1 of 4

২.০৬ সিন্দাবাদের ষষ্ঠ সমুদ্র-যাত্রা

সিন্দাবাদের ষষ্ঠ সমুদ্র-যাত্রা

পরদিন সকালে আবার সবাই এসে হাজির হলো। নাস্তাপানি শেষ হলে বৃদ্ধ সিন্দবাদ বলতে শুরু করে :

একদিন আমার বৈঠকখানায় বসে বন্ধুদের সঙ্গে খোশগল্পে মাসগুল হয়ে আছি। এমন সময় দেখলাম, আমার বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে চলেছে কয়েকজন পরদেশী সওদাগর। সাদর অভ্যর্থনা করে তাদের ডেকে বসালাম আমার ঘরে। কথাবার্তায় বুঝলাম, বিদেশে বাণিজ্য করতে বেরিয়েছে তারা। আমার রক্ত চনমান করে ওঠে। বললাম, আমিও যাবো, আমাকে নেবেন আপনাদের জাহাজে?

ওরা বললো, এতো ভারি। আনন্দের কথা। আসুন আমাদের জাহাজে। এখানে আমরা আরও দুদিন থাকবো।

আমি আর দেরি না করে বাজারে গিয়ে নানারকম সুন্দর সুন্দর জিনিসপত্র সওদা করে আনলাম। বাঁধাৰ্ছদা শেষ করে জাহাজে চেপে বসলাম। জাহাজ চললো বসরাহর দিকে।

বসরা হয় এসে আমরা আরও একটা বড় জাহাজে গিয়ে উঠি। দিনক্ষণ দেখে জাহাজ ছাড়া হলো। আমরা নিরুদ্দেশের সায়রে গা ভাসালাম।

রাত্রি শেষ হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

তিনশো নয়তম রাতে আবার সে বলতে শুরু করে :

আমরা এ বন্দর থেকে সে বন্দরে নোঙর করি। নতুন নতুন দেশ দেখি সওদাপত্র ফিরি করি।

এইভাবে কত অজানা দেশ দেখা হয়। একদিন রাতে আমরা তখন শুয়ে পড়েছি, হঠাৎ কাপ্তেনের চিৎকার শুনে ধড়মড় করে উঠে পড়লাম। সবাই।

কাপ্তেন বললো, তোমরা সবাই শোনো, আমরা এক অজানা সমুদ্রে এসে পড়েছি। এ পথ আমার অচেনা। কি হবে কিছুই বলতে পারছি না। এখন আল্লাহর নাম স্মরণ করা। তিনি যদি বঁচোন, তবেই বাঁচবো।

কাপ্তেন আর দাঁড়ালো না। সোজা মাস্তুলের উপরে উঠে গেলো। পালের কাছি খুলে দেওয়া হলো। একটুক্ষণের মধ্যেই প্রবল ঝড় উঠলো। সেই তুফানের দাপটে জাহাজখানা উথালি পাতাল করতে করতে সামনের এক পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে চুরমার হয়ে গেলো। অগাধ জলে কে কোথায় তলিয়ে গেলো, কিছুই হদিশ করতে পারলাম না। আমি সেই পাহাড়ের এবড়ো খেবড়ো পাথর

পাহাড়টাই খাড়াই উঠে গেছে। ওপরে ওঠার আশা দুরাশা। তবে লক্ষ্য করলাম, পাহাড়টা যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে আরম্ভ হয়েছে একটা দ্বীপ। পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে অতি কষ্টে এগিয়ে চললাম। সেই দ্বীপের দিকে।

দ্বীপের সৈকতে অসংখ্য জাহাজের ভাঙ্গা টুকরো আর নানারকম সওদাগরী সামনপত্রে ভর্তি। কত জাহাজ যে পথ হারিয়ে এই পাহাড়ের ধাক্কায় চুরমার হয়ে গেছে, তার ইয়ত্তা নাই। সেই সব জাহাজের ধ্বংসাবশেষ আর তার মালপত্র ঢেউ-এ ঢেউ-এ এসে জড়ো হয় এই বেলাভূমিতে।

ভাঙ্গা গলুই, কাঠের পাটাতন, মাস্তুল, পালের কাছি কাপড়ের গাঁট, বাক্স প্যাটরা তোরঙ্গ-এর স্তুপ ডিঙিয়ে দ্বীপের ভিতরে ঢুকে পড়লাম। একটু এগোতেই চোখে পড়লো, একটি ছোট্ট কলস্বনা নদী। ঐ পাহাড় থেকে নেমে এসেছে। দ্বীপের এদিক ওদিক একেবেকে আবার ঐ পাহাড়ের পাদদেশের এক গুহার মধ্যে হারিয়ে গেছে।

কিন্তু এর আসল চেহারা অন্য। এই ছোট্ট নদীটার দুই তীর নানা বর্ণের উপুলখণ্ডে সমাকীর্ণ। লক্ষ কোটি ছোট ছোট পাথরের নুডি। সবই মূল্যবান পাথর। বেশীর ভাগই চুনী। মাঝে মাঝে সূর্যের রশ্মি ঠিকরে চোখে হানছে হীরের দৃতি। এর মধ্যে সোনা আর রূপোর টুকরোর কি ছড়াছডি। তাছাড়া আরও কত অমূল্য গ্বহরত্ন যে এর মধ্যে মিশে রয়েছে তার হদিশ একমাত্র পাকা জহুরাই করতে পারবে। আমার সাধ্য নাই। সারা নদীর উপকূলে এই যে বহু বিচিত্র রঙের মেলা-এর উপর সূর্যকিরণ প্রতিফলিত হয়ে স্বপ্ন লোকের হুরী পরীর দেশের সে-এক রঙিন ছবি মনে করিয়ে দেয়। চীন আর ভারতের কুমারিকা অঞ্চলে যে উৎকৃষ্ট মানের ঘৃতকুমারী পাওয়া যায় সেই জাতের ঘৃতকুমারী গাছ গজে উঠেছে এই ঝর্ণানদীর জলে।

পাহাড় থেকে আরও একটা ঝর্ণা নেমে এসেছে। না, জলের নয়। গলিত আলকাতরার মতো এক প্রকার তরল পদার্থ পাহাড় থেকে নির্গত হয়ে অবিরামভাবে বয়ে চলেছে সমুদ্রের দিকে। সমুদ্র থেকে লোভী মাছেরা উঠে এসে এই তরল পদার্থ খেয়ে পেট ডাই করে। তারপর এক সময় সব উগলিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে সেই বমি জলের ওপরে রঙিন শক্ত মোমের মতো ভাসতে থাকে। এবং সেই ভাসমান মোমের সুগন্ধে সারা সৈকত মন্দির হয়ে ওঠে।

এই যে অমূল্য সম্পদসম্ভার, সবই মূল্যহীন হয়ে পড়ে আছে। এখানে। সম্পদ তখনই মূল্যবান হয় যখন তা মানুষের অধিকারে আসে। কিন্তু এই জনমানব বর্জিত দ্বীপে বাইরের কোনও মানুষ সশরীরে এসে পৌঁছতে পারে না। যারা পথ ভুলে এসে পড়ে, পাহাড়ের দুর্বল আকর্ষণে জাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে, তাদের সলিল সমাধি ঘটে। তাই, আজ পর্যন্ত এই অতুল ঐশ্বর্য মানুষের অদেখাই রয়ে গেছে।

সারা দ্বীপে এত ঐশ্বর্যের সমারোহ, কিন্তু ক্ষুগ্নিবৃত্তির কোনও আহার্য নাই। তন্নতন্ন করে খুঁজেও খাবার মতো কোনও বস্তুর সন্ধান পেলাম না। খিদের জ্বালায় আমি হন্যে হয়ে ঘুরি। কিন্তু না, কোথাও কিছু নাই। ভাবলাম, মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। কেউ আমাকে বাঁচাতে পারবে না।

এইভাবে আরও কয়েকটা দিন কাটে। আমি আর চলতে ফিরতে পারি না। বালির ওপরে অসাড় হয়ে পড়ে থাকি। বুঝতে পারি। ধীরে ধীরে আমার সকল শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসছে। অনাহার অনশনের যে কি জ্বালা-সে কথা আর বোঝাবো কি করে। তখন আর উপায় নাই, শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর মুহূর্তের অপেক্ষায় আছি। হাত দিয়ে বালি সরিয়ে সরিয়ে নিজের কবর নিজেই খুঁড়তে থাকি।

মোটামুটি গর্তটা খোঁড়া হয়ে গেলো তার নিচে দেহটাকে সঁপে দিই। মনে আশা, আমার মৃত্যুর পর সমুদ্রের ঝড়ো হাওয়া বালি উড়িয়ে এসে ঢেকে দেবে আমার দেহখানা।

নিজের উপর রাগ হয়। এর আগে পাঁচ পাঁচ বার কত বিপদ বিপর্যয়ে দিন কেটেছে তাতেও আমার শিক্ষা হলো না। আবার পথে বেরুলাম। আমার মতো মানুষের এই সাজাই সমুচিত। কি দরকার ছিলো এই সেধে বাঁশ ঘাড়ে নেবার। বাগদাদে যে সম্পত্তি আমি রেখে এসেছি তিন পুরুষ ধরে মোচ্ছবি করে খেলেও ফুরাবে না। তবে? তবে কেন এই দুৰ্মতি হলো আমার?

হঠাৎ আমার খেয়াল হলো, আচ্ছা, এই যে ছোট্ট নদী-এর উৎপত্তি স্থান ঐ পাহাড়-সে জায়গা আমি দেখে এসেছি। কিন্তু এর শেষ কোথায়, তাতো দেখতে পেলাম না? শুধু এইটুকু দেখতে পাচ্ছি। নদীটা একে বেঁকে আবার ঐ পাহাড়েরই গুহার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু গুহার ভিতর দিয়ে কোথায় কতদূর সে চলে গেছে, কোথায় গিয়ে কার সঙ্গে মিশেছে তা তো জানা হলো না?

আমি ভাবলাম, নদীটিা নিশ্চয়ই এই পাহাড়ের তলাতেই শেষ হয়ে যায়নি। হয়তো অন্য কোথাও অন্য কোনও দেশে চলে গেছে। ঠিক করলাম, শেষ দেখতে হবে। মৃত্যু তো শিয়রে এসেই গেছে, একবার শেষ চেষ্টা করে দেখি। যদি বেরুবার কোনও পথ পাই, ভালো, আর যদি ঐ নদীর জলেই সমাধি ঘটে ঘাটুক। এমনিও মরতে হবে-না হয় জলেই ভেসে যাবো।

ভাঙ্গা জাহাজের পাটাতনের কাঠ জুড়ে জুড়ে একখানা ভেলা বানালাম। কয়েকটা বস্তা, সমুদ্রের ধারে এই সব জিনিসের ছড়াছডি, সংগ্রহ করে নদীর ধার থেকে হীরে চুনি পান্না মুক্তোয় বোঝাই করে নিলাম। তারপর আল্লাহর নাম নিয়ে বস্তাগুলো ভেলায় চাপিয়ে নিজেও চেপে বসলাম। খরস্রোতা আমার ভেলা নিয়ে ঢুকে গেলো গুহার গহ্বরে। নিরন্ধ নিঃসীম অন্ধকার! তবে বেশ বুঝতে পারলাম, আমার ভেলাখানা তরতর করে এগিয়ে চলেছে। শুধু ভাবছি, এইবার হয়তো তমসার শেষ হবে। এই পাহাড়ে সুড়ঙ্গ নদী আলোয় এসে পড়বে। কিন্তু না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেতে থাকলো, অন্ধকার আর নদী কেউই শেষ হয় না। ভেলার ওপরে শুয়ে উপবাসী আমি এক মৃতকল্প মানুষ। কোনই চৈতন্য নাই। কি ভাবে কোথা দিয়ে কোথায় চলেছি কিছুই বুঝতে পারছি না।

হঠাৎ আমার তন্দ্ৰাভাব কেটে গেলো। চেয়ে দেখি আমি এক সবুজ ঘাসের শয্যায় শুয়ে আছি। আমার ভোলাটা বাঁধা আছে অদূরে নদীর কিনারে। আর আমার চারপাশে এসে জড়ো হয়েছে শতাধিক উৎসুক মুখ। সাজপোশাক চেহারা চরিত্র দেখে বুঝলাম, এরা হিন্দুস্তানের বাসিন্দা।

ওর আমাকে কি যেন জিজ্ঞেস করলো, কিন্তু ভাষার দুস্তর বাধা, ওদের কথা একবৰ্ণ বুঝলাম না আমি। বললাম, কে তোমরা? এই দেশেরই বা কী নাম?

ওরাও বুঝলো না আমার ভাষা। কিন্তু আমিও চেষ্টা করতে থাকলাম-কী করে মনের ভাব ব্যক্ত করা যায়, কী করে ওদের বক্তব্য বুঝতে পারা যায়—তারই কসরৎ চলতে থাকলো।

আমি পেট দেখিয়ে মুখে হাত রেখে বোঝালাম, অন্য কথা পরে হবে, আগে আমাকে কিছু খেতে দাও। আমি কতকাল কিছু খাইনি।

দেখলাম, ওদের মুখ ব্যথায় টনটন করে উঠলো। কয়েকজন ছুটে গেলো খাবার আনতে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই অনেক খাবার দাবার এসে গেলো। আমি খুব তৃপ্তি করে খেলাম।

এমন সময় দেখলাম, আমার এক জাতভাই সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে। ওরাই ডেকে নিয়ে এসেছে তাকে। আমাকে সে পরিষ্কার আরবী ভাষায় জিজ্ঞেস করলো, তোমার নাম কী? দেশ কোথায় তোমার? কেনই বা এসেছ এখানে?

আমি আমার দুঃখের কাহিনী বিবৃত করলাম। আমার নাম ধাম সব বললাম তাকে। সে আমার কথাগুলো হিন্দুস্তানী ভাষায় তর্জমা করে বুঝিয়ে দিলো। ওদের। দোভাষীর মুখে এই সব তাজ্জব কাহিনী শুনে তো তাদের চোখ কপালে ওঠার দাখিল।

—এমন দুঃসাহসিক কাণ্ড কি কেউ করতে পারে?

—আমি বললাম, এই আমার ধাত, একবার নয়, এর আগে আরও পাঁচ পাঁচবার ঘর ছেড়ে পথে বেরিয়ে প্রাণ সংশয় ঘটেছিলো। প্রতিবারই আল্লাহর অপার করুণায় উদ্ধার পেয়ে গেছি। এবারও বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বোধ হয় বেঁচেই গেলাম।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ জায়গাটার নাম কী?

দোভাষী বললো, সারন দ্বীপ। এখানকার সম্রাটের কাছে তোমাকে নিয়ে যাবো, চলো। তোমাকে দেখলে তিনি খুব খুশি হবেন।

আমি বললাম বেশ, চলো।

ওরা আমাকে শোভাযাত্রা করে সম্রাটের কাছে নিয়ে এলো। তিনি আমাকে সাদরে অভ্যর্থনা করে কাছে বসালেন। আমি আমার এই দুঃসাহসিক সমুদ্র অভিযানের সমস্ত কাহিনী তাকে খুলে বললাম।

সারন দ্বীপ সম্রাট বললেন, ঈশ্বর তোমাকে রক্ষা করেছেন। না হলে, এইরকম বিপদে পড়ে কেউ বাঁচতে পারে না।

আমার বস্তা খুলে কিছু রত্নপাথর ভেট দিলাম তাকে। এই সব দুষ্মপ্রাপ্য মূল্যবান পাথর দেখে সম্রাট তো মহাখুশি। সাগ্রহে নিলেন আমার উপহার। তিনিও আমাকে দিলেন অনেক মূল্যবান উপহার উপটৌকন।

তার কাছ থেকেই জানলাম, এই বিশাল সারন দ্বীপ চব্বিশটি প্রদেশে বিভক্ত। এই উত্তরে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশিখর। লোকে বলে, আমাদের আদি পিতা আদম এই পর্বতশৃঙ্গে কিছুকাল বসবাস করেছিলো। এই পর্বতমালায় নানা মূল্যবান গ্বহরত্ন পাওয়া যায়। সম্রাট তার কয়েকটা আমাকে উপহার দিলেন। যদিও আকারে সেগুলো বেশ বড়ই। তবুও আমার গুলোর মতো অত সুন্দর না। এই দ্বীপের আর একটা বস্তু লক্ষ্য করার মতো—চারদিকে অসংখ্য নারকেল গাছ।

একদিন সম্রাট আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, সিন্দবাদ, তোমার স্বদেশ বাগদাদের শাসন ব্যবস্থাদি কেমন? এবং সুলতান হারুন অল রসিদ-ই বা কতটা জনপ্রিয় শাসক? আমি বললাম, আমাদের সুলতানের মতো ধর্মাত্মা আমি দেখিনি। তাঁর হুকুমতে অন্যায় অবিচার বলে কিছু নাই। লোকে সুলতানকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। সুলতানও প্রজাদের কল্যাণের জন্য দিবস-রজনী চিন্তা করেন।

সারন দ্বীপ সম্রাট মুগ্ধ হয়ে বললেন, সত্যিই আদর্শ বাদশাহ। আমার গ্ৰীতির নিদর্শন হিসাবে তাকে কিছু উপহার পাঠাতে চাই। তুমি তার কাছে পৌঁছে দেবে, আমার হয়ে?

—বাঃ, কেন দেব না? আর তাছাড়া আপনি যে আমার সঙ্গে কত সুন্দর ব্যবহার করছেন তাও তাকে বলবো বৈকি! আমার তো মনে হয়, এর ফলে, দুই দেশের মধ্যে সখ্যভাব গড়ে উঠবে।

সম্রাট রাজন্যদের নির্দেশ দিলেন, সুলতান হারুন অল রসিদের উপহার সামগ্ৰী সাজাতে।

একটা বড় ঘট নানাজাতের মূল্যবান রত্নপাতরে ভর্তি করা হলো। একটা প্রকাণ্ড গালিচা দিলেন তিনি। সাপের চামড়া দিয়ে তৈরি। আগাগোড়া গালিচাটার গায়ে মোহরের মতো গোল গোল চক্ব। শ দুই কপূরের ডেলা। আট হাত লম্বা আর সেই পরিমাণ চওড়া হাতীর দীত। এবং এর সঙ্গে দিলেন। সারন দ্বীপের এক উর্বশী কন্যা।

এই সঙ্গে তিনি একখানা পত্র দিলেন খলিফা হারুন অল রসিদকে।

‘মহামান্য খলিফা; আমার এই দীন উপহারটুকু আপনি গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করুন। আপনারকীর্তিকাহিনী শুনে আমি মুগ্ধ। আমি আপনার মতো আদর্শ সম্রাট হয়ে রাজ্য শাসন করতে পারলে নিজেকে কৃতাৰ্থ মনে করবো। আপনি আমার আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করবেন। আপনার বন্ধুত্ব পেলে আমি ধন্য হবো।’

সম্রাট আমাকে বললেন, সিন্দবাদ, তুমি আমার আদরের অতিথি। যদি এ দেশ তোমার ভালো লাগে, এখানেই থাকে। আমি খলিফার কাছে অন্য দূত পাঠাচ্ছি। সে তামার আপনজনদেরও খবর দিয়ে আসতে পারবে—তুমি ভালো আছ।

আমি বললাম, আপনার সহৃদয়ত আমি কোনওদিনই ভুলতে পারবো না, সম্রাট। না, আমি দেশেই ফিরে যেতে চাই। আপনার দেশ আমার খুবই ভালো লেগেছে। কিন্তু নিজের আত্মীয়স্বজনদের দেখার জন্য মন আমার চঞ্চল হয়ে উঠেছে। দু-এক দিনের মধ্যেই একখানা নৌকা বসরোহর দিকে ছাড়বে। আমি ঠিক করেছি, এই নৌকাতেই রওনা হয়ে যাবে।

সম্রাট বললেন, বেশ, তাই যাও। কিন্তু তোমার জন্য আমার দরজা সব সময়ই খোলা রইলো, সিন্দবাদ। যখন তোমার ইচ্ছে হবে, চলে আসবে। 被

কাপ্তেনকে ডেকে তার সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিয়ে সম্রাট বললেন, এ হচ্ছে সিন্দবাদ, দুর্বর দুরন্ত। কতবার যে মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে এসেছে তার ইয়ত্তা নাই। তুমি যাওয়ার পথে এর মুখে শুনবে সেই সব বিচিত্র কাহিনী। শোনো, কপ্তেন, সিন্দবাদ আমার বিশেষ অতিথি। তাকে খুব যত্ন করে পৌঁছে দেবে তার দেশে। তোমার যা ভাড়া, আমি দেব।

সম্রাটের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি নিরাপদে বসরা হয় এসে পৌঁছলাম। সেখান থেকে আমার স্বদেশ-বাগদাদ।

জাহাজ থেকে নেমে প্রথমে আমি গেলাম সুলতান হারুন অল রসিদের প্রাসাদে। যথাবিহিত কুর্নিশ জানিয়ে সম্রাটের চিঠিখানা আর তার উপহার সামগ্ৰী দিলাম তাঁকে। আমার সমুদ্র যাত্রার উটব কাহিনীও বললাম।

খলিফা মনোযোগ সহকারে চিঠিখানা পড়লেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন সব উপহারের জিনিসপত্র। বললেন, বাঃ, বেশ সুন্দর তো!

আমি সম্রাটের গুণগান করে বললাম, সত্যিই, তার মতো ধর্মপ্ৰাণ প্রজাবৎসল, ন্যায়পরায়ণ সম্রাট আমি দেখিনি, জাঁহাপনা। র্তর দেশে অধৰ্ম, অন্যায়, অবিচার বলে কিছু নাই। সম্রাট নিজেই তার দেশের প্রধান বিচারক। প্রতিটি প্রজার কল্যাণের জন্য সর্বদা তিনি চিন্তিত।

খলিফা বললেন, আমারও তাই মনে হচ্ছে, সিন্দবাদ। তুমি যে তীর শুভেচ্ছা বয়ে নিয়ে এসেছ আমার কাছে, এজন্য তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ।

খলিফা আমাকে মূল্যবান সাজপোশাক উপহার দিলেন। এই হচ্ছে আমার ষষ্ঠ অভিযানের কাহিনী। এর পর কাল তোমাদের শোনাবো। আমার শেষ সমুদ্রযাত্রার আর এক অভিজ্ঞতা।

বৃদ্ধ সিন্দবাদ নাবিক, এরপর, সকলের সঙ্গে বসে খানাপিনা করলো। কুলি সিন্দবাদকে একশোটা সোনার মোহর উপহার দিয়ে বললো, কাল সকালে আবার আসবে। আমার কাহিনী শোনাবো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *