২১-২৫. মালদা শহর থেকে উত্তর-পূর্ব কোণে

২১.

মালদা শহর থেকে উত্তর-পূর্ব কোণে পঁচিশ-ত্রিশ মাইল তফাতে মহানন্দা ও টাঙ্গন নদী দুটি এক জায়গায় মিলেছে। বলা ভালো টাঙ্গন এসে মহানন্দায় পড়েছে। এই সঙ্গমের উত্তর অংশে দুই নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল বর্তমানে আগাছার জঙ্গলে পূর্ণ, বসতিহীন। পৃথিবী সেখানে এখনো আদিম। বর্ষার সময় থেকে শীতের শুরু পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল থাকে জলমগ্ন। উত্তরের বিশাল অঞ্চলের জল নামে এই দুই নদী দিয়ে এবং সেই জলের একটা বড় অংশ এই ব-দ্বীপ সদৃশ অঞ্চলে বছরের কয়েকমাস জমে থেকে এই ভূখণ্ডকে আদিম করে রেখেছিল। উত্তরের বালি মিশ্রিত পলি ক্রমশ জমে জমে এই জলাভূমির মধ্যে অসংখ্য ঢিবি তৈরি করেছে। জল যখন সরে যায় তখন প্রথমে মাথা তুলে দাঁড়ায় এই ঢিবিগুলি। শীতের প্রারম্ভে জল যখন সরতে থাকে তখন মনে হয় সারিবদ্ধ জলজন্তু রোদ পোহাচ্ছে পিঠ উঁচু করে।

লবণ ব্যবসায়ী সাহেবদের এক সাহেব গোমস্তা নদীপথে চলার সময়ে কোনো একদিন এই জঙ্গলাকীর্ণ জলার মধ্যে নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষণ দেখতে পেয়েছিল। যেসব জায়গায় জল জমে না সেইসব উঁচু জায়গায় একধরনের ঋজু গাছের প্রাচুর্য দেখেছিল সে। অভিজ্ঞ মানুষটা দু-এক নজর দেখেই বুঝেছিল এ গাছগুলো শাল, যদিও পরিচিত শালের তুলনায় অপেক্ষাকৃত খর্বাকৃতি, সেই কারণেই বোধ হয় আরও বলিষ্ঠ ও স্কুল।

চারদিকে তখন রেলের লাইন বসছে নতুন উদ্যমে। রেল মানেই সাহেবদের – সমৃদ্ধি, রেল মানেই শাসক আরো সুরক্ষিত। রেল লাইন বসছে সাহেবগঞ্জ—ভাগপুরে, রেল লাইন বসছে সান্তাহার থেকে পার্বতীপুর, থেকে কাটিহার। আর রেলের জন্য তো দরকার প্রচুর কাঠের এবং অবশ্যই শালকাঠের।

আশেপাশে শালের প্রাচুর্য কোথাও নেই। লবণের গোমস্তা সাহেব রাতারাতি সরবরাহকারী ঠিকাদার হয়ে গেল। কে যাবে এই অজগর জঙ্গলে নদীনালার গোলকধাঁধায় গাছ কাটতে? মানুষের কি অভাব আছে? লক্ষ সাঁওতাল ছিন্নমূল হয়েছে? আর গাছ কাটতে, জমি উদ্ধার করতে তাদের সমতুল্য কে?

সেই তখন সাঁওতালরা প্রথম প্রবেশ করে রাজশাহিতে, দিনাজপুরে। তাদের দেখাদেখি এল মুণ্ডা এবং ওরাওঁরা এবং তাদের লেজুড় ধরে ভূঁইয়া, তুরি, মাল, মাহালি, লোহার, কোলকামার আদি খেটে-খাওয়া মানুষের দল।

বদিউল ইসলাম সেইখানে জমি দিয়েছে বাজিকরদের। প্রথম তিনবছর কোনো খাজনা নেই, তৃতীয় বছর থেকে খাজনা দিতে হবে। বালিরা চার যুবক একদিন এল সেই জমি দেখতে। এর নাম জমি? হায় কপাল!

কেন কি এমন খারাপ জমি? পাথর তো নেই, কাঁকর তো নেই। তার উপরে দেখ, কেমন জলের আয় আছে।

একথা বলে সাঁওতালরা। প্রায় পঞ্চাশ-ষাট ঘর সাঁওতালের বসত এর মধ্যেই হয়ে গেছে জায়গাটায়। পনেরো-বিশ ঘর ওঁরাও’-আছে।

তারা বলে, হাসিল জমি, তৈরি জমি কে দেবে তোমাকে? আমরা জমি হাসিল করি, চালাক লোকে পরে তার দখল নেয়। যতদিন না নেয়, ততদিন তো জমি তোমার। ততদিনই আবদার কর, ফসল কর, খাও। নিয়ে যদি নেয়, আবার খালাস করবে জমি। জমির কিছু অভাব আছে পৃথিবীতে?

বালির মুখে এসব কথা শুনে পীতেম ধন্দুর ছেলেকে বলে, দে তো বাপ, কোমরের পিছনে দু’টো তামাচার ঠোকা দে তো। আস্তে দিস, তুই বড় জলদিই জোয়ান হয়ে যাচ্ছিস। তবে জোয়ান জলদিই হওয়া দরকার, কেন কি, আজ পৃথিবীতে জমির অভাব নেই, তবে কাল হবে।

তারপর সে বালির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, সাঁওতালরা আছে? ওরাওঁরা আছে?

আছে?

তবে বাজিকরও থাকবে, থাকতে তাকে হবে।

তবে ব্যবস্থা করি।

হ্যাঁ করো।

 

বালি তারপরে দলের পরিবার এবং লোকগণনা করে। রাজমহলে এসেছিল কুড়ি ঘর বাজিকর, থানাদারকে হিসাব দিয়েছিল একশো পাঁচজন মানুষের। এখন তার থেকে বেড়ে-কমে দাঁড়িয়েছে ষোল ঘর মানুষ। মানুষের সংখ্যা পঁচাশিজন। প্রতি সমর্থ পুরুষ পাঁচ বিঘা করে জমি পেয়েছে বদিউলের কাছ থেকে। সবই জংলা জমি, অর্থাৎ শুরুতে একেবারেই ঝাড়া হাত-পা।

কিন্তু ‘ব্যবস্থা করি’ বললেও ব্যবস্থা এত সহজে হয় না। ষোল ঘর মানুষের পাঁচ ঘর এই শহর ছেড়ে এখন আরেকটি অজ্ঞাত অপরিচিত স্থানে যেতে চায় না। পীতেম যে স্থিতির রসে দলের মানুষকে নিষিক্ত করতে চেয়েছিল এখন তা আবার কিছু অন্য রকম প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করল। মুক্ত পৃথিবীর এবং অজ্ঞাত রাস্তায় ভয়াবহতা কি পরিমাণ বেড়েছে, সেকথা যাযাবরের থেকে ভালো কে বাঝে? তাছাড়া বাজিকরের নিজস্ব রোজগারের পথও ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। কাজেই প্রথমে রাজমহল, তারপরে এই মালদার নতুন বৃত্তিসমূহ যে সামান্য স্থায়িত্বের জন্ম দিয়েছে, আর এক অজ্ঞাত ভবিষ্যতের মধ্যে গিয়ে সেটুকুকে হারাতে অনেকেই রাজি নয়। তাছাড়া আরো সমস্যা আছে। বাজিকর জানে না, পাঁচ বিঘা জমি মানে কতখানি মাটি। বাজিকর জানে না, এই জমি কি করে চাষোপযোগী করতে হয়। বাজিকর জানে না, বছরের কোন সময় বীজ বপন করতে হয়, কখন কাটতে হয়।

বালি বলে, শিখে নেব সব। বাজিকর তো বোকা নয়!

কিন্তু তার গলায় যতটা আহ্বানে আন্তরিকতা থাকে লড়াই করার জোর ততটা থাকে না, কেননা জমি নিয়ে যে জীবন, তার সঙ্গে বাজিকরের কত পুরুষের সংস্রব

 

বিরোধের কথা শুনে পীতেম প্রথমে কিছুটা দমে যায়। এরকম সে ভাবেনি। তার দলের মানুষেরা তার ইচ্ছা এবং পরিকল্পনার বিরুদ্ধে যাবে, একথা তার পক্ষে ভাবা সম্ভব ছিল না। কিন্তু পরে চিন্তা করে, দলের সত্যিকার কর্তৃত্ব সে বহুকালই করছে না, অথবা কর্তৃত্ব করার মতো বিশেষ কিছু নেইও আর। গত বিশ বছরে যেসব বড় বড় ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো এত শক্তিশালী যে পীতেমের আয়ত্তের বাইরেই তা ছিল। তাছাড়া, গোরখপুরে তিনশো ঘর বাজিকর ছিল। কোথায় গেছে তারা? পৃথিবীর কোন্ প্রত্যন্তে? আর কোথায় এসেছে পীতেম? যেদিন রহু তার দল নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়েছিল সেদিনের মানুষেরা কে কোথায় গেছে, তা কি কেউ জানে? কী নামে এখন তারা পৃথিবীতে পরিচিত? তারা কি রহুর নাম পর্যন্ত মনে রেখেছে? কে দিল তাদের নাম বাজিকর? সে তো রাস্তার নাম! এখন হোক না তার নাম বালি কর্মকার, জিল্লু টাঙ্গাওয়ালা, কি বিষেণ ঠাটারি? পীতেম কি তাই চাইছে না?

তাই পীতেম বালিকে ডেকে বলে, যারা যেতে চাইছে না, তাদের বলল, আমি চাই যে আমরা একসঙ্গে থাকি। তবুও যদি তারা একত্রে না থাকে, তবে থাকুক তারা এখানে। দুরের দেশে তো মানুষের কুটুমও থাকে। তারা আমাদের কুটুম হয়ে থাক। আমরা চল আরেকবার আমাদের কপাল ঠুকে দেখি।

 

২২.

পিছনে পড়ে রইল চার ঘর বাজিকরের সতেরো জন মানুষ। আরেক ঘরকে বালি শেষ পর্যন্ত রাজি করাতে পেরেছিল। পিছনে পড়ে রইল সালমা। পীতেমকে এ ব্যবস্থাও মানতে হল। বদিউল এরকম শর্তই করেছিল। ক্রমশ বদিউলের সঙ্গে সালমার সম্পর্ক এমনই এক পর্যায়ে এসেছিল যে অন্যান্য বন্ধুবান্ধব বদিউলের কাছে একেবারেই পরিত্যাজ্য হয়েছিল। সালমা ভেবেছিল এও এক বড়লোকি খেয়াল, একসময় খেয়াল কেটে গেলে সে নিষ্কৃতি পাবে। বদিউল অবশ্যই সেভাবে সালমাকে আটকায়নি। সে বলেছিল, এ বয়সে তুমি আর ওদের সঙ্গে গিয়ে করবে কি? তার থেকে যে কদিন বেঁচে থাকি, এসো বুড়োবুড়িতে এক নতুন খেলা খেলি। লোকে দেখুক প্রেমের খেলা শুধু যুবকদেরই একচেটিয়া নয়।

সালমা বলেছিল, মানুষ হাসবে না?

হাসুক।

বদিউল থোড়াই পরোয়া করে মানুষের কথার।

কিন্তু সালমা ভেবেছিল পীতেমের কথা। ধন্দুর বউ নতুন মানুষের সঙ্গে ঘর করছে। ধন্দুর ছেলে জামির, সে সবে জোয়ান হয়ে উঠেছে, সে তো সালমার কাছেই মানুষ তাছাড়া, এতদিনের অভ্যাস।

তবুও বদিউলের আবদারে মধ্যে কোথাও যেন সুপ্ত ছিল একটু দাবি অথবা বাজিকরদের জমির বিনিময়ে কিছু পাওয়ার ইচ্ছা।

কাজেই কাতর পীতেমকে সে বলেছিল, পীতেম, কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়।

তাই বলে তোকে দিয়ে যাব?

আমাকে কি আর দরকার আছে তোর?

নেই?

পীতেম আঁতকে উঠেছিল। সালমা বোঝে, দীর্ঘদিনের মৌনতার সময়ে পীতেম শিশুর মতো তার উপরে নির্ভর করত। এখন অনেকটা স্বাভাবিক হলেও পীতেম একাকিত্বের কথা ভাবতে পারছে না।

কিন্তু সে নিজে তো পীড়িত বোধ করছে না! হয়ত, এই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। সারাজীবন কোনোকিছুই তাকে তেমনভাবে আটকে রাখল না। বয়স স্বাভাবিক। নিয়মে না হলেও মন্থরভাবে তাকেও ভেঙেছে। বয়সের বার্ধক্য, শরীরে প্রৌঢ়ত্বের ক্লান্তি। পৃথিবীর রঙ এখন তার কাছেও বিবর্ণ। তবুও কোনো কিছুই তাকে আটকে রাখতে পারছে না কেন? এই যে ছেলেটাকে সে কোলেপিঠে করে মানুষ করল, যা সে সারাজীবনে এই একবারই করেছে, সেই জামিরও কেন তাকে আটকে রাখতে পারছে না! অবশ্যই বদিউলকে প্রতিদান দিতে হবে। কিন্তু সে কি এভাবেই! সর্বস্ব খুইয়ে!!

এখন যেন এভাবেই সে কাতর হতে চায়, অথচ সর্বস্ব খোয়াবার যন্ত্রণা সে তার অভ্যন্তরে টের পায় না। বয়স স্বাভাবিকভাবে যে সব দুঃস্বপ্ন আনে, তার তাড়নায় এখন সে নিজেকে অত্যন্ত সংগোপনে নিতান্ত দুর্ভাগাই মনে করে। কিন্তু স্বভাবের মধ্যে যে দম্ভ দীর্ঘকাল ধরে পালন করেছে, সেই দম্ভই তাকে এখনো পরিচালিত করে এবং এসব দুর্বলতার চিন্তা পীতমের কাছেও প্রকাশ করতে পারে

কাজেই পীতেমকে সে সান্ত্বনা দেয় ঐ ভাবেই! বলে, পীতেম, কিছু পেলে কিছু দিতে হয়। বদিউল অমনি তোদের জমি দেবে কেন?

যদিও পীতেমকে সে ভালো করেই চেনে, তবুও কোথায় যেন এক কাঙাল, যাকে সে ধরতে চিনতে পারে না, আশা করে,স্থাতেম বলুক, চাই না জমি, তবু তুই থাক আমার কাছে।

পীতেম একথা বলে না। সালমা জানে পীতেম একথা বলতে পারে না। পীতেম বলে, তবে তাই হোক। রহুর আচ্ছাই পূর্ণ হোক। বাজিকর গেরস্থ হোক।

সালমা থেকে গেল। বদিউল তার জন্য নতুন ঘর তুলে দিল, মাসোহারার বন্দোবস্ত করল। গাই-মোষ কিনল কয়েকটা। তাদের রক্ষণাবেক্ষণ দুধ-ঘির বন্দোবস্ত নিয়ে দিন কেটে যায় তার। বিকালে বদিউলের কাছে যেতে হয় তাকে। মানুষটাকে খারাপ লাগে না তার। তার কাছে সারাজীবন ধরে যেসব মানুষ এসেছে বদিউল তাদের থেকে লক্ষণীয়ভাবে পৃথক। বদিউল শুধু বৃদ্ধ বয়সের একাকিত্বের হাত থেকে কিছুটা রেহাই পাবার জন্য সালমার সাহচর্য চায়।

সালমা কাটায় এক নিরুপদ্রব জীবন। তার গরু-মোষের সংখ্যা বাড়তে থাকে ক্রমশ। অঢেল দুধ দেয় তারা। পশুবিক্রির ব্যবসাও সে তারপর শুরু করল। এজন্য তাকে নোক রাখতে হয়। খরচ করার কোনো দরকার তার ছিল না, কাজেই পয়সা নিজস্ব নিয়ম অনুসারে বাড়ে এবং সালমা নেশাগ্রস্ত হয় সেই বাড়ানোর প্রক্রিয়াতে। উদ্ধৃত্ত পয়সা দিয়ে সে কেনে সোনা। গলায় পুঁতির মালা সরিয়ে রেখে সে পরে এক ছড়া মোটা বিছাহার। অন্য কোনো গহনা সে পরে না। কারণ সে বোঝে গহনা পরার বয়স তার নেই এবং সে আকাঙ্ক্ষাও তার হয় না। গলায় ভারি বিছাহার পরে এই কারণে যে, তার যে পয়সা আছে, এটা অন্যের বোঝা দরকার। পয়সা মানুষের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং ক্ষমতা আশপাশের মানুষের উপর কর্তৃত্ব করার অধিকার দেয়।

কি করবে সালমা এত পয়সা দিয়ে? বাজিকরদের দিয়ে দেবে? কেন দেবে? দিলে কি তাদের অভাব মিটবে? অভাব মিটবে না, একথা সালমা বোঝে। আর দেওয়ার আগ্রহও সে বোধ করে না। মালদা ও জামিলাবাদে, সেই দুই জায়গায় বাজিকরেরা স্থায়ী হয়েছে, তারা দুরাবস্থা কাটিয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, একথা সালমা জানে। কখনো কখনো কেউ কেউ আসে তার কাছে আসে সাহায্যের জন্য। সালমা দু-পাঁচ টাকা দিয়ে বিদায় করে তাদের, তার বেশি কিছু করে না।

উদ্ধৃত্ত পয়সা দিয়ে সে নতুন ব্যবসা শুরু করল। বন্ধকী এবং সুদের ব্যবসায়ের এক বিচিত্র উত্তেজক নেশা আছে। সালমা সেই নেশায় আচ্ছন্ন হল।

বদিউল বলে, বিবি, শুনতে পাই অনেক পয়সা কামাচ্ছ, খাবে কে এসব পয়সা?

সেকথা আমিও ভেবেছি।

কি ভেবেছ?

মিয়া, তোমার বাপ-ঠাকুরদার সম্পত্তি রেখে গেছে, তুমি সারাজীবন খরচা করলে। হিসাবও রাখলে না কিসের থেকে কি হয়। তোমার নেশা খরচ করা। আর দেখ, বুড়ো বয়সে আমার নেশা হল পয়সা করা। ভোগ করার বয়স নেই, ইচ্ছাও নেই, অথচ পয়সা করে যাচ্ছি।

প্রশ্নটা তো আমার তাই। করছ কেন?

নেশায় করছি। তুমি যেমন নেশায় খরচ করছ, আমি তেমনি নেশায় পয়সা বানাচ্ছি। পয়সা তো মানুষ শুধু ভোগ করার জন্য করে না।

কি জানি? ভোগ ছাড়া পয়সা আর কোন কাজে লাগে কে জানে?

 

কয়েক বছর এইভাবে কেটে যাওয়ার সালমা পীতেম ও জামিরের কথাও ভুলে গেল। পয়সার টান তাকে এমন স্বার্থপর জগতে নিক্ষেপ করল যেখানে অন্য সব সম্পর্ক মূল্যহীন হয়ে যায়। সমস্ত দিন তার কেটে যায় নানা ব্যবসাপাতির কাজে। পীতেম জামিলাবাদ চলে যাওয়ার পর আর তার সঙ্গে দেখা হয়নি সালমার। পীতেমের পক্ষে এই দূর রাস্তা হেঁটে বা ঘোড়ায় আসা আর এই বয়সে সম্ভব নয়। চেষ্টা করলে সালমা হয়ত যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু তা সে করে না।

 

২৩.

উত্তরে শেষ ভূখণ্ড জামিলাবাদ। তারপর উত্তর ও উত্তর-পূর্ব কোণে যতদূর চোখ যায় শুধু জল আর জঙ্গল। মানুষ সেদিকে যায় না। এতকাল এমন নিয়মই ছিল।

কিন্তু সেই নিয়ম প্রথমে ভাঙে সেই গোমস্তা সাহেব, যে পরে ঠিকাদার হয়েছিল। কিন্তু সাহেব সেখানে বসতি স্থাপন করেনি বা কাউকে বসতি করায়ও নি। সেসবের দরকার তার ছিল না। কিন্তু যাদের নিয়ে এসে সে গাছ কাটিয়েছিল তাদের স্থানাভাব ছিল। সাহেব চলে যাবার পর তারা জামিলাবাদের দুই ক্রোশ উত্তরে আরেকটি গ্রাম পত্তন করে মানুষের ভৌগোলিক দূরত্বকে আরেকটু বিস্তৃত করেছিল।

সাঁওতালদের নতুন পত্তনি সেই গ্রামের নাম এখন নমনকুড়ি। পরে পনেরা-বিশ ঘর ওঁরাও এসে সাঁওতালদের কাছ থেকে স্থান চেয়ে নিয়ে তাদের আলাদা পাড়া তৈরি করেছিল।

পীতেম তার দলবল নিয়ে জামিলবাদ আর্সে আশ্বিনের শেষে। তারা জানত বর্ষায় সে অঞ্চল জলমগ্ন থাকে, কাজেই আগে গিয়ে কোনো লাভ হবে না। পত্তনি করতে হলে খরার সময় করতে হবে। আশ্বিনের লঘু মেঘ দেখে পীতেম বলেছিল, চলো জামিলাবাদ।

চার ঘর বাদ দিয়ে আর সবাই জামিলাবাদী আসল। বদিউলের কাছারিবাড়ি আছে সেখানে। বালি সেখানে ম্যানেজারের চিঠি দেখায়। কাছারির গোমস্তা অবশ্য খবর আগেই পেয়েছিল। বাজিকরদের মাতব্বরদের সে কতকগুলো অনির্দিষ্ট দিক দেখায়। বলে, ঐ যে দেখ গ্রাম, ও হল সাঁওতালদের নতুন পত্তনি নমনকুড়ি। এখান থেকে কাছে মনে হচ্ছে, নয়? কাছেই, তবে ক্রোশদুয়েক হবে। নমনকুড়ির বাঁয়ে ঐ যে ঢিপিগুলো সবে মাথা তুলছে, ওখানেই তোমাদের জমি। মাপ-জোখের দরকার নেই, আগে খালাস তো কর, ভিটা তোল মাটি কেটে, তারপরে ওসব দেখা যাবে।

পীতেম দূরে তাকিয়ে শুধু জল আর জঙ্গল দেখল। আশ্বিন শেষ হতে চলল, এর পরে আর জল নামবে কবে। নিজের ভেতরে হতাশার ফঁাকা শূন্যতা ঢের পায় সে। জামিরের কাঁধের উপর হাত দিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করে পীতেম। সব ক-জন মানুষ তাকিয়ে আছে সামনের দিগন্তবিস্তৃত আদিম ভূমিখণ্ডের দিকে।

পীতেম চেষ্টা করেও ঝাপসা চোখের দৃষ্টি দিয়ে যেখানে মাটি ও খড়ের সারিবদ্ধ বাড়ি ও ফসলের খেতের স্বপ্নলোক তৈরি করতে পারে না। আচ্ছা, পাড়াটা যদি এদিক থেকে শুরু করা যায়, তাহলে ঐ বড় ঢিপিটা কেটে সমতল করতে হবে। তারপর আরো মাটি তুলে পাশের ডোবা নালা ভরাট করতে হবে। এপাশের এই আগাছার জঙ্গলটা কম করে আধমাইল তো হবেই। আগাছার জঙ্গল যখন আছে, ওর নিচে মাটি নিশ্চয় শক্ত। ঐ জঙ্গলটাকে উৎখাত করতে হবে। তাহলে সব মিলিয়ে অন্তত না হোক বিশ পঁচিশ বিঘা জমি ঐ ঢিপিটার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া যাবে। তা যদি হয় কিন্তু এই তিরিশ চল্লিশ বিঘা জমি হাসিল করা কতজন মানুষের কতদিনের কাজ? এ কি সম্ভব!

পীতেম বালির দিকে তাকায়, তাকায় পরতাপের চোখে। যুবকরা কী ভাবছে? যুবকরা কি তাকে অপদার্থ ভাবছে? এই ব্যবস্তা তো কোনো মানুষকেই খুশি করতে পারে না। আর জল! কোন্ যাযাবার জলের কাছে থাকতে চায়?

গোমস্তা লোকটি এদের ভাবভঙ্গি দেখে এবং বোঝে। বলে, ভয়ের কিছু নেই বাজিকর। ভয় একমাত্র সাপকে। তা সাপ এখানে কিছু আছে বটে। তা ধর যত জোঁক আর তত সাপ।

সাপ! বাজিকর ভাতি দেখায় বটে, কবজ, তাবিজ, মাদুলি দেয় বটে, কিন্তু সাপের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক কোনোকালেই নেই।

কেন সাপে ভয় কি? সাপও আছে, মানুষও আছে। সাপও মরে, মানুষও মরে। তা-বাদে সাপ বেশি মরে, মানুষ কম মরে। সবশেষে সাপ মানুষের থেকে তফাত থাকতে চেষ্টা করে, নাকিরে, আছলাম?

গোমস্তার সঙ্গী হেসে সায় দেয়।

গোমস্তা বলে, এই যে জামিলাবাদ, এও তো নয়া আবাদই। ক-বছর যেন হল আছলাম?

ক-বছর আর, এই ভো বছর পনরো হবে। এই তো সেদিনের কথা। মনে নাই তোমার চাচা, গঙ্গার পানি সেবার যেন আছমান ছোঁবে, চরের জমি বেবাক ডুবল? বাপ বললে আর চরে থাকব না।

হাঁ, বছর পনেরো হবে। তা দেখল, বাজিকর, এখন কেমন জমজমা। তবু বলি, আছলাম, চর ছেড়ে বড় ভাই ভালো কাম করেনি। সেই বানের পরে না ভূতনির দিয়াড়া অত বড়টা হল? আমরা ছেড়ে আসলাম, তা-বাদে বিহারের বাদিয়ারা এসে দখল নিল। আমরা যদি খামি দিয়ে থাকতাম, কোন শালার ক্ষমতা ছিল ভূতনির দখল নেয়? আমরা না দিয়াড়ার মোছলমান?

তা যা বলেছ চাচা, চরের জমি আর বরিন্দের জমি, কোনো তুলনা হয়?

গোমস্তা আর তার ভাতিজা তাদের পুরনো কথাতে ঢুকে যায়। তারা গঙ্গার দিয়াড়া অঞ্চলের মুসলমান। চিরকাল সংলগ্ন ভাগলপুর ও কাটিহার, পূর্ণিয়ার বাদিয়া মুসলমানদের সঙ্গে তাদের বিরোধ চরের জমি নিয়ে। লড়াইয়ের কোনো পক্ষই কম যেত না, কিন্তু শেষপর্যন্ত যেন বিহারিরাই জিততে থাকে। এখন শামসি, রতুয়া, মানিকচক, ভোলাহাটের গঙ্গা সংলগ্ন জমি অধিকাংশ বহিরাগতদেরই হাতে। স্থানীয় চাষিদের পিছিয়ে আসার কারণ শুধু বড় বানই নয়, বহিরাগতদের সঙ্গে তারা এঁটে উঠতে পারেনি।

বাজিকরদের কানে এসব কথা ঢোকে না। তারা এখনো সামনের দিকেই তাকিয়ে আছে। তাদের কারো কারো চোখেমুখে আতঙ্ক, কারো বিরক্তি। পীতেমের মুখের ভঙ্গি ভেঙে পড়ার মতো। বালি, পরতাপ, জিল্লুর কপালে দুশ্চিন্তার কুঞ্চন। কেউ কোনো কথা বলে না।

হঠাৎ একসময় বালক জামির চিৎকার করে ওঠে, ঐ যে মানুষ!

তার কণ্ঠস্বরে আগ্রহ এবং আবেগ ছিল। সবাই তাকিয়ে দেখল, আধা ক্রোশ দূরে একটা শাড়ির মুখে একখানা ডিঙ্গি এসে লাগল। দু-জন মানুষ সেই জলজঙ্গলের ভেতর থেকে জামিলাবাদের দিকে আসছে।

বাজিকরেরা খুব উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে থাকে, যেন তারা আশ্চর্যজনক কিছু। দেখছে।

সেই দু-জন মানুষ কখনো জঙ্গলের আড়ালে হারিয়ে যায়, আবার কোনো বাঁকে দেখা যায় তাদের। দু-জন কৃষ্ণকায় মানুষ।

হাঁ, মানুষই তো!

আছলাম বলে, মানুষ নয় তো কি জিন বেরোবে এই সকাল বেলা! দেখ চাচা, কেমন আটাশ যাচ্ছে সব!

আরে, ও তো হাড়মা আর গান্দু। একজন হল সাঁওতালপাড়ার, আর জন হল ওরাওঁপাড়ার সওদা নিতে আসছে।

 

সেই যে জামিরের আগ্রহের চিৎকার ‘ঐ মানুষ!’—এই দুটি কথা যেন পীতেমের অন্তরের আকাঙ্ক্ষার উল্লাস! বালি, পরতাপ আর জিল্লুর কপালের চামড়া অনেকটা সরল হয়েছিল এই শব্দ দুটি শুনে।

গোমস্তা বলেছিল, দু-চার দিন থাক এই কাছারির মাঠে। তারপর নিজেরা দেখ ভাল করে বাঁশ কাঠ পোঁতো, ভিটের পত্তন কর। এমনি করেই হয়।

বালি, পরতাপ, জিল্লু হাড়মা আর গান্দুর সঙ্গে আলাপ করেছিল। তারা যখন ফিরে যায়, তখন যেচে তাদের সঙ্গে অতিথি হয়ে তাদের গ্রামে গিয়েছিল।

দূরের থেকে যতটা ভয়াবহ মনে হয়েছিল, নমনকুড়িতে এসে ততটা খারাপ লাগেনি তাদের। পলি জমি, কাদা তেমন নেই। এটা যেমন একদিকে ভালো, আবার অন্য কোনো একদিকে খারাপও। বাড়ি তৈরি করার আঠালো শক্ত মাটি পাওয়া মুশকিল। তবে সাঁওতালরা সে সমস্যার সমাধান করেছে। পলির মধ্যেও এঁটেল মাটির চাঙড় দু-একটা পাওয়া যায়। সেখানে খুঁড়লে শক্ত মাটি পাওয়া যায়। কষ্টসাধ্য কাজ, কিন্তু এমন কষ্ট তো করতে হবেই রে, ভাই। কেউ কি আর তোমাকে হাতে তুলে খাওয়াবে, শোওয়ার জন্য ঘর-গেরস্থালি গুছিয়ে রাখবে?

হাড়মা বলে, কষ্টে আছি, তবে শান্তিতে আছি। এতদূর ঠেলে কেউ ঝামেলা করতে আসে না।

সব পরিবারই দু-এক বিঘা করে জমি খালাস করে নিয়েছে। তার বেশি জমি খালাস করা এখনো সম্ভব হয়নি। এখন পর্যন্ত এসব জমি অকৃপণ ফসল দেয়। অবশ্য এখানে একটা কিন্তু আছে, যদি’ আছে। জল যদি তেমন বেশি নামে এই নাবাল জমিতে, তবে কিছুই করার নেই। সবই ডোবে। কাজেই ভিটার জমি প্রতিবছরেই, প্রতিবছর কেন, সময় পেলেই উঁচু করতে হয়। ভিটাতে তরকারির আবাদ হয় ভারি চমৎকার। তরকারির আবাদের সময় জল থাকে নামার মুখে, কাজেই সেটা মার যায় না। তাছাড়া গাই আছে প্রতি ঘরে দু-একটা, মুরগি আছে। একপাল করে, আছে শুয়োর। তাতেও কিছু আয় হয়। জামিলাবাদের হাটে দুই ক্রোশ রাস্তা পার হয়ে সাঁওতাল, ওরাওঁরা তরকারি, মুরগি, ডিম, জ্বালানি কাঠ, নানা ধরনের ফলফলারি নিয়ে যায়।

বিপদ? প্রধান বিপদ একই, জল। টাঙ্গন আর পুনর্ভবা দুইই সারাবছর মরা নদী। কিন্তু বর্ষার সময় কত জল, কত জল। অসাগর জল!

আছলাম বলেছিল, তা ধরো কেন, পদ্মায় যদি পানির টান থাকে তবেই বাঁচোয়া। টাঙ্গন এসে পানি ঢালছেন মহানন্দায় আবার তেনার তো নিজেরই তখন বহন ভারি। সেই পানি তিনি নিয়ে ফেলবেন সোজা নীচমুখি হয়ে সেই নবাবগঞ্জ পেরিয়ে পদ্মায়। এখন পদ্মা যদি আগেই ভারভারিক্কি হয়ে থাকেন, তো হল কম। তখন নমনকুড়ির পাথার একাই ভাসে না, জামিলাবাদও ভাসে। ভয় কি? আমরা তো এমনি করেই আছি।

বালি দেখে সবাইই অভয় দেয়। সাঁওতালরা তো সোল্লাসে গ্রহণ করে তাদের। অর্থাৎ সবাইই চায় মানুষ বাড়ুক এখানে। কিন্তু কিছুতেই সে হদিশ করতে পারে

কোথায় খুঁটি গাড়বে সে প্রথম?

এ সমস্যারও সমাধান করে নমনকুড়ির মানুষ। নমনকুড়িতে ঘর বাঁধার মতো প্রশস্ত জায়গা এখন কিছু অবশ্যই বাড়তি হয়েছে। বাজিকরদের সমর্থ পুরুষ ও স্ত্রীলোকেরা সাঁওতালদের কাছ থেকে ধার করে কোদাল আর ঝুড়ি নিয়ে অচিরে মাটি কাটতে শুরু করে। সাঁওতাল, ওরাওঁরা তাদের জোগায় সাহস আর পরামর্শ। নতুন ভিটায় মাটি পড়তে থাকে ঝপাঝপ।

 

২৪.

জামিলাবাদে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই মানুষ ছিল। বস্তুত হিন্দুরাই এখানকার পুরনো বাসিন্দা। মুসলমানরা এখানে পরে এসেছে। তবে হিন্দুদের সংখ্যা এখনো বেশি। এরা পোপ সম্প্রদায়ের লোক। জামিলাবাদ থেকে তিন ক্রোশ পশ্চিমে হিঙ্গল নামক গ্রামে তাদের আদি বাস। নিকট অতীতে এইসব গোপেরা অন্য জায়গার স্বজনদের দেখাদেখি নিজেদের সমাজের মধ্যেই কিছু কিছু বিভেদ উপস্থিত করে। যদিও বেশ কিছুকাল ধরেই তারা পশুপালনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের কৃষির মধ্যেও নিযুক্ত করেছিল, তবুও হিঙ্গলের গোপেদের মূল জীবিকা ছিল পশুপালনই।

আঠারো শতকের শেষদিকে ও উনিশ শতকের গোড়ায় দেশে ঘনঘন খাদ্যসঙ্কটে সরাসরি সরকার কর্তৃক খাদ্যশস্য কেনার ব্যবস্থায় কৃষিজাত পণ্যের দাম দ্রুত বাড়তে শুরু করে। অ-কৃষিজীবী মানুষ এ কারণেও বেশি বেশি করে কৃষিকর্মের দিকে মন দিতে থাকে।

এই হিঙ্গলে এই নিয়ে নতুন সমাজ সদগোপ ও যারা স্থানীয়ভাবে যথেষ্ট ক্ষমতাশালী নয় এমন পশুপালক স্বজনদের মধ্যে তীব্র বিরোধ উপস্থিত হয়। হয়ত এর মধ্যে কিছু স্থানীয় কারণ ছিল এবং সেই কারণই একই গোষ্ঠীর মধ্যে একটা সংঘর্ষমূলক ভাঙন ত্বরান্বিত করে। গোপ ও সদ্‌গোপ, এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে গোপেরাই বা কিসে নিকৃষ্ট, এই প্রশ্ন তুলে হিঙ্গল ছেড়ে জামিলাবাদে এসে তারা নতুন বসত করে। ক্রমে এই বিভক্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সবরকম সামাজিক ক্রিয়াকর্মও বন্ধ হয়।

জামিলাবাদের গোপেরা কৃষিকর্ম করত বটে, কিন্তু তাদের প্রধান উপজীবিকা ছিল পশুপালন। আশপাশের মেলা ও হাটগুলোতে তাদের ঘরের গরু ও মোষের কদর ছিল। জামিলাবাদ ও তার আশপাশে পশুচারণের অফুরন্ত জায়গা থাকতে এইসব গোপেরা পশুপালনই অধিকতর লাভজনক মনে করত।

নমনকুড়ির নতুন পত্তনির বাজিকরেরা জামিলাবাদের ঘোষেদের এই পশুপালন ব্যবস্থাটার প্রতি স্বাভাবিকভাবেই আকৃষ্ট হয়েছিল। কেননা, পশুপালন বিষয়টা তাদের জানা বিষয়ের মধ্যে ছিল। কৃষিকর্ম বাজিকরেরা কোনোদিন করেনি। তাছাড়া কৃষিকর্মের মূল বিষয় ধৈর্য ও অপেক্ষা। সেটা তাদের স্বভাবের মধ্যে ছিল না। চন্দ্র, সূর্য, তিথি ও নক্ষত্র বিচারের জটিলতা আর কৃষিসম্বন্ধীয় অনুশাসন, কৃষিজীবী হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে অবশ্যই অর্জন করতে হবে। বাজিকরের দ্রুত নিষ্পত্তি করা স্বভাবের সঙ্গে এটা সহজে খাপ খেতে চাইল না। প্রথম বছরের সামান্য প্রচেষ্টা দিয়েই পীতেম বুঝল, এ একটি এমন বিদ্যা যা বংশানুক্রমিক শিক্ষা দ্বারা অর্জন করতে হবে। যেনতেনভাবে কৃষিকর্ম করা যায় না এবং যদি কৃষিকর্মেই বাজিকরকে স্থায়ী হতে হয়, তাহলে তার জন্য আরো অনেক মূল্য দিতে হবে।

তাই পীতেম যখন দেখল বালি ইত্যাদি বাজিকরেরা জামিলাবাদের ঘোষদের সঙ্গে বেশি সখ্যতা করছে এবং এদিক ওদিক থেকে গরু-মোষ নিয়ে আসছে, সে আপত্তি করার কোন কারণ দেখেনি। প্রথমত, দনু পৃথিবীর যাবতীয় মাঠে চরা জানোয়ারের মালিকানা বাজিকরদের দান করেছিল। সুতরাং বাজিকরেরা এই দুঃস্থ অবস্থাতেও কোথা থেকে এতসব ভালো ভালো জানোয়ার নিয়ে আসছে, এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তার মনে ওঠেনি। আর, দ্বিতীয়ত, পশুপালন ও কৃষি, এই দুইএর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব বিচারের মাত্রাজ্ঞান তখনো বাজিকরের মধ্যেই আসেনি।

এর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল পরতাপসে সাঁওতালদের সঙ্গে সমান তালে জমি খালাসের কাজ করে যাচ্ছিল এবং খালাসি জমিতে শস্য উৎপাদনের চেষ্টা করছিল। করছিল।

হাড়মা বলেছিল, গত দু-বছরে নমনকুড়ি ছেড়ে বর্ষার সময় অন্যত্র যেতে হয়নি। এ লক্ষণ অত্যন্ত ভালো। এর আগে প্রতিবছরই বর্ষা ঘন হয়ে নামলেই নমনকুড়ির সমস্ত মানুষকে জামিলাবাদে উঠে আসতে হতো। এই দু-বছর প্রকৃতি কিছুটা সহায় আছে এবং সামান্য কিছু হলেও আমন মরশুমে মানুষ চাষ কিছু করতে পারছে।

বাজিকরেরা আসার পরবর্তী দু-বছরেও বন্যা নমনকুড়িকে ডোবাল না, বরং জল যেন ক্রমশই কম জমছে। ফলে সাঁওতাল ওরাওঁরা প্রতিবছরই আরো বেশি করে আমন চাষ করতে শুরু করে।

পরতাপ আদিবাসীদের সমান তালে চাষের কাজে আত্মনিয়োগ করে। তার সঙ্গে থাকে তার ভাইপো জামির। পরতাপের পশুপালন এবং পশুপ্রজননেও সমান উৎসাহ।

পশু বিক্রি করতে গিয়ে পরতাপ একবার রাজশাহিতে চলনবিল অঞ্চলে এক বিচিত্র ধানের চাষ দেখে আসে। নমনকুড়ির বিল অঞ্চল ছাড়িয়ে শুরু হয়েছে রাজশাহি। পরতাপ দেখেছিল জলের মধ্যে ধানের গাছ। চলনবিল অঞ্চলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল নমনকুড়ির মতোই জলা অঞ্চল। সেখানে মোটা দানার একধরনের ধান হয়। বর্ষার জল যেমন বাড়ে ধানের গাছও তেমনই বাড়ে। দেখেছিল অন্য বাজিকরেরাও, কিন্তু পরতাপ ছাড়া কেউ উৎসাহ দেখায়নি। পরতাপের উৎসাহ ছিল, তাই সে খোঁজখবর নেয়।

ধানের নাম বুনো ধান। বিল অঞ্চলে জল যখন কম থাকে বীজ ছিটিয়ে দেয় চাষি। দু-একটা চাষ দিয়ে আউশের মতোই ছড়াতে হয় বীজ। তারপর ধানের চারা জলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে। জলের সঙ্গে এ এক বিচিত্র প্রতিযোগিতা। ধান পাকার সময় জল কিছু কমে বটে, কিন্তু কাটতে হয় নৌকা করে। শিসের নিচে থেকে এক হাত খড় পেল তো যথেষ্ট। ফলন হয় অজস্র।

পরতাপ এসব খোঁজখবর নেয় গভীর অধ্যবসায়সহ। তারপর ফেরার পথে একমণ বীজধান সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। ভিতরে সে খুব উত্তেজনা বোধ করে, নমনকুড়ির সাঁওতালরা জানে না, এমন আবাদ করবে সে এবার। আর আর বাজিকরেরা তার বাড়িতে ধানের পোয়ালের স্তুপ দেখে, নতুন মাটির ভিটায় কলাগাছের ঝোপ দেখে, দেখে, বেগুন আর তেঁড়সের চাষের অফুরন্ত ফলন। এতে প্রত্যেকেই কিছুটা ঈর্ষা বোধ করে। কিন্তু এ জন্য যে প্রাণপাত পরিশ্রম করতে হয় বাজিকরেরা তাতে রাজি নয়। প্রীতম লক্ষ্য করে পরতাপের ভিতরে সেই বিচিত্র নেশার জন্ম হয়েছে, যার কা লক্ষ্মণ সোরেন তাকে বলেছিল। ধানের গাছ যখন গামর হয়, কলার গাছে যখন মোচা আসে, সবজিতে যখন ফুল আসে, পীতেম লক্ষ করে পরতাপের ভাবভঙ্গি অন্যরকম হয়ে যায়, যেন একটা ঘোরের মধ্যে থাকে সে।

তারপর বুনোধানের চাষ করে সমস্ত অঞ্চলে পরতাপ একটা সাড়া তুলে দেয়, জামিলাবাদের ওস্তাদ মুসলমান চাষিরাও বিস্মিত হয় এই চাষ দেখে। তারা দিয়াড়া অঞ্চলের মানুষ, বিল অঞ্চলের চাষ তাদের জানা নেই। কাজেই পরতাপ এখন সবার পথপ্রদর্শক হয়।

পীতেম পরতাপকে দেখে স্বস্তি পায় এখন। স্থায়ী মানুষ হওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে সে এখন যেন আয়ত্তের মধ্যে দেখে। বয়স তাকে এখন প্রায় সম্পূর্ণই অক্ষম করে ফেলেছে। তবু তার ইচ্ছা হয় কাস্তে কিংবা নিড়ানি হাতে নিয়ে পরতাপের মাঠে গিয়ে সে একবার নামে। শীতের সকালে পরতাপ ও জামির যখন মাথায় করে পাকা ফসলের ভার এনে উঠোনে ফেলে, সে দু-হাত দিয়ে তাদের স্পর্শ নেয়, গন্ধ শোঁকে এবং নতুন ধান শিস থেকে ছিঁড়ে নিয়ে দাঁতে কাটে। জামির তাকে ধরে নিয়ে এসে ধানের স্কুপের পাশে বসিয়ে দেয়। সে লাঠি দিয়ে শুয়োর আর মুরগি তাড়ায়। এভাবে সে একাত্ম বোধ করে এই নতুন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে।

জামিলাবাদ-নমনকুড়িতে শীত বড় বেশি পড়ে। পরতাপ আশা করেনি পীতেম এই শীত পার করতে পারবে। কিন্তু পীতেম শীত পার করে। সম্ভবত পাকা ফসলের ঘন সান্নিধ্য তাকে সঞ্জীবনী দান করেছিল। তাকে সেই অনাস্বাদিত অভিজ্ঞতা এনে দিয়েছে। ধান ও তা থেকে রূপান্তরিত চাল, যাকে, বাজিকর ‘সোঁকা’ বলে, এমন বিহুল ভাব সৃষ্টি করতে পারে, তা পীতেম কেন, পরতাপই কি জানত? তাই পীতেম বেঁচে থাকে অন্তত সেই শীত ও বসন্ত, যখন মাঠ থেকে পরতাপ ও জামির ফসল কেটে আনে, যখন পাগড়ি বাঁধা পরতাপকে পুরোপুরি চাষি গেরস্থের মতো দেখায়, জামিরের তরুণ পেশীগুলো সূর্যের আলোয় যৌবনের ইঙ্গিত দেয়, যখন পরতাপের বউ চেঁকিতে পাড় দিতে দিতে আঁচল ঠিক করে।

পীতেম এইভাবে পরতাপের সুস্থ মার্জিত গরম ভাত খায় মাঘ ফাল্গুন চৈত্র বৈশাখ মাস। তারপর একসময় গরম ভাত তার মুখে বিস্বাদ লাগতে শুরু করে, তেতো লাগে। প্রথমে সে ভেবেছিল এসব সাময়িক শারীরিক ক্লেশ, কিন্তু পরে তার ভুল ভাঙে। সে তখন ঘন ঘন দনুকে দেখতে শুরু করে, অথচ দনুর মুখ প্রশান্ত। সে রহুকেও দেখে। তাদের ঘরের উত্তর দিয়ে যেনালাটা গিয়ে টাঙ্গনে মিশেছে, সেখানে জ্যোৎস্নালোকে কিংবা আলোআঁধারি নির্জনতায় সে রহুকে বেড়াতে দেখে। রহুকে তার প্রফুল্ল মনে হয়। দনু তাকে বলে, পীতেম, রহু তোমাকে ডাকেন।

পীতেম বলে, বাপ হে বা, দাঁড়াও, আমি যাই, আমি যাই।

সে বার বার আবেগের আর্তনাদ করে এবং পরতাপ ও জামিরের ঘুম ভাঙায়। তারা উঠে এসে তাকে স্পর্শ করে। ঘামে পীতেমের সারা শরীর ভেজা, তার চোখে পরিচিতির কোনো লক্ষণ নেই। সে পরতাপকে বলে, কে তুই?

পরতাপ তার মুখের কাছে ঝুঁকে বলে, আমি পরতাপ, বাপ। মুখে জল দিই, Tal?

পরতাপ কে? আমি তো তোকে চিনি না।

আমি তোমার বেটা, বাপ।

কি করিস তুই, পরতাপ?

আমি আবাদ করি, ফসল করি, বাপ।

তুই ভিখ মাঙ্গিস না?

না, বাপ।

হাত পেতে গেঁহু আর সোকা নিয়ে ঝোলায় রাখিস না?

না, বাপ।

বাঁশবাজি, দড়িবাজি, বাঁদরনাচ করিস না?

না, বাপ।

আঃ, আমার মুখে জল দে।

পরতাপ জল দেয়, জামির তাকে দু-হাতে ধরে থাকে।

রাত কেটে গেলে পীতেম একটু স্বাভাবিক হয়। সে ঘোলাটে চোখে জামিরের মুখে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, তুই কে?

আমি জামির নানা, তোমার পোতা।

তুই কি করিস?

আমি কাকার সাথে হাল-জিরাতের কাম করি।

তোর বাপ কে?

আমার বাপ ধন্দু বাজিকর।

ধন্দু বাজিকর কে?

ধন্দু বাজিকর তোমার বড় বেটা, নানা।

ধন্দুকে ডাক।

জামির চুপ করে থাকে। শীতেম বিরক্ত ও উত্তেজিত হয়। বলে, ডাক তোর বাপকে।

জামির চুপ করে থাকে। পীতেম আবার প্রসঙ্গ ভুলে যায়। স্বলে, বিগামাই, হারুরানে যাই।

পীতেম দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবং তার গলার মধ্যে শ্লেষ্মর ঘনঘন শব্দ ওঠে। তারপর সেটা বাড়তে থাকে।

জামিরের তখন নিজের গলার মধ্যেই যেন অস্বস্তি শুরু হয়। বিগামাই, হারুরানে যাই’-পীতেম বাজিকরের এই অন্তিম ইচ্ছা বা ভীতি কোন্ অজ্ঞাত দেবীর কাছে অর্ঘ্য, জামির তা পরিষ্কার বোঝে না। সে তার নানার গলার ভিতরের অস্বস্তিকর শব্দটার নিবৃত্তির জন্য নিজের অজান্তেই নিজে গলাখাঁকারি দেয়।

কিন্তু পীতমের গলার ভেতরের শব্দ ক্রমান্বয়ে একঘেয়ে গোঙানিতে পরিণত হয় ও তার বুক হাফরের মতো ওঠানামা করতে থাকে।

জামির দ্রুত উঠে বাইরে গিয়ে পরতাপ ও অন্যান্যদের ডাকে। সব ঘরের বাজিকরেরা আসে। সবাই বোঝে পীতেম ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে, তার বাশক্তি রহিত হয়েছে।

সবাই পীতেমের শয্যা ঘিরে দাঁড়ায়। যদিও কথা বলতে পারছে না, তবুও পীতেমের চোখের দৃষ্টি স্বচ্ছ এখন। সে চোখের মণি ঘুরিয়ে শেষবারের মতো তার স্বজনদের দেখে। তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।

বালি তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ও কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, সালমা পিসিকে খবর দেব, কাকা?

পীতেম তার দিকে চোখের মণি ঘোরায়, তার দৃষ্টি অত্যন্ত করুণ এবং সেই চোখ দেখে বালি কিংবা অন্যান্যরা তার ইচ্ছা বুঝতে পারে না।

পীতেম এই অবস্থায় দু-দিন থাকে, এবং তৃতীয় দিন ভোর রাত্রে সকলের অজান্তে শেষ নিঃশ্বাস ফেলে।

সালমাকে খবর দেওয়ার জন্য বালি কিংবা পরতাপ কাউকে পাঠায়নি। কেননা এই দূরের রাস্তায় সালমার যদি আসার মতো অবস্থাও থাকে তবুও পীতোমের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার আশা ছিল না।

 

২৫.

লুবিনির স্মৃতিতে সালমা ধূসর, কেননা তার জন্ম হয়েছিল মালদা শহরে এবং সেখানে যখন তার বছর পাঁচেক বয়স তখন দল চলে আসে নমনকুড়িতে। নমনকুড়িতে পীতেম বেঁচেছিল সাত বছর। এই সাত বছরের শেষ দু-বছর লুবিনির প্রতিপালনের দায়িত্ব পীতেম নিয়েছিল। সতেরো বছরের নবযুবক জামিরের দশ বছরের কনে লুবিনি। সুতরাং ভরণপোষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ পীতেমকেই করতে হতো।

জামির ও লুবিনি এইসময় পরস্পরের কাছাকাছি থাকত একটা সময়ই, যখন পীতেম বাজিকরদের পুরনো কথা ও দেশদেশান্তরের অভিজ্ঞতার গল্প বলত। এইসব গল্প ও কাহিনীতে জামিরের তো উৎসাহ ছিলই, লুবিনিও একাগ্রতার সঙ্গে এসব বুঝবার চেষ্টা করত। এইসময় ছাড়া জামিরের সঙ্গে লুবিনির একাগ্রতার সঙ্গে এসব বুঝবার চেষ্টা করত। এইসময় ছাড়া জামিরের সঙ্গে লুবিনির বিশেষ দেখাসাক্ষাৎ হতো না। জামিরের মনোভাব বোধ্য। লুবিনি জামিরকে বিশেষ দৃষ্টিতে দেখতে ও বুঝতে শুরু করে এর অনেক পরে।

পনেরো জোড়া ছেলেমেয়ের সঙ্গে জামির আর লুবিনিরও বিয়ে হয়েছিল। সে সময় হরদম গুজব রটত, আর অধিকাংশ গুজবের বিষয়বস্তুতে সাহেবদের জড়ানো হতো। সাহেব যুক্ত গ্বোর্কলে গুজব হতো জোরদার ও বিশ্বাসযোগ্য।

মহারানির রাজত্বে ষোল বছরের ঊর্ধ্বের ছেলেমেয়েদের আর বিয়ে দেওয়া যাবে না, এরকম গুজব রটেছিল। সাহেবরা কলের গাড়ি লোহার রেলের উপর দিয়ে চালায়, সুতরাং সবই সম্ভব। সাহেবরা সব জমি দখল করে নেবে নীল, উঁত আর আফিং চাষ করবার জন্য—একসময় এরকম কথা অনেকেই বিশ্বাস করেনি, কিন্তু তারপর বহু জায়গায় জবরদস্তি এসব চাষ করার ব্যবস্থা সাহেবরা করেছিল, এ সবাই দেখেছে।

সুতরাং একদিকে তাড়াহুড়ো করে ষোল জোড়া বাজিকর বালক-বালিকার বিয়ে দেয় পীতে। লাল সুতোয় ঘেরা চৌহদ্দির মধ্যে সম্পূর্ণ বাজিকর রীতিতে বিয়ে। মেয়েরা গান গেয়েছিল ‘লাল পাড়াঙ্গি রেশকি ডোরি’, ‘দেও আওয়েতে দেওরে, ভাই’–এইসব প্রাচীন গান।

পীতেম মারা যাবার পর লুবিনি খুব নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। পরতাপের বউ হায়া যদিও তাকে কাছে টেনে নেয়, তবুও তার মনমরা ভাব কাটে না। বাপের ঘরে তার কেউ ছিল না। বাপ-মা আগেই মারা গেছে। থাকার মধ্যে আছে এক নানা, এখন তাকে দেখারই লোক দরকার। সুতরাং হায়া লুবিনির অবলম্বন হিসাবে পীতেম ছিল বলেই সে এদিকে মনোযোগ না দিয়েও পেরেছে। এখন তো অন্য কোনো উপায় নেই। তাছাড়া আরো একটা কারণে সে লুবিনিকে আগলে রাখার ব্যবস্থা করে। যে কাজটা ছিল পীতেমের, এখন হায়াকেই তা করতে হয়। লুবিনি সবেমাত্র বারোয় পা দিয়েছে, কিন্তু জামিরের চঞ্চল চাউনি এখন তাকে অনুসরণ করে। ব্যাপারটায় হায়া ভীত হয়, কারণ জামিরের দৈহিক আকৃতি যে-কোনো রমণীর উদ্বেগের কারণ। এটা হায়া সভয়ে খেয়াল রাখে। অন্তত আরো বছর তিনেক না গেলে লুবিনিকে জামিরের কাছে পাঠানো আদৌ নিরাপদ নয়। জামির পীতেমের মতো শরীর পেয়েছে, দীর্ঘ সবল গাছের মতো চেহারা তার, লম্বা হাত-পা।

এদিকে সে ছিল সহনশীল মানুষ। যে বুঝতে চাইত সবকিছু ও অপেক্ষা করত। কিন্তু এই উনিশ বছর বয়সে জামির কিছু চঞ্চল হয়েছিল, কেননা যৌবন এসেছিল প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে। পীতেম তাকেও কিছুটা নিঃসঙ্গ করে গিয়েছে। হায়া যে তাকে লক্ষ্য রাখে এবং লুবিনিকে সামলায় এ ব্যাপারটা বুঝে সে লজ্জা পায়। সে চেষ্টা করে আড়ালে থাকতে। সে চেষ্টা করে কাজকর্ম নিয়ে থাকতে। পীতেম তার ভিতরে গৃহস্থ হবার বাসনা অঙ্কুরিত করেছিল, পরতাপ প্রত্যক্ষে তাকে কার্যকর করার রাস্তা দেখাচ্ছিল। আর জামির আরো একধাপ এগিয়ে হিঙ্গলের পতাকি ঘোষের মতো গৃহস্থ হওয়ার স্বপ্ন দেখত।

গৃহস্থ বটে পাকি ঘোষ। এই না হলে গৃহস্থ! চারখানা মোষের ও চারখানা বলদের হাল পতাকির। যেমন মোষের চেহারা, তেমনি বলদের চেহারা। ধানের মরাই দশটা। তার পাঁচটা গাই-মোষ এবং ছ-সাত জোড়া গাই দুধ দিত অঢেল। ভীষণ বলশালী পতাকির যেমন দাপট তেমনি উদারতা। নিজে খাটত অসুরের মতো, চাকর-পাটকেও বসে থাকতে দিত না। আশ্চর্য মানুষ পতাকি তার চাকর-পাট মুনিষ-মাহিন্দরের সঙ্গে প্রায় একত্রই থাকত এবং কারো মনোকষ্টের কারণ হতো না। পতাকিই প্রথম ব্যক্তি যে বলেছিল, ‘আমি সদ্‌গোপ কিসের জন্য হতে যাব, আমার অভাবটাই বা কি আর আমি কমই বা কিসে?’ আবার পতাকিই সেই ব্যক্তি যে গোপও থেকে গেল কিন্তু হিঙ্গল ছাড়ল না।

জামিলাবাদের গোপেদের সঙ্গে হিন্সলের সদ্‌গোপদের বিরোধ এখন একটা বিশেষ পর্যায়ে গিয়েছিল। কে কার ঘরে মেয়ে-বউকে ফুসলে বের করে আনতে পারে এখন তারই প্রতিযোগিতা চলছে। ফলে এই একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে মাঝে মধ্যে অশান্তি ও দাঙ্গা জমে উঠত। এ বিষয়েও পতাকির বৈশিষ্ট্য ছিল। সে বলত, কারো ঘরের মেয়ে-বউকে টেনে আনব না, যদি কেউ আসে ছেড়েও দেব না।

এই পতাকির সঙ্গে জামিরের আলাপ হয়েছিল হঠাই। পতাকির একটা মোষ পড়ে গিয়েছিল ছোট একটা নালার মধ্যে। চার-পাঁচজন মানুষ নিয়ে পতাকি দু ঘণ্টা চেষ্টা করেও মোষটাকে তুলতে পারেনি। জামির সেই রাস্তা দিয়ে তখন ফিরছিল। কিছু সময় দাঁড়িয়ে দেখে সেও হাত লাগিয়েছিল।

কিন্তু হাত লাগালে হবে কি? বাঁশ বুকের নিচে ঠেসে চাপ দিতে পতাকি আর্তনাদ করে ওঠে, যেন তার বুকেই বাঁশডলা হচ্ছে।

জামির বুঝেছিল এভাবে হবে না। সে পতাকিকে বলেছিল, ঘোমশায়, মোষ পড়েছে খন্দে, কাজটা হলো এখন ওঠানো। না যদি ওঠাতে পারেন তাড়াতাড়ি, খাম হয়ে যাবে জানোয়ারটা, কোনো কাজে আর লাগবে না। হায় হায় করলে চলবে?

পতাকি বলে, তুমি কি বুঝবে বাজিকরের পো, ঘর-গেরস্থালি কর না। কলজায় লাগে যে!

কিন্তু ওঠাতে তো হবে?

হাঁ, তাতো ঠিক। কিন্তু—

বাস, আর কথা না। যান তো আপনি ঐ গাছতলায় পুবমুখা হয়ে দাঁড়ান, এদিকে দেখবেন না।

অনিচ্ছুক পতাকিকে হাত ধরে গাছতলায় দাঁড় করিয়ে দেয় জামির। অন্য লোকদের বলো, আসো ভাই, হাত লাগাও ঠিকমতো। বুকের নিচে আমি ধরব ঠেলে, তোমরা তিনজনে পেটের নিচে বাঁশের চাপ রাখো আর তোমরা কোমরের জড়ানো দড়ি ধরে টেনে পগারের উপরে ওঠাবে। দেখো, সবার দম যেন একসঙ্গে ধরে।

তারপরে সে নুতন শেখা বোল ধরে—হিঃ-মারো-জোয়ান—

হহঃ–

হিঃ—আউর—থোরানি—

হহঃ–

হিঃ-পর্বত টলে—

হহঃ–

হিঃ-ব্বাপ ভাতারি—

প্রচণ্ড আওয়াজে অন্যেরা “হহঃ” বলে এবং মোষটি আর-র-র শব্দে মরণ আর্তনাদ করে ওঠে। পতাকি আর পুবমুখখা তাকিয়ে থাকতে পারে না। হাউ-মাউ করে ছুটে আসে, মেরে ফেললে রে মেরে ফেললে রে—

কিন্তু জামিরের বোল তখন সপ্তমে ঘোষের গুষ্টি উদ্ধার করছে। ঘাড়ের উপরে বাঁশ ঠেলে নালার এক কোণে সে থামের মতো কোণাকুণি দাঁড়িয়েছে। হাত পা পিঠ বুকের পেশী ক্রুদ্ধ বাঘের মতো ফুলে উঠেছে। পতাকি হতবাক হয়ে যায়, হা জোয়ান বটে ছোকরা। অন্যেরা যদি সামান্য ঢিল দেয়, মুহূর্তে ঐ ঠেসে ধরা বাঁশ পিছলে গিয়ে পাঁজরের হাড় গুঁড়ো করে দিতে পারে।

পতাকি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। উঠেছে, উঠেছে। কোমরের বাঁধন ধরে যারা উপর দিকে টানছিল তারা এবার খামি দিয়ে দাঁড়ায়। জামির যেমন ছিল তেমন দাঁড়িয়ে থাকে, শুধু নিচের দিকে যারা বাঁশ দিয়ে ঠেলছিল তারা দ্রুত উঠে এসে সামনের দু পায়ের নিচে মোষের ঘাড় ঘুরিয়ে দড়ি জড়ায়। ঘাড়ের থেকে বাঁশ সন্তর্পণে হাতে নিয়ে জামির চাড় দেয়, দড়ির টানে মোষ নালার উপরে উঠে আসে।

পতাকি বলে, সাবাস জোয়ান, বাহাদুর বটে তুমি বাজিকরের পুত!

এইভাবে পতাকির সঙ্গে আলাপ হয় জামিরের। সেদিন পতাকি তাকে তার বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। দই কলা চিড়া দিয়ে যে ফলার খাইয়েছিল তাতে পরদিন পর্যন্ত জামিরের আর খাওয়ার কথা মনে হয়নি। জামির চারদিক তাকিয়ে দেখছিল গৃহস্থরা কাকে লক্ষ্মী বলে।

দ্বিতীয়বার পতাকির বাড়ি গিয়েছিল সে গুইিকে পাল খাওয়াতে। পতাকির ষাঁড়টিও তার গর্বের বস্তু ছিল। এই ষাঁড় নিয়েও সমোপদের সঙ্গে তার একটি রসিকতার সম্পর্ক ছিল। সদৃগোপদের কাছ থেকে ষাঁড় দেখাবার জন্য সে পয়সা নিত না।

না ভাই, উঁচা জাতের কাছ থেকে পয়সা নিতে পারব না।

কেন? বিনিপয়সায় আমরাই বা গাইকে পাল খাওয়াব কেন?

না খাওয়াও না খাওয়াবে, তবে আমরা আমাদের ষাঁড়গুলোকে মানাই দিয়ে রেখেছি তোমাদের জন্য।

এতে সদ্‌গোপেরা অপমানিত বোধ করত এবং প্রত্যেকেই প্রতিজ্ঞা করত এবারে যে করেই হোক সদ্‌গোপ পাড়ায় ভালো ষাঁড়ের বন্দোবস্ত করতেই হবে। কিন্তু কার্যকালে তাদের আসতেই হতো পতাকির বাড়ি এবং অপমানও হজম করতে হতো।

জামিরও দ্বিতীয়বার পতাকির বাড়ি ঢেকে গাই নিয়ে। গভীর রাতে গাইটা ডাকতে শুরু করেছিল। গাইয়ের ডাকে তার ঘুম ভেঙে যায় এবং ডাক শুনে তার প্রথমে খুব আনন্দ হয়। শুয়ে শুয়ে সে ডাক শোনে, কী গভীর আকাঙ্ক্ষার ডাক—আঁ–আঁ–আঁ!

কিছুক্ষণ জাগ্রত অবস্থায় গাইয়ের ডাক শুনতে শুনতে তার হঠাৎ অস্বস্তি বোধ হতে শুরু করে। দ্বাদশী লুবিনি এখনো তার ভেতরে কোনো মানসিক আন্দোলন তৈরি করতে পারেনি।

শুয়ে শুয়ে পাশের ঘরে পরতাপকে হায়ার সঙ্গে কথা বলতে শোনে সে। গাই ডাকতে তারা দুজনেই উৎফুল্ল। গাইটার এই প্রথমবারের ডাক, সুতরাং পরতাপ ও হায়া অনর্গল কথা বলতে থাকে। তারপর হঠাৎ তাদের কথা বলা বন্ধ হয়।

জামির আরো বিমর্ষ এবং বিরক্ত হয়ে যায়। চেষ্টা করেও সে আর ঘুমোতে পারে না। বাকি রাতটুকু এপাশ-ওপাশ করে অন্ধকার থাকতেই সে উঠে পড়ে।

পরতাপ ওঠার আগেই সে হিঙ্গল যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয় গাই নিয়ে! গরুটাকে পোয়াল-জল খাওয়াবার বৃথা চেষ্টা করে সে হাল ছেড়ে দেয়। নতুন ডাকা গাই ছটফট করছে, চমকে চমকে উঠছে, চাড়িতে মুখও দিল না। জামির পরতাপের ঘরের সামনে গিয়ে একবার জানান দিয়ে গরুর দড়ি হাতে নিল।

শেষরাতে পরতাপ ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাড়াতাড়ি উঠে বলল, হ্যাঁ বাপ, তাড়াতাড়ি যা, নতুন ডাকা গাই, ডাক বন্ধ করলে আবার কবে ডাকে। দেরি করে লাভ নেই, যা বাপ।

 

জামির এক হাতে একটা বাঁশের লাঠি ও অন্য হাতে গরুর দড়ি ধরে বেরিয়ে পড়ে। লাঠি নেয় এই কারণে যে পথে উটকো ষাঁড় ঝামেলা করতে পারে। আড়াআড়ি গেলে হিঙ্গল জামিলাধারে থেকে কাছে হয়। তবুও মাঠ ভেঙে দুই ক্রোশ রাস্তা কম নয়। তার উপরে হাতের দড়িয়ে বাঁধা ডাকা গাই। জামিরের মতো জোয়ানও গাইয়ের সঙ্গে হাঁটতে গিয়ে হাঁফিয়ে যাচ্ছে। গাই তো হাঁটছে না, যেন ধেয়ে চলেছে, সঙ্গে জামিরকেও টেনে নিয়ে যাচ্ছে। জামির বলে, র’, র’ সবুর কর।

সে হাসে আপনমনে। তার শরীরে উত্তেজনা ও পুলক জমে। গাইটার অসহায় অবস্থা সে মনে মনে উপভোগ করে। হায়রে, জানোয়ার, ডাকলে সাড়া পায়। আবার দেখ, তার মালিকও সমান উতলা হয়। আঃ, হাহা, বায়, বায়, পথ কেন ভুল করিস?

না, জানোয়রের পথ ভুল হয় না। বাতাস তার কাছে বার্তা নিয়ে আসে। কে যে তাকে পথ দেখায়, কে জানে। গাই ঠিক পথেই চলে। যেন গাইটাই জামিরকে সহজ ও সংক্ষিপ্ত পথটা চিনিয়ে দেয়। জামির তার পিছনে পিছনে ছোটে। মাঝে মাঝে জানান দেয় গাইটা—আঁআঁআঁ। আবার কোনো দ্বিধা-বিভক্ত মোড়ে মুহূর্তখানেক থমকে থামে, আবার নিমেষে ঠিক রাস্তায় চলতে শুরু করে। জামির মজা দেখে। দেখ, জানোয়ার কেমন! কেমন চতুর এই গাই!

হিঙ্গলের ভিতরে ঢুকে গাই আর কোনো বাধা মানতে চায় না। জামির বলে, দাঁড়া রে দাঁড়া, মালিকের অনুমতি নিই আগে। এমন অধীর হলে চলে!

পতাকি ঘোষের সীমানায় ঢুকে সে আচমকা একটা গাছকে ঘুরে এসে দড়ি বেড় দিয়ে গাইকে আটকে ফেলে। হঠাৎ বাধা পাওয়াতে গাই ক্ষিপ্ত হয়ে যায় যেন। জামিরকেই শত্রু মনে করে অথবা বিরক্ত হয়ে শিং নাড়ে সক্রোধে। জামির তার শিং ধরে গলায়, পিঠে হাত বুলায়। বলে, ছিঃ! এমন অধীর হয়? মালিকের মত নিতে হবে না? গাই ঘাড় দিয়ে তাকে ঠেলে, যেন তাকে ব্যস্ততা দেখাতে বলে, আবদারের মতো, ভারি সলজ্জ তার ভঙ্গি এখন।

জামির হেসে ফেলে শব্দ করে ও তার সঙ্গে কেউ হাসে পিছন থেকে। সে দড়ি বেঁধে পিছনে তাকায়।

পিছনে তাকিয়ে জামির যাকে দেখে সে নিশ্চিত রাধা, একথা জামির নিমেষেই যেন বুঝে ফেলে। এই রাধার কথা সে কেন, এ অঞ্চলের সব যুবকই শুনেছে। পতাকির বৈমাত্রেয় বোন রাধাকে নিয়ে গোয়ালা ঘোষ ও সদ্‌গোপ ঘোষদের মধ্যে ইতিমধ্যেই গোটাচারেক দাঙ্গা এবং একটা খুন হয়েছে।

হ্যাঁ, সে রাধাই বটে। বয়সে জামিরের থেকে বছর তিন-চারের বড়ই হবে। সে যুবতী হাসছিল, এখন জামিরকে ঘুরে দাঁড়াতে দেখে সে জিভ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে।

জামির তার দিক থেকে চোখ সরায় না, সরাতে পারে না সে।

রাধা বলে, সবুর কি আর সই সইতে পারে, বাজিকর?

জামির এই নির্লজ্জতায়ও চমকে ওঠে না, তাকিয়েই থাকে। রাধাকে দেখার মতোই বটে।

রাধা আবার বলে, তুমি তো বাহাদুর বাজিকর বটে, নাকি ভুল বললাম? সেদিন এক ঝলক দেখেছিলাম তো কেমন এক পালি দই চিড়া সাপটে দিলে?

জামির এবার মাথা নাড়ে। হ্যাঁ, এ সেই বাজিকর।

রাধা দাঙ্গার উপযুক্তই বটে। এমন নির্লজ্জ এবং রসিকা এ অঞ্চলে আর একটিও নেই। পতাকি তাকে সময়মতো বিয়েও দিয়েছিল, কিন্তু বদ্ধ জীবনে রাধা থাকতে পারল না। স্বামীকে ছেড়ে বছর না ঘুরতেই পালিয়ে এসেছে। আর তারপরে যায়নি।

গাইটা শিঙ দিয়ে ধাক্কা দিতে জামিরের চমক ভাঙে। রাধা আবার হেসে ওঠে। জামির তার দিক থেকে চোখ নামায়। জিজ্ঞেস করে, ঘোষ উঠেছে?

ওঠেনি! কখন মাঠে চলে গেছে।

তবে তো মুশকিল হল! কার সঙ্গে কথা বলি?

কথা বলার অবস্থা তো তোমার গাইয়ের নেই। পিছনের বাগানে নিয়ে যাও, আমি খামারু কাকাকে বলছি ষাঁড় ছেড়ে দিতে। দাদা এসে যাবে।

রাধা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হাসে ও ভিতরের দিকে যায়। কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে তাকিয়ে নিঃসন্দেহ হয় যে জামির তাকে দেখছে, আবার হাসে।

জামির খুব ধৈর্যশীল মানুষ হলেও মেয়েটার মোহিনী মায়া এড়াতে পারে না। গাছ থেকে দড়ি খুলতে গিয়ে টের পায় তার হাত কাঁপছে। দড়ি খুলে গাই নিয়ে সে পিছনের বাগানে চলে যায়।

নির্দিষ্ট খুঁটোয় গাই বেঁধে জামির কিছুদূরে একটা ঝাকড়া তেঁতুল গাছের ছায়ায় বসে থাকে। এখন বেশ কিছু সময় এভাবে তাকে থাকতে হবে, ব্যাপারটা দেখতে হবে এবং নিঃসন্দেহ হতে হবে যে কাজ হয়েছে।

ছাড়া পেয়ে ষাঁড় ঠিক জায়গাতেই এসে হাজির হয়। জামির এখন নিশ্চিন্ত। সে গামছা দিয়ে ঘাড় গলা মোছে! এখন চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই।

অনেকক্ষণ বসে থাকে জামির। নতুন গাই, ত্রাস আছে মনে। জামির বিরক্ত বোধ করতে শুরু করে। হঠাৎ একটা ঢিলের টুকরো এসে পায়ের কাছে পড়ে, তারপর আরেকটা।

জামির দিকনির্ণয় করে ঘন ঝোপের আড়ালে রাধাকে দেখল। রাধা একটা গাছে হেলান দিয়ে অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিল। তার দাঁড়াবার ভঙ্গিটি খুবই মনোরম। একটা পা ভাজ করে পিছনের গাছে ঠেকা দেওয়া, অন্য পা মাটিতে, সমস্ত দেহকাণ্ড তির্যকভাবে গাছে হেলান দেওয়া।

জামির প্রথমে ভয় পেল, তারপর নিজের মনেই হাসল, কিন্তু উঠল না জায়গা ছেড়ে। রাধা এবার পাশ ফিরে তাকাল তার দিকে। তার দৃষ্টিতে আহ্বান ছিল স্পষ্ট।

জামির কি করবে বুঝতে পারছিল না। শুধু সম্মোহিতের মতো রাধাকে দেখছিল। রাখা কখনো আঙুলে আঁচল জড়াচ্ছিল, কখনো দাঁতে পাতা কাটছিল।

এইসময় জামির সামনের দিকে দূরে পতাকিকে মাঠ থেকে ফিরতে দেখল। একটা দীর্ঘ স্বস্তির প্রশ্বাস তার বুক হালকা করে দেয়। বোঝে ভীষণ ভয় পেয়েছিল 69

উঠে এসে জামির পতাকির জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করে। সে আর পিছন ফিরে তাকায় না। ওঃ কি ভীষণ মেয়েমানুষ! অথচ কী সুন্দর!

1 Comment
Collapse Comments

EKTA BOI ER MODDHE NEI EI GOLPOTA???

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *