০৪. কালাচাঁদকে লইয়া সকলে

কালাচাঁদকে লইয়া সকলে চণ্ডী বাবুর বাড়ীতে উপস্থিত হইলেন। সেখানে বৈঠক বসিল; পাড়ার মাতব্বরেরা সকলেই ছিলেন যুবকেরাও উপস্থিত। তখন কথা উঠিল, কর্ত্তব্য কি? কালাচাঁদ যে পাপ কার্য্য করিয়াছে, তাহার আর প্রায়শ্চিত্ত নাই।

বৃদ্ধ চক্রবর্ত্তী মহাশয় বলিলেন “যা হবার তা হয়ে গিয়েছে; এখন আর সে কথা নিয়ে আন্দোলন করে কি লাভ হবে। অধিক লোক-জানাজানি করে সুধু কলঙ্ক বাড়ানো। এখন চেপে যাওয়াই কর্ত্তব্য। এতবড় সম্মানী ঘর, মুখুয্যেদের দেশজোড়া নাম; লোকজানাজানি করে সেই বংশের কলঙ্ক প্রচার করা কিছুতেই উচিত হবে না! তাতে তোমাদেরই একঘরে হতে হবে। ওই গোরাচাঁদের মেয়েটী রয়েছে; তার বিবাহই হবে না। এমন কলঙ্কের কথা রাষ্ট্র হলে কি তোমাদের ঘরের মেয়ে নিতে কেউ সম্মত হবে? এখন চেপে যেতেই হবে। এই হতভাগাটা দশ ব্রাহ্মণের পা ছুঁয়ে দিব্বি করুক যে, এমন কর্ম্ম আর করবে না—”

কে একজন বলিয়া উঠিল “আর একশ হাত মেপে নাকে খত দিতে হবে।”

একটী যুবক বলিলেন “কালাচাঁদ মুখুয্যের সঙ্গে কেউ কোন সম্পর্ক রাখতে পারবে না—ওকে এক-ঘরে করতে হবে, আর ওর দুটাে কাণ কেটে দিতে হবে; অমনি ছাড়া হবে না।”

আর একটা যুবক বলিলেন “ও কথাই নয়! ওকে আদালতে আসামী করে দিতে হবে। পাঁচ বছর জেল খাটাতে হবে। অমন লোককে সহজে ছেড়ে দেওয়া কিছুতেই হবে না।”

চণ্ডী বাবু বলিলেন “আদালতে গেলে যে কলঙ্কে দেশ ছেয়ে যাবে। ওর না হয় পাঁচ বছর মেয়াদ হবে। কিন্তু তার পর? আমরা দশের কাছে মুখ দেখাব কেমন করে? না, ন, ও সব হবে না। চক্রবর্ত্তী দাদা যা বললেন, তাই কর্ত্তব্য! চেপে যাওয়াই একমাত্র উপায়—আর পথ নেই!”

হরিশ গাঙ্গুলী এক পাশে বসিয়া তামাক খাইতেছিলেন; তিনি পাড়ার মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ। তিনি বলিলেন, “বলি, এমন কি হয়েছে যে, তোমরা একেবারে নবরত্নের সভা বসিয়ে ফেল্‌লে। সবই এখন থিয়েটারী কাও দেখ্‌ছি। কেন রে বাবু, ব্যাপার কি? এ যেন আর বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে কোথাও হয় না,—এই আমাদের গাঁয়েও যেন এমনটা কোন দিন হয় নাই। ছেলে মানুষ, বেটা ছেলে, করেছে না হয় একটা কাজ; তা নিয়ে এত চেঁচামেচি, এত গোলমাল কেন রে বাপু! বাবা রে, মা রে, গেলাম রে! এখন বসাও বৈঠক, কর বিচার। অমন কত যে হয়ে যাচ্ছে; অমনই বা বলি কেন,—ওর থেকেও গুরুতর কত কি হচ্ছে, তা দেখতে পাচ্ছ না, কাণে শুন্‌তে পাচ্ছ না। যত সব ছেলেমানুষী আর কি! এই আশি বৎসর বয়স হলো; আমার অজানা ত কিছুই নেই। কৈ এতদিন ত অমন করে ঢাক ঢোল বাজাও নেই। ঐ যে ও-বাড়ীর—”

চণ্ডী বাবু বাধা দিয়া বলিলেন “ঠাকুরদা, আর পরের কথা তুলে কি হবে? গোপনে ত অনেক চলে যাচ্ছে; তা আপনিও দেখছেন, আমরাও দেখছি। কি করব, দেখেও দেখিনে, শুনেও শুনিনে। কিন্তু সে সবই গোপনে চলছে। এটা যে বড়ই বেজে উঠল, তার কি উপায় ?”

কেনারাম ভট্টাচার্য্য গ্রামের অনেকেরই পুরোহিত। তিনি এক টিপ নস্য গ্রহণ করিয়া গম্ভীরভাবে বলিলেন “এ সম্বন্ধে শাস্ত্রের বিধানই বলবৎ গণ্য করতে হবে। এ প্রকার কুকার্য্য যে অনুষ্ঠিত হয় না, এমন কথা উচ্চারণ করা সমীচীন হবে না। এ প্রকার ব্যাপার সংঘটিত হয়, কিন্তু অতি গোপনে। যে গৃহে এই শ্রেণীর পাপাচার হয়, সেই গৃহস্থই তাহা গোপন করিয়া ফেলেন; পল্লীর দুদশজনের তাহা শ্রতিগোচর হইলেও তাহা জনশ্রুতি মাত্র; সুতরাং তাহা শাস্ত্রের অধিগম্য নহে। কিন্তু বর্ত্তমান ক্ষেত্রে তাহার ব্যত্যয় হইয়াছে। এই কুকার্য্যের সংবাদ কেবল গৃহস্থের গৃহের সীমার মধ্যেই আবদ্ধ রহিল না, গৃহান্তরেও গেল;– গৃহান্তরই বা বলি কেন, গ্রামান্তরের অনেক ভদ্রলোকও এই ব্যাপারের প্রত্যক্ষদর্শী হইলেন। সুতরাং গোপনে অনুষ্ঠিত কুকার্য্য বলিয়া ইহা গণ্যই হইতে পারে না। ইহা প্রকাশ্য ব্যভিচার। মাতৃসমা বিধবা ভ্রাতৃবধুর উপর তাঁহার অসন্মতিতে অত্যাচার। শাস্ত্রানুসারে ইহার দণ্ড, কর্ত্তব্য। এ বিষয় লইয়া রাজদ্বারে উপস্থিত হইবার প্রয়োজনাভাব; আমাদের শাস্ত্রের অনুশাসনই প্রযুক্ত। শাস্ত্রের বিধান এই যে, কালাচাঁদ বাবাজিকে শাস্ত্রানুসারে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে, নতুবা তাহাকে পতিত হইতে হইবে। সে প্রায়শ্চিত্ত করিয়া সমাজে গৃহীত হউক; তাহার দ্বিচারিণী ভ্রাতৃবধূকে গৃহত্যাগ করিয়া যথা-ইচ্ছা গমন করিতে হইবে; আমাদের সমাজে তাহার স্থান হইবে না; —যে বিধবার সতীত্ব নষ্ট হইয়াছে তাহার স্থান আমাদের পবিত্র হিন্দুসমাজে নাই। শাস্ত্রের এই সর্ব্বজনবিদিত ব্যবস্থা অনুসারে কার্য্য করা ব্যতীত গত্যন্তর দৃষ্ট হইতেছে না। এ কার্য্য গোপন করিলে চলিবে না; অন্ততঃ কেনারাম ভট্টাচার্য্য জীবিতমানে এমন কার্য্য হইতে পারিবে না।”

রমামুন্দরী একটু পূর্বেই কালাচাঁদের বাড়ী হইতে ফিরিয়া আসিয়াছিলেন।তিনি এই গ্রামেরই মেয়ে; তাহার পর তাঁহার বয়সও পঞ্চাশ পার হইয়া গিয়াছে; সুতরাং চণ্ডী বাবুর বৈঠকখানায় যাঁহারা আলোচনা করিতেছিলেন, তাঁহাদের সন্মুখে উপস্থিত হইবার তাঁহার বাধা বা লজ্জার কারণ ছিল না। তিনি চুপ করিয়া কেনারাম ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের সাধুভাষায় বিবৃত শাস্ত্রের বিধান শ্রবণ করিতেছিলেন। ভট্টাচার্য্য যখন তাঁহার বক্তব্য শেষ করিবেন, তখন অন্যের কথা বলিবার পূর্বেই তিনি বলিলেন “কেনারাম, তোমাদের সুবর্ণপুরে যে নুতন শাস্ত্র পাওয়া গিয়েছে, এ সংবাদ ত আমি পাই নাই।”

কেনারাম বলিলেন “নুতন শাস্ত্র কি দিদি ! যে শাস্ত্র আবহমান কাল এই হিন্দুসমাজের কর্ত্তব্য বিধান করিতেছে, আমি সেই শাস্ত্রের কথাই উল্লেখ করিলাম।”

“কৈ, তুমি ত ভাই প্রমাণ কিছুই দিলে না,—দুই দশটা বচনও আওড়ালে না। বচন-প্রমাণ না দেখালে কি আমাদের মত মুর্থ মেয়েমানুষ শাস্ত্র বুঝতে পারে?”

কেনারাম বলিলেন “এ সকল ত অতি সহজ ব্যাপার; ইহার জন্য আর প্রমাণ-প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় না।”

রমাসুন্দরী বলিলেন “কেনারাম, ভাই, কিছু মনে করো না; আমি জিজ্ঞাসা করি, গোপনে কোন কুকার্য্য করলে তাতে পাপ হয় না ?”

“পাপ হবে না কেন ? কিন্তু এ যে কলিকাল দিদি ! এখন , কি আর সেই সত্যযুগের ব্যবস্থা খাটে ? তাই এখন অনেকটা অন্তরাল করিয়া চলিতে হয়। কুকার্য্যকারী সকলকেই যদি দণ্ডিত করিবার ব্যবস্থা করা যায়, তাহা হইলে কি সমাজ তিষ্ঠিতে পারে। সেই কারণে, যে যাহা অনুষ্ঠান করে, তাহা উপেক্ষা করিতে হয়, নতুবা সমাজের স্থিতি রক্ষা হইবে কি প্রকারে?”

“তা হলে তুমি বলতে চাও যে, যার যা ইচ্ছা, যেমন কুকার্য্য ইচ্ছা, তাই সে করুক; তবে যেন সাবধানে করে, গোপনে করে; তা হলে তোমরা তাদের সমাজে চালিয়ে নিতে পার। এই তোমাদের এখানকার শাস্ত্রের বিধান, কেমন ?”

“না দিদি, তা ঠিক নয়। তবে এই- এই কথাটা-এই কি জান-” কেনারামের কথায় বাধা দিয়া রমামুন্দরী বলিলেন—“কথাটা এই যে, তোমরা শক্তের কাছে নরম, আর নরমের কাছে শক্ত। যাক্‌ সে কথা। তুমি যে বল্‌লে, কালাচাঁদ একটা প্রায়শ্চিত্ত করলেই তাকে তোমরা সমাজে তুলে নিতে পার। তার এই ঘোরতর পাপের ঐ সামান্য শাস্তিই তোমাদের শাস্ত্রে লেখা আছে।আর মানদার বেলায় তোমরা ব্যবস্থা করলে যে, সে যেখানে ইচ্ছা সেখানে চলে যাক। তোমরা তাকে সমাজে কিছুতেই স্থান দিতে পারবে না। কেমন, এই ত তোমার ব্যবস্থা?” .

কেনারাম বলিলেন “শাস্ত্রের বিধানই এই । ত্রিকালজ্ঞ মুনিঋষিরা যা ব্যবস্থা করে গিয়েছেন, অল্পবুদ্ধি আমরা কি তার অন্যথা করতে পারি, না তার তাৎপর্য্য গ্রহণ করতে পারি।”

রমাসুন্দরী বলিলেন “দেখ কেনারাম, আমিও ব্রাহ্মণের মেয়ে, আমিও শাস্ত্রের বিধান মানি। কিন্তু যে শাস্ত্রর কালাচাঁদের মত মানুষের জন্য অতি সামান্য, অতি হাস্যকর প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করতে পারে, আর মানদাকে পথের ভিখারিণী করতে পারে, সে শাস্ত্র মুনিঋষিরা করেন নাই, করতে পারেন না, এ কথা আমি জোর করে বল্‌ছি। যদি তুমি কোন শাস্ত্র থেকে প্রমাণ দিতে পার, তা হলে আমি তোমার মুখের উপর বলৰ যে, সে শাস্ত্র তোমার এই কালাচাঁদের মত মুনিঋরিাই করেছেন; তা হিন্দুর শাস্ত্র নয়,-প্রকৃত মানুষের শাস্ত্র নয়। অপরাধ করল কালাচাঁদ, মহাপাপ করল কালাচাঁদ, আর তার ফলভোগ করবে সেই অনাথা বিধবা! একবার গিয়ে দেখে এস মানদার অবস্থা, শুনে এস তার কান্না! পাষাণও গলে যায় কেনারাম; পাষাণও গলে যায়! তার অপরাধ কি? বল না তোমরা সকলেই ত এখানে আছ, বল না মানদার কি অপরাধ, ষে তাকে পথে দাঁড়াবার ব্যবস্থা করতে চাও। এই নরপশুটা তাকে আক্রমণ করল; সে নিরুপায়া অবলা; সে কি করবে? প্রাণপণে চীৎকার করা ছাড়া আর কি উপায় তার ছিল, বল না তোমরা? তারপর, তোমরা কি না এখানে বৈঠক করে কালাচাঁদকে ধুয়ে-মুছে ঘরে তুলতে যাচ্ছ, আর মানদাকে অকুল পাথারে ভাসিয়ে দিতে চাও। দেখ, যতই তোমরা বড়াই কর না কেন, আমি বলছি এ মহাপাপের প্রায়শ্চিত্ত তোমাদের করতে হবে, তোমাদের এই সমাজকে করতে হবে। হাঁ, মানদা যদি অসচ্চরিত্রা হত, তা হলে তাকে তোমরা দূর করে দিতে, কেউ একটা কথাও বলতে পারত না। কিন্তু এই ঘটনাটা ভেবে দেখ দেখি। আমি এই এখনই মানদার কাছ থেকে আসছি। তার এখন যে রকম ভাব, তাতে সে নিশ্চয়ই আত্মহত্যা করবে। তা ছাড়া তার আর কি পথ আছে? আর কি পথ তোমরা তাকে দেখিয়ে দিতে পার, বল না ?”

রমাসুন্দরীর পুত্র সিদ্ধেশ্বর এতক্ষণ চুপ করিয়া ছিলেন। তিনি বুদ্ধিমান বিচক্ষণ; তিনি উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি; বয়সও তাঁহার ছত্রিশ সাঁইত্রিশ হইয়াছে। ইংরাজী, বাঙ্গালা, সংস্কৃতে এত বড় পণ্ডিত হইয়াও তিনি অল্পভাষী; তাই এতক্ষণ যে বাদ্‌বিতণ্ডা হইতেছিল,তাহাতে তিনি কোন মতই প্রকাশ করেন নাই। বিশেষতঃ, তাঁহার পূজনীয়া মাতাঠাকুরাণী যখন কেনারাম ভট্টাচার্যের সহিত আলোচনায় প্রবৃত্ত হইলেন, তখন তিনি সে আলোচনার মধ্যে কথা বলা সঙ্গত মনে করিলেন না। কিন্তু, তাঁহার মাতা যখন বলিলেন “কি পথ তোমরা তাকে দেখিয়ে দিতে পার, বল না?” তখন সিদ্ধেশ্বর অতি ধীর ভাবে বলিলেন “মা, তুমিই একটা পথ দেখিয়ে দেও না।”

রমামুন্দরী তীক্ষ দৃষ্টি পুত্রের মুখে নিবদ্ধ করিলেন; একটু চুপ করিয়া থাকিয়াই কহিলেন “পথ দেখিয়ে দিতে পারি, কিন্তু সে পথে চল্‌তে পারবি সিধু!”

সিদ্ধেশ্বর দৃঢ় স্বরে বললেন “তুমি যদি আদেশ কর মা, তুমি যদি সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাক, তা হলে তোমার এই অযোগ্য সন্তান সব করতে পারে।”

“তবে শোন্‌ সিধু, আমি যে এতক্ষণ কেনারামের সঙ্গে তর্ক করছিলাম, সে তোর মন বোঝবার জন্য; সুবর্ণপুরের কালু মুখুয্যের জন্য আমার মাথাব্যথা পড়ে নাই। আমি ভাবছিলাম মানদার কথা—আমি ভাবছিলাম তোর কথা সিধু! আমার সে বাসনা পূর্ণ হয়েছে। তুই আমাকে পথের কথা জিজ্ঞাসা করবি, তারই জন্য এতক্ষণ এত কথা-বল্‌ছিলাম। শোন তবে আমার পথের কথা। আমি মানদাকে ঘরে নিয়ে যাব-দেবীপুরে নিয়ে যাব। এতদিনে দেবীপুরের নাম সার্থক করব। কেমন, পারবি এ ভার নিতে?”

“বলেছি ত মা, তোমার আদেশ প্রতিপালনে জন্য সব করতে পারব।”

চণ্ডী বাবু এতক্ষণ কোন কথাই বলেন নাই; এখন দেখিলেন ব্যাপার গুরুতর হইয়া দাঁড়াইল। তিনি আর নীরব থাকিতে পারিলেন না; বলিলেন “দিদি, সকল দিক ভেবে দেখেছ কি ? ওবাড়ীর বড়-বৌয়ের অবস্থার কথাই এখন তোমার মন অধিকার করে বসেছে; তাই তুমি আর কিছুই ভাবতে পারছ না। একটু স্থির ভাবে চিন্তা করে দেখ্‌লেই বুঝতে পারবে, কি কাজ তুমি করতে যাচ্চ। এই প্রথমেই ত দেখ, মুখুয্যে বংশের কি কলঙ্ক হবে? এর পর কি আর কোন ভদ্র ব্রাহ্মণ ওদের সঙ্গে আদানপ্রদান করবে? ওদের যে একঘরে হয়ে থাক্‌তে হবে, সে কথাটা ভেবেছ কি?”

“হাঁ ভাই চণ্ডি, সে কথা ভেবেছি। কালাচাঁদ মুখুয্যে যে পাপ করেছে, তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে না? তার বংশের কলঙ্ক ত দেশময় ছড়িয়ে পড়াই চাই! তাকে সকলে ঘৃণা করবে, তাই ত চাই। আর তোমরা যদি এমন নরপিশাচের সঙ্গে সম্বন্ধ রাখ, তা হলে তোমাদেরও ত প্রায়শ্চিত্তের দরকার, তোমাদেরও শাস্তি হইয়া চাই!”

চণ্ডী বাবু বলিলেন “আমাদের কথা না হয় নাই ভাবলে। আমাদের ভাবনা আমরাই ভাবব; কিন্তু তোমাদের কথাটাও ত একবার ভেবে দেখতে হয়। তোমরা দেবীপুরের জমিদার, তা সকলেই জানে। তোমাদের যে সে অঞ্চলে অসীম ক্ষমতা, তাও আমার জান্‌তে বাকী নেই। তোমরা ইচ্ছা করলে অনেক অসাধ্য-সাধনও করতে পার, এ কথাও স্বীকার করি। কিন্তু, তোমরা কি তোমাদের অঞ্চলের সমাজে যা ইচ্ছা তাই চালাতে পার? এমন ক্ষমতা কি তোমাদের আছে? তারপর ভেবে দেখ, দেবীপুরের তোমরা নয়-আনির জমিদার। সাত-আনির জমিদার মনোহর চাটুর্য্যের সঙ্গে তোমাদের যে রকম মনের মিল, তা আমি বেশ জানি। কেউ কারও ক্রটী দেখ্‌লে ছেড়ে কথা বলে না। এ অবস্থায় তোমরা যে কাজ করতে যাচ্ছ, তাতে মনোহর বাবু যে তোমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন, এ ত আমি দিব্যচক্ষে দেখ্‌তে পাচ্ছি। তার ফল যে কি হবে, তা আর তোমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে না। ঘোর একটা দলাদলির সৃষ্টি হবে; তারপর, তার থেকে মনান্তর, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মামলা-মোকদ্দমা—কত কি যে হবে, তা বলা যায় না। কেমন দিদি, কেমন বাবা সিধু, আমার এ কথাগুলো সত্যি কি না, বল দেখি? আমাদের গায়ের এই কেলেঙ্কারী মাথায় করে নিয়ে দেশে গিয়ে একটা কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে তোমাদের কি লাভ হবে, কি পৌরুষ বাড়বে, সেই কথাটা আমাকে বুঝিয়ে দিতে পার? আজ যে অত্যাচার তোমরা স্বচক্ষে দেখ্‌লে, তাতে তোমাদের কেন, মানুষমাত্রেরই মন বিচলিত হ’তে পারে; কিন্তু, তার প্রতিবিধানের জন্য তোমাদের এত মাথাব্যথা কেন? তার জন্য এমন বিপদ ডেকে আনা কেন?”

রমামুন্দরী বলিলেন “চণ্ডি, তুমি যে সব কথা বল্‌লে, আমি কি তা ভাবিনি, তুমি মনে করছ। আমি সব ভেবেছি। মানদার অবস্থা দেখে যে আমি বিচলিত হয়েছি, তাতে সন্দেহ মাত্র নেই। কিন্তু, আমি যখন তোমাদের সঙ্গে এই সকল কথার আলোচনা করছিলাম, তখন আমি এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবার ভবিষ্যৎ ফলের কথাও ভাবছিলাম, আর আমার ছেলে সিধুর মুখের দিকে চাচ্ছিলাম। সে মুখে আমি যে দীপ্তি, যে ভাব দেখ্‌তে পেয়েছি, তাতেই আমি সাহস করে এই ভার নিতে চাচ্ছি। কেমন সিধু ?”

সিদ্ধেশ্বর বলিলেন “মামা, মায়ের আদেশ আমি মাথায় করে নিয়েছি। আজ আমি যে দৃশ্য দেখলাম, এতে আমার প্রাণে যে ভাবের উদয় হয়েছে, তা মামা, তুমি বুঝতে পারবে না। মায়ের আদেশ পেয়েছি। আমি বল্‌ছি, ও বাড়ীর বড়-বৌকে আশ্রয় দেবার জন্য মনোহর কাকার সঙ্গে যদি বিবাদ করতে হয়, দেশের সকলের সঙ্গে যদি মনান্তর হয়, দেবীপুরের নয়-আনির বাড়ীকে যদি একঘরে হয়ে থাক্‌তে হয়, তাতেও কুন্ঠিত হব না। দেবীপুরের জমিদারী যদি বিকিয়ে যায়, তাতেও আমার অণুমাত্র দুঃখ হবে না। একটী অসহায়া, নিরপরাধা বিধবাকে সামাজিক নির্যাতন থেকে রক্ষা করবার জন্য আমার যথাসর্ব্বস্ব দিয়ে আমি পথের ভিখারী হয়েছি, এর চাইতে অধিক গর্ব্বের কথা আমি ভেবেই পাচ্ছি না। মা ঠিক কথা বলেছেন, যে সমাজ নিরপরাধা বিধবাকে এমন করে ত্যাগ করতে পারে, সে সমাজ হিন্দুসমাজ নয়। আমি সে হিন্দুয়ানীর বড়াই করতে চাইনে। না মা, তুমি ভেবো না। তোমার আদেশ পালন করবার জন্য আমি সমস্ত বিপদ মাথায় করে নিতে প্রস্তুত হয়েছি।”

হরিশ গাঙ্গুলী মহাশয় বলিলেন, “তোমরা যে যা বল্‌লে, সবই ত শোনা গেল। কিন্তু আমি একটা কথা বলি, তাই কেন কর না। ও-বাড়ীর বড়-বৌয়ের জন্য তোমাদের প্রাণে ব্যথা লেগেছে, সে বেশ কথা; কিন্তু, তাকে ঘরে নিতে চাও কোন্‌ বিবেচনায়? আমরা অবশ্য তাকে আমাদের সমাজে স্থান দিতে পারব না; তোমরাও দেখে নিও, দেবীপুর সমাজেও তার স্থান হবে না; মাঝের থেকে তোমরা অনেক বিপদ, অনেক লাঞ্ছনা ভোগ করবে। সকল দিক যাতে রক্ষা হয়, আমি সেই পরামর্শ দিচ্ছি। তোমাদের অর্থ আছে, তোমরা তা অনায়াসে করতে পার। বেশ ত,তোমাদের দয়া হয়েছে, তোমরা গোরাচাঁদের স্ত্রীকে কাশীতে পাঠিয়ে দেও; সেখানে তার ভরণ-পোষণের জন্য যা ব্যয় হবে, তা তোমরা দিও।. তবে তার মেয়েটার কথা ভাববার বিষয় বটে। তারই বা কি। কাশী হোলো গে একটা সৃষ্টিছাড়া যায়গা। পয়সা খরচ করলে সেখানে বেশ্যার মেয়েও কুলীন বামুনের মেয়ে বলে পার হয়ে যায়; এ ত সামান্য কথা। এই বুড়ো বামুনের কথাটা ভেবে দেখ, সব দিক্‌ যাতে রক্ষা হয়, আমি সেই সুপরামর্শই দিলাম।”

সিদ্ধেশ্বর বলিলেন, “সে বিবেচনা পরে করা যাবে। আপাততঃ ওঁকে ত দেবীপুরে নিয়ে যাই। তারপর যা হয়, দেখব, কি বল মা?”

রমাসুন্দরী বলিলেন “সেই কথাই ভাল। সকালেই আমাদের যাওয়ার বন্দোবস্ত করে ফেলো সিধু! ঘাটে ত নৌকা বাঁধাই আছে; কালই রওনা হতে হবে। আমি এখন ও-বাড়ী যাই; মানদাকে আজ রাত্রিতে চোখের আড়াল করা হবে না।” এই বলিয়া তিনি কালাচাঁদদিগের বাড়ীতে চলিয়া গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *