২৮. অ্যালোপেসিয়া আতঙ্ক

২৮. অ্যালোপেসিয়া আতঙ্ক

নাইজেল জাতে আফ্রিকান। ডেয়ারিং ডেকয়েট। মানে, অসম সাহসিক ডাকাত। সাউথ আফ্রিকা কাঁপিয়েছে এককালে। যত রাগ সাদা চামড়ার মানুষের ওপর। সাদাদের অত্যাচার কালোদের ওপর জন্ম জন্ম ধরে চলে আসছে… যাবে।

এই নাইজেল রূপান্তরিত হয়ে গেছিল একটা টেরিবল শক খাওয়ার পর। মোটর অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছিল বেস্ট ফ্রেণ্ড। ছ মাসের মধ্যেই খসে গেছিল সমস্ত চুল। মাথা থেকে পা পর্যন্ত সব জায়গা থেকে।

সবাই ভেবেছিল কুষ্ঠ-টুষ্ঠ জাতীয় কুৎসিত রোগ ধরেছে। আফ্রিকা তো রোগের ডিপো। এই কালো মহাদেশেই নাকি প্রথম মানুষ এসেছিল। নাইজেলও নিশ্চয়ই এক রূপান্তরিত মানব-এই অ্যাটমিক যুগে।

ডাক্তাররা বললেন অন্য কথা। এটা একটা রোগ। মেন্টাল শক থেকে এসেছে। সমস্ত চুল, সমস্ত লোম ঝরে যায়। মাথা থেকে, ভুরু থেকে, চোখের পাতা থেকে, গায়ের চামড়া থেকে। নির্লোম মানুষ হয়ে যায়। লোম আর চুল ফের গজাবে কিনা, কেউ তা বলতে পারে না। মেডিক্যাল সায়ান্সে যতই এগোক, অনেক হেঁয়ালির সমাধান এখনও করে উঠতে পারেনি।

অ্যালোপেসিয়া মানে টাক পড়া নয়। অন্য ব্যাপারে। মেয়ে আর বাচ্চাদেরও হতে পারে। এ রোগে যন্ত্রণা হয় না, প্রাণ যায় না। কিন্তু আত্যন্তিক দুর্ভোগটা থাকে মনের মধ্যে। চুল দেখেই মানুষ চেনা যায়। নির্লোম মানুষকে শনাক্ত করা মহা মুশকিল।

তাই কালো মহাদেশের একটা কালো সংঘ-গুপ্ত সমিতি—একটা নির্মম ব্যবস্থা নিয়েছিল নাইজেলকে চেনবার জন্যে। গাঁজার কলকের মতো ছোট স্টিল পাইপ

আগুনে তাতিয়ে চিত্রবিচিত্র করে দিয়েছিল নাইজেলের গোটা মুখমণ্ডল।

আমি, ইন্দ্রনাথ রুদ্র, তা জানলাম কী করে?

ক্রমশ প্রকাশ্য। সহৃদয় পাঠক এবং সর্বাণীরূপিনী পাঠিকা (সর্বাণী মানেই যে মা দুর্গা, তা কি ব্যাখ্যা করতে হবে?) তো জানেন, লেখক যখন কলম ধরেন, তখন তিনি দিব্যদৃষ্টি পান—আমি শ্রীহীন ইন্দ্রনাথ রুদ্রও এই মুহূর্তে কলম ধরেছি…

তাই ছুঁয়ে গেলাম অ্যালোপেসিয়া আতঙ্ক-মানবকে। যাকে দেখে শিউরে উঠেছিল কল্পনা আর রবি রে’র ছেলে সোমনাথ।

নাইজেল রহস্য আর একটু বিশদ করতে হবে? কলমবাজ লেখকরা টেলিপ্যাথিও জানে বইকি। পাঠক-পাঠিকার মনে অন্দর-কন্দরের অভীপ্সা তাদের অজানা থাকে না। জানা না থাকলে লেখাই যায় না।

তাই, ঔৎসুক্য নিবৃত্তির চেষ্টা করা যাক ছোট্ট একটা সংবাদ দিয়ে।

দুর্ধর্ষ ডানপিটে রবি রে’র জীবন কাহিনী সংক্ষেপে শুনিয়ে গেছি আগে। পাঠক এবং পাঠিকা জেনে গেছেন, রবি তার দুর্নিবার কৌতূহল নিয়ে হিরে খনি, হিরে মাজাঘষার কারখানা, হীরে বিক্রির মার্কেট দেখে এসেছে ভূমণ্ডলের বহু জায়গায়। সাউথ আফ্রিকার প্রাকৃতিক হিরক ভাণ্ডারের প্রসঙ্গও তখন এসে গেছি। সেখানকার পাহারাদাররা কতখানি ঈগল চক্ষু হয়, সে কথাও বলা হয়ে গেছে।

নাইজেল, নিঠুর নির্লোম নাইজেল, এই রকমেরই এক হীরক খনিব শাস্ত্রীরূপে মোতায়েন ছিল একদা।

বাকিটা অনুমেয়। তীক্ষ্ণধী পাঠক এবং সহজবুদ্ধির পাঠিকা নিশ্চয় তা ধরে ফেলেছেন।

হ্যাঁ। নাইজেল চেনে রবিকে। রবি চেনে নাইজেলকে।

 

সুফি’র কথা একটু আগে বলেছি। আমি যার নাম দিয়েছি অ্যালোপেসিয়া হা। নির্লোম দৈত্য। প্রেমচাঁদের বিশ্বব্যাপী অপরাধী অন্বেষণের গুপ্ত কর্মকাণ্ডে সৃষ্টি তার দক্ষিণ হস্ত! কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার পদ্ধতিতে বিশ্বাসী বলেই প্রেমচাঁদ আজ বিশ্বজোড়া গোয়েন্দা সংস্থা। ভাবতেও ভাল লাগে। একসঙ্গে পড়েছি তো স্কটিশ চার্চে।

সুফি যেন হাওয়ায় উড়ে এল আমার পাহাড়ি বাড়িতে। কি করে এল, কোখেকে এল, সে সব প্রসঙ্গ অবান্তর। সুফি এসে গেল। অ্যালোপেসিয়া হাল্ককে দেখে পুলিশ পুঙ্গবীর চক্ষু বিস্ফারিত হয়েছিল।

কিন্তু থমকে গেছিল রবি রে।

হ্যাঁ। রবি রে-ও পবন বেগে চলে এসেছিল পাহাড়ের বাড়িতে। ছেলে নিখোঁজ হলে। কোনও বাবাই স্থির থাকতে পারে না।

সে এসেছিল আমার ওপর রাশি রাশি সন্দেহ নিয়ে। মানুষের মন বড় বিচিত্র। আমি তার প্রিয়তম বন্ধু। তাই তার একদা প্রিয়তমা স্ত্রীর পিছনে চর হিসেবে মোতায়েন করেছিল আমাকে। সে জানত, আমার ওপর কল্পনার দুর্বলতা আছে। আরও জানত, আমি কলিযুগের ভীষ্ম। ছলাকলা দিয়ে কীভাবে ললনা—ছলনা-ব্যহ ভেদ করি, তা তার অজানা নয়। বিশেষ করে মোমের হাত’ কেসটার পর থেকে। তাই নির্ভয়ে আমাকে মোতায়েন করেছিল দুর্লভ হিরেগুলোকে যেন উদ্ধার করে আনি কল্পনার গর্ভ থেকে।

‘গর্ভ’ শব্দটায় যদি কুঞ্চন জাগে পাঠিকার, আমি নিরুপায়। কিন্তু যৎকিঞ্চিৎ চিন্তা করলেই বুঝবেন, ওরকম নিরাপদ আর একান্ত গোপনীয় স্থান ভূমণ্ডলে আর কোথাও নেই। তাই গর্ভ শব্দটাকে উপমা হিসেবে টেনে আনলাম আমার এই দুর্বল লেখনী দিয়ে।

মোদ্দা কথা, আমি ছিলাম রবি রে’র চর। অতীব বিশ্বাসযোগ্য স্পাই। অথচ দেখুন, নারী তাদের অসীম ক্ষমতা প্রয়োগ করে কত অসম্ভব কাণ্ডই না করে। ফেলে।

টেলিফোনে রবিকে আরও কি বলেছিল কল্পনা, আমরা তা জানার কথা নয়। কিন্তু সে আমার সামনে এল এক্কেবারে ভিন্ন রূপে, সেই অভিন্ন বন্ধুত্বের বাষ্পটুকুও চোখের তারায় অথবা বাক্যবর্ষণে না দেখিয়ে। সে এল মন থই থই সন্দেহ নিয়ে। সঙ্গে একজন ডিটেকটিভকে নিয়ে। মারদাঙ্গা টিকটিকি।

বক্তব্য অতীব পরিষ্কার। সোমনাথকে আমিই কিডন্যাপ করিয়েছি। পথের কাঁটা ভেবে। কল্পনাকে নইলে পাব কী করে? সেইসঙ্গে তার হিরে? পুলিশ-পুঙ্গবীর নয়ন-তারকায় দেখলাম সেই একই সান্দেহের ছায়াপাত!

দশরূপা নারী। তাই তো তোমাদের দশ দিক থেকে প্রণাম করে শ্রীহীন এই ইন্দ্রনাথ রুদ্র-কিন্তু কাছে ঘেঁষে না।

কি বিপাকেই না পড়েছিলাম সেদিন। ত্রাতারূপে এল সুফি। ভুবনজোড়া পাতা জাল থেকে নিমেযে গোপন খবর চলে আসত প্রেমচাঁদের স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রিত কন্ট্রোল কেবিনে।

দুর্ধর্ষ নাইজেল যে হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেছে, সে খবর তার কাছে চলে গেছিল। তাই ক্ষুর বুদ্ধি খাটিয়ে চকিত সিদ্ধান্ত নিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল সুফিকেআর এক নির্লোম মানবকে।

চিত্ত যার গ্র্যানাইট দিয়ে গড়া—শরীরটা সিনেটার হাল্ক-এর মতো।

ও হ্যাঁ, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। কাহিনি পরম্পরা রক্ষা করা বড় কঠিন ব্যাপার। আমি লেখক নই। আমাকে মাপ করবেন।

সুফি একা আসেনি। সঙ্গে এনেছিল একটা সারমেয়কে। বিশেষ জাতের কুকুর। আফ্রিকায় তার পূর্বপুরুষরা নেকড়ে-টেকড়ের বংশধর ছিল। গন্ধ শুকতে ওস্তাদ। হাওয়ায় গন্ধ থাকলেও তার গন্ধ-যন্ত্র টের পায়। এমনকি, প্রাকৃতিক বিপর্যয় যখন আসন্ন, তার ষষ্ঠ অথবা সপ্তম অথবা নবম ইন্দ্রিয় তা টের পায়। ইন্দোনেশিয়ায় যখন ভীম ভৈরবে সুনামি আছড়ে পড়েছে, তার অনেক আগেই নিকোবর থেকে প্ৰেমৰ্চাদের এক টিকটিকিকে নিয়ে সে চম্পট দিয়েছিল নিরাপদ অঞ্চলে।

টিকটিকি মানে যে ডিটেকটিভ, তা নিশ্চয় ক্ষুর বুদ্ধি পাঠক-পাঠিকাদের নতুন করে বলার দরকার নেই।

আশ্চর্য এই সারমেয় সহ সুফি নেমে গেল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ঠিক সেইখানে, যেখান থেকে আর পায়ের ছাপ পাওয়া যায়নি সোমনাথের।

বাতাসের মধ্যে নিশ্চয় একটা গন্ধ ধরে ফেলেছিল সারমেয়। গজায়নি, তর্জায়নি। নিঃশব্দে দৌড়েছিল পাথুরে পথ বেয়ে।

বুঝেছেন কিসের গন্ধ?

ডিজেলের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *