৪.৪৭ কুফার কবি মহম্মদ কথিত কাহিনী

এইবার আমি তোমাদের একটি সম্পূর্ণ নতুন ধরনের গল্প শোনাবো। সে তার নতুন গল্প শুরু করে :

কুফার বিখ্যাত কবি গায়ক মহম্মদ এই কাহিনীটা বলেছিলো :

যারা আমার কাছে গান শিখতো তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী ছিলো সলমা। শুধু দেখতেই সে অপরূপা ছিলো না, গানের সময় তার কণ্ঠে মধু ঝরতো। অসাধারণ বুদ্ধিমতী ছিলো সে। অতি সহজেই কঠিন সুরও আয়ত্ত করে ফেলতো।

এই শশাঙ্ক-শুভ্র সুন্দরীকে আমি আদর করে নীলা বলে ডাকতাম। তারও অবশ্য একটা কারণ ছিলো। মেয়েটির ওপর ঠোঁটের উপরে গোঁফের জায়গাটা ঈষৎ নীলাভ দেখাতো। ঠিক কৈশোর কাটিয়ে তারুণ্যে পা রাখার আগে ছেলেদের যেমনটা হয়, তেমনি। মনে হতো, কেউ যেন ওর নাকের নিচে খানিকটা জলকালি মাখিয়ে দিয়েছে।

আমি যখন ওকে গান শেখাতাম তখন ও কুমারী কিশোরী। তবে কুঁড়ি ফুটবো ফুটবো করছে। বুঝতে পারতাম, ওর কামিজের নিচে ছোট ছোট স্তন দুটি দিনে দিনে সুগঠিত এবং তিলে তিলে তিলোত্তমা হয়ে উঠেছে।

কেন জানি না, ওর দিকে চোখ পড়লেই আমার হৃদয় মথিত হয়ে যেত। বুকের মধ্যে এক তুফান উঠতো। চোখ দুটো ধক ধক করে জ্বলতে থাকতো, মাথাটা কেমন যেন বোঁ বোঁ করে ঘুরে যেত।

যদিও সে সময় নীলার সতীর্থ ছিলো কুফার সেরা সেরা সুন্দরী কন্যারা, তবু আমার কিন্তু ওকে ছাড়া আর কাউকেই তেমন মনে ধরেনি। আমার কেন কোনও পুরুষই ওর দিকে তাকিয়ে বুকের তড়ফানী চেপে রাখতে পারতো না। একবার যারা দেখতে তারাই মনে-প্রাণে কামনা করতো সলমার সঙ্গ-সুখ।

জানি সে আমার ছাত্রী। গুরু শিষ্যার সম্পর্কের মধ্যে কাম-গন্ধ থাকতে নাই। তবু অকপটে বলবো, সলমাকে আমি ভালোবেসেছিলাম। শুধু নির্ভেজাল নিরামিষ মহব্বৎ নয়, কামনার শরে জাগরিত ছিলো সেই উত্তপ্ত প্রেম। ওর একটি ইশারায় কিনা অসাধ্য সাধন করতে পারতাম আমি! যদি সে বলতো, একটা জ্যান্ত মানুষের শির কেটে মগজ এনে দাও, ভেজে খাবো, তাও আমি অনায়াসে এনে দিতে পারতাম তাকে। যদি সে হুকুম করতো, ঐ দুর্লঙ্ঘ্য গিরিচূড়ায় উঠে পেড়ে আনতে হবে বকপাখীর ডিম, তাও আমার পক্ষে অসাধ্য ছিলো না। কিন্তু হায়, আমার পোড়া কপাল, তেমন কোন আজ্ঞাই তার কাছ থেকে পেলাম না কখনও।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

নয়শো একাশিতম রজনী :

আবার সে বলতে থাকে–

ওস্তাদ ইবন ঘানিমের সঙ্গে সলমা মক্কায় গিয়েছিলো, তখন আমি তার বিরহে একটা গান লিখেছিলাম। কিন্তু সে গান একান্তই আমার ব্যক্তিগত বিরহের অভিব্যক্তি।

আমার চেয়ে হতভাগ্য ছিলো আর একজন। তার নাম ইয়াজিদ ইবন আয়ুফ। সেও নীলার প্রেমাকাঙ্ক্ষী ছিলো।

একদিন ওস্তাদ ঘানিম সলমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা নীলা, এখানে কী তোমাকে কখনও কেউ ব্যর্থ প্রেম নিবেদন করেছে? সত্যি কথা বলতো?

সলমা বললো, না, তেমন কেউই কিছু করেনি। তবে একদিন ইয়াজিদ ইবন আয়ুফ আমাকে একটিমাত্র চুম্বন করেছিলো।

ওস্তাদ ঘানিম অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, কী রকম? তোমার অমতে জোর জবরদস্তি করে?

-না তা নয়, তবে লোভ দেখিয়ে। সে আমাকে দুটো সুন্দর মুক্তো দেখিয়ে বলেছিলো, এ দু’টো তোমাকেই দেব, কিন্তু হাতে হাতে নয়। আমার মুখে থাকবে, তুমি মুখ দিয়েই তা বের করে তোমার মুখে পুরে নেবে।

সত্যি কথা বলতে কি ঐ মুক্তো দুটো দেখে আমার ভারি লোভ হয়েছিলো! ওর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। পরে ঐ মুক্তো দু’টো বিক্রি করে আমি আশি হাজার দিরহাম পেয়েছিলাম।

ওস্তাদ ঘানিম গম্ভীর হয়ে বললেন, হুম, এই কাণ্ড!

এর পর ইয়াজিদের কপালে কি জুটেছিলো বুঝতেই পারছেন। বেতের ঘায়ে ঘায়ে জর্জরিত হয়ে ব্যাচারা শয্যাশায়ী হয়ে থেকে একদিন মারা গেলো। একটি চুমুর জন্য তাকে এইভাবে মূল্য দিতে হয়।

একদিন আমি ওস্তাদ ঘানিমের বাড়িতে যাচ্ছিলাম সলমাকে গানের তালিম দেবার জন্য। পথে দেখা ইয়াজিদের সঙ্গে। খুব রংদার জমকালো পোষাকে সেজে-গুজে সেও যেন কোথায় যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার, এতো সেজে-গুজে চললে কোথায়?

ইয়াজিদ বললো, তুমি যেখানে চলেছ, আমিও সেইখানেই যাচ্ছি। আমি বললাম, তা হলে তো ভালোই হলো, চলো এক সঙ্গেই যাওয়া যাক।

আমরা ঘানিমজীর বৈঠকখানায় বসে অপেক্ষা করতে থাকলাম। একটু পরে সলমা এলো। চুমকী বসানো হলুদ রঙের বাহারী শালোয়ার আর পায়ে টকটকে লাল রঙের কাতান। ওকে দেখে আমার মনে হলো এক জ্বলন্ত সূর্যের গোলা যেন। সলমার পিছনে এসে দাঁড়ালো একটি সুন্দরী বাঁদী। হাতে তারের বাদ্যযন্ত্র।

আমি ওকে যে গানটা শেখাচ্ছিলাম সেটা একবার গাইতে বললাম। বড় মধুর করে গেয়ে শোনালো সে।

ওস্তাদজী আমাদের বসিয়ে রেখে বাইরে বেরিয়ে গেলেন দুপুরের খানাপিনার বায়না দিতে। সেই সুযোগে ইয়াজিদ আরও কাছে ঘেষে বসলো সলমার। সলমা যাতে একটিবার তার দিকে অনুকম্পার দৃষ্টি মেলে তাকায়, সেই আশাতে অপলক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু সলমা তখন গানে বিভোর।

ইয়াজিদ কোমরের থলে থেকে দুটো সুন্দর মুক্তো বের করে নাচাতে লাগলো। এবং সলমা দেখে প্রলুব্ধ হলো। গান শেষ হলে ইয়াজিদ বললো, এ দু’টো আমি ষাট হাজার দিরহামে কিনেছি। যদি তোমার পছন্দ হয় নিতে পার।

সলমা বললো, তার বদলে আমাকে কী করতে হবে?

—কিচ্ছু না, শুধু একটি গান শুনিয়ে দাও—

সলমা একটা গান শোনালো ইয়াজিদকে, তারপর বললো, কই দাও এবার?

ইয়াজিদ বললো, কথা যখন দিয়েছি আলবাৎ দেব। কিন্তু আমি মনে মনে একটা পণ করেছি। এ দুটো আমার মুখে থাকবে। আর তুমি তা বের করে নেবে তোমার ঠোঁট দুটো দিয়ে।

সলমার গা গুলিয়ে গেলো। ঐ হতচ্ছাড়া লোকটার মুখে মুখ ঠেকাতে হবে? কিন্তু মুক্তো দু’টো কী দামী? একটি মাত্র চুম্বনের বদলে অমন জিনিস সে দিয়ে দেবে তাকে! কী বোকা হাঁদা?

অবশেষে লোভ সামলাতে না পেরে সলমা সম্মত হয়ে গেলো। এই হচ্ছে ওদের চুম্বন বৃত্তান্ত। এর পর আর একটা সত্য ঘটনা শোনাচ্ছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *