৪১-৪৫. অথচ বেশ কয়েক বছর

8.

অথচ বেশ কয়েক বছর মহিমবাবু ও লালমিয়ার সেবা করার পরও প্রশ্ন উঠেছিল, তুমরা হিন্দু না মোছলমান? এর আগে দীর্ঘ একশো বছরের মধ্যে ও প্রশ্ন কারোরই ওঠাবার দরকার হয়নি। অথচ পাঁচবিবির মহিমবাবু কিংবা লালমিয়ার কাছে তখন এ প্রশ্ন জরুরি ঠেকেছিল।

তখনো দুই কুন্‌ঠির খাস জমিগুলো সম্পূর্ণ উদ্ধার হয়নি। তখনো গাছ ফেলা লছে। কোথায় নাকি যুদ্ধ হচ্ছিল, তাতে অনেক গাছের দরকার, বাঁশের দরকার। তাই ভিখমাঙা বাজিকরেরা গাছ ফেলছিল আর জমি খালাস করছিল। এসব তারা করবে পাঁচবিবিতে বসত করার এক পুরুষ পরে। এই এক পুরুষ তারা জামির বাজিকরের নেতৃত্বে পাঁচবিবিতে খুঁটো গেড়ে বসে থাকবে। তারা আর ভিখ মাঙবে না, এরকম একটা প্রতিজ্ঞা বৃদ্ধ জামিরের নেতৃত্বে আবালবৃদ্ধ বাজিকরেরা নেয়। খোদাবকসো বাজিকর, বালি বাজিকর ও শিউ বাজিকর—এই তিন অতিবৃদ্ধ বাজিকর ঘনঘন মাথা নেড়ে জামিরের কথায় সায় দিয়েছিল। না, আর ‘গেহুঁ’, মার সোঁকা’ হাত পেতে ভিখ-মাঙ্গা নয়! আর বান্দর, ভাল্লু, রহু চরডালের হাড় নাড়া-চাড়া নয়!

দনুর অধস্তন ষষ্ঠ পুরুষকে আর নানি এসব বৃত্তান্ত শোনায় আর সেই বালক, বয়সের থেকে অনেক বেশি একাগ্রতায়, নিবিষ্ট হয়ে শোনে সেই-ব কথা।

রহু চণ্ডালের হাড় জানু রে শারিবা।

না!

ঘোর অমাবস্যায় এক বিটিছেলের এক ছেল্যা হবে। সি হোবে একোই বেটা। সি ব্যাটা মরবা হবে অমাবস্যার দিনোৎ আর লাশ ভাসান হবে আমাবস্যার আতোৎ। তবি সি লাশ গহিন আতৎ নদী থিকা উঠাবা হবে। তা-বাদে তার কণ্ঠার হাড়ে বানাবা হবে ভাতির হাড়। সি হল রহু চণ্ডালের হাড়। সে হাড় হাতেৎ রাখ্যে তুমু হয়কে লয়, লয়কে হয় করতে পারবা।

সাচা?

সাচা লয়?

তুই দেখিছিলি, নানি?

হাঁ, দেখিছি। বালি বুড়ার কাছে ছিল সি রহু চণ্ডালের হাড়। আর কেরো লয়। আর সোব্বার হাতে থাকত মেকি হাড়। তাথেই ত্যাল সিন্দুর মাখায়া সবে ভেলকি লাচাত মিছাই। কেন্তু বালি বুড়ার ছিল আসল হাড়।

তো সি হাড়টা কী হল?

ও, সিটা তোক বলা হয় নাই? তবি শোন, তোরা নানাতো এলা সব ঠিক করল যি আর বাজি লয়, আর ভিখ-মাঙ্গা লয়। ইবার আর দশজনার মতো খাইটে খাবার হোবে। তো সব ঠিকঠাক কর্যে বেবাক হুই পাতালু নদীৎ বিসজ্জন হল।

তা-বাদে?

আঃ হা, তা-বাদেই তো আসল মজা।

কেম্‌কা?

বাজিকর বুললে হাম কাম করে খামো, ভিখ মাঙ্গমো না। কাম করবা? তা যাও, পাটের খ্যাত নিড়াও, জনে জনে দু দু পয়সা আর এক সস্তা খাওয়া। তো ভিখমাঙ্গা নেংটার দল পাটের খেতোৎ নাইমে গেল। বাস, দু-ঘণ্টায় কাম শ্যাষ। কামও শ্যাষ, পাটের খ্যাতও শ্যাষ!

ক্যান?

অনেকদিনের চাপা পড়া স্মৃতিতে বলক ওঠে। নানি হাসে। অথচ চোখের কোণে জল চিকচিক করো। পাট-নিড়ানি কাম ভিখ-মাঙ্গা বাজিকরের কাম লয়, শারিবা। পাটের চারা আধা উঠি গৈল নিড়ানির ঘায়ে, আর আধা পড়ল পায়ের তলায় চাপা।

সেই দোষে লালমিয়া কোড়া মারুল পঁচিশ ঘা।

জামির বলেছিল, হামা কোড়া মারেন, ছাহেব। বেবাক দোষ হামার।

তখন যুদ্ধের বাজার, পাটের দাম মেলা। পুরো মাঠের পাট নষ্ট। রাগ হয় বৈকি মানুষের।

লুবিনি পিঠের ঘায়ে বুনো লতাপাতার মলম লাগায়। তমো কি রোখ রে মানুষটার শারিবা, বলে ভিখ-মাঙ্গা কাম আর করমো না। চাষিমজুরের কাম শিখবা হোবে। বলে আর হা-নিঃশ্বাস ফেলায়। তো সি হা-নিঃশ্বাস দেখি হামি। আর আর বাজিকরের থমথমা মুখ। এলা কি দেকদারি কাম! বালি বাজিকরের ছেলা লছমন বাজিকর জবর খেলোয়াড়। সি বলে, হাই, সারা দুনিয়া হামার আছিল। হামার আছিল, লদী, পাহাড়, বালি আর মাঠ, আর এখুন দেখ হামরা বন্দি হই গেলাম। বাজিকর যদি ঘাটা ছাড়ি ঘর ধরে, তবিই সি আহাম্মক, লচেৎ লয়।

বালি বললে, তা লয় রে লছমন। যি পাপে বাজিকর বাউদিয়া, সি হাজার সালের পুরানা পাপ। সি পাপ খণ্ডাবার জন্য তুমাক তো দণ্ড নিবার হবে। তোত

জামির সি দণ্ড নেয় তুমাদের বেবাকের হয়।

কি পাপ নানি, কি পাপ?

হায়, শারিবা, সি বড় কঠিন পাপ। ওলা কথা বালি বুঢ়া জানত।

নানি সে কথাটা এড়িয়ে যেত। সে পাপের কথা জানতে শারিবার অনেকদিন লাগবে। কিন্তু জানার আগে দীর্ঘদিন সে পাপের দণ্ড স্বজনদের সঙ্গে ভোগ করবে। ছোটবেলা থেকে শুনে শুনে যেগুলো সে বুঝবে সেগুলোর সত্যতা সে অস্বীকার করতে পারবে না। যেমন, সে অপমানিত হবে চোর বলে, সে গাল খাবে লুঠেরা বলে, সে গোপনে মানুষকে বাজিকর বৃদ্ধাদের কাছে আসতে দেখবে গূঢ় অভিসন্ধিতে, গুণতুক আর গুপ্তবিদ্যার সাহায্যে অভিলাষ সিদ্ধ করার জন্য।

ক্রমশ অভিজ্ঞতা এবং বহিঃসমাজ তাকে শেখাবে আরো অনেক কিছু। সে জানবে বাজিকরের নিজস্ব সমাজ বলতে বিশেষ কিছু নেই, বিশ্বাস নেই, ধর্ম নেই, কার্যকারণ, স্থান-কাল-পাত্র কাণ্ডজ্ঞান খুব কম। বাজিকর জানে হামবড়াই, কিন্তু মানুষের সমাজের প্রয়োজনীয় মৌলিক কাজ সে জানে না। সে আসলে ভীরু ও লোভী। তার নিয়তি দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও ক্ষয়রোগ। এই সমস্ত পৃথিবী তার, কিন্তু এমন কোনো জায়গা তার নেই যেখানে সে পা রেখে দু-দণ্ড দাঁড়াতে পারে।

তাই বটে, তাই বটে শারিবা! তাই তোর নানা ফির মার খায়। জমিতে হাল দিতে নাইমে মহিমবাবুর অ্যাটা ভঁইসের পায়েং ফাল মারি দিল লছমন। চাষের কামের সোমায় অ্যাটা ভঁইস চোট খায়ে বইসে গেলে গেরস্তের রাগ হয় বৈকি!

আর জামির নিজেকে সান্ত্বনা দেয় এই বলে, মার খেয়েই শিখতে হবে। হাজার বছরের কর্মহীন উদ্যোগহীন হাত, এত সহজে কাজ শিখবে? পাপের দণ্ড দিতে হবে না? আরো কত পুরুষ ধরে পাপের ভোগ ভুগতে হবে?

জানিস শারিবা, তোর নানা চাইছিল গেরস্ত হবার। চাষি-গেরস্ত। নিজের ভঁইস থাকবে, হাল-লাঙ্গল থাকবে, উঁই থাকবে। ভিখ-মাঙ্গাকে সি বড় ঘেন্না করত।

নমনকুড়ির সামান্য সময়ের মরীচিকা তাকে আরো লোভী ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করেছিল।

লুবিনি ফিসফিস্ করে এইসব কথা বলত শারিবাকে, যেন অত্যন্ত গোপন কোনো শরমের কথা বলছে, যেন কিশোরীর প্রথম গোপন কথাটি। বড় মধুর, সজ্জার, আকাঙ্ক্ষার, একান্ত নিজস্ব। যেন এরকম একটা অদ্ভুত কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠতে পারে। সেই ভয়, এখনো। নানির এখন আশির উপরে বয়েস, জামির এই স্বপ্ন দেখতে শুরু করে এখন থেকে পঞ্চাশ বছর আগে থেকে, তবুও। জামির তো মারাই গেছে তিরিশ বছর হয়ে গেছে, তবু এখনো কেন শরম লাগে, ভয় ভয় লাগে লুবিনির?

শোন শারিবা, গোরখপুর আমাদের নিজেদের জায়গা। আমি শুনেছি তোের নানার নানার কাছ থেকে, সে শুনেছে তার নানার কাছ থেকে। আমরা ছিলাম পোরখপুরের আরো পশ্চিমে কোন এক মরুভূমি আর বালির মুলুকে। আর গোরখপুরে বাজিকরের বসত বছরে একমাস কি দু-মাস, একে কি বসত বলে? কখনো কখনো দু-বছর তিন বছর বাদে ঘুরে আসত কোনো দল। যেমন হামারদের দল, যেমন ঘুরল নাই, কুথায় হারাই গেল গোরখপুর?

তখন রমণীরা পরত ঘাঘরা আর কামিজ, পুরুষেরা পরত নুগরু আর কুর্তি। এখন দেখ সব মেয়ে শাড়ি পরে, পুরুষেরা পরে ধুতি আর লুঙ্গি। সেসব ছেড়ে দিল, তার নিজের ভাষা, নিজের পোশাক, নিজের আচার-আচরণ, নিজের ক্রিয়াকর্ম, সব। কেন রে শারিবা কেন? তোর নানা বলত, আমি মজুর খেটে খাব আর ভিখ মাঙ্গব না, লোক ঠকাব না। বে-ইজ্জতের কাম করব না। আমার বালবাচ্চা হবে ইমানদার আদমি। মুখে বলত আমি মজুর খেটে খাব, মনে ছিল আমি গেরস্ত হব। সে শুধু লুবিনি জানত, আর জানত বালি বুড়ো।

কিন্তু সে আর হল কই শারিবা? বাজিকর পাটখেত নিড়াতে জানে না, মার খায়। বাজিকর হাল মই দিতে জানে না, মার খায়। আচানক চুরির দায়ে ধরা পড়ে, মার খায়, জেল হয়। গ্রামে মড়ক লাগে, দোষ হয় বাজিকরের। বাচ্চাকাচ্চা চুরি গেল, হারিয়ে গেল, মারো শালা বাজিকরকে, দেও তার ঘর জ্বালিয়ে। তবু জামির বাজিকর পাঁচবিবি নদীর চর আঁকড়ে পড়ে থাকে। পাঁচবার হাতি ঘরদোর ভাঙার পরে রোখ আর তার আগের মতো থাকে না। তখন একদিন চতু বাজিকর আর আনোয়ার বাজিকর ঝোলা ঘাড়ে নিয়ে ভিখ মাঙতে বের হয়। জামির তাদের আর না করতে পারে না। দশদিন বিশদিন ঘুরে তারা কিছু রোজগার করে ফিরে আসে। সঙ্গে নিয়ে আসে দুটো বাঁদরের বাচ্চা। বাঁদরের বাচ্চাকে খেলা শিখাতে হয়। তারা জামিরের কাছে ভয়ে কিংবা লজ্জায় আসে না।

জামিরই তাদের ডাকে। বলে, ঠিক আছে। বাঁচে থাকা পরথম লড়াই, তা-বাদে আর সব। কাজ পালে কাজ করবা, না পালে বান্দর লাচাবা, রহু চণ্ডালের হাড় দিয়া ভেলকি দেখাবা। কিন্তু কাজ পরথম। আমি বুঢ়াটা হোই গিলাম, কথাটা মনে রাখ, বাপাসকল। সব কাম শিখবা হবে।

তখন আবার ঢোলকে বাড়ি পড়ে। ডুগ ডুগ ডুগ ডুগ লাগ ভেলকি লাগ, চোখে মুখে লাগ, হামার ছাড়ে সবাকে লাগ। হাই দেখো রহু চণ্ডালের হাড়ের কিসমৎ। সত্যের গুল্লি ডবল হ’, মিথ্যার গুল্লি চইল্যে যা-হাঁ, এই দেখো ডবল, ডুগডুগডুগডুগ—

তেরে নাও পিছল গয়া টুট গইল ঘাঘরিয়া
গাওমে ভিজ গয়া শাড়িরে–
তেরো নাও পিছল গিয়ায়
পুখর ঘাটমে চিকনা মাটি—

পনেরো হাত উঁচু দিয়ে দড়িতে অবলীলায় হেঁটে যায় বাজিকর যুবতী, দড়িতে দোল খায়, হাতের পায়ের ভঙ্গি করে। নিচে ঢোলক বাজে, চটুল গান হয়।

 

৪২.

এইভাবে বাজিকরের জীবন লল গড়িতে। আর প্রতি বছরই দু-জন তিনজন করে কাশি ও রক্ত ওঠা রোগে মরতে থাকে। লুবিনিও এই দীর্ঘ জীবন বেঁচে থাকবে এই রোগেই মরার জন্য।

জামির বাজিকরদের বাসস্থান করে দিয়েছিল। সে বাসস্থান যতই অকিঞ্চিত্বর হোক, যতদিন জামির বেঁচেছিল তার স্থায়িত্ব নিয়ে কারো মনেই কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু জামিরের মৃত্যু যত নিকটবর্তী হচ্ছিল, বাজিকর ততই অসহায় বোধ করেছিল। সে শুধু জামিরের নেতৃত্ব হারাবার ভয়েই নয়, মানুষের জীবনে ও চতুষ্পর্শ্বে জটিলতা খুব দ্রুত বাড়ছিল যা বাজিকরদের কাছেও অজানা ছিল না।

দনুর বংশধরেরা মৃত্যুর আগে বহুকে প্রত্যক্ষ করে। শেষ পর্যায়ে রহু তাদের তৃপ্তি কিংবা দুঃখ দেয়। পীতেম প্রসন্ন রহুকে দেখেছিল আর জামির দেখে বিষণ্ণ রহুকে, যেমনটি ঠিক দনু দেখেছিল।

লুবিনি শেষপর্যন্ত গেরস্থপাড়ায় ভিক্ষা করতে যেত, কখনো কখনো দুরের গ্রামেও। কখনো দু-একদিনের জন্য সে ফিরতও না শারিবা সেই সময় বড় অসহায় বোধ করত নিজেকে। বাপ রূপা বাজিকর দিনমজুরি করে সংসার চালায়। লুবিনির দেখাশোনা সে করতে পারে না। শাবিরার বড় অভিমান হয় বাপের উপর। কিন্তু লুবিনি ব্যাপারটা মেনে নেয়।(কলৈ, তুই যখন উঁয়া হবি তখন হামাক খোয়াবি। উপর তো নিজেরি চলে না।

তারপর লুবিনির দৃষ্টি খুব দ্রুত ঘোলাটে হয়ে আসতে থাকে। যেন কয়েক মাসের মধ্যেই তার বয়স অনেক বেড়ে যায়। সে অথর্ব হয়ে যেতে থাকে ক্রমশ। তখনো রূপা তাকে দেখাশোনার কথা চিন্তা করতে পারে না। লুবিনির তারপর নিয়মিত জ্বর হতে থাকে।

শারিবা বলে, নানি, তোর গা এংকা গরম ক্যান? জ্বর হইছে?

লুবিনি নেশাগ্রস্তের মতো উত্তর দেয়, জ্বর লয়রে, শারিবা হামরা ইয়াক ‘হাতপাক’ বলি। বিগামাই বিরাগ হল্লে এংকা রোগ হয়। গলা থিকা ‘লোই’ উঠে, খাশি হয়, তবি ইয়ার নাম লোই লোগ। ইতো বাজিকরের লিয়তি।

রোগ যত বাড়তে থাকে, লুবিনি তত প্রাচীনা ও অপরিচিতা হতে থাকে শারিবার কাছে। মাঝরাত্তিরে ঘুম ভাঙলে শারিবা নানির বিড়বিড় শুনতে পেত। নানি বলত, ঠাকুরজি, হারুরানে যাই। ওলামাই, কালিমাই, বিগামাই, হারুরানে যাই।

শাবিরা এসব শব্দ বুঝতে পারত না। পরে সে জানতে পেরেছিল, এইসব অজ্ঞাত দেবতা বাজিকরের রাস্তার সংগ্রহ, তার নিজস্ব কিছু নয়। লুবিনি এইসব দেবতার কাছে আত্মার শান্তি, না মৃত্যুভয় থেকে নিষ্কৃতির জন্য প্রার্থনা করত কে জানে? জ্বর যখন খুব জাঁকিয়ে আসত, লুবিনির তখন বিকারের লক্ষণ দেখা দিত। চাটাইয়ের উপর উঠে বসে সে শারিবাকে টেনে কাছে এনে দূরে পাতালুর বাঁওড়ের দিকে কাঁপা কাঁপা হাত তুলে দেখাত।

কি, নানি? কি?—

শারিবা, হুই দেখ, রহু।

জামিরকে সে সারাজীবন লড়াই করতে ও হারতে দেখেছে, সেসব স্মৃতি তাকে প্রবল হতাশায় সেইসব সময় ও এখন এই শেষ সময়ে আচ্ছন্ন করে রাখে। তবুও

সে শারিবাকে কিছু কথা বলে যা পীতেম ও জামির ভাবত ও বলত।

শারিবা ভয় পেয়ে বলত, কি বলিস? কি বলিস, নানি?

লুবিনি তখন আধা সম্বিতে আসত। বলত, তুই খুব সুন্দর নওরঁ হবি, শারিবা। তোর বিয়েতে বহু দূর থেকে সিই গোরখপুর ঠেঙে নওরিঁ আনব। তারপর বলত, বিহা লয় ইওয়া। হামি মরার আগে বাজিকরের বুলিগুলা শিখ্যে লে, শারিবা। আমি তো ডঅ, বেহুদ্দা বুড়া, আজ বাদে কাইল মরি যাব। তা-পর শ্বশুরঘরের লোকের সাথ কথা বলবার পারবি না, তখনু সি বড় লাজের কথা হোবে।

তারপর জ্বরের ঘোরে আপনমনে লুবিনি যেন শারিবার বিয়ের অনুষ্ঠান সাজাত। মাঝখানে মাটির বেদিতে নওরী-নওরিঁ বসে, চারদিকে চারটে কঞ্চি পুঁতে তাতে বিনিপাকের লাল সুতো দিয়ে ঘিরে ফেলছে লুবিনি, আর তার গলা থেকে তখন মৃদু অথচ উচ্ছল গান উঠত।

দেও আওয়েতো দেওরে ভাই
বান্ধনা তো সারিমাদে
দেও আওয়েতো দেওরে ভাই
মাকরানা সারিমাদে
দেও আওয়েতে দেওরে ভাই
সাপনারা সারিমাদে

এবং সে দুইহাতের আঁজলায় যৌতুক দেওয়ার ভঙ্গি করত নাচের মুদ্রায়। এই তোর ইওয়া হইছে, রে শারিবা। ইবার তোক আর তোর নওরিঁক হালদি মাখানু।

এ সে হলদি লাগিরে, এ তো মায়েরি
তেল মেশুরে লুড়ে, এ তো মায়েরি।

নানি তারপর উচ্ছল হাসত, হাসতে হাসতে কাশত এবং কাশতে কাশতে লোই তুলত।

 

৪৩.

এইভাবে একদিন লোই তুলে নানি ঠাণ্ডা হয়ে গেল। শারিবা তার বুকে গরম সেঁক দিয়েও আর উষ্ণ করতে পারল না। বাজিকরদের একটি যুগকে শেষ করে লুবিনি মরল। তারপর নতুন যুগ শুরু হল। কেননা তখন চৌধুরী সাহেব এ কথাটি তুলেছে, তুরা হিন্দু না মোছলমান, আঁ? মহিমবাবু প্রশ্ন তুলেছে, হাঁই বাপু, তোরা গরুও খাস, শুয়ারও খাস, ই কেমকা জাত রে বাবা!

এসব কথা তখন ওঠার কারণ ছিল। তখন সাহেবরা যাব যাব করছে। হিন্দুস্থান-পাকিস্তান হব হব করছে। সবচেয়ে বড় কথা, এই তাবৎ অঞ্চল জুড়ে তেভাগা নামে চাষিদের একটা বিরাট লড়াই হয়ে গেছে। এই লড়াইয়ে চাষি মরেছে অনেক সন্দেহ নাই, কিন্তু জোতদারও মরেছে, এটাও ঠিক। আধির উপর দখল কায়েম রাখার জন্য আধিয়াররা সংঘবদ্ধ হয়ে আছে।

এই শেষ ঘটনাটিই সবচেয়ে বড় বিপত্তির কারণ। কেননা যুদ্ধের বাজারে বাঁশ কাঠের দাম চড়া ছিল। কাজেই মহিমবাবু ও চৌধুরী সাহেব লালমিয়া জঙ্গল ও বাঁশবন পরিষ্কার করেছে বাজিকরদের দিয়ে। কেননা এত কম মজুরিতে অন্য কোনো মানুষ পাওয়া যেত না। জামিরের সঙ্গে একটিই মৌখিক চুক্তি ছিল, তা হল জঙ্গল খালাস হলে জমিগুলো বাজিকরদেরই আধি দিতে হবে।

মহিমবাবু কিংবা লালমিয়ার আপত্তি কিছু ছিল না। কারণ, তখনো তো হিন্দুস্থান-পাকিস্তান হয়নি। তখানা তো তেভাগা চাই’ আওয়াজ শোনা যায়নি। তখনো তো আধিয়ারের দাবি বলে কোনো অদ্ভুত কথা কেউ কোনোদিন শোনেনি।

কাজেই দু-দুটো বছর বাজিকরেরা সেই নতুন জমিতে শিক্ষানবিশি করল। এতদিন চাষের কাজে তারা আংশিক সময়ের শিক্ষানবিশি করত, এখন পুরো সময়ের। যা ফসল ফলল, তা অতি সামান্য। তবু তারই অর্ধেক মালিককে দিল, অর্ধেক নিজেরা খেল। একটা নতুন আনন্দ, যা জামির বাজিকরের মৃত্যু পর্যন্ত রোখ আর স্বপ্নই থেকে গেছে। এইভাবে তারা চাষের কাজ পুরোপুরি শিখল। জীবনের নতুন স্বাদ, সবরকম রঙের উজ্জ্বলতা তারা খুব ভায়ে ভয়ে অধিকার হিসাবে গ্রহণ করতে শিখল। যাবতীয় অনাস্বাদিত সুখের খোলা দরজার সামনে তারা যেন এসে দাঁড়িয়েছে। এইবারে ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি মিলে গেছে। গৃহস্থের অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, সামাজিকতার অধিকার যেন আয়ত্তের মধ্যে এসে গেছে। যাযাবরের তাঁবু ছিঁড়ে ফেলে শক্ত খুঁটোর ঘর বাঁধা। তারপর জীবন বয়ে যাবে স্বাভাবিক স্রোতের মতো। অনির্দিষ্টের মধ্যে আর ঘুরতে হবে না। জমি হচ্ছে স্থিতি—দৈহিক, মানসিক ও সামাজিক। লুবিনি বলত, শারিবা, তুই বুঝবি না, বাজিকরের জুয়া রেজা-রেজানিওর বিয়ে দেওয়া বড় কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই গোষ্ঠীর মধ্যে এই ছয় পুরুষ ধরে ক্রমাগত রক্তের সম্বন্ধ হচ্ছে। এলা ঠিক কাম লয়। এতে মানুষের সাথ কুৎরিওঁ বা ওয়ারুর, কুকুর বা বাঁদরের তফাত থাকে না। হিন্দু তোমা সমাজে লিচ্ছে না, মুসলমান তোমা একসাথ ওঠবস করায় না। এংকা কথা তোর নানা ভাবিছিলো। কিন্তু শেষ দিশা করবা পারে নাই। তবি ভাবিছিল। জমিন হল্যে থিতু হবে, থিতু হলে সব হবে।

সেই থিতু যখন হাতের কাছে, তখনই লালমিয়া, মহিমবাবু চরম প্রশ্নটি করে। ইয়াসিন তখন বাজিকরদের সর্দার বা মণ্ডল। লালমিয়া আকৰ্ণ বিস্ময় প্রকাশ করে।

নাম তোর ইয়াসিন, আর তুমু মুছলমান লও?

জী মালিক, হামি বাজিকর।

জুম্মা জিয়াপৎ করো না?

ওলা জানি না, হুজুর।

ধম্মোকম্মো কি কর?

অভিজ্ঞ ব্যক্তিটি দলের মানুষের কাছে বেকুব হয়ে যায়, এদিক ওদিক তাকায়।

ঠাকুর দেবতা কিছু আছে?

ওলামাই, কালীমাই, বিগামাই, এলা সব আছে।

তবি তো তুমাদের হিঁদুর সঙ্গ?

কিন্তু মহিমবাবু বলে, ক্যারে, ওলামাই, কালীমাই তো বোঝ্‌নো, কিন্তু বিগামাইটা কি বস্তু?

অংকা ঠিক জানো না, মালিক।

পূজা আচ্চা হয়?

থানে সিঁদুর, ধূপ দেবা হয় হুজুর। আর গান হয়।

আবার গরুও খাস?

মৌনতা।

আবার শুয়ারও খাস?

নিরবচ্ছিন্ন মৌনতা।

কি বেজাত রে বাবা, ভাবা পারি না?

তৃতীয় বছরে খালাসি জমি ভদুই ধানে হেসে উঠেছে। বাজিকর তখন আর বলদকে বারাদ বলে না, ভঁইসকে হেলো বলে না। স্থানীয়দের মতো বলদ আর ভঁইসই বলে। বেশ কয়েক ঘরে বলদ ও ভঁইসের হাল হয়েছে। জীবন স্বচ্ছল নয়, কিন্তু পায়ের নিচে চোরাবালিও নেই। নরম মাটি শক্ত হচ্ছে।

কিন্তু শক্ত মাটিতেও ধস নামে। যার ধর্ম নেই তার সঙ্গে আবার ন্যায়নীতির সম্পর্ক কি? যার সমাজ নেই তার সঙ্গে সামাজিক চুক্তি হয় না। এসব লালমিয়া এবং মহিমবাবু চিরকাল ভালো বোঝে। সুতরাং ভাদুই ধান কাটার আগেই ইয়াসিন ও রূপার জমি বেহাত হয়ে যায়। রূপা কিংবা ইয়াসিন কিংবা বাজিকরদের অন্য। কত মহিমবাবু বা লালমিয়াকে সঠিক চিনত না।

কিন্তু শারিবা চিনত। তাকে চিনিয়েছিল আকালু। আকালু পোলিয়াদের ছেলে, সাক্ষাৎ আকাল। তিন বছর বয়স থেকে সে অনাথ। এখন তার চোদ্দ বছর বয়স। শারিবার থেকে বছরদুয়েকের ছোটই হবে। অবশ্য বয়সের হিসাব শারিবা কিংবা আকালুদের সমাজে কেউই করে না। অন্তত নিয়মমতো করে না। তাদের বয়সের হিসাব শ্রমের মাপকাঠিতে, যথা—চ্যাংড়া, জোয়ান কিংবা বুঢ়া।

লুবিনির মৃত্যুর পর আকালুই শারিবার বন্ধু হয়। আকালু সেই তিন বছর বয়স থেকে পৃথিবীর সঙ্গে একা লড়ে যাচ্ছে। সুতরাং পৃথিবীকে সে ভালোই চেনে। সেই অবুঝ বয়স থেকেই তার পেশা হাপু গান। হাপু একটি দীর্ঘ ছড়া, গান ও আবৃওির মাঝামাঝি একটি সুরে গাওয়া হয়। অনুষঙ্গ থাকে গায়কের হাতের একটি মোটা পাঁচন লাঠি আর মুখ, নাক ও বুগল্প ইত্যাদি নির্গত বিভিন্ন বিকৃত ধ্বনি, শীৎকার। গানের সঙ্গে বা সমে লাঠি দিয়ে গায়ক তার সর্বাঙ্গে অত্যন্ত দ্রুত লয়ে আঘাত করে শব্দ সৃষ্টি করে। যেসব জায়গায় আঘাতের শব্দ অধিক হয় সেসব জায়গাতেই লাঠি বেশি পড়ে। অভ্যাসে ক্রমশ জায়গাটি নির্দিষ্ট ও ক্রমাগত আঘাত হিত হয়ে যায়। এই জায়গাগুলো হচ্ছে পিঠের উপরের দুই বাহুসন্ধি, পাছা, জানু, শিরদাঁড়ার ঢালু অংশ। এই সমস্ত অঞ্চল ক্রমশ কড়া পড়ে শক্ত ও তামাটে রঙের হয়ে যায়। গানের শেষাংশে লাঠির বাড়ি এমন দ্রুত ও ভয়াবহ শব্দে হতে থাকে যে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ অনেকসময় ছুটে এসে হাত চেপে ধরে লাঠি কেড়ে নেয়।

আকালু অনেকদিন পর্যন্ত বুঝতে পারেনি মানুষ এই গান শুনে এবং লাঠি পটা দেখে পয়সা দেয় কেন। তার এই বিচিত্র পণ্যের একজন নিয়মিত ক্রেতা ছিল মহিমবাবু। সপ্তাহে দু-তিনবার আকালুকে সে ডেকে পাঠাত ও হাপু শুনতে শুনতে, দেখতে দেখতে মহিমবাবুর মেদবহুল শরীরের বিভিন্ন অংশ উত্তেজনায় কাপতে থাকত, চোখ দুটো বড় বড় হয়ে ঠেলে বেরোতে চাইত, নাকের পাটা ফুলে উঠত এবং দ্রুততায় আকালু লক্ষ্য করত মহিমবাবু হাঁফাচ্ছে।

আকালুর আরও কিছু বাঁধা খদ্দের ছিল। দুপুরে শুয়ে বসে আলসেমি করে— এমন কিছু স্ত্রীলোক, যাদের বউ অন্য পুরুষের সঙ্গে নষ্টামি করে এমন কিছু পুরুষমানুষ, আর তাড়ির গদিতে বা ভাটিখানায় যারা অনেকক্ষণ বসে নেশা করে তারা। আকালু লক্ষ্য করেছে, এই ধরনের মানুষ তার “হাপু শুনবে—হা-পু-উ” এই হাঁক শুনলে চঞ্চল হবেই।

এইভাবে সে তার বিচিত্র গান, শব্দ ও প্রহারের সঙ্গে মানুষের অন্য এক বা একাধিক ইন্দ্রিয়বৃত্তির সম্পর্ক ভাসাভাসা ভাবে ধরতে শেখে। ব্যাখ্যা সে করতে পারে না। কিন্তু মহিমবাবুর সঙ্গে বাগোলা হাটের সেই গেরস্ত মানুষটার তফাত বোঝে। সে মানুষটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই এক ভাড় তাড়ি গলায় ঢালছিল। লাঠির শব্দে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে আকালুকে একনজর ভ্রু কুঁচকে দেখে। তারপর ভাড়টা নামিয়ে রেখে দ্রুত এসে লাঠিটা আকালুর হাত থেকে কেড়ে নেয় এবং ছুঁড়ে পগারে ফেলে মুখে বলে, ছিয়া ছিয়া, এলা বেটাছাবালের কাম? খাইটে খাবার পার না?

আকালু কোনো প্রতিবাদ করতে পারেনি। কেননা লোকটার মুখে একটা শক্তিশালী ধিক্কার ও ভৎসনা ছিল। কাজেই মহিমবাবুর সঙ্গে এই সুস্থ স্বাভাবিক মানুষটার তফাত বোঝে সে।

ইদানিং শারিবা আকালুর সঙ্গে সর্বত্র ঘোরে। শারিবা বলে, তুই যি অংকা পান্টি সে আগাপাশতলা বারাস, লাগে না?

লাগে তো।

তবি?

কি তবি? না বারালে মানসি পয়সা দিবে? হাঁই দেখে, মহিমবাবু। হামাক বারাবা দেখলি ওয়ার শরীরে স্বােয়াদ লাগে। অরুচি তো।

অরুচি? তোক বারাতে দেখলি স্বোয়াদ লাগে!

লাগে, লাগে। এলা তুই বুঝবু না।

 

সেই আকালু শারিবাকে আগেই বলেছিল, তোরাদের আধি জমিগুলান বেহাত হোই যাবে।

ক্যান?

অংকাই। আমুনি যায়।

এসব দার্শনিক কথা শারিবা বোঝে না। সে বলে তোর মাতা। মহিমবাবু লালমিয়ার কত্তো জমি। আরো জমি দে কি করবি?

আকালুর জিহ্বায় অশ্লীল কথা খুব স্বাভাবিকভাবে আসত। সে বলে, আর আর মানসের অ্যাটাই ইয়া থাকে। লালমিয়া আর মহিমবাবুর কড়া জানু?

কড়া!

পাঁচ পাঁচটা করে।

হেই!

বিশ্বাস যাচ্ছে না চাঁদু। দেখলি তবি বুঝতা।

তুই দেখিছিস?

নালে তোক অ্যাংকাই ক-ছি?

ধুর, মিছাই হামা বোকা বানাছে।

আকালু হি হি করে হাসে।

কিন্তু পরে শারিবার ধারণা হয়েছিল, এরকম একটা অস্বাভাবিক উপাঙ্গগুচ্ছের অস্তিত্ব না মানলে সবকিছু ব্যাখ্যা করা যায় কি করে?

দিগিন মণ্ডল নামে এক অবস্থাপন্ন জোতদার মহিমবাবুর কাছ থেকে রূপা ও ইয়াসিনের আধি জমিগুলো কিনে নেয়। সে মাঠ দু-খানায় তখন ভাদুই ধানে সাবে রঙ ধরেছে। দিগিন দুই বাজিকরকে ডেকে বলল, তিন দিন সময় দিলাম। ধান কেট্যে মাঠ ফাকা কর।

ক্যান?

জমিটা হামি কিন্যাছি।

কেন্তু ধান তো মোট্যে পাক ধরিছে।

ওলাই কাটবা হোবে। হামি আমন লাগাববছন বুড়া হই যাচ্ছে।

দু-জনে তখন মহিমবাবুর কাছে গিয়েছিল। মহিমবাবু তখন আকালুর আথাল-পাথাল পাণ্টির বারি খাওয়া দেখছে ও মুখের বিচিত্র ‘হোক্কা-হোক্কা’ আওয়াজ শুনছে। তার শরীরে তখন স্বেদ কম্প এইসব হচ্ছে। তার তখন কথা শোনার সময় নেই। পুরো না শুনেই বলল, আরে জমির অভাব হচ্ছে? পাশের জঙ্গল খালাস করে লেও। এলা কি অ্যাটা মোকদ্দমা?

ইয়াসিন, রূপা দিগিনের কাছে সাতদিনের সময় চায়। দিগিন হাঁ-না কিছুই বলে না ও তিনদিন পরে মাঠে হাল মই নামিয়ে দেয়। রূপার যাযাবর রক্তের আকস্মিক ক্রোধ ঝলসে ওঠে ও একজন তার হাতে খুন হয়। তারপরেই আড়ালের চিরকালের ভয়ার্ত মারখাওয়া বেদিয়া সারা দুনিয়াব্যাপী অন্ধকার দেখে পালায় সে, ক্রমাগত পালায়। পিছনে পড়ে থাকে দুই পুরুষেণ অর্জিত অধিকার, প্রিয়জন, আকাঙ্খা, অতৃপ্ত ঘর-গেরস্থালির পরিকল্পনা।

তারপর যা হয়, তখন তা হামেশাই হতো। এখন যাকে একটা ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস মনে হবে, তখন সেটাই স্বাভাবিক মনে হতো। দুই কুন্‌ঠিবাড়ির দুই হাতি বাজিকরের ঘর ভাঙে। ভাদুই ফসলের জমিগুলোকে দাপিয়ে কাদা করে। ঘরে আগুন লাগে। বাজিকর রমণীরা বয়স নির্বিশেষে ধর্ষিতা হয়। ইয়াসিনের মেয়ে পলবি নিখোঁজ হয়। তারপর এই ছিন্নমূল মানুষগুলোকে তাড়িয়ে অনেকদূর পার করে দেয় মহিমবাবু, লালমিয়া ও দিগিন মণ্ডলের লোকেরা। এসব উপভোগ করার মতো দৃশ্য তখন হামেশাই হতোবাচ্চা-কাচ্চা, পোঁটলা-পুটলি নিয়ে মানুষ ছুটছে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে, পিছনে তাড়া করে যাচ্ছে আরেকদল ক্ষিপ্ত মানুষ, ছুঁড়ছে ঢিল।

তখন বর্ষার দিন। মানুষগুলো নদীর পাড় ধরে এগোয়, কেননা নদীর পাড়ে কাদা কিছু কম, পলি অঞ্চল। তারা এগোয় পুবের দিকে। রাস্তায় আট-দশটি শিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধা মরে। মরে দু-জন আসন্নপ্রসবা রমণী। এইভাবে তারা পুবে চল্লিশ মাইল সরে এসে পাতালু নদীর ধারে মোহর হাটখোলায় তাদের বোঝা নামায়।

তাদের জীবন হয় আরো আদিম, আরো নির্মম। তাদের রমণীরা তখন গ্রাম্য হাটুরে মানুষের মনোরঞ্জন করে ক্ষুগ্নিবৃত্তির চেষ্টা করে। পুরুষরা চুরি জোচ্চুরি করে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখে। আবার ঢোলকের চামড়ায় কাঠি পড়ে, আবার বহু চণহালের হাড়ে তেল সিঁদুর লাগে, অনভ্যস্ত পায়ে টানটান দড়ির উপরে হেঁটে যায় বাজিকর বালিকা। আবার তার মধ্যেই কখনো আনুষ্ঠানিক গান ওঠে–

এ সে হালদি লাগিরে
এ তো মায়েরি
তেল মেশুরে লুড়ে
এ তো মায়েরি।

 

৪৪.

পরবর্তী ছ-মাস বাজিকরেরা মোহরের হাটখোলায় প্রায় খোলা আকাশের নিচে থাকে। এর মধ্যে পাঁচবিবি আর মোহরের এই চল্লিশ মাইল দূরত্বের মাঝামাঝি জায়গায় সীমানা চিহ্ন হয়। পাঁচবিবি পড়ে পাকিস্তানে, মোহর ভারতে। মোহরের উপর নতুন মানুষের চাপ বাড়ে। জমি বদল হয়, জমি দখল হয়। জমির দাম বাড়ে, মানুষের দাম কমে। দেশের মানচিত্রে ও শাসনযন্ত্রে নানারকম পরিবর্তন হয়।

কিন্তু বাজিকরদের বিগত পঞ্চাশ বছরের জীবনের সঙ্গে পরবর্তী তিরিশ বছরের কোনো তফাত হয় না। পঞ্চাশ বছর আগে জামিরের নেতৃত্বে যে প্রয়াস শুরু হয়েছিল ইয়াসিনের নেতৃত্বে আবার নতুন করে তা শুরু হয়। গত পঞ্চাশ বছরে যে অভ্যাস ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে তার থেকে আর রেহাই পায় না বাজিকর। বাজিকর আর পুরোপুরি বাসিয়া বাজিকর হতে পারে না। খেলা দেখায় ভিখ মাঙ্গে ঠিকই কিন্তু প্রাচীন জীবনে সে আর ফিরে যেতে পারে না। দুই পুরুষে পৃথিবীর রাস্তা তার কাছে সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে, পা সীমাবদ্ধ পরিচিত পথের মাপে।

কাজেই আজুরা মণ্ডলের আনাগোনাকে কাজে লাগাতে হয়। আজুরা ভয়ঙ্কর মুখাকৃতির ছোটখাটো চেহারার মানুষ। হঠাৎ মুখ দেখলে ভীষণ বলিষ্ঠ মনে হয়। পাশবিক মনে হয়। কোনোকালে হয়ত সারামুখে অজস্র ব্রণ হতো। এখন হয় না। কিন্তু অতীতের সেই ক্ষত মুখটাকে উঁচু নিচু একটা খসখসে কর্কশ রূপ দিয়েছে। তার চোখ স্থির, খুনীর মতো। সে প্রচুর জমির মালিক, কিন্তু সে পাঁচবিবির অবস্থাপন্নদের মতো হাতি-পোষা বড়লোকি করে না। কারণ পাঁচবিবি মোহর থেকে অনেক এগিয়ে। আজুরা মোহরের মাপের মানুষ। আজুরার ভোগবৃত্তি সবই মোহরের মাপের। দিগিন মণ্ডল পলবিকে লুঠে নিয়ে ভোগ করে, আর আজুরা সরাসরি বাজিকরের পাতার ঘরে আসে, গল্প জমায়, সরাসরি প্রস্তাব ও লেনদেন করে।

হাটখোলায় হাটুরে রসিকরা আসে, আজুরা আসে, কেরোসিনের লম্ফ জ্বলে, নেভে। পুরুষেরা কেউ এ নিয়ে কথা তোলে না, মেয়েরা এ নিয়ে পাতালুর নদীর গিয়েও আলোচনা করে না। কোনো আলোচনা না করেও সবাই ধরে নেয় পথচলতি রাস্তায় একটা অত্যন্ত অবর্জনাভরা বাঁক। এ বাঁকটা পেরোলেই ভালো, পরিষ্কার রাস্তা পাওয়া যাবে। কেউ এ আশ্বাস দেয়নি, তবুও।

ছ-মাস পরে মোহর হাটখোলা ছেড়ে ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তার দুপাশে বাজিকরেরা তাদের নতুন করে কাদামাটির দেয়াল তোলে। আজুরা তাদের সহায় থাকে, কাজেই বিশেষ প্রতিবন্ধকতা হয় না। আজুরার জঙ্গলাকীর্ণ বিশাল ভিটা জমি সমতল হয়ে আবাদি জমি হয়। ওপার থেকে ক্রমাগত মানুষ আসতে থাকে জমির ব্যবহার বাড়ে। ফসলের দাম দ্বিগুণ হয়। আজুরা তৈরি জমি বিক্রি করে ও বাজিকরদের সহায়তায় পতিত জমি উদ্ধারে মন দেয়। অলিখিত শর্ত থাকে পাঁচবিবির মহিমবাবুর মতো। অর্থাৎ বাজিকরেরা সেই পুরানো স্বপ্ন দেখে, খালাসি জমির আধি পাওয়ার স্বপ্ন। এইভাবে তারা আজুরার আশ্রয়ে থাকে। আজুরা একথা ভেবে শ্লাঘা বোধ করে ও বাজিকরেরা তার প্রতি কৃতার্থ থাকে। আজুরার সঙ্গে বাজিকরদের সম্পর্ক আরো দৃঢ় হয় যখন সে লছমনের মেয়ে নসিবনকে তার পাঁচ নম্বর উপপত্নী করে।

রাস্তার পাশের নতুন বাড়িতে এসে শারিবার মা মধ্যবয়সী শা-জাদি মধ্যবয়সী ইয়াসিনের ঘর করতে চলে যায়। কেননা রূপার ফেরার আর কোনো আশা থাকে না। পলবির মা পাঁচবিবি থাকতেই লোই আর হাতপাক রোগে মারা গিয়েছিল। শাজাদি যদিও ইয়াসিনের চাচাতো বোেন,তবু এ নিয়ে কোনো সমাজ হয় না। কেননা বাজিকরেরা চিরকালই নিজস্ব গোষ্ঠীর মধ্যে বদ্ধ। এখন একেবারেই নিরূপায়। পাশ্ববর্তী কোনো সমাজই তাদের গ্রহণ করে না। কাজেই জান্তব জৈব অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে প্রায় স্বজনগমনই তাদের মেনে নিতে হয়।

মানুষ যেহেতু যে-কোনো জানোয়ারের থেকে অনেক বেশি পরিশ্রমী সেকারণেই বাজিকরেরা নিজেদের অস্তিত্ব রাখতে পারে। আর বাজিকরদের পরিশ্রম আজুরাদের বড় কাজে লাগছে, কাজেই তারা বেঁচে থাকে। কিন্তু জীবন বিবর্ণ, এত বিবর্ণ যে জন্মে কোলাহল হয় না, মৃত্যুতে হাহাকার নেই। অথচ যে-কোনো স্তরের জীবনধারণের সংগ্রামে এই উচ্ছ্বাস দু-টি থাকে, এমনকি পশুদেরও।

শারিবা আজুরা মণ্ডলের পতিত ভিটা জমির উঁচু নিচু মাটি চটিয়ে সমতল করো অন্যদের সঙ্গে এবং বিশ্রামের সময়ে এসব চিন্তা করে। এখন তার বয়স বিশ বছরের কাছাকাছি। শক্তসমর্থ যুবক শরীর তার। সে চিন্তা করে, কেননা লুবিনি তার ভিতরে চিন্তার বীজ বপন করে গিয়েছিল। সে বোঝে চিন্তা সবাই করো না, চিন্তা কাউকে কাউকে করতে হয়। জামির বাজিকর চিন্তা করেছিল, লুবিনি চিন্তা করেছিল, শারিবা এখন চিন্তা করে।

একপাশে গাছের তলায় তার প্রায় সর্বসময়ের সঙ্গী আকালু বসে থাকে। আকালু তাদের সঙ্গেই দেশান্তরী হয়েছিল। সে পরিশ্রমের কাজ করো না, অথবা করতে পারে না। তার শরীর শীর্ণকায়। এখনো সে হাপু গায় এবং বাজিকরদের কাছে শেখা নানারকম হাত সাফাইয়ের খেলা দেখিয়ে পয়সা রোজগার করে।

আকালী বলে, চ্যাতনে আছিস, শারিবা? কি ভাবিস সদাই?

না, ভাবি না।

পলবির কথা?

থাম শালা বেজাত! খাম্‌‌কা একোই চিন্তা।

অথচ চিন্তাটা খামোখা নয়, এবং জানে একমাত্র আকালুই। যে বয়সে শারিবা পলবির দৃষ্টিতে শিশু। সর্বত্রই, সব সমাজেই অষ্টাদশী পলবিরা মোল বছরের শারিবাদের শিশু ভাবে। অথচ এরকম ঘটনা হয়, সব জায়গাতেই।

আকালু বলে, ইয়াসিন তোর মামা লাগে না?

শারিবা ইঙ্গিতটা বোঝে। মাথা নাড়ে। এ শুধু তাদের দু-জনার অন্তরঙ্গ সংলাপ, শুধু তাদের দুজনার।

তোর মায়ের আপন চাচেরা ভাই?

শারিবা নিশ্চুপে মাথা নাড়ে।

তোদের মাঝে একা হয়, হামারদের বম্মনদের এমকা হয় না।

হামারদেরও এলা আগে হোত না। এখন হয়, রূপায় কি?

তোরা তো হামারদের সাথ কুটুম করবি না। মুসলমানরাও করবে না। বাজিকরের ঘরোৎ বিয়া-সাদি ঝকমারি হোই গিছে।

ক্যান? আজুরা তোদের সাথ কুটুম করলো লয়?

কুটুম? ওলা কুটুম কয়? আন্ লোকের কথা ছাড়, আকালু। তুই বিহা করবি বাজিকরের বিটিক?

হামি? তোর মাথা খারাপ? হামাক কোন মেয়া বিহা করবে?

ক্যান? মেয়ার অভাব?

না না, সিটা কথা লয়। হামাক ভাল করি দ্যাখ, ভাই শারিবা। হামাক যি মেয়া বিহা করার চাবে, তাক হামি কেমকা বিহা করমো?

ক্যান?

শারিবা ধরতে পারো না রহস্যটা।

হামার জুটি যি হবি শারিবা তাক কোন মরদ বিহা করবার চাবে?

মজাক ছাড়, আকালু। সিধা কথা ক। বাজিকরের মেয়া বিহা করবি?

হামার তো জাত নাই। হামি বেজাত। কেন্তু হামাক্‌ দি কি আসে যায়?

 

পলবি নিখোঁজ হয়, নসিবন ঢেমনি হয়, শা-জাদি তার চাচেরা ভাইয়ের ঘরে উঠে যায়। শিশুমৃত্যু, অকালমৃত্যু বাড়ে। একই রক্তের মধ্যে বারবার মিশ্রণ হয়। উপায় কি! নিদান দেওয়ার মতো বয়োবৃদ্ধ কেউ বেঁচে নেই।

এরকম একদিন অতি ভোরবেলায় শারিবা পাতালু নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ওপারে সূর্যোদয় দেখে। ওপারে নদী একসময় পুব থেকে পশ্চিমে বয়ে আসত, এখন গতিপথ পরিবর্তন করে উত্তর থেকে দক্ষিণে এসে এই জায়গায় পশ্চিমে বাঁক নিয়েছে। ফলে পুবের পরিত্যক্ত চড়া এখন দীর্ঘস্থান জুড়ে বালিয়াড়ি, প্রায় উদ্ভিদশূন্য। সূর্য ধীরে ধীরে ওঠে, সেই বালিয়াড়িতে নানাবর্ণের প্রতিফলন ফেলে। বালির উপরে জমে থাকা শিশিরবিন্দু ঝলমল করে। শারিবার এই সূর্যকে মনে হয় লুবিনির-বর্ণিত ‘তরক’-এর মতো। রক্তাক্ত বৃহৎ যাযাবরী ‘তরক’ যেন পরিচিত সূর্য নয়। এবং সেই তরকের ভেতর থেকে যেন নেমে আসে একটি হেলো, মহিষ নয়। গলা লম্বা করে বাড়িয়ে দিয়ে সেই হেলো ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকে, পিছনে সূর্য। ক্রমে স্পষ্ট হয়। হেলোর পিঠের উপরে একজন মানুষ আড়াআড়ি বসে আরেকজন মানুষ পাশে পাশে আসে।

আকালু ও শারিবা আগন্তুকদের দেখতে থাকে। নদীর পাড়ে এসে তারা থামে, তারপর নদী পার হয়। এপারে এলে শারিবা পরিষ্কার চিনতে পারে রূপাকে। যদিও লাল জমকালো লুঙ্গি তার পরনে, গায়ে নীল শার্ট, মাথায় হলুদ রঙের রুমাল কপালের উপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে টেনে বাঁধা। তবুও বাপকে চিনতে ভুল হয় না শারিবার। মোষের পিঠের উপর বছর পঁচিশ-ছাব্বিশের তীক্ষ্ণ চেহারার এক যুবতী। তার দুই পাশে দড়ির শিকলিতে ঝুলিয়ে রাখা তিন তিন ছ-টা সাপের ঝাঁপি।

রূপা প্রথমে দ্বিধাগ্রস্ত থাকে তারপর নিঃসংশয় হয়, তারপর আবেগ ও গর্ব তাকে আপ্লুত করে।

শারিবা! হামার বেটা!

শারিবা নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে থাকে।

রূপা তার মুখে গায়ে হাত বুলায়, তার হাত কাঁপে, মুখের পেশী কাপে। সে আবার বলে, শারিবা? হামার বেটা।

শারিবা দাঁড়িয়ে থাকে।

রূপা তাকে ছেড়ে তার সঙ্গিনীর কাছে যায় দ্রুত। তার হাত ধরে টেনে নামায় তাকে।

শারিবা, হামার বেটা।

তার সঙ্গিনী দু-হাত উপরে তুলে ক্লান্তি ভাঙে শরীরকে মুচড়ে। ক্লান্ত অথচ কলহাস্য করে, বিস্ময় তার কণ্ঠে।

বাব্বা! এংকা জুয়ান বেটা তুমার!

রূপা আবার শারিবার কাছে আসে, কিছুটা বিল, কিছুটা সলজ্জ। সে সঙ্গিনীর পরিচয় দেয়।

শারিবা, ইয়া-ই-হইল শরমী।

সবার অলক্ষে আকালু গ্রামে ছুটে গিয়েছিল।

খুনী রূপা, পলাতক রূপা ফিরে আসে রঙ্গিলা রূপা হয়ে। এই হল যাযাবরী সভাব। আচমকা কথায় কথায় ছুরি ঝলসে উঠতে পারে, পরক্ষণেই আবার হয়ত হো হো হাসি, পানপাত্র হাতে। দাম্ভিক, হামবড়াই যাযাবর। আসল সাহসিকতার কাজে, ধৈর্যের কাজে, কষ্টসহিষ্ণুতার কাজে সে নেই।

জামির চেয়েছিল সেখান থেকে তাকে তুলে আনতে। শক্ত মাটির পৃথিবীতে তাকে দাঁড় করাতে চেয়েছিল। সে বলত, যাও সব, যার যার ঘরের ছামুতে গাছ লাগাও। নদীর চড়ায় বাস, বালির রাজ্যি। আকাশের এক তরক জমিনে হাজার তরক জ্বালায়। গাছ লাগাও, হেঁয়া হবে। গাছ লাগাও খড়ি হোবে, গাছ লাগাও তক্তা হবে।

যাযাবর বলে, হেই, কবি গাছ ঢেঙা হোবে, তা-বাদে তার পাত ঝাপরা হোবে, তবি সি গাছে ঘেঁয়া হবে। ওলা আমার কাম লয়।

জামির সেই যাযাবরকে শাসন করেছিল।

আবার সেইসব অনুশাসন যা বাজিকরকে অর্থহীন ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চাইত, জামির তাও ভেঙেছিল।

হেই তুমি বিটি ছেল্যা হয়্যার কাপড় নাইড়ে দিয়া আন্ জাগাৎ গেছ, আন কাপড় পিনধে আইছ, তুমার সামাৰ্জ বন্ধ হইল। হেই জামির, তুমু ইয়ার দণ্ড দেও। ইয়ার সাজা বিধান কর। (

না, ইয়ার দণ্ড হয় না। অংকা বিচার হয় না। মাঠ-ঘাট-রাস্তার বিচার মাঠ-ঘাট-রাস্তা—রাইখ্যে আসিছি। এখুন ঘর-জমিন আর ফসলের বিচার, লতুন বিচার, লতুন আইন।

অনেকে আহত হয়, আশঙ্কিত হয়।

আবার সেই জামির মতিনকে বলেছিল, না, পাসরা, তুমার বুনের বিটি, উয়া তুমু বিহা কইরবা পারবা না।

তবি হামি কাক বিয়া করছো? হামার বিহা হোবে না?

তুমু আন মেয়া খোঁজ, মতিন। পাসরা তুমার আপন বিটির পারা, তাক বিহা করা সাজে না।

সমস্যাটা তখনই জটিল হয়ে উঠেছিল। বাজিকরের ছেলেমেয়ের বিয়ের সমস্যা সবাইকে ভাবাচ্ছিল। অকালমৃত্যু বাজিকরদের দ্রুত সংখ্যা হ্রাস করছিল। কাজেই উপযুক্ত সময়ে পাত্রের পাত্রী ও পাত্রীর পাত্র পাওয়া যাচ্ছিল না। তাছাড়া লি-লাঙ্গল-জমি নিয়ে যে সমাজ তাতে বিয়ে একটি বিশেষ ব্যাপার। বিয়ে সমাজকে প্রশস্ত করে, পরিধি বাড়ায়। সবচেয়ে বড় কথা, বিয়ে কম হোক বেশি হোক, জমিকে নাড়াচাড়া করায়, কর্মী লোকের জমি বাড়ে। কিছু থাকলে তুমি খেটে তাকে বাড়াতে পার। সামান্য কিছুও পরিশ্রমের তেজে তাপে বাড়ে। কিন্তু আদিতে তো সেই সামান্য কিছু চাই। কিছু-না থেকে কিছু-না-ই বেরোবে। জামির এসব বুঝত। বুঝত, অন্য সমাজের সঙ্গে কুটুম্বিতা চাই। যাও মতিন, অন্য সমাজের বিটি বিহা করি আন।

কিন্তু সেসব জামিরের স্বপ্নই থাকে। পার্শ্ববর্তী কোনো সমাজের পাত্র বা পাত্রীকে বাজিকর ছুঁতে পারে না। দুর্লঙ্ঘ্য বাধা দূর করতে পারে না কেউ। অতি কদাচিৎ কেউ নিজ বাজিকর পরিচয় গোপন করে দূর থেকে বাজিকরের থেকেও হা-ঘরে নিরম্ন ঘরের মেয়ে নিয়ে আসে। জানাজানি হওয়ার পর অশান্তি হয়, দাঙ্গাও হয় কখনো কখনো। শেষপর্যন্ত জামিরকে অতি দুঃখে নিদান দিতে হয়, বাপসকল, জানবার হয়ো না। অর্থাৎ কন্যাস্থানীয় কিংবা পুত্রস্থানীয়কে বিয়ে কোরো না। চেষ্য রাখবা, যাতে বিটিরা দূরে যায় আর বেটারা দূর থিকা আনে। শোগর, মরি আর ইওয়া—জন্ম, মৃত্যু আর বিবাহ এই তিনকে হিসাবের মধ্যে রাখ, নিয়মের মধ্যে রাখ।

আর জামির বলত, বাজিকরের বেটারা, তুমরা বাদিয়া বটে, কেন্তু সি কথা এখন বিসসারণ হই যাও। আঁছোতে লোই লাচাবা না। না করবা মাথা গরম। কেন কি ইটা আমাদের থিতু হোবার সোমায়। মাথা ঠাণ্ডা রাখ বাপসকল।

তথাপি দেখ শারিবা, আমি কি কাজ করানো। হামার বাপ জামির বাজিকর কত বুঝার আদমি ছিল। হামি বাজিদের থিতু উচ্ছেদ করনো। হামি বাজিকর বালবাচ্চাকে মারা করনো। ই স আমার দোষে রে শারিবা। আর ই দেখ, এখুন পালাই বেড়াই। হোথা যাই, হেথা যাস, ফির বুঝি বাদিয়া বনে যাই। ই হামার সদাই ডর।

না, তুমার সি ডর নাই। দেশ ভাগ হোই গিছে। সি দ্যাশের আইন সিথাই থাকি গিছে। ওলা আইন হেথায় আর তুমাক ছোঁবে না।

হাঁ, সিটা বুঝেই ফিরনো। এখুন ইয়াসিন হামা রাখে, হেথা থাকমা। লয়তো চলি যাবো, ফির বাজিকর হোই যামো।

রূপা শা-জাদির কথা একবারও জিজ্ঞেস করে না। নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হয় বলে বোধহয় ছেলের কাছে সংকোচ লাগে। শারিবার পর শা-জাদি আরো তিনটি সন্তান রূপাকে উপহার দিয়েছিল, তার একটিও এখন আর বেঁচে নেই। শেষটির, জুম্মনের মৃত্যু হয় পাঁচবিবি থেকে পালানোর সময় রাস্তায় সাপের কামড়ে। রূপা এখনো সে কথা জানে না। মোষের পিঠের উপরে ঝোলানো সাপের ঝাঁপিগুলোর দিকে শারিবা যতবার তাকাচ্ছে ততবারই কথাটা তার মনে হচ্ছে। জুম্মন এখন থাকলে বছরদশেকের হতো। শারিবা আশঙ্কা করছে কখন রূপা প্রশ্নটা করে।

হাঁ শারিবা, জুম্মনরা কেকা আছে?

শারিবা থমকে থামে, অথবা সে থামে না, কেউ তাকে থামায়। সে আগে আগে চলেছিল, অন্যরা পিছনে। সে ফিরে দাঁড়ায়। তার দৃষ্টি আবিষ্ট, দূরবর্তী।

পাঁচবিবি থেকে মোহরের পথে এখন তার অস্তিত্ব। একটা পরিত্যক্ত মাঠকোঠা শাড়িতে তাড়া-খাওয়া মানুষগুলোর রাতের অবসন্ন আশ্রয়। অভুক্ত ঘুম। ভাই, হামাক্‌ কিসে কাটল? হায় ভাই, হামার হাত জ্বলি যায়।

শারিবা লাফ দিয়ে উঠেছিল। অন্ধকার বর্ষণসিক্ত রাত! মাটির মেঝেতে ধাবমান ইদুরের ভয়ার্ত চিৎকার। তার সঙ্গে ধাবমান সাপের ক্রুদ্ধ গর্জন। কি অন্ধকার। ভাই, কিসে কাটল হামাক? হায় ভাই, হামার হাত জ্বলি যায়।

দিগিন মণ্ডল তাড়া করেছিল রূপাকে। তার হাতে ছিল দেড় মানুষ দৈর্ঘ্যের একটা বল্লম, যার ধাতব অংশটাই ছিল এক হাত। রূপা পালিয়েছিল।

খাদ্য ও খাদকের মধ্যে হঠাৎ পড়ে গিয়েছিল জুম্মনের ঘুমন্ত হাত। কালাত্মক যম ভেবেছিল এ বোধহয় এক প্রতিবন্ধকতা। হায় ভাই, হামার হাত জ্বলি যায়।

কাঠখড়ির আগুনটাকে উসকে তুলেছিল শারিবা। তারপর জুম্মনের দ্রুত কিন্তু চার ঘন্টাব্যাপী মৃত্যু। ভাই, আমার সারা গাও রবশ লাগে ক্যান? মাও, হামাখ ধইরে উঁচা কর। হামি কেছু দেখবা পাছি নাই ক্যান?

শতাধিক মানুষ নিঃশব্দে ঘিরে রাখে জুম্মনকে, কেউ কোনো শব্দ করে না। যেন শব্দেরও মৃত্যু হয়েছে। যেন সবাই নিঃশক্ত ঐক্যমত হয়েছে নৈঃশব্দ্যে। যেন শুধু শব্দ ও ধ্বনি উচ্চারণ করবে এখন জুম্মন, যেহেতু আর কোনোদিন সে বাতাসের বিরুদ্ধে তরঙ্গ তুলবে না।

তারপর যখন জুম্মনের ঘোলাটে চোখের কোণা ফেটে রক্তের ফোটা জমে, কান থেকে গড়িয়ে নামে রক্ত, মুখের কষে ফেনা, যখন সে শেষবারের মতো গোঙায়, হেই মাও, তোর মুখ দেখি না ক্যান? তখন শা-জাদি বাঁধ ভাঙে। হাহাকার ধ্বনি যার কোনো নির্দিষ্ট রূপ নেই, এমন শব্দ। যা রাত্রিকে খান খান করে। যাবতীয় আবদ্ধ যন্ত্রণাকে একবারেই ছড়িয়ে দিতে পারে সমস্ত পৃথিবীতে এমন নিরেট সিসের টুকরোর মতো ভারি শোক।

তারপর সেই শতাধিক মানুষ একসঙ্গে সন্তাপ করে। সাররারাতব্যাপী অভুক্ত, ক্লান্ত শোক। গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের অসংখ্য রুদ্ধ নিরূপায় শোক এখন গতিশীল হয়। যে রাত শেষ হয়ে কখনো সূর্যোদয় হয় না, যে রাতের অন্ধকার শুধু লবণাক্ত জলে ভাসিয়ে দিতে হয়, সেইরকম রাত পার করে দেয় এইসব মানুষ।

শারিবা? জুম্মন?

নাই। সাপকাটি হয়্যা মরিছে।

ক্লান্ত মোষটা ঘাসে মুখ দেয়। শারিবা মুখ ঘুরিয়ে আবার চলে, পিছন ফিরে তাকায় না। যেন তার পিছনে কেউ নেই। যেন তার কোনো অতীত নেই। যেমন বাজিকরের যে-কোনো অতীত জামির ভেঙে ফেলে শুধু বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রেখে গেছে তার বংশধরের জন্য।

 

৪৫.

চারিদিকে হাটুরে মানুষের ভিড় গোল হয়ে। মাঝখানে ছ-টি সাপের ঝাঁপি। একটির মুখ খোলা। তার ভেতর থেকে মাথা তুলে আছে এক বিশালকায় গোক্ষুর, স্থানীয় ভাষায় গোমা। রূপা ঢোলকে কাঠি মারে, ঘুরে ঘুরে ভিড়ের বৃত্তকে বড় করে। শরমীর কাপড় হাঁটুর উপরে তোলা। পায়ের চেটোয় ভর দিয়ে বাঁ উরু আন্দোলিত করে গোঙ্কুরের সামনে। যুবতী নারীর ভরাট উরু। মানুষের ভিড় বাড়ে। গোমা তার উত্তোলিত দেহ বাঁকা করে পিছন দিকে, আরো পিছনে। শরমী হাতের মুদ্রা করে। গোমা ছোবল মারে, শরমী হাঁটু সরিয়ে নেয় এবং একই সাথে বাঁ হাতে সাপের গলার নিচে হাত দিয়ে সাপকে প্রতিহত করে। একটা পূর্ণবয়স্ক গোক্ষুরের ছোবলের শক্তি মাঝারি শক্তির ঘুষির মতো। শক্ত মাটিতে ছোবল আছড়ে পড়লে সাপ জখম হবে। শরমী বলে, খা—খা—খা, বক্কিলাক্‌ খা, কিপ্লুনাক খা–।

রূপা ঢোলক রাখে। মাথার রঙিন ফেট্টি খুলে আবার নতুন করে বাঁধে। রক্তাভ বিশাল তার চোখ, পাকা গমের মতো গায়ের রঙ, বলিষ্ঠ চেহারা। অচিন মানুষকেও সে আকৃষ্ট করতে পারে। ঝুলির ভেতর থেকে একটা শুকনো শিকড় সে বের করে। মাঝখানে দাঁড়িয়ে বক্তৃতার ঢঙে সে বলে, এই যে ভদ্দরলোক—ইয়ার নাম মণিরাজ গাছ। তারপর অদ্ভুত ভঙ্গিতে স্বরগ্রাম উঁচুতে নিচুতে উঠিয়ে নামিয়ে সে অনর্গল কথা বলে। যে-কোনো শব্দের সঙ্গে যখন তখন একটা বিসর্গ যুক্ত করে সে তার পেশাদারি ঢঙটি বজায় রাখে।

ইয়ার নাম মণিরাজ গাছ।

আস্তক মুনি কামনা মণিরাজ সাপের মাথায় মণি।

মহাভারতের ফরমাঃ ন।

হামার ওস্তাদ আপার আসামে থাকেন—

কামরূপের লোক উনিহ্‌।

জাতে গারো লোক—

না (হা)ম—রামলাল গারোলী।

বয়স—একশৎ পঁচিশ বছ্‌ছর।

তবি এটাই কথা মোনৎ রাইখবেন,

ভদ্দর নোক—

দুইটা, চাইরটা পয়সা সাপ দেখায়া হামি

রোজগার করবা চাই নাঃ।

হামার একটাই দাবি, ভদ্দর নো(হ)ক,

ওস্তাদের হুকুম—

বছরে দুই মাস হামি বিনা পয়সায়

সাপ দেখায়া বেড়াই।

মাত্তুর দুই মাস।

আর এই মণিরাজ—

ভদ্দরনো-হোক,

ডাক্তারে, ওষুধে, কবিরাজে

কাম হয় না।

সাপকাটি দংশন ঘন্টা পারাবে না,

জানা আছেঃ—

বজিৎ-সাপেৎ জঙ্গলে লড়হাই—

তাবাদে বেজি ডাক্তার কোবরাজের কাছে যায়?

নাঃ

যায় এই গাছরার কাছে।

মণিরাজের শিকর,

ওস্তাদের আদেশ—হুকুম—

ভদ্দরনোক মাফ কইরবেন,

কুনো পয়সা দি’ লয়,

ওস্তাদের হুকুম।

ইয়াই হামার শ্যাষ কথা।

তবি এটা কথা মোনৎ রাখেন,

ই গাছরা আপনার বেবাক বেমারি ভাল করবা পারে নাঃ।

খালি সাপকে দূরে রাখবা বারে—

এই গাছরা।

ভদ্দরনোক—

আপনার ঘরোৎ এঁদুরে বড় বড় গত্‌থ করে—

যম আসে, আপনার যম!

বেবাক ভাই জানেন,

আততাৎ ঘষরর আঁগনাৎ শোওয়া ভাই জানেন,

কানের নিচে মাটির নিচে

সর্‌সর্‌ শব্দ করি যি যায়—

সি আপনার যম।

কেন্তু রূপায়?

নাই।

মাটির ঘরে গত্‌থ হবেই।

এঁদুর বসবেই।

সাপ এসবেই।

সি সা—(হা)প-

মানষির গায়ের গরমে ডিম পাড়ে,

সি সা—(হা)প-

দুই থিকা দু হাজার হোবার পারে।

আর অসাবধানে—

আপনাক কাইটবে।

এক ঘড়ি যাবে না—

তার আগে এ–ই সাপের রঙ পাবে আপনার চামড়া।

আস্তক মুনি, মণিরাজ

সাপের মাথায় মণিঃ–

এই গাছরা–

আপনার ঘর বাইনধবে,

সাপকে রাইখবে দূরে দূরে

আপনা বাঁচাবে।

আ (হা) র—

যি সব বাচ্চা চেংড়া শোকর শুঁকরি,

ঘুম গেলে দাঁত কিড়মিড় করে,

মুখ দিয়া জেলা তুলে,

ভদ্দর নো–(হো)–ক,

এই গাছরা মাদুলি কইরে

লয়।

ভরা কলসির এক বদনা জলোৎ

একবার, খালি একেবার চুবায়া

সি জল পিলাবেন সি চ্যাংড়াক্‌।

আর হামার জুঁয়া ভাইদের,

এটা কঠিন বেপার আছে।

আততাৎ ঘুমির মধ্যে—

শয়তান যার ঘাড়োৎ চাপে,

মোনৎ শয়তান ঢুকে বসে,

সি জুঁয়া ভাই, কু স্বপন দেখে,

যাক্‌ হামরা কহি–খারাপ স্বপন।

ই গাছরা ধারণ কইরবেন, আইজ্ঞা।

ই হামার শেষ কথা।

তবি মোনৎ রাইখবেন,

তামা, সীসা, দস্তা, সোনা, রূপা,

হাঁ, সব ধাতুর মাদুলি চইলবে।

ওস্তাদের হুকুম।

না, মাফ কইরবনে আইজ্ঞা,

পয়সা নিই না।

ওস্তাদের হুকুম দুই মাস,

আর ই গাছরা এংকাই দি,

পয়সা নিই না

তবি যদি বলেন,

সি মাদুলি কইরবা গেলে

আপনার খরচ লাইগবে তিন টাকা, পাঁচ টাকা।

ভদ্দর নোক, গরীব ভাই,

আপনার হুজ্জতি রেহাই,

ঠগবাটপাড় রেহাই,

মণিরাজ আস্তক মুনি কামনা, মহাভারতের ফারমা(ঃ)ন

হামার ওস্তাদ—

এই গাছরা যা জানে খালি বনের বেজি,

পাঁচ টাকা লয়, তিন টাকা লয়,

দুটাকা লয়, এক টাকা লয়,

কেবল বারো গণ্ডা পয়সায়

সি মাদুলি—

মোনৎ রাইখবেন খালি মাদুলির দাম—

গাছরার লয়

খালি বারো গণ্ডা পয়সা।

ই হামার শেষ কথা।

তবি ভদ্দর নো—(হো ) ক—

হামি মরা মানষি বাচাবার পারি না।

হামার ওস্তাদ রামলাল গারোলী,

কড়ি চালান দি’

সাপ ধইর‍্যে আনে।

সাতদিনের সাপকাটি বাসি মরা

জিয়ায়!

তবি ভদ্দরনোক,

আপনাদের দোয়া মাঙ্গে রূপা বাজিকর।

ওস্তাদের সাচ্চা চেলা য্যান্‌ হোবার পারি।

তারপর শরমী ঝাঁপির ঢাকনায় তাবিজ ফেরি করে, ফাউ হিসাবে ক্রেতার সঙ্গে দুই একটা রঙ্গরসের কথা বলে। এদিকটায় ব্যাপারটা খুবই অভিনব। মানুষ দেখে মুখের কাছে তাবিজ ধরলে, গাছড়া ধরলে অমন কালান্তক গোমা, আলা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আর সাপকে ডরায় না কে? মানুষ বারো আনা পয়সা খরচ করতে পিছপা হয় না। রূপার রোজগার ভালোই হয় তিন বছরের পলাতক জীবনে সে সঞ্চয় করেছে এই নতুন পেশা, খেলা ও তার সঙ্গে এই পাটোয়ারি বুদ্ধির ব্যবসা। চেহারা তার চিরকালই আকর্ষণীয়। এখন সেই চেহারাও তার কাজে লাগে। বাজিকর সাপ নাচায় না, জামির একথা বলেছিল কোন এক প্রাচীন কালে। তারপর জামির একথাও বলেছিল, থিতু হওয়ার জন্য সব কাম করবা হোবে। রামলাল গারোলী তার গুরু ঠিকই। শুধু সাপ ধরা আর সাপ খেলাই শেখেনি রূপা তার কাছ থেকে, শিখেছে আরো অনেক কিছু। সাপ ধরো, রামলাল শেখাত, লোহার শিক গরম করা ধরো তার মুখোৎ, সাপ তার স্বভাব দোষে খুবলাবে সি গরম শিক। একবার, দুবার, পাঁচবার। তা-বাদে? তা-বাদে তার মুখোৎ খ্যাংড়ার কাটি ধরো, মুখ ঘুরায়ে লিবে সি। ইবার তুমি সি ছাইপাশ দি তাবিজ বানাও, মাদুলি বানাও, মানষি কেনবে।

আকালু বলে, বাপ তোর বেপসাটা ভালই শিখ্যেছে।

ব্যাপসা ক্যান? অযুদের দাম লগিচ্ছে না, খালি মাদুলি।

হঁ রে শারিবা, এক সিক্কার মাদুলি বারো আনা। মানুষ অংকা বোকা লয়, বুঝে সবাই।

তবি লেয় ক্যান?

লেয় সাপের ডরে। যা মানুষ যত ডরায়, তা মানুষ তত দেখবা চায়। সাপের চ্যায়ড়ার দিকি তাকা, চোখ ফেরাবা পারবু না। কি চিকন কালা দ্যাহখান! মাজা তুল্যে য্যামন দাঁড়ায়, চোখ আঁকায়া দেখ জানওয়ারটা—কেমন রাজা রাজা দেখায়। লয়?

সিটা ঠিকোই। তবি বাপের অষুদের কুনো গুণ লাই?

বাপকে শুধা।

শুধোতে হয় না। সাপের আকর্ষণ মানুষের কাছে তীব্র। সে আকর্ষণ শারিবাও এড়াতে পারে না। কাজেই রূপা যখন তাকে বলে, সাপ ধরাটা শিখ্যে লে, সে এগিয়ে আসে। তারপর রূপা তাকে প্রথমেই সাপের গতিপ্রকৃতি বোঝায়, মাথা হেলানোর অর্থ বোঝায়, আঘাতের তীব্রতার মাত্রা বোঝায়। রূপা বোঝায় আর শরমী হাতেকলমে দেখায়, ই দেখ বাবু, ভাল করি নজর করি দেখ, উরাৎ পাশে হিলালে সাপ কী করে আর উপর-নিচ হিলালে সাপ কী করে। ই দেখ বাবু, সাপ ক্যান্ গলা ফুলায়, না দম ল্যায়, দম ভরে বুকোৎ, ইবার পুরা মার মারবে, পুরা জোরের মার।

রূপা বলে, সোরন রাখ শারিবা, একহাত খাঁড়া মাজা তো দ্যাড় হাতত পুরা বিষ ঢালবে, দুহাত ফণা উঁচু তত তিনহাত তক পুরা খুবলাবে।

তবি উ তাবিজ গাছরা কুন্‌ কামে লাগে?

রূপা হাঁ করে থাকে, শরমী খিলখিল করে হাসে।

ওলা তোর জন্যি লয়, ওরা যারা সাপ লাচায় তাদের জন্যি লয়, বাপ। যারা সাপ দেখলি বিশ হাত দূরে পালাবে, ওলা তার জন্যি।

শারিবা সাপ নাড়াচাড়া করতে শেখে, নাচানো শেখে, ধরা শেখে। রূপা পুরো বাজিকর মহল্লায় একটা নতুন আলোড়ন আনে। পয়সা রোজগারের নানান ফন্দিফিকির খোঁজে বাজিকরেরা। আজুরা মণ্ডলের জমি খালাস হয়। শা-জাদি ইয়াসিনের ঘরেই থাকে ও সম্ভবত তার শেষ সন্তানের জন্ম দেয়। আজুরার রাখনি নসিবনও পরপর দুটি সন্তানের জন্ম দেয় ও ক্রমে হতশ্রী হয়ে আজুরার কৃপা হারায়। তবুও তার মহত্ত্ব কীর্তিত হয়, কেননা নতুন খালাসি জমির দু-বিঘা সে নসিবনকে দলিল করে দেয়। সেই শক্তিতে বলীয়ান নসিবন খুবলাল নামক এক বিগতদার বাজিকরের ঘরে ওঠে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *