১৮. কোথা দিয়ে ঘুমের মধ্যে দিয়ে

কোথা দিয়ে ঘুমের মধ্যে দিয়ে রাতটা কেটে গিয়েছিল মনে নেই ভূতনাথের। কিন্তু ঘুমের মধ্যেও যেন স্বপ্ন দেখেছে ব্রজরাখালকে। মনটা ছটফট করেছে ব্রজরাখালের কাছে যাবার জন্যে। ব্ৰজরাখাল এত বড় সংবাদকে কেমন করে সহ্য করবে কে জানে! বাঙলা দেশে এত বড় নীরব ভক্ত আর কে ছিল!

ভোরবেলা কিন্তু আর এক কাণ্ড ঘটলো। যুবক সঙ্ঘের সদর দরজার সামনে এসে গাড়ি দাঁড়ালো একটা। ঘোড়ার পা ঠোকার শব্দ। তারপরেই সুবিনয়বাবুর গলা–কই? এই বাড়িতে নাকি?

শিবনাথ বুঝি ছিল সামনে। বললে—ভূতনাথবাবু এখন ঘুমোচ্ছন একটু—তা আপনি ভেতরে আসুন।

সুবিনয়বাবু বললেন—অথচ ক’দিন থেকেই আমি ভাবছিলাম— কী হলো, কী হলো—ভূতনাথবাবু আসে না কেন, ব্ৰজরাখালবাবুকে জিজ্ঞেস করি—তিনিও বলতে পারেন না—শেষে আজ ভোরবেলা…

হঠাৎ ঘরের মধ্যে উদয় হলেন। সেই কালো চাপকানের ওপর কোণাকুণি পাকানো চাদরটা ফেলা। দাড়ি-গোঁফের প্রাচুর্যের মধ্যেও মুখের উদ্বিগ্নভাব ধরা পড়লো। ভূতনাথকে জেগে থাকতে দেখে সামনে এসে ঝুঁকে বললেন—কেমন আছো এখন ভূতনাথবাবু? তারপর একটু থেমে আবার বললেন—গোরাদের ওপর দোষ দিয়ে লাভ নেই, কিন্তু আঘাতটা যে মারাত্মক হয়নি এই রক্ষে। সর্ব জীবের যিনি নিয়ন্তা, যিনি ভূলোক দ্যুলোকের অধিপতি সেই পরম…

শিবনাথ বললে—আমরা যথাসাধ্য সমস্ত রকমের যত্ন নিয়েছি। চিকিৎসার কোনো ত্রুটি হয়নি।

সুবিনয়বাবু বললেন—কিন্তু জবা মা যে বড় উদ্বিগ্ন হয়ে আছে, আমাকে বলে দিয়েছে ও-জায়গায় ভূতনাথকে রেখে আসা ঠিক হবে না—হয় তো ঠিকমতো সেবা হচ্ছে না। জবা যে আমার বড় একগুয়ে মেয়ে শিবনাথবাবু। নিজেই আসতে চাইছিল, আমি তাকে বারণ করলাম—বললাম আমি তাকে নিয়েই আসবো। আমি যে জবা মাকে কথা দিয়ে এসেছি একেবারে।

শিবনাথ বললে—ব্রজরাখালবাবুর বড়কুটুম—তাকে জিজ্ঞেস না করে–

সুবিনয়বাবু বললেন—তিনি যদি আপত্তি করেন, তাই বলছেন শিবনাথবাবু?

শিবনাথ বললে—তাকে না জিজ্ঞেস করে নিয়ে যাওয়া কি ভালো হবে?

সুবিনয়বাবু বললেন—তা-ও তো ঠিক হবে না জানি, কিন্তু জবা মাকে আমি গিয়ে কি জবাব দেবো? বড় একগুয়ে মেয়ে কি না! কিন্তু ব্ৰজরাখালবাবুকে এখন একবার খবর দিলে হয় না?

—তিনি তো এখন বেলুড়ে—স্বামিজীর ব্যাপারে…তার দেখা পাওয়া শক্ত।

-তা হলে কি হবে শিবনাথবাবু?

এতক্ষণে ভূতনাথ যেন কথা বলবার ক্ষমতা ফিরে পেল। বললে–আমি আপনার সঙ্গেই যাবে সুবিনয়বাবু।

সুবিনয়বাবু যেন অকূলে কূল পেলেন। বললেন—আমাকে বাঁচালে ভূতনাথবাবু, জবা ভোরবেলা খবরটা পাওয়া অবধি বড় কাতর হয়ে আছে কি না—ক’দিন থেকেই আমরা ভাবছিলুম, ভূতনাথবাবু সেদিন বাড়ি গেল, আর দেখা-সাক্ষাৎ নেই। খবর পাঠালুম ব্রজরাখালবাবুকে, তিনিও নেই, খবর পেলাম তিনিও নাকি বাইরে গিয়েছেন।

শিবনাথবাবু ধরাধরি করে ভূতনাথকে উঠিয়ে দিয়েছিল সুবিনয়বাবুর গাড়িতে। সারা রাস্তা সুবিনয়বাবু কথা বলেছেন। শিবনাথও সঙ্গে ছিল। মোহিনী-সিঁদুর’ আপিসে এসে পাঠকজী আর শিবনাথ নামিয়ে দিলে গাড়ি থেকে!

যে-ঘরে শোয়ানো হলো সে-ঘরটা জবার মা’র ঘর। একেবারে অন্দরমহলে এনে ওঠানো হলো। জবা তৈরিই ছিল। বললে বাবা আপনি এখন একটু বিশ্রাম করুন, ভূতনাথবাবুকে আমি দেখছি। তারপর আবার মাকে ডেকে বললে—বৈজুকে বল ডাক্তারবাবুকে একবার যেন খবর দেয় আর একটা গামলায় খানিকটা গরম জল করে নিয়ে আয় তো তুই।

অনেকখানি পরিশ্রমের পর ভূতনাথ বোধ হয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। কখন দিন গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়েছে টের পায়নি। যখন আবার তন্দ্রা ভাঙলো মনে হলো কোথায় এসেছে সে। স্মরণ করতে একটু সময় লাগলো। তারপর ভালো করে নজর পড়তেই দেখলে পাশে বিছানার ওপর জবা বসে আছে। মাথায় জল-পটি দিচ্ছে। হঠাৎ এ মূর্তি দেখলে যেন চিনতে পারার কথা নয়। ভূতনাথের একেবারে কাছাকাছি বসে। এতখানি সান্নিধ্যের অবকাশ অবশ্য আগে কখনও মেলেনি। জবার শরীরের গন্ধ যেন নাকে এসে লাগছে। হাতের স্পর্শে যেন রোমাঞ্চ হয়। ভূতনাথের শরীরের উত্তাপ যেন আরো বেড়ে গেল।

সুবিনয়বাবু একবার ঘরে ঢুকলেন। কিন্তু কিছু প্রশ্ন করার আগেই জবা বললে—বাবা, আপনি আবার কেন এলেন? ডাক্তারবাবু তো বলে গেলেন কোনো ভয় নেই-জ্বরটাও একটু কম। আপনি যান বসুন গিয়ে, আমি যাচ্ছি।

সুবিনয়বাবু বললেন—মাথার ঘা’টা কেমন আছে মা।

জবা জলপটি দিতে দিতে বললে—ডাক্তারবাবু বললেন আরো কিছুদিন সময় নেবে। শুকোবার মুখ এখন, চুপচাপ কেবল শুইয়ে রাখতে বলেছেন, ঘা’টা ভালোর দিকে গেলেই জ্বরটাও কমে আসবে।

—দেখো মা, ছেলেদের ইচ্ছে ছিল না ভূতনাথবাবুকে এখানে পাঠায়, তোমার জন্যেই নিয়ে এলাম এখানে, যেন বিপদ না হয় দেখো-বলে সুবিনয়বাবু চলে গেলেন।

জবা ঘরের আলোটা নিবিয়ে দিয়ে এসে আবার বসলো পাশে। ভূতনাথের জ্বরের ঘোরেও মনে হলো জব যেন তার বড় কাছাকাছি ঘেঁষে বসেছে। জবার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে যেন। এ এক নতুন অনুভূতি। এমন করে এত কাছাকাছি যেন কেউ আগে এসে বসেনি। অস্পষ্ট কুয়াশার মতো ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ে শুধু পিসীমা’র কথা। অসুখ হলে এমনি করে পিসীমা কাছে এসে বসতো। বড় ভালো লাগতো তখন। কত বায়না করতে ভূতনাথ। অসুখ থেকে সেরে ওঠবার পর পিসীমা ভাত খেতে পারতো না। বিধবা মানুষ। দুপুর বেলা শুধু একবার পাথরের থালাটা নিয়ে বসতে খেতে। কিন্তু টের পেয়েই ভূতনাথ আস্তে আস্তে পাশে গিয়ে বসতো।

পিসীমা বলতো–ও মা, তুই ঘুমোচ্ছিস দেখে দুটো ভাত নিয়ে বসলাম।

ভূতনাথ নিবিষ্টচিত্তে দেখতো পিসীম কেমন করে ডাল দিয়ে ভাত মাখছে। কেমন করে মুখে তুলছে। ভাতের লোভে সমস্ত শরীরটা যেন লালায়িত হয়ে উঠতে তার।

—পিসীমা, কুলের অম্বল করোনি আজ?

-না বাছা, কুলের অম্বলে আর কাজ নেই, বাড়ির ছেলের অসুখ আর আমি কুলের অম্বল দিয়ে কি না ভাত খাবো, তোর অসুখ ভালো হলে তখন আবার কুলের অম্বল করবো।

–কবে ভাত খাবো পিসীমা?

পিসীমা’র গলা দিয়ে যেন ভাত নামতো না। সান্ত্বনা দিয়ে বলত—অসুখ থেকে উঠে কি কি খাবি বল দিকিনি শুনি?

কত তালিকা তৈরি করতে ভূতনাথ। শুয়ে শুয়ে লিখতে কাগজের ওপর অসুখ সারলে কী কী খাবে সে। কুলের আচার। বড়ি ভাজা। সজনে ডাটা চচ্চড়ি। কত সাধারণ জিনিষ সব। কিন্তু অসুখের সময় ভাবতে কি ভালোই যে লাগতো! কিন্তু সেরে ওঠবার পর আবার যে-কে-সেই।

পিসীমা বলতো-ও কি রে, আর দুটি ভাত নে।

–পেট ভরে গিয়েছে পিসীমা।

—তবে যে বললি আজকে অনেক ভাত খাবি! এই তোর খাওয়া, তুই-ই যদি না খাবি তো কার জন্যে এত সব রান্না।

অসুখের সময় যে-মানুষ খাবার জন্যে অত ব্যস্ত, অসুখের পর সেই মানুষকেই খাওয়াবার জন্যে কী পেড়াপীড়ি! বোধ হয় এমনিই হয় সকলের। এ-বাড়িতে এসেও সেই সব কথা মনে পড়ে ভূতনাথের। দিনের বেলা যখন ভূতনাথ জেগে থাকে, কেউ থাকে না ঘরে—চারিদিকে চেয়ে দেখে। ঘরের বাইরেই বসবার হল-ঘর। জবা তার সুবিনয়বাবুর গলা শোনা যায়।

জবা মাঝে মাঝে বই পড়ে শোনায় বাবাকে। আধো জাগা আধো তন্দ্রার মধ্যে রামায়ণ-মহাভারতের সুর ভেসে আসে। মনে পড়ে যায় নিবারণের কথা। ছেলেটা যেন স্বপ্ন দেখছে কোন্ দূর স্বর্গের। ভারতবর্ষকে স্বাধীন করবার স্বপ্ন। মনে পড়ে যায় সেই গানটা—“মা গো যায় যেন জীবন চলে, বন্দে মাতরম্ বলে। কবে আসবে সেই তিনজন বাঙালী। যতীন বাড়জ্জে, বারীন ঘোষ আর অরবিন্দ ঘোষ। মনে পড়ে যায় প্লেগ কমিশনার র্যাণ্ড সাহেবের হত্যার কাহিনী। এমন চমৎকার করে বলতে পারে নিবারণ। পুণার বড়লাটের বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে র্যা সাহেব। চোখের সামনে যেন ভেসে ওঠে সে-দৃশ্য। আর মনে পড়ে ১৮৯৯ সালের একটা দিন। নিঃশব্দে নাকি একদিন প্রত্যুষে ফঁসি হয়ে যায় চাপেকার ভাইদের। সেই রক্তের বীজ বাঙলা দেশে এসে বুনেছে ওরা। ওই ‘আত্মোন্নতি সমিতি’, ‘অনুশীলন সমিতি’ আর ‘যুবক সঙ্ঘের’ ছেলেরা। একা-একা শুয়ে শুয়ে আরো এলোপাতাড়ি কত কি কথা মনে পড়ে।

বড়বাড়ির কথাও মনে পড়ে। ব্ৰজরাখাল আর তাকে দেখতে আসেনি। কত কাজ ব্রজরাখালের। কখন সে আসবে। কোথায় ফুলবালা দাসীর ভেদবমি, কার অসুখের ওষুধ, আলমবাজারের মঠ, দক্ষিণেশ্বরের আশ্রম, নিজের যোগসাধনা। তারপর আছে চাকরি। তবু যে কেন চাকরি করে ব্রজরাখাল! কাদের জন্যে! বড়বাড়ির ছেলেদের রাত্রে পড়ানো তো সব দিন হয় না। প্লেগের যেবার হিড়িক হলো—কি কাণ্ডটাই না করলো সে ক’দিন। কলকাতার বস্তিতে বস্তিতে ঘুরে সেই অমানুষিক সেবা আর অমিত পরিশ্রম। এখনও মনে আছে ভূতনাথের। লম্বা লম্বা ছুচের মতো যন্ত্র নিয়ে ইনজেকশন দিতে আসতো। বড়বাড়ির চাকর-ঝি কেউ বাদ গেল না। কি ব্যথা হয়েছিল হাতে ক’দিন ধরে। রাস্তায় রাস্তায় যাকে দেখতে পায় তাকেই দেয় ছুঁচ ফুটিয়ে। হাত ফুলে ঢোল হয়ে ওঠে। দলে দলে প্লেগের ভয়ে পালাতে শুরু করলো লোক। শেয়ালদা’ স্টেশনে নাকি ভিড়ের জন্যে টিকিট কাটাই দায়। সারাদিন পরিশ্রমের পর ব্রজরাখাল যখন রাত্রে ফিরতে কি চেহারা তার!

ভূতনাথ একদিন জিজ্ঞেস করেছিল—আপিস যাচ্ছে না ব্রজরাখাল, তোমার চাকরি থাকবে তো?

ব্ৰজরাখাল বলেছিল—চাকরি বড় না মানুষের প্রাণ বড়। তারপরে একটু থেমে বলেছিল—আর পারছিনে বড়কুটুম—এ সাহেব আসে স্যালিউট দাও, ও সাহেব আসে স্যালিউট দাও একটু স্যালিউট দিতে ভুল হয়েছে কি চাকরি নট—কিন্তু আমিও ঠিক করেছি এক ঠাকুর ছাড়া কারুর কাছে মাথা নোয়বো না বড়কুটুম—বলে ঠাকুরের ছবিটার দিকে চেয়ে চোখ বুজে অনেকক্ষণ ধরে প্রণাম করেছিল।

ভূতনাথ বলেছিল কিন্তু তবে কেন তোমার ছাই চাকরি করা?

ব্ৰজরাখাল নিজের মনেই বলেছিল—সাধ করে কি আর চাকরি করি বড়কুটুম!

ভূতনাথও জানতে সে-কথা। ক’দিন ব্ৰজরাখাল বাড়িতে না এলেই লোকের পর লোক এসে হাজির। এ এসে জিজ্ঞেস করে—ব্রজরাখালবাবু আছেন? ও এসে জিজ্ঞেস করে—ব্রজরাখালবাবু আছেন? মাসের প্রথম দিকটা অনেকগুলো লোক হাঁ করে বসে থাকে ব্ৰজরাখালের পথ চেয়ে।

বড়বাড়ির কথা মনে পড়লেই মনে পড়ে যায় ছোটবৌঠানের কথা। সেই তেতলার ঘরখানার কথা। উঁচু পালঙ্ক। কড়িকাঠ থেকে একটা রঙিন মশারি ঝুলছে। দিনের বেলায় চূড়ো করে বাঁধা। এতখানি পুরু গদির ওপর শাখের মতো সাদা চাদর পাতা। সারা দেয়ালে পটের ছবি। শ্রীকৃষ্ণের পায়স-ভক্ষণ। গিরিগোবর্ধনধারী যশোদাদুলাল। দময়ন্তীর সামনে হংসরূপী নলের আবির্ভাব। ঠোটে একটা ভাঁজ করা চিঠি। মদন ভস্ম। শিবের কপাল ফুড়ে ঝাটার মতন আগুনের জ্যোতি বেরিয়ে আসছে। পাশের কাচের আলমারিতে পুতুল। বিলিতি মেম—ঘাগরা পরা। গোরাপল্টন-মাথায় টুপি।

চোখ বুজলেই সব নিখুত মনে পড়ে যায়। আর মনে পড়ে যায় ছোটবৌঠানের আলতা-পরা পা-জোড়া। টোপাকুলের মতো টলটলে আঙুলগুলো। মোহিনী-সিঁদুরে’ কিছু কাজ হয়েছে কি না কে জানে। অনেকদিন তো হয়ে গেল। ছোটকর্তা কি আজো সেইরকম নিয়ম করে বিকেলবেলা ল্যাণ্ডোলেট চড়ে বনমালী সরকার লেন পেরিয়ে চলে যায়। কড়ির মতো সাদা ঘোড়া দুটো টগবগ করতে করতে কি তেমনি বড়বাড়ির গেট পেরিয়ে ছুটতে শুরু করে।

সুবিনয়বাবু সেদিন এলেন ঘরে। বললেন—এখন কেমন আছো ভূতনাথবাবু?

ভূতনাথ বললে—একটু ভালো বোধ করছি—আর কিছুদিন বাদেই কাজ আরম্ভ করতে পারবো ভাবছি।

–কীসের কাজ?

-আপিসের কাজ-ভূতনাথ বললে।

—কোন্ আপিসের কাজ?

ভূতনাথ হঠাৎ এ-প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারলে না। তারপর বললে—আপনি একলা সব পেরে উঠেছেন না।

–ও-ও-ও-সুবিনয়বাবু যেন এতক্ষণে বুঝতে পারলেন। বললেন—না ভূতনাথবাবু, ভাবছি, ও আমি তুলে দেবো-ও বুজরুকি আর করবো না, বিবেকে বাধছে, অর্ধ শিক্ষিত অশিক্ষিতের দেশ, এখনও ‘মোহিনী-সিঁদুরে’র কাটতি আছে এবং কাটতি আরো বাড়ছে, বোধকরি যতদিন চালাবে ততদিন চলবে, আমার অর্থ সম্পত্তি সব দিয়েছে ওই ‘মোহিনী-সিঁদুর’—উপনিষদে আছে…

বাধা পড়লো। জবা ঢুকলো ঘরে। বললে—বাবা, আপনি বিশ্রাম করুন গে যান, আমি ভূতনাথবাবুকে দেখছি।

সুবিনয়বাবু চলে গেলেন নিঃশব্দে। কিন্তু কথাটা শুনে ভূতনাথের কেমন ভয় হলো। মোহিনী-সিঁদুরের ব্যবসা যদি তুলে দেন তা হলে সে করবে কি?

জবা এসে বিছানার পাশেই বসলো। তারপর ভূতনাথের চোখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলে—কিছু বলবেন আমাকে?

ভূতনাথ প্রথমে কেমনভাবে কথাটা পাড়বে বুঝতে পারলে না। শেষে বললে–বাবা যা বলছিলেন সত্যি?

—বাবা কী বলছিলেন?

—ওই যে বলছিলেন মোহিনী-সি দুরে’র কারবার তুলে দেবেন?

জবা বললে—বাবার কথায় কান দেবেন না, বাবার এখন মাথার ঠিক নেই, এখন ওঁর কেবল মনে হচ্ছে এ লোক-ঠকানো ব্যবসা, কিন্তু লোকে যদি ইচ্ছে করে ঠকে তো আমরা কী করতে পারি। এ হচ্ছে কর্তাভজার দেশ, মন্ত্র-তন্ত্রের দেশ, অবতারবাদের পীঠস্থান, এর মতন ফলাও ব্যবসা আর আছে নাকি? এর পেছনে আরো মূলধন ঢালতে পারলে এ আরো চলবে।

ভূতনাথ খানিকটা আশ্বস্ত হলেও যেন নিঃসন্দেহ হতে পারলে। বললে—কিন্তু উনি যে বললেন, এ সব বুজরুকি।

জবা বললে—আজকাল ওই রকম ওঁর মনে হচ্ছে—বাবার এখন মাথার ঠিক নেই।

হঠাৎ আর একটা কথা মনে পড়লো ভূতনাথের। তবে তো ছোটবৌঠানকে সে ঠকিয়েছে। কোনো কাজই হয় নি সে-সিঁদুরে। মিছিমিছি ছোটবৌঠান সেই সিঁদুর নিয়ে আজও ছোটকর্তার পথ চেয়ে প্রতীক্ষা করে থাকে হয় তো। এখনও হয় তত পরীক্ষা-নীরিক্ষার শেষ নেই। এখনও হয় তত তেমনি রাতের পর রাত ছোটকর্তার জন্যে জেগে জেগে কাটে। তারপর ভোরের দিকে যখন ছোটকর্তা আসে, যখন বংশী কাপড় বদলিয়ে দোতলার ঘরে শুইয়ে দেয়, নেশায় অচৈতন্য হয়ে বাড়িতে ফেরে, তখন খবর যায় ছোটবৌঠানের ঘরে। ছোটবৌঠানের যশোদাদুলাল তেমনি জলচৌকির ওপর নিশ্চল নিথর দৃষ্টিতে পাথরের চোখ দিয়ে সব দেখে। সমস্ত বংশের পাপের জন্যে এক ছোটবৌঠানই হয় তো প্রায়শ্চিত্ত করে। তবে বুঝি পটেশ্বরী বৌঠানের বাবার গুরুদেবের কথাই সত্যি। পূর্বজন্মে পটেশ্বরী ছিল বুঝি দেবোলা। দেবসভায় ব্রাহ্মণের অপমান করায় এ-জন্মটা এমনি প্রায়শ্চিত্ত করেই কাটিয়ে দিতে হবে।

পটেশ্বরী বৌঠানের কথা মনে পড়তেই ভূতনাথের যেন কেমন অশ্বস্তি হতে লাগলো। মনে হলো—-অনেকদিন যেন দেখেনি ছোটবৌঠানকে। আর যদি কখনও দেখা না হয়! এখনি ছুটে যেতে পারলে যেন ভালো হতো! অন্ততঃ বড়বাড়িতে যেতে পারলেও শান্তি পাওয়া যেতো। কিছুটা তত কাছাকাছি। দেখতে না-পাওয়া যাক। একটু সান্নিধ্য। একই বাড়ির ঘেরাও-এর মধ্যে। এক ছাদের তলায়। একই আবহাওয়ার মধ্যে। অন্ততঃ বংশীর কাছে থাকতে পারলেও যেন ভালো হতো। বংশী মুখে ছোটবৌঠানের কথা শুনতে। এ-যেন এক অপূর্ব আকর্ষণ! মাত্র দু’দিনের দেখা। তা-ও অত অল্প সময়ের জন্যে। কিন্তু মনে হলো বৌঠানের কাছে

গেলে সে যেন বাঁচবে না। সে শুধু একবার গিয়ে বলবে—ছোটবৌঠান—সব মিথ্যে—সব মিথ্যে কথা। মোহিনী-সিঁদুরে’ কিছু কাজ হয় না।

ভূতনাথ হঠাৎ বললে—আগে তবে বললানি কেন যে মোহিনীসিঁদুরে’ কিছু হয় না। সব তোমাদের বুজরুকি। কেন তবে বললানি আমাকে?

জবা ভূতনাথের এই কথায় কেমন যেন অবাক হয়ে গেল। কিন্তু সান্ত্বনার সুরে বললে—বাবার কথা বিশ্বাস করে মিছিমিছি কেন মন খারাপ করছেন। বাবার কি এখন মাথার ঠিক আছে, মা মারা যাবার পর থেকেই বাবা কেবল ওই কথা বলছেন?

ভূতনাথ যেন বুঝতে পারলে না। বললে–মা? তোমার মা?

–আপনি শোনেন নি? মা তো মারা গিয়েছেন!

–সে কি? কবে? কী হয়েছিল? জবা বললে—এখনও পনেরো দিনও হয়নি হঠাৎ হার্টফেল করলেন, রাত্রে যেমন শুয়ে থাকেন বিছানায় তেমনি শুয়ে ছিলেন, ঠিক এই ঘরেই…সকাল বেলা জানতে পারলুম—রাত্রে কেউ টেরও পাইনি। কাউকে এতটুকু কষ্ট দিয়ে যাননি। বলতে বলতে জবার চোখ দিয়ে যেন জল পড়বার উপক্রম হলো।

ভূতনাথ বললে-কই! আমি তো কিছুই জানতুম না, বাবাও কিছু বলেন নি—অন্তত ব্যবহারেও কিছু জানতে দেন নি।

জবা বললে–বাবাকে আপনি চিনলেন না, যে দিন মা মারা গেলেন সেদিনও বাবা সমাজে গিয়ে রোজকার মতো প্রার্থনা করে এসেছেন, সকলের সঙ্গে কথা বলেছেন, কেউ বুঝতে পারেনি আমাদের এত বড় দুর্ঘটনার কথা, রাত্রে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে শুনতে পেয়েছি বাবা যেন কেবল জপ করছেন—“ত্বমেকং জগৎকারণং বিশ্বরূপং’—“ত্বমেকং জগৎকারণং বিশ্বরূপং’-পরের দিন আমাকে সেই বাবার প্রিয় ব্ৰহ্ম সঙ্গীতটি গাইতে বলেছেন

-নাথ, তুমি ব্ৰহ্ম, তুমি বিষ্ণু, তুমি ঈশ, তুমি মহেশ
তুমি আদি, তুমি অন্ত, তুমি অনাদি, তুমি অশেষ—

আমি আপন মনেই গেয়ে চলেছি আর বাবা হাতে চৌতালে তাল দিয়ে চলেছেন। শেষে আমার সঙ্গেই গলা মিলিয়ে গাইতে লাগলেন। আমি গান থামালুম, বাবা তখনও গাইছেন—

জল স্থল মরুত ব্যোম পশু মনুষ্য দেবলোক
তুমি সবার সৃজনকার হৃদাধর ত্রিভুবনেশ…

বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না বাবাকে দেখে, বেশ স্বাভাবিক মানুষ কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমূল বদলে গিয়েছেন। কেবল বলেন, লোক-ঠকানোর পাপেই আমার এই ঘটলো—এ ব্যবসা আমি তুলে দেবো মা।

কথা বলতে বলতে জবা যেন আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে এল ভূতনাথের। ভূতনাথ আস্তে আস্ত জবার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে ধরলো। জবা কোনো আপত্তি করলে না। তারপর কি জানি কোন্ অজ্ঞাত আকর্ষণে ভূতনাথ জবার হাতটা নিয়ে নিজের ঠোটে স্পর্শ করলে। তবু যেন জবার কোনো সম্বিত নেই। জবা যেন নিষ্প্রাণ প্রস্তর-প্রতিমা। ভূতনাথ অনেকক্ষণ তেমনি করে জবার স্পর্শের সান্নিধ্য আস্বাদ করতে লাগলো।

জবা হাত না সরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলে—’মোহিনী-সিঁদুর’ উঠে গেলে আপনার ভয় কেন? চাকরি যাবে বলে?

ভূতনাথ দুই হাতে জবার হাতটা তখনও তেমনি করে ধরে আছে। মুখ আর বুকের মাঝামাঝি জায়গায় হাতটা লাগিয়ে রেখে বললে—ঠিক তা নয়–আগে জানতে পারলে ছোটবৌঠানকে অন্তত আমি বিশ্বাস করে ‘মোহিনী-সিঁদুর’ দিতাম না।

—ছোটবৌঠান আবার আপনার কে? কী হয়েছিল তার?

একদিন প্রতিজ্ঞা করেছিল ভূতনাথ পটেশ্বরী বৌঠানের কাছে যে, এ-কথা কাউকে বলবে না। এমন কি জবাকেও না। কিন্তু এই মুহূর্তে সে-প্রতিজ্ঞা ভুলে গেল ভূতনাথ। বললে—তার কথা তত তোমায় বলেছি, বড়বাড়ির ছোটবউ। ছোটকর্তা রাত্রে বাড়ি আসেন না—তাকে বশ করবার জন্যে ‘মোহিনী-সিঁদুর’ কিনে দিয়েছিলাম।

জবা যেন কি ভাবলো। তারপর বললে—আপনার ছোটবৌঠানের বয়েস কত?

–তোমার চেয়ে বড়, আমার চেয়ে কিছু ছোট।

জবা হেসে বললে—ছোটবৌঠানের জন্যে আপনার এতখানি দরদ তো ভালো নয়?

ভূতনাথ কিন্তু হাসতে পারলে না। বললে—পটেশ্বরী বৌঠানকে দেখলে তুমি এ-কথা বলতে পারতে না জবা।

জবা তেমনি হেসে বললে—আমি না দেখলেও কল্পনা করে নিতে পারি।

ভূতনাথ বললে—আর সবাইকে কল্পনা করা যায় কিন্তু ছোটবৌঠান কল্পনার বাইরে। তাকে না দেখলে কল্পনা করা শক্ত, দেখবার আগে আমারও সেই ধারণাই ছিল।

জবা বললে—তা হলে দেখছি জল অনেকদূর গড়িয়েছে। তারপর একটু থেমে বললে—‘মোহিনী-সিঁদুর’ কখনও বিফল হয় না জানতুম।

ভূতনাথ বললে—তার মানে?

-তার মানে, বড়লোকের বাড়ির স্বামী পরিত্যক্তা রূপসী বউ, আপনার…হঠাৎ জবা হাত টেনে নিলে। রতন ঘরে ঢুকেছে।

রতন বললে—দিদিমণি খোকাবাবু এসেছেন।

জবা বিছানা ছেড়ে উঠে বললে-বসতে বল হ-ঘরে, আর চা করে আন—আমি আসছি। বলে এক নিমেষে জবা পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। ভূতনাথ যেন হতবাকের মতো অসহায় অপ্রস্তুত হয়ে শুয়ে পড়ে রইল। কিছু যেন করবার নেই। নিরূপায় সে। কে এ খোকাবাবু! কিন্তু সে যে-ই হোক এই মুহূর্তেই কি তাকে আসতে হয়! যেন অনেক কথা বলবার ছিল জবাকে, সবে মাত্র সূচনা হয়েছিল, কিন্তু বলা হলো না।

ও-পাশের হ-ঘর থেকে ওদের গলার শব্দ কানে আসছে। জবা কথায় কথায় হাসছে। জবা এত হাসতে পারে। এত হাসির কথা হচ্ছে কার সঙ্গে। একবার মনে হলো চুপি চুপি বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে দেখে আসে। আজ সবে ভাত খেয়েছে সে এতদিন পরে! এটুকু পরিশ্রমে কিছু ক্ষতি হবে না তার। কিন্তু লজ্জাও হলো। যদি ধরা পড়ে যায়। হঠাৎ মনে হলো যেন চেনা চেনা গলার আওয়াজ। যেন ননীলালের গলা! ঠিক সেইরকম কথার ভঙ্গী! ভারী কৌতূহল হলো দেখবার!

উঠতেই যাচ্ছিলো ভূতনাথ। আস্তে আস্তে নিঃশব্দে উঁকি দিয়ে দেখে আসতে যাচ্ছিলো। কিন্তু হঠাৎ রতন আবার ঘরে ঢুকলো। কী একটা জিনিষ নিয়ে চলে যাবে। ভূতনাথ ডাকলো।

রতন ঘাড় ফেরালো-আমায় ডাকছেন নাকি কেরানীবাবু?

—হাঁ, শোনো এদিকে, কাছে এসো।

রতন কাছে সরে এল।

ভূতনাথ গলা নিচু করে জিজ্ঞেস করলেও-ঘরে কে এসেছে।

রতন বললেও খোকাবাবু।

—খোকাবাবু? খোকাবাবু কে? এ-বাড়ির কে হয়?

–এ-বাড়ির জামাইবাবু হবে, দিদিমণির সঙ্গে বিয়ে হবে!

–ওর আসল নামটা কী?

—তা জানিনে আমি—বলে রতন চলে গেল।

 

সেদিন রাত্রে শোবার আগে জবা একবার ঘরে এল। বললে। —ওষুধটা খাননি কেন?

ভূতনাথ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রইল। কোনো জবাব দিলে। জবা ওষুধের শিশিটা নিয়ে কাছে এল। বললে-জ্বর ছেড়ে গিয়েছে বলে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করবেন নাকি? নিন হাঁ করুন—

ভূতনাথের কী মনে হলো কে জানে। নিঃশব্দে ওষুধটা খেয়ে নিলো। কোনো ওজর-আপত্তি করলে না। কিন্তু হঠাৎ এক কাণ্ড করে বসলো।

জবা ওষুধ খাইয়ে চলেই যাচ্ছিলো। হঠাৎ ভূতনাথ শাড়ির আঁচল চেপে ধরতেই কাঁধ থেকে কাপড়টা খসে পড়লে জবার।

একটি মুহূর্ত মাত্র। কিন্তু এক মুহূর্তে দুজনই অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। এক নিমেষের মধ্যে যেন একটা খণ্ড প্রলয় ঘটে গেল।

জবার মুখটা কঠিন হয়ে উঠেছে। ঘৃণায় মুখ বিকৃত করে বললে—অভদ্র নীচ কোথাকার—বলে আর দ্বিরুক্তি না করে ঘর থেকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল।

 

পরদিন খুব ভোরেই ঘুম ভাঙলো। কিম্বা হয় তো সারা রাত ঘুমই হয়নি ভূতনাথের। নিজের মনের মধ্যে সারারাত কেবল একটা দুশ্চিন্তাই জেগেছে যে, এ-বাড়িতে সে জবার কাছে মুখ দেখাবে কেমন করে। জবা তো শুধু নারী নয়, সে যে একাধারে তার মনিব। মাসে মাসে সাত টাকা মাইনে আর এক বেলা খাওয়ার পরিবর্তে সে এখানে দাসত্ব করে। মানুষের পক্ষে যা অপরাধই মাত্র, তার পক্ষে যে তা ঘোরতর অপরাধের সামিল।

যথারীতি সুবিনয়বাবু রোজ ভোরবেলা একবার ঘরে এসে কুশল প্রশ্ন করেন। সেদিনও এলেন। তখনও ভালো করে সকাল হয়নি। কিন্তু এসে বললেন—ভূতনাথবাবু তোমার একটা চিঠি আছে।

চিঠি! চিঠি ভূতনাথের বড় একটা আসে না কখনও। চিঠি তাকে কে লিখতে গেল। বিশেষ করে এই ঠিকানায়। সুবিনয়বাবু বললেন—একটি লোক চিঠি নিয়ে এসেছে—নিচে দাঁড়িয়ে আছে।

চিঠিটা খুলে পড়তেই ভূতনাথের সমস্ত শরীরে রোমাঞ্চ হলো। ছোটবৌঠানের চিঠি!

সুবিনয়বাবু বললেন—তা হলে রতনকে বলছি ওকে ডেকে দিক এ-ঘরে-বলে সুবিনয়বাবু চলে গেলেন।

ভূতনাথের সমস্ত শরীর কাঁপছিল। চিঠিটা আবার পড়লো সে।

“প্রাণাধিক ভূতনাথ,

পরে বংশীর নিকট এইমাত্র তোমার সংবাদ পাইলাম। কেমন আছো এখন। বড় উদ্বেগ বোধ করিতেছি। বংশীকে তোমার নিকট পাঠাঁইলাম। যদি সম্ভব হয় এখানে চলিয়া আসিবে। পাল্কি পাঠাঁইলাম। আশীর্বাদ জানিবে।

তোমার ছোটবৌঠান”

বার বার চিঠিটা পড়ে যেন তৃপ্তি হলো না ভূতনাথের। এমন করে পটেশ্বরী বৌঠান যে তাকে চিঠি লিখবে এ যেন কল্পনাও করা যায় না। ভূতনাথের জীবনে এই সামান্য কাগজের একটা টুকরো যেন এই মুহূর্তে এক অমূল্য সম্পদ বলে মনে হলো। ক্ষমতা থাকলে এখনি উঠে বসতো ভূতনাথ। তারপর বিশ্বশুদ্ধ লোককে এই চিঠিখানা দেখাতো।

বংশী এল। ভূতনাথকে দেখবার জন্যে তারও যেন আগ্রহের শেষ নেই। এসেই বললে—শালাবাবু, এ কী চেহারা হয়েছে আপনার আজ্ঞে।

ভূতনাথ যেন এতদিনে একজন নিতান্ত আপনার লোক পেয়ে গিয়েছে। শুধু বললে—বংশী তুই…।

বংশী বললে—ক’দিন থেকেই খবর করছি—শালাবাবু কোথায় গেল—ছোটমা’ও অস্থির-থানায় তোক পাঠান, বড়বাড়ির চাকরবাকর সবাইকে শুধোই, ভৈরববাবু দশ জায়গায় ঘোরেন, তাকেও শুধোলাম, তিনি বললেন—কেল্লার গোরারা বোধহয় জখম-টখম করে দিয়েছে দেখ—মধুসূদনকে শুধোলাম— সে বললে—আপদ গিয়েছে তো বাঁচাই গিয়েছে, তার গায়ের জ্বালা আছে কিনা আপনার ওপর।

ভূতনাথ বললে—কেন, তার গায়ের জ্বালা কেন রে আমার ওপর।

–ওই যে আপনি হলেন গিয়ে আমাদের তরফের লোক, ওর সুবিধে হচ্ছে না, আপনি আসার পর থেকে তেমন বাব আদায় হচ্ছে না, আর ঝি-চাকরে ঝগড়া হলে তো ওরই লাভ, বা এনে নতুন লোক বসিয়ে দেবে, বা নেবে, তারপর চাকরি করে দিলে এক টাকা করে মাইনে থেকে কেটে নেবে—সেটা পুরোপুরি হচ্ছে না।

ভূতনাথ বললে—আমি তো আর ওর পাওনায় ভাগ বসাতে যাচ্ছি নে।

—ভাগ বসাতে যাবেন কেন, কিন্তু ওর ভয় তো আছে, আপনি যদি ছোটমা’কে বলে দেন, ছুটুকবাবুর সঙ্গে আপনার পেয়ার আছে, দেখেছে আপনি ছুটুকবাবুর আসরে গান-বাজনা করতে যান—যদি বলে দেন? ও সব জানে যে, সব দেখে যে—চোখজোড়া ছোট হলে কী হবে—নজর যে আছে আঠারো আনা।

হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে দিয়ে বংশী বললে—ওদিকে এক কাণ্ড হয়েছে শোনেন নি—না আপনি আর শুনবেন কী করে, ঠনঠনের দত্তবাবুরা মেজবাবুর পায়রা চুরি করেছিল।

—পায়রা?

–হ্যাঁ শালাবাবু, পায়রা, গেরোবাজ পায়রা, পশ্চিম থেকে নিলেমে কিনেছিল ভৈরববাবু দেড় শ’ টাকা দিয়ে একজোড়া, সেই পায়রা তিনবার লড়াই-এ জিতেছিল, ক’দিন থেকে পাওয়া যাচ্ছিলো না তাদের, মেজবাবু সকালবেলা উড়িয়ে দিয়েছে রোজকার মতে, বার কয়েক আকাশে চক্কর মেরে তারা যেমন ঘুরে আসে রোজ, সেদিন আর তেমন এল না, শ্যামবাজারের দিকে উড়ে গিয়েছিলো, তারপর কোথায় মিলিয়ে গেল—সন্ধ্যে পর্যন্ত দেখা নেই, মেজবাবুর মেজাজ খারাপ রইল ক’দিন ধরে, বেণীও সামনে যেতে ভরসা পায় না। শেষে পাওয়া গিয়েছে ছেনিবাবুর হাটখোলার মেয়েমানুষের ঘরে।

—সে কি?

–আজ্ঞে হ্যাঁ শালাবাবু, পুলিশ এল, মামলা হলো, দু’ শ’ টাকা আদালতে গুণে দিয়েছে ছেনিবাবু-পরশু যে আমাদের বড়বাড়িতে তাই ধুমধাম হলো খুব, বেণীর দু’ টাকা বকশিশ হয়ে গিয়েছে, চাকরদের কাপড় হলো একখানা করে, মেজবাবু দলবল নিয়ে গঙ্গায় পানসি চালাতে গেলেন, সঙ্গে বড়মাঠাকরুণ, মেজমাঠকরুণ, ছোটমাঠাকরুণ সবাই গিয়েছিলো, নাচ-গান-বাজনা খানা-পিনা করে সমস্ত রাত কাটিয়েছেন, কিন্তু আমার মনটা ভালো ছিল না। কেবল ভাবছিলাম শালাবাবুর কী হলো!

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে-বদরিকাবাবুর খবর কী?

—তাকেও শুধোলাম আজ্ঞে, অত যে হৈ চৈ, তিনি সেই বৈঠকখানা ঘরে শেতলপাটির ওপর চিৎপটাং হয়ে শুয়ে আছেন, বললেন—ছোকরা বেঁচে গিয়েছে খুব, ভেগেছে নির্ঘাৎ—বলে টাকঘড়িটা একবার বড়ঘড়িটার সঙ্গে মিলিয়ে দেখে নিলেন। পাগল না পাগল-কিন্তু আর দেরি নয়, আপনি চলুন আজ্ঞে, অনেক কাজ ফেলে এসেছি, ওদিকে আবার ছুটুকবাবুর বিয়ের তোড়জোড় হচ্ছে।

ভূতনাথ অবাক হয়ে গেল। ছুটুকবাবুর বিয়ে?

—আজ্ঞে হ্যাঁ শালাবাবু, বড়মা ধরে বসেছেন, তার ভারী ইচ্ছে, নিজের তো ছুচিবাই, কবে আছেন কবে নেই, সখ হয়েছে বউ দেখে যাবেন, অধর ঘটকী ক’দিন ধরে যাতায়াত করছে, সিন্ধু বলছিল আসছে মাসে নাকি হবে। তা এখন থেকে তো তৈরি হতে হবে, ঘর-বাড়ি সাফ করা, কেনা-কাটা হাতে আর সময় কই বলুন।

রতন ঘরে এল। বললে-দিদিমণি বললেন, আপনার ওষুধ খাবার সময় হয়েছে কেরানীবাবু।

ওষুধ! ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—কিন্তু দিদিমণি কোথায়?

—দিদিমণি ভাঁড়ার বার করে দিচ্ছেন।

—একবার ডেকে দিতে পারো? কিন্তু তারপর কী ভেবে বললে—আচ্ছা থাক, বাবু কোথায়?

—বাবুকে ডাকবে? বলে রতন চলে গেল। ভূতনাথ বংশীর দিকে ফিরে বললে—বড়বাড়ির আর কী খবর?

কী জানি ছোটবৌঠানের কথা সোজাসুজি জিজ্ঞেস করতে কেমন লজ্জা করতে লাগলো ভূতনাথের। আর কখনও তার কাছে যাবার সুযোগ মিলবে কিনা কে জানে। আর একবার যদি তার কাছে যাওয়া যেতো।

বংশী বললে—লোচন ক’দিন ধরে আপনার খোঁজ করছিল।

—আমার খোঁজ করে কেন সে?

—আজ্ঞে আয় কমে গিয়েছে যে তার, তামাক আর কেউ খাচ্ছে, ছুটকবাবুর আসরে বরাদ্দ ছিল তিন সের তামাক হপ্তায়, তাও এদানি বন্ধ করে দিয়েছে। তিনি বলেন—তামাক কেউ খায় না, বিড়ি খায় সবাই, তা সবাই যদি বিড়ি-সিগারেট ধরে, ওর চলে কী করে আজ্ঞে, লোচন আমাকে বলছিল সেদিন—শালাবাবুর সঙ্গে তোর এত ভাব, ওকে তামাক ধরাতে পারিস না, না হয় মাসে আটটা করে পয়সাই নেবো আমি—আর ওদিকে ইব্রাহিমেরও ভারী ভয় লেগে গিয়েছে।

-কেন?

বংশী হাসতে লাগলো। বললে—যে-যার ভাবনা নিয়ে আছে শালাবাবু, আমার ভাইটাকে আমি যেমন বড়বাড়িতে ঢোকাবার কত চেষ্টা করছি কিছুতেই পারছি না, ওরও তেমনি–

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলেও আবার কাকে চাকরিতে ঢোকাবে?

-আজ্ঞে চাকরিতে ঢোকাবে আর কাকে, নিজের চাকরি তাই-ই থাকে কিনা দেখুন, মুখ একেবারে শুকিয়ে গিয়েছে ভাবনায়, অমন বাবরি চুল, পাঠানী দাড়ি, তাই বলে আর ভালো করে আঁচড়াচ্ছে না…

-কেন?

০০আজ্ঞে খবর সব পেয়েছে ও, খবর তো আর জানতে কারো বাকি নেই, বাবুরা যে হাওয়া-গাড়ি কিনছে, সে গাড়ি চালাতে তো আর কোচোয়ান লাগবে না, ঘোড়াও লাগবে না, হাওয়ায় চলবে, বিলেতে একরকম গাড়ি উঠেছে শোনেন নি?

—হাওয়া-গাড়ি। বাবুরা কিনবে নাকি হাওয়া-গাড়ি? কার কাছে শুনলি তুই?

বংশী বলতে গিয়েও যেন থেমে গেল। শেষে বললে—আজ্ঞে শুনেছি আমি ভালো লোকের মুখ থেকেই, চুনী দাসী—ছোটবাবুর মেয়েমানুষ…

চুনী দাসী! রূপো দাসীর মেয়ে। ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে গিয়েছিলি নাকি চুনী দাসীর বাড়িতে?

—আজ্ঞে হ্যাঁ শালাবাবু, গিয়েছিলাম, ছোটবৌঠান যেতে বলেছিল বলেই গিয়েছিলাম, কিন্তু না গেলেই ভালো হতো আজ্ঞে।

–কেন?

—আজ্ঞে ছোটমা’র সেদিন উপোস, উনি পুজো-আচ্ছা করেন তো মাঝে মধ্যে, নীলের উপোস ছিল সেদিন, নির্জলা একেবারে, সারাদিন ধকল গিয়েছে নিজের পূজোয়, রূপলাল ঠাকুর এসে যশোদাদুলালের পূজো করে গিয়েছে, দুপুর বেলা চিন্তা সেই নৈবিদ্যির থালা বারকোষে সাজিয়ে বার-বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে, সেখান থেকে সরকারী পূজোবাড়ির সিধে পত্তোর সব নিয়ে একসঙ্গে বারবাড়ির লোক গিয়ে রূপলাল ঠাকুরের বাড়ি দিয়ে আসবে। আমি যেমন গিয়েছি সন্ধ্যেবেলা, দেখি ছোটমা’র মুখ একেবারে শুকিয়ে গিয়েছে—তখনও জল খাওয়া হয়নি। বরাবর উপোসের পর আমি গিয়ে ছোটবাবুর কাছে জলের বাটি নিয়ে যাই, ছোটবাবু পায়ের বুড়ো আঙুল ছুঁয়ে দেন, তারপর সেই জলটুকু খেয়ে ছোটমা উপোস ভাঙেন, কিন্তু ছোটবাবু সেদিন বাড়ি আসেন নি, ছোটমা’রও কিছু পেটে পড়েনি।

-কেন, ছোটবাবু বাড়ি আসেন নি কেন?

–তা কি আমি জানি? না ছোটমা জানেন! ছোটমা আমাকে বললে—যা বংশী তুই একবার জানবাজারে যা একবাটি জল নিয়ে আর দেখে আসিস বাবু কেমন আছেন। তা সেই অন্ধকারেই গেলাম আজ্ঞে জানবাজারে। গেলাম মরতে মরতে গিয়ে দেখি সে এক কাওছোটবাবু শুয়ে আছে পা ভেঙে, খুব বেশি নাকি খেয়ে ফেলেছিলেন, মাথার ঠিক ছিল না, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে পা ফস্কে পড়ে গিয়েছেন—আমাকে দেখে কী রাগ, বললেন—বংশী তোকে বারণ করেছি না-এ-বাড়িতে আবার এসেছিস।

ছোটবাবুর রাগের মাথায় কিছু উত্তর দিতে নেই। তা হলেই আরো রেগে যাবেন। কিছুই বললাম না, চুপ করে রইলাম। আস্তে আস্তে পায়ের কাছে বাটিটা নিয়ে ধরলাম গিয়ে। ছোটবাবু পা সরিয়ে নিলেন। বললেন—কে তোকে আসতে বলেছে এখেনে? বেরো এখান থেকে—তবু কিছু উত্তর দিলাম না। মাথা হেঁট করে চুপ করে বসে রইলাম। জানি কথা বললে আরো রাগ চড়ে যাবে। তারপর খানিক পরে ছোটবাবু বললেন—পায়ে একটু হাত বুলিয়ে দে তো।

বুঝলাম এবার ঘুম আসবে। তারপর ছোটবাবু যেই একটু ঘুমিয়ে পড়েছেন, অমনি পায়ের আঙুলটা টপ করে জলে ছুঁইয়ে নিলাম আজ্ঞে—কিন্তু জলটা নিয়ে চলে আসছি হঠাৎ দেখি সামনে নতুন-মা

ভূতনাথ বললে-নতুন-মা কে?

—আজ্ঞে ওই চুনী দাসী, ওকে আমরা নতুন-মা বলি কি না, তা আমাকে দেখেই নতুন-মা বলে উঠলো-বংশী তুই কখন এলি?

বললাম—বাবু কাল বাড়ি যাননি তাই দেখতে এসেছিলাম আজ্ঞে।

—হাতে কী?

–আজ্ঞে ছোটমা’র আজ নীলের উপোস গিয়েছে কি না।

নতুন-মা’র হাতে ছিল পানের ডিবে। দিনরাত পান খায় নতুন-মা, এক মুখ পান, ভালো করে চেয়ে দেখলাম নতুন-মা যেন আরো ফরসা হয়েছে, আরো মোটা হয়েছে, এক গা গয়না, নাকে নাকছাবিটা চকচক করছে।

নতুন-মা খানিক ভেবে বললে—হ্যাঁ রে বংশী তোর ছোটমা শুনেছে আমি মোটরগাড়ি কিনছি?

বললাম-হাওয়া-গাড়ি? কই শুনিনি তো?

—তোর ছোটমাও গাড়ি কিনবে নাকি? শুনেছিস কিছু?

সে-কথার উত্তর না দিয়ে চলেই আসছিলাম। ছোটমা বাড়িতে না-খেয়ে বসে আছেন। তাড়াতাড়ি সিঁড়ির কাছে এসেছি, নতুন-মা আবার ডাকলে-বংশী শুনে যা একবার!!

কাছে যেতেই নতুন-মা বললে—এই রাস্তা দিয়েই তো যাচ্ছিস, যাবার পথে ওই মোড়ের দোকানে একবার খবর দিয়ে যাবি তো, বলবি আরো পনেরোটা সোডার বোতল যেন পাঠিয়ে দেয়, আজ রাতটা ওতেই চলে যাবে। কাল সকালবেলা আবার খবর দেবো, আর দু’ সের বরফ ওই সঙ্গে। এই নে টাকা—বলে তিনটে টাকা দিলে আমার হাতে।

ভূতনাথ বললে—পনেরো বোতল সোড়া! অত সোড়া কী করবে বংশী?

বংশী হাসলো। বললে—মদ খাবে আজ্ঞে, কপালে ভাত জুটতো না যার এককালে, এখন সেই লোকের আজ ছোটবাবুর দৌলতে—

হঠাৎ সুবিনয়বাবু ঘরে ঢুকলেন—আমাকে ডাকছিলে নাকি ভূতনাথবাবু? না, না, উঠতে হবে না।

ভূতনাথ উঠে বসে বললে—আমি তো একটু ভালো হয়েছি, বড়বাড়ি থেকে ওঁরা পাল্কি পাঠিয়েছেন—তাই ভাবছি

সুবিনয়বাবু ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বললেন—তা হলে বেশ তো …কিন্তু জবা মাকে একবার খবর দাও। তার অনুমতিটা একবার-–ওরে রতন।

সেদিন ‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিস থেকে পাল্কি করে যেতে যেতে বার-বার মনে হয়েছিল বটে যে, জবা যাবার সময় একবার দেখা করতেও এল না! কিন্তু আর একটা দুর্বার আকর্ষণে ভূতনাথ তখন সে-অপমানও ভুলতে পেরেছে। অসভ্য ছোটলোকের মতনই তো ব্যবহার করেছে সে জবার সঙ্গে। অমন ব্যাপারের পর ভূতনাথেরও তো লজ্জার আর সীমা ছিল না।

মাধববাবুর বাজার পেরিয়ে ভূতনাথের পাল্কি তখন দুলতে দুলতে চলেছে। পাল্কি-বেহারাদের মুখের সেই বোল এখনো যেন এত বছর পরেও কানে এসে বাজে—হি-তাল, হি-তাল, হিন-তাল, হিন্-তাল,—হি-তাল, হি-তাল, হিন্-তাল হিন্-তা–ল—ল…

 

পাল্কি এসে সদর দরজা দিয়েই ঢুকলে বটে। কিন্তু তারপর কোথা দিয়ে কোথায় চললো ঠিক ধরা গেল না। আস্তাবলবাড়ি, রান্নাবাড়ি, ভিস্তিখানা পেরিয়ে গিয়ে থামলো একেবারে বাড়ির দক্ষিণে। সে দিকটায় গিয়ে নজরে পড়ে থোপাদের কাপড় কাচবার জায়গা, বাগান, পুকুর। এদিকে কখনও আসেনি ভূতনাথ আগে।

বংশীর গলা কানে এল—এইবার পাল্কি নাবাও হলধরা। পাল্কি নামালে ওরা।

বংশী এসে দরজা ফাঁক করে মখমলের ঝালর-দেওয়া পর্দা সরিয়ে দিলে। মুখ বাড়িয়ে বললে—শালাবাবু এখানেই নামতে হবে আজ্ঞে।

দুর্বল শরীরটা ঠিক যুৎসই হয়নি এখনও। একটু বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে মাথাটা ঘুরে যায়। বংশী ধরলো এক পাশে। তারপর বললে—আমার কাঁধের ওপর ভর দিয়ে চলুন।

প্রথমটা সিঁড়ির মুখে অন্ধকার। ছোটো ছোটো সিঁড়ি ভালো ঠাহর পাওয়া যায় না। তারপর ভেতরে ঢুকে বেশ ফুটফুটে। চলতে চলতে একটা জায়গায় উঠে বংশী একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলে। ছোটখাটো ঘরটা। এককালে বুঝি সাজানো ছিল এ ঘর। এখনও পালঙ আছে একটা। দেয়ালে পঙ্খের কাজ করা। উড়ন্ত পরী, বেশ-বাস অবিন্যস্ত। কোথাও পাখী উড়ে যাচ্ছে, মুখে তার রঙিন চিঠি। আরো কত কী আঁকা। দেয়ালের বালি খসে গিয়েছে জায়গায় জায়গায়। তবু ছবিগুলো ঠিক রুচিশীল বলা যায় না। চারদিকে চেয়ে দেখে ভূতনাথের দৃষ্টিতে কেমন কৌতূহল ফুটে উঠলো।

বংশী বললে—ছোটমা এই ঘরটাতেই আপনার থাকবার ব্যবস্থা করছেন আজ্ঞে। কোনো অসুবিধে হবে না আপনার এখেনে।

ভূতনাথ বললে—কিন্তু ব্ৰজরাখাল যদি খোঁজে তোমাদের মাস্টারবাবু?

বংশী বললে—মাস্টারবাবু? তিনি তো আর আসেন না এখানে।

—সে কি! ব্রজরাখাল কোথায় গেল?

—আজ্ঞে তা বলতে পারিনে। বহুদিন আসছেন না তিনি। চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন এ-বাড়ির।

সে কি!

আকাশ থেকে পড়লো যেন ভূতনাথ। তার সঙ্গে এ-বাড়ির সম্পর্ক তো ব্ৰজরাখালকে কেন্দ্র করেই। ব্রজরাখালই যদি চলে গেল তা হলে এখানে থাকবে সে কোন্ অধিকারে। ওদিকে ‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিসও যদি উঠে যায় তা হলে সে যে সম্পূর্ণ নিরাশ্রয় হয়ে পড়বে! কেমন যেন অসহায় বোধ করলো ভূতনাথ নিজেকে। আবার সেই গ্রামে ফতেপুরেই ফিরে যেতে হবে নাকি। খাবে কী সে সেখানে। থাকবেই বা কোথায়। এতদিনে সে বাড়ি কী অবস্থায় আছে কে জানে। পাশের বিপিন কলুদের তেঁতুল গাছের জঙ্গল বোধহয় আরো বেড়ে বেড়ে তাদের বাড়িটাও গ্রাস করে নিয়েছে। সেইখানে বাঘের আড্ডা হয়েছে হয় তো। হয় তো সাপ ক্ষোপের বাসা হয়েছে। রান্নাঘরটা তো ছিল বাঁশঝাড়ের লাগোয়া। বাঁশগুলো কে আর কাটছে! বাঁশগুলো সব হয় তো নুয়ে পড়েছে খড়ের চালের মাথায়। উই টিপিতে ঢেকে গিয়েছে দাওয়া। পিসীমা’র অত যত্নের রান্নাঘর। গোবর লেপে লেপে কী সুন্দরই বাহার করতে পিসীমা। তারপর গোবর লেপা হলে মাটির দাওয়ার ওপর ঘুটের আগুনে পোরের ভাত চাপিয়ে দিতো। কত বছর খায়নি পপারের ভাত। কাঁঠাল বিচি ভাতে, পোরের ভাত আর সরের ঘি!.. কিন্তু সে কথা থাক, ব্রজরাখাল তাকে ফেলে গেল কোথায়? কেনই বা গেল। বংশীকে জিজ্ঞেস করলে সে-ও বিশেষ কিছু বলতে পারে না।

ওই ঘরটার মধ্যেই কাটলো সমস্তটা দিন।

একবার ডাক্তারবাবু এসে দেখে গেল ভূতনাথকে। কোট ধুতি বুট জুতো পরা ডাক্তার। কী একটা ওষুধও বুঝি নিয়ে এল বংশী। বললে—খেয়ে ফেলুন দিকি ওষুধটা বেশি তেতো লাগলে এই ফলগুলো খাবেন—বেদানা, আঙুর, নাশপাতি কুঁচিয়ে কেটে এনেছে রেকাবিতে। বললে—আপনার জন্যে আজ্ঞে বকুনি খেতে হলো ছোটমা’র কাছে।

–কেন?

বংশী বললে—আমার হয়েছে জ্বালা শালাবাবু, চিন্তা কাজ করবে না তা-ও আমার দোষ, এই যে আপনি রুগী মানুষ বাড়িতে এসেছেন, ফলগুলো কুঁচিয়ে রাখতে পারে না ও, ভাড়ারে গিয়ে যদি রাঙাঠাকমাকে বলি তত শত হেনস্থা হবে আমার, ফিরিস্তি দাও কি হবে, কে খাবে, কেন খাবে, কী অসুখ, শালাবাবু তোর ছোটমা’র কে হয়। হ্যাঁ ত্যান, ছোটমা তাই চিন্তাকে দিয়েছিল ফল কুঁচোতে, অথচ ওর কাজ কী বলুন, আমার মতো কাজ করতে হতো তো বুঝতো। মেয়েমানুষের সোয়ামী থাকলে সেও কি বসিয়ে খাওয়াতে ওকে—না কি বলুন শালাবাবু—অন্যায্য কিছু বলেছেন ছোটমা।

ভূতনাথ ঢক ঢক করে ওষুধ খেয়েই মুখটা বিকৃত করে উঠলো। বললে-বড়ো তেতো ওষুধ বংশী।

—আজ্ঞে, খাঁটি ওষুধ তত তেতো হবেই, শশী ডাক্তারের সব খাটি ওষুধ কিনা, ছোটমা বলেছেন যত টাকা লাগে সব দেবো আমি, রোগ সারা চাই—সস্তা ওষুধ হলে চলবে না। তা ছোটমা’রও তো ক’দিন থেকে মেজাজ ভালো যাচ্ছে না কি না।

–কেন? ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে।

—ছোটমা যে নেকাপড়া জানা মেয়ে শালাবাবু, মেজমা’র মত নয় তো.যে দিন-রাত কেবল বাঘবন্দি খেলবে, কি বড়মা’র মতন নয় যে, দিনের মধ্যে চৌষট্টিবার চানই করছে কেবল, কেবল সাবান আর জল ঘটছে, ছোটমা হলো মনিষি যাকে বলে—কিন্তু পড়েছেন আজ্ঞে ছোটবাবুর মতন মানুষের হাতে, কপালের লেখন কে খণ্ডাবে বলুন। এই যে এতদিন পরে বাড়ি এলেন, মানুষটা পড়েছিলেন বাড়ির বাইরে সেই জানবাজারে নতুন-মা’র বাড়িতে, কেমন আছেন, ছোটমা’র দেখতেও তো ইচ্ছে হয়, কিন্তু না-ডেকে পাঠালে সে-হুশও নেই, শেষে ডেকে আনলুম ছোটমা’র ঘরে। ছোটবাবু তখন বেরোচ্ছেন, কাপড় কুঁচিয়ে দিয়েছি, জুতো পরিয়ে দিয়েছি, রুমাল দিয়েছি, আংটি দিয়েছি, টাকাকড়ি গুছিয়ে দিয়েছি, সব শেষে বললুম—ছোটমা একবার ডাকছিলেন আপনাকে ওপরে।

ছোটবাবু খেঁকিয়ে উঠলেন। বললেন—কেন?…আচ্ছা চল যাচ্ছি—যাবার মুখে এলেন ঘরে। আমিও এলুম পেছন পেছন। সব শুনলুম আড়ি পেতে। ছোটবাবু বললেন-ডেকেছিলে নাকি আমাকে? ছোটমা গলায় আঁচল দিয়ে পায়ে মাথা ঠেকিয়ে পেন্নাম করলেন। বললেন—কেমন আছো?

ছোটবাবু জিজ্ঞেস করলেন—কিছু দরকার আছে কি?

—না, দরকার আর কি, এমনি একবার দেখতে ইচ্ছে হলো, অনেকদিন দেখিনি। আজ আমার হিতসাধিনী ব্রত।

ছোটবাবু হো হো করে হাসলৈন।—আবার তোমার সেই ন্যাকামি আরম্ভ হলো।

ছোটমা কিছু কথা বললেন না। ছোটবাবু রেগে গেলেন বুঝি। বললেন—সেই কান্না আর কান্না, কেন, হাসতে পারো না, হাসতে পারে না আর সব বউদের মতে, দেখো তত বড়বৌঠান, মেজবৌঠান সবাই কেমন হেসে খেলে আছে, হাসোগাও–যা খুশি করে—যা দু’চক্ষে দেখতে পারি না তা-ই হয়েছে।

—কিন্তু হাসি যে আমার আসে না।

—কেন আসে না? কী হয়েছে তোমার?

—কিন্তু তুমিই কি হাসো-এ-ঘরে তোমার হাসি তো দেখিনি কখনও? অথচ শুনতে পাই তুমি ভারী আমুদে লোক, আমি কী দোষ করলুম বলতে পারো?

—তার কৈফিয়ৎ তোমার কাছে দিতে হবে নাকি আমি, চললুম। এখন সময় নেই তোমার ন্যাকামি শোনবার বলে ছোটবাবু ফিরছিলেন।

ছোটমা সরে এসে তাড়াতাড়ি ছোটবাবুর চাদরের খুটটা ধরলেন। বললেন–না গেলেই নয়?

ছোটবাবুর ওদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছিলো বোধ হয়। ল্যাণ্ডোগাড়ি জোতা রয়েছে, একবার উঠলেই টগবগ করে ছুটতে আরম্ভ করকে ঘোড়া দুটো। ওদিকে নেশার সময় বয়ে যাচ্ছে, জানি তো সব, নতুন-মা গেলাশ সাজিয়ে বসে থাকবে কি না, আর ছোটবাবুও মেজাজী লোক, সব কাজ ঘড়ি ধরে, নেশা মাথায় চড়ে গেলে আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না আজ্ঞে। তা ছোটবাবু একবার শুধু ফিরে তাকালেন ছোটমা’র দিকে। ছোটমা আবার বললেন-না-ই বা গেলে আজ সেভেনে।

ছোটবাবু রেগেই ছিলেন। বললেন—না গিয়ে তোমার আঁচল। ধরে বসে থাকবে, কেমন?

ছোটমা কিছু কথা বললেন না। ছোটবাবু বলতে লাগলেন বড়বাড়ির পুরুষমানুষদের তুমি তেমনি অপদার্থ ভাবব নাকি?

—কিন্তু তুমি তো মানুষ—তোমারও তো মনুষ্যত্ব…

ছোটবাবু এ-কথার আর জবাব দিলেন না আজ্ঞে, শুধু যেতে যেতে হেসে বললেন—বউ-এর কাছ থেকে যে মনুষ্যত্ব শেখে তার গলায় দড়ি ছোটবউ!

বংশী গল্প বলতে পারে বেশ। ভূতনাথ একমনে শুনছিল। কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। ছোটবৌঠানের এতটুকু যদি উপকারে আসতে পারা যেতো। হঠাৎ ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে আচ্ছা বংশী তোর ছোটমা সিঁদুর পরে কপালে?

—আজ্ঞে পরেন বৈকি, এতখানি জ্বলজ্বলে টিপ রোজ পরেন।

—তোর ছোটমা’কে বারণ করে দিস ও-সিঁদুর পরতে।

–কেন আজ্ঞে?

—তুই বারণ করে দিস, ও-সব বুজরুকি—আগে জানলে…বলেই ভূতনাথ ‘সতর্ক হয়ে গেল। বংশীর সঙ্গে অত কথা বলবার দরকার কী! আগে যদি সে জানতো তা হলে অমন করে ঠকাতো না ছোটবৌঠানকে। মিছিমিছি গোটাকতক টাকা নষ্ট হলো। হঠাৎ যেন রাগ হলে সুবিনয়বাবুর ওপর। রাগ হলো জবার ওপর। ওরা সব পারে। যাদের জাত নেই, তারা আবার ভগবানের কথা মুখে আনে! সব মিথ্যে কথা ওদের। ও-বাড়ির চাকরিটা যদি চলেও যায়, কোনো দুঃখ থাকবে না তার। আর একটা নতুন চাকরি যোগাড় করে নিতে হবে। শরীরটা একটু ভালো হলেই ঘুরবে চাকরির চেষ্টায়। ওই যুবক সঙ্ঘে’র নিবারণকে বলে একটা যা হয় কিছু চাকরি নেবে। ওরা কলতাতার লোক। জানে শোনে সব। ব্রজরাখাল যদি ফিরে আসে তাকেও ধরতে হবে। এন্ট্রান্স পাশ করেছে সে, চাকরির জন্য এত ভাবনা! ডালহাউসি স্কোয়ারের ওদিকটায় জাহাজ কোম্পানীর সব আপিস হয়েছে কয়েকটা। ওখানে ঘোরাঘুরি করতে হবে। ঘোরাঘুরি না করলে কে এসে সেধে চাকরি তুলে দেবে তার হাতে। নতুন রেল-লাইন খুলছে পুরীর দিকে, সেখানেও একবার চেষ্টা করতে হবে। রেলের চাকরি ভালো। ঢুকেই পনেরো টাকা মাইনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *