১৬. আজো মনে আছে সেটা শুক্রবার

আজো মনে আছে সেটা শুক্রবার। কী একটা উপলক্ষ্যে বুঝি ছুটি ছিল। বংশী এল। বললে—ছুটুকবাবু একলা আছেন, এখন আজ্ঞে দেখা করলে চাকরিটা হয়ে যায়। শশীর কাছে শুনতাম ছুটুকবাবু আপনাকে খুব পছন্দ করেন কিনা।

শেষ পর্যন্ত যেতে হলো।

ঠিক সন্ধ্যে হয়নি তখনও। গানের আসর বসতে তখনও দেরি আছে। একটা তাকিয়া হেলান দিয়ে কী একটা বই পড়ছিলেন ছুটুকবাবু। কোঁচানো ধুতি। ঢেউ ভোলা বাবরি ছাঁট চুল।

পাশে পানের ডিবে। জরদার কৌটো। সিগারেট। আর মেঝের ওপর গড়গড়া। বোধ হয় একটু আগেই ঘুম থেকে উঠেছেন।

ভূতনাথকে দেখতে পেয়ে বললেন—আসুন স্যার, কী খবর–অনেক দিন পদধূলি পড়েনি।

ভূতনাথ বসলো গদির ওপর।

ছুটুকবাবু বললেন-কালকে এলেন না, বেনারসের ওস্তাদ আনোয়ার আলী এসেছিল, আহা-হ্যাঁ কী আলাপ আর কী খেয়াল গাইলে যে কী বলবো, যেমন তৈরি গলা তেমনি লয়-জ্ঞান, সঙ্গত করছিল বৈজু। যাই বলুন বৈজুর হাত বড় মিঠে স্যার, রাত তিনটের সময় দরবারি কানাড়ার খেয়াল ধরলে একখানা—আ হা হা কোথায় লাগে আপনাদের ইয়ে। তারপর একটু থেমে বললেন–আমাদের বাড়িতেই ছোটবেলা গান শুনেছি কজ্জন বাঈ-এর দোলের দিন। সে কী নাচ আর গান। আমার বাবা মশাই-এর বন্ধু ধর্মদাসবাবু ড়ুগি-তবলা বাজিয়েছিলেন। আমরা স্যার তখন ছোট, দপ্তরখানার ভেতর দরজার ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছিলুম। নাচতে নাচতে সোনার থালা থেকে ঠোট দিয়ে সবগুলো মোহর তুলে নিলে। তারপর আর একবার তাকে দেখেছিলাম অনেক দিন পরে, সে চেহারা আর নেই। মেজকাকীর কাছ থেকে ভিক্ষে চেয়ে নিয়ে গেল। অনেক বল কওয়াতে একটা গান গাইলে–-বাজু বন্দ, খুলু খুলু যায়–ভৈরবীর রে-গা-ধা-নি-র মোচড়গুলোতে তখনও যেন যাদু মেশানো রয়েছে। সেই কজ্জন বাঈ-এর গান শুনেছিলুম আর কালকের আনোয়ারের দরবারি,আ-হা-হা-

গানের গল্প আর থামতে চায় না ছুটুকবাবুর। একটু ফুরসত পেতেই ভূতনাথ বংশীর কথাটা আরম্ভ করতে যাচ্ছিলো, হঠাৎ বাধা পড়লো। কে যেন ঘরে ঢুকছে। সামনে চেয়েই ভূতনাথ

অবাক হয়ে গেল। ননীলাল!

ননীলালও বেশ আশ্চর্য হয়ে গিয়েছে। বললে-আরে, ভূতনাথ যে! তারপর ছুটুকবাবুর দিকে চেয়ে বললে-চূড়ামণি, একটা কাজে এলুম তোর কাছে।

ছুটুকবাবুও যেন বেশ খুশি। বললে—কাজ হবে’খন—তোর খবর কী? বিন্দির খবর কী?

–বিন্দি ভালো আছে, তোর খবর জিজ্ঞেস করে। আমি বলি সে এখন সাধু হয়ে গিয়েছে, গান বাজনা নিয়ে আছে, কিন্তু আজকে সে-সব গল্প করবার সময় নেই—এখনি যেতে হবে।

ছুটুকবাবু বললে—সে কী রে, একটু বোস। সরবৎ খা।

—না ভাই, ও-সব ছেড়ে দিয়েছি।

কথাটা ছুটুকবাবুর কাছে যেন বিশ্বাস না হবার মতো। বললে সে কী?

-হ্যাঁ ভাই, বিন্দির কাছেও আর যাই না।

–কেন?

—বিয়ে করছি।

ভূতনাথও এবার অবাক হলো। বললে-বিয়ে?

ছুটুকবাবু জিজ্ঞেস করলেন—ননীলালকে আপনি চিনলেন কেমন করে ভূতনাথবাবু?

—ও যে আমার সঙ্গে এক ক্লাশে পড়েছে, আমাদের গায়ের স্কুলে।

কিন্তু ননীলালের তখন বাজে আলোচনা করবার সময় নেই। বললে—সেই জন্যেই তো এসেছি তোর কাছে, কিছু টাকা চাই আমার, বিয়ের পর সব শোধ করে দেবে। বেশি না এক হাজার টাকা।

ছুটুকবাবু কিছু কথা বললেন না। একটা সিগারেট ননীলালকে দিয়ে নিজে আর একটা ধরালেন। লম্বা ধোঁয়া ছেড়ে ননীলাল বললে—সত্যি বলছি, টাকাটার বিশেষ দরকার, তারা তো জানে না, বাড়ি-টাড়ি সব বাঁধা পড়ছে। জানে বড়লোক, টাকার অভাব নেই। তা যা হোক, এবার আমিও ভাই তোর মতন বিয়ের পর সাধু হয়ে যাবে, সত্যি বলছি

ছুটুকবাবু বললেন—সে সব কথা থাক—বিয়ে করছিস কোথায়, মেয়ে কেমন? ননীলাল বললে-মেয়েমানুষের নেশা আমার চলে গিয়েছে ভাই, এখন শুধু টাকা চাই—টাকার বড় দরকার—ওদের অগাধ টাকা, ওখানে বিয়ে হলে সারাজীবনের মতো টাকার ভাবনাটা ঘুচবে—কিন্তু তার আগে আমার নিজের খরচটার জন্যে হাতে কিছু টাকা চাই।

ছুটুকবাবু আবার বললে—বিয়ে করছিস কোথায়?

ননীলাল টপ করে কথাটার জবাব দিতে পারলে না। একবার ভূতনাথের দিকে চাইলে। যেন সঙ্কোচ হচ্ছিলো। ভূতনাথ উঠলো। হয় তো গোপনীয় কোনো কথা আছে। বললে—আমি এখন উঠি ছুটুকবাবু—পরে আসবে।

বংশীর ভাইটার চাকরির কথা বলতেই আসা। হলো না। তা পরে হবে একদিন।

বাইরে আসতেই বংশী ধরেছে। বললে-বলেছেন আজ্ঞে?

-না রে, বলা হলো না, একজন বন্ধু এসে পড়লোতা তোর ভাবনা নেই, বলবো’খন একদিন।

আজ সেই বংশীও নেই, তার ভাই-এর চাকরিটাও হয়নি সেদিন। কিন্তু সে-চাকরির উপলক্ষ্যে ছুটুকবাবুর কাছে না গেলে তো

ননীলারের সঙ্গে দেখাও হতে না ভূতনাথের। অথচ সমস্ত সর্বনাশের বীজ বুঝি সেইদিন প্রথম বোনা হয়ে গেল। শুধু ভূতনাথের জীবনেই বা কেন? ওই ছোটবাবু, ওই পটেশ্বরী বৌঠান সকলের জীবনের ওপরই এক ধূমকেতুর মতন আবির্ভাব হলো ননীলালের। ননীলাল যেন উনবিংশ শতাব্দীর বণিক সভ্যতার বিষ! বিষের আঙুর। আজ ঘরে ঘরে সে আঙুরের চারা গজিয়েছে যেন। কিন্তু সেদিন সেই অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনাটা না ঘটলে হয় তত বড়বাড়ির ইতিহাস অন্যরকম করে লেখা হতো।

 

‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিস থেকে বেরিয়ে ভূতনাথ হাঁটা পথে আসছিল। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। বাগবাজারের ভেতর দিয়ে গলি রাস্তা। চারদিকে অন্ধকার। দু’ পাশের নর্দমার নোংরা এড়িয়ে রাস্তার মধ্যেখান দিয়ে আসতে হয়। ছাড়া ছাড়া খোলার বাড়িতে টিমটিমে বাতি। দুটো রাস্তার মোড়ের কাছে সেই দিশী মদের দোকানটার কাছে আসতেই নাকে গেল চেনা গন্ধ। এড়িয়েই যেতে চেয়েছিল ভূতনাথ। রাস্তার ওপরেই বসে বসে কয়েকজন ভাঁড়ে করে মদ খাচ্ছে। সুর ভাঁজছে। হল্লা করছে। একজন গাইছে—

পোড়ারমুখী কলঙ্কিনী রাই লো।
ওলো রাধে, রাজার মেয়ে,
ভুলে গেলি রাখাল পেয়ে, ছি লো,
খাসা দৈকে ফেলে দিয়ে কাপাস খেলি তুই লো,
লাজে মরে যাই লো—

আর একজন পাশ থেকে সমের মাথায় চিৎকার করে উঠলো–হ্যাঁ হা হা হাঃ…

অন্ধকারে মূর্তিগুলোকে সব দেখা যায় না। হট্টগোলের মধ্যে কয়েকটা মাতালের নৈশ-উল্লাস। কিন্তু এমন সময়েই কাণ্ডটা ঘটলো। হঠাৎ সামনে একটা মূর্তিকে দেখে যেন চিনতে পারলে ভূতনাথ। সেই জবাদের বাড়ির পুরোনো ঠাকুরটা না? কিন্তু সামলে নেবার আগেই একটা আস্তো থান ইট ভূতনাথের মাথা লক্ষ্য করে ছুঁড়েছে। মাতাল ঠাকুরটার কথাগুলোর কিছু অংশ যেন কানে গেল—শালার কেরানীবাবুকে দে শেষ করে–

তারপর আর কিছু মনে নেই ভূতনাথের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *