১৬. শনিবার দিন দপ্তরে এসেছি

শনিবার দিন দপ্তরে এসেছি একটু বেলা করেই। তার একটা কারণও ছিল। শুক্রবার সারারাত জেগে গান শুনেছি। আলাউদ্দীন সংগীত সমাজের তিন রাত্রিব্যাপী জলসার প্রথম রাত্রি কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছি বেলা আটটায়। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর একটু বিশ্রাম করেই দপ্তরে এসেছি, কোনরকমে তাড়াহুড়ো করে কাজকর্ম সেরেই ছুটতে হবে রূপবাণী চিত্ৰগৃহে, আবার অহহারাত্র জাগরণ। বড় বড় ওস্তাদদের আসর, না শুনতে পেলে জীবনটাই যেন বৃথা। রামপুর থেকে এসেছেন অশীতিপর বৃদ্ধ ওস্তাদ মুস্তাক হুসেন খাঁ। এক সময়ে তার কণ্ঠের খেয়াল গান শুনবার জন্য লোকে পাগল হত। আজ বৃদ্ধের কণ্ঠে সাতটি সুর সাতটি পোষ পাখির মত আর খেলা করে না। যৌবনের সতেজ করে সে দাপট নাই, সাপট তানের সেই ফুলঝুরি-বাহার আজ স্তিমিত। হলক আর গমক তান দমের অভাবে তিন সপ্তক পর্যন্ত ছুটোছুটি করতে পারে না। তা না পারুক, তবু মরা হাতির দামও লাখ টাকা। গত সন্ধ্যায় ঢিমা লয়ে শুধ, কল্যাণের খেয়াল যখন ধরলেন তখন চমকে উঠেছি রাগের বিস্তার আর তার চলন শুনে। মনে হল কতকালের হারানো সম্পদ যেন ফিরে পেলাম। নবীন যুবা কাশীনাথের দলে বুড়া বরজলাল শ্রোতাদের হাততালি কুড়োতে

পারলেও তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন লয় ঠিক রেখে বড় তালের খেয়াল কি ভাবে পথ কেটে এগিয়ে চলে উদারা থেকে মুদারায়, আবার মুদারা থেকে তারায়।

দপ্তরের কাজের ফাঁকে-ফাঁকে মনে পড়েছিল বৃদ্ধ খাঁ সাহেবের সেই বেদনাক্লিষ্ট মুখ যখন তারার গান্ধারে সুরকে দৃপ্ত ভঙ্গিমায় দাড় করাবার চেষ্টা করছেন কিন্তু পারছেন না।

বিকেল হয়ে এসেছে, বৈঠকের বন্ধুরা একে-একে আবিভূত হলেন। এসেছেন সব্যসাচী লেখক, গাল্পিক কথা-সাহিত্যিক, তরুণ কবি। আর এসেছেন আমাদের না-লিখে-সাহিত্যিক বিশুদা।

ঘরে ঢুকেই বিশুদা বললেন–এ কি, আজ যে টেবিল পরিষ্কার, তাড়াতাড়ি বেয়োতে হবে বুঝি?

বললাম সংগীত সম্মেলনের কথা। আজ আবার আলাউদ্দিন খাঁ ও আলী আকবরের যুগলবন্ধ সরোদ তারপর গোলাম আলীর গান। সুতরাং যেতেই হবে এবং গতকালের মত রাতও জাগতে হবে।

তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বিশুদা বললে—কি করে যে রাতের পর রাত জেগে আপনারা কালাতি গান শোনেন বুঝে পাই না।

বৈঠকে সেদিন উপস্থিত ছিলেন আরেকজন কথাসাহিত্যিক, ইনস্যুরেন্স অফিসের বড় চাকুরে। তিনি বললেন–

আর বলেন কেন। লক্ষৌ-এ আমি এক ওস্তাদের পাল্লায় পড়েছিলাম। গিয়েছি মোটর অ্যাকসিডেন্টের একটা কেস নিয়ে। যে-হোটেলে উঠেছিলাম সেই হোটেলেই আছেন বরোদার ওস্তাদ ফৈয়জ খাঁ। আর আছেন তত আছেন, একেবারে আমার পাশের কামরাতেই।

ভারত বিখ্যাত ওস্তাদের পাশের কামরায় থাকার সৌভাগ্যে ঈর্ষা হওয়া স্বাভাবিক। আমি বললাম

শুনেছি খাঁ সাহেব রোজ সকালে তিন-চার ঘণ্টা রেওয়াজ করেন আর সে নাকি অপূর্ব। আপনি তো মশাই ভাগ্যবান।

বিরক্তির সঙ্গে বললেন—রাখুন মশাই। আমি আমার কাজকর্মের ধান্দায় সকাল নটার মধ্যেই বেরিয়ে যেতাম, ফিরতাম সন্ধ্যায়। উনি বেরিয়ে যেতেন সন্ধ্যায় আর ফিরতেন সকাল নটায়। আমার সঙ্গে দেখা হবেই বা কখন আর রেওয়াজই বা শুনব কখন? কিন্তু একদিন উনি মধ্যরাত্রে কখন ফিরেছেন জানি না। সকালে নটার মধ্যেই আমার বেরোবার প্রচণ্ড তাড়া, সেদিনই লক্ষ্মৌ-এর কাজ চুকিয়ে কলকাতায় ফিরতে হবে। পাশাপাশি দুটো কামরার একটা ছিল কমন বাথরুম। তাড়াতাড়ি তোয়ালে-সাবান নিয়ে বাথরুমে ঢুকেই ছিটকে বেরিয়ে আসতে হল। জল চৌকির উপর খালি গায়ে লুঙ্গি পরে এক বৃদ্ধ বসে, আরেকটা লোক তার গায়ে তৈল মর্দনে ব্যস্ত। চানের ঘরে ঢুকতেই বৃদ্ধ হাত নেড়ে এমন এক ধমক দিলেন যে পালিয়ে আসার পথ পাই না। লোকটা তত আচ্ছা অভদ্র! তখুনি চলে গেলাম ম্যানেজারের কাছে। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন—সে কি মশায়, উনিই তো ওস্তাদ ফৈয়জ খাঁ। আমি বললাম-হতে পারে উনি মন্তবড় ওস্তাদ, কিন্তু আমাকে ধমক দেবার তার কি অধিকার আছে। ম্যানেজার হেসে বললেন–ওটা ধমক নয়, গমক। গমক তান ছেড়েছিলেন। আপনি তো সকাল-সকাল রোজ বেরিয়ে যান। সারারাত বাইরে কাটিয়ে সকালে ফিরে এসে বাথরুমে উনি ঘণ্টা দুই তেল মালিশ করান, সেই সঙ্গে চলে রেওয়াজ।

এ-কথায় সবাই হেসে উঠল। আমিই শুধু দুঃখ জানিয়ে বললাম-আপনি সত্যিই দুর্ভাগা। এতবড় একজন ওস্তাদকে কাছে পেয়ে হেলায় হারালেন?

সব্যসাচী লেখক সুযোগ পেয়ে টিপ্পনী কেটে বললেন—শাস্ত্রে কি আর সাধে তিনবার দিব্যি গেলে বলেছে–আরসিকেযু রসস্য নিবেদনং মা কুরু, মা কুরু, মা কুরু।

গাল্পিক কথা-সাহিত্যিক এবার মুখ খুললেন। এক সময়ে বাপ-মাকে লুকিয়ে সংগীত চর্চা করেছেন, নিধুবাবুর টপ্পার কাজ আজও ওঁর গলায় অনায়াসে খেলে যায়; লক্ষৌ-ফেরত সাহিত্যিকের পক্ষ নিয়ে বললেন–ওঁর আর দোষ কি। গানের রাজা রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত ওস্তাদদের ভয় পেতেন। শুনেছি একবার বরানগরে প্রশান্ত মহলানবিশের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ এসে উঠেছেন। দিলীপকুমার রায় রবীন্দ্রনাথকে ধরে পড়লেন—বরোদা থেকে এক বিখ্যাত ওস্তাদ কলকাতায় এসেছেন, নাম ফৈয়াজ খাঁ। তাঁর গান শুনতেই হবে। রবীন্দ্রনাথ প্রস্তাব শুনেই আতঙ্কিত। কিন্তু দিলীপ রায় ছাড়বার পাত্র নন। গান শোনাবেনই। রবীন্দ্রনাথ নিতান্ত নিরুপায় হয়ে ভয়ে ভয়ে বললেন—মণ্টু, তুমি যখন বলছ তখন গান শোনাই যাক। কিন্তু তোমার ঐ ওস্তাদটি থামতে জানেন তো?

আমি বললাম—সে ঘটনা আমার জানা। বরানগরে একদিন সকালে দিলীপ রায় উদ্যোগী হয়ে ফৈয়াজ খাঁর গানের আসর বসালেন। পুরো একঘণ্টা তৈরীতে খেয়াল গাইবার পর যখন ঠুংরি ধরলেন বাজু বল খুল খুল যায় তখন রবীন্দ্রনাথের চোখ মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। বেলা বারোটা বেজে গেছে, খাবার সময় উত্তীর্ণ, রবীন্দ্রনাথের হুঁশ নেই। ফৈয়াজ খাও তখন এতবড় একজন সমজদার গুণী শ্রোতাকে পেয়ে মেতে উঠেছেন। দরদী কণ্ঠে অন্তরের সমস্ত আবেগ উজাড় করে যখন একটি কলি নানা ভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পাইছেন সাবরিয়া নে যাদু ডারা তখন রবীন্দ্রনাথের ঈষৎ শিয়শ্চালন দেখেই বোঝা গিয়েছিল যে ভৈরবীর বেদনা-মধুর সুরের মূছনা তাঁকে আচ্ছন্ন করেছে।

সেদিন সকালে ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁর গান শুনে রবীন্দ্রনাথ উচ্ছ্বসিত হয়ে যে প্রসংশা করেছিলেন তা পরদিন সব খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল।

সব্যসাচী লেখক বললেন—ফৈয়াজ খাঁর গান শোনার সৌভাগ্য আমার কখনও হয় নি। কিন্তু আরেক ওস্তাদের গান শোনার একটা ঘটনা বলি। বহুকাল আগে পূরবী সিনেমায় নিখিল বঙ্গ সংগীত সম্মেলনের অধিবেশন চলছে। বন্ধু-বান্ধবের পাল্লায় পড়ে রবিবার সকালের অধিবেশনে গান শুনতে গেলাম। সেদিনের প্রধান আকর্ষণ ছিল জ্ঞান গোঁসাই-এর গান।

জ্ঞান গোঁসাই স্টেজ-এ এসে যখন বসলেন সঙ্গে সঙ্গে একটা ঘরোয়া পরিবেশ দেখা দিল। শিষ্য শাগরেদ পরিবৃত হয়ে মাঝখানে বসে পরিচিত জনদের সঙ্গে নমস্কার বিনিময় হল, কুশল সংবাদ জিজ্ঞাসা করলেন। অবশেষে জৌনপুরীতে গান ধরলেন ফুলবনকো মৈ তো। ঠেকা চলেছে-তবলায় ধা, ধিন ধিন্ না। পিছন থেকে দু-দুটো তানপুরা ছাড়ছে সুর, অপর পাশে সম ফাঁক তাল লক্ষ্য রেখে হারমোনিয়াম বাজিয়ে চলেছে অপর এক শিষ্য। জ্ঞানবাবুর দরাজ ও বলিষ্ঠ কণ্ঠের গানে গমগম করছে আসর। সবেমাত্র একটা কঠিন তান তুলে সমে এসে ছেড়েছেন, এমন সময় ওঁর বিশেষ পরিচিত এক ব্যক্তি স্টেজের উপর এসে বসলেন। ভদ্রলোককে নজরে পড়া মাত্র জ্ঞানবাবু হাতজোড় করে মুখে হাসি এনে ঘাড়টা ডানদিকে কাত করলেন, অর্থাৎ ভালো তো?

আগন্তুকও তদ্রূপ ভঙ্গিতেই জানিয়ে দিলেন ভালো আছি।

তবলায় ঠেকা তখন ফাঁক দেখিয়ে সমের কাছাকাছি প্রায় এসে পড়েছে। এক ঝটকায় মুখটা আগন্তুকের দিক থেকে তবলচীর দিকে ফিরিয়ে ডান হাতে শূন্যে এক প্রচণ্ড থাপ্পড় মেরে বলে উঠলেন—হঃ। বুঝলাম তবলচীকে সমের মুখে জানান দিলেন যে, উনি তালে ঠিক।

গাইয়ে-বাজিয়েদের মেজাজ শরীফ না থাকলে আসর বরবাদ হয়ে যায়। এ-অভিজ্ঞতা আমার কিছু আছে, কারণ গান-বাজনার মহফিল-এর খবর পেলেই বাহুত গিয়ে আসরের এক কোণায় আসন নেওয়া আমার বহুদিনের অভ্যেস। আমি তাই বললাম—

গান-বাজনার আসরে ওস্তাদদের মেজাজ খুশ, না থাকলে গান জমে না। সেইজন্যে সব আসরেই একদল সমঝদার থাকেন যাদের কাজই হচ্ছে মাথা নেড়ে ওস্তাদদের তারিফ করা। ওস্তাদ যদি একটা সূক্ষ্ম কাজ করলেন অমনি পার্শ্বচর শ্রোতাদের মধ্যে হইহই রব উঠল-কেয়া বাত, কেয়া বাত্‌। তুনে তো গজব কর দিয়া? মাহ্‌শাল্লা। হায় হায়। এ ছাড়া ওস্তাদের সামনেই তারা এমন প্রশস্তি শুরু করে দিলেন যেন জীবনে আর কখনও এরকম গান তারা শোনেন নি। প্রত্যেকটি তারিফকে সেলাম জানিয়ে ওস্তাদরা সম্মানিত করেন। এটাই মহফিল-এর প্রচলিত রীতি।

ওস্তাদদের মেজাজের কথা বলছিলাম। একবার কলকাতার এক সংগীত সম্মেলনের উদ্যোক্তারা বেনারসের বিগতযৌবনা এক বিখ্যাত ঠুংরি-গাইয়ে বাইজীকে আমন্ত্রণ জানালেন। তার সঙ্গে লিখিত চুক্তি হল রেলভাড়া আর হোটেল খরচ সমেত হাজার টাকা, অলিখিত চুক্তি ছিল আসরে গান গাইতে বসার আগে এক পাইন্ট স্কচ হুইসকি। উদ্যোক্তারা লিখিত চুক্তি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন কিন্তু তালেগোলে অলিখিত চুক্তির কথাটা গিয়েছিলেন বেমালুম ভুলে। বিখ্যাত বাইজীর গান শোনার লোভে সেদিন প্রেক্ষাগৃহ লোকে লোকারণ্য। যথাসময়ে বাইজীকে হোটেল থেকে নিয়ে আসা হল, মাইক্রোফোন-এ ঘোষণা হয়ে গেল—কিছুক্ষণের মধ্যেই উনি আসরে গান গাইবেন। গ্রীনরুমে বসে তানপুরা বাঁধা হল, তবলা বাঁধা হল, শারেঙ্গী বাধা হল। এবার আসরে গিয়ে বসলেই হয়। হঠাৎ বাইজী বেঁকে বসলেন ময় তো গাঁউঙ্গী নহী। এদিকে অধীর আগ্রহে শ্রোতা অপেক্ষা করছে, ওদিকে বাইজীর ঐ এক কথা গাউদী নহী। এমন সময় উদ্যোক্তাদের মধ্যে একজনের মনে পড়ে গেল অলিখিত শর্তের কথা। কপাল চাপড়ে বলে উঠলেন, এই র্যা, নটা বেজে গেছে, এখন তো কোন দোকানও খোলা পাব না যে দৌড়ে গিয়ে কিনে আনব। এখন উপায়? উপায় একটা হল। সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন এক মাভোয়ারী ভদ্রলোক। বাইজীর আসরে আসতে দেরি হচ্ছে কেন খোঁজ নেবার জন্যে গ্রীনরুমে গিয়ে শুনলেন বাইজীর মেজাজ নেই, মেজাজের বন্দোবস্ত না হলে উনি গাইবেন না। প্রেসিডেন্ট বললেন—ইয়ে বাত? মুঝে কিউ নেহি বোলা? সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভারকে ডেকে বাড়ি পাঠিয়ে এক বোতল মেজাজ আনিয়ে ফেললেন। বোতলটা হাতে দিতেই বাইজীর মুখে হাসি ফুটল। সোডা আর গেলাসের কথা জিজ্ঞাসা করতেই বললেন–কোই জরুরত নহী। বোতলের ছিপিটা অভ্যন্ত পাকা হাতে খুলে ঢকঢক করে গলায় ঢাললেন। আধ বোতল যখন নিঃশেষ, বোতলে আবার ছিপি আঁটলেন। হাণ্ডব্যাগ থেকে আয়না বার করে চোখের কাজল আর গালের রঙ ঠিক আছে কিনা দেখে নিলেন, রুমাল বার করে কপালের ঘাম আলতো ভাবে মুছে নিয়ে বললেন–ববালিয়ে কৌন গান গাঙ। গজল ইয়া ঠুংরি। উদ্যোক্তারা হাফ ছেড়ে বাঁচলেন, বাইজীর মেজাজ শরীফ। ওদিকে প্রেক্ষাগৃহে জনতা বিলম্বে অধৈর্য। ঘোষণা হল এবারে উনি আসরে এসে বসছেন। প্রথমে গাইবেন গজল, পরে ইংরি। হর্ষোৎফুল্ল শ্রোতাদের ঘন ঘন করতালির মধ্যে নীলাম্বরী শাড়ি পরে, মাথায় ঘোমটা দিয়ে, আসরে এসে প্রথমে ধরলেন গজল–

জিন্দগী ইউঁভী গুজরহী যাতি
ক্যোঁ তেরা রাহ,গুজর ইয়াদি আয়া।

গাল্পিক সাহিত্যিক এই সময় বললেন—গানটার প্রথম দুই কলির সুরের একটু আন্দাজ দিতে পারেন?

গানের আরম্ভের সুর আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল। গুনগুন করে গেয়ে শোনাতেই বিশুদা বললেন—গানের অর্থটিও তো জানা দরকার।

বললাম—অর্থ অতি সহজ। জীবন তো এভাবেও কোনমতে কেটে যেত, তবু কেন তোমার সঙ্গে আবার দেখা হল?

সব্যসাচী লেখক কানের কাছে মুখ এনে চাপা স্বরে জিজ্ঞাসা করলেনবাইজীর বয়েসটা জানতে পারি?

আমি বললুম—বাইজীর বয়েস পঞ্চাশোর্ধ। কিন্তু যৌবনকালে যে অপরূপ সুন্দরী ছিলেন তা আজও তাঁর দেহসৌষ্ঠব, গায়ের রং আর চোখমুখের নিখুত গড়নেই বোঝা যায়। গজল শেষ করে ঠুংরি ধরলেন— পিয়া তেরা তিরসি নজরিয়া লাগে শ্যাম।

হইহই করে উঠলো পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহের শ্রাতৃমণ্ডলী, আনন্দের হিল্লোল বয়ে গেল। বেনারসী লচাও ঠুংরির কাটা-কাটা সুক্ষ্ম কাজ, যেন থোক। থেকে একটি-একটি করে আঙ্গুর তুলে এনে রস নিঙড়ে ঢেলে দিচ্ছেন। আর কী অপরূপ গায়ন ভঙ্গিমা। কোলের কাছে তানপুরাটি সোজা দাঁড়িয়ে। চারটি তারের উপর ডান হাতের চাপার কলির মত মধ্যমা আর তর্জনী যেন নেচে বেড়াচ্ছে। বাঁ হাতটি কখনও কানের উপর চেপে ধরে সুর যাচাই করে নিচ্ছেন, আবার কখনও সামনে বিস্তৃত করে সমের মুখে পঞ্চমে সুর তুলে একটু ঝোঁক দিয়ে গেয়ে উঠছেন লাগে শ্যাম! নজরিয়া কথাটি নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যখন ঘোট ঘোট তান তুলে নানাবিধ নকশার আলপনা আঁকছিলেন তখন তার কাজল-মাখা খঞ্জনসদৃশ চঞ্চল আঁখিতারায় যৌবনের বহু-অভ্যস্ত তির্যক চাহনি সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে নেচে উঠছিল। সুরের মায়াজাল আর মদভরনয়নার মোহিনী শক্তি অগণিত শ্রোতাকে আবেশে বিভোর করে ফেলেছে।

গান শেষ হতেই করতালির শব্দে প্রেক্ষাগৃহ ফেটে পড়ছে। শ্রোতাদের ঘন-ঘন অনুরোধ, আরেকটা গান শুনতে চাই। বাইজী কিন্তু আর গাইলেন না। শ্রোতাদের কাছে নিবেদনের ভঙ্গিতে ছোট্ট একটি নমস্কার জানিয়ে তানপুরাটি আলগোছে সামনে শুইয়ে রেখে ধীরপদক্ষেপে স্টেজ ছেড়ে উঠে গেলেন গ্রীনরুমে। অর্ধনিঃশেষিত পানীয়র বোতলটা তখনও রাখা ছিল। একবার শুধু আড়চোখে সেদিকে তাকালেন। আর তার প্রয়োজন নেই। তারপর নিঃশব্দে বাইরে চলে এলেন অপেক্ষমান গাড়ির কাছে। তাঁকে অভিনন্দন জানাবার জন্যে সেখানে প্রচুর ভিড় কিন্তু সেদিকে তার হৃক্ষেপ নেই। জীবনে বহু প্রসংশা, বহু তারিফ বহু সমাদর তিনি পেয়েছেন, আজ তিনি সে-মোহের অনেক উর্ধ্বে। গাড়ি ছাড়বার সময় উদ্যোক্তাদের নমস্কার জানিয়ে শুধু বললেন–ম্যয় চলতী হুঁ, ফির মিলুঙ্গী।

গাড়ির চারপাশের মুগ্ধ জনতার এক প্রান্তে আমিও এসে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলাম। গাড়ি চলে যেতেই বাইজীর কণ্ঠে প্রথম গাওয়া গজলের দুটি কলি আমার অন্তরে গুঞ্জরিত হয়ে উঠল—জিন্দগী ইউভী গুজরহী যাতি, ক্যোঁ তেরা রাহ্‌গুজর ইয়াদি আয়া। সে-কেন দেখা দিল রে, না দেখা ছিল রে ভাল।

বিশুদা বললেন–অব সমঝ লিয়া। এতক্ষণে বোঝা গেল কেন আপনি গান-বাজনার আসর পেলে আর সবকিছু ফেলে ছুটে যান।

অরসিককে কি করে বোঝাব যে সংগীতের আস্বাদ ঈশ্বরাষ্পদের সামিল। বিশুদার কথার প্রতিবাদ না করে শুধু বললাম-যে কোন ভালো গায়কের গান শুনতে পাওয়াটাই সৌভাগ্য। সংসারের শত কর্মে বিক্ষুদ্ধ চিত্তকে তিন চারঘণ্টার জন্য এমন একটা সুরলোকে পৌঁছে দেয় যেখানে সুরের আলো ভুবন ফেলে ছেয়ে, সুরের হাওয়া চলে গগন বেয়ে। সেই সময়টুকু রবীন্দ্রনাথেরই ভাষায় আপনার মনে হবে-সমাজ সংসার মিছে সব, মিছে এ জীবনের কলরব।

সব্যসাচী লেখক টিপ্পনী কেটে বললেন–অর্থাৎ সুর ও সুরা কথা দুটির শব্দগত মিল যতটা অর্থগত মিলও ততটাই।

 

আমি বললুম-শব্দগত মিল থাকলেও এ-দুইয়ের ক্রিয়ার পার্থক্য অনেক। সুরের অমৃত যতই পান করুন তৃষ্ণা ততই যাবে বেড়ে। সুরা মাত্ৰাধিক হলেই মাতাল হতে হয়।

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল আমার ছাত্রজীবনে শান্তিনিকেতনের শাস্ত্রীয় সংগীতগুরু রণজিৎ সিং-এর কথা। রণজিৎ সিং ছিলেন বহরমপুরের লোক। তার বাপ-ঠাকুরদা ছিলেন রাজস্থান, গান বাজনা শিক্ষকতার কাজ নিয়ে বহরমপুরে এসে তারা স্থায়ীভাবে সেখানেই বসবাস করেছিলেন। বাংলা দেশে বিষ্ণুপুর যেমন ধ্রুপদের জন্য বিখ্যাত, বহরমপুর ছিল খেয়াল ও ঠুংরির জন্য প্রসিদ্ধ। মুর্শিদাবাদের নবাব ও কাশিমবাজারের মহারাজা ছিলেন শাস্ত্রীয় সংগীতের বড় পৃষ্ঠপোষক, এক সময়ে বহু গুণী ওস্তাদের সমাগম ছিল এই দুই দরবারে। রণজিৎ সিং-এর পূর্বপুরুষ কাশিমবাজারের মহারাজার আমন্ত্রণেই বহরমপুরে এসেছিলেন। এস্রাজ ও সেতার বাজনায় এই পরিবার ছিলেন বহরমপুরে বিখ্যাত।

শান্তিনিকেতনে ছাত্ররা যাতে হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীত চর্চা করে সেদিকে রবীন্দ্রনাথের ছিল কড়া নজর। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে ছাত্রদের মনে হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীতের ভিত পাকা না হলে রাগরাগিণী ও তাল লয়ের বোধ জাগবে না। কিন্তু আমার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ এটাও জানতেন যে, বিদ্যালয়ের ছাত্ররা যদি তার রচিত গান ভবিষ্যতে কোনদিন একান্তভাবে চর্চা করতে চায় তাহলেও হিন্দুস্থানী সংগীতের উপর বেশ কিছুটা দখল তাদের থাকা প্রয়োজন। কেননা রবীন্দ্রসংগীতের পূর্ণ রস উপভোগ করতে হলে চাই সংস্কৃতিবান রুচিশীল মন আর হিন্দুস্থানী সংগীতের রাগরাগিণীবোধ।

এই কারণে ছোটবেলা থেকেই আমরা শান্তিনিকেতনে দেখেছি মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ভীমরাও শাস্ত্রীকে। তিনি ছিলেন একাধারে সংস্কৃত শাস্ত্রে পণ্ডিত এবং হিন্দুস্থানী সংগীত শাস্ত্রে পারঙ্গম। বাল্যকালে ওঁর কাছে আমরা বসন্তবাহারের সুরে গান শিখেছি—ক্যায়সে নিকসে চাঁদনী ইমনকল্যাণে–তুহি ভজ ভজ রে, আশাবরীতে—উন সন যায়কা হোরী ইত্যাদি গান। ভীমরাও শাস্ত্রীরই উদ্যোগে সেই সময় হিন্দুস্থানী সংগীতের স্বরলিপি সমেত দুটি চটি সংকলনগ্রন্থ শান্তিনিকেতন প্রেস থেকে বাংলা হরফে ছেলে প্রকাশিত হয়েছিল। বই দুটির নাম ছিল সংগীত পরিচয় ও সংগীত র্পণ। সে-বই ছিল শান্তিনিকেতনের সংগীত শিক্ষার্থী ছাত্রদের পাঠ্যপুস্তকের অঙ্গীভূত। বিভিন্ন রাগরাগিণীর উপর প্রচলিত বিখ্যাত হিন্দী গানগুলি অতি সযত্নে সংগ্রহ করে এই সংকলনগ্রন্থ প্রকাশ করা হয়েছিল। দুঃখের বিষয় আজ ভীমরাও শাস্ত্রী বেঁচে নেই, বই দুটিও বহুকাল ধরে পাওয়া যায় না, গানগুলিও হারিয়ে গিয়েছে।

ছাত্রসংখ্যা যখন ক্রমশই বাড়তে লাগল তখন ভীমরাও শাস্ত্রীর পক্ষে আর একা গান শেখানো সম্ভব হয়ে উঠছিল না। রবীন্দ্রনাথ তখন এমন একজন গুণী ওস্তাদের সন্ধান করছিলেন যিনি গান তো শেখাবেনই সেই সঙ্গে এস্রাজ, সেতার, তবলাও শেখাতে পারবেন। সৌভাগ্যক্রমে পেয়েও গেলেন। রবীন্দ্রনাথের পরম সুহৃদ কাশিমবাজারের মহারাজা প্রমথ চৌধুরীর কাছে খবর পেয়ে রণজিৎ সিংকে পাঠিয়ে দিলেন শান্তিনিকেতনে।

এক পুজোর ছুটির পর রণজিৎ সিং এসে উঠলেন লাইব্রেরী-ঘরের পিছনে খড়ের চালা বাড়ির একটা ঘরে। বয়স পঞ্চাশের উপর, সুতী নাকের নীচে একজোড়া গোঁফ ঠোটের দুপাশ দিয়ে থার্ড ব্রাকেটের মত ঝুলে পড়েছে। বাঁ-পাটা পঙ্গু, লাঠি ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে চলেন। অপূর্ব এস্রাজ বাজাতেন রণজিৎ সিংজী। সেতার ও তবলায় সমান দক্ষতা তাঁর ছিল কিন্তু গানের গলা ছিল কিছুটা কর্কশ। গান শেখানোর পদ্ধতি তিনি ভালই জানতেন। রণজিৎ সিংজীর আরেকটি গুণের পরিচয় পেয়েছিলাম বেশ কিছুদিন পরে। তিনি ছিলেন দক্ষ কারিগর। সেতার এস্রাজ ঘরে বসে নিজের হাতে বানাতেন। অবসর সময়ে যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করছেন, শিরীষ কাগজ দিয়ে কাঠ ঘষছেন, বার্নিশ লাগাচ্ছেন। রণজিৎ সিং মানুষটি ছিলেন আমাদের পরম বিস্ময়ের, ততোধিক বিস্ময়ের ছিল তার হাতুড়ি বাটালি বঁাদা নিয়ে যন্ত্র বানাবার পদ্ধতি।

রণজিৎ সিং-এর ঘরে ছিল আমাদের অবাধ গতি। কখনও আপন মনে এস্রাজ বাজাচ্ছেন, কখনও যন্ত্রপাতি নিয়ে সেতার বানাচ্ছেন আবার কখনও আমাদের সঙ্গে গল্প করছেন বহরমপুরের, কখনও রাজস্থানের। ভাঙ্গা-ভাঙ্গা হিন্দীমিশ্রিত বাংলা বলতেন বিকৃত উচ্চারণে, তাতে চন্দ্রবিন্দুর প্রয়োগ থাকত প্রয়োজনাতিরিক্ত।

জ্ঞান গোস্বামীর তখন খুব নাম ডাক। ওঁর গানের রেকর্ড তখন প্রতি ঘরে-ঘরে। তিনিও বহরমপুরের লোক। একদিন জ্ঞান গোস্বামীর কথা তার কাছে পাড়তেই বললেন—

গেনুর কথা বলছ? ওতো আমাদের বাড়ির ছেলের মত ছিল। ওর যখন তেরো-চৌদ্দ বছর বয়েস তখন আমার বাবার কাছে তালিম নিয়েছে, আমার কাছেও নিয়েছে।

বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করি—সে কি! আপনার কাছেও গান শিখেছেন?

হাঁ, শিখেছে বই কি। কত খাতির করত আমাকে। পায়ের জুতো নিজের হাতে কতবার খুলে দিয়েছে। তবে হ্যাঁ, মাথা ছিল ওর। একটা তান একবার দেখিয়ে দিলে চট করে তুলে ফেলত।

জিজ্ঞাসা করলাম–আপনার সঙ্গে আজকাল দেখা হয়?

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বেদনা মিশ্রিত কণ্ঠে বললেন–গেনু আজকাল কি রকম বদলে গিয়েছে। নাম যশ টাকা হলে মানুষ বদলে যায়। মাঝে-মাঝে বহরমপুর আসে, খবরও পাই, দেখা হয় না।

একদিন বললাম-রণজিৎ সিংজী, হিন্দুস্থানী গান ভাল করে শিখবার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আমার তো সে-রকম জ্ঞান নেই, শুনেছি দশ বারো বছর সময় লাগে। তাই আর সাহস করে এগোই নি।

রণজিৎ সিং বললেন–বুট, বিলকুল বুঢ় বাত। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে সরগম্ সাধনা কর, যেমন করে মানুষ সকালে ঘুম থেকে উঠে ভগবানের নাম করে। মনমে সুর এসে গেলে কঠে আসতে কতক্ষণ। আর কণ্ঠে সুর এসে গেল তো ভগবানকে মিলে গেল। তখন প্রেমসে যত গান করবে, ভগবানের আশীর্বাদ ভি তো মিলবে।

১৯৩২ সালের কথা। শান্তিনিকেতন থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের একটি দল গিয়েছিল লক্ষে রবীন্দ্রনাথের একটি গীতিনাট্য অনুষ্ঠানের জন্য। সেই দলে রণজিৎ সিং ছিলেন, আমিও কি এক অছিলায় ভিড়ে গিয়েছিলাম। উপলক্ষটা ছিল লক্ষৌ ম্যারিস কলেজের বাৎসরিক অনুষ্ঠান। ম্যারিস কলেজের প্রশস্ত হল-এ তিনদিন ধরে হিন্দুস্থানী সংগীত সম্মেলনও চলছে, উত্তর ভারতের বহু গুণী ও বিখ্যাত ওস্তাদ এসেছেন। সুতরাং আমার কাছে লক্ষে আসাটা তীর্থক্ষেত্রে আসার সামিল। দলের অন্যান্যরা লক্ষে শহর ঘুরে দেখতে ব্যস্ত, আমি ও রণজিৎ সিংজী কনফারেন্সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আছি। সময় কী ভাবে কোথা দিয়ে কেটে যাচ্ছে টেরও পাচ্ছি না।

দ্বিতীয় দিন প্রাতঃকালীন অধিবেশনের সর্বশেষ প্রোগ্রাম ছিল ভারত বিখ্যাত ধ্রুপদীয়া ওস্তাদ নসীরুদ্দিন খাঁ সাহেবের ধ্রুপদ গান। আমি আর রণজিৎ সিংজী তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া সেরে একটা টাঙ্গা নিয়ে বেলা ১১টার মধ্যে হলে-এ এসে হাজির। তখন সাখাওয়াৎ হুসেন-এর সরোদ বাজনা চলছে। ঠিক বেলা বারোটার সময় আসরে এসে বসলেন ওস্তাদ নসীরুদ্দিন খা। যেমন বিশাল বপু তেমনি রাজকীয় তাঁর সাজপোশাক। খাঁ সাহেবের মত অতবড় ধ্রুপদীয়া তখন ভারতে দ্বিতীয় আর কেউ নেই। ইন্দোরের বিখ্যাত ঘরানার বংশধর তিনি। পিতা আল্লাবন্দে খাঁ, প্রপিতা বৈরাম খা, যাদের নাম উচ্চারণ করবার সময় আজও ওস্তাদের নাকে কানে হাত দিয়ে প্রণাম জানায়।

খাঁ সাহেব চোখদুটি মুদ্রিত রেখে সুর ছাড়লেন। মনে হল জোয়াবিদার কণ্ঠনিঃসৃত সুরের অনুরণন প্রেক্ষাগৃহের দেওয়ালে যেন কী খুজে বেড়াচ্ছে। কখনও বাঘের মত আওয়াজ পরমুহুর্তে বীণাধ্বনি। দীর্ঘ আলাপের পর যখন লয়ের কাজ শুরু হয়ে গেল তখন গমগম করছে আসর, যেন মেঘের গুরুগুরু আওয়াজ। কণ্ঠে কত রকম ছন্দে কত রকম ধ্বনি। নাদব্রহ্ম কথাটা শুধু শুনেই এসেছি, সেদিন প্রত্যক্ষ করলাম।

মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখছি রণজিৎ সিং-এর দিকে। যেন আফিং-এর নেশায় বুদ হয়ে বৃদ্ধ ঝিমোচ্ছে। দুই পায়ের মাঝখানে রাখা লাঠিটার ঘোড়ামুখখা বাটে দুই হাত রেখে তার উপর থুতনিটা ঠেকিয়ে চোখ বুজে বসে আছেন রণজিৎ সিংজী। কোন সাড়াশব্দ নেই।

গান ধীরে মহুরে শুরু হয়ে পরতে পরতে বিস্ময় সৃষ্টি করে এক উত্তেজনার শিখর থেকে আরেক শিখরে ছুটে চলেছে। আর সঙ্গে সঙ্গে সমঝদার শ্রোতারা হায় হায় শব্দে ফেটে পড়ছেন। কিন্তু রণজিৎ সিংজী সেই যে চোখ বুজে পাথরের মত স্থির হয়ে বসে আছেন তো আছেনই। ডানদিকের ঠোটটা যেন অনেকখানি স্কুলে পড়েছে, সেই সঙ্গে গোঁফও। সন্দেহ জাগল, বুড়ো গান শুনছে না ঘুমচ্ছে। গানের আসরে শ্রোতারূপে যে-রস আমি উপভোগ করছি তা আমার পাশের পরিচিত লোকটিও সমান উপভোগ করছে জানতে পারলে আনন্দ হয়। সেইজন্যে এই ধরনের আসরে কখনও কোন রকম সাড়া না পেয়ে মনটা দমে গেল। আমার আনন্দের ভাগ দেব তা হলে কাকে?

বেলা চারটের সময় আসর ভাঙ্গল। পুরো চারঘণ্টা একজনের গান এক নাগাড়ে শোনার অভিজ্ঞতা আমার সেই প্রথম। কিন্তু গায়কের চোখেমুখে ক্লান্তির কোন চিহ্ন নেই। পরম তৃপ্তির আনন্দ নিয়ে শ্রোতারা প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে-রণজিৎ সিং-এর কিন্তু উঠবার নাম নেই, ঠিক সেই ভাবেই বসে আছেন। আর সন্দেহ রইল না, বুড়ো নির্ঘাত ঘুমুচ্ছে। ডেকে তুলব কি না ভাবছি, হঠাৎ লাঠির মাথায় রাখা দুই হাতের চেটোতে ভর দিয়ে থুতনি নড়ে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে একটা অস্ফুট ধ্বনি, একটা চাপা ক্রনের শব্দ।

–কি হল রণজিৎ সিংজী, কি হল? ওঁর গায়ে হাত দিলাম, শরীরটা থরথর করে কাপছে। শুধু বললেন–হাড় গুড়িয়ে দিলে। এই কথা বলেই আমার দিকে মুখ তুলে তাকালেন, চোখে নেশাগ্রস্ত মানুষের ঘোলাটে দৃষ্টি। চোখের জলে বৃদ্ধের দুই গাল ভেসে গেছে। বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় শুধু বললেন—মুঝে ভগবানকো পা মিলা। যব গানা খতম হুয়ী ওহ, চলে গয়ে।

হল ছেড়ে আবার টাঙ্গায় চড়ে নিজেদের ডেরায় ফিরলাম—সারা রাস্তা রণজিৎ সিং-এর মুখে ঘুরে ফিরে শুধু একটি মাত্র কাতর বিলাপ ওহ, চলে গয়ে।

এ-কাহিনী বলার পর বৈঠকের বন্ধুদের মুখে আর কথা নেই, সবাই চুপ। আমি বললাম-তাহলে বুঝতে পারছেন সংগীতের আবেদন মানুষের অন্তরে কত গভীর।

বিশুদা কিন্তু ছাড়বার পাত্র নন। আমার কথার পাল্টা জবাবে বললেন–আপনাদের রণজিৎ সিং ছিলেন সংগীতপ্রেমীলোক। শুধু তাই নয়, সংগীত সাধকও। কিন্তু আমাদের কাছে ওস্তাদি গান শুধু কসরত বলে মনে হয়।

আসরের গাল্পিক সাহিত্যিক বললেন—ওস্তাদী গানের সমঝদার হতে হলে নিজের মধ্যে খানিকটা প্রস্তুতি থাকা চাই। এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ গায়ক ও শ্রোতার সম্পর্ক সম্বন্ধে বলেছেনএকাকী গায়কের নহে তো গান, গাহিতে হবে দুইজনে। গায়কের সঙ্গে শ্রোতার অন্তরের তন্ত্রী একসুরে বাঁধা থাকা চাই।

সব্যসাচী লেখক বললেন–রণজিৎ সিং-এর আরও কিছু ঘটনা আমাদের বলুন।

না-লিখে-সাহিত্যিক বিশুদা বললেন—ও, গল্প লেখার খোক বুঝি জোগাড় করছেন।

আমি বললাম-সে দিনের ঘটনায় মানুষটির চরিত্রের আরেকটা দিক আমার কাছে খুলে গেল। এবার আমি ওঁর পুরোপুরি চ্যালা বনে গেলাম। কিন্তু তাঁর শাগরেদ করার সৌভাগ্য আমার বেশিদিন হয় নি।

ওঁর শরীর ক্রমশই খারাপ হয়ে পড়েছিল। একা মানুষ, তার উপর সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ। পাক খেতেন। শরীর ভেঙ্গে পড়ায় কিছুদিনের ছুটি নিয়ে বিশ্রামের জন্য বহরমপুর গেলেন আর ফিরলেন না। শান্তিনিকেতন ছেড়ে যাবার মাস দেড়েক বাদেই খবর এল তাঁর মৃত্যু হয়েছে।

কথায় কথায় কখন যে আটটা বেজে গেছে টের পাই নি। ওদিকে রঙমহলে কনফারেন্স বোধ হয় শুরু হয়ে গেল। পথে কোন একটা পাঞ্জাবীর দোকানে ঢুকে রুটি আর মাংস-তড়কা খেয়ে সারা রাত জাগতে হবে। বৈঠকের বন্ধুরা উঠি-উঠি করেও উঠছেন না, আড্ডার এমনই মৌতাত। আমার তাড়াতাড়ি উঠবার প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও গতরাত্রে সংগীত সম্মেলনে যে-কাণ্ডটা হয়েছিল তা না বলে থাকতে পারলাম না। আমি বললাম-আপনারাই বলুন, আমার চেহারার সঙ্গে বিখ্যাত গায়ক ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কি খুব বেশী মিল আছে?

বিশুদা জ্বজোড়া কুঁচকে চোখের দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণতা এনে আমাকে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। আমি যেন চিত্র প্রদর্শনীর দেয়ালের ঝোলানো পোট্রেট আর জবরদস্ত আর্ট-ক্রিটিক বিশুদা কখনও সামনে ঝুকে, কখনও চেয়ারের গায়ে শরীরটা টান করে পিছিয়ে নিয়ে, কখনও ডান দিকে হেলে, কখনও বাঁদিকে ঝুকে, আমাকে দেখে নিয়ে বললেন–হু, তা কিছুটা মিল আছে বলেই তো মনে হয়।

আসরের গাল্পিক সাহিত্যিক বললেন–গ্রামোফান রেকর্ডের খামের উপর ভীষ্মদেব চাটুজ্যের যে ফোটো ছাপা হয় তার সঙ্গে চেহারার বেশ আদল

আমি বললাম-এ-কথা আরও অনেকেই আমাকে আগেও বলেছেন, আমি বিশ্বাস করি নি। কিন্তু বিশ্বাস করতে হল গতকাল রাত্রের এক অভাবনীয় ঘটনায়।

সব্যসাচী লেখক বললেন—কি ব্যাপার, একটা কিছু কমেডি অফ এররস ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে।

আমি বললাম-ঠিক তার উল্টো। ট্রাজেডি অফ এররস বলতে পারেন।

গতকাল রাত বারোটার সময় মুস্তাক হুসেন খাঁ আসর থেকে গান গেয়ে বিদায় নিলেন, তার পরে ছিল সরোদ বাজনা। এই অবসরে পান-জর্দা খেয়ে ঘুম তাড়াবার মতলবে অডিটরিয়ম থেকে বেরিয়ে বারান্দা ধরে এগোচ্ছি কোণার পানের দোকানের দিকে। হঠাৎ নজরে পড়ল সামনে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে আমাকে নিরীক্ষণ করছেন। কঁচা-পাকা গোঁফ, পরনে গিলে হাতা আদ্দির পাঞ্জাবি, কাঁধে পাট করা গরম শাল, বাঁ-হাতে কেঁচানন ধুতির খুট ধরা, ডান হাতে হাতির দাঁতের বাঁট লাগানো ছড়ি। ভদ্রলোকের কাছে যখন এসে পড়েছি হঠাৎ ঢিপ করে আমাকে এক প্রণাম; একেবারে পা ছুঁয়ে প্রণাম। খুড়োর বয়েসী ভদ্রলোকের এমন অতর্কিত আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। এক লাফে বেশ খানিক পিছনে হটে গেলাম। মুখে বিগলিত হাসি এনে গদগদ ভাষায় বললেন–ওস্তাদ, ঠিক চিনতে পেরেছি। শুনেছি আপনি কলকাতায় ফিরে এসেছেন। এখন আপনার শরীর সুস্থ তো?

ভদ্রলোকের দুই হাত ধরে ক্ষমা প্রার্থনা করে বললাম-দেখুন, আমি আপনার ওস্তাদ ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় নই। আপনি কেন, অনেকেই এই ভুল করে থাকেন।

আমি পানের দোকানে জর্দা-পানের অর্ডার দিয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি বারান্দার সেই ভদ্রলোক, সেই জায়গাতেই, বিমূঢ়ের মত আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। বোধ হয় তখনও তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না যে আমি ভীষ্মদেব নই।

এই ঘটনা বলার পরই দেখি বিশুদা পকেট থেকে একটা আধ খাওয়া সিগারেট বার করে ঠোটে গুঁজে হাতটা টেবিলের উপর মেলে ধরে বললেন–

দেশলাই।

সিগারেট ধরালেন, ধোঁয়াটা এড়াবার জন্যে চোখ-দুটো আধবোজা অবস্থায় রেখে বললেন–চা।

এই রে! রাত প্রায় নটা বাজে, এখন আবার চা! বুঝলাম বিশুদার পেটের ভিতর একটা গল্প ভুড়ভুড়ি কাটছে, শুধু এক কাপ চায়ের অপেক্ষা।

আমার তখন একমাত্র ভাবনা, এতক্ষণে বুঝি আলাউদ্দিন খা সাহেবের বাজনা আরম্ভ হয়ে গিয়েছে।

বিশুদা চা-এর জন্য আবার তাগাদা দিয়ে বললেন–আপনাকে দেখে লোকটা ভীষ্মদেব চাটুজ্যে বলে ভুল করেছিল। কিন্তু আমি আর একটা ঘটনা জানি। শরৎ চাটুজ্যেকে দেখে একটা লোক শরৎ চাটুজ্যে বলে ভুল করেছিল। কই, চা আসুক।

হাতজোড় করে বিশুদাকে অনুরোধ জানালাম-বিশুদা, আপনার গল্প শুনতে গেলে আমার বাজনা শোনা হবে না। ওটা আসছে শনিবারের জন্য ভোলা থাক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *