২৬-৩০. হিঙ্গল থেকে ষাঁড় দেখিয়ে আসার পর

২৬.

হিঙ্গল থেকে ষাঁড় দেখিয়ে আসার পর পঞ্চম দিনে গাই আবার অস্থির হয়ে ওঠে। গাইকে অস্থির হতে দেখে জামিরের হৃৎপিণ্ড আচমকা একটা লাফ দেয়। সে তাতে এমন চমকে ওঠে যে দ্রুত আশপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখে নেয় তার এই ভাবান্তর কেউ দেখে ফেলল কিনা।

রাতে শুয়ে তার ঘুম আসে না, সে উত্তর্ণ হয়ে থাকে। তারপর গাই যখন তারস্বরে ডাকতে শুরু করে সে উত্তেজনায় শয্যার উপর উঠে বসে। হ্যাঁ, গাই ডাকছে, অর্থাৎ পাল ঝেড়ে ফেলেছে গাই, আর এর পরম্পরা কী তা ভাবতেই জামিরের এই উত্তেজনা!

ভোর না হতেই জামির গাই নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সম্পূর্ণ চেনা পথে জানোয়ারটা এবার আরো দ্রুত চলতে থাকে।

আগের দিন পতাকিকে দেখে তার ধড়ে প্রাণ এসেছিল। সে যে রধার প্ররোচনায় যথার্থ ভয় পেয়েছিল তাতে আর সন্দেহ কী! অথচ তেঁতুল গাছের তলা থেকে উঠে রাধার কাছে যাওয়ার মতো মানসিক অবস্থা তার ছিল না। তার ভিতরে অনেক রকমের ভয়ের বীজ তখন অঙ্কুরিত হচ্ছিল। তার মধ্যে অপরাধভীতি থেকেও জাতের ভয় আরো বেশি ছিল। সে বুঝতে পারছিল রাধা তার আয়ত্তের মধ্যে, অথচ—। তখন তার একবারও লুবিনির কথা মনে হয়নি।

আর ঠিক সেই সময় সে পতাকিকে আসতে দেখেছিল। পতাকিকে তখন তার একমাত্র বিকল্প মনে হয়েছিল। পতাকির সঙ্গে কথাবার্তা বলে, জলটল খেয়ে আবার যখন সে এসে তেঁতুল গাছটার তলায় বসেছিল, তখন সে অনেকটা ধাতস্থ। তখন সেখানে অবশ্যই রাধা ছিল না। অথচ তার মনে হয়েছিল, রাধা যদি এখন একেবারে সামনে এসে দাঁড়ায় তাহলেও সে আর অত ভয় পাবে না।

আচ্ছা, ব্যাপারটা কি এরকমই হয় নাকি? যেহেতু আশৈশব সে পীতেমের সান্নিধ্য বেশি করেছে এবং যেহেতু পীতেম তার বোধবুদ্ধিমতো তাকে অন্যরকম মানুষ তৈরি করার চেষ্টা করেছে, স্বশ্রেণীর আর দশজন যুবকের মতো জামির এইসব অত্যন্ত স্বাভাবিক সম্পর্কগুলোয় তেমন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারেনি।

কাজেই হঠাৎ তার মনের মধ্যে দ্বন্দ উপস্থিত হয়, রাধার কি তার কাছে অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল? এমনও তো হতে পারে, রধা তাকে অন্য কোনো কথা বলতে চেয়েছিল। হয়ত, শুধু আলাপ করতেই চেয়েছিল? আর সে তার নিঘুম তপ্ত মস্তিষ্কে সব কিছু গুলিয়ে ফেলেছিল?

আবার শেষপর্যন্ত সে ভেবেছিল, সত্যিই কি রাধাকে ঐ ঝোপের মধ্যে গাছে হেলান দেওয়া অবস্থায় সে দেখেছিল, না তার দৃষ্টিবিভ্রম? শেষে সে সিদ্ধান্ত নেয়, সে যাই হোক, রাধাকে এত ভয় পাবার কোনো কারণ নেই।

কিন্তু ফেরার পথে এ সবই ভুল প্রমাণিত হয়। মাঠে নামার আগে একটা বাঁশবাগানের ভেতর দিয়ে পথ সংক্ষিপ্ত করতে হয়। রাধা যেন ওদিক থেকেই আসছিল। খুব স্বাভাবিকভাবেই সে বলে, খুব ধকল গেল আজ সারাদিন, না বাজিকর?

জামির কোনো উত্তরই দিতে পারে না। সে কোনোমতে একটু হাসতে চেষ্টা করে। সে শুধু চোখ তুলে একবার দেখে, রাধা তার সর্বাঙ্গ যেন চোখ দিয়ে জরিপ করছে। তার অনাবৃত দেহকাণ্ডে সে হঠাৎ অনুভব করে এক অস্বাভাবিক জড়তা। সে শুধু বলতে পারে, না, ধকল আর কী!

ধকল নয়! নতুন বাছুরটাকে বাগানে খুঁজতে গিয়ে তোমায় দেখলাম তেঁতুল গাছের নিচে। ওঃ, সে খুব কঠিন অবস্থা তোমার!

রাধা আঁচল দিয়ে মুখ চাপা দিয়ে হাসে।

জামির হঠাৎ বুঝতে শুরু কর্বে। সে বোঝে, রাধা কথা বানাচ্ছে এবং তাকে নিয়ে খেলা করছে। ধীরস্থির মানুষ সে, একটু একটু করে নিজেকে ফিরে পায় এবার। বস্তুত রাধার কথার মধ্যে তাকে অপমানজনকভাবে নিগ্রহ করার একটা প্রচেষ্টা সে ধরতে পারে। জামির একটু উত্তেজিত হয় এবং বোঝে না রাধা এমনই চায়। সে এবার একটু গুছিয়েই বলে, তা হবে। তবে আমাদের ঘরের বাছুর আড়ালে গেলে তার মা-ই তাকে ডেকে নেয়। ঘোষেদের ব্যাপার বুঝি বা আলাদা।

কারণ যাই হোক, রাধা উপেক্ষিত হয়েছে আজ এবং উপেক্ষা ঢাকবার জন্য একটা মনগড়া ব্যাখ্যা সে তৈরি করেছিল বাছুর হারানো নিয়ে। কেননা, উপেক্ষা কোনো রমণীই সহ্য করে না, আর সে যদি রাধা হয়, তাহলে তো প্রশ্নই নেই।

কথার ভঙ্গি আগের মতো রেখেই সে প্রত্যাঘাত করে। বলে, তা যা বলেছ বাজিকর, ঘোষেদের নিয়মকানুন বাজিকরদের থেকে একটু আলাদাই বটে। এই যেমন ধরো না, আমাদের মাঝে বেটাবেটির মাকেই তার মুতের কাঁথা ধোওয়া-শুকা করতে হয়। তোমাদের শুনি বিটির বে হয়ে গেলে সোয়ামীকেও সে কাজ করতে হয়?

ইঙ্গিতটা হঠাৎ ধরতে পারে না জামির, তবু এটা যে একটা মারাত্মক খোঁটা সেটা রাধার তৃপ্ত উজ্জ্বল চোখ দেখে বোঝে।

সে দ্রুত বলে, কেমন? এবং সঙ্গে সঙ্গেই রাধার নিক্ষিপ্ত তীরের গতিমুখ ধরতে পারে। তার চোখ নিমেষে নেমে আসে এবং সারামুখে এক ঝলক রক্ত ছড়িয়ে পড়ে তার ফর্সা সুদর্শন মুখমণ্ডলকে রক্তিম করে। আচ্ছা! এ মেয়েটা তাহলে তার সম্বন্ধে খোঁজখবরও নিয়েছে? আচ্ছা! ওঃ, রাধা লুবিনির ইঙ্গিত করল!

রাধা খিলখিল করে হাসে। যেন জামির তার ফাঁদে পড়া শিকার এমনভাবে বলে, আঃ বাজিকর, বদনে তোমার কেমন রঙ ধরে গেল!

সে জামিরের আরো কাছে আসে, এত কাছে যে জামির তার নিঃশ্বাসের শব্দ এবং গায়ের ঘ্রাণ টের পাচ্ছিল। রাধা আবার বলে, তবে বিবির কথায় যে পুরুষের বদনে রঙ লাগে, বিবির জন্য তার মনে রঙ নাই—একথা আমি জানি।

জামিরের হাতের দড়িতে বাঁধা গাইটা এখন নিরুপদ্রব অস্তিত্ব। সে দড়ির গণ্ডির মধ্যে ঘাস পাতা টেনে খাচ্ছিল, কেননা সারাদিনের উন্মত্ততায় তার খাওয়ার কথা মনে হয়নি, অথবা খাওয়ার ব্যাপারটাই অবান্তর ছিল।

জামির গাইয়ের দড়িতে টান দেয়। তারপর বলে, কি জানি, শুনেছি অনেক পুরুষই তোমার দেখা আছে। তুমিই ভালো জানবে।

হাতের বাঁশ দিয়ে গাইকে তাড়িয়ে সে চলবার উদ্যোগ করে এবং সত্যি-সত্যিই রাধার পাশ কাটিয়ে মাঠের দিকে এগোয়।

রাধা হঠাৎ চুপ করে যায়। তার চোখের সামনে যে পুরুষমানুষটা এতক্ষণ ছিল তার নাভিদেশ থেকে কণ্ঠা পর্যন্ত দেহকাণ্ডটা বড় দীর্ঘ এবং ভীষণ সরল। সেই মানুষ এই নিয়ে দ্বিতীয়বার তাকে উপেক্ষা করল। সে চেষ্টাকৃত নিষ্ঠায় নিজেকে স্থির রেখে তীব্রভাবে বলে, বাণ মারলাম, বাজিকর; গাই তোমার দশদিনের মধ্যে পাল ঝেড়ে ফেলবে। তোমাকে আবার আসতে হবে এখানে।

জামির ফিরে তাকায় না। তার মনে হয়, এক বিশেষ ধরনের উত্তেজক খেলায় সে জিতেছে, অথচ জেতার পরেও তার আক্ষেপ থেকে যাচ্ছে।

 

সেদিনের ঘটনা এমনই হয়েছিল। কিন্তু নমনকুড়িতে ফিরে আসতে আসতে তার সারা শরীরে জ্বলুনি শুরু হয়েছিল। গাই নিয়ে যখন বাড়িতে ঢুকেছে তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। নিজে হাত-পা ধোওয়ার আগে গাইটাকে গোয়ালে ঢুকিয়ে ঘাস জল দিচ্ছিল জামির এবং হায়াকে ডাক দিয়ে একটা লম্ফ চেয়েছিল।

সে সময়ে সে ছিল একটা ঘোরের মধ্যে। অথচ হাত-পা চালাচ্ছিল নিতান্ত অভ্যাসবশে। আর তখন লুবিনি লক্ষ্য নিয়ে গোয়ালে ঢুকেছিল। লম্ফটা একটা উঁচু জায়গায় রেখে সে জিজ্ঞেস করে, ষাঁড় দেখিয়ে আনলে?

জামির হঠাৎ ঘুরে লুবিনির দুই বাহুসন্ধি শক্ত করে ধরে সামনে টেনে আনে। তার চোখ রক্তাভ, সমস্ত শরীরে ঘাম, মুখ চেপে ধরে এবং নিজের চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর বাঁ হাতখানা আস্তে করে লুবিনির মাথায় রাখে।

লুবিনির মাথা তার বুক পর্যন্ত ওঠেনি। লক্ষ্যের আলোতে তাকে একটা দৈত্যের সামনে পুতুলের মতো দেখায়। চোখ খুলে জামির হাত ধরে লুবিনিকে গোয়ালঘরের বাইরে নিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল। জামির খুব লজ্জা পেয়েছিল তখন।

তারপর রাত্রে শুয়ে শুয়ে সে তার নানার কথা ভেবেছিল, সে ভেবেছিল তার না-দেখা বাপের কথা, সে আরো ভেবেছিল তাদের গোটা বাজিকর জাতটার কথা।

তার নানা তাকে বলেছিল, বাজিকরকে মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে সহ্য করতে হবে, দাম দিতে হবে। কোনো বিশৃঙ্খলা বরদাস্ত করবি না, জামির—না নিজের, নাপরের। এমন সব কথা বলত তার নানা।

কিন্তু দ্বিতীয়বার গাইটা যখন অস্থির হয়ে উঠল, তখন তার শরীরে রক্ত আবার ছলকে উঠেছিল। এবং কাল সারারাত সে ভোর্বছে যে রাধা তার নিয়তি। আর এখন গাই নিয়ে যখন সে মাঠ ভাঙছে, তখন সে ভাবছে অন্য কথা। সে ভাবছে যে, আসলে সে আগাগোড়াই বিশ্বাস করতে চাইছিল যে রাধার বাণমারা কথাটা সত্য হোক। তাই সত্য হল এবং সে জানে না এখন কী হবে। তবে সে তার রক্তেই টের পাচ্ছিল যে রাধা যদি আজকে তাকে উসকাতে আসে, তাহলে একভাবে সে ফেরত যাবে না।

তারপর সে নির্দিষ্ট খুঁটোয় গাই বেঁধে সেই একই তেঁতুল গাছের তলায় বসেছিল। তারপর নিয়মমতো ষাঁড় এসেছিল গাই দেখতে। তারপর তার পায়ের উপর ঢিল পড়েছিল। তারপর সে ফিরে তাকিয়ে সেই একই ভঙ্গিমায় রাধাকে দেখেছিল অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতে।

তখন সে খুব আশ্বস্ত হয়ে বুঝেছিল যে রাধা বাণ মেরেছে তাকেই। সে উঠে রাধার গাছ পর্যন্ত যেতে রাধা সে গাছ ছেড়ে অধিকতর ঝোপঝাড়ের মধ্যে ঢুকে যায় এবং জামির তাকে অনুসরণ করে তার অপরিচিত এক অরণ্যে নিজেকে রাধার মুখোমুখি দেখে।

 

২৭.

মালদা শহরের জৌলুস বাড়ছিল দিনদিন। লোকও বাড়ছিল মেলা। বদিউল আরো অথর্ব হয়ে শেষমেশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পুরোপুরি বিছানা নিল। সালমা তাকে দেখতে আসত প্রায়ই, কিন্তু আগের মতো আর প্রতিদিনই আসতে পারত না। একে তার ব্যবসার সাম্রাজ্য আরো বিস্তৃত হয়েছিল, তার উপর তার বয়সও হয়েছিল কম নয়।

পিছনে পড়ে থাকা মালদার চার ঘর বাজিকর নির্ঘাৎ শহুরে বদমাস হয়ে উঠেছিল। অন্তত সালমার এরকমই ধারণা হয়। প্রথম প্রথম তারা আশা করত, সালমা তার ঐশ্বর্যের কিছু অংশ অন্তত তাদের জন্য ব্যয় করবে। কিন্তু সন্ধলমা তা করত না। তার যুক্তি ছিল পরিষ্কার। কী সম্পর্ক এদের সঙ্গে তার? কতকগুলো অকর্মণ্য চোর!

এই চার ঘর বাজিকর প্রথম প্রথম তার কাছে এসে অনুনয় বিনয় করত, পরে কৌশল পাল্টে দাবি করত। কিন্তু সম্পদবৃদ্ধি সালমাকে তার জীবনের এক পরমার্থ এনে দিয়েছে। সারা জীবনে সে বুঝতে পারেনি এ জীবনটা কেন। এখন এই সম্পদবৃদ্ধির ভিতরে নিজেকে নিরস্তুর মুক্ত রেখে অস্তিত্বের একটা অর্থ খুঁজে পায় সে।

ফলে বিত্তবানদের নিয়ম অনুযায়ী সে পশ্চিমা দারোয়ান রাখে। তারা বাজিকর ও অন্যান্য সুযোগ-সন্ধানী ও কৃপাপ্রার্থীকে সামলায়।

শহরের আয়তন যত বাড়ে টাঙ্গাওয়ালা বাজিকর ও সমগোত্রীয় অন্যান্য এমদায়ী মানুষের রোজগার তত বাড়ে। কিন্তু দ্রব্যমূল্য বাড়ে তার দ্বিগুণ হারে। কাজেই সাধারণ মানুষের জীবন আরো কষ্টকর হয়। বাজিকরেরা তাদের পুরনো অভ্যাসগুলোকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঝালিয়ে নেয়। কেউ ভানুমতির ঝুলি বের করে, কেউ পশু চুরি করে রাতের অন্ধকারে অন্যত্র চালান করে।

এইভাবে দুলদুলি লোপাট হয়ে যায়। নিঃসন্দেহে এটি বাজিকরদের কাজ। এর মধ্যে নিছক চুরি ছাড়া সামলাকে এক হাত নেওয়াও থাকে। পশু চুরিতে বাজিকরের কোনো বিবেকের বালাই থাকে না।

যে রাতে দুলদুলি চুরি হয় সে রাতেই বদিউল মারা যায়। দুলদুলির জিন মাহাত্ম্য তাতে আরো বাড়ে। সালমা বদিউলের মৃত্যুসংবাদ শুনে সে বাড়িতে গিয়ে দুলদুলির চুরি যাওয়ার খবরও শোনে। যদিও সে এখন শহরের পয়সাঅলাদের একজন, তবুও কিছু বিরূপ মন্তব্য তাকে হজম করতে হয়। কেননা, শহরে পশুচোর হিসাবে বাজিকরদের তখন খ্যাতি বেশ ভালোই ছিল। তাছাড়া, এ বাড়িতে যে ব্যক্তি তাকে সম্মান দিত, তার মৃত্যুর পর সালমা দেখে সে কী পরিমাণ অবাঞ্ছিত এখানে। কেউ কি একথা বলেছিল, ‘জামাল, দেখিস ও বাউদিয়া মাগি যেন কাফেনের ঘরে না যাবার পরে!’ একথা কি সালমা সত্যিই শুনেছিল? এরকম কোনো রমণীকণ্ঠ?

এবং অবশ্যই সালমাকে সে ঘরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সালমা জানলায় দাঁড়িয়ে বদিউলের শব দেখেছিল। যদিও তার ইচ্ছা ছিল, তবুও সে শবানুগমন করতে পারেনি। সে প্রতিমুহূর্তে অপমানের আশঙ্কা করছিল এবং প্রতিক্ষেত্রেই নিষেধাজ্ঞা অনুমান ও আশঙ্কা করছিল। বদিউলের বাড়ি থেকে ফেরার পর সে যথার্থই বুঝতে পারে এ শহরে সে আদৌ সম্রান্ত নয়। সে নিতান্তই এক কুসীদজীবী, পশুপালিকা বৃদ্ধা। বদিউল জীবিত থাকাতে বহুকাল যা বুঝতে পারেনি এখন মুহূর্তে তা বোঝে। সে নিজেকে দেখে একেবারে একা।

সালমা গোপনে খবর নিয়ে জানতে পারে, চেতা নামে এক চতুর বাজিকর দুলদুলিকে চুরি করে এক রাতে বিশ-পঁচিশ ক্রোশ রাস্তা ঘোড়া ছুটিয়ে ধলদিঘির মেলায় ঘোড়া বিক্রি করে আবার তার পরদিনই ফিরে আসে। বদিউলের বাড়িতে তার অপমানের ক্রোধ গিয়ে পড়ে শেষপর্যন্ত এই চার ঘর বাজিকরের উপর। কোতোয়ালিতে জামাল ঘোড়া চুরি বিষয়ে তার বাজিকরদেরই সন্দেহের কথা বলেছিল। তিন চারজন যুবক ও বৃদ্ধ বাজিকরকে এ ব্যাপারে যখন গ্রেপ্তার করে এনে মারধর করা হয়, সে খবরে সালমা সুখী হয়।

তারপর যখন চারঘর বাজিকরের রমণীরা একত্রে এসে তার কাছে টাকা চায়, সে ক্ষিপ্তের মতো বলে, কিসের টাকা?

কোতোয়ালিতে দিতে হবে, মানুষগুলো বেবাব আটকে আছে।

আমি দেবো কেন?

তোমার টাকা আছে, তাই দেবে।

আবদার! যা যা, যত সব চোরের দল!

পীতেম বুড়া থাকলে এমন কথা বলত না।

খবরদার! পীতেমের নাম করবি না। পীতেমের কথা তোরা শুনিসনি।

তারাও তো সুখে নাই।

নাই তো নাই, আমার কী? আমি কি বাজিকর? আমার সাথে কারো কোনো সম্পর্ক নাই।

অথচ এই সালমা বুক খুলে দিয়েছিল, বস্ত্র খুলে দিয়েছিল রাজমহলের কোতোয়ালিতে পীতেমকে বাঁচাবার জন্য। সে এমন কথা বলে!

কিন্তু তারাও বাজিকরের মেয়ে। বলে, জমিদারনি হবে ভেবেছিলে? টাকা আমাদের দেবে না, একদিন গলায় পা দিয়ে কেউ নিয়ে নেবে, সেদিন আটকাবে কে? মরলে পরে মুদ্দফরাসে পায়ে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাবে, কারণ তোমার মড়া হিন্দুতেও ছোঁবে না, মোছলমানেও ছোঁবে না। আর আমরা বাজিকরেরা? মাটি দেওয়া দুরে থাক, গোরে লাথি মারতেও আসব না।

সালমা দারোয়ান দিয়ে তাদের বের করে দিয়েছিল। বদিউল মরে যাওয়ার পর চতুর্দিক থেকে নানাধরনের অস্থিরতা ও অশান্তি তাকে ঘিরে ধরছিল। সে তখন পীতেমের কথা ভাবছিল। নমনকুড়িতে চলে যাওয়ার কথাও দু-একবার ভেবেছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত হয়নি। আরাম ও সাবলীল জীবনে এখন দীর্ঘকাল ধরে অভ্যস্ত সালমা এই বয়সে আর কোনো ঝুঁকি নিতে পারে না। তারপর ভেবেছিল জামিরকে এখানে নিয়ে এসে রাখবে, কেননা পীতেম আসবে না সে ঠিকই জানত।

কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে জামিরকে নিয়ে এলে তার এই সঞ্চিত অর্থ ও এই বিশাল পশুপালা, এও তো জামিরকে দিয়ে যেতে হবে! কেন জামিরকে দেবে?

জামির তার কে?

সালমা টের পায় না কি অস্থির বিকৃতি তাকে গ্রাস করেছে। এক এক সময় তার মনে হয়, সে বোধহয় মরবে না। কেননা মরলে পরে তার এতসব সম্পত্তির কী হবে? তার ধারণা হয়, মৃত্যুটা একমাত্র দরিদ্র বাজিকরদেরই নিয়তি, সে স্বতন্ত্র। যেসব প্রক্রিয়াতে এতকাল সে লুব্ধ মানুষের যৌবন ও আয়ুবৃদ্ধি করত, এখন সেসব সে নিজের উপরই প্রয়োগ করে।

তারপর জ্যৈষ্ঠ মাসে পরতাপ এবং জামির তার কাছে আসে পীতেমের মৃত্যুসংবাদ নিয়ে। সব খবর শুনে সে বাহ্যজ্ঞানশূন্য মানুষের মতো বসে থাকে অনেক সময়। তার চোখে আতঙ্ক, যা স্পষ্টতই পরতাপ ও জামিরের চোখে ধরা পড়ে। সে কাঁদে না, কিংবা চেঁচিয়ে শোকপ্রকাশ করে না। সে সামনের দিকে অনির্দিষ্টভাবে তাকিয়ে থাকে, যেন অতিপ্রাকৃত সব দৃশ্য দেখে। তারপর বিড়বিড় করতে শুরু করে। একসময় মূছা যায়।

সালমার পরিচারিকার সঙ্গে জামির ও পরতাপ তাকে ধরাধরি করে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দেয়। বিছানায় শোয়াবার পর তার চোখ খোলে। তখন কড়িকাঠের দিকে বিহুল দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে।

পরতাপ ও জামির সে রাত অন্য বাজিকরদের সঙ্গে কাটায়। তাদের কাছে সালমার যাবতীয় বৃত্তান্ত তারা শোনে। তারা এই চার ঘর বাজিকরের ভয়ানক আক্রোশ টের পায়।

পরদিন তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারে সালমা এখনো বিছানা ছাড়েনি। তৃতীয় দিনে বিদায় নেবার জন্য তারা আবার তার সঙ্গে দেখা করতে যায়।

সালমা তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবহার করে। এই স্বাভাবিক ব্যবহার জামির ও পরতাপের কাছে অদ্ভুত লাগে। ধনী গৃহস্থ যেমন চাষিমজুরের সঙ্গে একটা দূরত্ব বজায় রাখে, সালমার ব্যবহারেও তারা সেই জিনিসটি টের পায়। সালমা তাদের খেতে দেয় ও নিরাসক্তভাবে দলের লোকজনের খোঁজখবর নেয়। তারপর তারা যখন বিদায় চায়, সে শুধু ‘আচ্ছা’ বলে তাদের বিদায় করে।

 

আষাঢ় মাসে প্রচুর বৃষ্টি হয়। শ্রাবণে ঘন বর্ষা নামে। সবাই আশঙ্কা করতে থাকে এবার বড় বান হবে। কেননা খবর পাওয়া যাচ্ছিল গঙ্গা ইতিমধ্যেই ভরে গেছে। উত্তরে নাকি অনেক আগে থেকেই বর্ষা শুরু হয়েছে। মহানন্দা প্রবল বেগে জল এনে ঢালতে থাকে গঙ্গায়, ভীষণ স্রোত সে জলের। তারপর ধীরে ধীরে মহানন্দার জলের স্রোত মন্দীভূত হতে থাকে ও ক্রমশ উঁচু হয়, কেননা নিচের দিকে গঙ্গা আগেই ভরা ছিল। তখন সেই নদীর উপরে গেরুয়া রঙের ফেনা জমতে থাকে, ভেসে আসতে থাকে এবং শ্রাবণের মাঝামাঝি থেকে বিরামহীন বৃষ্টি শুরু হয়।

একটানা সাতদিন বৃষ্টি হবার পর মানুষ শহর ছেড়ে দূরে, নদী থেকে দূরে পালাবার আয়োজন করতে শুরু করল। কেননা তখন শহরের নিচু অংশগুলোতে বৃষ্টির জল ও মহানন্দার জল একসঙ্গে মিশেছে। নদীর জলের আর যেন কোনো গতি নেই। শুধু উঁচু হচ্ছে সেই জল, যেন সামনে কোনো বিশাল প্রাচীর তুলে নদীকে কেউ আটকে দিয়েছে। সামনে অবশ্যই প্রাচীর ছিল, সে প্রাচীরও জল দিয়ে তৈরি।

পনেরো দিন বৃষ্টি হবার পর শহরের উঁচু অংশগুলোতেও কোমর ডুবে গেল মানুষের। সালমা তার পনেরো হাত উঁচু কাঠের ঘরের মাচানের উপর আপৎকালীন ব্যবস্থা মজুত করল।

তারপর বৃষ্টি কিছুটা ধরে এলেও জল সমানে বাড়তে থাকল। সমস্ত শহরই প্রায় জলের তলায়। সালমার পশুশালার গরু মোষ সব মরতে শুরু করল। প্রথমে তারা মরল খাদ্যাভাবে এক এক করে, বাকিরা একসঙ্গে জলে ডুবে। তার চৌহদ্দির মধ্যেই তারা ফুলে পচে ঢোল হয়ে ভাসতে থাকল। চতুর্দিকে কটুগন্ধপূর্ণ বিষাক্ত বাতাস।

সালমা এই নরকের মধ্যে সম্পূর্ণ একা বেঁচে রইল। তার পরিচারক, পরিচারিকা সময় থাকতেই পালিয়েছিল, কিন্তু সালমা কোথাও যাওয়ার কথা ভাবেইনি।

তারপর জল যখন নামতে শুরু করে তখন সালমা মই বেয়ে উপর থেকে নিচে নেমে আসে। কোমরসমান জলে দাঁড়িয়ে একাই সে একটার পর একটা মৃত প্রাণীর দেহ বাঁশ দিয়ে ঠেলে স্রোতের দিকে বের করে দিতে থাকে।

জল একসময় সম্পূর্ণ নেমে যায়, বৃষ্টিও বন্ধ হয় পুরোপুরি। সমস্ত শহরে শুধু দীর্ঘকাল ধরে পড়ে থাকে মৃত মানুষ ও পশুর মৃতদেহ এবং পৃতিগন্ধে ভারি বাতাস।

তখন এক রাতে চেতা সহ আরো তিন ঘরের তিনজন বাজিকর সালমার বাড়িতে প্রবেশ করে। মই বেয়ে মাচানের উপরে উঠে তাকে নিয়ে আসে আলোর সামনে। তাদের চারজনের হাতে উদ্যত ছুরি। তারা সালমার সঞ্চিত মোহর, অলঙ্কার ও টাকা চায়।

সালমা ভয় পায় না এবং স্থির প্রত্যয়ে বলে, কিছু পাবি না!

চেতা বলে, না পেলেও ক্ষতি নেই, তোমার কলজেটা উপড়ে নিয়ে যাব বরং।

সালমা বলে, তাই নিয়ে যাও

তাকে তখন ডাইনির মতো দেখাচ্ছিল, তাতে চেতা ছাড়া আর তিনজন ভয় পেয়েছিল।

চেতা তার ছুরি দিয়ে সালমার মুখে ও বাহুতে ক্ষত করেছিল, তা থেকে রক্তপাত হচ্ছিল।

সালমা সেই একই ভঙ্গিতে বলে, তাও পাবি না।

চেতা তখন তার গলার উপর ছুরি চেপে ধরেছিল। বলেছিল, বল কোথায় আছে তোর দৌলত?

সালমা উন্মাদিনীর মতো বলেছিল, কেন কলজে নিবি না?

আর তখনই চেতা তার ছুরি সালমার বুকে বসিয়েছিল গভীর করে।

তারপর প্রায় সারারাত তারা সমস্ত বাড়ি ভেঙেচুরে তোলপাড় করেও কিছুই পায়নি। শুধু মাচানের উপরে তখনো এক কলসী খাবার জল ছিল আর কয়েক বস্তা চাল। ঘাতক বাজিকরেরা সেগুলো নিয়েই ফিরে গিয়েছিল।

 

২৮.

নমনকুড়িতে ভালো ফসল হচ্ছে ক্রমাগত। সাঁওতাল ও ওরাওঁদের ঘরে ঘরে সারা বছরের খাবার থাকে। উদ্যম লোকেরা নতুন নতুন জমি হাসিল করে। কিন্তু এসবের মূলে যে কারণটি, তা কেউ বোঝে না। সেই যে বাজিকরেরা এল আর বানবন্যা বন্ধ হল। নমনকুড়ি, জামিলাবাদ আর হিঙ্গলের যাবতীয় ডুবো জমি সব সোনা ফলাতে লাগল। প্রথম বছর পাঁচেক বর্ষার পরে জল দাঁড়াত জমিতে, কিন্তু সেও ক্রমশ কমের দিকে। তারপর থেকে আর কখনো বানভাসি হয়নি নমনকুড়িতে।

এর মধ্যে কোনো জাদু আছে নাকি? বাজিকর পীতেম বুড়োর জাদু? কে বা জানে অচিন দেশের মানুষ সব, জানে বা কোনো গুপ্তবিদ্যা, তা দিয়ে বশ করে নদী, বান, বৃষ্টি।

এসব কথা ভাবত সাঁওতাল, ওরাওঁরা, আর গোয়ালা, সদগোপ, মুসলমান চাষিরা। বর্ষার সময় নদী ভরে উঠত ঠিকই, কিন্তু সে আর উপচে পড়ত না। আবার আশপাশের জলও যখন নেমে আসত, নদী সে জলও নিয়মমতো পৌঁছে দিয়ে আসত মহানন্দায়, কোনো অঘটন ঘটাত না।

নতুন জমিদার বদিউলের ছেলে জুমিল অনেক আগে থেকেই বাজিকরদের উপর খাজনা বসিয়েছে। খাজনা দিতেও হচ্ছে বাজিকরদের, কিন্তু মুশকিল হল। যে আশায় পীতেম নমনকুড়িতে বসতি করল সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল না। বাজিকরেরা গৃহস্থ হতে পারছে না সবাই। পরতাপ ও জামির অবশ্যই ব্যতিক্রম। তাদের দেখাদেখি অন্য পাঁচ-দশজনও জমিতে মেহনত দিতে শুরু করে। কিন্তু যেই কোনো বাধা আসে, আসে কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যার হাত থেকে চাষির নিস্তার নেই এবং যা হামেশাই হতে পারে, হতাশ হয়ে বসে পড়ে তারা। পরতাপ তার অর্জিত অভিজ্ঞতায় বোঝায়, আরে বাপু, ধরে নেও না কেন যে তিনটা চাষের একটা মারা যাবে। তাহলেও আর দুটো থাকে। আর সে দুটোয় তোমায় ভরে দেবে। চাষের তো এই নিয়ম।

কিন্তু এসব কথা জাত যাযাবরকে বোঝানো কঠিন। তারপর ফসলের জন্য অপেক্ষা তার কাছে আরো অশান্তির মনে হয়। কাজেই পরতাপ, জামির সহ কয়েক ঘর মাত্র পুরোপুরি চাষের কাজে আত্মনিয়োগ করে, অন্যেরা যে যার মতো পুরনো কায়দায় বেঁচে থাকার চেষ্টা করে।

নমনকুড়ির জীবন বয়ে চলে পুনর্ভবার আর টাঙ্গনের স্তিমিত স্রোতের মতো, তাতে আর ঢল নামে না, বান ডাকে না।

কিন্তু প্রকৃতির এই স্বাভাবিকতায় জামিলাবাদ এবং হিঙ্গল বড় অশান্ত হয়ে ওঠে। প্রকৃতিগত কয়েক বছর ধরে দিচ্ছে এমন অকৃপণ হাতে যে কর্মী মানুষ পরিশ্রমী মানুষ তা থেকে একটু চেষ্টাতেই ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হয়ে যায়। পাঁচ বছর আগে যাদের ছিল এক হালের জমি, এমন অনেকেই এখন তিন হাল চার হাল করে নিয়েছে। মাঠে কাজ করার লোকের অভাব নেই। আদিবাসীরা আসছে দলে দলে, নমনকুড়ির বহর আরো বড় হচ্ছে। এমনকি গৃহস্থরা নিজেদের সুবিধার জন্য জামিলাবাদ ও হিঙ্গলেও বেশ কিছু আদিবাসী পরিবারের বসতি করিয়েছে। না হলে চাকরপাটের অভাব গুরুতর আকার ধারণ করেছিল। কাজেই জামিলাবাদ ও হিঙ্গলের জীবনে এখন প্রচুর সময়, ভোগের জন্য উদ্বৃত্ত আয়।

এই তো সময়, যখন গোয়ালাদের সঙ্গে সদৃগোপদের পুরনো শরিকি ও মর্যাদার লড়াইগুলোর নিষ্পত্তি করে নেওয়া যায়। এবং এই তো সময়, যখন জামিলাবাদের আগন্তুক বাদিয়া মুসলমানদের দাপট দেখিয়ে কিছুটা খর্বাকৃতি করে দেওয়া যায়।

কাজেই প্রচুর বিক্ষিপ্ত ও সংগঠিত ঝামেলা হয়—যেমন হয়েছিল কয়েক বছর আগে জামির-রাধার সম্পর্ককে কেন্দ্র করে।

 

রাধা সেই যে জামিরকে ঝোপঝাড়ের অন্ধকারে আকর্ষণ করে নিয়ে গিয়েছিল তার সে আকর্ষণ থেকে জামির সহজে নিষ্কৃতি পায়নি। তাদের এই প্রেম ও অভিসার চলেছিল বছরদুয়েক। চতুর রাধা জামির ও তার সামাজিক দূরত্বটার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারত। কাজেই অন্তত বছরখানেক সে ব্যাপারটাকে গোপন রাখতে পেরেছিল। কিন্তু তার পরে সে ধরা পড়ে যায়।

আর ধরা পড়ে দুর্দান্ত দেদোন ঘোষের হাতে। অবশ্য দেদোনের হাতে ধরা পড়াই স্বাভাবিক, কেননা, দেদোন দীর্ঘকাল ধরে রাধাকে আকাঙ্ক্ষা করে আসছে। এবং অসংখ্যবার তাকে প্রেম নিবেদনও করেছে। কিন্তু তার ভীষণ কুৎসিত মুখাকৃতি রাধাকে চিরকাল প্রতিহত করেছে। কাউকে দেহদানের ব্যাপারে রাধার একটিমাত্রই বিলাসিতা ছিল, তা হল, পুরুষটিকে সুপুরুষ হতে হবে। সম্ভবত, এই কারণেই সে স্বামীর ঘর করতে পারেনি।

দেদোন সময় পেলেই রাধা গতিবিধি অনুসরণ করত। অনেকদিন ধরেই তার সন্দেহ হচ্ছিল। সন্দেহের প্রধান কারণ, রাধা পুরুষমানুষ ছাড়া থাকতে পারে না। এতকাল সে যে ক-জন পুরুষকে সঙ্গ দিয়েছে তারা হয় জামিলাবাদ না হয় হিঙ্গলের মানুষ। সুতরাং কারো কাছেই এসব ব্যাপার গোপন থাকত না।

এখন বেশ কিছুদিন যাবৎ রাধার চালচলনের কোনো সঠিক হদিশ পাওয়া যাচ্ছিল না। তাতেই দেদোনের সন্দেহ হয় যে, এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো বাইরের লোক আছে। সন্দেহ তার দৃঢ় হয় যখন একদিন সে জামিরকে অন্ধকারের মধ্যে দূরের থেকে দেখে। কিন্তু সে নিঃসংশয় হতে পারনি। অন্ধকার ছিল বলে সে জামিরের মুখ ভালো দেখতে পায়নি, কিন্তু তার সন্দেহ হয়েছিল যে, যে-মানুষটা এইমাত্র মাঠে নেমে গেল সে জামিরই।

জামির ও রাধার অভিসারকুঞ্জ ছিল জামিলাবাদের একটি পরিত্যক্ত প্রাচীন মন্দির। জায়গাটা জঙ্গল এবং কঁটাঝোপে এমন সুরক্ষিত ছিল যে মানুষের সেদিকে কোনো প্রয়োজন ছিল না। জামির নিয়মিত সেখানে রাধার সঙ্গে মিলিত হতো।

সেই গোপন স্থানে একদিন দুপুরের দিকে দেদোন ধরে ফেলে তাদের দুজনকে। প্রথমে সে নিজেকে লুকিয়ে রেখে রাধা ও জামিরের ক্রিয়াকলাপ দেখে এবং তারপর সে ঝাঁপিয়ে পড়ে জামিরের উপর।

দেদোনের খ্যাতি এ অঞ্চলে ধর্ষক হিসাবে। প্রত্যেকে সমাজেই কিছু মানুষ থাকে যাদের বাদ দিয়ে সমাজটা চলতেই পারে না, অথচ এরা উচ্চতর সমাজের বিচারে পরগাছার মতো। এই ঘোষ ও মুসলমান বসতির আশেপাশেও একরম কিছু দরিদ্র মানুষ ছিল যারা সর্বদাই সন্ত্রস্ত থাকত।এদের পুরুষেরা অবস্থাপন্নদের বাড়িতে চাকরের কাজ করত। মেয়েরা করত খেলালি কিম্বা ধান কোটা ভানা, চিড়া মুড়ি, ভাজা, ইত্যাদি কাজ। জামিলারা ছিঙ্গলের উভয় গোষ্ঠীর গোপেদের মধ্যে দেদোনের মতো কিছু মানুষ এই শ্রেণীর রমণীদের উপর যথেচ্ছাচার করত এবং এমন ত্রাসে রাখত যে বাপের সামনে মেয়েকে কিংবা স্বামীর সামনে স্ত্রীকে ধর্ষণ করলেও কেউ কোনো কালে প্রতিবাদ করতে সাহস করত না। পরবর্তীকালে দিয়াড়া অঞ্চলের মুসলমানরা এখানে উঠে আসার পর তাদের মধ্য থেকেও এ ধরনের কিছু নিপীড়কের উৎপত্তি হয়েছিল। হয়ত জামিলাবাদ ও হিঙ্গল কোনো ব্যতিক্রম নয়। তবে দেদোন নিশ্চয়ই ব্যতিক্রম, কেননা, তার খ্যাতি ছিল এমন যে, সে নাকি চালা ফুটো করে ঘরে ঢুকেও মেয়ে তুলে আনতে পারে। একমাত্র রাধার উপরে এ ধরনের কোনো আক্রমণ সে করত সাহস করেনি, তার কারণ রাধা পতাকির বোন এবং স্বশ্রেণীর মধ্যে এধরনের ঘটনার সৃষ্টি করলে একেবারে অক্ষত পার পাওয়া যায় না।

সেই দেদোন এখন আচমকা জামিরের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাধা তাকে আগেই দেখেছিল। সে আর্তনাথ করে সরে যেতে সময় পায়, কিন্তু জামির সে সুযোগ পায় না। সে ওঠারই সময় পায় না, তার আগেই দেদোন তার উপরে চেপে বসে।

ঘোষের মেয়ের সঙ্গে পিরিত আজ তোর শেষ। হারামজাদা

দেদোন গর্জন করে, কিন্তু বেশি বাগাড়ম্বর করে না। সে শক্তিশালী মানুষ, নিজের উপর আস্থাও তার খুব।

রাধা একপাশে সরে দাঁড়িয়ে দেদোনের এই উন্মত্ততা দেখে। চিৎকার করতে কিংবা পালিয়ে যেতেও সাহস করে না সে, শুধু মাঝে মাঝে ভয়ার্ত হিক্কা তোলে।

জামির দেদোনের আক্রমণ ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াতে পারে না। দেদোন তার উপরে চেপে বসা, চুলের মুঠি ধরে দেদোন তার মাথা মন্দিরের চাতালে ঘেঁছবার চেষ্টা করে। জামির দু-হাত দিয়ে তাকে আটকাবার প্রয়াস পায় শুধু।

দেদোন পূর্ণবয়স্ক যুবক এবং সম্ভবত জামিরের থেকে অনেক শক্তিশালী। তার দেহ সুগঠিত। কিন্তু জামির দীর্ঘকায় এবং অল্প বয়সের জন্য অনেক বেশি ক্ষিপ্র। ফলে দেদোন তার বুকের উপর চেপে বসলেও কোমরের উপরে সে ভর রাখতে পারে, আর কোমরের উপরের কোনো চাপ না থাকায় দুই পা বাঁকিয়ে জামির দেদোনকে কায়দা করে ফেলে ও নিজেকে মুক্ত করে। তারপর দু-জনে মুখোমুখি দাঁড়ায়।

রাধা জানে দেদোন যদি এ লড়াইতে জেতে তার প্রেমাস্পদ অবশ্যই খুন হবে এবং সেও অবশ্যই স্বাভাবিকভাবে বাড়ি ফিরতে পারবে না। কেননা তখন দেদোন তাকে স্বাভাবিক কামুকতায় গ্রহণ করবে না, গ্রহণ করবে অস্বাভাবিক পাশবিকতায়। এটাই নিয়ম। এজন্য সে সমাজে নিন্দিতও হবে। কেননা গ্রাহ্য বীরত্বও এটাই। তাই গলায় আঘাত খেয়ে জামিরকে ভারসাম্য হারাতে দেখে সে আতঙ্কে আরেকবার ককিয়ে ওঠে।

জামির হ্যাচকা টানে হঠাৎ প্রতিপক্ষকে ইটের চাতালে প্রথমে আছড়ে ফেলে, তারপর যাযাবরী ক্ষিপ্রতায় শূন্যে লাফিয়ে উঠে হাঁটু ভেঙে নেমে আসে দেদোনের বুকের উপর। দেদোন আর্তনাত করে উঠলেও মূহূর্তে জামিরকে ধরে ফেলে সাপটে, যে ব্যাপারটা এ লড়াইয়ের প্রথম থেকেই সে করতে চেষ্টা করছে।

বেশ কয়েকবার ওলটপালট চলে। দু-জনের মুখই রক্তাক্ত। কান এবং মুখের কষ বেয়ে রক্ত ঝরছে জামিরের। এখন তার চেহারায় খুনির ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দু-জনে দু-জনের কাছ থেকে সামান্য দূরত্বে আক্রমণের সুযোগে ঘুরছে চোখে চোখ রেখে। দু-জনেই সতর্ক কেননা দু-জনেই আহত এবং ক্লান্ত। দুজনেই জানে মারাত্মক আঘাতের সময় এটাই।

হঠাৎ রাধার খেয়াল হয় সে এখানে দাঁড়িয়ে আছে কেন? সে তো পালাতে পারত এতক্ষণে! তবে? জামির, অথবা ভয়? সে আস্তে আস্তে পিছনে সরতে শুরু করে।

দৃশ্যটা প্রথম চোখে পড়ে দেদোনের। সে জামিরকে ছেড়ে রাধার দিকে ঝাপ সে জামির এ সুযোগ ছাড়ে না। সে একটা চিতাবাঘের মতো দেদোনের পিঠের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। গর্দানের উপরে একটা প্রবল আঘাতে দেদোনের কাণ্ডজ্ঞান সম্পূর্ণ লোপ পায়। মাথার ভেতরে একটা ভোঁতা শূন্যতাবোধ, কুয়াশার মতো ঝাপসা অনুভূতির সামান্য সময়, তারপর সে ঝড়ে ভাঙা গাছের মতো আছড়ে পড়ে মাটিতে। জামির তার উপরে দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে হাঁফায়। তারপর রাধার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে টলতে টলতে জাঙ্গলের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে যায়।

দেদোন জিতলে শুধু থুথু ফেলে চলে যেত না, দেদোন জিতলে জামির খুন হতো। কিন্তু একথা জামির বুঝেও দেদোনের মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করেনি। কেনান সে শুধু আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ করেছিল। সে অবশ্যই ভুল করেছিল।

দেদোন কয়েকদিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে ওঠে। তারপর গোপনে পরিকল্পনা চলে কয়েকদিন। তারপর একদিন মাঝরাত্রে নমনকুড়ির আকাশ লাল হয়ে উঠেছিল আগুনে।

দেদোন দলবল সংগঠিত করে আক্রমণ করেছিল বাজিকর বসতি। সব কটি ঘরে আগুন লাগিয়েছিল, ধর্ষণ করেছিল রমণীদের, বিশেষ করে লুবিনিকে, তার তখন চোদ্দ বছর বয়েস। দেদোন আগুনের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছিল পরতাপের দুটি সন্তানকে, দাঙ্গাবাজদের ভীষণ আকৃতির হাঁসুয়ায় খুন হয়েছিল আরো দুজন মানুষ।

এই ঘটনার পর দেদোনোর বীরখীতি আরো ছড়ায়, তার পাশবিকতা ও যথেচ্ছার আরো বাড়ে। এতে মজা পায় সে। নিজেকে একদল শেয়ালের মধ্যে সিংহের মতো মনে হয় তার।

তারপর সে নমনকুড়ির সাঁওতালপাড়ায় নজর দেয়। সাঁওতাল মেয়েদের পছন্দ অপছন্দ এবং ইচ্ছা-অনিচ্ছার দাম আছে, একথা দেদোনরা জেনেছিল। এতে যে দেদোনদের দম্ভে লাগে, একথা সাঁওতালরা জানত না।

কাজেই আচমকা রাতের অন্ধকারে কিংবা হাটফেরতা দলছুট কোনো সাঁওতাল রমণী হিঙ্গলে ও জামিলাবাদে ধর্ষিতা হতে থাকে। সাঁওতালরা সতর্ক হয়। এখনো এই দেশ তাদের কাছে বিদেশ, তাছাড়া এখানে দেদোনরাই দলে ভারি। কাজেই তারা নিজেরা সতর্ক হয় ও মেয়েদের শাসন করে।

তারপর একদিন হাড়মার নতুন বউ দুর্গি জামিলাবাদের আমবাগানের হারানো গরু খুঁজতে যায়। নিরালা নির্জন আমবাগানে যে দেদোন.তাড়ির আসর বসিয়েছে, একথা সে জানবে কী করে? দুর্গি দেদোনকে বাপ ডেকেও পার পায় না। আঁচল মুখে কামড়ে ধরে সে বাড়ি ফিরে আসে এবং ‘কী হয়েছে’ জিজ্ঞেস করতে হাড়মার গায়ের উপর আছড়ে পড়ে উন্মাদের মতো মারতে থাকে তাকে। তারপর সে চেঁচিয়ে কাঁদে ও পাড়ার লোকে জানতে পারে সবই।

হাড়মা কদিন গুম হয়ে ঘরের ভিতর বসে থাকে। কোনো কাজ করে না। কোনো কাজে উৎসাহও বোধ করে না।

কিন্তু এভাবে তো মানুষের চলে না। তাই দুর্গিকেও ঘরসংসার করতে হয়, হাড়মাকেও মাঠে যেতে হয়। দু-জনেই একটু স্বাভাবিক হতে হাড়মা বলে, এবার একদিন আমবাগানে ডাক দেদোনকে।

দুর্গি শঙ্কিত হয়ে বলে, কেমন?

হাড়মা বলে, ছেনালি করে ডাকবি।

এসব কাজ জানি নাকি?

দরকারে সব জানতে হয়।

যা হবার তো তো হয়ে গেছে, আর এসব ঝামেলায় গিয়ে লাভ কি?

হয়ে গেছে কে বলল? হচ্ছে তো প্রায়ই। আর হয়েই যদি গিয়ে থাকে তাহলে মারলি কেন আমায়?

হাড়মা চালায় বাঁশে গোঁজা তিনসেরি হেঁসোখানা নামায়। হেঁসোর মাথা একমুঠোহাত লম্বা, পাশে আট আঙুল প্রমাণ। মুর্যের মধ্যে ধরা যায় এমন হাতলের সরু বাঁকানো বেশ খানিকটা লম্বা লোহার দণ্ড ঢোকানো। সেই লোহার মাথায় হঠাৎ চওড়া হওয়া মারাত্মক হেঁসোর ফল। বুনো জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গে হাতহাতি লড়াই করতে এমন অস্ত্র লাগে। হার্ডমা শান্তভাবে একখানা কাঠের পালিশ করা টুকরো বের করে তার উপরে বালি ছড়িয়ে সেই হেঁসোয় ধার দিতে বসে। দুর্গি এলে, তারপর?

তার পরের কথা তারপরে ভাবব। এখনকার কথা আগে ভাব। এখন যদি পাগল হয়ে যাই ‘তারপর দিয়ে তোর কী হবে?

দুর্গি আর কথা বলে না। হাড়মার ভাবভঙ্গি দেখে সে বোঝে এ কাজ তাকে করতে হবে। সে করেও।

দেদোন টোপ খায়, কেননা টোপ খাওয়ার মতো চেহারা দুর্গির ছিল। সন্ধ্যাবেলা নির্দিষ্ট গাছের নিচে দুর্গি দাঁড়িয়ে থাকে, দেদোন আসে। দেদোন কাছে আসলে হঠাৎ সেই গাছের হাত-পা গজায় এবং দেদোনের মুণ্ড ও ধড় আলাদা হয়ে সেখানে পড়ে থাকে।

আর তখন জামিলাবাদের ঘোষপাড়ায় হরিনাম সংকীর্তনের আসরে তুমুল খোলকৰ্তাল বাজনা চলে। আজ এর বাড়ি তো কাল ওর বাড়িতে আসর বসে। মানুষ উদ্দাম হয়ে নাচে, গান গায়।

 

২৯.

সাঁওতাল এবং ওরাওঁরা খড় ধার দিয়েছিল, জঙ্গলে বিন্না ও শন ছিল। কাজেই বাজিকরদের ঘরগুলো আবার নতুন করে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল। প্রতি বাড়িতেই দুঃস্বপ্নের স্মৃতির মতো বরগায় কি আড়ায়, দু-একখানা অঙ্গারের রঙ ধরা কাঠ কিন্তু রয়ে গেল। সেগুলো আগুন ধরেছিল ঠিকই, কিন্তু নতুন করে বাড়ি বানাবার সময় দেখা গেল একেবারে পরিত্যাগ করার মতো হয়নি।

পুলিশ কোতোয়ালি ছিল হাবিবপুরে, এখান থেকে অনেকটা দূর। বাজিকরদের কেউ পরামর্শ দেয়নি কোতোয়ালিতে খবর দিতে, আর বাজিকর অতীতে কখনো স্বেচ্ছায় পুলিশের কাছে যায় নি, এখনো যায় না। জামিলাবাদ একজন চৌকিদার আছে, সরকারি নিয়মে তারই অবশ্য খবর দেওয়ার কথা। কিন্তু সে স্থানীয়দের উপেক্ষা করতে সাহস পায় না। কাজেই এই খুন, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগ স্বাভাবিক ঘটনার মতোই গৃহীত হয়। কেউ এ নিয়ে নতুন করে আলোড়ন সৃষ্টি করে না।

শুধু বালি দলের নেতা হিসাবে জামিরকে গালাগালি করে তার অপরিণামদর্শিতার জন্য। কিছু জরিমানাও হয় তার। অর্থাৎ নতুন ঘর তোলার জন্য জমিলব্ধ যাবতীয় খড় ও তার যাবতীয় গবাদি পশু বিক্রি করে তার সম্পূর্ণটাই তুলে দিতে হয় বালির হাতে। খড় অবশ্য অঙ্গীকারের মধ্যে থাকে, কেননা আগুন একপণ খড়কেও রেহাই দেয়নি।

সময় যেহেতু কারো অপেক্ষায় থাকে না, বছর ঘুরে যায় একের পর এক। তারপরে জামালের জমিদারির এই অংশ বিহার থেকে আগত ভূঁইঞা পদবিধারী কয়েকজন ব্রাহ্মণ কিনে নেয় এবং জামিলাবাদে নতুন বাড়িঘরের পত্তনি করে। এরা সব অবস্থাপন্ন মানুষ। প্রথমেই তারা, নানাধরনের শিক্ষিত মিস্ত্রি মজুর নিয়ে এসে ইট পুড়িয়ে পাকা বাড়ি তৈরি করে। বেশ কয়েকখানা পাকা বাড়ি তৈরি হয় ও পাকাপাকি হয়ে বসতে তাদের প্রায় একবছর লাগে।

এইসব ভূঁইঞারা যে-কোনো ছুতোনাতায় পুরনো পত্তনি উচ্ছেদ করে জামিলাবাদ ও হিঙ্গল সংলগ্ন অনেক জমি খাসে আনতে শুরু করল। এরা কেউই সাবেকি জমিদার নয়, শুধু বড়সড় জোতদার। কাজেই জমি থেকে নিজেরাই মুনাফা তুলবার সবরকম কায়দা এদের জানা। এ ছাড়া প্রত্যেক ঘরই মহাজনি কারবারের বিরাট জাল পেতে বসল। এরা থানা-পুলিশ-আইনকানুন ভালো বুঝত এবং এসবের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগও রাখত। ফলে সদগোপ, ঘোষ ও মুসলমানেরা এদের সমীহ করে চলতে শুরু করল।

নমনকুড়ির মাঠে ইদানীং সবচেয়ে ভালো ফসল হচ্ছিল। এইসব জমি আদিবাসী ও বাজিকরেরা নামমাত্র খাজনায় এতকাল ভোগদখল করে আসছিল। পুরানো বছরের খাজনা বাকির অজুহাতে বেশ কয়েকঘর মানুষের জমি হাতছাড়া হয়ে গেল। এর মধ্যে অবশ্যই বেশির ভাগ মানুষ বাজিকর। এইসব বাজিকরেরা এতদিনেও জমির সঙ্গে একাত্ম হতে পারেনি, কিংবা জমিজমা সংক্রান্ত আইনকানুনও বুঝতে শেখেনি।

যেসব বাজিকরের জমি চলে গেল, তাদের অধিকাংশেরই এজন্য কোনো বিকার দেখা গেল না। তাদের যেভাবে দিন চলছিল, সেভাবেই চলতে লাগল।

কিন্তু পরে পৌষে, মাঘে কৃষিকৰ্মারহিত বাজিকরেরা পরতাপ, জামির ইত্যাদির ঘরের সামনে এসে রুদ্ধবাক ঈর্ষা প্রকাশ করে তাদের চাহনিতে। এত অজস্র শস্য এবার ফলেছে যে, যে-ব্যক্তি সামান্য জমি মাত্র চাষ করেছে, তারও সারাবছরের খোরাকির জন্য ভাবতে হবে না।

সেই মাঘে লুবিনির ছেলে হল। অসামান্য রূপবান শিশু। পরতাপ তারনাম রাখল রূপা। লুবিনি ছেলে পেয়ে তার ক্ষোভ ভুলে গেল। জামির ও রাধার বৃত্তান্ত তার অজানা ছিল না। বিষয়টা যখন প্রচার হয়, লুবিনির তখন বোঝার বয়স হয়েছে। কাজেই ঈর্ষা তাকে কিছুদিন বিপর্যস্ত রেখেছিল। সে মনে মনে রাধাকে উলঙ্গ করে তার সর্বাঙ্গে আলকুশি ছড়াতে চেয়েছিল।

লুবিনির এইসব ভাবান্তর জামির লক্ষ করেনি। কারণ জামিরের সঙ্গে লুবিনির কোনো সম্পর্ক হয়নি। তাছাড়া, সে রাধাকে নিয়ে এত বিভোর ছিল যে লুবিনির শারীরিক মানসিক কোনো পরিবর্তনই তার চোখে পড়েনি। রাধাপর্ব চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হয়ে যাবার পর জামির কিছুদিন আনমনা থাকে। তখন লুবিনি তাকে আড়াল থেকে নজর রাখত। জামির মোটামুটি স্বাভাবিক হয়ে যেতে লুবিনি তাকে উপেক্ষা দেখাতে শুরু করে। প্রথম প্রথম জামির এসব খেয়াল করত না। যেমন, এতকাল তার নির্দেশমতো লুবিনি হাতে হাতে যেসব সহায়তার কাজ করত, ইদানীং সেসব কাজে অবহেলা দেখাতে শুরু করল। ব্যাপারটা এমন নয় যে লুবিনি সংসারের কোনো কাজ করত না, বরং উল্টো। এই সে আরো বেশি বেশি দায়িত্ব নিয়ে কাজকর্ম দেখাশুনা করছিল। কেননা ফসল যেহেতু বেশি আসছিল, চাষি গৃহস্থের কাজের পরিধিও বাড়ছিল। লুবিনি জামিরকে উপেক্ষা করত অন্যভাবে। জামির যখন বলে, গাইটাকে এবার ছেড়ে দে, চরে আসুক। লুবিনি তখন তার দিকে একবার তাকিয়ে গোয়ালঘরের উল্টোদিকে হাঁটা দিত। আবার পরিশ্রান্ত হয়ে জামির যখন দাওয়ায় এসে বসে বলত, জল দে, লুবিনি তখন এক ঘটি জল জামিরের থেকে হাত তিনেক তফাতে ঠক্ করে নামিয়ে রেখে চলে যেত।

এধরনের মৃদু প্রতিবাদ বেশ কিছুদিন জামিরের চোখে পড়েনি। তাতে লুবিনি আরো ক্ষিপ্ত হচ্ছিল। তারপর জামির যখন নতুন করে স্ত্রীলোকের প্রয়োজন অনুভব করতে শুরু করে, তখন সকৌতুকে লুবিনির এসব ভাব সে লক্ষ করে।

একদিন সন্ধ্যাবেলা হায়া ঘরের পিছনে আবর্জনা ফেলতে গিয়ে গোয়ালঘরের পাশ দিয়ে জামিরের সন্তর্পণে মাঠে নেমে যাওয়া দেখল। জামিরের পাঁজা কোলে লুবিনিকে সে দেখেছে ঠিকই, নাহলে, অতবড় পুরুষটার বুকের উপর দুমদাম কিল মারছিল কে? জামির চাপা হাসি হাসছিল।

দেখে হায়ার প্রবল আতঙ্ক হয়। ভয় সে চেপে রাখতে পারে না, ঘরে এসে পরতাপকে বলে।

পরতাম প্রথমে কিছু বোঝে না। বলে, হ তো কি হল?

এ কথার সঠিক উত্তর হায়ারও দিতে পারে না। সে শুধু বলে, না আমার বড় ভয় করছে। কিসের ভয়?

জামিরের যা সা-জোয়ান চেহারা

পরতাপ তাকে ধমক দিয়ে বলে, যা যা নিজের কাজে যা, যাদের কাজ তাদের বুঝতে দে! পাগল

কিন্তু হায়ার আতঙ্ক কাটে না। সে লুবিনির ফেরার অপেক্ষায় থাকে। বেশ কিছু সময় পরে লুবিনি ফিরে এলে হায়া সতর্কভাবে তার চোখমুখ নজর করে দেখে। না, একটা সলজ্জ উত্তেজনা ছাড়া সে আর কিছু আবিষ্কার করতে পারে না।

এর দিনদুয়েক বাদে হায়া লুবিনিকে জামিরের ঘরে শুতে পাঠাতে শুরু করে এবং এর পরে সারাজীবন জামির আর কখনো অবিশ্বস্ততার কাজ করেনি।

 

৩০.

জামিলাবাদ, হিঙ্গল, নমনকুড়ি ইত্যাদি গ্রামের মানুষ জানত না কী করে এখানকার জমি এত ফলপ্রসূ হল। গত পনেরো বছর ধরে টাঙ্গন দিয়ে জল আসা ক্রমাগত কমেছে। এতকালের ডুবো জমি এখন চমৎকার আবাদি জমি হয়েছে। প্রতি মরসুমে ফসলে মাঠ হেসে উঠছে। মানুষ দেবতার আশীর্বাদ হিসাবে দেবতার নামে জয়ধ্বনি করছে। কিন্তু কেউ জানত না কি করে এমন হল।

আবার সন্তোষ, দেবীকোট, কান্তনগর, সুলতানপুর, জাহাঙ্গীরপুর ও বিজয়নগর পরগনার অসংখ্য গ্রামের মানুষ এই একই ঘটনাকে দেবতার অভিশাপ বলে ধরে নিয়েছে। সেসব গ্রামে কয়েক বছর ধরে কীর্তন, নামাজ, পূজাপার্বন ও মানত চলছে দেবতার রোষ থেকে মুক্তি পাবার জন্য। কারণ আত্রাই আর পুনর্ভবায় জল নেই। বর্ষার কয়েকমাস সামান্য জল থাকে, তাছাড়া বছরের অন্যসময় নদীগর্ভ ধু ধু বালিয়াড়ি। ব্যবসা-বাণিজ্য যাতায়াতের জন্য এইসব পরগনার বিস্তৃত অঞ্চলে এই নদী দুটিই ভরসা। কোনো অজ্ঞাত কারণে হঠাৎ নদী দুটিই শুকিয়ে গেল।

বৃদ্ধরা বলে, হ্যাঁ বাপু, এমন আরো একবার হয়েছিল বটে, বাপ-দাদাদের কাছে শুনেছি, সে এখন থেকে একশো সওয়াশো বছর আগে।

আগে যা ঘটেছিল এইবারেও তাই ঘটেছে। তিস্তা আর আত্রাই-এর সংযোগে হিমালয় থেকে নেমে আসা বড় বড় পাথরের চাই, গাছের গুড়ি জমে জল যাতায়াতের রাস্তা ক্রমশ বন্ধ করেছে। সেই বাধার উপর পলি ও বালি দীর্ঘদিন ধরে জমে জমে আত্রাই-এর মুখকে পুরো বন্ধ করে দিয়েছে। এদিকে তিস্তার প্রবল জলধারা নতুন পথ করে নিয়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম, জনপদ। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রংপুর জেলা। একদিকে জলের জন্য হাহাকার, অন্যদিকে বন্যা প্রতিবছরই।

আগের বারে জেলা কালেক্টররা আপ্রাণ চেষ্টা করে কলকাতার রেভিনিউ বোর্ডকে রাজি করিয়ে টাকার ব্যবস্থা করেছিল এই বাধা দূর করার জন্য। প্রতিদিন দশহাজার কুলি কাজ করত। কিন্তু সেসব ব্যবস্থা বড় সহজে হয়নি। দুর্ভেদ্য জঙ্গল ও পাহাড়ি জায়গা ছিল মানুষের বসবাসের অযোগ্য। শয়ে শয়ে মানুষ মরছিল জ্বর ও পেটের রোগে। ফলে কুলিরা পালাতে থাকে। তখন আবার কুলিদের আটকাবার জন্য দারোগা, পাহারাদার, দফাদার ইত্যাদি নিয়োগ করতে হয়।

সে সময়ে সাহেবদের এইসব আয়োজনের প্রয়োজন ছিল। লবণ, রেশম, তঁত, চাল ইত্যাদি চলাচলের জন্য তখন একমাত্র পথ ছিল নদী। কাজেই সাহেবদের ব্যবসা মার খাচ্ছিল। তার উপরে কলকাতায় তখন ঘনঘন চাল পাঠাবার দরকার হতো। নদীতে জল না থাকলে কিভাবে চাল পাঠানো যাবে? কাজেই সরকারি ব্যবস্থায় দ্রুততা ছিল।

কিন্তু এবারের ব্যবস্থা অত তাড়াতাড়ি হয় না। যাতায়াতের জন্য স্থানে স্থানে রেলব্যবস্থা হয়েছে। রাস্তাঘাটও তখনকার দিনের থেকে অনেক নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ হয়েছে। কাজেই কালেক্টরদের ব্যবস্থা নিতে বেশ সময় পার হয়ে যায়। অবশ্য আত্রাই-এর মুখ পুরোপুরি বন্ধ একদিনে হয়নি। বছরের পর বছর ধরে আত্রাই-এর মুখ আটকেছে, আর সেকারণে জল কমেছে দিনাজপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। জল কমেছে আত্রাই, পুনর্ভবা, টাঙ্গন ও এদের অসংখ্য খাড়িগুলোতে। আর এই জল কমাতে লাভবান একমাত্র নমনকুড়ি, হিঙ্গল, জামিলাবাদের মানুষ। তাই তারা খোঁজও নেয়নি কিসে জল কমল!

তবুও সরকারকে একসময় ব্যবস্থা নিতে হয়। কেননা আত্রাই, পুনর্ভবা, টাঙ্গন শুকোলে রেলপথের খুব একটা অসুবিধা না হলেও তিস্তা জলপাইগুড়ি ও রঙপুর ভাসাচ্ছে। তাতে ক্ষতি হচ্ছে বিরাট। কাজেই সরকারকে নজর দিতে হয়। আবার হাজার হাজার কুলি সংগ্রহ করতে হয়। তবে এবার আর খুব একটা অসুবিধা হয় না। আদিবাসীদের আগমন অব্যাহত ছিল। কুলি হতে তারা কখনোই অরাজি নয়। সুতরাং আত্রাই-এর মুখের বাধা সরতে থাকে।

ফলে পরের বছর বর্ষার সময় নমনকুড়ির নিচু জায়গা ডুবল। তারপরের বছর নমনকুড়ি নতুন আবাদি জমি ডুবল। আর তার পরের বছণ প্রবল জলস্রোতে নমনকুড়িকে পুরো ডুবিয়ে জামিলাবাদ হিঙ্গলকেও ডুবালো। আগের পনেরো-বিশ বছরের মধ্যে এরকম অভিজ্ঞতা কারো হয়নি। বাজিকরেরা আসার পর তো জল হয়ইনি। বলতে গেলে বাজিকরেরা জলকে ভয় পায়। সাঁওতাল ওরাওঁরা যদিও প্রথমে লড়াই করেছে, কিন্তু এখন এতদিন পরে তারাও অসহায় বোধ করে। জামিলাবাদ-হিঙ্গলের উঁচু জায়গায় নমনকুড়ির মানুষ ও জানোয়ার অনাদরে অবহেলায় দুরন্ত বর্ষার সঙ্গে লড়াই করে, মরে।

তারপর বৃষ্টি শেষ হয়ে যখন শরতের মেঘের আনাগোনা শুরু হয় আকাশে, তখনো নমনকুড়ির জল দিগন্ত পর্যন্ত থৈ থৈ করে। সাঁওতাল ওরাওঁরা আশায় থাকে জল একসময় নামবে, তারা আবার তাদের ডুবে যাওয়া ভিটেগুলো সন্ধান করে বের করবে। আবার মাটি তুলে উঁচু করে, তারপর আবার ঘর বাঁধবে। এতদিন প্রকৃতি হার মানবেই।

কিন্তু বাজিকরেরা এরকম সাহসিক চিন্তা করতে পারে না আর। পরতাপ, জামির ও তাদের মতো আরো দু-চারজন, যারা জমির সঙ্গে নিজেদের আত্মীয়তা তৈরি করতে পেরেছিল, দূরে জলের মধ্যে তাকিয়ে নিজেদের জমিগুলোর দিক নির্ণয় করার প্রয়াস পায় বৃথাই।

তারপর আশ্বিন মাস পার হয়ে গেলে বালি দলের সবাইকে জিজ্ঞেস করে, এবার?

একথার উত্তর কারো কাছেই নেই। তখন বালিই আবার বলে, এখানে আর নয়, কোনো নতুন জায়গা খুঁজতে হবে।

কোথায়?

একথার উত্তরও থাকে না।

তখন কেউ একজন বলে, এবার কোনদিকে যাব?

পুবে।

একথা বলে জামির।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *