৩৬-৪০. পাখি একটা ঘোরের মধ্যে চলছিল

৩৬.

পাখি একটা ঘোরের মধ্যে চলছিল। কেননা তার দেহের প্রয়োজনটা ছিল বড় বেশি। যতদিন সে তা জানত না ততদিন তো কোনো অশান্তি ছিল না। কিন্তু সোজন তাকে সেই অনুপম উদ্যানে হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিল, যেখানকার বাতাস পর্যন্ত এমন স্বয়ংসম্পূর্ণ যে, একমাত্র পেটের খিদে ছাড়া অন্য যাবতীয় প্রয়োজনকে মানুষ হেলায় দূরে সরিয়ে রখেতে পারে। অন্তত পাখির তাই মনে হয়েছিল।

তখন এক রাতে সোজন বলেছিল, এই এখন তোর আমার দুই বুকের মাঝখানে যদি একটুকরো জ্বলন্ত কয়লা রাখা যায়, তাহলে কি হবে?

ভারি কঠিন প্রশ্ন। পাখি কোনো কথা বলেনি এবং তা শুধু চুপ করে থাকবে বলে নয়, উত্তরটা নিয়ে সে যথার্থী সমস্যায় পড়েছিল বলে।

সে তো মাত্র কয়েকদিনের স্মৃতি। তারপর যতদিন সোজন নদীর পাড়ে একা বসে থাকত ততদিন পাখি সেই জলন্ত অঙ্গারের জ্বালা টের পেয়েছে বুকের উপরে, ভেতরে। তারপর সোজন হারিয়ে যাওয়ার পর ক্রমে টের পেয়েছে তার শরীর এবং মন এখন আর কিছুই চায় না, শুধু একটি সমর্থ পুরুষের শরীর। সে পুরুষ সোজন হোক, আর যেই হোক, এখন আর তার কিছু যায় আসে না।

ফলে প্রথমে ঝোলোপাড়ায় এবং পরে ঝোলোপাড়ার সীমানা ছাড়িয়ে মালোপাড়ায় পাখি অশান্তি ছড়ায়, আর তার পরিণতি হয় মর্মান্তিক।

দুই সন্তানের বাপ নলিন পাখির মোহ এড়াতে পারে না। তবে কে কাকে আগে প্রলুব্ধ করেছে বলা কঠিন। নলিনের চেহারা চিকন কালো, সমর্থ শরীর। অন্তত আজ থেকে পাঁচ-ছ বছর আগে এই চেহারার দৌলতেই সে যোগেন সাঁইদারের মেয়ে ধার্যবালাকে বিয়ে করতে পেরেছিও। না হলে তার যা অবস্থা তাতে সাঁইদারের মেয়ে ধার্যকে বিয়ে করার কোনো কারণ নেই।

নলিন যেহেতু অভিজ্ঞ লোক তাই পাখির সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টা বেশ কিছুদিন গোপন রাখতে সমর্থ হয়। কিন্তু এবারে সে বড় বেশি মজে, কেননা নষ্ট প্রেমে এস বেশি গেজিয়ে ওঠে, নেশা বড় বেশি জমে।

ধার্য যখন টের পায় তখন ভারি হৈ-চৈ করে সে, অশান্তি করে। নিয়মমতো নলিন ক্ষমা চায়, প্রতিজ্ঞা করে। সে অবশ্যই ভুলতে পারে না যে ধার্যর বাপ যোগেন সাঁইদারের কৃপাতেই আজ সে দু-খানা নৌকার মালিক।

কিন্তু এসব প্রতিজ্ঞা থাকে না। নলিন আরো গোপনতা ও অধিকতর চাতুরির আশ্রয় গ্রহণ করে এবং আবার ধার্যর কাছে ধরা পড়ে। নলিনকে ছেড়ে সে এবার পাখিকে নিয়ে পড়ে। পাখি অবশ্যই এপাড়ায় আসে না, কিন্তু ধার্য ওপাড়ায় গিয়ে যদি কখনো পথচলতি পাখিকে দেখতে পায় তাহলে তুমুল গালিগালাজ করে।

এসব ব্যাপারে পাখি আর আজকাল কথা বাড়ায় না। বলে, নিজের মানুষকে ঠিক রাখতে পার না, আমায় বলে কি লাভ! সে অন্যদিকে সরে যায়।

তারপর এই নিত্য অশান্তির হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ধার্য নিজেই বুদ্ধি বার করে। প্রবল প্রতিহিংসার বিষ তাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিচ্ছে। নলিন এখন অন্য রাস্তা ধরেছে। সে পরিষ্কার বলেছে, বেশি ঝামেলা করবি তো একেবারে ঘরে এনে তুলব। যেমন আছিস তেমন থাক।

তা সত্ত্বেও ধার্য ঝামেলা করে এবং প্রতিফলস্বরূপ নলিনের কাছে একদিন প্রচণ্ড মার খায়। মার খাওয়া ধার্যর এই প্রথম। এ ব্যাপারে তার বড় অহঙ্কার ছিল, এখন সে অহঙ্কার ভাঙে। সে একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়।

তারপর একসময় সে ভাবে যে, সে যোগেন সাঁইদারের মতো ক্ষমতাশালী মানুষের মেয়ে, কাজেই এভাবে এসব মেনে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।

ঝালো এবং মালোপাড়ার মাঝামাঝি একটা ছাড়া জায়গায় একটা মজা দিঘি আছে। দিঘি একসময় বড় ছিল। এখন চারদিকে মজা পচা পাক, মাঝখানে ছোট পুকুরের আকারে খানিকটা জল জায়গা। জায়গাটা নির্জন ও আগাছায় পূর্ণ। দুই পাড়ার স্ত্রীলোকদেরই এই জায়গাটা আড়ালে যাওয়ার জন্য দরকার হয়, সে কারণে পুরুষরা এদিকে বড় একটা আসে না। জায়গাটা যেহেতু ভীতিজনক, কাজেই কেউই এখানে একা আসে না। আর প্রত্যেকেরই এই আড়ালে আসার ব্যাপারে একটা নিজস্ব দল আছে। দল যে শুধু এ কাজের জন্য তা নয়, ঘনিষ্ঠতা, গল্পগুজব, প্রাণের কথা বলা, সবই এই আড়ালে আসার আকর্ষণ বাড়ায়।

পাখি শুধু এর ব্যতিক্রম। তার কোনো সঙ্গী সাথী নেই। তার ভয়ডরও নেই। সে একাই আসে, একাই যায়। কোনো স্ত্রীলোেকই তাকে পছন্দ করে না, আবার ভয়ও পায়।

ধার্য তার সঙ্গীদের সঙ্গে কি পরামর্শ করেছিল কেউ জানত না, তার সঙ্গীরাও কতটা গুরুত্ব দিয়েছিল তার প্রস্তাবে তাতেও সন্দেহ আছে। কিন্তু সেদিন সন্ধার আগে ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে পাখি ধার্য ও তার দুই সখীকে সামনে দেখতে পেয়েছিল।

ধার্য সঙ্গীদের কি যেন ইঙ্গিত করে পাখিকে বলেছিল, এই পাখি, এদিকে শোন।

পালাবার জায়গা ছিল না, আর পালাবার কথা পাখি ভাবেওনি। সে বলে, কি বলবে বল, আমার সময় নাই।

ধার্য ঠাণ্ডা গলায় বলে, সময় তোর নাই, জানি। নাগর বইসে থাকলে সময় আর কার থাকে?

বলে পাকা খুনীর মতো ধার্য এগিয়ে এসে পাখির হাতখানা ধরে।

একি হাত ধরিছ কেন?

ধার্য যে যোগেন সাঁইদারের মেয়ে তা তার চেহারাতেই বোঝা যায়। সে অক্লেশে কাধের গামছা পাখির মুখের মধ্যে ঠেসে ধরে। তার সঙ্গীদের বিশেষ সাহায্য করতে হয় না। তারা বরং ঘটনার কার্যকারিতায় হতবাকই হয়ে যায়। আর সবচেয়ে আশ্চর্য পাখি নিজেও খুব একটা বাধা দেয় না। লজ্জা, ভয়ডরের মতো জীবনের উপর আসক্তিও কি তার চলে গিয়েছিল!

ধার্য তাকে টেনে নিকে পাঁকের মধ্যে নেমে পড়ে। পাখি যেন সেই ছাগশিশু যার কান কামড়ে শিয়াল জঙ্গলে টেনে নিয়ে যায়। সে ছটফট করে ঠিকই, কিন্তু তাকে ঠিক বাধা দেওয়া বলা যায় না। ধার্য তাকে পাঁকের মধ্যে চেপে ধরে, প্রথমে হাত দিয়ে, তার পরে পা দিয়ে। পা দিয়ে চেপে সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁফায়। তারপর পায়ের নিচে কম্পন কমে গেলে সে পাড়ের দিকে তাকায়, সেখানে তার সঙ্গীরা ছিল না।

 

৩৭.

পাঁচখানা নৌকা নদীর উপর দিয়ে খুব ধীরে এগোয়। তরমুজে ভর্তি নৌকা খুব ভারি, নৌকার কানা পর্যন্ত জল উঠে এসেছে। পাঁচ নৌকায় হাজার তরমুজ। প্রতি নৌকায় দু-জন করে মানুষ সামনে পিছনে। এক নৌকায় জামির আর রূপা, আরেক নৌকায় রামজান আর আবু, অন্যেরা বাকি নৌকায়। আজ শনিবারের গঞ্জের হাট। পাইকার ব্যাপারীরা আসবে। নৌকা খুব ধীরে এগোয়। রাস্তা তো বেশি নয়, দুপুরের মধ্যেই পৌঁছানো যায় হাটে।

কয়েকটা তরমুজ নিয়ে এসে পরতাপের পায়ের কাছে রেখেছিল জামির। তরমুজ চাষের কথায় যে অর্থব চোখে কোনো উৎসাহ আনতে পারেনি জামির, তরমুজের চেহারা দেখে সে চোখ উত্তেজনায় ঝিলিক দিয়ে ওঠে।

পরতাপ শীর্ণ হাতে নেড়েচেড়ে ছুঁয়ে ছেনে তরমুজ দেখে। আঃ, কতদিন পরে খেতের ফসলের স্পর্শ! জামির, তোর খেতে হয়েছে এমন সোনা! আহাহা, কি চেহারা! জামির, আমি তোর খেত দেখতে যাবু। নিয়ে যাবি আমাকে?

আলবত নিয়ে যাব, চাচা।

কেমন করে নিয়ে যাবি? আমি যে হাঁটতে পারি না।

গরুর গাড়িতে করে নিয়ে যা চাচা।

গরুর গাড়ি কোথায় পাবি, জামির? তুই কি গরুর গাড়ি করতে পেরেছিস?

ধার করে নিয়ে আসব। না পাই, কাঁধে করে নিয়ে যাব তোমায়।

তাই চল। তাই নিয়ে চল। কলই যাব আমি।

পরের দিন বৃদ্ধ পরতাপকে গরুর গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে এসেছিল জামির। চাষির মতো মাথায় পরতাপ একটা সাদা কাপড়ের ফালি দিয়ে পাগড়ি বেঁধেছিল, হাতে নিয়েছিল লাঠি। লাঠিতে ভর করে খেতের পাশে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করেছিল পরতাপ। বুক ভরে উত্তাপ আর সুঘ্রাণ নিতে চেয়েছিল সে। তারপর রমজানের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, সুঘ্রাণ পাই না কেন, বাপ?

রমজান বলে, সব ফসলের সুঘ্রাণ থাকে না, চাচা। তরমুজের খেতে কি ধানখেতের বাসে পাওয়া যাবে?

যাবে, আলবাত পাওয়া যাবে। সব ফসলের সুঘ্রাণ আছে। আমার বুড়া নাক তাই লাগে না। বাঃ, ভাল খেত। মন বড় ভরে গেল, জামির। আঃ, আমার হাতে আর জোর নাই। থাকলে তোদের দেখায়ে দিতাম।

উত্তেজনায় লাঠি ধরা হাতটা তার কাপে। জামির তাকে বসিয়ে দেয়। রমজান তার সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে সুখদুঃখের কথা বলে।

সেই তরমুজ কেটে পরতাপের সামনে ধরেছিল জামির। ভালো তরমুজ, চামড়া পাতলা, আগাগোড়া টকটকে লাল। পরতাপ মাড়ি ডুবিয়ে কামড় দিয়েছিল। বলেছিল, জামির রে, এ তরমুজ ক-দিন রেখে দিলে এর মধ্যে দানা হবে নির্ঘাত, মিশ্রির মতো দানা হবে।

 

সেই তরমুজ নিয়ে জামির এখন রামজানের সঙ্গে হাটের পাইকারের কাছে যায়।

হাটের কাছে নৌকা বেঁধে রমজান নিচে নেমে পাইকারের সঙ্গে কথা বলতে যায়। জামিরকে বলে যায়, নজর কড়া রাখেক, বাজিকরের পো। এ বড় চ্যাচোর জায়গা।

ঘাটভর্তি নৌকা, নানা জিনিসপত্র ফলমূলে ভর্তি। দক্ষিণ থেকে আসা বড় বড় ঘাসি নৌকায় নারকেলের স্তুপ। এদিকে নারকেল বিশেষ হয় না। ভালো দাম পায় ব্যাপারিরা। জামির বড় উত্তেজিত আজ। কতদিন পরে আবার মাঠের ফসল সওদা নিয়ে হাটে এসেছে। আহাঃ ভিখ-মাঙ্গা থু-করা কামে হয়ত আর যেতে হবে না। কম করেও চার পাঁচ হাজার তরমুজ সে ফলিয়েছে। এর জন্য তাকে রক্ত জল করা পরিশ্রম করতে হয়েছে, রমজানের মধ্যস্থতায় মহাজন করেছে, আর এখন সেই ফসল নিয়ে হাটে। আজকের হাটে হাওয়া বুঝে পরের হাটে বেশি মাল আনার ব্যবস্থা করতে হবে। পনেরো দিন বাদে রঘুনাথ ঠাকুরের মেলায় সব বাজিকরদের পাঠাতে হবে তরমুজ দিয়ে। সে মেলায় আকর্ষণই একমাত্র তরমুজ। লোকে বলেও তরমুজের মেলা। হাজার হাজার তরমুজ সেখানে খুচরো বিক্রি হয়। পড়তাও ভালো থাকে। জামির এসব চিন্তায় বিভোর থাকে।

হঠাৎ একসময় মানুষের চিৎকারে তার চমক ভাঙে। একখানা নৌকা বে-আক্কেলের মতো এসে তরমুজের নৌকার উপর পড়ছে। সামাল সামাল করতে করতে আবুর তরমুজ ভর্তি নৌকা ডুবে গেল। সময় থাকতে লাফ দিয়ে আবু অন্য নৌকায় উঠে গিয়েছিল। জামির কিছু বুঝবার আগেস আগন্তুক নৌকার পনেরো বিশজন আরোহী তরমুজের ভারভর্তি নৌকাগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তিনখানা নৌকা ডুবে যেতে জামির বৈঠা তুলে নিয়েছিল। আশপাশের নৌকাগুলো থেকে হৈ হল্লা হচ্ছিল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তারা নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে থাকে। জামিরের বৈঠা একজনের পিঠে পড়ে দু-টুকরো হয়ে গেল। সে তখন চোখের সামনে শুধু ফুলকি দেখতে পায় এবং নিমেষে গলুয়ের নিচে হাত ঢুকিয়ে একখানা বল্লম টেনে বার করে। তরমুজ খেত পাহারা দেওয়ার জন্য এই বল্লম সে নিজের হাতে বানিয়ে নিয়েছিল।

বল্লম তুলে একটা নৌকার উপরে সে আবুকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে। আবুর রক্ত দেখে জামির উন্মাদ হয়ে যায়। সে তার দীর্ঘ দেহ নিয়ে আক্রমণকারী নৌকার উপর লাফিয়ে পড়ে। নৌকা ভীষণ দোল খায়। দু-তিনজন বল্লমে বিদ্ধ হয়। জামিরের হাতের উপর একটা হেঁসোর কোপ লাগে। সে আবার নিজের নৌকায় ফিরে আসে। আক্রমণকারী নৌকাটা পিছোতে শুরু করে। তাদের একজন একটা তরমুজের নৌকায় ছিল। নিজেদের নৌকা দূরে সরে যাচ্ছে দেখে সে ঝাপ দিতে গিয়েও দূরত্ব আন্দাজ করে সাহস করল না। তারপর নিজের বিপদ বুঝে জলে ঝাপ দেওয়ার উপক্রম করতেই পিছন থেকে জামির তাকে আমূল বিদ্ধ করে এবং প্রবল আক্রোশে বল্লমে গাঁথা অবস্থায় জলের ভিতরে চেপে ধরে। প্রবল জিঘাংসায় জলের নিচে চেপে ধরা মানুষটার অন্তিম আলোড়ন সে উপভোেগ করে এবং এক সময় টের পায় মানুষটা আর নড়ছে না। সে চারদিকে তাকিয়ে প্রচুর মানুষ দেখে যারা হতবাক হয়ে তার দানবীয় কীর্তি দেখছিল। সে বল্লমসহ মানুষটাকে ছেড়ে দেয়, তারপরে দুহাতে মুখ ঢেকে নৌকার উপর বসে পড়ে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তার সমস্ত ইন্দ্রিয় আচ্ছন্ন করে ঘুম আসে এবং সে সেই নৌকোর গলুইয়ের উপর লুটিয়ে পড়ে।

 

৩৮.

লুবিনি ও অন্য বাজিকরেরা প্রথমে শুনেছিল জামির খুন হয়েছে। খবর পাবার পর তারা অনেকেই সেই গঞ্জের হাটে ছুটে এসেছিল। স্বামীর দুর্ঘটনায় মৃত্যুসংবাদ শুনে কোনো রমণী যেভাবে ছুটে আসে, লুবিনিও সেভাবেই এসেছিল। আলুথালু বেশ, চুল উড়ছে হাওয়ায়, উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি, লুবিনি ছুটছে। কোন দিকে যাচ্ছে, কোন দিকে যেতে হবে সে জানত না।

সন্ধ্যা নাগাদ ঘটনাস্থলে এসে তারা অনেক কষ্টে রূপা এবং রমজানকে খুঁজে পায়। রমজান ও রূপা কিছু মানুষের জটলার মধ্যে বোবার মতো বসেছিল।

তার আগেই অবশ্য পুলিশ এসেছিল। তারা তিনজন আহত আক্রমণকারী, অজ্ঞান জামির ও আবুকে নিয়ে গিয়েছিল।

রমজানের পরিচিত মানুষেরা তাকে নানারকম পরামর্শ দিচ্ছিল, কিন্তু সেসব কথা রমজানের কানে যাচ্ছে না। সে হতভম্বের মতো সবার দিকে, সবার মুখের দিকে, চোখের দিকে তাকাচ্ছে, মাথা নাড়ছে। কিন্তু কোনো কথাই যে তার মগজে ঢুকছে না, সেকথা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।

বিষয়টা বুঝতে কারো অসুবিধা হয় না। এ হল সেই বাবুঘরের উদ্ধৃঙ্খল ছোকরাদের কাজ। পয়সাঅলা ঘরের ছেলে সব। পয়সা দিয়ে লোক ভাড়া করে শিক্ষা দিতে চেয়েছে রমজান আর জামিরকে, নিজেরা আড়ালে থেকে মজা দেখেছে। কিন্তু হয়ত এতটা প্রতিরোধ আশা করতে পারেনি। পাঁচখানা তরমুজের নৌকা ডুবানো আর কি এমন কঠিন কাজ। কিন্তু কাজটা কঠিন হয়ে গেল। আশাতিরিক্ত ঝামেলা হয়ে গেল। জামিরের মতো শান্ত এবং সবার কাঝেই পোষ মানতে রাজি এক দৈত্য হঠাৎ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। অক্লান্ত শ্রমের বিনিময়কে এভাবে নষ্ট করা মেনে নিতে পারল না।

পরদিন নদীর পার থেকে বাজিকর বসতি উঠে এল শহরের আরো কাছে, পুলিশ লাইনের মাঠের একপাশে। বৃদ্ধ বালি আরো কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে পুলিশ সাহেবের সঙ্গে দেখা করল। তারা এই প্রথম কিছু দাবির কথা বলল। এই প্রথম। পুলিশ তাদের এখান থেকে অন্য কোথাও সরে যেতে বলেছিল। বালি বলেছিল, আমরা আমাদের উপর আক্রমণ আশঙ্কা করছি। তাই আমরা কিছুদিন এখানে থাকতে চাই, হুজুরের কাছাকাছি। সময় সুযোগ মতো অন্য কোথাও চলে যাব। আর হুজুরের কাছে আমাদের দলপতির বৃত্তান্তটাও জানতে চাই।

সাহেব জানিয়েছে, জামির খুনের আসামী, তার বিচার হবে। বিচারে হাকিম যা শাস্তি দেয় তা মানতে হবে।

সাহেব তাদের কিছুদিনের জন্য পুলিশ লাইনের কাছে থাকবার অনুমতি দিয়েছিল।

জামির শিরদাঁড়ার উপরে কোথাও চোট খেয়েছিল, ফলে সেই যে সে নৌকার উপর ঘুমিয়ে পড়েছিল সে ঘুম তার ভাঙল বেশ কয়েকদিন পর। এই দিনগুলো সে থানার হাজতে মৃতের মতো শুয়েছিল। প্রতিদিন একবার করে পুলিশের ডাক্তার তাকে দেখে যেত। এর মধ্যে দু-দিন লুবিনি এবং অন্য দু-একজন বাজিকরের অনুমতি মিলেছিল তাকে দেখবার। তারা কেউ জামিরের জীবনের আশা করেনি।

যখন জামিরের জ্ঞান ফিরল তখনো তার মস্তিষ্কের নির্বোধ ভাব কাটল না। সে যদিও শান্ত ছিল, কিন্তু সে ছিল বাহ্য ও দৃশ্যমান জগতের সম্পূর্ণ বাইরে। তার বাক্শক্তিও ছিল না। এই সময় থানায় তার জন্য পৃথক বন্দোবস্ত হয় এবং লুবিনিকে তার সঙ্গে থেকে তার দেখাশোনা করার অনুমতি দেওয়া হয়।

এর এক সপ্তাহ বাদে জামির একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে লুবিনিকে দেখে হাসে। লুবিনি তার চোখে পরিচিতিরর লক্ষণ দেখে। তারপর জামির কথা বলে এবং একদিনের মধ্যে পূর্ণ স্বাভাবিকতার জগতে ফিরে আসে। এই ঘটনায় লুবিনির এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়। জামির স্বাভাবিক হওয়াতে তার অপরিসীম আনন্দ হয়, আবার জামিরকে ছেড়ে চলে যেতে হয় বলে নিদারুণ দুঃখও হয়।

 

৩৯.

জানো রে, শারিবা, তোর নানা কলো, ই মুই কোথায়, আমি ভায়েৎ তার মুখ চাপি ধরনো। যাঃ সব্বোনাশ, মরা মানুষ জিন্দা হয়, যোবা মানুষ কখনো কথা কয়। ওঃ, সি কি হামার সুখ, সি কি যে দুঃখ!

লুবিনি তারপরে রমজান মিয়ার কাছে গিয়েছিল, এখন কী হবে? একথার উত্তর রমজান কী দেবে? আবুও যে হাজতে।

তারপর ধীরে ধীরে শক্ত হয় রমজান। বাকি তরমুজ পাইকার ডেকে মাঠ থেকেই বিক্রি করে দেয়। কিছু টাকা পায় লুবিনি। রমজান বলে, মোকদ্দমা চালাতে হবে। পয়সা আবোলতাবোল খরচ করা যাবে না।

কিন্তু মোমদ্দমা যে চালাবে মুরুব্বি কোথায়? তাও পাওয়া যায়। রমজানের এক ভায়রা এ ব্যাপারে এগিয়ে আসে। অভিজ্ঞ বুঝদার মানুষ। বেশ কিছুদিন ধরে মামলা চলে। সে সব আইন কানুনের কূট-কুচাল কি লুবিনি বোঝে যে শারিবাকে বলবে? তবে বাবুরা জামির, আবু, ইত্যাদির বিরুদ্ধে নামী উকিল দিয়েছিল। সাক্ষী সাবুদ হাজার হেনস্থায় দিন মাস গড়িয়ে বছর ঘুরে গেল। বিচারে আবুর তিন বছর আর জামিরের সাত বছর জেল হল।

লুবিনির বুক ভাঙল। বাজিকরের মেয়েকে ছোটবেলা থেকেই নানা খেলা, ভানুমতি, বুজরুকি শিখতে হয়। কিন্তু লুবিনি অল্পবয়সেই জামির বাজিকরের বউ হয়, সেই জামির, যার নমনকুড়িতে ফসলের জমি ছিল। কাজেই বাঁশবাজি, দড়িবাজি, লুবিনির অত গরজ করে শেখার দরকার হয়নি। নমনকুড়ি ছাড়ার পর সে অভাব সে টের পায়। জামির এসব ব্যাপারে তাকে কখনো কিছু বলত না। কিন্তু তখন এসব নতুন করে ঝালিয়ে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না, কেননা পেট তো মানে না। আর বাজিকরের অন্য কোন বিদ্যাই বা জানা আছে! কাজেই লুবিনিও অন্যদের মতো ‘ভিখমাঙ্গা’ শুরু করেছিল অন্যদের মতোই এসবে চৌকশ হয়ে উঠেছিল।

আর এখন, যখন জামির বলল, বেঁচে থাকিস, আমি ফিরে আসব—তখন বেঁচে থাকার জন্যই লুবিনি অন্যদের সঙ্গে দেশদেশান্তর করত ভিখ-মাঙ্গার কাজ নিয়ে।

শেষবার জেলখানায় দেখা করতে আসার সময় রমজান সঙ্গে ছিল। জামিরকে সে বলেছিল, দেখেক, বাজিকরের বন্ধু মেলা ভার। আমার মানুষগুলোকে একটু নজর রাখে। আর সে লুবিনিকে ও রূপাকে দেখিয়েছিল। জামিরের চোখ ছলছল করছিল, লুবিনি কাঁদছিল।

রমজান তাকে কথা দিয়েছিল। কিন্তু সবাই জানত এসব কথার কতটুকু মূল্য। রমজানের কী ক্ষমতা যে এতগুলো মানুষকে সে দেখে? তবুও জামির যেন আশ্বস্ত হয়েছিল।

 

৪০.

সাত বছর নয় এক বছর মাপ পেয়ে জামির ছ-বছর পরে মুক্তি পায়। ছ-বছর পরে যখন সে বেরিয়ে আসে তখন জামির একজন বৃদ্ধ! তার চেহারার কাঠামোটুকুই শুধু অবশিষ্ট আছে। হাড়ের কাঠামো, আর কিছু নেই। তারপর আরো বিশ বছর সে বেঁচে থাকে বাজিকরদের দুর্গতির সমস্ত দায়বহন করবার জন্য। শেষপর্যন্ত জীবন তাকে নতুন কিংবা তার আকাঙ্ক্ষিত কোনো বস্তুই দিতে পারেনি।

যখন সে জেলে ছিল বাজিকরেরা রাজশাহি শহরকে মূল বিন্দু করে কাছের ও দূরের জনপদে ঘুরে বেড়াত তাদের আদিম ব্যবসাকে কেন্দ্র করে। লুবিনির কথা স্বতন্ত্র, কিন্তু অন্য বাজিকরেরাও বছরে অন্তত দু-তিন মাসের জন্য রাজশাহি শহরে বাস করত। কারণ জামিরকে ছেড়ে তারা চিরকালের জন্য দূরে যাওয়ার কথা চিন্তা করতে না। যে কারণে রহুর সঙ্গে তার জনগোষ্ঠী জলে ঝাঁপিয়েছিল, সেই কারণ বা সংস্কার তাদের রক্তে এখনো ছিল। তাই জামিরের মুক্তির জন্য তারা অপেক্ষা করছিল। এই অপেক্ষার সময়ে অনেকে মারা যায়। মৃতদের মধ্যে সব বয়সের মানুষ ছিল। যক্ষ্মা ও অন্যান্য মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ তাদের মধ্যে লেগেই ছিল।

জামিরের জন্য অপেক্ষা তাদের ছিল ঐকান্তিক, কিন্তু জামিরের নির্দেশিত পথে চলবার এবং চালাবার মতো শক্তিমান ব্যক্তিত্ব তাদের মধ্যে আর কেউ ছিল না। একমাত্র জীবিত বৃদ্ধ বালি কেবল দুঃখ করত।

ইতিমধ্যে রূপা বয়স্ক যুবক হয়েছিল। নিজ গোষ্ঠীর মধ্যে থেকেই কন্যা বাছাই করে লুবিনি তার বিয়ে দিয়েছিল। রূপার বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে লুবিনিকে খুবই ভাবতে হয়। প্রথমে সে ঠিক করেছিল, যে জামির ঘুরে এলে তবেই রূপার বিয়ে দেবে। কিন্তু রূপা ছিল জামিরের একেবারে বিপরীত না হলেও অনেকাংশেই অন্যরকম। রূপা উচ্ছল ও কিছুটা উজ্জ্বল। তার চমৎকার আকর্ষণীয় চেহারা গগাষ্ঠীর মধ্যে সমস্যা সৃষ্টি করেছিল, কেননা খুব কম স্ত্রীলোকই তার আকর্ষণ এড়াতে পারত। এ কারণে লুবিনি জামির ফিরে আসার আগেই তার বিয়ে দিয়ে দেয়। বালিও সেরকম পরামর্শই দিয়েছিল। বাজিকরেরা সবাই একমত হয়ে শা-জাদি নামে এক বালিকার সঙ্গে রূপার বিয়ে দেয়।

রূপা ছিল পাকা খেলোয়াড়। প্রচলিত খেলাগুলো ছাড়াও সে শিখে নিত যেখানে যা নতুন দেখত। তাছাড়া, তার ছিল অসাধারণ বাম্পটুতা। খেলা দেখাবার সময় অনর্গল কথা বলে মানুষের মনোযোগ ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারত সে। সে ভালো ভোলক বাজাত, চমৎকার গান গাইত। সে ছিল যথার্থই এক বাজিকর।

জামিরের হাজতবাসের সময় দলের সর্দারি পেয়েছিল পিয়ারবক্সের ছেলে ইয়াসিন। সদারির কাজে ইয়াসিন যে খুব নির্ভরযোগ্য মানুষ ছিল এমন নয়, তবুও তার থেকে উপযুক্ত লোক তখন আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। খুব শক্তসমর্থ না হলেও খুব বিবেচক হিসাবে ইয়াসিনের খ্যাতি ছিল।

জামির ফিরে আসার পর ইয়াসিন তার কাছে গিয়ে বলেছিল, ইবার লেন চাচা, আপন কম্ম নিজে করোন, হামা সোয়াস্তি দেন।

জামির বলে, কি কামডা কল্লে এতদিন, বসূত করার মতো জায়গা খুঁজিছ?

ইয়াসিন চুপ করে থাকে।

খোঁজ নাই, না পাও নাই?

এলা কি আমার কাম? বেবাক মাষে দূর দূর ছাই ছাই করে—

খোঁজই নাই, তত পাবা কি?

ক-দিন বিশ্রাম নিয়ে জামির ইয়াসিনকে ডেকে পাঠাল, বলল, সব মানুষ হেথায় থাকবে। খালি আমি তুমি যামো। আশপাশ কাছে দুরে খুঁজবা হবে বাজিকরের বসত করার মতো জায়গা এ দুনিয়ায় আছে কিনা। আগে বসত, তার পরে অন্য কাম।

এর দিন দুয়েক পরে তারা দলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। এক মাস পরে তারা ঘুরে জানাল, জায়গা একটা পাওয়া গেছে বাজিকরদের স্থায়ী আস্তানা গাড়ার। কাজেরও কিছু অগ্রিম কথাবার্তা হয়েছে সেখানে। কোথায় সেই স্থান যা বাজিকরকে ধারণ করতে পারে? এখান থেকে উত্তরে পাঁচবিবি নামে একটা বর্ধিষ্ণু গ্রাম আছে, তারই কাছে পাতালু নদীর তীরে বাজিকরদের নতুন বসত পত্তনি হবে। সেখানে হিন্দু ও মুসলমান দুই জমিদারেরই কুন্‌ঠিবাড়ি আছে। সেই কুন্‌ঠিবাড়িতে হাতি আছে। তারা দু-দলই জামিরকে কথা দিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *