২৯. সোমনাথ যখন কফিনে

২৯. সোমনাথ যখন কফিনে

রবি রে যে ডিটেকটিভ নামক বস্তুটিকে সঙ্গে এনেছিল আমাকে কাত করার জন্যে, তাকে দেখতে অনেকটা সিনেমার ব্যামবোর মতো। গুলি গুলি চোখে বরফ শীতলতা, হাত-পা গর্দানের পেশিগুলো ইস্পাতের তার বললেই চলে। রবি আমাকে চেনে। আমি নবনীত কোমল কবি-কবি দর্শনধারী হতে পারি, কিন্তু প্রয়োজনে শরীরী বিভীয়িকা হয়ে যেতে পারি। যুদ্ধের দামামা যখন বাজে মাথার মধ্যে, তখন বিদ্যুৎ খেলে যায় প্রতিটি পেশির প্রতিটি তন্তুতে। ইন্দ্রনাথ সখন নৃশংস হয় এই কাহিনী যাঁরা পাঠ করেছেন, তারা অন্তত জানেন, আমি কি দিয়ে তৈরি।

রবি রে’র তা অজানা নয়। তাই কোত্থেকে জুটিয়ে এনেছে এই র্যামবো মার্কা মস্তানটাকে।

আমি ছিলাম আমার কোয়ার্টারে। পাহাড়ের খাদের ধরে আমাদের এই বাড়িটা ইংরেজি ‘ইউ প্যাটার্নে তৈরি। দোতলা বাড়ি। অনেকগুলো অ্যাপার্টমেন্ট। আমি থাকতাম একটা প্রান্তে, সোমনাথের মা আর এক প্রান্তে। রবি এসে উঠেছিল সেই প্রান্তের অ্যাপার্টমেন্টে—সোমনাথের বাবা যে—তার মায়ের কাছেই তো যাবে। ছেলে এমনই জিনিস। সন্তান যখন বিপদে, তখন বাপ-মা কাছে চলে আসে-বন্ধু। হয় পর। আমে দুধে মিশে যায়, আঁটি যায় বাদ।

আমি তাতে আঘাত পাইনি। এসব ব্যাপারে আমার ভেতরটা পাথর হয়ে গেছে অনেক আগে। কবিতা বউদি আমাকে কলির কেষ্ট বালে খেপায় বটে, কিন্তু সমস্ত সত্তা দিয়ে জানে—অশরীরী, হায়না, চিতা আর গরিলা—এই সব কটি পদার্থ দিয়ে গড়া তার প্রাণপ্রিয় ঠাকুরপো। কিন্তু পাথরও মুচড়ে ওঠে। হে পাঠক, হে পাঠিকা—আপনারা অন্তত তা জানেন।

যাক গে, বড় বেশি নিজের কথা লিখছি। কেন লিখছি? ডায়েরিতে সব্বাই প্রাণ খুলেই মনের কথা লিখে যায়, আমার এই কাহিনিও মাঝে মধ্যে ডাইরি

স্টাইল নিচ্ছে। বিশেষ করে যখন মনে বেদনা আসে।

সেদিনও মনে কষ্ট পেয়েছিলাম। মানুষ তো আমি। বন্ধুকৃত্য করতে কলকাতার আরাম ছেড়ে এই পাহাড়ি মুলুকে এসেছি নিখোঁজ হিরের সন্ধানে। যে হিরে আছে পাথরের ডিমের মধ্যে, যে হিরে আর পাওয়া যায়নি।

যাবে কি করে? নাটের গুরু যে কল্পনা। এই কারণেই রবি আমাকে লেলিয়ে দিয়েছিল। তার একদা অর্ধাঙ্গিনীই সাত পাকে বেঁধে বিয়ে করা বরের কানে ফুসমন্ত্র দিয়ে তাকে ঘুরিয়ে দিল আমার দিকে।

আমি নাকি মনের দিক দিয়ে পাথর? কবিতা বউদি উঠতে বসতে মুখনাড়া। দেয় আমাকে এই একটা পয়েন্টে। তবে কেন সেদিন প্রিয় বন্ধুর বাস্পীভূত অনুরাগের প্রত্যাবর্তন দেখে আমি অত কষ্ট পেয়েছিলাম?

বহুদর্শিনী পাঠিকা নিশ্চয় মুচকি হাসছেন। মনে মনে বলছেন, কত রঙ্গ দেখলাম ইন্দ্রনাথ রুদ্রের, দেখছি আর এক রঙ্গ। আগুন কাছে থাকলে ঘি গলবেই। ইন্দ্রনাথ তো ছার!

যে যা ভাবে ভাবুন, আমি বলে যাই আমার কাহিনি। ছোট করে।

রবি রে’র র্যামবো ডিটেকটিভ রক্ত চোখে আমাকে বললে, কোথায় রেখেছেন ছেলেটাকে?

সুফি ওর হাল্কা মার্কা বডিটাকে আমাদের মাঝখানে এনে ফেলে বললে, শাট আপ।

আমি আপার কাট’ ঝাড়ব কিনা যখন ভাবছি, পাহাড়ের মেয়ে সেই পুলিশ পুঙ্গবী পাথুরে গলায় বললেন, ব্যস বস, আর না। কোস্তাকুতি নট অ্যালাউড। পুলিশ টেক আপ করেছে কিডন্যাপিং কেস। আপনারা হেল্প করতে চান, করুন, প্লীজ, ফাইট করবেন না। লকআপে ঢুকিয়ে দেব।

কড়া গলা পর্বত কন্যার। তার পরেই সুর নরম করে বললেন, সোমনাথের কমপিউটার রয়েছে। বাচ্চারা ই-মেল নিয়ে অনেক কাণ্ড করে। সেই খোঁজ করছে। পুলিশ ডিপার্টমেন্ট। সে যদি নিজেই নিজেকে কিডন্যাপ করে থাকে, তা ফাঁস হয়ে যাবে। আমার তো তাই মনে হয়। ডিভোর্সি দম্পতির ছেলেমেয়েরা ইনসিকিওরড ফিল করলে এমনটা করে। আকছার ঘটছে। এখন—সুফির অপার্থিব আকৃতির কুকুরটাকে দেখিয়ে-এর নাকের হেল্প নেওয়া যাক।

তখনই কুকুর নামানো হয়েছিল শেষ পদচিহ্ন যেখানে দেখা গেছিল—সেখানে। সে যে গন্ধটা শুকে চনমনে হয়ে উঠেছিল, সুবুদ্ধি পাঠক এবং পাঠিকা ত অনেক আগেই ধারে ফেলেছেন…

ডিজেলের গন্ধ!

এবার দেখা যাক, কফিনের মধ্যে সোমনাথ কী করছে। পাঠক এবং পাঠিকা, আপনারা তো অনিমা, লঘিমা প্রমুখ অষ্টসিদ্ধি করতলগত করে বসে আছেন। আপনাদের অজানা, আপনাদের অগম্য কিছুই নেই এই ত্রিভুবনে। সুতরাং…

 

সোমনাথের মাথার ওপর দেখা গেছিল একটা আলোক বিন্দু। বহু দূরের নক্ষত্রের মতো ঝিকিমিকি আলোক কণা, সকালের দিকে। নিশ্চয় বাতাসের ফটো কেটে রাখা হয়েছে কফিনেব ডালায়। সেই ফুটোয় চোখ লাগিয়ে সে দেখেছিল, টিউবের মধ্যে দিয়ে বহুদূরের এক কণা নীল চাকতি।

ফুটোয় মুখ ঠেকিয়ে, মুখের দু’পাশে দু’হাতের চেটো জড়ো করে চেঁচিয়েছিল তারস্বরে—বাঁচান! বাঁচান! আমি এখানে—মাটির তলায়! হেল্প! হেল্প মি: আই অ্যাম ডাউন হিয়ার!

কেউ জবাব দেয়নি।

হেল্প!

সারারাতে অনেক মেহনৎ করেছে সোমনাথ। ফিতের বাঁধন থেকে মুক্ত করেছে দু’হাত আর দু’পা। লাথিয়ে ভাঙবার চেষ্টা করেছে কফিনের প্লাস্টিক দেওয়াল। কিডন্যাপাররা নিশ্চয় চম্পট দিয়েছে এতক্ষণে। কেউ জানে না একটা জ্যান্ত ছেলেকে অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা করে শুইয়ে রাখা হয়েছে মাটির নিচে। পেটের জ্বালায়, তেষ্টার কষ্টে পটকে যাবে যথাসময়ে—কেউ জানতেও পারবে না। অনেক লাথিয়ে, অনেক চেঁচিয়ে শেষকালে বেদম হয়ে ঘুমিয়ে নিয়েছিল। এক চোট। তার পরেই ফের শুরু হয়েছিল হাত-পা ছোঁড়া আর মা-মা চিৎকার।

আর তারপরেই কে যেন কাঁৎ করে একটা লাথি কষিয়েছিল তার পেটে। পরক্ষণেই যেন দশ হাজার ভোল্টের ইলেকট্রিক শক গোটা শরীরটাকে স্থান করে দিয়েছিল এক চাবুকেই। বৈদ্যুতিক চাবুক।

চোপ। চেঁচাবি না?

বাক্সের কিনারায় উঁকি দিচ্ছে গেমস ফিকের সেই মারকুটে কালিকা রানি। চাহনিতে জিঘাংসা!

চিল চিৎকার করে সোমনাথ বলেছিল, তুই তো সত্যি নস! মিথ্যে!

তাই নাকি? তাহলে খ আর একটা লাথি। লাগবে না। আমি তো মিথ্যে!

ককিয়ে উঠেছিল সোমনাথ।

আর তখনই চোখে পড়েছিল কালিকা রানির আঙুলের লম্বা লম্বা নখের ঝিলিক। ছুঁচোলো নখ, ছুরির ফলার মতো, ঝকঝকে। এই নখ চালিয়ে শত্রুকে ফালাফালা করে দেওয়ার অদ্ভুত কমব্যাট কৌশল গেমস ফিক খেলনায় দেখিয়েছে কালিকা রানি।

এখন দেখাবে নাকি সোেমনাথকে? শিউরে উঠে সিটিয়ে গেছিল দশ বছরের ডানপিটে।

দশ আঙুল-নখের দশখানা ছুরি সোমনাথের চোখের সামনে দিয়ে টেনে নিয়ে গিয়ে বলেছিল কালিকা রানি–গাধা কোথাকার। ধার দেখেছিস ডগায়? দশখানা তুরপুন। ফুটিয়ে দিলে–

আমি বাড়ি যাব।

দেব তোর পেট চিরে—ফের যদি চেঁচাবি।

মা…মা…

তবে রে! কালিকা রানি লাফিয়ে আসতেই… তিড়বিড়িয়ে ছিটকে যেতে গেছিল সোমনাথ। আর ঠিকতখাই, প্যান্টের পকেটে থাকা জিনিসটা প্যাট করে ফুটে গেছিল উরুর চামড়ায়। রুপোর সেই তারকা। যা সে পেয়েছিল… ইন্দ্রনাথ রুদ্রের কাছে প্রেজেন্টেশন হিসেবে-সময় মতো কাজে লাগিয়ে মস্ত বীর হওয়ার জন্যে…

এসেছে সেই সময়!

 

দুঃস্বপ্ন তিরোহিত হয়েছিল তৎক্ষণাৎ। স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে কালিকা রানি ধরিয়ে দিয়ে গেছে কফিন কেটে বেরোনোর হদিশ।

পঞ্চকোণ রজত তারকা দিয়ে সেই মুহূর্তে প্লাস্টিক কফিনের ডালা কাটতে শুরু করেছিল সোমনাথ। ছুরির মতো ধারালো প্রতিটা ডগা। আঙুল বুলিয়ে বুলিয়ে দেখছিল কাটা হল কতখানি। চোখে পড়েছিল এক লাইনের ক্ষীণ আকাশ।

বিপুল উদ্যমে মরিয়া ছেলেটা পঞ্চকোণের পঞ্চ ছুরি চালিয়ে চালিয়ে কেটে কেটে গেছিল কফিনের ঢাকনা। ঝুরঝুর করে প্লাস্টিকের গুঁড়ো ছড়িয়ে গেছিল সারা গায়ে…

 

ঠিক সেই সময়ে দুই কিডন্যাপারের মধ্যে কথা চলছে এইভাবে :

অ্যালোপেসিয়া আতঙ্ক—ছেলেটাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে।

মর্কটপ্রতিম সাগরেদ (যে চালিয়েছে সাদা ভ্যান) : কিসের চিন্তা? ছোঁড়া রয়েছে তিন ফুট ধুলোর নিচে।

বেঁচে আছে কিনা একবার দেখা দরকার। তারপর ফোনে জানিয়ে দিতে হবে পার্টিকে—হিরে চাই, নইলে পাবে লাশ।

মর্কট কিডন্যাপার রিভলভারটা ট্রাউজার্সের পকেটে ঢুকিয়ে পা বাড়িয়েছিল গ্যারেজের দিকে।

অ্যালোপেসিয়া ততঙ্ক বলেছিল পেছন থেকে—হিরে না পেলে করবি কি ছোঁড়াটাকে নিয়ে?

পদক্ষেপে বিরতি না দিয়ে বলেছিল মর্কটাকৃতি ড্রাইভার—বাক্সের ফুটো বন্ধ করে দেব।

 

এই যে এত ঘটনা ঘটে চলেছে সিকিমের পাহাড়ি অঞ্চলে, যেখানে ঘটছে, সেই জায়গাটা নিয়ে একটা শব্দও লেখা হয়নি এতক্ষণ। কাহিনির মূল টানে ভেসে গেছিলাম যে। তাছাড়া সাহিত্যের রস বিতরণেও আমি অপারগ! মৃগাঙ্ক লিখতে বসনে। শুধু প্রাকৃতিক বর্ণনায় কাহিনি ভরিয়ে দিত।

কিন্তু আমি নেহাতই অকবি—চেহারায় যদিও অন্যরকম। তাই ছোট্ট করে ছুঁয়ে যাচ্ছি রোমাঞ্চকর এই প্রাণ নিয়ে টানাটানির লীলাক্ষেত্র সম্পর্কে দু’চার কথা।

সিকিমে খেচিপেড়ি নামে একটা লেক আছে। এই লেক লেপচাদের কাছে বড় পবিত্র হ্রদ! উচ্চতায় এক হাজার আটশো কুড়ি মিটার। এই সরোবরের চারদিকে সারি সারি পতাকা ওড়ে সারবন্দী খুঁটির ডগায়। কৌতূহলোদ্দীপক একটা কিংবদন্তী আছে এই সরোবর সম্পর্কে। এত তো গাছ সরোবর ঘিরে। কিন্তু গাছের পাতা পড়ে না সরোবরের জলে। পড়লেই ছোঁ মেরে সেই পাতা তুলে নিয়ে যায় একটা na একটা পাখি। বিশুদ্ধ জলকে অশুদ্ধ হতে না দেওয়ার মহান দায়িত্ব যেন এখানকার বিহঙ্গকুলের। তাই সরোবর সব সময়ে টলটলে স্বচ্ছ-দর্পণপ্রতিম।

এ সরোবরের নাম ইচ্ছাপূরণের সরোবর। যারা বৌদ্ধ, যারা লেপচা, তারা বিশ্বাস করে-কল্পতরু সরোবর কারও মনের বাসনা অপূর্ণ রাখে না। দীঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে যা চাওয়া যায়, তাই পাওয়া যায়।

কুলিশ কঠোর এই কাহিনির মাঝে আচমকা ইচ্ছাপূরণের লেকের কথা নিয়ে এলাম কেন, তা জানতেই অবশ্যই আগ্রহী হয়েছেন নিবিষ্ট পাঠক এবং পাঠিকা।

কারণ আছে…কারণ আছে…ব্যাপারটা যদিও গভীর গোপন—কিন্তু দৈবাৎ আমি জেনে ফেলেছিলাম।

এই সরোবরের পাড়ে একদা হানিমুন করতে এসেছিল কল্পনা আর রবি। তখন দুজনেরই চোখে অনেক…অনেক স্বপ্নের রামধনু…যে রামধনু কিছু দূরের কাঞ্চনজংঘা। ফলস থেকে বিচ্ছুরিত সুর্যের সাতটা রঙের রামধনুকেও হার মানিয়ে দিয়েছিল। ইচ্ছাপূরণ সরোবরের পাড়ে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে দু’জনে নিবেদন করেছিল

একটাই ইচ্ছা : ছেলে হোক আমাদের।

এসেছিল সেই ছেলে–সোমনাথ।

আর সেই ছেলেই জ্যান্ত কবরস্থ হতে চলেছে এই অঞ্চলেরই গভীর গোপন। একটা সদ্য গড়ে ওঠা রিসর্টে। সোজা বাংলায় যা বদমাইসি করার আখড়া। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘেরা এমন নিরালা জায়গাতেই তো শরীরী প্রেম জমে-বিয়ে না করেই—জমে পরকীয়া লীলা যা লাম্পট্যের অপর এক নাম। এখানকার ঘরে ঘরে চলে পর্নো সিডি…তোলাও হয় পর্নো ভিসিডি…যে বস্তুটার রমরমা ব্যবসা শুধু ভারতের মেট্রো সিটিগুলোতেই আটকে নেই—চালান যাচ্ছে বিদেশে…ভারতীয় লাস্যময়ীদের নগ্ন কেচ্ছার বাজার যে সেখানে অনেক বেশি। অশালীন ছবির বাজার যুগ যুগ ধরে রমরমা থেকেছে তামাম দুনিয়ায়। কিন্তু সেই শিল্পে এখন ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে এমন ফলের রস যার মধ্যে থাকে শরীর তাতানো আর নাচানোর মাদক দ্রব্য, বেশরম হওয়ার মতো দ্রব্য, হেসে কুটিপাটি হওয়ার জন্যে ঘরময় ছড়িয়ে দেওয়া হয় লাফিং গ্যাস, জুগিয়ে যায় মনের আনন্দ আর প্রাণের আরাম, খোদ ডেভিলকে বন্দনা করে ডেয়ারিং অবৈধ সম্পর্ক স্থাপনের এমন জায়গা তো পাহাড়ী অঞ্চলেই নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাওয়া যায়…।

সোমনাথ জীবন্ত কবরস্থ হতে চলেছে রমরমা এই রিসর্টের সন্নিকটে।

ঠিকানা? দুঃখিত। জানতে চাইবেন না। সবইনফরমেশন সবাইকে দেওয়া যায় না।

রিসর্টটার নাম?

তন্ত্রমন্ত্র।

উদ্দামতার আজ্ঞা তন্ত্রমন্ত্র। নিরিবিলিতে নষ্টামি করার রিসর্ট তন্ত্রমন্ত্র। ইণ্ডিয়ান পুলিশের নাগালের বাইরে—অথচ কোটিপতি ইণ্ডিয়ানদের লাম্পট্য চলে এইখানেই। ইন্ধন জুগিয়ে যায় বিবিধ নারকোটিক; যেমন, এক্সট্যাসি, জিএইচবি অথবা লিকুইড এক্সট্যাসি, মিথ্যামফিটামাইন বা স্পীড, ফেটামাইন বা কে অথবা ক্যাট ভেলিয়াম, রোহিপনল অথবা ফিজ বা ফরগেট মি বড়ি, নাইট্রাস অক্সাইড বা লাফিং গ্যাস, এলএসডি—যা অ্যাসিড। এর সঙ্গে চলে মাতাল করার মিউজিক আর স্ট্যাকাটো ড্যান্স। শরীর তখন শরীরে লেগে যায়…এক শরীরের টান আর এক শরীর রুখতে পারে না…রুখতে চায় না…

থাক আরও বর্ণনা। বিধাতার নির্মম প্রহসনের কিঞ্চিৎ আভাস দেওয়ার জন্যেই নক্কার জনক প্রসঙ্গে কিছুটা ছুঁয়ে গেলাম। এ হেন নরকের কাছেই নির্মিত হতে চলেছে আর এক নরক…

সোমনাথের জীবন্ত কবর!

 

সোমনাথের ধমনীতে বইছে কিন্তু রবি রে’র রক্ত। বংশগতির মহিমা দেখিয়ে গেছিল কফিনে চিৎ অবস্থায় শুয়ে। হাতের মুঠোয় ইন্দ্রনাথ রদ্রের রৌপ্যপদক-সিলভার স্টার।

ধারালো কোণ দিয়ে ঘসে ঘসে কেটেছে প্লাস্টিক কফিনের ঢাকনা। ঝুর ঝুর করে ধুলো ঝরেছে, একটার পর একটা কোণ ভোতা হয়েছে, পরপর তিনটে কোণের ধার যখন চলে গেছে, চতুর্থ কোণ দিয়ে কাজ আরম্ভ করতেই দেখেছিল, মাথার ওপর ফুটো দিয়ে তারার আলো আর আসছে না।

পরক্ষণেই ভেসে এসেছিল দুশমন কণ্ঠস্বর, বেঁচে আছিস?

জবাব দেয়নি সোমনাথ।

দুই কিডন্যাপার এসেছে খোঁজ নিতে। কেন জবাব দেবে সোমনাথ?

শোনা গেল কণ্ঠস্বর–নিশ্চয় ঘুমোচ্ছে।

অন্য কণ্ঠস্বর—অথবা মটকা মেরে রয়েছে। এই অবস্থায় কেউ ঘুমোয়?

তাহলে থাক।

নৈঃশব্দ্য ফিরে এল মাথার ওপর। একটু সবুর করল সোমনাথ। রুপোর কোণ দিয়ে ঘষে ঘষে প্লাস্টিক কাটা শুরু হল তার পরেই। খুব আস্তে…খুচ খুচ খুচ করে…আওয়াজ যেন ওপরে না যায়।

অনেক পবে পেয়েছিল কঠোর কেরামতির পুরস্কার। ধুস করে কাটা প্লাস্টিক আচ্ছাদন ধসে পড়েছিল গোটা শরীরটার ওপর। ওপরকার তিনফুট ধুলোর ওজন তো কম নয়।

কিন্তু ঘাবড়ায়নি সোমনাথ। টু শব্দও করেনি। গায়ের জোরে প্লাস্টিক ডালা সামেত ধুলোর বোঝা মাথার ওপর তুলে যখন বেরিয়ে আসছে কবরের গর্ত থেকে, ছুটে এসেছিল দুই কিডন্যাপার। একটু দূরে থাকলেও তাদের চোখ ছিল যে এইদিকেই। পঞ্চানন ঘোষালের ‘অপরাধ বিজ্ঞান’ পুস্তকে এমন কথাই তো লেখা আছে : অপরাধী অপরাধের জায়গায় ঘুরে ফিরে আসে…

তাই তারা প্রথমে দেখেছিল কবরের ঝুরো মাটি তোলপাড় হচ্ছে, তারপরেই দেখেছিল সোমনাথকে উঠে আসতে…

কিন্তু পালাতে দেয়নি। দৌড়ে গিয়ে মুখ চেপে ধরে টেনে এনেছিল গ্যারেজের মধ্যে। আর ঠিক তখনই নিঃশব্দে…অতিশয় শব্দহীন এবং বিদ্যুৎসম গতিতে সুফির সেই ভয়াল সারমেয়-বাতাসে ডিজেলের গন্ধ শুকে শুকে এসেছিল এইখানে…

সাদা ভ্যানের ডিজেল ট্যাঙ্কের ছোট্ট চিড় দিয়ে যেটুকু গন্ধ বেরিয়ে বাতাসে ভেসে থেকেছে, প্রশিক্ষণ পাওয়া শিকারি কুকুরের কাছে সেইটুকুই তো মস্ত ক্লু!

 

মারামারির বর্ণনাটায় আর গেলাম না। ও সব থাকে হিন্দি সিনেমায়। দুই অ্যালোপেসিয়া আতঙ্ক জ্বলন্ত চোখে কীভাবে চেয়ে থেকে কীভাবে তেড়ে গিয়ে কি কাণ্ড করেছিল, যাক সেসব কথা। আমি ঘায়েল করেছিলাম বেটে মর্কটটাকে রামরদ্দা দিয়ে। ঘাড়ের একটা বিশেষ জায়গায় ঠিকমতো চোট মারতে পারলে মহাবীরও চোখে সর্ষেফুল দেখে। আমি দেখিযে ছেড়েছিলাম।

তারপর আমাকেই রিভলভারেব বাঁট চালাতে হয়েছিল ভয়ঙ্কর আকৃতির সেই অ্যালোপেসিয়া আতঙ্কের মাথা টার্গেট করে—যাঁর সারা মুখ ঘিরে চামড়া পুড়িয়ে দাগানো হয়েছে—’যে গলা টিপে ধরেছিল সুফির।

করোটি চুরমার হয়নি। তবে চোটটা ছিল প্রায় মারাত্মক। অমন প্রহর খেলে মহাবীরও জ্ঞান হারায়।

গ্যারেজ থেকে যখন বেরিয়ে এসেছিলাম, দেখেছিলাম একটু তফাতে নিন্দনীয় প্রমোদকাননের জানলায় জানলায় চমকে চমকে উঠছে বহুরঙের ফ্ল্যাশ…

উল্লাস… উল্লাস… উল্লাস!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *