিয়ে এসেছিলাম তোমরা সেই পথের ধারে অপেক্ষা কর। আমার আদেশ, আমার মত তোমরা আর কাউকে নিয়ে এসে তোমাদের সিংহাসনে বসাও। আমি স্বেচ্ছায় এই সিংহাসন ছেড়ে চলে যাচ্ছি। ঠিক করেছি। এই যুবকের সঙ্গে আমি ওর দেশে চলে যাব। ওকেই আমি আমার সারা জীবনের সঙ্গী হিসাবে গ্রহণ করেছি। আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি। আল্লাহ তোমাদের মঙ্গল করুন।

পরিষদবর্গ শান্ত হয়ে সুলতানের নির্দেশ শুনলো।ইতিমধ্যে দুটি খোজা প্রচুর খাবার, ধনরত্ন, মণিমাণিক্য সাজপোশাক উট আর খচ্চরের পিঠে ফেললো সাজিয়ে। সব শেষে জুমুর‍্যুদ আর আলী শার সুসজ্জিত একটা উটে টানা পান্ধির ভেতরে গিয়ে বসলো। সঙ্গে নিলো কেবল সেই দুটি খোজাকে। খোরাসান শহরে নিজেদের বাড়িতে পৌঁছে গেলো তারা। গরীব দুঃখীদের দুহাত দিয়ে দান করলো। দান করলো বিধবাদের, পিতৃ-মাতৃহীন ছেলেমেয়েদের। বন্ধুবান্ধবদের উপটৌকন পটাল ভালো-ভালো। ওরা ফেরার আগেই সেই বৃদ্ধাটি দেহ রেখেছিলেন। ওরা তীর কবরের ওপরে সুন্দর একটা বেদী তৈরি করে দিলো।

অনেক দিন সুখে-শান্তিতে ঘর করলো ওরা। একটি পুত্র সন্তানও হলো ওদের। আনন্দে ভরে গেলো ঘর। সেই আনন্দ ভেঙে গেলো যখন আল্লাহ ওদের একজনকে তুলে নিলেন।

এই হলো গ্লোরি, তার ছেলে, আর জুমুর‍্যুদের গল্প।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *