৪.৪৫ আয়েশা কথিত কাহিনী

আরব সাম্রাজ্যে তখন ইসলামের প্রবর্তন সবে শুরু হয়েছে। তখনকার দিনের আরব মহিলাদের সম্পর্কে এবার আমি তোমাদের একটি গল্প শোনাবো। গল্প বলা হয়েছে আমাদের প্রিয় নবীর স্ত্রী আয়েশার মুখ দিয়ে। তিনি ছিলেন ইসলাম ধর্মের প্রথম যুগের রমণীদের মধ্যে সুন্দরতমা এবং সত্যিকার মহিয়সী মহিলা। তিনি যেমনি নম্র স্বভাবের, তেমনি সাহসী। আবার তার মত এমন পণ্ডিত ও বাগ্মী মহিলাও সেকালে দুর্লভ ছিলো।

যুবকটি তখন আয়েশার ভাষ্যতেই পরবর্তী গল্পটি বলতে শুরু করে :

একদা ইয়েমেনের কয়েকজন অভিজাত মহিলা আমার সাথে দেখা করতে আসেন। কথায় কথায় তাদের স্বামীদের প্রসঙ্গ এসে পড়ে। তারা শপথ নিয়ে জানান, স্বামী সম্পর্কে প্রত্যেকেই নির্বিচারে সত্য কথা বলবেন।

প্রথমজন বলতে শুরু করেন,আমার স্বামী! সে তো একজন চুড়ান্ত নোংরা লোক। যেন একটা খাড়া পাহাড়ের গায়ে উটের মাংসের টুকরো ছড়িয়ে পড়ে আছে। কোন রস কষ নাই

লোকটির মধ্যে। তুলনা দিয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, যেন একটা ছেড়া খড়ের মাদুর, কোনই কাজে আসে না।

দ্বিতীয় মহিলাটি শুরু করেন,-স্বামীর নাম উচ্চারণ করতে আমার গা শিউরে ওঠে! একটা বুনো পশুর মত লোক। ওর একটি কথার প্রতিবাদ জানালে মুখ খিচিয়ে আমায় বিচ্ছেদের ভয় দেখাবেন আবার চুপ করে থাকলেও মহা গোলমাল হৈ চৈ বাধিয়ে বসবেন।

তৃতীয়জন তখন বলতে থাকেন—আমার স্বামী দেবতাটির কথা বলি তাহলে! এমনই লোক যে, খেতে শুরু করবে তো পাত্রের তলানীটুকুও চেটেপুটে শেষ করবে। আর পান করতে শুরু করলো তো শেষ বিন্দুটিও মহাযত্নে নিঃশেষ করে ফেলবে। যখন বসবে তোএকটা ভারী বোকার মত বসেই থাকবে আবার খাবারের জন্য কোন জন্তুকে বেছে নেবে তো জানবেন সেটিই হলো সবচেয়ে শুকনো, রোগা, মৃতপ্রায় জন্তু। এছাড়া তিনি আর কোন কর্মেরই নন!

চতুর্থজন বললেন, আমার থেকে কাছে বা দূরে যেখানেই থাকুক, দিবা-রাত্রি ও আমার কাছে একটি বোকা। খুঁত খুঁজে বার করতে গেলে দেখবেন ওর সবেতেই খুঁত। সবকিছুতেই বোকার মত বাগাড়ম্বর করবে! দেখা হলেই মাথায় একটি চাটি মারবে প্রথমে অথবা পেটে একটি খোঁচা মারবে সজোরে। মারধরের আর শেষ নাই। একটা বদমেজাজী জন্তু যেন! আল্লাহ ওকে ধ্বংস করুন।

পঞ্চম জন তখন বলেন, আমার স্বামীটি কিন্তু যেমন ভালো মানুষ তেমনি মিষ্টি স্বভাবের লোক। তিহামার সেই রূপকথার রাত্রের মত মিষ্টি লাগে ওর সঙ্গ। উনি নিঃসেন্দহে একজন মহৎ লোক, আমাদের প্রতিটি যোদ্ধা ওকে যেমন ভয় পান আবার তেমনই সম্মান করেন। চলমান সিংহের মত ওর শান্ত গাম্ভীর্য্য এক দর্শনীয় বস্তু। চারপাশের প্রত্যেক লোককেই উনি ভালোবাসেন। বিপদের দিনে উনি নিজে থেকে এগিয়ে এসে সারারাত মহল্লা পাহারা দেবেন, ভোজের দিনেও অন্যদের কথা ভেবে পেট পুরে খাবেন না। মহল্লার একদম সামনের দিকে উনি বাড়ী করেছেন, যাতে যে-কোন পথিক প্রথমেই ওঁর দরজায় অতিথি হয়ে এসে ওঠে। যেমন তার মহত্ত্ব আবার তেমনই তার দেহ-সৌষ্ঠব। ওঁর ত্বক যেন খরগোশের চামড়ার মত রেশম কোমল। ওঁর নিঃশ্বাসে যেন জার্নরের সৌরভ ভাসে!

ষষ্ঠ মহিলা তার স্বামীর কথা বলতে গিয়ে মিষ্টি হাসি হেসে ফেলেন, আমার স্বামী হলেন মালিক আবু জার, সম্প্রদায়ের প্রত্যেকে তাকে ভালোবাসে। শৈশবে তিনি আমাকে এক গরীব ঘর থেকে কুড়িয়ে এনেছিলেন। আমাকে উনি আদরে, সোহগে, অলঙ্কারে ভরিয়ে রেখে দিয়েছেন। উনি আমাকে যেমন সম্মান করেন তেমনই ভালোবাসেন। সামহারের উজ্জ্বল বর্শা আর জীবন্ত সংগীতের মত উনি আমাদের বাড়ীটিকে সব সময় প্রাণবন্ত করে রাখেন। এখানে বসেও আমি যেন আমাদের উঠানে উট ঘোড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি, আমার কানে এখন দুধ দোওয়ার শব্দ ভেসে আসছে! এমন মধুর ওনার সাহচর্য যে, আমি ঠিক ভাষায় প্রকাশ করে বলতে পারবো না! আমাকে উনি একটি কি সুন্দর সন্তান দিয়েছেন। শিশুটি যখন হেলে-দুলে পা-পা করে হাঁটতে চেষ্টা করে তখন ওকে দেখলে আপনি ভালো না বেসে পারবেন না। আমাকে একটি কন্যা আসন্তান দিয়েছে উনি! এমন স্বাস্থ্যবতী আর নম্র স্বভাবের মেয়েটি যে, আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে ওকে সকলে একটি রত্ন বলে ভাবে।বিশাল আয়ত ঘন কালো চোখ ওর, নাকটি যেন একটি বাঁকা বাঁশী। কি সুন্দর মেয়েটির মুখশ্রী! ওর মিষ্টি কথা শুনলে নির্মল সুখে আপনার মন ভরে উঠবে।ওদের দুজনকে নিয়ে আমার ঘর পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আল্লাহ ওদের সুখে। রাখুন, আবু জারের মঙ্গল করুন তিনি।

ষষ্ঠজন তার ভাষ্য শেষ করতেই আমি আমার সকল অতিথিকে ধন্যবাদ জানাই। রাত প্রায় ভোর হয়ে আসে, গল্প থামিয়ে শাহরাজাদ হঠাৎ চুপ করে যায়।

 

নয়শত আটাত্তরতম রজনী।

সে আবার বলতে শুরু করে :

আমি তখন তাদের বলি—প্রিয় বোনেরা আমার! আল্লাহ আমাদের আশীর্বাদ করুন। তার প্রেরিত মহান নবী আমাদের মেয়েদের সম্পর্কে কি বলেন তাই শুধু আমি আপনাদের জানাতে চাই। আমরা নারীরা যেন নরকের অগ্নিকুণ্ডের জ্বালানী এক একটি। একদিন আমি তার কাছে উপদেশ চাইতে গেছিলাম। তিনি আমায় বললেন—আয়েশা, আমার হৃদয়ের টুকরো! মুসলমান রমণীদের নিজেদের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। বিপদের দিনে তাদের ধৈর্যশীল হতে হবে আবার সুখের দিনে তারা যেন উদাসীন না হয়ে পড়েন। পুত্র-কন্যারা তাদের সংসার পূর্ণ করে তুলবেন, স্বামীকে সম্মান এবং যত্ন করবেন সুশীলা রমণীর মত। এবং আল্লাহর দয়ার কথা তারা যেন উপেক্ষা না করেন কোনদিন! আল্লাহর দোয়া থেকে তারা তাহলে বঞ্চিত হবেন চিরতরে। যে রমণী তার স্বামীকে ঘৃণা করবেন, বলবেন, কি কদাকার লোক! শেষ বিচারের দিনে আল্লাহ তার একটি চোখ মুচড়িয়ে খুলে নেবেন। তিনি তার শরীর বিকৃত করে দেবেন। যে রমণী কথায় কথায় তার স্বামীকে প্রতিবাদ জানাবেন, তাকে অনর্থক বিরক্ত করবেন আল্লাহ্ তার জিব টেনে ছিঁড়ে ফেলবেন।

কিন্তু একজন কল্যাণী রমণী, যিনি স্বামীর শান্তি কখনও বিঘ্নিত করেন না, যিনি স্বামীর আদেশ ব্যতীত কখনও বাড়ির বাইরে যান না, যিনি মূল্যবান অলঙ্কারে কখনও শোভিত করেন না, যিনি চারু ভাষিণী, যিনি স্বামী পুত্রকে স্নেহ ভালোবাসায় পরিপূর্ণ করে রাখেন, একমাত্র তাকেই আল্লাহ স্বর্গের প্রবেশের দ্বার উন্মুক্ত করে দেবেন। তার প্রেরিত দেবদূত আর অনুসরণকারীদের সাথে সেই রমণীই শুধু স্বর্গে প্রবেশের অধিকার পাবেন।

আমি তখন বলে উঠি,-নবী আমার! তুমি তো আমার কাছে আমার পিতামাতার চেয়েও বেশি আপন।

যুবকটি আবার বলতে শুরু করে,-এইবার আমি ইসলাম ধর্ম প্রবর্তনের আমলের কয়েকটি গল্প বলবো। প্রথমে খলিফা ওমর ইবন অল-খাতাবের জীবন থেকে কয়েকটি আকর্ষণীয় ঘটনার কথা বলি।

যুবকটি তার নতুন গল্প শুরু করে :

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *