০৩. হিরে মাস্টার রবি রশ্মি

০৩. হিরে মাস্টার রবি রশ্মি

রবি রে আমার কলমের ডগায় এসে যাচ্ছে। ওকে নিয়ে দু’চার কথা না লেখা পর্যন্ত আমার এই কাহিনি প্রকৃত গতি পাবে না। ইংরেজিতে যা রে, বাংলায় তা রশ্মি। তার রশ্মি ছড়িয়ে আছে চমকদার এই উপাখ্যানের প্রতিটি পংক্তিতে। তার ছেলে গায়েব হয়েছে, কিডন্যাপার মুক্তিপণ চেয়েছে, আর কিছু নয়—ডিম। পাঠক এবং পাঠিকার, কৌতূহল নিবৃত্তির জন্যে এই ডিম প্রসঙ্গে যৎকিঞ্চিৎ না লিখে পারেনি আমার এই নাছোড়বান্দা লেখনী। হিরেদের আত্মা যেন কলমে ভর করে লিখিয়ে গেল নিজেদের কাহিনি। অনিক্স পাথরের ডিম-কাহিনি।

কিন্তু সেইসঙ্গে এসে যাচ্ছে রবি রশ্মি কাহিনি। রবি যখন রায় পদবীকে কেটে হেঁটে শুধু রে বানিয়েছিল, তার আগে থেকে ওকে আমি চিনি।

অবাক হওয়ার মতো ব্যাপারই বটে। যার ডিভোর্সি বউ এখন আমাকে কজায় আনার ফিকিরে গ্যাংটকের তুহিনশীতল পাহাড়ি অঞ্চলে নিবাস রচনা করেছে, আমি সেই রবি রে-কে চিনি এবং জানি তার কৈশোর থেকে।

এই কলকাতায়, আমি সেই আদি কলকাতার কথা বলছি, যেখানে একদা ক্রীক রোর খাল বেয়ে নৌকো চালিয়ে এসে লর্ড ক্লাইভ সুরাজ ট্যাঙ্ক লেন দিয়ে হেঁটে বৈঠকখানার বটগাছতলায় হুঁকো টানার আসরে বসতে, সুপ্রাচীন সেই মধ্য কলকাতায় মুচিপাড়া নামে একটা অঞ্চল আছে! একসময়ে খুবই কুখ্যাত ছিল এই থাকা অঞ্চল।

এই তল্লাটেই ভূমিষ্ঠ হয়েছিল রবীন্দ্ররঞ্জন রায়বর্মণ। বিশাল নাম। কিন্তু মানুষটার সাইজ অতবড় নয়। পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি হাইটের পাতলা হিলহিলে একটা মানুষ। অতিশয় ডাকাবুকো। পাড়ার হাওয়া গায়ে লাগিয়ে বড় হতে হতে সে অনেক কাণ্ড করে ফেলেছে। বোমা বেঁধেছে, বোমা মেরেছে, বেপাড়ার মস্তানদের মুচিপাড়ায় মস্তানি করতে দেয়নি। মেয়েদের সম্মান দিয়ে গেছে, মেয়েরাও ওকে বিপদ-আপদের পরম বন্ধু বলে জেনেছে।

কিন্তু অতবড় নাম নিয়ে কি কেউ বড় হতে পারে? জেট যুগে এ নাম অচল। তাই স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে যখন বেরিয়ে এল দামাল মানুষটা, তখন ওর নাম কাটছাঁট করে এসে দাঁড়ালো রবি রে’তে।

এইবার শুরু হল ওর অবিশ্বাস্য দুঃসাহসিক জীবনের আর এক পর্ব। মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের কাজ নিয়ে গোটা ভারতে চক্কর মারার সময়ে বোম্বাইয়ের হিরে কারবারিদের সংস্পর্শে এসেছিল রবি রে। ওর মধ্যে যেন একটা ন্যাচারাল ম্যাগনেট আছে। অজানার দিকে ছুটে যাওয়ার ম্যাগনেট। যেখানে রহস্য, সেইদিকে ধেয়ে যাওয়ার প্রবণতা। ভারত ভ্রমণের এই চাকরিতে ঢুকেছিল আতীব্র এই আকাঙ্ক্ষা নিয়েই। বোম্বাইতে ওকে টেনে ধরল এই পৃথিবীর হিরে কারবারিদের আশ্চর্য দুনিয়া। হিরের টুকরো ছিল ছেলেবেলা থেকেই। এখন সে চলে গেল প্রকৃত হিরের জগতে…

সুদীর্ঘ সেই কাহিনি সবিস্তারে লিখতে গেলে, এই উপাখ্যান একটা থান ইটের মতো ভারি হয়ে যাবে। হিরের দুনিয়াটাই যে রোমাঞ্চকর। রোমাঞ্চ স্পৃহা যার প্রতিটি রক্তকণিকায় নৃত্য করে যায়, সে তো রোমাঞ্চময় হিরের কারবারের একদম ভেতরে ঢুকে যাবেই। অসম্ভব ডানপিটে, অসম্ভব কৌতূহলি, অসম্ভব উপস্থিত বুদ্ধির মানুষ রবি রে। তাই একটা সময়ে আপন রশ্মি বিকিয়ে দুনিয়া জোড়া হিরে আবাদের নাড়ি-নক্ষত্র আঙুলের ডগায় জড়ো করে নিয়েছিল।

শুরু হয়েছিল লোপাট হয়ে যাওয়া বিশাল এক হীরক খণ্ড থেকে। আকাটা হিরে। ওজন ২৬৬ ক্যারাট। পাঠক এবং পাঠিকার অবগতির জন্যে জানিয়ে রাখি, এক গ্রাম ওজনের এক পঞ্চমাংশ হল এক ক্যারাট।

বোম্বাইয়ের গদি থেকে বিপুলাকার এই হিরের অন্তর্ধানের সঙ্গে সঙ্গে গোপন তদন্ত অভিযানের প্রয়োজন হওয়ায় তলব পড়েছিল আমার। এই হিরে এসেছিল কঙ্গোর খনি থেকে। নিরুদ্দেশ হওয়ার পর সেই হিরেকে খুঁজে বের করেছিলাম নিউইয়র্ক সিটিতে। হিরের খোঁজে থেকেই কোটি কোটি ডলারের খনির খোজ পেয়েছিলাম, রক্তাক্ত সংঘর্ষের বিবরণ পেয়েছিলাম।

মূলে শুধু হিরে! কয়লা থেকে জন্ম নেওয়া একটা পাথর। মহাকাল বুঝি স্তব্ধ হয়ে যায় তার রূপের সামনে। রূপমী হীরক। তোমাকে নমস্কার। হিরের ডিমের প্রসঙ্গে এবার ফিরে আসা যাক। এবং সে কাহিনি শোনানো যাক হীরক-কন্যা কল্পনা চিটনিসের জবানিতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *