3 of 4

৪.৩৬ গোহা ও তার ইয়ার-বন্ধুরা

এক সময়ে কাইরো শহরে গোহা নামে এক মজার লোক বাস করতো। কাজ-কাম বলতে সে

কিছুই করতো না। সারাদিন রাত পড়ে পড়ে শুধু সে ঘুমাতো। একদিন তার ইয়ার-বন্ধুরা এসে বললো, ওহে গোহা, সারাটা জীবন এই অলসভাবে শুয়ে শুয়ে কাটাবে নাকি?

গোহা বললো, কেন কাজ তো আমি করি মাঝে মাঝে। এই তো সেদিন বিরাট একটা বককে ধরেছিলাম আমি। বেচারা ডানা মেলে নীল আকাশে মনের আনন্দে উড়ে বেড়াতো। তার ডানা দু’খানা কেটে দিয়ে আমি ওকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু পাখীটা ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেল! গোহা দাঁত বের করে খিক খিক করে হাসতে লাগলো।

বন্ধুরা বললো, আল্লা তোমার গুনাহ মাফ করবেন না। তোমার এই নিষ্ঠুরতার হেতু কী?

গোহা বললো, বকটা দেখে আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিলো ও আমার চোখ উপড়ে নিয়ে পালাবে।

আর একদিন গোহা তার বন্ধুদের বললো, জান ভাই, আল্লাহ কেন উট আর হাতিদের পাখা দেননি?

বন্ধুরা বললো, না, জানি না তো! কেন, বলো দেখি।

গোহা বললো, ঐ রকম ভারী জন্তুদের যদি পাখা থাকতো তবে তারা উড়ে গিয়ে অন্যের বাগানের গাছপালা ভেঙ্গেচুরে তছনছ করে দিত।

একদিন এক বন্ধু এসে গোহাকে বললো, তোমার গাধাটা একবার ক’দিনের জন্য দেবে ভাই, আমি একটা শহরে যাবোয়

গোহা তৎক্ষণাৎ জবাব দিলো, নিশ্চয়ই দিতাম ভাই। কিন্তু ক’দিন আগে তো গাধাটাকে আমি বেচে দিয়েছি।

ঠিক তখুনি পাশের আস্তাবল থেকে গাধাটার মধুর কণ্ঠ-সঙ্গীত ভেসে এলো। বন্ধু বললো, কিন্তু ভাই, গাধা তো দেখছি তোমার আস্তাবলেই আছে।

গোহা বললো, তুমি যদি একটা গাধার কথা শুনেই বিশ্বাস করে বসলে, তাহলে আমার কিছু করার নাই।

একদিন এক সন্ধ্যায় গোহা গিয়েছিলো এক প্রতিবেশীর বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। একটা গোটা মুরগীর তন্দুরী তাকে খেয়ে দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু মুরগীটা এতই বুড়ো যে, মাংস আর টেনে ছিঁড়তে পারলো না সে। তখন সে মুরগীটাকে উদরস্থকরার বায়না ত্যাগ করে তাকে মাথায় ঠেকিয়ে প্রণাম জানাতে থাকলো।

গৃহস্বামী অতিথির এই আচরণে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো কী হলো, এতো বস্তু থাকতে একটা রান্না করা মুরগীকে মাথায় ঠেকিয়ে প্রার্থনা করছো কেন বাবা?

গোহা বললো, না চাচা, আপনি ভুল করছেন। এই মুরগীটাকে একটা সাধারণ মুরগী ভেবে আপনি জবাই করেছিলেন। আসলে সে খোদার পেয়ারের পুণ্যাত্মা ভক্ত জীব। তাই আপনি তাকে কেটে মসলাপাতি মেখে ঠিকমতো গনগনে আগুনে পুড়িয়েও এতটুকু দগ্ধ করতে পারেন নি। এর দেহের মাংস রান্না করার আগে যেমনটি ছিলো পরেও ঠিক তেমনি অবিকৃত রয়ে গেছে। পাপীরা দগ্ধ হয়, কিন্তু আগুনের উত্তাপ পুণ্যাত্মা ভক্তদের অঙ্গ স্পর্শ করতে পারে না।

গোহা একবার এক কাফেলার সহযাত্রী হয়েছিলো। কিন্তু পথের মধ্যে তাদের দানাপানি প্রায় ফুরিয়ে গেলো! গোহা স্বভাবত একটু পেটুক মানুষ। কিন্তু খাবার সময় সে তার ভাগের একটা পুলি আর একটিমাত্র সিদ্ধ ডিম পেলো। গোহা তা ফিরিয়ে দিয়ে বললো, খোদা কসম, এ আমি খেতে পারবো না বরং আপনারা কেউ পেটপুরে খান।

গোহা একদিন কসাইয়ের দোকানে গিয়ে বললো, আজ আমাদের বাড়িতে কিছু লোকজন খাবে, খুব ভালো দেখে কিছু মাংস দাও তো, ভাইসাব। কসাই তাকে বেশ খানিকটা মাংস ওজন করে বেঁধে দিলো।

মাংসের মোড়কটা বাড়িতে এনে বিবির হাতে দিয়ে বললো খুব ভালো করে কাবাব বানাও তো। আমি একটু বেরুচ্ছি, ঘুরে এসে খাব।

সন্ধ্যা হতে না হতে গোহা ঘরে ফিরে এলো কাবাবের টানে। কিন্তু খেতে বসে রুটি সবজি আর কিছু পনির ছাড়া কিছুই সে দেখতে না পেয়ে বিবিকে জিজ্ঞেস করলো, কী ব্যাপার কাবাব কোথায়?

বৌটা বললো, আর বললো না, কাবাবগুলো বানিয়ে আমি গোসল করতে গেছি। ফিরে এসে দেখি মুখপোড়া বেড়ালটা সব সাফ করে দিয়েছে।

রাগে ফেটে পড়লো গোহা। কোথায় সে বেড়াল। এঘর ওঘর খুঁজে একটা বেড়ালকে ধরে নিয়ে এসে সে বললো, এতটুকু বেড়াল অতগুলো মাংসের কাবাব খেয়েছে? মাংসের তত বেশ ওজন ছিলো, কিন্তু বেড়ালটা তো দেখছি পলকা পাখীর মতো হাল্কা। তা হলে মাংসগুলো গেলো। কোথায়?

একদিন গোহা-বিবি তার তিন মাসের বাচ্চাটাকে গোহার কোলে তুলে দিতে দিতে বললো, ছেলেটাকে একটু ধরতো, গো। আমি খানাটা পাকিয়ে নিয়েই নিচ্ছি।

এই সব মেয়েলী কাজ গোহার একদম পছন্দ নয়। কিন্তু উপায় কী? ছেলেটাকে নিয়ে সে নাচাতে লাগলো, একটু পরে বাচ্চাটা বমি করে তার সদ্য কাচানো কাতানটা ভাসিয়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে সে ক্রোধে ফেটে পড়ে বাচ্চাটাকে ধপাস করে মাটিতে বসিয়ে দিয়ে তার মাথায় থুথু ছিটাতে লাগলো।

মা ছুটে এসে ছেলেকে কোলে তুলে স্বামীকে ভৎসনা করতে লাগলো, একি তোমার ব্যবহার, কত আদরের ধন আমাদের এই বাছা, তার গায়ে তুমি থুথু দিলে!

গোহা তখনও রাগে গরগর করছে, আদরের ধন না হাতি! ও সব ছেলেই নয়। দেখগে অন্য কারো হয়তো হবে।

এই বলে আর সে দাঁড়ালো না, হনহন করে বেরিয়ে গেলো।

একদিন গোহার এক বন্ধু জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা ভাই বলতে পার, দ্বিতীয়ার চাঁদ অমন ক্ষীণ হয় কেন?

গোহা খুব বিজ্ঞের মতো বললো, মাদ্রাসায় দেখছি কিছুই তোমাকে লেখা পড়া শেখায়নি। আরে বোকা এও জান না, যে ক’দিন চাঁদ সরু থাকে সে কদিন আল্লাহ চাঁদের দেহ দিয়ে আসমানের তারা গড়েন!

গোহা একদিন তার এক প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে ভেড়ার কাল্লা সিদ্ধ করার জন্য একটা পাতিল ধার চাইলো। প্রতিবেশী শেখ তাকে হাঁড়িটা দিয়ে বললো, মনে করে কাল সকালে দিয়ে যেও ভাই।

পরদিন সকালে কথামতো হাঁড়িটা ফেরত দিতে এলো। গৃহস্বামী অবাক হয়ে দেখলো তার হাঁড়ির মধ্যে অন্য একটা ছোট্ট হাঁড়ি বসানো আছে।

-কী ব্যাপার, এটা কার?

গোহা বললো আমি তো ভাই বলতে পারবো না। নির্ঘাৎ তোমার হাঁড়িটাই কাল রাতে বাচ্চা পেড়েছে।

গৃহস্বামী মাথা নেড়ে সায় দিলো গোহার কথায়,, তা অবশ্যই হতে পারে। এই বলে সে পাত্র দুটি তাকে সাজিয়ে রেখে দিলো।

পরদিন গোহা আবার এলো পাত্রটি ধার করতে! প্রতিবেশি ভাবলো একটা দিলে দুটো পাওয়া যায়, দুটো দিলে নিশ্চয়ই চারটে ফেরত পাওয়া যাবে। সে দু’টো হাঁড়ি এনে গোহার হাতে দিয়ে বললো, একটাতে নাও হতে পারে, ব্যাপারের বাড়ি, দুটোই নিয়ে যাও ভাই।

গোহা নির্বিবাদে দুটো হাঁড়ি বগলদাবা করে চলে এলো।

এক এক করে অনেকদিন পার হয়ে গেছে। গোহা আর হাঁড়ি দু’টো ফেরত দিতে আসে না। কিন্তু প্রতিবেশি ভাবে গোহার মতো সাচ্চা মানুষ হয় না, সে নিশ্চয় অন্য কাজে কর্মে ব্যস্ত আছে। সময় পেলেই দিয়ে যাবে।

প্রতিবেশি ও নিয়ে বিশেষ চিন্তা করে না। কিন্তু দেখতে দেখতে অনেক মাস কেটে গেলো দেখে একদিন শেখসাহেব গোহার বাড়িতে এসে একথা সেকথার পর হাঁড়ি দু’টোর কথা তুললো, আমার হাঁড়ি দুটো ফেরত দাও ভাই।

গোহা যেন আকাশ থেকে পড়লো, হাঁড়ি? কোন্ হাঁড়ি বলো তো ভাইসব।

প্রতিবেশি বলে কেন, মাস কয়েক আগে আমার বাড়ি থেকে দুটো হাঁড়ি ধার নিয়ে এলে, মনে নাই?

–ও হো হো, সে কথা বুঝি তোমাকে বলিনি। এই দ্যাখো একেবারে ভুলো মন আমার, কিছুই মনে থাকে না আজকাল। তোমার হাঁড়ি দুটোর বদহজম হয়েছিলো ভাইসাব। পরদিন ভোর রাতেই কলেরায় মারা গিয়েছিলো।

শেখসাহেব অবাকহয়ে বললেন, বলো কী, হাড়ি পাতিলের কলেরা—তারা আবার মারা যায় কি?

-বারে! আল্লাহর পয়দা-করা বস্তু চিরকাল দুনিয়ায় থাকবার জন্যে আসে মাকি। মেয়াদ ফুরালেই তাকে মারা যেতে হবে না। জন্মিলেই মরিতে হবে, অমর কে কোথা রবে, ভাই?

একদিন এক খামারের মালিক গোহাকে একটা মোটা-সোটা মুরগী উপহার দিলো। গোহা খুশি হয়ে তাকে তার সঙ্গে খানা-পিনা করতে আমন্ত্রণ জানালো। খামার-মালিক সানন্দে তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করলো। এবং সেইদিন রাতে তারা দুজনে বসে খুব তৃপ্তি করে মুরগীকে উদরস্থ করলো।

এর কয়েকদিন পরে গোহার দরজায় করাঘাত হলো। দরজা খুলে এক অপরিচিত মেহেমানকে দেখে গোহা স্বাগত জানালো, আসুন আসুন, আমার কী সৌভাগ্য! তা আপনার পরিচয়টা জানতে পারি ভাইসাব!

লোকটি বললো, আমি হচ্ছি ঐ খামার-মালিকের দোস্ত। আপনার আতিথেয়তার তিনি খুব প্রশংসা করছিলেন, তাই চলে এলুম, ভাবলাম আমার বন্ধুর ভাগ্যে যখন জুটেছে, আমার ভাগ্যেও কি কিছু জুটবে না!

গোহা হেসে বলে, তা বেশ করেছেন, বসুন।

গোহা সেদিন অচেনা অতিথিকে যথেষ্ট আদর আপ্যায়ন করে খানাপিনা দিলো। খেয়েদেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে পঞ্চমুখে প্রশংসা করতে করতে সে চলে গেলো।

এর কয়েকদিন পরে আবার কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে দরজা খুলে দিলো গোহা।

-আপনি কে ভাইসাব?

আগন্তুক বললো, আমি—আমি হচ্ছি আপনার খামার চাষী-বন্ধুর বন্ধু। শুনলাম আপনি খুব অতিথিপরায়ণ মানুষ, তাই চলে এলাম—

-ওঃ, তা আসুন আসুন ভিতরে এসে বসুন। লোকটিকে বাইরের ঘরে বসিয়ে গোহা অন্দরে চলে গেলো। একটু পরে এক বাটি ধোঁয়া ওঠা গরম জল এনে বসিয়ে দিলো তার সামনে। জলের ওপরে কয়েক ফোঁটা তেল ভেসে বেড়াচ্ছিল শুধু। লোকটি হাঁ করে তাকিয়ে রইলো ােেহার মুখের দিকে।

—এ বস্তুটি কী ভাইসাহেব?

গোহা বললো, ও, বুঝতে পারছেন না? এ হচ্ছে সেই পানি, যে পানিতে ঐ মুরগীটাকে সিদ্ধ করা হয়েছিলো তার খুড়তুতো বোনের মাসতুতো বোন।

একবার গোহার বন্ধুরা গোহাকে নিয়ে একটু মজা করতে উদ্যোগী হয়েছিলো। সকলে একটা একটা ডিম সঙ্গে নিয়ে গোহার বাড়িতে উপস্থিত হয়ে প্রস্তাব করলো, চলো দোস্ত আজ সবাই মিলে একসঙ্গে গোসল করে আসা যাক।

গোহা বললো, বেশ চলল।

দল বেঁধে একটা হামামে ঢুকলো ওরা। সাজ-পোশাক খুলে রেখে উলঙ্গ হয়ে সবাই একসঙ্গে স্নানের ঘরে প্রবেশ করলো। একজন প্রস্তাব করলো, আচ্ছা বলো, আমাদের মধ্যে কে কে ডিম পাড়তে পারে এখানে। এক গোহা ছাড়া সবাই বললো, তারা ডিম বের করতে পারবে। গোহা বললো, অসম্ভব। গুল ঝাড়ার আর জায়গা পেলে না।

অবশেষে সাব্যস্ত হলো যে, যে ডিম দিতে পারবে তাকে হামাম খরচা দিতে হবেনা। যে দিতে পারবে না, তাকে সে ভার বহন করতে হবে। গোহা বললো, আমি রাজি।

এরপর গোহা ছাড়া আর সবাই একটা একটা করে ডিম বের করে দিলো যথাস্থান থেকে।

এই সব কাণ্ডকারখানা দেখে গোহা প্রথমে ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলো খানিকটা। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে কঁক কঁক কঁক করতে করতে এক একজনকে তাড়া করে করে নাস্তানাবুদ করতে থাকলো।

একজন বললো, কী ব্যাপার দোস্ত, অমন ক্ষেপে গেলে কেন, হলো কী তোমার?

গোহা বললো, একা আমি মোরগ, তোমরা সবাই মুরগী। এতগুলো মুরগীকে এক জায়গায় পেয়ে কি আর মেজাজ ঠিক রাখা সম্ভব, বলো?

প্রতিদিন অতি প্রত্যুষে গোহা ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ রুজু করে নামাজে বসে। নামাজান্তে আল্লাহর কাছে প্রতিদিনই সে একটিমাত্র প্রার্থনা জানায়, খোদা আমাকে তুমি একশোটি দিনার পাইয়ে দাও। গোনাগুনতি একশোটি—একটা বেশিও চাই না, একটা কম হলেও চলবে না আমার। ও আমি নেব না।

এক ইহুদী পড়শি প্রতিদিন গোহার ঐ রকম বায়না শুনে শুনে একদিন মনে মনে ঠিক করলো, লোকটাকে একবার পরীক্ষা করে দেখা দরকার।

পরদিন সকালে গোহা যখন মুদিত-নয়নে প্রার্থনায় বসেছে, সেই সময় ইহুদীটা একটা তোড়ায় নিরানব্বইটা দিনার ভরে ঘরের জানলা গলিয়ে তার সামনে ছুঁড়ে দিয়ে গা-ঢাকা দিয়ে রইলো।

চোখ খুলে গোহা তোড়াটা দেখে আনন্দে নেচে উঠলো। কিন্তু এক এক করে দিনারগুলো গোনার পর মুখ কালো করে ওপরের দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি যে আমার প্রার্থনা শুনেছ আল্লাহ, এ জন্য আমি ধন্য। কিন্তু তোড়াতে তো একশো দিনার নাই। একটা কম আছে। এতে তো আমার কাজ হবে না। সুতরাং তোমার এ দান আমি গ্রহণ করতে পারছি না, খোদা। আমাদের পাশের বাড়িতে এক গরীব ইহুদী বাস করে। বেচারার বড় কষ্টের সংসার। অনেকগুলো বালবাচ্চা, সবাইকে ভালো করে খাওয়াতে পারে না। আমি ভাবছি তোমার এই নিরানব্বইটা দিনারের তোড়াটা ওকেই দিয়ে দেব! লোকটা বড় সৎ, বড় ভালো।

এই বলে সে তোড়াটা ইহুদীর বাড়ির জানলা গলিয়ে ঘরের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে হনহন করে হাওয়া হয়ে গেলো।

ইহুদী তাজ্জব হয়ে গেলো মুসলমানটার সত্যনিষ্ঠায়।

পরদিন সকালে আবার সে গোহাকে পরীক্ষার করার জন্য আর একটা দিনার ভর্তি তোড়া ছুঁড়ে দিলো তার ঘরে। এবার সে একশো একটা দিনার ভরেছিলো। গোহা দিনারগুলো গুনে-টুনে সকৃতজ্ঞভাবে আল্লাকে প্রণিপাত জানালো, তোমার দান আমি খুশিমনে গ্রহণ করে ধন্য হলাম, আল্লাহ।

এই বলে সে তোড়াটা কোমরে বেঁধে পথে বেরুলো। ইহুদী ছুটে গিয়ে গোহার পথ আগলে দাঁড়ালো, আমার তোড়া ফেরত দাও।

গোহা বললো, তোমার তোড়া? কীসের তোড়া?

-দিনারের তোড়া, দাও ফেরত, একশো একটা দিনার আছে ওতে।

গোহা বললো, দেখ ইহুদী-সন্তান, ভালো চাও তো পথ ছাড়। তুমি কি ভেবেছ আল্লাহর কাছ থেকে রোজ যা পাবো সবই তোমাকে দেব? এই নাও, একটা দিনার বেশি আছে, এটা তুমি পেতে পার!

একটা চকচকে স্বর্ণমুদ্রা ইহুদীর নাকের ডগায় ছুঁড়ে দিয়ে হনহন করে নিজের কাজে চলে গেলো।

একদিন গোহা মসজিদে বসে ইমামের উপদেশ শুনছিলো : প্রত্যেক প্রকৃত ইসলামী স্বামীর প্রতিরাতে যথাকর্তব্য পালন করা উচিত। তাতে খোদার কাছে ভেড়া কোরবানীর পুণ্য লাভ হয়। দিবসকালে ধর্মপত্নীর সঙ্গে সহবাসের ফলে বান্দা মুক্তিদানের পুণ্য সঞ্চয় হয়। আর যে ব্যক্তি মধ্য রাত্রে বিবির সঙ্গে সহবাস করে একটি উট কোরবানীর সুফল পায় সে।

ঘরে ফিরে এসে বিবিকে ইমামের উপদেশের বাণী শোনায়। সেইদিন রাতে যথারীতি গোহা বিবিকে পাশে নিয়ে শুয়েছে। একটু পরে বৌটা দেখলো গোহা রতি-সঙ্গ করতে এগিয়ে আসছে না। তখন সে নিজে গোহাকে দু’হাতে কাছে টানতে টানতে বলে, কী নেতিয়ে পড়লে কেন, এসো, ওপরে এসো। ভেড়া কোরবানীর পুণ্য লাভ কর।

গোহা বিবির ডাকে সাড়া দিয়ে যথাকর্তব্য সম্পাদন করে আবার শুয়ে পড়লো পাশে। মাঝ রাতে বৌটা আবার গোহাকে টেনে তুললো, এসো ওপরে এসো। উট কোরবানীর পুণ্য করবে না?

ঘুমে জড়িয়ে আসছিলো গোহার চোখ। কিন্তু নাছোড়বান্দা বিবি। অগত্যা ঐ অবস্থাতেই কাজকাম সেরে বিছানায় ঢলে পড়লো সে।

রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

নয়শো চব্বিশতম রজনী :

আবার সে বলতে থাকে–

সকাল হতে না হতে বৌটা গোহাকে জাগিয়ে দেয়, দেখ দেখ, কত বেলা হয়ে গেছে। এখন তো রোদভরা সকাল। এসো, এসো ওপরে এসো, একটা বান্দা মুক্ত করার পুণ্য কি কম? এসো, পুণ্য সঞ্চয় করে নিই আমরা!

গোহা বললো, হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।

মুখে সম্মতি জানালো, কিন্তু কাজে ব্রতী হলো না। যেমনটি পড়েছিলো তেমনি পড়ে রইলো বিছানায়,

বৌটা ততক্ষণে কামার্ত হয়ে চড়া সুরে হুকুম করছে, কই, কাপ মেরে পড়ে রইলে কেন, এসো? বান্দা মুক্ত করার পুণ্য লাভ কর?

গোহা হাই তুলে বললো, আজকের মতো পুণ্যটা তুমি একাই সঞ্চয় কর সোনা! এ বান্দাকে মুক্তি দাও।

একদিন জগৎ বিখ্যাত তৈমুরলঙ তার সৈন্যসামন্ত সমভিব্যাহারে শহর উপান্তে এসে তাঁবু গাড়লো। শহরবাসীরা তটস্থ হয়ে উঠলো। তখন গোহা বললো, হতে পারে সে প্রবল পরাক্রমশালী, কিন্তু তা বলে আমি ডরাই না। তার কাছে যাবো আমি।

সাজ-পোশাক সেরে মাথায় মসলিনের পাগড়ী বাঁধলো একটা ইয়া মস্ত বড়। বাজারের সমস্ত দোকানে যত মসলিন ছিলো একত্র করে পাগড়ী জড়ালো সে মাথায়।

তাতার-সম্রাট অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, কীসের এই পাগড়ী, এতো বিরাট।

গোহা বিনয়ের অবতার হয়ে বললো, জী, এটা আমার রাতের সাজের ছোট টুপী, দুনিয়া মালিক। আসল টুপিটা তাড়াহুড়ায় পরে আসতে পারলাম না। ওটা ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে আসা হচ্ছে।

প্রবল প্রতাপ তৈমুরলঙ ভাবলো, এ তো সাধারণ মানুষ নয়। এতো বড় পেল্লায় টুপিটা যার রাতের সংক্ষিপ্ত সাজ, না জানি আসল জাঁকজমক তার কেমন!

আর ক্ষণকাল সেখানে অবস্থান করা সঙ্গত মনে করলো না তৈমুর। তবু খুলে লোকলস্কর সঙ্গে করে সেইদিনই সে সেদেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলো।

একদা গোহা সস্ত্রীক নদীর ধারে বেড়াচ্ছিল। এমন সময় পা পিছলে বৌটা স্রোতের মধ্যে তলিয়ে গেলো। গোহা আর কালবিলম্ব না করে তৎক্ষণাৎ জলে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণপণে উজানে যাবার চেষ্টা চালাতে থাকলো। পথচারীরা এই দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, ও সাহেব, উজান-সাঁতার দিয়ে ওদিকে যাচ্ছ কেন, তোমার বিবিজান তো স্রোতের টানে উল্টোদিকে চলে গেছে।

গোহা বললো, সাধারণতঃ কোন মানুষ ডুবে গেলে অতি স্বাভাবিক কারণেই স্রোতের টানে ভাটার দিকে চলে যায়, কিন্তু আমার বিবিকে তো আমি হাড়ে হাড়ে জানি; সব সময় সে উল্টোদিকে ছাড়া চলতে পারে না।

গোহার চুটকীগুলো শোনাবার পর শাহরাজাদ একটু থেমে সুলতান শারিয়ারের দিকে তাকিয়ে সপ্রশ্ন চোখে জিজ্ঞেস করলো, কেমন লাগলো জাঁহাপনা?

—চমৎকার—চমৎকার তোমার বলার কায়দা শাহরাজাদ। ভারি আনন্দ পেলাম শুনে। এরপর শাহরাজাদ আবার নতুন কাহিনী বলতে শুরু করলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *