3 of 4

৪.৪৪ কিণ্ডাইটের সম্রাট হজর ও তার স্ত্রী হিন্দের গল্প

কিন্ডাইট সম্প্রদায়ের সম্রাট হজর ছিলেন অসীম সাহসী ও দুর্দান্ত হিংস্র যোদ্ধা। তার পুত্র ইমরু অল কেয়স ছিলো সে যুগের সুবিখ্যাত কবি। সম্রাট হজর এতো নৃশংস প্রকৃতির লোক ছিলেন যে, তার নিজস্ব পরিবারের লোকেরাও তার নির্দয়তার হাত থেকে মুক্তি পেতো না। পিতার নির্যাতনে রাজকুমার ইমরু ঘর ছেড়ে পলায়ন করতে বাধ্য হয়। তার পিতার বদ্ধমূল ধারণা ছিলো যে কবিত্ব শক্তির জন্ম কাপুরুষতা থেকে।

একদা সম্রাট হজর তার নিজস্ব অঞ্চল ছেড়ে অনেক দূরে বানী-আসাদ সম্প্রদায়ের সাথে যুদ্ধ সংক্রান্ত ব্যাপারে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলেন। তার চিরন্তন শত্ৰু কোদেইদে সম্প্রদায় এই সুযোগে তার অঞ্চল আক্রমণ করে। বীর জিয়াদের নেতৃত্বে তারা কিণ্ডাইট সম্প্রদায়কে সহজেই নৃশংসভাবে পরাজিত করে। কারণ হজর তার বাহিনী নিয়ে তখন অনুপস্থিত ছিলেন। জিয়াদ তার বাহিনী সমেত কিণ্ডাইটদের সঞ্চয় থেকে প্রচুর শুকনো খেজুর, অশ্ব, উট অন্যান্য গৃহপালিত জন্তু এবং কিছু অল্পবয়সী সুন্দরী মহিলা ছিনিয়ে নিয়ে যান। এদের মধ্যে ছিলেন সম্রাটের প্রিয়তমা পত্নী, কিণ্ডাইটের রত্ন-প্রতিম সুন্দরী রানী হিন্দ।

এই দুঃসংবাদকানে যেতেই সম্রাট হজর তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে দ্রুত ফিরে এলেন এবং কোদেইদে বাহিনীর সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। শত্রু সম্প্রদায়ের তাঁবুর কাছাকাছি এসে পড়তেই তিনি তার দু’জন বিশ্বস্ত গুপ্তচর সালিহ এবং সাদুসকে পাঠিয়ে দিলেন জিয়াদের বাহিনী সম্পর্কে গোপন র খোঁজ-খবর নিতে।

গুপ্তচরদ্বয় অনেক চেষ্টার পর কৌশলে শত্রু শিবিরে ঢুকে পড়ে। সেখানে তারা শত্রুবাহিনীর সৈন্যসংখ্যা, অস্ত্রশস্ত্র, রসদ ইত্যাদি সম্পর্কে বিশদ খোঁজ-খবর সংগ্রহ করে। কয়েক ঘন্টা অতিবাহিত হলে সালিহ তার সঙ্গীকে জানায়,—জিয়াদ বাহিনী সম্পর্কে আমরা অনেক তো সংবাদ সংগ্রহ করলাম, এখন চলো আমরা নিজেদের শিবিরে ফিরে যাই। সুলতানকে আমরা – জিয়াদের বুদ্ধি, পরিকল্পনা কি হতে পারে, এখন তা সহজেই বুঝিয়ে বলতে পারবো।

কিন্তু সাদুস উত্তর দেয়—না, আমি কিন্তু আরো সংবাদ সংগ্রহ করতে চাই। সালিহ্ ফিরে যায়, সাদুস একাই থেকে যায় শত্রু শিবিরে।

রাত্রি সমাগত হতেই জিয়াদের বাহিনী তাদের নেতার শিবিরে কড়া পাহারা মোতায়েন করে। সাদুস এতে বেশ মুশকিলে পড়ে যায়। অনেক চিন্তার পর সহসা সে এক অদ্ভুত সাহসের কাজ করে ফেলে। জিয়াদ বাহিনীর একজন রক্ষীর পিঠে সে অকস্মাৎ পদাঘাত করে বলতে চায়,—কে তুই গুপ্তচর! এখানে কি চাস?

লোকটি শঙ্কিত স্বরে নিজের বিশদ পরিচয় দিতে শুরু করে। এরপর আর সাদুসের পক্ষে মুক্তভাবে বিচরণ করতে কোন অসুবিধা হয় না। সকলে তাকে জিয়াদ বহিনীর রক্ষী বলেই ধরে নেয়।

জিয়াদের তাঁবুর সামনে সে কান পেতে রেখে অপেক্ষা করতে থাকে। তাঁবুর অভ্যন্তর থেকে জিয়াদ ও সম্রাজ্ঞী হিন্দের অন্তরঙ্গ ভাষ্যালাপ ও চুম্বনের শব্দ ভেসে আসে। জিয়াদের স্বর শোনা যায়—আমাদের এই অন্তরঙ্গ মিলনের সংবাদ পেলে তোমার স্বামী কি করতেন বলে?

হিন্দ উত্তর দেন,—আমি শপথ করে বলতে পারি, সে নেকড়ে বাঘের মত ছুটে এসে তোমাদের ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। উন্মত্ত রাগে ও প্রতিহিংসায় সে পাগল হয়ে উঠতো, মুখ দিয়ে ফেনা উঠতে থাকতো।

জিয়াদ তার জবাব শুনে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন, হিন্দের গালে একটি চাপড় মেরে বলেন, -বুঝতে পারছি, ঐ বনমানুষটাকে এখনও তুমি ভালোবাস। ওর হাতে আমি পরাস্ত হই নির্যাতিত হই, তাই তুমি চাও।

হিন্দ সরবে প্রতিবাদ করতে শুরু করেন,—মোটেই না! আমি লাত এবং ও জাতের নামে শপথ করে বলতে পারি। আমার স্বামীকে যতদূর আমি ঘৃণা করি এমনটি আর কাউকেই কখনও করিনি। কিন্তু সেই সাথে আমি তোমাকেও সতর্ক করে দিতে চাই যে, কি শুতে, কি বসতে তার মত এমন সতর্ক আর বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন লোক আমি দুটি দেখিনি।

জিয়াদ প্রশ্ন করেন,-কী রকম?

হিন্দ বলতে থাকেন,হজুর যখন নিদ্রা যায়, তখনও বোধ হয় ওর এক চোখ খোলা থাকে এবং মন থাকে অর্ধ জাগ্রত। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। একদিন রাত্রে হজুর আমার পাশে ঘুমিয়েছিলো, আমি শুয়ে শুয়ে ওকে দেখছিলাম। এমন সময় দেখি একটা বিষধর সাপ ওর দিকে এগিয়ে আসছে। আমি রুদ্ধশ্বাসে প্রতীক্ষা করতে থাকি। সাপটি সোজা ওর মুখ লক্ষ্য করে হামাগুড়ি দিতে দিতে এগিয়ে আসছে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই হজুর পাশ ফিরে শোয়, সাপটি তখন ওর খোলা হাতের পাতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, আমি দেখতে পেলাম এবারেও ও ঘুমের মধ্যেই হাতটি সরিয়ে নিলো। সাপটি তখনও সোজা এগিয়ে যাচ্ছে ওর পা লক্ষ্য করে। হজ্বর এবারেও ঘুমের মধ্যেই পা মুড়ে শোয়। আমি বিস্মিত নেত্রে দেখে যেতে থাকি। সাপটি ততক্ষণে হজুরের বিছানা অতিক্রম করে চলে গেছে। কাছেই এক পাত্র দুধ রাখা ছিলো, হজুরের জন্য। সাপটি লোভীর মত সেই দুধ পান করে তারপর সেই পাত্রেই সেই দুধটুকু বমি করে রেখে যায়। আমি মনে মনে খুশি হয়ে উঠি। এতদিন পর আমি ওর হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে চলেছি। কারণ ঘুম থেকে উঠে এই বিষাক্ত দুধটুকু পান করলেই তো ওর মৃত্যু অনিবার্য! খানিকক্ষণ পর হজুরের ঘুম ভেঙে যায়, তৃষ্ণার্ত বোধ করায় দুধের পাত্র সে হাতে তুলে নেয়, মুখে দিতে গিয়েও কি মনে হতে সে হাত নামিয়ে নেয়, দুধের গন্ধ শুকতেই তার হাত কাঁপতে থাকে। অবশেষে হাত থেকে পাত্রটি পড়ে যায় এবং চারদিকে সেই বিষাক্ত দুধটুকু ছড়িয়ে পড়ে। সমস্ত ব্যাপারেই ও এমন সতর্ক। বিপদ এসে পড়লেও বোধহয় আগে থাকতেই বুঝতেই পারে।

গুপ্তচরটি এরপর আর কোন বাক্যালাপ শুনতে পায় না। শুধু কিছু স্বাস-প্রশ্বাস ও চুম্বনের শব্দ ছাড়া আর কিছুই ভেসে আসে না ভেতর থেকে। সাদুস সন্তর্পণে উঠে দাঁড়ায়, তারপর সবার অলক্ষ্যে ফিরে আসে নিজেদের শিবিরে।

হজুরকে বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে, সাদুস তার ভাষ্য শেষ করে এই বলে, আমি যখন জিয়াদের শিবির ত্যাগ করে আসি সে তখন সাম্রাজ্ঞী হিন্দের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি এখনও পর্যন্ত ওরা কোন সংবাদই পায়নি।

সম্রাট হজুর এই কথা শুনে এক নিশ্চিন্ততার নিঃশ্বাস ফেললেন, অবিলম্বে কোদেইদের শিবির আক্রমণ করতে আদেশ দিলেন তিনি।

ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদও গল্প থামিয়ে চুপ করে যায়।

 

নয়শত সাতাত্তরতম রজনী :

সে আবার বলতে শুরু করে :

কিন্ডাইটবাহিনী তাদের অনুসরণকারীদের অকস্মাৎ আক্রমণে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। তাদের তাঁবুগুলি টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়, আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় তাতে। প্রচুর লোককে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো, কেউ কেউ অর্ধমৃত অবস্থায় পলায়ন করতে সক্ষম হলো।

পলায়নপর বাহিনীতে হজর জিয়াদকে খুঁজে পান। উন্মত্ত আক্রোশে তিনি ঘোড়া থেকেই জিয়াদকে এক ঝটকায় শূন্যে তুলে নেন। সমস্ত শক্তি বাহুতে জড় করে তিনি জিয়াদকে খেলনার মত শূন্যে ছুঁড়ে দেন। মাটিতে পড়ে যেতে জিয়াদের হাড়গোড় ভেঙ্গে যায়। তার মাথাটি বিচ্ছিন্ন করে নিজের ঘোড়ার লেজের সাথে বেঁধে দেন হজর।

আপন প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে হজুর হিন্দের সন্ধানের প্রবৃত্ত হন। দুটি ঘোড়াকে দুদিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে দিয়ে হিন্দকে বেঁধে দেওয়া হয় তাদের মাঝখানে। তীক্ষ চাবুকের আঘাতে ঘোড়া দুটিকে ছুটিয়ে দিতেই হিন্দের দেহ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। হজুর চিৎকার করে তাকে জানিয়ে দেন,-তোমার মুখ ছিলো খুব মিষ্টি, কিন্তু বুকের মাঝখানটিতে বড় তিক্ত কথা লুকিয়ে ছিলো!

এই বন্য প্রতিহিংসার গল্প শেষ করে যুবকটি আবার বলতে শুরু করে :

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *