১৭. হিরের খনি! হিরের খনি!

১৭. হিরের খনি! হিরের খনি!

তার আগে শুনে নিয়েছিলাম জহুরি দণ্ডপথের মুখে–হিরে, কত রকমের অভিশাপ টেনে এনো দেশে দেশে, কত রক্ত ঝরিয়েছে… কত রাজ্যের উত্থান আর পতন ঘটিয়েছে…

মানুষটা নিজেই একটা হীরক-ইতিহাস… আশ্চর্য! আশ্চর্য!

শুধু কি তিব্বত, হিরে তাকে টেনে নিয়ে গেছে যেখানে খনি, যেখানে হিরের কারবার… সেইখানে, সেইখানে… কি জানি কেন আমার মতো উজবুককে উনি ‘স্নেহের চোখে দেখে ফেলেছিলেন অথবা কিঞ্চিৎ কৃপাবর্ষণ করেছিলেন–কারখানার কল্পনাকে জীবনসঙ্গিনী করবার পথে পা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলাম বলে… না করেও পারিনি, ইন্দ্র… যা কারও কাছে বলা যায় না, তা প্রিয় বন্ধুর কাছে বলা যায় … কল্পনা আমাকে টেনেছিল কেন? ওর চোখ দিয়ে… ওর চোখ দিয়ে… চিরকাল জুলিয়েটরা রোমিওদের যেভাবে টেনে ধরে… সেইভাবে… যে পন্থায় চুয়া মোহন করেছিল চন্দনাকে… লায়লা-মজনুর কাহিনি রচিত হয়েছে যেভাবে, সেইভাবে… সেইভাবে. .স্রেফ চাহনিবাণ মেরে… মোহন চাহনি দিয়ে আমাকে মগ্ন করে দিয়েছিল… যাচ্চলে… হিরের কথা বলতে বলতে ফের মানবী-হি.লর কথায় চলে এলাম… হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কল্পনা একটা হিরের টুকরো কন্যা…

ভুরু নাচাচ্ছিস? নাচা, নাচা, প্রেমে তো কখনও পড়িসনি… যেদিন পড়বি, বুঝবি কত ধানে কত চাল। কি কথা হচ্ছিল? জহুরি দণ্ডপখ আমাকে স্নেহের চোখে দেখে ফেলেছিলেন। জহুরি যে, মানুষ চিনতে পারেন… আমি অমানুষ নই বলেই শিখিয়ে দিয়েছিলেন মেকি আর আসলি হিরে কি করে চিনতে হয়… কি করে বালির দানার সাইজের হিরের আটান্ন দিক সত্যিই আছে কিনা, দেখে নিতে হয়… যা দিয়ে দেখতে হয়, আতস কাচের মতে সেই জহুরি যন্তরটার নাম ইংরেজিতে উপ… অথচ কোনও ইংরেজি ডিক্সনারিতে এ নাম খুঁজে পাইনি…তাতে কিছু এসে যায় না… জহরবিদ্যা বড় বিদ্যা, এ বিদ্যা যায় না মারা… দণ্ডপথ আমাকে শিখিয়ে দিলেন বালির সাইজের খুদে হিরের ঝকঝকে আটান্নটা দিক যাচাই করে নেওয়ার বিদ্যে…হিরেটাকে দশগুণ বাড়িয়ে নিয়ে ওই লউ-এর ফোকাস মেরে…

আমি তখন হিরে কেনার কারবার শুরু করেছিলাম। একশো আটষট্টিটা বালি সাইজের হিরে কিনেছিলাম… ছ’হাজার টাকা ক্যারাট দামে… খুদে হিরে… খুদে হিরে. এ যুগটা মিনিয়েচার করার যুগ… হির-মিনিয়েচার শিল্প দখলে রেখেছেন দণ্ডপথ নিজের কারখানায়… এক-একটা খুদে হিরের আটান্ন দিক তুলতে সময় লাগে মাত্র তিনঘণ্টা…

তোর চোখ দেখে বুঝছি, ইন্দ্রনাথ, তুই হীরক সমাচ্ছন্ন হয়েছিস… একেই বলে হিরের নেশা… মদের নেশার চাইতেও মারাত্মক… এই নেশায় পাগল হয়ে গিয়ে আমি দেশে দেশে ঘুরেছি… সাউথ আফ্রিকার বিশাল হিরের খনি দেখেছি… আন্টওয়ার্প, নিউইয়র্ক, তেল-আভিভ-এর হিরে কেনাবেচার বাজারে টহল। দিয়েছি… হিরে নিয়ে লড়তে গিয়ে যেসব দেশ ধ্বংস হয়েছে, সেই সব দেশ পরিক্রমা করে এসেছি… কিন্তু সুরাট শহরের মূল ডায়মণ্ড এলাকা ভারাচা রোড-এর মতো হীরক-হাট কুত্রাপি দেখিনি… কি বললি? কুত্রাপি মানে কি? ইডিয়ট… কুত্রাপি মানে, কোথাও, কখনও… আধুনিক বাংলায় গুলি মার… সাধু বাংলা ছাড়া মনের ভাব বোঝানো যায় না…।

ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে নাকি? আমি নিরুপায়… হিরে আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে… হিরে, হিরে, হিরে … শয়নে স্বপনে জাগবণে উখানে এই হিরে আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে দেশ-দেশান্তরে… সব লিখতে গেলে একটা মহাভারত লেখা হয়ে যাবে… সুরাটের বুস্টার ডায়মণ্ডস ফ্যাক্টরি দেখবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন জহুরি দণ্ডপথ… আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন সেখানকার দুই মালিক অনুজ আর অক্ষয় মেটা’র সঙ্গে… আশ্চর্য কি জানিস, ইন্দ্র? …যে বালি হিরে ছ’হাজার টাকা ক্যারাট হিসেবে কিনেছিলাম, দশহাজার টাকা ক্যারাট হিসেবে এদের কাছেই বেচেছিলাম… হিরের দালালিতে সেই আমাব প্রথম লাভ…

তারপর অনেক ঘুরেছি, অনেক শুনেছি, অনেক দেখেছি… একদিনে হইনি ডায়মণ্ড এক্সপার্ট… কঙ্গোর ডায়মণ্ড অঞ্চলে মুবুজি মায়ি খনি দেখেছি, হিরেও। কাসাঞ্জির সঙ্গে দহরম মহরম সম্পর্ক গড়ে তুলেছি … সেখানকার একখানা হিবের দাম তিরিশ লক্ষ ডলারে উঠে যাওয়ার পরেও সেই হিরে নিয়ে রক্ত ঝরানো খেলা শুরু হয়ে গেছিল… কঙ্গোয় তখন গৃহযুদ্ধ চলছিল একটানা দু’বছর ধারে. . উভয়। পক্ষই যুদ্ধের খবচ জুগিয়ে যাচ্ছিল হিরে বেচে … মাসে মাতে হিরের কারখানা থেকে আড়াই কোটি ডলার খাজনা আদায় করে যাচ্ছিল গভর্নমেন্ট। আমি আদায় করছিল তোলা—হিরের খনি থেকে হাত মিলিয়েছিল বিপ্লবীরাও। সে এক নয় ছয় কাণ্ড।

দু’হাজার সালের আগস্টে কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট নিরুপায় হয়ে, যুদ্ধের খরচ জোগাতে, হিরের খনির এক্সকুসিভ রাইট বেচে দিয়েছিলেন ইজরায়েলের একটা কোম্পানিকে দু’কোটি ডলারে। কাসাঞ্জির রত্নখনি থেকে হিরে স্মাগলিং শুরু হয় তখন থেকেই—চলে যায় বর্ডারের ওপারে।

শুরু হয়েছিল হীরক যুদ্ধ। বহু আগে যেমনটা হয়েছিল এই ভারতে। অ্যাংগোলান বিপ্লবী সাভিমবি আকাটা হিরে সাপ্লাই দিয়ে গেছে হরদম, ইউনিতা অনি পাঠিয়ে দখল করেছে কুয়ানগো উপত্যকার হিরের খনি… যার দাম চার বিলিয়ন ডলার। হিরে অভিশাপে মরতে বসেছিল অ্যাঙ্গেলা রক্তাক্ত হিরে নিয়ে লড়াই শুরু হয়েছে আফ্রিকার অন্য অন্য অঞ্চলেও… শুরু হয়েছে হিরে লুঠ… সাঙ্কো সৈন্যরা অসহায় কারিগরদের লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে হাত আর পা কেটে দিয়েছে—দেশের লোককে ভয় দেখাতে… বাচ্চাদেরও বাদ দেয়নি… নরপিশাচ… মানুষখেকো… এই ভাষায় খবর বেরিয়ে গেছিল ‘নিউইয়র্ক পোস্ট’ কাগজে ১৯৯৯ সালে… ইন্দ্র, পড়ে নিস… যদি এখনও অবিশ্বাস থাকে অভিশপ্ত হিরে বাণিজ্যের কাণ্ডকারখানায়। নেলসন ম্যাণ্ডেলা তো বলেইছিলেন-হিরে বয়কট করলে বোটসওয়ানা আর নামিবিয়ার অর্থ ব্যবস্থা… আই মিন, ইকনমি ভেঙে পড়বে। আমেরিকান কংগ্রেস আইন প্রণয়ন শুরু করেছিল ক্লিন ডায়মণ্ডের সার্টিফিকেট দেওয়ার ব্যাপারে—যে হিরেতে লেগে নেই রক্ত… লেগে নেই চোখ ধাঁধানো হিরের নেকলেসে।

এত সত্ত্বেও, এত রক্তাক্ত ব্যাপারের পরেও, হিরে পরশ পাথর হয়ে রয়েছে বহুত মানুষের কাছে।

অভিশপ্ত পাথর কিছু মানুষের কাছে। আমার এই কাহিনির অবতারণা সেই জন্যেই… হিরে মানুষকে অমানুষ করে তোলে… ছেলেদের পিশাচ আর মেয়েদের পিশাচি বানিয়ে দিতে পারে।

ইন্দ্র, কল্পনা এই হিরে বাণিজ্যে গা না ভাসালেই ভাল করত। তাই ওকে আমি তুলে এনেছিলাম সুরাট থেকে বিয়ে করেছিলাম। ডায়মণ্ড কমপ্লেক্স গড়ে তুলেছিলাম ব্যাঙ্গালোরে। তবে হ্যাঁ, ওর ব্রেন আমাকে হেল্প করেছিল… এখনও করছে…

তারপর? ‘ উধাও হয়ে গেল হিরের ডিম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *