৪.৪৬ খলিফা ওমর ইবন অল-খাতাবের কাহিনী

খলিফা ওমর ইবন অল-খাতাব ছিলেন ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক। এমন খাঁটি চরিত্রের সত্যনিষ্ঠ মানুষ সে যুগে আর হয়নি। তাকে অনেকে অল-ফারুক বা বিচ্ছেদবাদী বলতেন। কারণ যে ব্যক্তি নবী মুহম্মদের দণ্ডাদেশ মানতে বিন্দুমাত্র আপত্তি জানাতে, তিনি একটি তরবারীর সাহায্যে মুহূর্তে তার শিরচ্ছেদ করে ফেলতেন।

তিনি অতিশয় সাদাসিধা জীবন যাপন করতেন। ইয়েমেন সাম্রাজ্যের রাজভাণ্ডারের অধিকর্তা হয়ে তিনি সকল মুসলমানের মধ্যে তা সমান ভাগে ভাগ করে দিলেন; ছোট-বড়, গরীব-দুঃখী কিছুই বাছ-বিচার করলেন না। অন্যান্য জিনিসের সাথে প্রত্যেকের ভাগে পড়লো এক খণ্ড করে ডোরাকাটা কাপড়ের টুকরো। ওমর তার নিজের টুকরোটুকু দিয়ে একটি পোেষাক

তৈরী করলেন। সেই পোষাকে তিনি মদিনায় তার প্রচার বেদীতে উঠে দাঁড়িয়ে তার অনুসরণকারীদের ধর্মোপদেশ দিতে লাগলেন। নাস্তিকদের কিভাবে দমন করতে হবে তিনি তাই বোঝাচ্ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়িয়ে তাকে বাঁধা দিয়ে বললো, আমরা আপনাকে আর মানববা না।

ওমর জানতে চাইলেন,-কেন?

লোকটি তখন উত্তর দেয়,—কারণ, আপনি যখন ইয়েমেনের এই ডোরা কাটা কাপড় সকলকে ভাগ করে দিয়েছিলেন, তখন আপনি বলেছিলেন যে, সকলকেই সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হলো। কিন্তু আপনি যা লম্বা, মাত্র সেইটুকু কাপড়ে আপনার পোষাক তৈরী হতে পারে না। অর্থাৎ আপনি আমাদের ঠকিয়েছেন। আপনি চুরি করে নিজের জন্য বেশি কাপড় রেখেছেন, আপনি অধার্মিক!

ওমর তার পুত্র আবদাল্লার দিকে চেয়ে বললেন, তুমি এ কথার উত্তর দাও, কারণ লোকটি ঠিকই বলেছে।

আবদাল্লা তখন উঠে দাঁড়ায়, সমবেত জনসাধারণকে চিৎকার করে জানায়,-মুসলমান ভাইগণ, আমাদের খলিফা যখন তার পোষাক তৈরী করাতে গেলেন, তখন দেখা গেলো যে, তার ভাগের সেই সামান্য কাপড়টুকু তাঁর শরীরের তুলনায় নিতান্তই কম। আমি তখন আমার ভাগ থেকে একটু অংশ ছিঁড়ে দিলাম তাকে, না হলে আজ আপনাদের সামনে এসে দাঁড়াবার মত তার কোন পোষাকই থাকতো না।

তখন সেই বাধাদানকারী ব্যক্তি চিৎকার করে জানায়, আল্লাহ অবিনশ্বর! ওমর, আমায় মাপ করুন, আমরা আপনার সমস্ত কথা শিরোধার্য করে নেব।

আর একদিনের কথা, ওমর তখন সিরিয়া, মিশর, পারস্য, রাউমের সমগ্র ভূখণ্ড এবং ইরাকের বাসোরা ও কুফা জয় করে মদিনা ফিরছেন, তার শরীরের পোষাক তখন ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে, চারদিকে শুধু খণ্ড-খণ্ড কাপড়ের টুকরো ঝুলছে। তিনি সেই ছেড়া পোষাকেই মসজিদের সিঁড়িতে বসে পড়লেন, বসে বসে তিনি সকলের অভিযোগের সুবিচার করতে থাকলেন। একজন আমীর থেকে একজন সামান্য উট চালক, প্রত্যেককেই তিনি সমান গুরুত্ব দিয়ে বিচার করতেন।

সীজার হিরাক্লিয়স কনস্টান্টিনোপলের খ্রিস্টানদের শাসন করতেন। একদা তিনি আরব-সম্রাটের আচার-ব্যবহার ও তার শক্তি সম্পর্কে গোপনে তথ্যানুসন্ধানের জন্য একজন দূত নিযুক্ত করলেন। লোকটি মদিনায় এসে একে ওকে জিজ্ঞাসা করতে শুরু করলো, তোমাদের সম্রাট কই?

লোকে তখন তাকে জবাব দেয়, আমাদের তো কোন সম্রাট নেই! তবে একজন নেতা আছেন। তিনি হলেন পরম ধার্মিক ওমর ইবন অল-খাতাব, ঈশ্বর প্রেরিত খলিফা।

লোকটি তখন জানতে চায়, কোথায় থাকেন তিনি? তাঁর কাছে আমাকে নিয়ে চলো।

লোকে তখন মসজিদের দিকে আঙুল দেখিয়ে জানালো,-ঐ যে ঐখানেই থাকেন তিনি। উনি যতক্ষণ জেগে থাকেন ততক্ষণ জনসাধারণের সুবিচার করেন, বাকী সময় ঘুমান।

সিজার-প্রেরিত দূতটি তখন মসজিদের সামনে এসে দেখে দুপুরের কড়া রোদে ওমর মসজিদের সিঁড়িতে শুয়ে ঘুমিয়ে আছেন। তার কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে, মাথার চারদিকে স্বেদ-বাষ্পের একটি বর্তুলাকার পিণ্ড তৈরী হয়েছে।

লোকটি হঠাৎ কেমন ভয় পেয়ে যায়, স্বতঃস্ফূর্তভাবে সে চিৎকার করে ওঠে,-পৃথিবীর সমস্ত সম্রাট এই ভিক্ষুকের পায়ের নিচে মাথা নোয়বে। ইনিই গোটা ধরিত্রীর মালিক।

পারস্য বিজয়ের সময় ইস্তাকার নগরীতে অবস্থিত সম্রাট জেডেজার্ডের রাজপ্রাসাদ থেকে কিছু সম্পদ নিয়ে আসা হয়। এর মধ্যে ছিলো একটি কার্পেট, ষাটটি বৃহৎ বর্গাকার প্রস্তরখণ্ড, সেগুলিতে একটি বাগানের ছবি খোদিত, যার প্রতিটি ফুল-পাতাই স্বর্ণ বা কোন দুপ্রাপ্য পাথর দ্বারা প্রস্তুত। মুসলমান নেতা সাধ বিন আবু-ওয়াকাস দেখেই বুঝতে পারেন যে, এগুলি দুর্লভ বস্তু। তিনি তাই এইগুলি ওমরকে উপহার দেবার জন্য আলাদা করে রাখেন। কিন্তু ন্যায়নিষ্ঠ খলিফা এইগুলি গ্রহণ করতে ভয় পেলেন, পাছে সম্পদ ও জাঁকজমকের উপর তাঁর লোভ জন্মে যায়! ইয়েমেন দখলের পর থেকে তিনি একটুকরো মোটা ডোরাকাটা কাপড় ছাড়া অন্য কিছুই ব্যবহার করতেন না। তিনি কার্পেটটিও নিজে গ্রহণ করলেন না। মদিনার গোষ্ঠীপ্রধানদের মধ্যে সমানভাবে টুকরো টুকরো করে ভাগ করে দিলেন। কার্পেটটি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলায় এর মূল্য নিঃসন্দেহে কমে গেলো! কিন্তু তা সত্ত্বেও আলী শুধুমাত্র তার খণ্ডটিই সিরিয়ার এক বণিকের কাছে কুড়ি হাজার দিরহাম মূল্যে বিক্রয় করেন।

পারস্য বিজয়ের সময় স্যট্রাপ (প্রাচীনকালে পারস্যের প্রাদেশিক শাসনকর্তাকে স্যট্রাপ বলা হত) হারমোজান ছিলেন সর্বশেষ যারা নতি স্বীকার করেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি আত্মসমর্পণের সময় শর্ত করে নিলেন যে, একমাত্র খলিফা ওমরই তার বিচার করতে পারবেন। ওমর তখন মদিনায় ছিলেন। দু’জন সাহসী এবং বিশ্বস্ত আমীরের সাথে তাকে প্রেরণ করা হলো।

আমীরদ্বয় ভালোমানুষ, রক্ষীর মর্যাদা যাতে খলিফা ওমর বুঝতে পারেন সেজন্য তার হারমোজানকে তার রাজকীয় পোষাক পরে খলিফার সামনে উপস্থিত হতে অনুমতি দিলেন। হারমোজান স্বর্ণখচিত একটি ঢিলা এবং একটি উজ্জ্বল কিরীট পরিধান করে মসজিদের সামনে এলেন। কিন্তু ছেড়া কাপড়ের টুকরো পরা লোকটিকে তিনি খলিফা বলে মেনে নিতে অস্বীকার করেন।

খলিফা ওমর চোখ তুলে দেখতে পান যে, যে জাঁক-জমকপূর্ণ পোষাক-পরিচ্ছদ তিনি নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন, তাই পরে একজন বন্দী তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, তখন তিনি চিৎকার করে উঠলেন, আল্লাহর মহিমা বৃদ্ধি পাক! তোমার মত দাম্ভিকদের শান্ত করবার জন্যই তিনি ইসলাম ধর্মের প্রবর্তন করিয়াছেন।

তিনি বন্দীটির সেই রাজকীয় পোষাক টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলতে বাধ্য করেন। সেভালিতে মরুভূমির বালিতে নিক্ষেপ করে তিনি জানতে চান,তুমি কি বিশ্বাস কর যে, একমাত্র আল্লাহই সর্বশক্তিমান?

হারমোজান সাথে সাথে উত্তর দেন,হ্যাঁ, বিশ্বাস করি। কারণ সেকথা সত্য না হলে আমাদের পরাজয় ঘটতে পারতো না। ঈশ্বর, নিরপেক্ষ থাকলে আপনাদের বাহিনীকে সহজেই পরাস্ত করতে পারতাম। ঈশ্বর নিশ্চয়ই আপনাদের পক্ষ নিয়ে লড়েছেন।

বন্দীর এই তীক্ষ্ণ সত্যভাষ্য উপলব্ধি করে ওমর কঠোর দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন তার দিকে। হারমোজান তার দৃষ্টি দেখে রীতিমত ভয় পেয়ে যান ভাবেন এই রকম বাক্যালাপ করলে ওমর হয়তো তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করবেন। তিনি তাই শঙ্কিত দৃষ্টিতে তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়ার ভান করলেন। তিনি তাই জল পান করতে চাইলে তাকে এক মাটির পাত্রে জল দেওয়া হলো। পাত্রটি হাতে নিয়ে ওমরের দিকে চেয়ে তিনি ইতস্ততঃ করতে থাকেন। ওমর তখন জানতে চান,-এতো ভয় কিসের?

ইতিমধ্যে ভোর হয়ে আসে। গল্প থামিয়ে শাহরাজাদ হঠাৎ চুপ করে যায়।

 

নয়শত ঊনআশিতম রজনী :

সে আবার বলতে শুরু করে :

স্যট্র্যাপ উত্তর দেন,—ভয় হচ্ছে, জল পান করা কালীন কেউ আমায় খুন না করে ফেলে।

ওমর এখন বলেন,—এ রকম সন্দেহের হাত থেকে আল্লাহ আমায় রক্ষা করুন। তৃষ্ণা নিবারিত না হওয়া পর্যন্ত তোমার কোন ভয় নেই।

সাথে সাথে পারস্য বন্দীটি জল ভরা মাটির পাত্রটি মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দেন। শপথে আবদ্ধ থাকায় ওমর তাকে কোন শাস্তি দিতে পারলেন না। হারমোজান তার করুণায় মুগ্ধ হয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। ওমর তাকে দুই সহস্র দিরহামের ভাতা মঞ্জুর করে দেন।

জেরুজালেম শহর দখলের সময় সেখানকার ধর্মযাজক সফরোনিয়স শর্ত দেন যে, খলিফা সশরীরে উপস্থিত হলে তবেই তিনি আত্মসমর্পণ করতে রাজী। ওমর সম্পূর্ণ একাকী একটি উটে চেপেমদিনা শহর থেকে জেরুজালেমের পথে রওয়ানা হলেন। মাত্র দু’টি বোঝা সম্বল করে তিনি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে প্রবৃত্ত হন। তার একটিতে ছিলো উটের জন্য কিছু শুকনো খাদ্য আর অন্যটিতে তার নিজের জন্য কিছু শুকনো খেজুর। শুধুমাত্র প্রার্থনার জন্য বা পথে কেউ তার কাছে বিচার প্রার্থনা করলে তিনি উট থামাচ্ছিলেন, এছাড়া দিবারাত্র তিনি পথ অতিক্রম করতে থাকেন। শহর দখলের সন্ধিপত্রে সাক্ষর করার পর জেরুজালেমের দ্বার তার সামনে খুলে দেওয়া হলো। খ্রিস্টানদের গীর্জার পাশ দিয়ে যাবার সময় তঁর প্রার্থনার সময় ঘনিয়ে এলো। কোথায় প্রার্থনা করা যায় জানতে চাইলে সফরোনিয়স তাকে তার গীর্জায় আসতে আমন্ত্রণ জানালেন। কিন্তু ওমর তখন বলেন, যদিও তোমাদের বিশ্বাস ভূয়ো, তবু আমি এখানে প্রার্থনা করবো না। কারণ খলিফা যেখানে প্রার্থনা করেন, মুসলমানেরা তৎক্ষণাৎ সেই স্থানের দখল গ্রহণ করে।

প্রার্থনা শেষে তিনি খ্রিস্ট-ধর্মযাজককে প্রশ্ন করেন—কোথায় এখানকার মুসলমানদের জন্য একটি মসজিদ স্থাপন করা যায়। আমাকে দেখিয়ে দিন।

সফরোনিয়স তাকে সুলেয়মানের ধর্মস্থানের দিকে নিয়ে গেলেন। এই স্থানে আব্রাহামের পুত্র ইয়াকুবতার দেহরক্ষা করেন। ওমর দেখতে পান যে, এই স্থানে শহরের সমস্ত আবর্জনা জড় করা হয়। তিনি তখন নিজে হাতে কিছু আবর্জনা তুলে তাঁর কাপড়ের ভাঁজে করে দুরে ফেলে দিয়ে আসেন। তার এই কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে আরো অনেকে কাজে হাত লাগান, ফলে দ্রুত স্থানটি পরিষ্কৃত হয়ে যায়। এই স্থানে নির্মিত মসজিদটি বিশ্বের অন্যতম সুন্দর মসজিদ, এর সাথে তার স্মৃতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে।

ওমর মক্কা ও মদিনার রাস্তায় সাধারণতঃ একটি জীর্ণ বস্ত্র পরিধান করে একটি লাঠিতে ভর দিয়ে চলাফেরা করতেন। যে সব বণিকরা লোক ঠকাতে চেষ্টা করতো, তিনি এই রকম ছদ্মবেশ ধারণ করে তাদের হাতে হাতে ধরে ফেলতেন। কখনও তিনি উপদেশ দিয়েই অপরাধীকে ছেড়ে দিতেন, কখনও বা অপরাধের গুরুত্ব বুঝে তাকে বেত্রাঘাত করতেন।

একদিন তিনি দুধের বাজারের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, এমন সময় দেখতে পেলেন এক বৃদ্ধা কয়েকপাত্র দুধ বিক্রয় করছে। বৃদ্ধাটিকে দুধে জল মেশাতে দেখে তিনি বলে উঠলেন,-শোনো, আর কখনও এইভাবে লোক ঠকিও না। তুমি দুধে জল মিশিয়ে বিক্রী কর কেন? কখনও এমন কাজ করো না।

মহিলাটি উত্তর দেয়, আপনার কথা আমি মাথা পেতে নিলাম, আর কখনও করবো না।

পরদিন তিনি আবার দেখা করলেন বৃদ্ধা দুধ-বিক্রেতাটির সঙ্গে,-গতকালই না তোমায় আমি সাবধান করে দিলাম যে, দুধে জল মিশিও না! আবার তুমি সেই কাজ করেছ!

—না, শপথ করে বলছি, আমি আজ জল মেশাইনি। মহিলাটি চিকৃৎ নিনাদে প্রতিবাদ করে।

ভেতর থেকে একটি মেয়ের ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,—মা, তুমি খলিফা ওমরের সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যা কথা বললে কেমন করে? একে তো অন্যায় করেছ, তার ওপর আবার মিথ্যা কথা বলে পাপ বাড়াচ্ছো? আল্লাহ তোমায় মাফ করুন!

মেয়েটির সৎসাহস ও সত্যবাদিতায় তিনি মুগ্ধ হয়ে পড়েন। বৃদ্ধাটিকে শাস্তি না দিয়ে তিনি অবিলম্বে বাড়ি ফিরে এলেন, দুই পুত্র আবদাল্লা ও আকিমকে সমস্ত জানিয়ে বললেন,-এই গুণবতী মেয়েটিকে তোমাদের কে বিয়ে করতে চাও বলো? আল্লাহ এই মেয়েটির নিশ্চয়ই মঙ্গল করবেন।

-আমি ওকে বিয়ে করতে রাজী আছি, আব্বা! ছোট ছেলে আকিম উত্তর দেয়।

খলিফা পুত্র আকিমের সাথে সেই বৃদ্ধার দুগ্ধ-বিক্রেতা কন্যাটির বিবাহ হয়ে যায়। তাদের এই বিবাহে আল্লাহর সত্যকার আশীর্বাদ বর্ষিত হয়েছিলো, কারণ তাদের কন্যা আবদ্ অল আজিজ বিন্ মারোয়ানকে বিবাহ করে এবং ওমর বিন আবদ্ অল আজিজের জন্ম দেয়। কালক্রমে এই পুত্র ওমিয়াদ সিংহাসনে আসীন হন। তিনি ইসলামের সুমহান পাঁচজন খলিফাদের একজন ছিলেন।

ওমর বলতেন,—কোন মুসলমান খুন হলে আমি তার সত্যকার প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়বো না।

একদিন তিনি মসজিদের সিঁড়িতে বসেছিলেন, এমন সময় কয়েকজন লোক একটি মৃতদেহ নিয়ে আসে তার কাছে। তারা জানায়, এটিকে তারা রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছে।

ওমর অনেক চেষ্টা করে এ হত্যার রহস্যের মীমাংসা করতে পারেন না। তার সুবিচারক মনে এই ঘটনা গভীরভাবে রেখাপাত করে। প্রায়ই তাকে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে দেখা যেত, মহান্ আল্লাহ, আমি যেন ঐ লোকটিকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে পারি।

উক্ত ঘটনার প্রায় একবছর পরে কয়েকজন লোক তার কাছে একটি শিশুকে নিয়ে আসে। তারা জানায়, শিশুটিকে সেই দুর্ঘটনাস্থলে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে।

ওমর উত্তেজিত স্বরে বলে ওঠেন,-আল্লাহ করুণাময়। আমি বুঝতে পারছি যে, সেই হত্যা-রহস্যের মীমাংসা এবার করতে পারবো।

তিনি তার বিশ্বস্ত একটি মহিলার হাতে শিশুটিকে তুলে দিয়ে বললেন, একে তুমি পালন কর, আমি এর যাবতীয় ব্যয় বহন করবো। একে সযত্নে আগলে রাখতে হবে, যদি এর সম্পর্কে কাউকে কিছু বলতে শোনো, সাথে সাথে, আমায় খবর দেবে। আর শিশুটিকে অপরিচিত কেউ যদি বুকে চেপে ধরে আদর করে বা চুমু খায়, তাও আমাকে তৎক্ষণাৎ জানাবে।

ইতিমধ্যে ভোর হয়ে আসে। গল্প থামিয়ে শাহরাজাদ হঠাৎ চুপ করে যায়।

 

নয়শত আশিতম রজনী :

আবার সে বলতে শুরু করে :

দিনে দিনে শিশুটি বেড়ে উঠতে থাকে। শিশুটির যখন দুই বছর বয়স তখন একজন ক্রীতদাসী সহসা সেই মহিলার কাছে এসে জানায়, আমার মনিব এই শিশুটিকে একটু দেখতে চান। তিনি অন্তঃসত্তা; আল্লাহর কাছে তিনি প্রার্থনা করবেন এই রকম সুকোমল গড়নের একটি স্বাস্থ্যবান পুত্র হয় যেন তার।

-ঠিক আছে, ওকে নিয়ে যেতে পার, তবে আমিও যাব তোমার সঙ্গে। শিশুটিকে নিয়ে ওরা ক্রীতদাসীটির মনিবের বাড়ী যায়। দূর থেকে শিশুটিকে দেখতে পেয়েই সানয়নে ছুটে আসে মনিবটি, কোলে তুলে নিয়ে তাকে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিতে থাকে।

ধাত্রীটি ছুটে এসে ওমরকে খবর দেয় যে, মহিলাটি শ্রদ্ধেয় নগররক্ষী সালের কন্যা সালেহা।

কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর ওমর একটি তরবারী তার পোষাকের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। নগররক্ষীটির বাড়ী পৌঁছে তিনি দেখতে পান সদর দরজার পাশেই সালে প্রার্থনায় রত। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর তিনি জানতে চাইলেন,—তোমার কন্যাটির খবর কি?

আল্লাহ ওর মঙ্গল করুন! দয়া, দাক্ষিণ্য এবং ধর্মপ্রিয়তার জন্য ওর সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ওর মত এমন সুচরিত্রের মেয়ে ক’টা হয়?

বাঃ খুব ভালো কথা! আমি ওর সাথে দেখা করবো।

—আল্লাহ আপনাকে দোয়া করুন। আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি ওকে আগে খবর দিয়ে আসি।

অন্দরে প্রবেশ করে ওমর সবাইকে ঘর ছেড়ে চলে যেতে বলেন, সালেহার সাথে তিনি একাকী কথা বলতে চান। সবাই চলে গেলে ওমর তার তরবারীটি মুক্ত করে বলেন :

রাস্তায় যে মৃতদেহটি পাওয়া গেছিলো, তার সম্পর্কে তুমি কি জান বলো? যদি কোন সত্য গোপন করতে চেষ্টা কর তো এই তরবারীটি দেখতেই পাচ্ছ।

—মহান্ খলিফা! আপনি ঠিক জায়গাতেই খবর নিতে এসেছেন। আমি আল্লাহর নামে শপথ নিয়ে বলছি যে, আমি আপনার কাছে কিছুই লুকাবো না। তারপর গলা নামিয়ে আবার সে বলতে শুরু করে, আমার কাছে একজন বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা থাকতেন। তাকে আমি মায়ের মত ভালোবাসতাম। অনেকদিন ছিলেন তিনি আমার কাছে। আমাকে উনি যেমন স্নেহ করতেন, আমিও ওনাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতাম।

একদিন তিনি আমায় জানালেন, আমি এক আত্মীয়ের বাড়ী যেতে যাই কয়েকদিনের জন্য। আমার একটি কন্যা আছে, সে তোমার কাছে এসে থাকবে। আমি অনুমতি দিতে তিনি চলে গেলেন। পরদিন তার কন্যাটি আমার বাড়ী এলো। মেয়েটিকে যেমন সুন্দর দেখতে তেমনি দীর্ঘ সুস্থ চেহারা তার। ওকে আমার বেশ ভালো লেগে গেলো। আমি ওকে আমার ঘরেই শুতে দিলাম।

একদিন বিকালে আমি হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি, ঘুমের মধ্যে একটি পুরুষ আমার উপর চড়াও হয়েছে। লোকটি সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে আমাকে ততক্ষণে পর্যুদস্ত করে ফেলেছে। ওর হাত থেকে মুক্তি পাবার আগেই লোকটি আমাকে অসম্মান যা করার করে ফেললো। লজ্জায়, রাগে উন্মত্ত হয়ে আমি তখন ওর বুকে একটি ছুরি বসিয়ে দিলাম! তারপর ভালো করে দেখি, সে একটি মাকুন্দ পুরুষ এবং এই লোকটিই মেয়ে সেজে এসেছিলো আমার কাছে, আমিও বিশ্বাস করে তাকে গ্রহণ করেছিলাম।

খুন করার পর কি করি, আমি ওকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। কিন্তু বলাৎকারের ফলশ্রুতি হিসাবে আমি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লাম। একটি পুত্র-সন্তান হলো আমার। এই অসম্মানের সন্তানকে গ্রহণ করতে মন চাইলো না আমার, আমি তখন এর পিতাকে যেখানে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম, সেইখানেই একেও ছেড়ে দিয়ে এলাম। আল্লাহ্ জানেন, আমি আপনার কাছে। কিছুই গোপন করিনি।

-তুমি সত্যি কথাই বলেছ লক্ষ্মী মেয়ে, আল্লাহ তোমাকে আশীর্বাদ করুন।

মেয়ের সাহস ও সত্যবাদীতায় তিনি মুগ্ধ হয়ে যান, আল্লাহর কাছে তার মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করেন।

কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে ধনী যুবকটি আবার বলতে শুরু করে :

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *