০২. অনিক্স পাথরের ডিম

০২. অনিক্স পাথরের ডিম

আগের শীতে কলকাতার শিল্পমেলায় সেই প্রথম চিন আর পাকিস্তান আসর জমিয়ে বসেছিল। ছিল বাংলাদেশও। কিন্তু চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে শুধু পাকিস্তান। পাথরের শিল্পকর্ম দেখিয়ে। অনিক্স পাথর থেকে যে এত রকম জিনিস তৈরি হতে পারে, তা বুঝি জানা ছিল শুধু মোগল আমলে অথবা ভারত ভাগের আগে। এখন সে সব জিনিস আর আসে না। দেখার জন্যে হায়দ্রাবাদের সালারজাঙ মিউজিয়াম অথবা মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের মারবেল প্যালেসে যেতে হয়। কিন্তু অনিক্স পাথর কুঁদে এত বিস্ময় সামগ্রী সে সব জায়গাতেও এমনভাবে জড়ো করা হয়নি, যে-ভাবে করা হয়েছিল ময়দানের শিল্পমেলায়।

ব্রিটিশ আমলে বাহারি কিন্তু বিপুল মূল্যের বস্তুগুলো চলে যেত প্রাসাদ সাজাতে। এখন যাচ্ছে গুজরাতি-মাড়োয়ারিদের অট্টালিকায়, আলিপুর-টালিপুর অঞ্চলের অভিজাত পরিবারদের বড় বড় নয়নসুন্দর সৌধগুলো তো তারাই কিনে নিয়েছে। গোটা বড়বাজার হাতের মুঠোয় এনে ফেলেছে। উত্তর কলকাতাতেও অনুপ্রবেশ ঘটছে। এই পৃথিবীর সেরা দশ ধনীর নাম করতে গেলে কলকাতার এই আধুনিক ধনীদের নাম এসে যায়। তৃতীয়জনই তো মাড়োয়ারি নন্দন। খাস কলকাত্তাই পিলে। মিত্তাল।

ময়দানের শিল্পমেলায় এরা এসেছিল। ভিড় করেছিল তেহরান, ইরান, মূলতান, বেলুচিস্তান থেকে পাথরের কারিগর ব্যবসায়ীরা। স্টল উপছে পড়েছে তাদের চোখ ধাঁধানো শিল্প সামগ্রীতে—থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল স্টলের বাইরে-মাঠের ওপর।

কড়া সিকিউরিটির ব্যবস্থা অবশ্যই ছিল। কলকাতার নামযশ তো অকারণে হয়নি। মরু উদ্যান যে।

সেই সুনাম রক্ষাও করেছিল কলকাতা। হাত সাফাই বিদ্যায় মহাপটু শিল্পীরা ভানুমতীর খেল দেখিয়ে দিয়েছিল তাবড় তাবড় রক্ষীদের বোকা বানিয়ে দিয়ে। কলকাতা যে সেরা ম্যাজিশিয়ানের শহর।

উধাও হয়ে গেছিল এক বাক্স অনিক্স পাথরের ডিম।

সাইজে হাঁসের ডিমের মতো, কিন্তু চেহারায় একটু অন্যরকম। সারা গায়ে রকমারি রঙের শিরা-উপশিরা। পাথরের বুক কেটে তৈরি তো, তাই। ঝিকিমিকি দ্যুতি সর্বাঙ্গে। এক-একটা বাক্সে সাজানো ছ’টা করে ডিম। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলে তাক লেগে যায়। বারে বারে দেখতে ইচ্ছে যায়। ঘরে নিয়ে গিয়ে রাখতে ইচ্ছে যান। দাম তো অতি সামান্য। মাত্র পঞ্চাশ টাকা-এক-একটা পিস।

শিল্পরসিক কিন্তু সীমিত রেস্তর বঙ্গতনয় এবং তনয়ারা এই ডিম কিনেছে অনেক। কিন্তু ছ’টি ডিম সমেত একটা প্যাকেট নগদ মূল্য দিয়ে এক ব্যক্তি নিয়ে যায়নি। ম্যাজিক দেখিয়ে মেরে দিয়েছে। ঈগলচক্ষু নজরদারিদের চোখে ধুলো দিয়ে।

বোধহয় ত্রাটক যোগে সিদ্ধ ছিল সেই ব্যক্তি। সেই যোগ, যার অভ্যাসে পুরাকালের মুনিঋষিরা সম্মোহন করতেন বনের পশুদেরও।

যোগী-তস্কর কিন্তু বড় অল্পে তুষ্ট! অনেক মূল্যবান অনিক্স পাথরের সামগ্রী নিচয় থেকে ভ্যানিশ করে দিয়েছিল শুধু ছ’টি ডিম। মাত্র ছ’টি ডিম।

সংবাদ মাধ্যমকে এই চৌর্য পর্ব জানানো হয়নি। তাহলে ঢি ঢি যত না পড়ত, তার চেয়ে বেশি সজাগ হয়ে যেত ডিম-জাদুকর। কিন্তু আমি জেনেছিলাম। কেননা, ডিম ছ’টা অনিক্স পাথরের খোলস ধারণ করে গোপন করে রেখেছিল পৃথিবী সেরা বেশ কিছু হিরে। সিকিউরিটিতে যারা ছিল, এ সংবাদ তাদের ছিল না। জানানো হয়নি। জানতাম শুধু আমি। আমার ওপর সেই ভার দেওয়া হয়েছিল বলে।

না, আমার চোখে ধূলো দেওয়া যায়নি। আমি জানি সেই ডিমের গতিপথ, গন্তব্যস্থল এবং বর্তমান অবস্থান।

এই ডিমই চাওয়া হয়েছিল টেলিফোনে। সোমনাথ গায়েব হয়েছে এই কারণেই। অলমতিবিস্তরেণ। প্রসঙ্গটা নিয়ে সবিস্তার হওয়া যাবে পরে…যথাসময়ে। গুপ্ত রহস্য যে! যতক্ষণ গুপ্ত থাকবে, ততক্ষণ সে এই কাহিনি পড়বেন। জেনে গেলেই ছুঁড়ে ফেলে দেবেন। কারণ, আমি লেখক নই বন্ধুবর মৃগাঙ্কর মতো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *