০৫. মোহিনী-সিঁদুর

‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিসে চাকরি হয়ে গেল ভূতনাথের।

বার-বাড়িতে রাত্রে শোয়া আর সকাল বেলা স্নান করে একটু জলখাবার খেয়ে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে আপিসে পৌঁছনো। তা হেঁটে যেতে ঘণ্টাখানেকের রাস্তা। সকাল থেকেই কাজ শুরু। দুপুর বারোটার সময় ডাকতে আসে ঠাকুর—বাবু ভাত বেড়েছি—

তাড়াতাড়ি হাতের কাজটা রেখে হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে খেতে বসা। একতলায় বাড়ির পেছন দিকের সমস্ত ঘরটাই রান্নাঘর। তারই এক কোণে এক একদিন আসন পেতে জলের গ্লাশ দেয় ঠাকুর। কলাপাতার ওপর গরম গরম ভাত ফেলে দেয়, হাতায় করে। বলে—মধ্যিখানটায় একটু গর্ত করুন তো-ডাল দিই—

এক রাশ গরম ভাতের ওপর গরম ডাল পড়ে। তারপর আলুকুমড়োর একটা তরকারি দেয় এক থাবা। কোনো দিন শাকচচ্চড়ি গাদাখানেক।

ছোট বেলায় ফতেপুরে মাছ না হলে খেতে পারতো না ভূতনাথ। তা পরের বাড়ি। এমনিতেই খেতে লজ্জা করে। তার ওপর আবার চাওয়া।

আরো ভাত দিলে যেন ভালো হতো। কিন্তু ঠাকুর যেমন তাড়া দেয়, তাতে কেমন লজ্জা হয়। একদিন জিজ্ঞেস করেছিল ভূতনাথ-মাছ নেই ঠাকর?

ঠাকুর বলেছিল—গোণাগুন্তি মাছ—সে তো সব ওপরে চলে গিয়েছে—তারপর তাড়া দিয়ে বলে—একটু হাত চালান বাবু, হাবুর মা এখুনি এসে আবার এটো পাড়বে।

সুতরাং কোনো রকমে খাওয়া সেরে নিয়ে আবার কাজে বসতে হয়। কাজ না কাজ। হাজার হাজার প্যাকেট ভর্তি সিঁদুর। সেই কাগজের কৌটোয় সিঁদুর ভরা-তারপর মুখ বন্ধ করে ছাপানো লেবেল লাগিয়ে দেওয়া। এক একটি কৌটোর দাম—আড়াই টাকা। এক মাসের ব্যবহারের জন্য আড়াই টাকা। কত দূর দূর দেশে যায়। কোথায় রাজসাহী, চট্টগ্রাম, সিহাচলম, পেনাঙ, আন্নামালাই, জাভা, বোর্নিও–

ফলাহারী পাঠক সিঁদুর ভরে, প্যাকেট আঁটে, লেবেল লাগায়–

আর চিঠিপত্র লেখে ভূতনাথ। মনি-অর্ডার এলে সুবিনয়বাবুর কাছে পাঠিয়ে দেয়। ভি-পি. করে পার্সেল যায়। যত এজেন্ট আছে, তাদের কাছে পাঠাতে হয় হ্যাণ্ডবিল। নানান ভাষায় লেখা হ্যাবিল। হ্যাণ্ডবিল-এ লেখা থাকত–

‘অদ্ভুত ত্বড়িৎশক্তি সম্পন্ন সিঁদুর। মোহিনী-সিঁদুরে’র গুণে মুগ্ধ হইয়া হাজার হাজার নরনারী অসংখ্য প্রশংসাপত্র পাঠাঁইয়াছেন। কোনো মানুষের জীবনে হতাশ হইয়া আত্মহত্যা করিবার মতো অবস্থা আসিলে ইহার এক প্যাকেট পরীক্ষা করিয়া দেখিতে পারেন। যাঁহারা জীবনে প্রিয়পাত্র কিম্বা প্রিয়পাত্রীর প্রেম পাইতে চান; প্রিয়জনকে আপনার বশীভূত করিতে চান, প্রণয়িনীকে যদি আপনার করতলগত করিতে চান, কিম্বা যে স্ত্রীলোক আপনাকে ঘৃণা করে, অবজ্ঞা করে বা দূরে পরিহার করে তাহাকে যদি হৃদয়েশ্বরীরূপে লাভ করিতে চান, আমাদের এই বহু পরীক্ষিত বহু প্রশংসিত ‘মোহিনী-সিঁদুর’ পরীক্ষা করিয়া দেখুন। স্বামী-স্ত্রী, প্রভু-ভৃত্য, পিতা-পুত্র, শিক্ষক-ছাত্র, গুরু-শিষ্য সকলের পক্ষেই অপরিহার্য। নিত্য হাজার হাজার গ্রাহক ইহার কল্যাণে বিষময় সংসারে অপার শান্তিলাভ করিতেছেন। ইহা ছাড়া মকদ্দমায় জয়লাভ, দূরারোগ্য ব্যাধির উপশম, নিরুদ্দিষ্ট প্রিয়জনের সাক্ষাৎলাভ ইত্যাদি নানা বিষয়ে ইহার দ্বারা কার্যসিদ্ধি হয়। এক স্ত্রী এই মোহিনী-সিঁদুর’ ব্যবহার করিয়া তাহার পানাসক্ত স্বামীকে পুনরায় সংসারাশ্রমে ফিরাইয়া আনিয়াছে, আর একজন দারিদ্র্য লাঞ্ছিত হতভাগ্য লটারীতে বিশ সহস্র অর্থ পাইয়া সুখে কালযাপন করিতেছে, আর একজন…বিফলে মূল্য ফেরৎ…সংসারে শান্তি ফিরাইতে, হতভাগ্যদের সৌভাগ্য সঞ্চারে, অপুত্রককে পুত্ৰ মুখ দেখাইতে, ঋণীকে অঋণী করিতে, প্রবাসীকে ঘরে ফিরাইতে, ইহা অদ্বিতীয়.. ইত্যাদি ইত্যাদি–

হ্যাণ্ডবিল ছাড়া পাঁজিতে বিজ্ঞাপনের পাতায় বড় বড় হরফে লেখা থাকতে ‘মোহিনী-সিঁদুর’—‘মোহিনী-সিঁদুর’–

স্বদেশে বিদেশে, বাঙলায়, ইংরেজীতে, জার্মানী, চীন, জাপানী, তারপর হিন্দুস্থানী, গুজরাটী, গুরুমুখী, পুস্তু সর্ব ভাষায় সর্বত্র এই ‘মোহিনী-সিঁদুরে’র বিজ্ঞাপন।

যত বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো–তত বিক্রির অর্ডার। প্রশংসাপত্রও আসতো অসংখ্য। এক প্যাকেট ব্যবহার করে যারা অল্প ফল পেয়েছে, তারা আরো দু’ প্যাকেটের অর্ডার দিতো।

আরো দুটি পণ্য ছিল সুবিনয়বাবুর। মোহিনী আংটি আর ‘মোহিনী আয়না।

গুণাগুণ অল্পবিস্তর তিনটেরই এক। কিন্তু তিনটের মধ্যে নামডাক ‘মোহিনী-সিঁদুরে’রই বেশি। মোহিনী-সিঁদুরে’র চিঠি পত্র লিখতে লিখতেই হাত ব্যথা হয়ে যেত ভূতনাথের।

আপিস ঘরের পেছনে গুদাম ঘরে ফলাহারী পাঠকের আপিস বা কারখানা। ফলাহারী হেড আর তার দশজন য়্যাসিস্টেন্ট। তারাও হিন্দুস্থানী। আপিসের ছুটির পর যখন তারা বেরোয়, তখন মাথা থেকে পা পর্যন্ত লালে-লাল হয়ে গিয়েছে শরীর।

সিঁদুর ঢালাঢলি, কৌটোয় ভরা, লেবেল আঁটা আর তারপর প্যাকিং করার পর পোস্টাপিসে ডাকে পাঠানো সমস্ত ভার ফলাহারীর। কিন্তু তদারক করতে হবে ভূতনাথকে। কোন্ অর্ডারটি কখন এল, সেটা রেজিস্ট্রি করা, কত তারিখে ডেসপ্যাচ করা হলো— সেটি লিখে রাখা। এজেন্টদের চিঠি লেখা, ভি-পি’র ফরম পূরণ করা।

সুবিনয়বাবু এক একবার সকালের দিকে তদারক করতে আসতেন। বলতেন—কাজকর্ম কেমন হচ্ছে ভূতনাথবাবু—

কালো চাপকান গায়ে, পরনে পায়জামা, কোঁচানো চাদর বুকের ওপর ক্রসের মতন লটকানো। পায়ে কখনো চটি কখনও য্যালবার্ট। এটা সেটা দেখতেন। বলতেন—চমৎকার হচ্ছে ভূতনাথবাবু—বলে একটু পরেই চলে যেতেন। হাসি হাসি মুখ। সদাশিব মানুষ। টাকার ব্যাপারটা নিয়ে যেতে হত ওপরে। ওপরে সেই বড় ঘরটায় বসে থাকতেন তিনি। কখনও আপিসের কাগজপত্র নিয়ে। কখনও বই নিয়ে। হয় তো হেলান দিয়ে একটা কিছু পড়তেন। আশে পাশে সাধারণত কেউ থাকে না।

সই করবার আগে একবার জিজ্ঞেস করেন—এটা ভালো করে দেখে নিয়েছেন ভূতনাথবাবু-তারপর আবার বই-এর দিকে মনোযোগ দেন। বাঁধানো বই সব। আলমারিতে থাকে থাকে সাজানো। দুর্গেশনন্দিনী’, ‘কামিনীকুমার’, ‘হংসরূপী-রাজপুত্র’, ‘বিজয়-বসন্ত’ প্রভৃতি আরো অনেক বই। সোমপ্রকাশ, ‘বিবিধার্থ-সংগ্রহ’, ‘রহস্য-সন্দৰ্ভ’, ‘ব্রাহ্মিক দিগের প্রতি উপদেশ, ‘ব্ৰহ্মসঙ্গীত ও সংকীর্তন।

বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হয় না। একটু পরেই নিচে চলে আসতে হয়।

তারপর ঠাকুর রোজকার মতো ডাকতে আসে—বাবু ভাত বাড়া হয়েছে—খেতে আসুন।

সেই গরম ভাতের ওপর ডালের গর্ত, আর এক থাবা, তরকারি। প্রত্যহের আপিসের কাজের মধ্যে খাওয়াটা যেন এক শাস্তির মতন অসহ্য হয়ে উঠলো।

ফলাহারীদের অন্য ব্যবস্থা। দুপুর বেলা কারখানা ঘরের মধ্যেই পেতলের কাঁসি বেরোয় এক একটা করে। কাগজের ঠোঙা করে ছাতু বেঁধে আনে কাপড়ে, সেটা ঢালে, তার ওপর ঢালে জল। অতি সংক্ষিপ্ত সরল প্রণালী। খাওয়ার পর বাঁ হাতে জলের ঘটিটা উপুড় করে মুখের মধ্যে। কী খাটতে পারে সব! সিঁদুর ঘাঁটতে ঘাঁটতে লাল হয়ে যায় চোখ মুখ—তবু ক্লান্তি নেই। তারা মাইনে পায় পাঁচ টাকা করে। মাসে মাসে মনি-অর্ডার করে তিন টাকা দেশে পাঠায়।

ঠাকুর সেদিন যথারীতি ডাকতে এসেছে। রান্নাঘরের কোণে আসন পেতে বসিয়ে ভাত আর ডাল দিয়ে ঠাকুর বললে—আজ ওই দিয়েই খেতে হবে বাবু-তরকারি হবে না।

 

ভূতনাথ মাথা উচু করে বললে সে কি?

—সব ফুরিয়ে গিয়েছে, কম করে ভাড়ার থেকে আনাজ বেরুলে আমি কী করবো বাবু—ভাড়ার তো আমার হাতে নয়।

ভূতনাথ ভাবলে তাও তো বটে। বললে—ভাড়ারের ভার তবে কার ওপর?

“আজ্ঞে সে তো হাবার মা’র হাতে জবা দিদিমণি পাঠিয়ে দেয়। ভূতনাথ বললে—হাবার মাকে একবার ডাকো দিকি।

এল হাবার মা। আধ-ঘোমটা দিয়ে দাঁড়ালে দরজার একপাশে।

ঠাকুর বললে—ওই তো হাবার মা এসেছে—ওকে জিজ্ঞেস করুন।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—আমাদের খাবার জন্যে আনাজ তরকারি কিছু দেওয়া হয়নি—তোমাকে?

ঘোমটার ভেতর থেকে আবার মা কী বললে বোঝা গেল না।

ঠাকুর বুঝিয়ে বললে তাকে–আনাজ-তরকারি কিছু তোমাকে আজ দেওয়া হয়নি-কেরানীবাবু তোমাকে জিজ্ঞেস করছেন।

–আজ্ঞে হ্যাঁ, দেওয়া হয়েছিল। ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে-আজ কম দেওয়া হয়েছিল কি?

—যেমন বরাদ্দ থাকে তেমনি দেওয়া হয়েছিল।–কতখানি বরাদ্দ থাকে?–আমি নেকাপড়া জানিনে, যা বরাদ্দ থাকে তাই নিয়ে আসি। হাবার মার কাছ থেকে কোনো প্রশ্নের সমাধান যে পাওয়া যাবে এমন মনে হলো না।

এবার ভূতনাথ ঠাকুরকে বললে–তুমি বলো কর্তাদের যে, বরাদ্দ যেন বাড়ানো হয়—যা দেওয়া হয়, তাতে পেট ভরে না কারো—সারাদিন খাটবো-খুটবো, না খেতে পেলে তোমরাই বা কাজ করতে পারবে কেন—তোমরাও তো উপোষ করবে।

ঠাকুর বললে—তা তো ঠিক বাবু—কিন্তু কর্তাদের ও-কথা বলতে পারবো না।

–কেন পারবে না,সবাই খেতে পেলে কি না-পেলে তা তো তোমাকেই দেখতে হবে?

ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করে ভূতনাথ জানতে পারলে—এ-বাড়ির নিয়ম প্রতিদিন সকাল বেলা জব দিদিমণি ভাড়ার খুলে তালিকা দেখে দেখে সারাদিনের জিনিষ একসঙ্গে বের করে দেয়। বাড়ির লোকজন ছাড়া চাকর-ঠাকুর-ঝি, কেরানীবাবু, গরু-ঘোড়-পাখী সকলের খাবার জিনিষ দিয়ে দেয়। চাকরদের তামাক পর্যন্ত। চাল ডাল তেল নুন তরি-তরকারি, কাঁচা আনাজ, ঘোড়ার দানা, গরুর খোল, ভূষি, চুনি সমস্ত। সমস্ত ওজন করে মেপে দেওয়া। কম পড়বার কথা নয়।

সুবিনয়বাবু যেমন ভালো লোক, তাকে এই নিয়ে বিব্রত করতে কেমন যেন লাগলো। ব্রজরাখালকে বললেও হয়। কিন্তু ব্ৰজরাখালই বা কী ভাববে। হয় তত এর পরে চাকরিটাই হাতছাড়া হবে শেষ পর্যন্ত। এত কষ্টের চাকরি।

বাড়িতে ফিরে এসে ব্ৰজরাখাল বলে—কী গো বড়কুটুম, কেমন চাকরি বাকরি চলছে—কোনো কষ্ট হচ্ছে না তো?

না, কষ্ট আর কী! অন্য কিছু কষ্ট তো নেই তার। তবু মুখ ফুটে বলতে গিয়ে কেমন বাধে যেন। কিন্তু একদিন বলেই ফেললে। বললে—আজকে চালটা একটু বেশি নাও ব্রজরাখাল।

—কেন? পেট ভরে না বুঝি?

—ভরে।

–তবে?

ভূতনাথ বললে—আজ সকাল সকাল খেয়েছি ওবেলা, আর খিদেটাও পেয়েছে একটু বেশি।

সত্যি পিসীমার মতো কে আর সামনে বসিয়ে খাওয়াবে ভূতনাথকে। পেটের কাপড় সরিয়ে পিসীমা পেট দেখে তবে ছাড়ান দিতে। খা একটু দুধ দিয়ে। হরগয়লানী নতুন গরুর দুধ দিয়ে গিয়েছে, তার চাছি পড়েছে এতখানি—তাই দিচ্ছি আর নতুন আমসত্ত্ব। ও ভাত ক’টা ফেলিসনে আর, আজ খাজা কাঁঠালটা ভাঙছি, বোস একটু—কত সব আদর, কত ভালোবাসা।

সন্ধ্যেবেলা নিজের ঘরটাতে বসে ভূতনাথ সেই আগেকার কথাগুলো ভাবে। ব্ৰজরাখাল বড়বাড়ির ভেতরে বাড়ির ছেলেদের পড়াতে চলে গিয়েছে। ডান দিকে নিচু একতলা বাড়িটার বারান্দায় এখন কেউ নেই। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে ইব্রাহিম কোচোয়ান আর ইয়াসিন সহিস। ঘরের ভেতরে টিম টিম করে বাতি জ্বলছে। বোরখা পরা দু একটা মূর্তি কখনও সখনও ছাদের দিকে এসে পড়ে। আর দক্ষিণ দিক থেকে দাসু মেথরের ঢালের চাটির শব্দ ভেসে ভেসে আসে। উত্তরের সদর গেটের দু পাশে রেঢ়ির তেলের বাক্স বাতি দপ দপ করে জ্বলছে—যেন দিন হয়ে গিয়েছে ওখানটায়—ঠিক যেমন রাস্তায় আলো জ্বলে তেমনি। ব্রিজ সিং-এর ডিউটি নয় এখন। নাথু সিং বন্দুক উচিয়ে পুতুলের মতন কখনও দাঁড়িয়ে, কখনও বসে পাহারা দিচ্ছে।

ব্ৰজরাখালের বাঁয়া তবলা জোড়া নিয়ে এবার বসলো ভূতনাথ। আগেকার অনেক বোল আবার তার মনে আসতে শুরু করেছে। চর্চাটা রাখা ভালো তো। আর তাছাড়া সন্ধ্যেটা এই অচেনা দেশে কাটেই বা কী করে। প্রথমটা আস্তে আস্তে। তারপর একবার লয়-এর স্রোতে গা ঢেলে দিলে আর কোনো দিকে খেয়াল থাকে না। অন্ধকার ঘর। শুধু চাঁদনী রাত থাকলে—দক্ষিণের জানালাটা দিয়ে ঘরে আলো এসে পড়ে। আর ওধারের বাগানের টগর আর চাপা ফুলের গন্ধতে ঘর ভুর ভুর করে সারা রাত। আর তারপর ছুটুকবাবুর আসরে শুরু হয় আর একজোড়া বাঁয়া তবলার চটি। হাতুড়ি ঠুকে ঠুকে ঘাটগুলো বেঁধে নেয় তানপুরার সঙ্গে। এক দিকে তানপুরা ছাড়তে থাকে আর সঙ্গে সঙ্গে সাধা গলার শব্দ বেরিয়ে আসে। খেয়াল দিয়ে কোনো দিন আরম্ভ হয় আসর, কোনো দিন হয় না। কিন্তু জমে বেশি ঠুংরিতে নয় টপ্পায়। সেটা বেশি রাত পর্যন্ত জেগে থাকলে শোনা যায়। নিধুবাবুর টপ্পা।

প্রেমে কী সুখ হোত–
আমি যারে ভালবাসি সে যদি ভালবাসিত।
কিংশুক শোভিত ঘ্রাণে,
কেতকী কণ্টক বিনে
ফুল হোত চন্দনে, ইক্ষুতে ফল ফলিত—

কোনো দিন আরো বেশি রাত পর্যন্ত জেগে থাকলে শোন যায়—মেজকর্তার গাড়ির শব্দ। তখন সবাই প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। বনমালী সরকার লেন-এর দূর থেকে ইব্রাহিম গাড়ির ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে আসে, ঘোড়ার গতি মন্থর হয়ে যায়। ব্রিজ সিং ঘড় ঘড় শব্দ করে গেট খুলে দেয়। তারপর সেই গাড়ি এসে দাঁড়ায় খাজাঞ্চীখানা আর বৈঠকখানার মধ্যে লম্বা গাড়ি-বারান্দার তলায়। পাশের ঘর থেকে মেজকর্তার চাকর বেণী শব্দ পেয়ে ছুটে যায় নিচে। দরজা খুলে হাত ধরে নিয়ে যেতে হবে তাকে। এক একদিন পা দুটো খুব টলে। সেদিন বেণীর ঘাড়ে ভর দিয়ে চলেন। অন্দর মহলে আর যান না, বাইরে বসবার ঘরে ঢালা ফরাস তাকিয়া পাশবালিশ আছে, সেইখানেই শয্যা পাতেন। কচিৎ কদাচিৎ যদি কখনও ইচ্ছে হয়, সোজা চলে যান মেজগিন্নীর শোবার ঘরে। কিন্তু মেজগিন্নীর ঘুম বড় সাংঘাতিক। একবার ঘুমোলে কার সাধ্য জাগায় তাকে।

বংশী বলে—বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে মেজকর্তা দমাদম লাথি মারতে থাকেন—ঘরের ভেতরে মেজগিন্নীরও যত ঘুম, গিরিরও ঘুম তত।

শেষে বুঝি গিরির ঘুম ভাঙে। মস্ত বড় ঘোমটা টেনে দরজা খুলে দেয়। তারপর নিজের বিছানাটা গুটিয়ে নিয়ে বাইরে এসে বারান্দায় আবার পাতে।

কিন্তু ছোটকর্তা আসেন আরো অনেক রাতে। যখন রাত প্রায় শেষ হবার উপক্রম। তখন কেউ জেগে থাকে না। টেরও পায় না কেউ। ঘুমে ঢোলে ব্রিজ সিং। ছোটবাবুর সাদা ওয়েলার-জোড়া পায়ে ঠকঠক শব্দ করে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। ঢং ঢং বাজে ছোটবাবুর ল্যাণ্ডোলেটের ঘণ্টা। ভেতরে জেগে বসে আছেন তিনি একলা। বেশি কথার লোক নন। গাড়ি এসে গাড়িবারান্দার নিচে দাঁড়ালে নিজেই নামেন। বংশী দরজা খুলে বাতিটা জ্বেলে দেয় ঘরের। এক এক করে গায়ের জামা, হাতের হীরের আংটি, পায়ের জুতো খুলে নেয়। তারপর নতুন কোঁচানো ধুতি এগিয়ে দিতে হবে—সেটা পরে শুয়ে পড়বেন।

এ-সব বংশীর কাছে শোনা। এমনি দিনের পর দিন। রাতের পর রাত।

কিন্তু যদি ভূতনাথের এই ঘরের ছাতের ওপর ওঠা যায়, দেখা যাবে অন্দর মহলের সব আলোগুলো এখন নেভানো। বউদের মহলের বারান্দায় শুধু ঝিলমিলির ফাঁক দিয়ে টিম টিম করে জ্বলছে একটা তেলের ঝাড়। কিন্তু সব চেয়ে উজ্জ্বল বাতিটা জ্বলছে ছোটমা’র ঘরে।

বংশী বলে—ছোটমা তো ঘুমোয় না–সমস্ত রাতই পেরায় ঘুমোয় না।

ভূতনাথ বলে-ঘুমোন না তো—করেন কী?

–ছোটমা যে নেখাপড়ি জামে শালাবাবু, বই পড়ে-নয় তো গল্প করে চিন্তার সঙ্গে—নয় তো পুতুলের জামাকাপড় তৈরি করে দুজনে। ছোটমা’র পুতুলের সঙ্গে চিন্তার পুতুলের বিয়ে হয়। আমরা মুচি খাই—রসমুণ্ডি খাই—নয় তো পূজো হয় যশোদাদুলালের–

—সমস্ত রাত? ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে।

—হ্যাঁ মাঝে মাঝে সমস্ত রাত।

তারপর যখন খবর পেছোবে যে, ছোটকর্তা ফিরেছে, তখন আলো নিভবে ছোটমা’র ঘরের। চিন্তা ঘরের দরজায় হুড়কো বন্ধ করে ছোটমা’র ঘরের মেঝের ওপর ছোটমা’র বিছানার পাশে শুয়ে পড়বে।

এ সমস্ত বহুদিন আগের ঘটনা। কিন্তু অস্পষ্ট কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশের বাঁকা তৃতীয়ার চাঁদের মতন সমস্ত এখনও আঁকা আছে ভূতনাথের মনে।

 

‘মোহিনী-সিঁদুরে’র আপিসে ঢুকে খাওয়ার কথাটা মনে পড়লেই কেমন যেন ঘৃণা হতে ভূতনাথের। বরাবর পেটুক মানুষ। ভালো জিনিষ খাওয়ার দিকে বরাবরের ঝোঁক তার। বড়বাড়িতে রাত্রের খাওয়া তেমন পছন্দ হয় না। ব্ৰজরাখাল নিরামিষাশী। তাছাড়া নিজের হাতে সে রান্না করে। বাজার করারই সময় হয় না তার। আর এই ষড় রিপুকে বশে আনতেই সে ব্যস্ত। কাম ক্রোধ লোভ মোহ মদ মাৎসর্য কোনোটাকেই সে প্রশ্রয় না দেবার পক্ষপাতী। সাধন পথে ওরা বড় অন্তরায়।

কিন্তু কালীঘাটের পাঁঠা এনে যখন পেছনের বাগানে বেঁধে রাখা হয়, পরের দিন মাংস খাবার জন্যে, তখন সারা দিন রাত কী চিৎকারটাই না করে। এক একদিন অন্দরের রান্না-বাড়ির আব্রু পেরিয়ে বাইরে ভেসে আসে গরম মশলা আর মাংসের গন্ধ। সারা বাড়িটা সে গন্ধে মাতাল হয়ে যায়।

ব্ৰজরাখালের নাকেও গন্ধ যায়। নাকে কোঁচার কাপড় চাপা দেয়। বলে—জালালে দেখছি।

ভূতনাথ বলে—গন্ধটা ভালো লাগছে না তোমার ব্রজরাখাল? পেঁয়াজ রসুন আর…।

ব্ৰজরাখাল বলে—রাখো তোমার পেঁয়াজ রসুন–শরীরের পক্ষেও কি এত সব মশলা পত্তর ভালো হে—কেবল তমো গুণ বাড়ায়, ও সব তামসিক খাওয়া।

কিন্তু ভূতনাথের পক্ষে লোভ সম্বরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

ব্ৰজরাখাল বলে–বুঝি, তোমার রাতের খাওয়াটা সুবিধের হচ্ছে না—কিন্তু সুবিনয়বাবুর বাড়িতে দুপুরবেলাটা তো ভালোই খাও।

কিন্তু ব্রজরাখালকে তার অসুবিধের কথাটা যেন বলতে কেমন বাধে।

সেদিন সকালবেলা আপিস যাওয়ার মুখে হঠাৎ বংশী এসে ডাকলে—শালাবাবু।

সার্ট আর ধুতিটা তখন পরা হয়ে গিয়েছে। জুতোটা পায়ে গলিয়ে বেরোবার বন্দোবস্ত করছে সে। ব্ৰজরাখাল তখন রান্নাঘরে রান্নায় ব্যস্ত।

বাইরে থেকে বংশী আবার ডাকলে—শালাবাবু।

—কী রে বংশী?

বাইরে আসতেই বংশী হঠাৎ কাছে সরে এল। চারিদিকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে গলাটা নিচু করলে। বললে একটা কথা ছিল আপনার সঙ্গে।

-কী কথা রে—ভূতনাথ উদগ্রীব হয়ে রইল।

বংশী ইতস্তত করে বললে—ছোটমা আপনাকে একবার ডেকেছেন।

-–ছোটমা? ছোটমা কে? বড়বাড়িতে ছোটমা একজনই মাত্র। তবু কি জানি কেন ভূতনাথ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলে ছোটমা কে রে!

–আজ্ঞে ছোটকর্তার বউঠাকরুণ, ছোটবউঠাকরুণ এ-বাড়ির—

কানে কথাটা স্পষ্টই শুনতে পেলে ভূতনাথ। কিন্তু যেন বিশ্বাস হলো না। বললে—আমাকে না মাস্টারবাবুকে?

–মাস্টারবাবুকে নয়, আপনাকে, আমি ঠিক শুনেছি।

এত লোক থাকতে তাকে যে কেন ছোটবউঠাকরুণ ডাকবে তা বুঝতে পারলে না ভূতনাথ। এত আবু চারিদিকে। এতদিন আছে এ-বাড়িতে কোনো দিন কোনো সূত্রে বাড়ির কোনো মেয়েবউকে দেখবার সৌভাগ্য হয়নি ভূতনাথের। চারদিকে ঝিলিমিলি, পর্দা, পাল্কি—সব চিকে ঢাকা। বাড়ির ভেতরেও বাইরের পুরুষদের যাওয়া নিষেধ। সে-বাড়ির বউ তাকে ডাকছে—সে কী রকম? ছোটমা’র নাম শুনেছে চাকর-বাকরদের কাছে। তাদের কথাবার্তা থেকে ছোটবউঠাকরুণ সম্বন্ধে একটা ধারণাও করে নিয়েছে। কিন্তু বাইরের অজ্ঞাত পুরুষকে ছোটবউঠাকরুণ ডেকে দেখা করতে চেয়েছেন—তাই বা কেমন বিচিত্র ব্যাপার! তাছাড়া এ তো আর সুবিনয়বাবুর বাড়ি নয়। তাঁরা হলেন ব্রাহ্ম। জবাময়ী ভূতনাথের সামনে বেরিয়েছে, কথা বলতেও তার আপত্তি নেই হয় তো কিন্তু তা বলে বড়বাড়ির ছোটবউ?

ভূতনাথ বললে—কী জন্যে, কিছু বলেছেন নাকি তোমার ছোটমা?

—তা কিছু বলেনি।

ভূতনাথ কী বলবে ভেবে পেলে না। ব্ৰজরাখালকে একবার জিজ্ঞেস করা উচিত যাবার আগে।

বংশী বললে—তা হলে আমি সন্ধ্যেবেলা আপনাকে ডেকে নিয়ে যাবো কী বলেন?

ভূতনাথ ‘আচ্ছা’ বলে আপিসে বেরিয়ে পড়লো।

যথাসময়ে ঠাকুর এসে সেদিনও ডাকলে—ভাত বেড়েছি বাবু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *