1 of 4

১.৪৩ বিদূষী হাফিজার কাহিনী

বিদূষী হাফিজার কাহিনী

শাহরাজাদ স্মিত হাসে। দুনিয়াজাদ বলে, দিদি, এবার কোন কাহিনী শোনাবে?

–শুনুন মহানুভব জাঁহাপনা, এবার আপনাকে সভাকবি আবু নসাব-এর দু-একটা মজার অভিজ্ঞতার কাহিনী শোনাবো। বড় উপাদেয়, মনোহারী।

দুনিয়াজাদ আব্দর ধরে, তা হলে শুরু কর, দিদি।

শাহরাজাদ বলে, জাঁহাপনা শুনতে চেয়েছেন, শোনাতে আমি বাধ্য, বোন। কিন্তু আজ তো আর হবে না, রাত শেষ হয়ে আসছে। এখন ঘুমাও, কাল রাতে শুরু করা যাবে।

 

দুশো সত্তরতম রজনীতে নতুন কাহিনী :

শুরু করার আগে শাহরাজাদ সুলতান শারিয়ারের সঙ্গে সুরতরঙ্গ শেষ করে নেয়। দুনিয়াজাদ এতক্ষণ নিচে গালিচার উপরে দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে কাপ মেরে শুয়েছিলো। এবার সে পালঙ্কে দিদির পাশে এসে বসলো। শাহরাজাদ বলতে থাকেঃ একদিকে আবু নসাব খলিফা হারুন অল বসিদের সভাকবি হিসাবে খ্যাতিমান ছিলো; আর এক দিকে আবার তার মতো কুখ্যাত অসচ্চরিত্রের মানুষ দুটি ছিলো না।

দুনিয়াজাদ দিদিকে জড়িয়ে ধরে, কেন দিদি, কী সে করেছিলো?

সুলতান শারিয়ারও বলে, কিসসা শুরু করার আগেই দারুণ জমিয়ে দিলে, দেখছি। আবু নসাবের দু-একটা কীর্তির কিসসা তা হলে শুনতেই হয়। মনে হচ্ছে, খুব মজাদার হবে। কিন্তু আজ রাতে আমার মনটা বড় উদাস হয়ে আছে, শাহরাজাদ। আজ কিছু জ্ঞানের কথা, কিছু উপদেশর বাণী শুনতে পেলে দিলটা হালকা কবতে পারতাম।

শাহরাজাদ বলে, আমিও হঠাৎ, আজি সারাটা দিন, এই ধরনের কথাই ভাবছিলাম জাঁহাপনা।

শাহরিয়ার বলে, তা হলে আর কোল ৱিলম্ব করে লাভ কী? শুরু কর।

শাহরাজাদ এক মুহূর্ত কি যেন ভাবে। তারপরে সে বলতে থাকে :

এক সময়ে বাগদাদ শহরে এক ধনী সওদাগর ছিলো—বিষয় আশয় ধনদৌলত-কোনও কিছুরই অভাব ছিলো না তার। কিন্তু এত সত্ত্বেও তার মনে কোনও সুখ ছিলো না। তার সেই বিশাল বিত্ত বৈভব কে ভোগ করবে? তার কোন সন্তানাদি ছিলো না। ভেবে ভেবে অকালে তার মাথার চুল সাদা হয়ে গেলো। দেহে জরা-বাৰ্ধক্য দেখা দিলো। পুত্রার্থে অনেক ভার্য সে কিনেছিলো। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি।

কারণে অকারণে সে অনেক দানধান করতো। অনেক পীর পয়গম্বরের আস্তানায় ধর্ণ দিয়ে পড়ে থাকতো। উপবাস থেকে দেহ, মন শুদ্ধ রাখতো। প্রহরে প্রহরে নামাজ পড়তো। এবং সর্বকনিষ্ঠা সুন্দরী বিবির সঙ্গে সহবাস করতো।

অবশেষে আল্লাহ মুখে তুলে চাইলেন। ছোট বিবি গৰ্ভবতী হলো। নমাস পরে সে একটি চাঁদের মতো ফুটফুটে সুন্দর ছেলে প্রসব করলো। খোদাতালার এই অপার করুণায় আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে সে ভিক্ষুক, অনাথ, বিধবাদের সাতদিন ধরে পেট পুরে খাওয়ালো।

ছেলের নাম রাখা হলো আবু আল-হুসন। ধাই ও বহু সুন্দরী বাঁদীদের পরিচর্যায় শিশু বড় হতে থাকে। সময়কালে তার লেখা পড়ার ব্যবস্থা করলো সওদাগর। কোরান, কাব্য, অঙ্ক, হস্তলিপিতে সে পারদর্শী হয়ে উঠতে থাকে। খেলাধূলা এবং অস্ত্রবিদ্যাতেও বেশ পটু হতে লাগলো-সব চেয়ে তার ঝোক ছিলো ধনুর্বিদ্যায়। অব্যৰ্থ লক্ষ্য তার। নিশানার এক চুল এদিক ওদিক যায় না তার তীর।

শুধু লেখাপড়া বা খেলাধুলাতেই সে অন্য ছেলেদের চেয়ে সেরা হয়ে উঠেছিলো তাই না, তার মতো চোখ ঝলসানো যাদুকরের মতো রূপই বা আর কার ছিলো? একবার দেখলে সহসা চোখ ফেরানো যায় না।

আবু হুসন তার বাবার চোখের মণি, আঁধার ঘরের আলো। ছেলের দিকে বুক ভরা আনন্দ নিয়ে তাকিয়ে থাকে বৃদ্ধ। আর ভাবে, তার তো যাবার সময় হয়ে এসেছে-এবার সব ফেলে রেখে চলে  যেতে হবে। ছেলেকে কাছে ডেকে সে বলে, বাবা শোনো, তার ডাক পড়েছে, আমাকে যেতে হবে। কোনও কাজই আমি অসমাপ্ত রেখে যাচ্ছি না! তোমার জন্য প্রচুর ধন-দৌলত রইলো-সাত পুরুষ বসে খেলেও ফুরাবে না। যা রেখে গেলাম, ভালো করে ভোগ করবে। কিন্তু অমিতব্যয়ী হয়ো না। তাই বলে আত্মাকে কষ্ট দিয়ে সম্পত্তি সঞ্চয় করো না। যতটুকু প্রয়োজন, ব্যয় করতে দ্বিধা করো না। সব সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করবে। মনে রাখবে, তার করুণাতেই বেঁচে আছো।

সওদাগর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো। যথাবিহিত মর্যাদা সহকারে তার শেষ কৃত্য সমাধা করলো আবু আল-হুসন।

শোকের দিনগুলো শেষ হয়ে গেলো। বন্ধু-বান্ধবরা হুসনকে হামামে নিয়ে গিয়ে গোসল করিয়ে নতুন সাজপোশাকে সাজালো!

‘সব শিশুই একদিন বৃদ্ধ হয়। তার মৃত্যুই তার অস্তিত্বের ইতি নয়। সব শিশুর অন্তরেই পিতা ঘুমিয়ে থাকে। মুছে ফেলো অশ্রু। তোমার এই অফুরন্ত যৌবন আর অতুল বৈভব-এর সদ্ব্যবহার কর।’

বন্ধুদের সান্ত্বনা বাক্য উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে শোকের পালা শেষ হয়। দিন যায়। সঙ্গী সাথীর সাহযর্যে দেহ-প্ৰাণ-মন চপল চঞ্চল হয়ে ওঠে। সুতরাং আবু আল-হুসন একটু একটু করে বাবার উপদেশ বাণী ভুলে যেতে থাকে। বিলাসিতার বাহুল্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। ’ম’ কারান্ত সবগুলো উপসৰ্গই প্রধান হয়ে ওঠে তার জীবনে। বাড়িতে নাচগানের আসর বসে নিত্য। নামকরা বাইজীরা আসে। দামী দামী মদ মাংসে মহোৎসব চলে। এইভাবে বসে বসে উড়ালে সুলতানের ভাণ্ডার শূন্য হতে কতদিন লাগে! হঠাৎ একদিন সে দেখলো, তার বিপুল বিত্ত বৈভবের আর বিশেষ কিছুই অবশিষ্ট নাই। থাকার মধ্যে আছে শুধু একটি কেনা বাঁদী।

এই হচ্ছে নসীবের নিয়তি। একটিমাত্র সুন্দরী বাঁদী ছাড়া সব তিনি কেড়ে নিলেন। এই বাঁদী তখনকার দিনের সেরা সুন্দরীদের সেরা ছিলো। তার অসাধারণ রূপগুণের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিলো তামাম দুনিয়ায়। নাম হাফিজ। তন্বী শ্যামা শিখর দশনা। হরিণীর মতো কাজল কালো টানা টানা চোখ, টিকালো নাক, গুলাবের পাঁপড়ীর মতো গাল আর পাকা আঙুরের মতো অধর পুরুষের বুকে আগুন ধরিয়ে দেয়।

এখন আবু আল-হুসনের এই সুন্দরী হাফিজাই একমাত্র এবং শেষ সম্পত্তি। আর সবই সে খুঁইয়ে ফেলেছে। চিন্তায় ভাবনায় তার মুখে খানা রোচে না, চোখে ঘুম আসে না।

হাফিজা দেখলো, এইভাবে অনাহারে অনিদ্রায় কাটাতে থাকলে হুসন বাঁচবে না। যেভাবেই হোক, তার মনের কষ্ট লাঘব করতে হবে। মুখে হাসি ফোটাতে হবে।

ঘরে যে-টুকু গহনা-পত্র অবশিষ্ট ছিলো, তাই পরে নিলো হাফিজ। দামী সাজ-পোশাকে সেজেগুজে হুসন-র কাছে এসে বললো, আমাকে দিয়ে তোমার ভাগ্য ফিরে যাবে। আমার কথা শোনো, খলিফাহারুন অল-রাসিদের কাছে নিয়ে চলো আমাকে বলবে, মাত্র দশ হাজার দিনার-এর বিনিময়ে তুমি আমাকে বেচে দিতে চাও। যদি তিনি বলেন, দাম বড় বেশি হচ্ছে, তুমি বলবে কোন বাদশা সওদাগরের ঘরে চলে যাবে সে—কিছুই জানতে পারবো না। কিন্তু আপনার কাছে থাকলে আমি নিশ্চিন্ত হবো, সে কোনও দুঃখ কষ্ট পাবে না। আর তাছাড়া, রূপের জেল্লায় সবাই হয়তো তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু তার গুণের কদর আপনি ছাড়া আর কেউ-ই করতে পারবে না। যদি প্রমাণ চান, এখুনি কেমন সে গুণবতী পরীক্ষা করে দেখে নিতে পারেন।’ তবে একটা কথা, খলিফা যদি দরকষাকষি করে, তুমি কিছুতেই রাজি হবে না।

আবু আল হুসন ভাবতে পারে না। হাফিজার মতো সর্ব গুণান্বিতা সেরা সুন্দরীকে হাত ছাড়া করার কথা কি করে সে ভাববে? সে তো শুধু পয়সা দিয়ে কেনা বাঁদীই নয়, সে যে তার দিল কা কলিজা! কিন্তু পেয়ারের চেয়ে প্রয়োজন অনেক বড়। তাই হাফিজার এই প্রস্তাব একেবারে নস্যাৎ করে দিতে পারে না। বলে, ঠিক আছে চলো।

যথারীতি কুর্নিশ জানিয়ে হুসন খলিফার কাছে হাফিজার শেখানো বুলিগুলো আওড়ে যায়। খলিফা জিজ্ঞেস করে, তোমার নাম কী, সুন্দরী?

-হাফিজা।

খলিফা বললেন, হাফিজা, তোমার তো অনেক গুণকীর্তন শুনলাম। তা কী কী বিষয়ে তোমার পাণ্ডিত্য-একটু-আধটু নমুনা দেবে?

—কেন নয়, জাঁহাপনা? একশোবার দেব। বলুন, আপনি কী জানতে চান? আমি কাব্য, ব্যাকরণ, সমাজবিজ্ঞান, সামরিক বিজ্ঞান, সঙ্গীত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যামিতি, অঙ্ক, আইন এবং কলাবিদ্যা আহরণ করেছি। পবিত্র ধর্মগ্রন্থের শাশ্বত সত্য আমি উপলব্ধি করেছি। তার প্রতিটি স্তবক, প্রতিটি ছত্র আমার মুখস্থ। আমি জানি কোরানের কোন অংশটুকু মক্কায় লেখা আর কোনটুক মদিনায় বলেছিলেন। আমি মুসলমান ধর্মের সব ফরমানই জানি।

আমি কালোয়াতী গাইতে পারি। নাচতেও জানি। বীণা সেতার স্বরোজ পাখোয়াজ বাজাতে পারি।

হারুন অল রসিদ। মেয়েটির অসাধারণ বাকপটুতায় মুগ্ধ হয়ে আবু অল হুসনকে বললেন,

এই বাঁদীর বিদ্যাবুদ্ধি। তাদের বিচারে এ যদি উৎরে যায়, তাহলে মাত্র দশ হাজারই নয় অনেক অনেক বেশি ইনাম তুমি পাবে। আর যদি সে না পারে, তবে তোমার জিনিস তুমি ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, আমার কোনও কাজে লাগবে না।

খলিফা তখনকার সবচেয়ে সেরা পণ্ডিত ইবরাহিম ইবন শিয়ারকে ডেকে পাঠালেন। বলতে গেলে, তিনি বিদ্যার সাগর। এছাড়া দেশের সেরা কবিদেরও ডাকা হলো। ডাকা হলো ব্যাকরণবিদ, দার্শনিক, জ্যোতির্বিদ, আইনবিদ এবং আরও বহু প্ৰাজ্ঞ ব্যক্তিদের।

প্রাসাদের বিরাট সভাকক্ষে সকলে এসে সমবেত হলো। কেউই জানে না, কী কারণে খলিফা তাদের তলব করেছেন। সভাকক্ষের ঠিক মাঝখানে খলিফার স্বর্ণািসন। তার চারপাশ ঘিরে বৃত্তাকারে বসলো সুকলে। হাফিজা নগণ্য এক নারী-বোরখা ঢাকা দিয়ে সভাকক্ষের এক পাশে

হঠাৎ কলগুঞ্জন থেমে গিয়ে নিরালা নির্জন অন্ধকারের নিঃশব্দ নিস্তব্ধতা নেমে এলো সেই বিশাল সভাকক্ষে। হাফিজ এগিয়ে এসে আভূমি আনত হয়ে কুর্নিস জানালো, খলিফাকে।

-ধর্মাবতার বাঁদী হাজির, হুকুম করুন, আমি তামিল করার জন্য প্রস্তুত। এখানে উপস্থিত সকলেই প্রাজ্ঞব্যক্তি, আপনাদের পছন্দ মতো যে কোনও বিষয়ে যে কোনও প্রশ্ন আপনারা করতে পারেন, আমি সাধ্য মতো জবাব দেবার কোসিস করবো।

হারুন অল রসিদ চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, এখানে আপনারা সবাই গুণীজন। হাজির আছেন। যার যা ইচ্ছা, এই মেয়েকে প্রশ্ন করতে পারেন। আজ তার বিদ্যাবুদ্ধির পরীক্ষা হবে।

সকলে মাটিতে মাথা নুইয়ে সুলতানের প্রতি শ্রদ্ধা জানালো।

হাফিজ উঠে দাঁড়িয়ে সমবেত পণ্ডিতদের সামনে বলতে থাকে, আপনাদের মধ্যে কোরান বিশেষজ্ঞ কি কেউ আছেন? মেহেরবানী করে সাড়া দিন।

সকলের চোখ একজনের দিকে ঘুর গেলো। এক হেকিম উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি—আমি সেই লোক।

হাফিজ স্মিত হেসে বললো, তাহলে আপনিই আমাকে প্রথমে প্রশ্ন করুন, মালিক।

সুতরাং কোরান বিশারদ সেই হেকিম তখন প্রশ্ন করেন, শোনো মেয়ে, তুমি তো কোরানের সব পাঠই শেষ করেছ। আচ্ছা বলে দেখি, পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কয়টি পরিচ্ছেদে বিভক্ত? কতগুলি শব্দ কতগুলি অক্ষর এবং কতগুলি আদেশ আছে কোরানে? আচ্ছা আগে বলো, কে তোমার মালিক কে তোমার পয়গম্বর, কে তোমার ইমাম? বলো, কোনটা তোমার নির্দিষ্ট দিক। এবং তোমার জীবনের নীতি কী? কী তোমার নির্দেশিত পথ? এবং কারা তোমার ভ্ৰাতা?

সে বললো, আল্লাহ আমার মালিক। মহম্মদ আমার পয়গম্বর। কোরানই আমার কানুন। সুতরাং তিনিই আমার ইমাম। মক্কাতে অবস্থিত আবরাহামের নির্মিত আল্লাহর কাবাহ আমার দিক। আমার পয়গম্বরের নির্দেশই আমার জীবনের নীতি। সুন্নী সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যই আমার পথনির্দেশ। আর আমার ধর্মেবিশ্বাসী যারা সকলেই আমার ভাই।

হাফিজার জবাবে খলিফা মুগ্ধ হলেন। এবার সেই হেকিম আবার প্রশ্ন রাখলেন, আচ্ছা বলো, কী করে বুঝতে পার আল্লাহ আছেন?

—যুক্তি দিয়েই বুঝতে পারি।

—কী সেই যুক্তি?

—যুক্তি দুই প্রকারের। প্রথম যুক্তি পাই অন্তর থেকে। দ্বিতীয় যুক্তি অর্জন করতে হয়। প্রথম যুক্তি যা অন্তর থেকে পাই তা আল্লাহ নিজেই তার অনুগতদের অন্তরে প্রবেশ করিয়ে দেন। আর অর্জিত যুক্তি শিক্ষা দ্বারা জ্ঞানের দ্বারা লাভ করতে হয়।

–চমৎকার। কিন্তু এবার বলো, এই যুক্তির অবস্থান কোথায়?

–হৃদয়ে। অবশ্য উৎসাহ আসে মস্তিষ্ক থেকে।

–আমাদের ধর্মের অবশ্য করণীয় কর্তব্য কি কি?

–অবশ্য করণীয় কর্তব্য পাঁচটি। ধর্ম বিশ্বাস-আল্লা ভিন্ন দ্বিতীয় কোন ঈশ্বর নাই, এবং মহম্মদ আল্লাহর পয়গম্বর। প্রার্থনা। দান। রোজা-রমজান মাসব্যাপী উপবাস। যখন সম্ভব মক্কায় তীর্থযাত্ৰা।

—ধর্মের প্রতি প্রশংসণীয় আচরণ কি কি?

—ছয় প্রকার। প্রার্থনা-নামাজ। দান। উপবাস। তীর্থযাত্রা। রিপু দমন, নিষিদ্ধ দ্রব্যবৰ্জন এবং ধৰ্মযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করা।

–নামাজের উদ্দেশ্য কি?

–আল্লাহর পায়ে আমার ধর্মের অর্ঘ নিবেদন করা, তার মহিমার গুণকীর্তন করা। এবং আমার আত্মার শান্তি বিধান করা।

–বাঃ বা, চমৎকার-চমৎকার। নামাজের জন্য অপরিহার্য প্রস্তুতির প্রয়োজন নাই?

–নিশ্চয়ই আছে। রুজু দ্বারা সমস্ত দেহ পবিত্র করা দরকার। পরিষ্কার শুদ্ধ বস্তু পরিধান বিধেয়। নামাজের জন্য পরিষ্কার স্থান নির্বাচন করা দরকার। পবিত্র এবং একাগ্র হওয়ার জন্য নাভি থেকে উরুপ্রদেশ পর্যন্ত সুরক্ষণ করা প্রয়োজন। পবিত্ব কাবার দিকে—অর্থাৎ মক্কার দিকে মুখ করে নামাজ পড়তে হবে।

–নামাজের আবশ্যকতা কী?

-ধর্ম বিশ্বাসের ভিত সুরক্ষিত করে।

—নামাজে কি লাভ হয়?

—নিখাদ নামাজে পার্থিব কোন লাভ নাই। মানুষ এবং আল্লাহর মধ্যে এক অপার্থিব যোগসূত্র রচনা করে। এর দ্বারা দশটি অলৌকিক ফললাভ হয় ৪ হৃদয় উদ্ভাসিত করে। মুখমণ্ডলে প্রশান্তি আনে। সহানুভূতি জাগ্রত করে। শয়তানকে তাডিত করে। হৃদয় দয়াদ্র হয়। অশুভ অন্তহিত হয়। অসুস্থতা প্রতিরোধ করে। শত্রু থেকে রক্ষণ করে। টলায় মান চেতনাকে দুৰ্গ-সুরক্ষিত করে। এবং আত্মা আল্লাহর নিকটবতী হয়।

—নামাজের চাবি-কাঠি কী?

—যথাযথ রুজুই নামাজের প্রকৃষ্ট উপায়। এবং রুজু করার আগে মন করুণাঘন ও সহানুভূতিসম্পন্ন করে তোলা দরকার।

—রুজুর বর্ণিত ব্যবহার কিরূপ?

–গোঁড়া ইমাম মহম্মদ ইবন ইদ্রিস অল সফির নির্দেশ ছয় প্রকারের : সৃষ্টিকতাঁর পায়ে নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য একনিষ্ঠ ইচ্ছা দরকার-এতে আত্মা পবিত্র হয়। প্রথমে মুখমণ্ডল প্রক্ষালন, হাত থেকে কনুই অবধি ধোয়া, মাথার একাংশ ঘর্ষণ করা, পায়ের নখ থেকে গোড়ালী পর্যন্ত ধোয়া, এবং সব কাজই গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে করা।

যখন রুজু শেষ হয়ে যাবে তখন এই সূত্রটি আওড়াতে হবেঃ আল্লাহ, আমাকে শুদ্ধ, অনুতপ্ত এবং বিশ্বস্ত বলে গ্রহণ করা। আমি জানি আর কেউ নাই, তুমিই একমাত্র আল্লাহ! তুমি আমার আশ্রয়, আমার গুনাহর জন্য তোমার কাছে আমি আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থী। আমেন! এই সূত্রটি আমাদের পয়গম্বর আওড়াতে সুপারিশ করেছেন। বলেছেন, এই প্রার্থনা যে করে তার জন্য আমি বেহেস্তের আটটি দরজা উন্মুক্ত করে রাখি। তার খুশি মতো যে কোনও ফটক দিয়ে সে প্রবশে করতে পারে।

–যথার্থ প্রশংসা পাওয়ার মতো জবাবই বটে। কিন্তু এ কথা কি বলতে পোর, যখন একজন মানুষ রুজু করে তখন শয়তান অথবা জীনারা কি করে?

—মানুষ যখন রুজু করতে থাকে তখন জীনরা ডান পাশে এসে দাঁড়ায়। আর শয়তানরা দাঁড়ায় বা পাশে। কিন্তু যখনই আল্লাহর নামে নামাজ প্রস্তুতি উচ্চারিত হতে থাকে শয়তান সটকে পড়ে, কিন্তু জীন আরও কাছে সরে আসে। চারদিকে থেকে চারটি আলোর মণ্ডপ মাথার উপরে তুল ধরে। আল্লাহর জয়গান করে এবং মানুষের পাপের ক্ষমার জন্য মধ্যস্থত করে। যদি সে আল্লাহ নাম উচ্চারণ করতে ভুলে যায় অথবা রুজু করার সময় বাদ পড়ে যায়। শয়তান ফিরে এসে তার উপর চড়াও হয়। প্ৰাণপণে আত্মাকে নিপীড়িত করতে থাকে। সন্দেহর ইঙ্গিত করে। চেতনা প্রশমিত করার আগ্রহ দেখায়।

এই সময়ে রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ চুপ করে বসে থাকে।

 

দুশো তিয়াত্তরতম রজনীতে আবার সে শুরু করে :

অথবা অদৃশ্য সমস্ত চুল জলে ভেজানো দরকার। এবং তার যৌন অঙ্গপ্রত্যঙ্গও। সারা শরীরের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ভালোভাবে ঘষামাজ করা দরকার। এই সব শেষ না হওয়া পর্যন্ত পা ধোয়া

উচিত নয়।

—খুব চমৎকার জবাব। আচ্ছা বলতে পোর, তায়ামাম প্রথায় কীভাবে রুজু করা হয়?

–তায়ামাম শুদ্ধি বাণী দিয়ে করা হয়। সাতটি উপলক্ষ্যে পয়গম্বর এই বাণী দিয়ে রুজুর বিধান দিয়েছেন। সাতটি উপলক্ষ্য এইরূপ & পানির অভাব, পানি নিঃশেষিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা, পানীয় পানির প্রয়োজনে, পানি বহন করে নিয়ে যাওয়ার সময় নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকলে, পানি ব্যবহারে মারাত্মক ব্যাধির আশঙ্কায়, হাড় ভেঙ্গে যাওয়ার পরে এবং এমন ক্ষত যা স্পর্শ করা নিষেধ। আরও চারটি প্রয়োজনীয় শর্ত গ্রন্থে উল্লেখ আছে। একান্ত বিশ্বস্ত হওয়া দরকার। বালি অথবা ধুলো হাতে নিয়ে গায়ে মুখে না মেখে মাথায় অনুরূপ নকল ভঙ্গী করতে হবে। দুটি রীতি সুমী সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত আছে। এইভাবে রুজু করার সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করবে এবং শরীরের বা পাশের আগে ডান পাশের রুজু শেষ করতে হবে।

–অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। আচ্ছা এবারে রোজা সম্বন্ধে বলো।

—রমজান মাসে সূর্যাস্তের আগে আহার, পান, ও মৈথুন থেকে বিরত থাকতে হয়। নতুন চাঁদ যতদিন না দেখা যাবে ততদিন ধরে এই উপবাস পালন করা বিধেয়। আরও ভালো হয় যদি এই রোজার সময় কোরান ছাড়া অন্য কিছু পাঠ এবং অনর্থক কথা বলা থেকে বিরত থাকা যায়।

–আপাত দৃষ্টিতে কতকগুলো ব্যাপারে মনে হতে পারে রোজা কলুষিত হয়, কিন্তু শাস্ত্রে বলেছে না তা হয় না-সেগুলো কী?

—চুলে মাখার সুগন্ধী তেল, মলম, কাজল সুর্ম ব্যবহার; রাস্তার নোংরা ধুলোবালি লাগা, থুথু গিয়ে ফেলা, দিনে অথবা রাত্রে বীর্যপাত; অমুসলমান নারীর প্রতি দৃষ্টিপাত, রক্তপাত, সহবাস-এর কোনটার দ্বারাই রোজা দুষিত হয় না।

-আত্মিক পলায়ন কাকে বলে?

—শুধুমাত্র উদবাসন, নারী সংসর্গ পরিহার এবং মৌন থাকার জন্য দীর্ঘকাল মসজিদে অবস্থানকে সুনীরা আত্মিক পলায়ন বলে। কিন্তু এটা ধৰ্মসম্মত নয়।

–আচ্ছা এবার তীর্থযাত্রা বিষয়ে বলে।

—প্রত্যেক মুসলমানের জীবদ্দশায় অন্তত একবার মক্কায় তীর্থ করতে যাওয়া কৰ্তব্য। এ ব্যাপারে কতকগুলো শর্ত মেনে চলা কর্তব্য : দরবেশের পোশাক ধারণ করা, নারীদের সঙ্গে কোন ব্যবসায়িক বিষয় পরিহার করা, মস্তক মুণ্ডন করা, নখ কাটা, মস্তক এবং মুখমণ্ডল আবৃত রাখা। সুমীরা অবশ্য আরও কতকগুলো বিধি পালন করে।

—এবার পবিত্র যুদ্ধ সম্পর্কে বলো।

–বিধর্মী দ্বারা ইসলাম বিপন্ন হলে জেহাদ ঘোষণা করা হয়। এই যুদ্ধ কেবলমাত্র আত্মরক্ষার জন্য—আক্রমণাত্মক নয়। তখন সাচ্চা মুসলমান অস্ত্রসজ্জিত হয়ে নিৰ্ভয়ে সামনে কদম বাড়াবে-কখনও পলায়ন করবে না।

প্রশ্নকর্তা মনে মনে স্বীকার করলেন, হাফিজার অজানা কিছুই নাই। তবু তাকে বেকায়দায় কী করে ফেলা যায়। তার কায়দা ভাজতে লাগলেন।

—আচ্ছা বলো, রুজু করার ভাষাগত অর্থ কী?

—অন্তরের এবং বাইরের সব মলিনতা প্রক্ষালন করা।

–রোজা শব্দের অর্থ?

—বিরত থাকা।

—দানের অর্থ?

—নিজেকে সমৃদ্ধ করা।

–তীর্থযাত্রী দলে সামিল হওয়া মানে?

–চরম লক্ষ্যের পথে এগিয়ে যাওয়া।

—যুদ্ধ কাকে বলে?

—নিজেকে রক্ষার জন্য প্রতিরোধ করা।

এবার প্রশ্নকর্তা, প্রশংসায় সোচ্চার হয়ে ওঠেন, ধর্মাবতার এই বাঁদীর অগাধ পণ্ডিত্য আমাকে হতবাক করে দিচ্ছে।

হাফিজা মৃদু হাসলো, এবার আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই।

—বলতে পারেন, ইসলামের বনিয়াদ কী?

কিছুক্ষণ ভাবলেন তিনি। তারপর বললেন, চারটি বনিয়াদের ওপর ইসলাম দাঁড়িয়ে আছে। ধর্ম বিশ্বাস—যা জ্ঞানগর্ভ যুক্তি দ্বারা প্রতিভাত হয়। সাধুতা। কর্তব্য বোধ, ন্যায়পরায়ণতা ও বিচক্ষণতা। এবং সমস্ত অঙ্গীকার পালন।

হাফিজা বলে, আর একটা প্রশ্ন করতে অনুমতি দিন। যদি আপনি এ প্রশ্নের জবাব না দিতে পারেন, তবে, আপনার ঐ শিরোপা খুলে আমাকে দিয়ে দিতে হবে।

–আমি রাজি। কী তোমার প্রশ্ন, বলো?

হাফিজার প্রশ্ন, ইসলামের কয়টি শাখা? অনেকক্ষণ ধরে ভাবলেন সেই কোরান বিশারদ। কিন্তু জবাব দিতে পারলেন না। সুতরাং খলিফা বললেন, হাফিজ তুমি যদি পোর, তুমিই আমাদের শুনিয়ে দাও। শিরোপা তোমার পাওনা হলো।

হাফিজা মাথা নত করে খলিফাকে শ্রদ্ধা জানায়।

—ইসলামের কুড়িটি শাখা : শাস্ত্রের কঠোর শিক্ষণ, পয়গম্বরের মুখ নিসৃত বাণী নির্দেশ এবং রীতিনীতি পদ্ধতির স্বীকৃতি, অন্যায় অবিচার এড়ানো, মঞ্জুরীকৃত খাদ্য গ্রহণ, কখনও না নিষিদ্ধ খাদ্য ভক্ষণ, শয়তানের শাস্তি বিধান, দুষ্কৃত কর্মের জন্য অনুতাপ, ধৰ্মজ্ঞান আহরণ, শত্রুর সঙ্গে সহৃদয়তা, বিনয় নম্রতা, আল্লাহর দাসত্ব গ্রহণ, নতুন প্রথা প্রবর্তন ও পরিবর্তন থেকে বিরত থাকা, বাধা বিপত্তিতে সাহস প্রদর্শন এবং পরীক্ষার সময় শক্তি সঞ্চয়, ক্ষমতাবানকে ক্ষমা প্রদৰ্শন, বিপদে ধৈর্য ধারণ, আল্লাকে উপলব্ধি করা, পয়গম্বরকে জানা, দুষ্টের পরামর্শ প্রতিরাধ করা, ষড়রিপু দমন, পবিত্র আত্মবিশ্বাসে উদ্ধৃদ্ধ হওয়া এবং আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ।

খলিফা কোরান বিশারদকে বললেন, আপনি পরাজিত, আপনার শিরোপা হাফিজকে দিয়ে দিন।

তৎক্ষণাৎ তিনি তার শিরোপা হাফিজার সামনে রেখে অবনত মস্তকে সভাকক্ষ ছেড়ে বাইরে চলে গেলেন।

এর পর আর এক বিশারদ উঠে দাঁড়ালেন।

—আমি তোমাকে সামান্য একটা প্রশ্ন করবো। আচ্ছা বলো তো, আহার্যগ্রহণের সময় কী কী নিয়ম অনুসরণ করা বিধেয়?

—খেতে বসার আগে হাতমুখ প্রক্ষালন করে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানানো অবশ্য কর্তব্য। খানার সময় বাঁদিকে কুঁজো হয়ে বসতে হয়। এবং শুধুমাত্র বৃদ্ধাঙ্গুষ্ট, তর্জনী ও মধ্যমার সাহায্যে খাদ্যবস্তু তুলে মুখে পুরতে হয়। খুব ছোট ছোট গ্রাস মুখে নেওয়া উচিৎ। প্রতিটি গ্রাস ভালোভাবে চৰ্বন করা প্রয়োজন। খাওয়ার সময় অন্য কারো দিকে দৃকপাত করতে নাই বা কে কি ভাবছে এই ভেবে সঙ্কুচিত হতে নাই। এর ফলে ক্ষুধা নষ্ট হবার আশঙ্কা থাকে।

—আচ্ছা বলো, খানিকটা কী, অর্ধেকটা কী এবং তুচ্ছতি তুচ্ছই বা কাকে বলে?

—ধৰ্মাত্মাই ‘খানিকটা’, ভণ্ড ‘অর্ধেকটা’ আর বিধর্মই ‘তুচ্ছতিতুচ্ছ’।

–চমৎকার। আচ্ছা বলতে পার বিশ্বাসের সন্ধান কোথায় পাওয়া যায়?

এই বিশ্বাস চার জায়গায় থাকে : হৃদয়ে, মস্তকে, জিহ্বায় এবং ধর্মানুসারীদের মধ্যে।

—হৃদয় কয় প্রকারের?

–অনেক। তার মধ্যে সাচ্চ মুসলমানের হৃদয় পুতপবিত্র হয়, কিন্তু বিধমীর অন্তর ঠিক তার বিপরীত…

এই সময়ে রাত্রি প্রভাত হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

দুশো ছিয়াত্তরতম রাত্ৰিতে আবার সে শুরু করল?

—কারো কারো অন্তর বিষয় আশয়ে মজে থাকে। আবার বা কারো হৃদয় অপার্থিব আনন্দে মশগুল। কেউবা কামনায় দগ্ধ হয়, ঘৃণা ও লোলুপতা কারো অস্তরে বাসা বাঁধে। কেউ বা অলস হৃদয়, কারো হৃদয় ভালোবাসার আগুনে জ্বলে পুড়ে যায়, কারো অন্তর অহঙ্কারে ভরা, আমাদের পয়গম্বরের উন্মুক্ত হৃদয় আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত। এই হৃদয়ই কাম্য।

হাফিজার জবাব শুনে প্রশ্ন কর্তা বিস্ময়ে হতবাক!

—তোমার তুল্য জ্ঞান আমি প্রত্যক্ষ করিনি।

হাফিজ হাসে, আমার কিন্তু একটা প্রশ্ন আছে। খলিফার দিকে চেয়ে বলে, ধর্মাবতার, আমি এঁকে একটি প্রশ্ন করতে চাই। যদি তিনি জবাব দিতে না পারেন ওঁর শিরোপা আমাকে খুলে দিতে হবে।

খলিফা হাসলেন, ঠিক আছে, তাই হবে।

—বলতে পারেন, সবচেয়ে আগে কোন কর্তব্য সম্পাদন করতে হয়। হয়তো অনেক জরুরী। কোজ সামনে আছে—তার থেকে আরও জরুরী কাজ সামনে আছে। তার থেকে আরও জরুরী কাজ কি মনে হতে পারে?

এ প্রশ্নের জবাব জোগালো না তার মুখে। হাফিজ শিরোপা পেয়ে গেলো। তারপর নিজেই সে উত্তর দিলো :

ধর্মীয় সব কর্তব্য পালন করার আগে রুজু কৰ্তব্য সমাধা করতে হবে। ধর্মীয় কর্তব্য সমাধা করতে গেলে প্রথমে দেহ মনের শুদ্ধি প্রয়োজন।

এবার আর এক মহা দিগগজ উঠে দাঁড়ালেন।

–তুমি তো কোরান সম্বন্ধে সবই জান। আমাদের কিছু নমুনা শোনাও, দেখি!

—কোরানে একশো চোদ্দটি অধ্যায় আছে। তার মধ্যে সত্তরটি মক্কায়এবং বাকী চুয়াল্লিশটি মদিনায় রচিত হয়েছিলো। এগুলো আবার ছয়শো একুশটা পরিচ্ছেদে বিভক্ত। এদের নাম দশক। ছয় হাজার দুশো ছত্রিশটি স্তবক আছে এতে। সব শুদ্ধ সংখ্যা উনআশী হাজার চারশো উনচল্লিশ। তিন লক্ষ তেইশ হাজার ছয়শো সত্তরটি অক্ষরমালায় এই শব্দ সমষ্টি গঠিত।

পঁচিশজন পয়গম্বরের নাম : আদম, নোয়াহ, ইসলাইল, আইজাক, জ্যাকব, জোসেফ, ইলিসা, জোনাহ, লভ, সালিহ, হুদ, সুয়াইব, ডেভিড, সোলেমান, ধুল-কাফ্ল, ইদ্রিস, ইলিয়াস, ইয়াহিয়া, জ্যাকারিয়াস, জোব, মোসেস, আরুন, জেসাস এবং মহম্মদ।

—ঠিক বলেছ। এবারে বলো, আমাদের পয়গম্বর কিভাবে বিধমীর বিচার করেছেন।

—তিনি বলেছেন, ইহুদীরা বলে খ্রীস্টানরা ভুল, আর খ্রীস্টানরা বলে ইহুদীরা ঠিক নয়। বলতে গেলে ওরা দুজনই ঠিক কথা বলে।

এই সময়ে রজনী অতিক্রান্ত হতে থাকে। শাহরাজাদ চুপ করে বসে রইলো।

 

দুশো আটাত্তর রজনীতে আবার সে বলতে থাকে :

প্রশ্নকর্তা এবারে উল্লসিত কণ্ঠে বলেন, ধর্মাবতার এই অসামান্য মহিলার পাণ্ডিত্যের তুলনা নাই।

হাফিজা বললো, আমি এবারে একটা প্রশ্ন করবো। বলুন তো কোরানের কোন স্তবকে কাফ অক্ষরটি তেইশবার আছে! মিম ষোলবার এর আর একটা অক্ষর চল্লিশবার আছে?

এ প্রশ্নের তিনি উত্তর দিতে পারলেন না। হাফিজ তখন তার শিরোপা দাবি করে বললো, আমি বলে দিচ্ছি।

খলিফা উঠে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, সারা দেশের মধ্যে হাফিজা শ্রেষ্ঠ গুণী। তার সমকক্ষ আর কেউ নাই।

হাফিজকে দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা ইনাম দিলেন খলিফা। দশটি থলেয় ভরে এই মোহরগুলো আবু অল হুসনর হাতে তুলে দেওয়া হলো।

খলিফা জিজ্ঞেস করলেন, হাফিজা তুমি কি আমার হারেমে যেতে চাও? সেখানে তোমাকে বাদশাহী মর্যাদায় রাখতে পারি আমি। অথবা তুমি এই যুবকের সঙ্গেও যেতে পোর।

হাফিজা আভূমি আনত হয়ে কুর্নিশ জানায়। খোদা মেহেরবান, তিনি আপনার মঙ্গল করুন, আপনার বাঁদী এই যুবকের সঙ্গে যেখানে থেকে এসেছিলো সেখানেই ফিরে যেতে চায়।

এ কথায় খলিফা অসন্তুষ্ট হলেন না। বরং খুশি হয়ে বললেন, আমি তোমাকে আরও পাঁচশো দিনার উপহার দিচ্ছি। তোমাদের ভালোবাসার কাছে আমার প্রাসাদের এই ভোগবিলাস যে তুচ্ছ, তা জেনে আমি মুগ্ধ হলাম, হাফিজ। আমি তোমার ভালোবাসা আবু অল হুসনকে আজ থেকে আমার দরবারের এক উচ্চ পদে বহাল করলাম।

এর পর ওরা দুজনে সভাগৃহ ছেড়ে চলে গেলো। হাফিজা নিলো সেই শিরোপাগুলো আর আবু অল হুসন নিয়ে চললো সেই মোহরের থলেগুলো।

সভাকক্ষের সমবেত সকলে বিপুল হর্ষধ্বনি দিয়ে ওঠে, আব্বাসের বংশধরের এই মহানুভবতায় তুলনা সারা বিশ্বে কোথাও খুঁজে পাবে না কেউ।

শাহরাজাদ বললো, তারপর খলিফার হুকুমে হাফিজার এই গুণকীর্তন লিপিবদ্ধ করে রাখা হলো।

শাহরাজাদ থামলো। শারিয়ার বাহবা দিয়ে বলে, তোফা? কিন্তু এবার তো তোমাকে আবু নসাবের কাহিনী শোনাতে হবে শাহরাজাদা?

–বেশ তো শোনাচ্ছি।

এতক্ষণ দুনিয়াজাদ আধা-ঘুমে ঢুলছিলো। এই সব তত্ত্ব-কথা তার ভালো লাগবে কি করে? আবু নসাবের নাম কানে ঢুকতেই সে সোজা হয়ে বসলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *