1 of 2

২.২২ অভিমানী পারুল

অভিমানী পারুল স্বেচ্ছায় স্বর্গের টিকিট ত্যাগ করেছিল। একদা তার আর বকুলের স্কুলে ভর্তি হওয়া নিয়ে যখন সংসারে ঝড় উঠেছিল, তখন পারুল বেঁকে বসেছিল, বলেছিল, এত অপমানের দানে রুচি নেই আমার।

অথচ ওই স্কুল নামক জায়গাটা সত্যিই তার আজনের স্বপ্ন-স্বৰ্গ ছিল। সামনে-পিছনে আশেপাশে যে বাড়িগুলো দৃষ্টিগোচর হতো, সকালের দিকে সেই বাড়িগুলোর দিকে লক্ষ্য রাখা একটা কাজই ছিল পারুলের।

সেই সব বাড়ির যে সব মেয়েরা স্বৰ্গরাজ্যের প্রবেশপত্ৰ পেয়েছে তারা কেমন করে বেণী ঝুলিয়ে বইখানা বুকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে, তাদের দেখবার জন্যে চেষ্টার আর অন্ত ছিল না। তার।

আর যাদের যাদের বাড়ির দরজায় সেই একটি খড়খড়ি আটা টানা লম্বা গাড়ি এসে দাঁড়াতো, পোশাকপরা চালক বিশেষ একটি সুরে হাঁক দিত, এবং একটু বড় বয়সের মেয়েরা খোঁপাবাঁধা ঘাড়টা একটু হেট করে তাড়াতাড়ি বেরিয়েই গাড়িতে গিয়ে উঠতো!

তাদের দিকে ছিল বুঝি বুভুক্ষার দৃষ্টি, ঈর্ষার দৃষ্টি!

জগতের আনন্দ যজ্ঞে সবার নিমন্ত্রণ।

নিমন্ত্রণ নেই শুধু পারুলদের!

যেহেতু তারা ভারি একটা পুণ্যময় সনাতন বাড়ির মেয়ে। তাই পারুল শুধু তাদের জানলার খড়খড়ি তুলে সেই নিমন্ত্ৰণ-যাত্রার দৃশ্য দেখবে।

বড় হওয়া অবধি বারান্দায় দাঁড়ানোয় শাসনদৃষ্টি পড়েছিল, তাই ভরসা ওই পাখী দেওয়া জানলা! পারুল বকুলের মা চেয়েছিল ওই টিকিট তাদের জন্যে যোগাড় করে দিতে। সম্পূর্ণ কৃতকার্য হয় নি।

ঝড় উঠেছিল, সেই ঝড়ের ধুলোয় অন্ধ হয়ে গিয়েছিল অভিমানিনী পারুল। পারুল বলেছিল, আমার দরকার নেই।

বকুলের অভিমান অত দুৰ্জয় নয়।

বকুল অবজ্ঞা আর অবহেলায় ছুঁড়ে দেওয়া টিকিটখানা পেয়েই ধন্যবোধ করেছিল।

তা হয়তো ওইটুকুও জুটতো না, যদি বকুলের সামনের লাইনে তার দিদি না থাকতো।

সেজদি!

দুজনের দাবি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল সুবর্ণ, সুবর্ণর যুদ্ধ-ভীত স্বামী মাঝামাঝি রফা করতে চেয়েছিল, বলেছিল, বকুল যায় যাক, পারুল আবার যাবে কি?

আর তার বিদ্বান বিজ্ঞ ছেলেরা বলেছিল, বিদুষী হয়ে হবেটা কি? কলাপাতে না এগোতেই তো লিখছে!

গ্ৰন্থ অতএব পারুল সেই রণক্ষেত্র থেকে বিদায় নিয়েছিল। আর এক কড়া স্কুলে ভর্তি হয়ে চলে গিয়েছিল। সেখানের বোর্ডিঙে!

নিঃশব্দচারিণী নিঃসঙ্গ বকুল তার স্বর্গে যাওয়া-আসা করছিল।

কিন্তু সেই আসা-যাওয়ার পথের দিকে যদি কেউ চোখ ফেলে দাঁড়িয়ে থাকে, যদি চোখোচোখি হওয়া মাত্র আনন্দে ভাস্বর হয়ে ওঠে সেই চোখ, বকুল কি করবে?

বকুল বড় জোর বলতে পারে, রোজ রোজ এখানে দাঁড়িয়ে থাক যে? কলেজ নেই তোমার?

সে তো সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেবে, স্কুল বসবার পরে কলেজের টাইম, এই একটা মস্ত সুবিধে!

বকুল যদি লাল-লাল মুখে বলে, বাঃ, তাই বলে তুমি রোজ রোজ—

সে সপ্রতিভ গলায় বলে ওঠে, থাকি তা কি? তোর কি ধারণা তোকে দেখবার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকি?

আর কি বলতে পাবে বকুল?

আর কিভাবে প্ৰতিকার করতে চেষ্টা করবে?

ওর সঙ্গে কথা কইতে যাওয়াতেও যে ভয়! ওর চোখের তারায় যেন অজস্র কথার জোনাকি, ওর কথার ভঙ্গীতে যেন অসীম রহস্যলোকের ইশারা!

তবু ওর বেশি নয়।

যেন উদঘাটিত হতে রাজী নয়। কেউই।

যা বলবে কৌতুকের আবরণে।

কিন্তু বলবে অনেক ছলে, আর দেখা করবে অনেক কৌশলে।

তবু সে কৌশল ধরা পড়ে যাচ্ছে অপরের চোখে।

অন্তত বকুলের বাপের চিরসন্ধানী সন্দেহের চোখে। আর সে ওই নুড়ির মধ্যেই পর্বত দেখছে, চারাগাছের মধ্যেই মহীরুহ।

অতএব সর্বনাশের ভয়ে আতঙ্কিত হচ্ছে।

 

কিন্তু শাসন দিয়ে সর্বনাশকে ঠেকানো যায়? বালির বাঁধ দিয়ে সমুদ্রকে? তথাকথিত সেই সর্বনাশ তো এসে যাচ্ছে নিজের বেগে। বন্যার জল যেমন মাঠ-পথ গ্রাস করে ফেলে বাড়ির উঠানে এসে ঢোকে।

সব দিকেই উঁকি মারছে সে, যখন-তখনই সমাজে সংসারের গণ্ডিভাঙার ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে!

আর মজা এই, সেই ভাঙনে যেন কারুর লজ্জা নেই, বরং গর্ব আছে। পরিমলবাবুর ভগ্নী যে বাড়িতে ওস্তাদ রেখে কালোয়াতি গান শিখছে, সেটা যেন পরিমলবাবুর গর্বের বিষয়, সামনের বাড়ির যোগেনবাবুর নতুন জামাই যে বিলোতফেরত, সেটা যেন যোগেনবাবুর সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির সহায়ক, ভানুর কোন মামাতো শালার ভায়রাভাই যে বৌ নিয়ে বিলেত গেছে, সেটা যেন রাজ্যসুদ্ধ লোককে বলে বেড়াবার মত প্ৰসঙ্গ, আর বিরাজের দ্যাওরঝি যে শুধু একটা পাস করেই ক্ষান্ত হয় নি, একটার পর দুটো এবং দুটোর পর তিনটে পাস করে ফেলে গ্র্যাজুয়েট হয়ে বসলো, এটা রীতিমত একটা বুক ফুলিয়ে বলবার মতো খবর। এ খবর যেন বিরাজের সনাতন বনেদী শ্বশুরবাড়িকে একটি গৌরবময় উচ্চস্তরে তুলে দিয়েছে।

মেয়েদের ঘোমটা খুলেছিল ওদের কবেই! যবে থেকে জুড়িগাড়ি বাতিল করে মোটরগাড়ি কিনেছে, তবে থেকেই ওরা খোলা গাড়িতে মুখ খুলে বসে হাওয়া খেতে শুরু করেছে। তবু সেটা যেন অনেকটা শুধু পয়সা থাকার চিহ্ন। আর এটা হচ্ছে প্ৰগতিশীলতার চিহ্ন।

যদিও খবরটা বিরাজ নিন্দাচ্ছলেই শুনিয়ে গেল, কারণ জা-দ্যাওরের নিন্দে করে হাল্কা হবার জন্যেই মাঝে মাঝে মেজদার বাড়ি বেড়াতে আসে বিরাজ, অতএব সুরাটা নিন্দের মতই শোনালো, তবু তার মধ্যে যে প্রচ্ছন্ন রইল ওর প্রগতির গর্বটুকু, তা প্রচ্ছন্ন থাকলেও ধরা পড়তে দেরি হলো না।

কিন্তু প্ৰগতি যে ক্রমশই আপনি বাহু প্রসারিত করছে, বিস্তার করছে। আপন দেহ। নইলে কানুর শালী মাস্টারনী হয়ে বসে?

পাস অবশ্য করেছে সে মাত্র দুটো, কিন্তু তাতে মাস্টারনী হওয়াটা বাধাপ্রাপ্ত হয় নি। নিচু ক্লাসেও তো আছে ছেলে-মেয়ে, তাদেরই পড়াবে।

তা উঁচু  ক্লাস নিচু ক্লাসটা তো কথা নয়, কথাটা হচ্ছে—কানুর পিসতুতো শালী নিত্য দুবেলা পিরিলি করে শাড়ি পরে, বাঁধে ব্ৰোচ এঁটে, আর পায়ে জুতো-মোজা চড়িয়ে একা রাস্তায় যাওয়া-আসা করছে।

আর পিসশ্বশুর-বাড়ির এই প্রগতিতে কানু নিন্দায় পঞ্চমুখ না হয়ে গৌরবে মহিমান্বিত হচ্ছে। কথায় কথায় বিছুরিত হচ্ছে সেই গৌরব।

কিন্তু এসব কি সমাজে এই নতুন এল?

আসে নি। এর আগে?

তা একেবারে আসে নি বললে ভুল হবে।

এসেছে।

এসেছে আলোকপ্ৰাপ্তদের ঘরে; এসেছে ধনীর ঘরে।

কিন্তু সেটাই তো সমাজের মাপকাঠি নয়? মাপকাঠি হচ্ছে মধ্যবিত্ত সমাজ।

যারা সংস্কারের খুঁটিটা শেষ পর্যন্ত আটকে রাখে।

ভাঙনের ঢেউটা যখন তাদের ঘরে ঢুকে পড়ে সেই খুঁটি উপড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তখনই নিশ্চিত বলা চলে—এসেছে নতুন, এসেছে পরিবর্তন।

অতএব ধরতেই হবে যে এসেছে পরিবর্তন, এসেছে প্ৰগতি। আর প্রথমেই নাশ করছে ভয় আর 6७७।

নচেৎ ভানুও একদিন বড় মুখ আর বড় গলা করে তার এক বড়লোক বন্ধুর ভাইঝির জলপানি পাওয়ার গল্প করে?

এস্ট্রেন্স পাস করে জলপানি পেয়েছে বন্ধুর ভাইঝি, সেই উপলক্ষে ভোজ দিচ্ছে বন্ধু, সেই গৌরবের সংবাদটুকু পরিবেশন করে ভানু তার নিজের ছোট বোনকে একহাত নেয়।

স্বাভাবিক ব্যঙ্গের সুরে বলে, তাঁর বয়স কত জনিস? মাত্র পনেরো! আর তুমি ধাড়ি মেয়ে থার্ড ক্লাসে ঘাষাটাচ্ছে। লজ্জা করে না!

বকুল আনন্দোজল মুখেই দাদার বন্ধুর ভাইঝির গুণকীর্তন শুনছিল, হঠাৎ এই মন্তব্যে উজ্জ্বল চোখে জল এসে গেল তার। আর হঠাৎ আহত হওয়ার দরুনই বোধ হয় সামলাতে না পেরে বড় ভাইয়ের মুখের উপর বলে বসে, নিজেই তো বললে তোমার বন্ধু ভাইঝির জন্যে চল্লিশ টাকা খরচ করে তিন-তিনজন মাস্টার রেখেছিলেন–

তা ভানু অবশ্য বোনের এই উচিতাবাক্যে চৈতন্যলাভ করে না।

জগতে কেই বা করে?

উচিত বাক্যের মত অসহনীয় আর কি আছে?

ভানুও তাই অসহনীয় ক্রোধে বলে ওঠে, মাস্টার? তোমার জন্যে যদি চারশো টাকা খরচ করেও মাস্টার পোষা হয়, কিছু হবে না, বুঝলে? ওসব আলাদা ব্রেন। তোমার জন্যে মাস্টার রাখলে তুমি আর একটু ঔদ্ধত্য শিখবে, আর একটু অসভ্যতা। ইহঁ!

বকুল আর কিছু বলে না, বোধ করি অশ্রুজল গোপন করবার চেষ্টাতেই তৎপর হয়। বলে বকুলের মা, যে এতক্ষণ নিঃশব্দে একটা লেপের ওয়াড় সেলাই করছিল দালানের ওপ্রান্তে বসে।

হয়তো বেছে বেছে এইখানটাতেই এসে বন্ধুর ভাইঝির গৌরবগাথা শোনানোর উদ্দেশ্য ছিল ভানুর। মাকে ডেকে বলতে ইচ্ছে না করলেও মাকে শোনানোর ইচ্ছেটা প্রবল। মেয়েদের পড়া পড়া করে কত কাণ্ডই করেছেন, বলি, এইরকম মেয়ে তোমার? ঐ মেয়ে ক্লাসে একবারও ফাস্ট ভিন্ন সেকেণ্ড হয় নি, আর এখনও এই দেখ!

তা যতক্ষণ সেসব বলেছিল। ভানু বোনকে এবং বৌকে উপলক্ষ করে ততক্ষণ কিছুই বলে নি সুবৰ্ণলতা। মনে হচ্ছিল না শুনতে পাচ্ছে, হঠাৎ এখন কথা কয়ে উঠলো। বললো, ও-ঘরে গিয়ে গল্প করে গে তোমরা, আমার বড্ড মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে, কথা ভালো লাগছে না।

মাথার যন্ত্রণা?

যে মানুষ ছুঁচ-সুতো নিয়ে সেলাই করছে, তার কিনা কথার শব্দে মাথার যন্ত্রণা?

ভানু বোধ করি এই অসহ্য অপমানে পাথর হয়ে গিয়েই কোনো উত্তর দিতে পারে না, শুধু ওঃ; বলে গাঁটগট করে উঠে চলে যায়।

সঙ্গে সঙ্গে ভানুর বৌও।

শুধু বকুলই বসে থাকে ঘাড় হেঁট করে।

হয়তো অন্য কিছুই নয়, তাকে উপলক্ষ করে দাদার এই যে অপমানটা ঘটলো, তার প্রতিক্রিয়া কি হবে তাই ভাবতে থাকে দিশেহারা হয়ে।

সুবৰ্ণ হাতের কাজটা ঠেলে রেখে চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর হঠাৎ বলে ওঠে, সুনিৰ্মলকে একবার ডেকে দিতে পারবি?

সুনিৰ্মল!

তাকে ডেকে দেবার আদেশ বকুলকে?

এ আবার কোন রহস্য!

আর বর্তমান প্রসঙ্গে সঙ্গে সুনির্মলের সম্পর্ক কি? এ যে অবোধ্য!

শঙ্কিত দৃষ্টি মেলে মার দিকে তাকায় বকুল। সুবৰ্ণ সেইদিকে এক পলক তাকিয়ে বলে, একটা মাস্টারের জন্যে বলবো ওকে।

মাস্টার!

বকুলের জন্য মাস্টার!

ধারণী দ্বিধা হচ্ছে না কেন?

ছেলের সঙ্গে হার-জিতের খেলায় মা কি এবার বকুলকে হাতিয়ার করবেন? হে ঈশ্বর, দুৰ্মতি কেন হচ্ছে মার? অথচ দাদার থেকে মাও কিছু কম ভীতিকর নয়। তবু ভয় জয় করে বলে ফেলে বকুল, না না, ওসবে দরকার নেই মা-

দরকার আছে কি নেই সে কথা আমি বুঝবো। তুই ডেকে দিবি।

হাতের কাজটা আবার হাতে তুলে নেয়। সুবৰ্ণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *