উপন্যাস
গল্প
নাটিকা

১২. শজারু সঙ্গীত

১২. শজারু সঙ্গীত

গর্তে পড়ে মনে হয়েছিল—পটলডাঙার প্যালারাম এবার একদম ফিনিশ—হাড়গোড় কিছু বুঝি আর রইল না। মরে গেছি—মরে গেছি–ভাবতে ভাবতে দেখি, আমি মোটেই মারা যাইনি। দিব্যি বহাল তবিয়তে একরাশ নরম কাদার ওপর পা ছড়িয়ে বসে আছি পিঠটা ঠেস দেওয়া রয়েছে মাটির দেওয়ালে।

কোমরটা কেবল একটু ঝনঝন করছে—মাথাতেও ঝাঁকুনি লেগেছে। সেটুকু সামলে নিয়ে চোখ মেলে তাকালুম। মাথার হাত-দশেক ওপরে একটা গোল আকাশ-আরও ওপরে একটা গাছের ডাল দুলছে। আশেপাশে চেয়ে দেখলুম অন্ধকার, গর্তটা কত বড় কিংবা আমি ছাড়া এর ভেতরে আর কী আছে, কিছু বুঝতে পারলুম না।

এমন সময় খুব কাছেই যেন একটা ঝমঝম করে শব্দ শুনতে পেলুম। ঠিক মনে হল কেউ যেন হাতে করে টাকার তোড়া বাজাচ্ছে।

আমার খাড়া খাড়া কান দুটো আরও খাড়া হয়ে উঠল। ব্যাপারখানা কী?

গর্তে যখন পড়েছি তখন তো মারাই গেছি। কিন্তু মরবার আগে সব ভালো করে জেনেশুনে নেওয়া দরকার, কারণ বইতেই পড়েছি : মৃত্যুকাল পর্যন্ত জ্ঞান সঞ্চয় করিবে। ওটা কীসের আওয়াজ?

মাথায় ঝাঁকুনি লাগবার জন্যেই বোধহয় চোখ এখনও ঝাপসা হয়ে রয়েছে। খুব লক্ষ করেও একদিকে ছোট একটা ছায়ার মতো ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলুম না। কিন্তু আবার শুনলুম কে যেন ফোঁসফোঁস করে নিশ্বাস ফেলছে, আর শব্দ উঠছে : ঝম-ঝম-ঝম–

অ্যাঁ–যখের গর্ত নাকি?

ভাবতেই আমার কানের ভেতরে গুবরে পোকারা কুরকুর করতে লাগল, নাকের ওপর যেন উচ্চিংড়ে লাফাতে লাগল, পেটের মধ্যে ছোট হয়ে-যাওয়া সেই পালাজ্বরের পিলেটা কচ্ছপের মতো শুড় বের করতে লাগল। শেষকালে কি পাতালে যখের রাজ্যে এসে পৌঁছে গেলুম? সেই কি অমন করে মোহরের থলি বাজিয়ে আওয়াজ করছে? একটু পরেই থলিটা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বলবে : বস প্যালারাম, অনেক কষ্ট করে তুমি এখানে এসে পৌঁছেছ দেখে ভারি খুশি হয়েছি, এবার এই মোহর নিয়ে তুমি দেশে চলে যাও বিরাট অট্টালিকা বানাও-ঘোড়াশালে ঘোড়া, হাতিশালে হাতি–

হাতির কথা ভাবতেই মনে হল, আমাদের লিডার টেনিদা বুনো হাতির পিঠে চড়ে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে। আমরা তাকে খুঁজতে বেরিয়েছিলুম। কিন্তু কোথায় টেনিদা—আমিই বা কোথায়? এই বিচ্ছিরি আফ্রিকার জঙ্গলেদানা, ম্যাডাগাস্কারের অরণ্যে—দুত্তোর ড়ুয়ার্সের এই যাচ্ছেতাই বনের ভেতর, আমাদের চারমূর্তিরই বারোটা বেজে গেল।

সব ভুলে গিয়ে আমার এখন একটু একটু কান্না পেতে লাগল। মাকে মনে পড়ছে, বাবা, ছোড়দি, বড়দা, ছোট বোন দুটোকে মনে পড়ছে, এমনকি, যে-মেজদা একবার পেট কামড়েছে বললেই দেড় হাত লম্বা একটা সিরিঞ্জ নিয়ে আমার পেটে ইঞ্জেকশন দিতে আসে, তাকেও মনে পড়ে যাচ্ছে। খুব ছোটবেলায় বড়দা একবার আমায় বলেছিল ঘড়ি দেখে আসতে। ঘড়ি দেখে এসে আমি খুব গম্ভীর চালে বলেছিলুম, সাড়ে দেড়টা বেজেছে, আর শুনেই বড়দা আমার একটা লম্বা কানে তিড়িং করে চিড়িং মেরে দিয়েছিল। হায় বড়দা আর কোনও দিন অমন করে আমার কানে মোচড় দেবে না!

বারোটা নয়, এবার সত্যিই আমার সাড়ে দেড়টা বেজে গেল!

আবার সেই ঝমঝম শব্দ! চমকে উঠলুম।

চোখটা মুছে চাইতে এবার আমার জ্ঞান লাভ হয়। ধ্যেৎ–যখ-টখ কিছু না—সব বোগাস। এতক্ষণে গর্তের ভেতরকার অন্ধকারটা চোখে খানিকটা ফিকে হয়ে এসেছে। দেখলুম বেড়ালের চাইতে একটু বড় কী একটা জন্তু হাত-চারেক দূরে দাঁড়িয়ে সমানে ফোঁসফোঁস আওয়াজ করছে। তার খুদে-খুদে চোখ দুটো অন্ধকারে চিকচিক করছে আর তার সারা শরীরে মোটা মোটা ঝাঁটার কাঠির মতো কী সব খাড়া হয়ে রয়েছে।

আমি বলে ফেললুম, তুই আবার কে রে? ঝাঁটা বাঁধা বেড়ালের মতো দেখতে?

শুনেই জন্তুটা গা ঝাড়া দিলে। আর তক্ষুনি আওয়াজ হল : ঝন-ঝম—ঝুমুর-ঝুমুর!

আরে, তাই বল! এইবারে বুঝেছি। মিস্টার শজারু। ছেলেবেলায় মল্লিকা মাসিমার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলুম শক্তিগড়ে। ওঁদের বাড়ির পাশে আমবাগানে রাত্তির বেলা শজারু ঘুরে বেড়াত আর ভয় পেলেই কাঁটা বাজিয়ে আওয়াজ করত ঝুম ঝুম! মল্লিকা মাসিমা বলতেন, শজারুর মাংস খেতে খুব ভালো। যখন কাঁটা উঁচিয়ে দাঁড়ায়, তখন দুম করে ওর পিঠের উপর একটা কলাগাছ ফেলে দিতে হয়। ব্যস—জব্দ। কাঁটা কলাগাছে আটকে যায়—আর পালাতে পারে না।

বুঝতে পারলুম, আমি পড়বার আগে শজারু মশাইও কী করে গর্তে পড়েছেন। তাই আমি আসাতে খুব রাগ হয়েছে—ভাবছেন, আমিই বুঝি প্যাঁচ কষিয়ে ওঁকে ফেলে দিয়েছি। তাই খুব কাঁটা ফুলিয়ে আমাকে ভয় দেখানো হচ্ছে।

আমার খুব মজা লাগল। থাকত কলাগাছ–লম্ফঝম্ফ তোমার বেরিয়ে যেত! এখন দাপাদাপি করো—যত ইচ্ছে!

আরে, মারা যখন গেছিই, তখন আর ভাবনা কী! শজারুটার ফোঁসফোঁসানি দেখে আমার দস্তুরমতো গান পেয়ে গেল। তোমরা তো জানোই—দেখতে আমি রোগা-পটকা হলে কী হয়—গান ধরলে আমার গলা থেকে এমনি হালুষ রাগিণী বেরুতে থাকে যে ক্যাবলাদের রামছাগলটা পর্যন্ত দারুণ ঘাবড়ে গিয়ে ম্যা-হা-হা বলে চিৎকার ছাড়ে। শজারুটা যাতে তেড়ে এসে আমাকে কয়েকটা খোঁচা-টোচা না লাগিয়ে দেয়, সেজন্যে ওকে ভেবড়ে দেবার জন্যে আমি হাউ-মাউ করে হ-য-ব-র-ল থেকে গাইতে শুরু করলাম :

বাদুড় বলে, ওরে ও ভাই শজারু,
আজকে রাতে হবে একটা মজারু—

সেই বন্ধ গর্তের ভেতর আমার বেয়াড়া গলার বাজখাঁই গান যে কেমন খোলতাই হল—সে বোধহয় না বললেও চলে। এমন পিলে কাঁপানো আওয়াজ বেরুল যে শুনে নিজেই আমি চমকে গেলুম। শজারুটা তিড়িক করে একটা লাফ মারল।

এই রে, তেড়ে আসে নাকি আমার দিকে! ওর গোটাকয়েক কাঁটা গায়ে ফুটিয়ে দিলেই তো গেছি—একেবারে ভীষ্মের শরশয্যা! প্রাণের দায়ে জোর গলা-খাঁকারি দিয়ে আবার আরম্ভ করলুম :

আসবে সেথায় প্যাঁচা এবং প্যাঁচানি—

শজারুটা এবার কেমন একটা আওয়াজ করলে। তারপর আমার দিকে আর না এগিয়ে–সুড়সুড়িয়ে আরও পেছনে সরে গেল, কাঁটা ফুলিয়ে কোণে গোল হয়ে বসে রইল। আমার গানের তোয় আপাতত বিপর্যস্ত হয়ে গেছে মনে হল—সহজে যে আর আক্রমণ করবে এমন বোধ হচ্ছে না।

ও থাক বসে। আমিও বসি। কিন্তু আমিও বসব? বসে থেকে আমার কী লাভ? আমি তো এখনও মরিনি। উপর থেকে হাত-দশেক নীচে একটা গর্তের মধ্যে পড়েছি বটে, তাই বলে এখনও তো আমার পঞ্চত্ব পাওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। একটু চেষ্টা করলে হয়তো আরও কিছুদিন শেয়ালদা বাজারের শিঙিমাছ আর কচি পটোল সাবাড় করবার জন্যে আমি বেঁচে থাকতে পারি।

আর শুধু নিজের বাঁচাটাই কি বড় কথা? আমাদের বাংলার প্রফেসর একদিন পড়াতে পড়াতে বলেছিলেন, নিজের জন্যে বাঁচে জানোয়ারেরা, সকলের জন্য বাঁচে মানুষ। আমি পটলডাঙার প্যালারাম-রোগা-পটকা হতে পারি, ভিতু হতে পারি, কিন্তু আমি মানুষ। খালি আমার নিজের কথাই তো ভাবলে চলবে না। আমাদের লিডার টেনিদাকে যেমন করে হোক উদ্ধার করতে হবে, চার মূর্তির আর সবাই কোথাও যদি কেউ বিপদে পড়ে থাকে তাদের বাঁচাতে হবে। আমি বাঁচব-সকলের জন্যেই বাঁচব!

গর্তের কোনায় গোল-হয়ে বসে থাকা শজারুটা কেমন ফ্যাঁচ-ফ্যাঁচ করে উঠল। আমার মনে হল, যেন রাষ্ট্রভাষায় বললে, কেয়াবাৎ-কেয়াবাৎ! অথাৎ কিনা শাবাশ, শাবাশ!

আবার মাথা তুলে চাইলুম। ওপরে গর্ত জুড়ে সেই গোল আকাশটুকু। একটা গাছের ডাল নেমে এসেছে, তার পাতা কাঁপছে ঝিরঝিরিয়ে। পারব না—একটু চেষ্টা করলে উঠে যেতে পারব না? তেনজিং এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে পারলেন—আমি একটা গর্ত বেয়ে উঠে যেতে পারব না ওপরে? তেনজিংয়ের তো আমার মতো দুখানা হাত আর দুখানা পা-ই ছিল! তবে?

দেখিই না একবার চেষ্টা করে। সেই-যে বইতে আছে না, যে মাটিতে পড়ে লোক, উঠে তাই ধরে? মাটির ভেতর দিয়ে আছড়ে পড়েছি, মাটি ধরেই উঠে যাব।

যা থাকে কপালে বলে উঠতে যাচ্ছি, আর ঠিক তখন–

হঠাৎ কানে এল বনবাদাড় ভেঙে কে যেন দুড়দাড় করে ছুটে আসছে। তার পরেই হুড়মুড় সরসরঝরঝর করে আওয়াজ। ঠিক মনে হল, গোল আকাশটা তালগোল পাকিয়ে নীচে আছড়ে পড়ল। আমার মুখ-চোখে ধুলো-মাটি আর গাছের পাতার পুষ্পবৃষ্টি হল, আর কী একা পেল্লায় জিনিস ধপধপপাস করে নেমে এল গর্তে প্রায় আমার গা ঘেঁষে। তার প্রকাণ্ড ল্যাজটা চাবুকের মতো আমার গায়ে ঘা মারল।

আর সেই বিরাট জন্তুটা গুরুর—হুম–বলে কানফাটানো এক চিৎকার ছাড়ল।

সে-চিৎকারে আমার মাথা ঘুরে গেল। চোখের সামনে দেখলুম সারি সারি সর্ষে ফুলের শোভা। উৎকট দুর্গন্ধে যেন দম আটকে আসতে চাইল।

গর্তে যে পড়েছে তাকে আমি দেখেছি। সে বাঘ! বাঘ ছাড়া আর কেউ নয়।

আমার তা হলে বারোটা নয় সাড়ে দেড়টাও নয়, পুরো সাড়ে আড়াইটে বেজে গেল। একবার আমি হাঁ করলুম, খুব সম্ভব গাঁ-গাঁ করে খানিক আওয়াজ বেরুল, তারপর

তারপর থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে গর্তের মাটিতে একেবারে পপাত।