উপন্যাস
গল্প
নাটিকা

০৫. শাখামৃগ কথা

০৫. শাখামৃগ কথা

অরণ্যের সেই করাল বিভীষিকার সামনে যখন হাবুল স্তম্ভিত, আমি প্রায় মূৰ্ছিত, ক্যাবলা খানিক দূরে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আর টেনিদার গগনভেদী আর্তনাদতখন

তখন আশ্চর্য সাহস ছোট্টলালের। মাটি থেকে একটা শুকনো ডাল কুড়িয়ে নিয়ে সে ছুটল সেই ভীষণ জন্তুটার দিকে : ভাগ—ভাগ জলদি।

টেনিদা তো গেছেই—বোধহয় ছোট্টুলালও গেল। আমি দু-চোখের পাতা আরও জোরে চেপে ধরেছি, এমনি সময় কিচকিচ কিচিংকাচুং বলেই একটা অদ্ভুত আওয়াজ, আর সঙ্গে সঙ্গে ক্যাবলার অট্টহাসি।

চমকে তাকিয়ে দেখি, বনের সেই বিভীষিকা টেনিদার ঘাড় ছেড়ে দিয়ে লাফে লাফে সামনের একটা উঁচু শিমুল ডালে উঠে যাচ্ছে। আর ছোট্টলাল শুকনো ডালটা উচিয়ে তাকে ডেকে বলছে : আও—আও—ভাগতা কেঁও। মারকে মারকে তেরি হাড্ডি হাম পটক দেব–হঁঃ!

কিন্তু হাড্ডি পটকাবার জন্যে সে আর গাছ থেকে নামবে বলে মনে হল না। বরং গাছের উপর থেকে তার দলের আরও পাঁচ-সাতজন দাঁত খিঁচিয়ে বললে, কিঁচ-কিঁচ কাঁচালঙ্কা–কিঞ্চিৎ–

এখনও কি ব্যাপারটা বলে দিতে হবে? ভয়ঙ্কর ব্যাপারটা আর কিছু নয়, একটা গোদা বানর।

ক্যাবলা তখনও হাসছে। বললে, টেনিদা–ছ্যা-ছ্যা! পটলডাঙার ছেলে হয়ে একটা বানরের ভয়ে তুমি ভিরমি গেলে!

টেনিদা মুখ ভেংচে বললে, থাম—থাম-বেশি চালিয়াতি করতে হবে না। কী করে বুঝব যে ওটা বানর? খামকা জঙ্গলের মধ্যে থেকে বেরিয়ে বিচ্ছিরি মুখ করে অমন করে ঘাড়টা খিমচে দিলে কার ভালো লাগে বল দিকি?

আমি বেশ কায়দা করে বললুম, আমি আর হাবলা তো দেখেই বুঝতে পেরেছিলুম যে ওটা বানর। তাই আমরা হাসছিলুম।

হাবুল বললে, হ-হ। আমরা খুবই হাসতে আছিলাম।

ছোট্টুলালই গোলমাল করে দিলে। বললে, কাঁহা হাঁসতে ছিলেন? আপলোগ তো ডর খাকে একদম ভূঁইপর বৈঠে গেলেন!

টেনিদা বললে, মরুক-গে, আর ভালো লাগছে না। মেজাজ-টেজাজ সব খিঁচড়ে গেছে। দিব্যি বিকেল বেলায় গান-টান গাইছিলুম, কোত্থেকে বিটকেল একটা গোদা বানর এসে দিলে মাটি করে।

ছোট্টুলাল বললে, আপ অত চিল্লালেন কেন? বান্দরকে কষিয়ে এক থাপ্পড় লাগিয়ে দিতেন—উসকো বদন বিগড়াইয়ে যেত–হঁঃ!

—তার আগে ও আমারই বদন বিগড়ে দিত! বাপরে কী দাঁত! নে বাপু, এখন বাড়ি চল। বাঁদরের পাল্লায় পড়ে পেটের খিদে বড্ড চাগিয়ে উঠেছে কিছু খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা যাক।

শিমুল গাছের উপর বানরগুলো তখনও কিচির-মিচির করছিল। ছোট্টলাল শুকনো ডালটা তাদের দেখিয়ে বললে, আও—একদফা উতার আও! এইসা মারেগা কি

উত্তরে পটাপট করে কয়েকটা শুকনো শিমুলের ফল ছুটে এল। আমি আঁই আঁই আঁই করে মাথাটা সরিয়ে না নিলে একটা ঠিক আমার নাকে এসে লাগত।

হাবুল সেন বললে, শূন্য থিক্যা গোলাবর্ষণ করতাছে—পাইরা উঠবা না! অখনি ধরাশায়ী কইর‍্যা দিব সক্কলরে।

বলতে বলতে—ঠকাস! ঠিক তাক-মাফিক একটা শিমুলের ফল এসে লেগেছে ছোটুলালের মাথায়! এ দাঃদ্দা বলেসে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল—আর তক্ষুনি ফলটা ফেটে চৌচির হয়ে শিমুল তুলো উড়তে লাগল চারিদিকে।

ছোটুলালের সব বীরত্ব উবে গেছে তখন।বহুৎ বদমাস বান্দরবলেই সে প্রাণপণে ছুট লাগাল। বলা বাহুল্য, আমরাও কি আর দাঁড়াই? পাঁচজনে মিলে অ্যাঁয়সা স্পিডে ছুটলাম যে অলিম্পিক রেকর্ড কোথায় লাগে তার কাছে! গাছের উপর থেকে বানরদের জয়ধ্বনি শোনা যেতে লাগল—পলাতক শত্রুদের ওরা যেন বলছে–দুয়ো, দুয়ো!

কুট্টিমামার কোয়ার্টারে ফিরে মন-মেজাজ যাচ্ছেতাই হয়ে গেল।

পটলডাঙার চারমূর্তি আমরা কোনও কিছু আমাদের দমাতে পারে না—শেষকালে কিনা একদল বানর আমাদের বিধ্বস্ত করে দিলে! ছ্যা-ছ্যা!

প্লেট-ভর্তি হালুয়ায় একটা খাবলা বসিয়ে টেনিদা বললে, কী রকম খামকা বাঁদরগুলো আমাদের ইনসাল্ট করলে বল দিকি!

ক্যাবলা বললে, অসহ্য অপমান!

আমি বললুম, এর প্রতিকার করতে হবে!

হাবুল বললে, হ, অবশ্যই প্রতিশোধ লইতে হইব।

টেনিদা বললে, যা বলেছিস–নির্মম প্রতিশোধ নেওয়া দরকার।–বলেই আমার হালুয়ার প্লেট ধরে এক টান।

আমি হাঁ-হাঁ করে উঠলুম, তা আমার প্লেট ধরে টানাটানি কেন? আমার ওপর প্রতিশোধ নিতে চাও নাকি?

—মেলা বকিসনি। টেনিদা থাবা দিয়ে আমার প্লেটের অর্ধেক হালুয়া তুলে নিলে : তোর ভালোর জন্যেই নিচ্ছি। অত খেয়ে তুই হজম করতে পারবি না—যা পেটরোগা।

—আর তুমি পেটমোটা হয়েই বা কী কীর্তিটা করলে শুনি?—আমার রাগ হয়ে গেল—একটা বানরের ভয়ে একদম মূছা যাচ্ছিলে!

–কী বললি?–বলে টেনিদা আমাকে একটা চাঁটি মারতে যাচ্ছিল, কিন্তু ক্যাবলা হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে এমন চেঁচিয়ে উঠল যে থমকে গেল টেনিদা।

ক্যাবলা বললে, টেনিদা, সর্বনাশ হয়ে গেল!

—কিসের সর্বনাশ রে?

–বানরটা তোমার ঘাড়ে আঁচড়ে দেয়নি তো?

—দিয়েছে বোধহয় একটু।—টেনিদা ভয়ানক ঘাবড়ে গিয়ে বললে, সে কিছু -সামান্য একটুখানি নখের আঁচড়। তা কী হয়েছে?

ক্যাবলা মুখটাকে প্যাঁচার মতন করে বললে, দিয়েছে তো একটু আঁচড়! বাস—আর দেখতে হবে না।

টেনিদার গলায় হালুয়ার তাল আটকে গেল।

কী দেখতে হবে না? অমন করছিস কেন? ক্যাবলা মোটা গলায় জিজ্ঞেস করলে, কুকুরে কামড়ালে কী হয়? হাবুল দারুণ উৎসাহে বললে, কী আবার হইব? জলাতঙ্ক।

টেনিদার মুখখানা কুঁকড়ে-টুকড়ে কি রকম যেন হয়ে গেল। ঠিক একতাল হালুয়ার মতো হয়ে গেল বলা চলে।

—কিন্তু আমাকে তো কুকুরে কামড়ায়নি। আর, মাত্র একটু আঁচড়ে দিয়েছে তাতে এইবার আমি কায়দা পেয়ে বললুম, যা হবার ওতেই হবে—দেখে নিয়ে।

–কী হবে? টেনিদার হালুয়ার মতো মুখটা এবার ডিমের ডালনার মতো হয়ে গেল। ক্যাবলা খুব গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বললে, কেন, প্রেমেন মিত্তিরের গল্প পড়োনি? হবে স্থলাতঙ্ক।

–অ্যাঁ।

—তারপর তুমি আর মাটিতে থাকতে পারবে না। বানরের মতো কিচমিচ আওয়াজ করবে–

আমি বললুম, এক লাফে গাছে উঠে পড়বে—

হাবুল সেন বললে, আর গাছের ডালে বইসা বইস্যা কচিকচি পাতা ছিড়া ছিড়া খাইবা।

টেনিদা হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠল : আর বলিসনি—সত্যি আর বলিসনি। আমি বেজায় নাভার্স হয়ে যাচ্ছি। ঠিক কেঁদে ফেলব বলে দিলুম।

বোধহয় কেঁদেও ফেলতহঠাৎ কুট্টিমামা এসে গেলেন।

–কী হয়েছে রে? এত গণ্ডগোল কেন?

–মামা, আমার স্থলাতঙ্ক হবে—টেনিদা আর্তনাদ করে উঠল।

–স্থলাতঙ্ক! তার মানে?-কুট্টিমামার চোখ কপালে চড়ে গেল।

আমরা সমস্বরে ব্যাপারটা যে কী তা বোঝাতে আরম্ভ করলুম। শুনে কুট্টিমামা হেসেই অস্থির। বললেন, ভয় নেই, কিছু হবে না। একটু আইডিন লাগিয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

শুনে টেনিদার সে কী হাসি! বত্রিশটা দাঁতই বেরিয়ে গেল যেন।

—তা কি আর আমি জানি না মামা। এই প্যালারামকেই একটু ঘাবড়ে দিচ্ছিলুম কেবল। চালিয়াতিটা দেখলে একবার?