উপন্যাস
গল্প
নাটিকা

১৪. কী পচা পাঁক

কী পচা পাঁক, আর কী বিচ্ছিরি গন্ধ! কতক্ষণ আর মাথা ড়ুবিয়ে থাকা যায় তার ভেতরে! একটু মাথা তুলি, আর বোঁ–ওঁ–ওঁ! সমানে চক্কর দিচ্ছে ভীমরুলেরা। এ কী ল্যাঠায় পড়া গেল!

ভাগ্যিস ডোবাটায় বেশি জল নেই, নইলে তো ড়ুবে মরতে হত! হাঁটুসমান কাদা আর একটুখানি জলের ভেতর কোনওমতে ঘাপটি মেরে বসে আছি। চারিদিকে ব্যাঙ লাফাচ্ছে–নাকে কানে পোকা ঢুকছে, ঠাণ্ডায় হাত-পা জমে যাচ্ছে। বাঘের গর্ত থেকে উঠে কি শেষতক পচা ডোবার মধ্যেই মারা যাব নাকি?

একবার মাথা ওঠাই–অমনি বোঁ-ও-ওঁ। আবার ড়ুব! অমনি করে কতক্ষণ কাটল জানি। তারপর যখন ভীমরুলেরা হতাশ হয়ে সরে পড়ল, তখন ভালো করে তাকিয়ে দেখে-টেখে আমি ডোবা থেকে উঠে এলুম।

ইঃ–কী খোলতাই চেহারাখানাই হয়েছে। একটু আগে আমি ছিলুম পটলডাঙার প্যালারাম ওজন ছিল সর্বসাকুল্যে এক মন সাত সের। এখন আমি যে কে–ঠাহরই করতে পারলুম না। সারা গায়ে কাদার আস্তর পড়েছে, নিজের হাত-পা জামা কাপড় কিছু দেখতে পাচ্ছি না–পা তো ফেলছি না, যেন হাতির মতো পদক্ষেপ করছি। আমি এখন ওজনে অন্তত সাড়ে তিন মন–মাথার ওপর আরও পোয়াটাক ব্যাঙাচি নাচানাচি করছে।

কিন্তু এমন কী করি! কোন্ দিকে যাই?

কাদা-টাদাগুলো খানিক পরিষ্কার করলুম, জামা জুতো ডোবার জলেই ধুয়ে নিলুম। কিন্তু এখন কোন দিকে যাই! শীতে সারা শরীর জমে যেতে চাইছে। চারিদিকে ঘন জঙ্গল কোথায় যাব, কী করব কিছুই ঠিক করতে পারলুম না। টেনিদার কী হল–চারমূর্তির বাকি তিনজনই বা কোথায় কুট্টিমামা তাঁর শিকারিদের নিয়েই বা কোন্ দিকে গেলেন?

সে ভাবনা পরে হবে। এখন এই শীতের হাত থেকে কেমন করে রেহাই পাই?

বনের পাতার ফাঁক দিয়ে এক জায়গায় ঝলমলে রোদ পড়েছে খানিকটা। বেলা এখন বোধহয় দুপুরের দিকে। আমি সেই রোদের মধ্যে এসে দাঁড়ালুম। বেশ ঝাঁঝালো রোদ–এতক্ষণে একটু আরাম পাচ্ছি।

কিন্তু ল্যাঠা কি আর একটা নাকি? এইবারে টের পেলুম–পেটের মধ্যে ছুঁই ছুঁই করে উঠেছে। মানে—জোর খিদে পেয়েছে।

যেই খিদেটা টের পেলুম অমনি মনে হল আমি যেন কতকাল খাইনি–নাড়িভুঁড়িগুলো সব আবার ছিড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে চাইছে। খিদের চোটে আর দাঁড়াতে পারছি না আমি। মনে পড়ল, আসবার সময় টিফিন ক্যারিয়ার-ভর্তি খাবার আনা হয়েছিল—তাতে লুচি ছিল, আলুর দম ছিল, বেগুন ভাজা ছিল, সন্দেশ ছিল—

হায়, কোথায় ভ্যান–কোথায় লুচি আর আলুর দম! জীবনে কোনও দিন কি আর আলুর দমের মুখ দেখতে পাব আমি। কিছুক্ষণ পরে বনের ভেতরই পটলডাঙার প্যালারামের বারোটা বেজে যাবে। যদি বাঘ-ভালুকে না খায়, খিদেতেই মারা যাব।

নাঃ, আর পারা যায় না! কিছু একটা খাবার-দাবার জোগাড় করা দরকার।

যেই খাবার-দাবারের কথা ভাবলুম অমনি শরীরে তেজ এসে গেল। আমি দেখেছি, আমার এই রকমই হয়। সেই একবার হাবুলের ছোট ভাই বাবুলের অন্নপ্রাশনে নেমন্তন্ন ছিল। আগের দিন রাতে কোঁ-কোঁ করে জ্বর এসে গেল। ভাবলুম, পরদিন ওরা সবাই প্রেমসে মাংস-পোলাও সাঁটবে আর আমার বরাতে কেবল বার্লির জল। দারুণ মনের জোর নিয়ে এলুম। বললে বিশ্বাস করবে না, সকালেই জ্বর একদম রেমিশন। খেয়েছিলুমও ঠেসে। অবশ্য সেদিন রাত থেকে…কিন্তু সে কথা বলে আর কাজ নেই। মানে, নেমন্তন্নটা তো আর ফসকাতে দিইনি!

আপাতত আমায় খেতেই হবে। শীতফীত চুলোয় যাক।

বনে তো অনেক রকম ফল-পাকড় থাকে শুনেছি। মুনি-ঋষিরা সেইসব খেয়েই তপস্যা করেন। আমি গাছের দিকে তাকাতে তাকাতে গুটিগুটি এগোলুম। দু ফল কোথায়? কেবল পাতা আর পাতা! ছাগল হলে অবিশ্যি ভাবনা ছিল না। বড়দা আমাকে ছাগল বলে বটে, কিন্তু আমি তো সত্যিই-সত্যিই ঘাস-পাতা খেতে পারি না! ফল পাই কোথায়।

একটা গাছের তলায় কালো কালো কটা কী যেন পড়ে রয়েছে। একটা তুলে কামড় দিয়ে–দেখি–বাপরে! ইটের চাইতেও শক্ত–দাঁত বসবে না। একটু দুরেই লাল টুকটুকে গোটা-দুই ফল লতা থেকে ঝুলছিল—দৌড়ে গিয়ে একটা ছিড়ে নিলুম। কামড় দিতেই–আরে রামো-রামো! কী বিচ্ছিরি ভেতরটাতে, আর কী দারুণ বদ গন্ধ! থুথু করে ফেলে দিতে পথ পাই না। তখন মনে পড়ল–আরে, এ তো মাকাল! এ তো আমি দেখেছি আগেই! ছ্যা! ছ্যা!

মুনি-ঋষিদের নিকুচি করেছে! বনে ফল থাকে, না ঘোড়ার ডিম থাকে। এখন বুঝতে পাচ্ছি সব গুলপট্টি! আমাকে লাখ টাকা দিলেও আমি কখনও সাধুসন্নিসি হব না–প্রাণ গেলেও না।

কিন্তু খাই কী।

–ক্র্যাং!

পেছনে কেমন একটা বিটকেল আওয়াজ। আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠলুম।

আবার সেই শব্দ : ক্র্যাং! ক্র্যাং!

এ আবার কী রে বাবা! কোথাও কিছু দেখছি না অথচ থেকে থেকে অমন যাচ্ছেতাই আওয়াজ করছে কে!

ক্র্যাং—কর-র-র–

একটা দৌড় মারব কি না ভাবছি—এমন সময় হুঁ হুঁ! ঠিক আবিষ্কার করেছি। আমার সঙ্গে ইয়ার্কি!

দেখি না, পাশেই একটা নালা। তার ভিতরে গোলগাল একটি ভদ্রলোক। ওই আওয়াজ তিনিই করছেন।

ভদ্রলোক? আরে হ্যাঁ—হ্যাঁ–ভদ্রলোক ছাড়া কী বলা যায় আর? একটি নধর নিটোল কোলা ব্যাঙ! পিঠের ওপর বড় বড় টোপ তোলা মস্ত মস্ত চোখ দুটো কানের মতো খাড়া হয়ে রয়েছে। আমার দিকে ড্যাবডেবে চোখ তুলে চেয়ে রয়েছে, আর থেকে থেকে শব্দ করছে; ক্রাংক্রাংকর কুরু

করছে কী জানো? ফুটবলের ব্লাডারে হাওয়া দিলে যেমন করে ফোলে, তেমনিভাবে গলার দুপাশে বাতাস ভরে নিচ্ছে, গলাটা মোটা হয়ে উঠছে। আর বাতাসটা যেমনি ছেড়ে দিচ্ছে অমনি শব্দ হচ্ছে; ক্র্যাং—কড়াং–

বটে! তাহলে এমনি করেই কোলাব্যাঙ ডাকে। সারা বর্ষা এইভাবে গ্যাঙর-গ্যাঙর করে।

আমি ব্যাঙটাকে বললুম, খুব যে মেজাজে বসে আছিস দেখছি!

ব্যাঙ একটা মস্ত লাল জিভ বের করে দেখালে।

–আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস বুঝি?

ব্যাঙ গলার দুধারে বাতাস জড়ো করতে লাগল।

—এক চাঁটিতে তোকে উড়িয়ে দিতে পারি তা জানিস?

ব্যাঙটা আওয়াজ করলে; ক্র্যাং—কুর্‌র্‌! মানে যেন বলতে চাইল; ইস, ইয়ার্কি নাকি? চেষ্টা করেই দেখ না একবার!

–বটে!

–ক্রুং—ফুর্‌র–

-জানিস, আমার বড্ড খিদে পেয়েছে? আমি ইচ্ছে করলে তোকে এক্ষুনি ভেজে খেতে পারি?

–তবে তাই খা—বলেই কে আমার পিঠে ঠাস্ করে একটা চাঁটি মারল।

–বাপরে–ভূত নাকি?

আমি হাত-তিনেক লাফিয়ে উঠলুম। তারপর দেখি, একমুখ দাঁত বের করে হাবুল সেন।

–হাবলা—তুই?

হাবুল বললে, হ, আমি। কিন্তু তোর এ কী দশা হইছে প্যালা? কাদা মাইখ্যা, ভূত সাইজ্যা অ্যাঁটা ব্যাঙের লগে মস্করা করতে আছস?

এই ফাঁকে ব্যাঙটা মস্ত লাফ দিয়ে ঝোপের মধ্যে কোথায় যেন চলে গেল।

আমি ব্যাজার হয়ে বললুম, খোশ-গল্প এখন থাক। কিছু খাবারের ব্যবস্থা করতে পারিস?

—আরে আমি খাবার পামু কই? সেই তখন থিক্যা জঙ্গলের মইধ্যে হারা উদ্দেশ্যে ঘুরতাছি। কে যে কোথায় চইলা গেল খুঁইজাই পাই না। শ্যাষে একটা গাছের নীচে শুইয়া ঘুম দিলাম।

–বনের মধ্যে ঘুমুলি?

-হ, ঘুমাইলাম।

—তোকে যদি বাঘে নিত?

হাবুল আবার একগাল হাসল; আমারে বাঘে খায় না।

–কী করে জানলি?

—আমি হাবুল স্যান না? উইঠ্যা বাঘেরে অ্যাঁমন অ্যাঁটা চোপড় দিমু যে—

বাকিটা হাবুল আর বলতে পারল না। হঠাৎ সমস্ত বন জঙ্গল কাঁপিয়ে কে যেন বিকট গলায় হ্যা-হ্যাঁ-হ্যাঁঃ করে হেসে উঠল। একেবারে আমাদের কানের কাছেই।

-ওরে বাপরে—

হাবুল আর ডাইনে বাঁয়ে তাকাল না। ঊধ্বশ্বাসে ছুট লাগাল।

আবার সেই শব্দ; হ্যা-হ্যা-হ্যাঃ—

এবার সেই ভিজে কাপড়ে জামায় আমিও হাবুলের পেছন দে ছুট–দে ছুট।

–ওরে হাবলা, দাঁড়া-দাঁড়া যাসনি আমাকে ফেলে যাসনি—