১৪. পাঠকের দরবারে আসামীর মত

সম্পাদককেও যে লেখকরা কখনও কখনও পাঠকের দরবারে আসামীর মত হাজির করিয়ে ছাড়েন তারই এক করুণ ও তিক্ত অভিজ্ঞতা আমার একবার ঘটেছিল, যার উল্লেখ মাত্র করেছিলাম কয়েক মাস আগের এই বৈঠকে, যেদিন আড্ডার অন্যতম গল্পবাজ সভ্য বিশুদা এসে বলেছিলেন প্রভাত দেব সরকারের পূজা সংখ্যার গল্প বিনিয়োগ পড়ে জনৈক পাঠক লেখককে হাতের কাছে না পেয়ে তার দাদাকেই বেধড়ক পিটিয়েছে।

সেই সঙ্গে বিশুদা আমাকে দুশচিন্তায় ফেলে দিয়েছিলেন এই বলে যে, যেহেতু গল্পটি আমিই প্রকাশ করেছি সেই হেতু উক্ত মারকুটে পাঠক নাকি আমাকেও রেহাই দেবে না।

লেখকদেরও বলিহারি! আজকাল কোনও কোনও গল্প-লেখকদের মধ্যে কিছুকাল যাবৎ একটা প্রবণতা দেখা দিয়েছে যে, বাস্তব জীবন ও চরিত্র নিয়ে গল্প লিখতে হবে, কোনরকম কল্পনার ভেজাল তাতে থাকবে না। যা ঘটেছে এবং যা দেখেছি হুবহু তাই নিয়েই হবে গল্প। আজকালকার পাঠকরা নাকি বাস্তব ঘটনায়ী গল্প চায়, কল্পিত ঘটনায় তাদের অরুচি। আমার কিন্তু এতে আপত্তি ছিল না। আপত্তি হত না, যদি না এই বাস্তবধর্মী গল্প-প্রকাশের পরিণাম এমন মর্মান্তিক পরিহাসরূপে আমার জীবনে দেখা দিত।

বাস্তব ঘটনা নিয়ে লিখতে চান লিখুন, গল্প হলেই হল। এই গল্প হওয়াটাই হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন কাজ এবং বাস্তব জীবনের কোনও একটি ঘটনাকে শিল্পকর্মে রূপ দেওয়াই হচ্ছে লেখকের কৃতিত্বের চরম সার্থকতা। প্রতিদিনই আমরা আমাদের চারিপাশে পরিচিত জনের জীবনে গল্পের মাল মসলা দেখতে পাই। রিয়ালিস্টিক সাহিত্যের মোহ পড়ে লেখক যদি মাল মসলাকে হুবহু লেখায় তুলে ধরেন তা কখনই গল্প হবে না, সেটা হবে রিপোর্টাজ। ফটোগ্রাফ আর শিল্পীর হাতে আঁকা ছবির যে প্রভেদ, রিপোর্টাজ আর গল্পেও সেই প্রভেদ। শিল্পী যখনই শহরের রাস্তার একটি ভিখারী বালিকার ছবি তুলির রেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন তখনই সেই বালিকার অন্তর্নিহিত বেদনার একটি বিশেষ অভিব্যক্তিকে তিনি দর্শকের কাছে তুলে ধরার প্রয়াসী। সেই সঙ্গে শিল্পী তাঁর নিজের মনকেও সেই ছবির মধ্যে ঢেলে দেবার চেষ্টা করেন, তাঁর মনের প্রতিক্রিয়া সেই ছবির প্রতি টানে ধরা পড়ে যায়। তাকেই বলে শিল্পকর্ম। গল্প রচনার ক্ষেত্রেও এই শিল্পকর্মই হচ্ছে প্রধান কথা।

আমার যে-অভিজ্ঞতার কথা আজ আপনাদের কাছে বলতে যাচ্ছি তা আমার জীবনে কখনই ঘটত না, যদি না, প্রভাত পূজা সংখ্যায় বিনিয়োগের মৃত রিয়ালিষ্টিক গল্প না লিখত। সে-অভিজ্ঞতা বলার আগে বিনিয়োগ গল্পের সারার্থ আপনাদের কাছে না বলে রাখলে আমার এই অভিজ্ঞতার কাহিনীর মধ্যে যে বেদনা নিহিত আছে তা আপনারা উপলব্ধি করতে পারবেন না। আমি চাই, আমার সেদিনের অভিজ্ঞতা আমার এই লেখার পাঠকদের সঙ্গে আরেকবার এক পংক্তিতে বসে সমান ভাগে ভাগ করে নিতে এবং সেই জন্যেই কিছুকাল আগে এ-প্রসঙ্গের একটু উল্লেখ করে আজ সবিস্তারে বলতে বসেছি।

প্রভাত দেব সরকারের বিনিয়োগ গল্পের দুটি প্রধান চরিত্রই হচ্ছে দুই অন্তরঙ্গ বন্ধু। সুধাংশু আর দিব্যেন্দু। দুজনেই মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। ছাত্রজীবনে সুধাংশু প্রায় প্রতিদিনই দিব্যেন্দুর বাড়ি যেত, আচ্ছা চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বিধবা মায়ের একমাত্র অবলম্বন ওই ছেলে দিব্যেন্দু ও মেয়ে সুনীতি। তাদের মানুষ করে তোলার জন্য আর্থিক সংকটের মধ্যেও মায়ের সংগ্রাম দিনের পর দিন সুধাংশু দেখেছে। দিব্যেন্দুর বোন সুনীতি বয়সে কচি খুকী হলে কী হবে, চেহারায় যেমন মাধুরী ছিল, তার চেয়ে ঢের বেশী মাধুর্য সে ঢেলে দিত তার গানের গলায়। এই গান শোনবার লোভেই সুধাংশু ছাত্রজীবনে দিব্যেন্দুর বাড়ি কারণে-অকারণে গিয়ে আড্ডা

জমিয়েছে।

কলেজের পাট চুকিয়ে দিয়ে চাকরির ধান্দায় কে কোথায় ছড়িয়ে পড়ল, দুই বন্ধুর মধ্যে দীর্ঘকাল আর দেখা-সাক্ষাৎ নেই।

বহু বছর বাদে অকস্মাৎ দেখা হয়ে গেল সুধাংশুর সঙ্গে দিব্যেন্দুর। খবরের কাগজে সরকারী আফিসের একটা কেরানীর কাজের বিজ্ঞপ্তি দেখে সুধাংশু দরখাস্ত করেছিল। সেই দরখাস্তের কী হল না হল তারই একটু খোঁজ-খবর নিতে গিয়ে হঠাৎ সেই অফিসের সিঁড়িতে দেখা হয়ে গেল দিব্যেন্দুর সঙ্গে। দিব্যেন্দুর চেহারা, চালচলন, সাজপোশাক সব পাল্টে গেছে, চেনবার উপায় নেই। একেবারে পাক্কা সাহেব। সুধাংশুকে প্রথমেই জানিয়ে দিলে ওরকম বাঙালী মার্কা ধুতি পাঞ্জাবি চেহারায় এ-অফিসে কেরানীর চাকরিও জোটে না। ইন্টারভিউতেই আস্মার্ট বলে নাকচ হয়ে যাবে। আরও জানিয়ে দিলে, যদিও সে সামান্য টাইপিস্টের চাকরি নিয়ে ঢুকেছিল, আজ সে বড় সাহেবের পি. এ.। আঙুল দিয়ে দেখিয়েও দিলে অদূরে দরজায় লেখা আছে ভি. মুখাজি, পি. এ.।

সুধাংশুর খোঁজ নিয়ে দিব্যেন্দু জানলে সে-এখন পাঁচ ছেলের বাবা, সামান্য মাইনের সরকারী চাকরি করে অন্যত্র। কিন্তু এ-চাকরিটা পেলে পরিশ্রম কিছুটা লাঘব হয়, তাছাড়া কাজটাও মনের মতন। সুধাংশুর যাতে চাকরিটা হয়ে যায় সে আশ্বাস দিয়ে দিব্যেন্দু বললে একদিন ওর বাড়িতে আসতে। আগের বাড়িতে নেই, নতুন বাড়িতে উঠে গেছে। বোন সুনীতির বিয়ে দেবার জন্য খুবই চেষ্টা করছে, হাজার দশ-বারো টাকা খরচ করতেও প্রস্তুত। কিন্তু বাংলা দেশে উপযুক্ত পাত্র মেলা দুরূহ বলেই বিয়ে দিতে পারছে না। বোনর বিয়ে না দিতে পারলেও নিজে কিন্তু এক বড়লোকের মেয়েকে সম্প্রতি বিয়ে করেছে, সে-কথা সুধাংশুকে জানাতে ভোলে নি দিব্যেন্দু। দিব্যেন্দুর লম্বা-চওড়া কথাবার্তা সুধাংশুর যেন ভাল লাগল না। মানুষটা যেন অন্য রকম হয়ে গেছে। তবু চাকরির আশ্বাস পেয়ে খুশি মনেই সুধাংশু চলে এল, আসবার সময় কথা দিয়ে এল একদিন ওর বাড়ি যাবে।

কিছুদিন পর এক ছুটির দিন বিকালে সত্যি সত্যিই সুধাংশু রাস্তা আর বাড়ির নম্বর খুঁজে দিব্যেন্দুর বাড়িতে এসে হাজির। ওর অনুরোধে সুনীতির জন্য একটি ভাল পাত্রের সন্ধান যোগাড় করেছে সেটা তাকে জানিয়ে আসা দরকার আর সেই সঙ্গে চাকরিটারও একটু খোজ খবর।

কড়া নাড়তেই কিছুক্ষণ পরে একটি নারীমুর্তি দরজা খুলে দেখা দিল। সুধাংশু চিনতে পারল সুনীতিকে। বয়সের স্বাভাবিক সৌন্দর্য কেমন যেন ম্লান হয়ে গেছে অনেক দিনের ফোঁটাফুল বৃস্তচ্যুত না হওয়ার মত। দিব্যেন্দুর কথা জিজ্ঞাসা করতেই জানতে পারল, শ্বশুরবাড়ি থেকে গাড়ি এসেছিল, দিব্যেন্দু বউকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে গেছে। মা গেছে কালীঘাটে, বাড়িতে

একাই আছে সুনীতি।

সুধাংশু অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞাসা করল।

তুমি তা হলে একলা আছ?

একলাই তত থাকি।

আজকাল গানটান গাও না?

শুনবে কে?

কেন, নিজে।

সব জিনিস কি নিজের জন্য হয়?

পর্দাতে আঁকা-ছবির মত স্থির নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুনীতি। সুধাংশুর কথা ফুরিয়ে গেছে। অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করবার ছিল, সব যেন গোলমাল হয়ে গেছে। সুধাংশু যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াল।

সুনীতিরও বোধ হয় কিছু বলবার নেই। সুধাংশু চলে যাবার সময় আলো নিবিয়ে সদর দরজা বন্ধ করতে করতে সুনীতি যেন নিজেকে শুনিয়ে অস্ফুটে বললে, কেন মিথ্যে আপনারা চেষ্টা করছেন-আমি ভালই আছি।

সুধাংশু চমকে ফিরে তাকাল। অন্ধকারে আধভেজানো দরজার ফাঁকে দুটি সজল চোখ দেখা গেল মুহূর্তের জন্য। তার সুদীর্ঘ কুমারী জীবনের কোনও দুঃখের কথাই বোধ হয় সে বলতে চাইল। সুধাংশু সেই কথাই ভাবতে ভাবতে চলে এল।

ছমাস পরে সুধাংশুর ইন্টারভিউর ডাক এল। খুশি হলেও আর যেন চাকরিটার ওপর তেমন লোভ নেই সুধাংশুর। দিব্যেন্দুর অফিস, দু-বেলা হামবাগটার লম্বা লম্বা কথা শুনতে হবে।

তবু হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা ঠিক নয় ভেবে ইন্টারভিউতে যাওয়াই স্থির করলে। বিদ্যে বুদ্ধি যখন তারও আছে তখন দিব্যেন্দুর মত উন্নতি সেও বা করতে পারবে না কেন?

নতুন অফিসের হাল-চাল জানবার জন্যে সুধাংশু সোজা দিব্যেন্দুর ঘরে উপস্থিত হল। কিন্তু দরজা খুলেই সুধাংশু পিছিয়ে এল, দিব্যেন্দুর জায়গায় অন্যলোক।

অপ্রস্তুতি কাটিয়ে উঠে মিঃ মুখার্জির কথা জিজ্ঞাসা করতেই ভদ্রলোক বেল বাজিয়ে চাপরাসীকে ডেকে বললেন–ডি পি-র ঘরে নিয়ে যাও।

বেরিয়ে চাপরাশীকে সুধাংশু জিজ্ঞাসা করলে, ডি পি কেন হ্যায়?

চাপরাসী বললে-বড় সাহাব আছেন, ডিরেক্টর সাহাব।

এতক্ষণে দিব্যেন্দুর নতুন পদের তাৎপর্য বুঝতে পারে সে। ডিরেকটার অব, পারশোনে। দিব্যেন্দু করেছে কি? পাঁচ শো থেকে একেবারে বানো শো?

এবারে আমি বিনিয়োগ গল্পের শেষ কটি লাইন লেখকের ভাষায় হুবহু তুলে দিচ্ছি যাতে মারপিটের উত্তেজক কারণটি কোথায় নিহিত তা আপনাদের ধরতে সুবিধা হয়।

সুধাংশু ভাবলে এখানে চাকরি করার চেয়ে সরে পড়াই যেন ভাল। ওই দিব্যেন্দু এ-অফিসের কর্তা, নিয়োগ-বদলির দণ্ডমুণ্ড।

বড় সাহেবের দরজার সামনে এসে সুধাংশু দাঁড়াল, বিদ্যুৎস্পৃটের মত একটা সন্দেহ তার মাথায় খেলে গেল-দিব্যেন্দুর এই পদোন্নতিতে নারী-রূপরস-সুরের কোন পরোক্ষ হাত নেই তো? মিস্টার শিবলিঙ্গ কি দিব্যেন্দুকে এমনি সুনজরে দেখেছিল? কিসের বিনিময়ে এসমৃদ্ধি দিব্যেন্দুর? সেদিন সুনীতির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এর যেন আভাষ সুধাংশু পেয়েছিল। আপনারা মিথ্যে চেষ্টা করছেন, আমি ভালই আছি-মানে কি?

ডিরেক্টর সাহেবের কামরার একটা পাল্পা ফাঁক করে চাপরাসীটা তখনও অপেক্ষা করে।

ঠিক এই মুহুর্তে বন্ধুকে সম্বর্ধনা করা উচিত হবে কি না ভেবে ঠিক না। করতে পেরেই বোধ হয় সুধাংশু পা-পা পিছিয়ে যায়। ভয়ে।

গল্পের এইখানেই শেষ।

গল্পটা পূজা সংখ্যায় প্রকাশিত হবার আগে প্রভাত নিজেই প্রথম প্রুফ দেখে দিয়েছিল। মেক-আপ প্রুফ আমরাই দেখে দিয়েছি, পরের দিন সকালে প্রেস-এ ফর্মা ছাপতে যাবে। হঠাৎ সন্ধ্যেবেলা টেলিফোনে প্রভাত বললে যে, সে প্রফটা আরেকবার দেখতে চায়, দু-একটা শব্দ অদল-বদল করতে হবে।

সেদিন সন্ধ্যায় আমার একটু তাড়াতাড়ি বেরোবার তাড়া ছিল, তাই মেকআপ, ম্যানকে বলে গেলাম প্রভাত এলে প্রুফটা ওকে আরেকবার দেখাতে।

পরদিন সকালে অফিসে গিয়ে দেখি ফর্মা যেমন-কে-তেমন পড়ে আছে, ছাপাখানায় যায় নি। মে-আপ ম্যান প্রভাতের দেখা প্রফগুলি আমার টেবিলে হাজির করে বললে-কী করে ফর্মা যাবে বলুন? সব গল্পটা তো আবার কম্পোজ করতে হবে।

মানে? পেজ-প্রুফের উপর তাকিয়ে দেখি লেখক সুধাংশুর বন্ধুর নামটা বদলে আগাগোড়া দিব্যেন্দু করে রেখেছে। গল্পের প্রতি লাইনেই সুধাংশুর বন্ধুর উল্লেখ, এবং তা বদলাতে গেলে সবটা পুনর্বার কম্পোজ করা ছাড়া উপায় নেই। লাইনো যন্ত্রের অনেক সুবিধার মধ্যে ওই-একটি মস্ত অসুবিধা হচ্ছে যে, লাইনের একটি কমা বা দাড়ি বদলাতে হলে পুরো লাইনটাই আবার কম্পোজ করতে হয়।

একবার ভাবলাম ফর্মা না আটকে রেখে যেমন আছে তেমনি ছেড়ে দিই।

কিন্তু আগাগোড়া রি-কম্পোজ হবে জেনেও প্রভাত যখন নামটা পালটেছে তখন নিশ্চয় কোন বিশেষ কারণ আছে মনে করেই সংশোধন করতেই বলে দিলাম।

তখন কি আর জানতাম যে রিয়ালিষ্টিক গল্প লিখতে গিয়ে প্রভাত দিব্যেন্দুক চাকুরি ক্ষেত্র, তার বাড়ির পরিবেশ এমনকি তার পৈত্রিক নামটাও সে হুবহু রেখে দিয়েছে! শেষ মুহূর্তে শুভবুদ্ধির উদয় হতে শুধু নামটুকু পালটে দিয়ে আইনকে হয়তো ফাঁকি দিয়েছে কিন্তু যাকে নিয়ে গল্প তার কাছে তো ধরা পড়তেই হবে এবং আইন যে সে আবার নিজের হাতেই নিয়ে বসবেগল্প লেখার নেশায় বোধ হয় সেদিন প্রভাতের সে হুঁশ ছিল না।

দিব্যেন্দুর আসল নামটা ওই একই কারণে আপনাদের কাছে আমি প্রকাশ করতে অপারগ, সুতরাং প্রভাতের দেওয়া নামেই আমি একাহিনী বলছি।

পূজা সংখ্যা প্রকাশিত হল মহালয়ার আগের দিন বিকেলে, মহালয়ার পরের দিন বিকেলে দুমুখ বিশুদা দুঃসংবাদ নিয়ে এসে আমার মধ্যেও ভয় ঢুকিয়ে দিলেন। পরদিন সকালেই সাতদিনের ছুটি নিয়ে চলে গেলাম শান্তিনিকেতন, কাজ কি এসময় কলকাতায় থেকে।

সাত দিন পর কলকাতায় ফিরেই প্রথম খোঁজ করলাম প্রভাতের। কেন ও এ-গল্প লিখে ওর বন্ধুকে এমন বে-ইজ্জত করল, আর কেনই বা মাঝখান থেকে প্রভাতের নিরীহ দাদা মার খেল। তাছাড়া দিব্যেন্দু এখনও ক্ষেপে আছে কি-না সেটাও জানা দরকার। যণ্ডামার্কা চেহারা হলে কি হবে। শুনলাম প্রভাত এক মাসের ছুটি নিয়ে তার পৈত্রিক ভিটে বজবজের কাছে মালা গ্রামে চলে গিয়েছে।

প্রভাতের মত দশাসই চেহারার মানুষটার মনেও কি মার খাবার ভয় ঢুকেছে? তা হলে আমি তো কোন ছার। রীতিমত চটে গেলাম প্রভাতের উপর। একবার সামনে পেলে হয়। অগত্যা ক্রোধটা মনে মনেই পুষে রেখে প্রভাতের পুনরদয়ের দিন গুনছি।

দিব্যেন্দুকে আমি চিনি না। প্রভাতের অন্যান্য বাল্যবন্ধুদের মধ্যে যাদের সাহিত্যের নেশা আছে তাদের অনেকের সঙ্গেই আমার পরিচয় আছে। দিব্যেন্দুর সঙ্গে আমার কোন পরিচয়ই নেই। গল্প পড়ে ওর চেহারার একটা আন্দাজ করে রেখেছিলাম, সুটেড-বুটেড টিপটপ সাহেব, হাতে সিগারেটের টিন। সুতরাং অফিসে যাওয়া-আসার পথে সাহেবী পোশাকপরা যুবকদের দিকে সন্দেহের দৃষ্টি রেখেই চলা-ফেরা করতাম। বলা তো যায় না, জনারণ্যের মধ্যে থেকে হয়তো সাহেবী পোশাকধারী দিব্যেন্দু আমার ঘাড়ে অতর্কিতে লাফিয়ে পড়তে পারে। একদিন দুপুরে অফিসে বসে আছি, টেলিফোন বেজে উঠল।

হ্যালো, কে কথা বলছেন?

আমি বিনয় ঘোষ।

কি খবর বিনয় বাবু, ভাল আছেন তো? কী ব্যাপার?

গম্ভীর গলায় বিনয় বাবু বললেন–ব্যাপার খুবই গুরুতর।

বিখ্যাত ঐতিহাসিক প্রাবন্ধিক বিনয়বাবু আমাদের বহুকালের বন্ধু। এক সময়ে আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়র উনি ছিলেন নিয়মিত লেখক। ১৯৪০-৪১ সালের কথা। প্রতিদিন সন্ধ্যায় অফিসের পর আমরা দল বেঁধে আড্ডা দিয়েছি। সুবোধ ঘোষ, মন্মথনাথ সান্যাল, অরুণ মিত্র, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, বিজন ভট্টাচার্য আর প্রভাত দেবসরকার ছিলেন আমাদের সেদিনের আড্ডার নিত্য সঙ্গী। একেকদিন একেকজনের আস্তানায় আমাদের আড্ডা বসত, গল্প বা প্রবন্ধ পাঠ হত, আর তাই নিয়ে চলতে চুলচেরা আলোচনা, গভীর রাত পর্যন্ত। আমাদের মধ্যে বিনয় ঘোষ ছিলেন প্রভাতের পুরনো বন্ধু। এক পাড়ায় ওরা থাকত, এক কলেজেই পড়েছে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, সেই সঙ্গে জনযুদ্ধের জোয়ারে আমাদের আড্ডার একদল ভেসে গেল অন্যদিকে। সাহিত্য ছেড়ে তখন আজ্ঞায় রাজনীতি নিয়ে শুরু হয়ে গেল তুমুল তর্ক-বিতর্ক, তার ফলে দেখা দিল মতান্তর। মতের পার্থক্য ক্রমশ এত ব্যাপক হয়ে পড়ল যে আড্ডাই গেল ভেঙ্গে, কে-কোথায় ছিটকে পড়ল।

মতান্তর ঘটলেও মনান্তর কখনও আমাদের মধ্যে ঘটে নি। রাস্তায় ঘাটে, সাহিত্যের সভাসমিতিতে দেখা হলে আমাদের পুরনো বন্ধুত্বের জের টেনেই ঘনিষ্ঠভাবে আলাপ করেছি। কিন্তু আমাদের সাহিত্যিক সার মধ্যে সেদিন এমন একটা ব্যবধান তখন সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে যে, পুরনো আচ্ছা আর দানা বাঁধতে পারে নি। রাজনীতির এমনই প্রভাব।

সেই বিনয় ঘোষ টেলিফোন করে বললেন–ব্যাপার গুরুতর।

প্রথমটা বুঝতেই পারি নি কী হল। জনযুদ্ধের রাজনীতি ততদিনে থিতিয়ে এসেছে, সে উন্মাদনাও আর নেই। তা হলে?

বিনয় ঘোষ বললেন—আপনাদের পূজা সংখ্যায় প্রভাতের গল্প নিয়ে যে-কাণ্ড হয়েছে আপনি তা শুনেছেন?

আমি বললাম—সবই শুনেছি, আমি তো প্রভাতের অপেক্ষায় বসে আছি। সে তো মালা গ্রামে গা ঢাকা দিয়েছে।

দুঃখভরা কণ্ঠে বিনয়বাবু বললেন–তার ফলে কি কাণ্ড হয়েছে জানেন? উত্তেজনার বশে দিব্যেন্দু ওর অফিসের কর্মচারী প্রভাতের দাদাকে মেরেছে। এই নিয়ে সারা অফিসে হুলস্থুল।

দিব্যেন্দুর উপর ডিসিপ্লিনারী অ্যাকশন নিতে পারে। শুধু তাই নয়, আজ কিছুদিন ধরে ও অফিসে যাচ্ছে না, বাড়িতেও থাকে না, খাওয়াদাওয়া বন্ধ করেছে, পাগলের মত অবস্থা। ওর বৃদ্ধা মা দিনাত কাঁদছেন, পরিবারে এই নিয়ে ভয়ানক অশান্তি। দিব্যেন্দু আমারও বন্ধু, আমি ওকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছি যে, যা হবার হয়ে গেছে। এর তো আর চারা নেই। কিন্তু কিছুতেই ওকে শান্ত করতে পারছি না। আশঙ্কা হচ্ছে সত্যি সত্যিই না পাগল হয়ে যায়।

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে বিনয়বাবু থামলেন। আমি স্তম্ভিত। এর কি উত্তর দেব? কি প্রতিকার আমি করতে পারি। প্রভাতের রিয়ালিস্টিক গল্প লেখার যে এই পরিণাম হবে আমিই বা তা জানব কি করে?

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বিনয়বাবু আবার বললেন–আমি বুঝতে পারছি আপনি খুবই অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছেন, কিন্তু আপনার একটু সাহায্য আজ একান্তই প্রয়োজন।

দিব্যেন্দুকে আমি চিনি না, জানি না। তবু বিনয়বাবুর মুখে ওর এই অবস্থার কথা শুনে ওর প্রতি সহানুভূতি হল, সমবেদনায় মন ভরে উঠল। আমি বললাম-বলুন বিনয়বাবু, এই অবস্থায় আমি কি করতে পারি।

বিনয়বাবু বললেন—আপনাকে শুধু ওদের বাড়িতে একবার যেতে হবে।

ওদের বাড়িতে? আমি যাব? বলেন কি! না বিনয়বাবু, তা হয়। এরকম পরিস্থিতির সামনে গিয়ে দাঁড়ানো আমার পক্ষে অসম্ভব। আর যা কিছু বলুন, এ-অনুরোধ আমাকে করবেন না।

দুঃখের সঙ্গেই বিনয়বাবু টেলিফোন ছেড়ে দিলেন। ছাড়বার আগে শুধু বললেন—আপনি যখন নিতান্তই যেতে চান না তখন আর আপনাকে বিব্রত করব না। ওদের এই দুঃখের দিনে আপনি গেলে ওরা একটু সান্ত্বনা পেত। দেখি, আমি কি করতে পারি।

বিনয়বাবুর টেলিফোন পাবার পর মন এত দমে গেল যে অফিসের কাজে আর উৎসাহ নেই, দুশ্চিন্তায় রাত্রে ঘুম হল না।

পরদিন বিকেলে বিশুদা হন্তদন্ত হয়ে আমার অফিসে এসেই বললেন–থানায় ডায়েরী করিয়েছেন?

ডায়েরী! আমি থানায় ডায়েরী করতে যাব কোন দুঃখে। সে তো করবে প্রভাত। একেই তো বিনয় ঘোষের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হওয়ার পর থেকে মন-মেজাজ খিচড়ে আছে তার উপর বিশুদার গুলতাপ্পি। একটু রেগেই বললাম

দেখুন বিশুদা, এসব ইয়ার্কি আর ভাল লাগছে না।

অভিমানের সুরেই বিশুদা বললেন–ইয়াকি হল? যা আমার আর কি। খবরটা শুনে আপনার জন্যে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম বলেই অফিসের পর লোকের ভিড় ঠেলে ছুটতে ছুটতে আসা।

বিশুদার মুখে আবার কি খবর? ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করতেই বললেন–আমার পাড়ার সেই ছেলেটা, যে প্রভাতের দাদার অফিসে কাজ করে, সে আজ সকালে এসে বলে গেল যে পকেটে মস্ত এক ছোরা নিয়ে সে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাই বলছিলাম থানায় ডায়েরী করে রাখুন।

বিশুদাকে আর এক ধাপ রাগাবার জন্যে হেসে বললাম-যুদ্ধের সময়ের গুজবে কান দিবেন না পোস্টারগুলো এখনো কলকাতার দেয়াল থেকে উঠে যায় নি। আপনার এ-কথায় তাই আর কান দিলাম না।

বিশুদা ততোধিক গম্ভীর হয়ে বললেন—কান দেওয়া-না-দেওয়া আপনার ইচ্ছা। কথাটা যে আপৎকালে গ্রাহ্য হবে না আমি তা জানতুম। আমার কর্তব্য আমি করে গেলাম।

মহৎ কর্তব্য সমাধা করে, অর্থাৎ আমার মনে আরও খানিকটা ভয় ঢুকিয়ে দিয়ে বিশুদা কেটে পড়লেন। তবু ভরসা করে বলতে পারলাম না যে একই পাড়ায় যখন থাকি একসঙ্গে বাড়ি ফেরা যাক, যদি আমার মানসিক অবস্থা ওঁর কাছে ধরা পড়ে যায়।

পরদিন সকালে আমার বাড়ির তিনতলা ফ্ল্যাটের দক্ষিণ-ঘরের খাটের তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে অর্ধ শায়িত অবস্থায় খবরের কাগজ পড়ছি। অগ্রহায়ণের শেষ, আসন্ন শীতের মিঠে নোদর জানালা দিয়ে পিঠে এসে পড়েছে। গৃহিণীকে এককাপ গরম চায়ের ফরমাশ দিয়ে পত্রিকার সম্পাদকীয় স্তম্ভে মনোনিবেশ করেছি, এমন সময় দরজার কড়া নাড়ার শব্দ পেলাম। গৃহিণী এসে বললেন–একজন ভদ্রলোক তোমার সঙ্গে দেখা করতে চান, একে আগে কখনও দেখি নি।

সাহেবী পোশাক-পরা কেউ নয় তো?

না, একেবারে খাঁটি বাঙ্গালী।

তা হলে পাঠিয়ে দাও।

এই বলে আমি কৃষ্ণের কপট নিদ্রার মত অধশায়িত অবস্থাতেই খবরের কাগজের কপট পাঠক সেজে দৈনিক পত্রিকাটা মুখের উপর মেলে ধরলাম। ভাবখানা যেন ঝানু সাংবাদিক আমি, সংবাদের নির্যাস নিতে বড়ই ব্যস্ত। আগন্তুক ঘরে ঢুকতেই আড়চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়েই কাগজ ফেলে রেখে উঠে টান হয়ে বসলাম। ভদ্রলোককে আগে কখনও দেখি নি, কিন্তু মুখের সরল বিনম্র হাসিটির মধ্যে যে-আন্তরিকতা ফুটে উঠেছিল আমাকে তা আকর্ষণ করল। পরনে মাল-কেঁাচা-মারা ধুতি, গায়ে ঘি-রঙের পপলিন শার্ট, হাতের আন্তিন গোটানো। বয়েস অনুমান করলাম প্রাক্-তিরিশ হবে।

যুবকটি দাঁড়িয়েই ছিলেন। বসবার জন্য অনুরোধ করতে কুণ্ঠিতচিত্তে চেয়ারে বসে বললেন–সকাল বেলায় আপনাকে বিরক্ত করতে এসেছি, অপরাধ নেবেন না। না-এসেও আমার উপায় ছিল না, তাই বিনয় ঘোষের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে আমিই চলে এলাম আপনার বাড়ি। আপনার অফিসে তো আর এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যায় না।

আমি শঙ্কিতচিত্তে জিজ্ঞাসা করলাম–আপনিই কি দিব্যেন্দু?

আজ্ঞে না, আমি তার ভগ্নিপতি। বছর দুই হল ওর বোনকে আমি বিয়ে করেছি। আমরা থাকি বাংলাদেশের বাইরে। আমার স্ত্রী শাশুড়ীর একমাত্র মেয়ে, তাই অনেক করে লিখেছিলেন পুজোর ছুটিতে কলকাতায় আসতে। এক মাসের ছুটি নিয়ে এসেই তো এই অশান্তির মধ্যে পড়ে গেছি। সবই তো শুনেছেন বিনয়বাবুর কাছে।

আমি সবই শুনেছি, শুনে খুব দুঃখও পেয়েছি। বিনয়বাবু আমাকে আপনাদের বাড়ি নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আপনিই বলুন, এরকম একটা অবস্থা যেখানে, সেখানে কোন মুখ নিয়ে আমি তাদের কাছে উপস্থিত হব, কী-ই বা সান্ত্বনা তাদের দিতে পারি।

ভদ্রলোক দু হাত জোড় করে অনুরোধ জানিয়ে বললেন—তবু আপনাকে একবার যেতে হবে সাগরবাবু, এ আমার একান্ত অনুরোধ আপনার কাছে। কেন বলছি জানেন? আমি আমার শাশুড়ীকে শ্যালককে অনেক বুঝিয়েছি। একটা গল্পের মধ্যে কে-কি লিখেছে তা গায়ে মাখবার দরকার কি। তার শুধু এক কথা—আমার বোনকে নিয়ে, আমাকে নিয়ে প্রভাত যে জঘন্য ইঙ্গিত করেছে তার জ্বালা আমি সইতে পারছি না। আমি ওকে বলি, এসব গায়ে

মাখলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। ওর না হয় বোন, আরে সে তো আমারও স্ত্রী। আমি তো ওর মতন উন্মাদ হয়ে যাই নি।

ভদ্রলোকের কথায় আমি বিস্ময় বোধ করলাম। এ-ক্ষেত্রে এমন মানসিক স্থৈর্য আশাই করা যায় না। তবু কৌতূহলবশে জিজ্ঞাসা করলাম

আচ্ছা, আপনার স্ত্রী এ-বিষয়ে কী বলেন?

আমার স্ত্রী আমার চেয়েও বেশী নির্লজ্জ। গল্পটা পড়ে তো হেসেই বাঁচে। সব সময় আমাকে ঠাট্টা করে বলে–কী গো, রামচন্দ্রের মত তুমিও বলবে না কি-সমাজরঞ্জন তরে সুনীতিরে বিসর্জন দিব।

একথা বলেই ভদ্রলোক উচ্চৈঃস্বরে প্রাণখোলা হাসি হাসলেন, আমিও যোগ দিলাম। হাসতে হাসতেই বললেন–আমার স্ত্রী কিন্তু এই ব্যাপারটা খুব স্পাের্টিংলি নিয়েছেন। খুব হাসি-খুশি মানুষ কি না।

কথাটা বলেই ভদ্রলোক লজ্জায় পড়ে গেলেন। আমার সামনে স্ত্রীর প্রশংসায় প্রগলভ হয়ে পড়েছেন-এইটেই ওঁর সঙ্কোচ। আমি কিন্তু মনে মনে খুব খুশী হলাম এই ভেবে যে, প্রভাত বিনিয়োগ গল্প লিখে এই দুটি মানুষের সুখী দাম্পত্যজীবনে বিঘ্ন ঘটাতে পারে নি।

ভদ্রলোক এবার নিজের সঙ্কোচ কাটিয়ে উঠে সানুনয় কণ্ঠে বললেন–অনেক বাজে কথা বলে আপনার সময় নষ্ট করলাম, অথচ যে-জন্যে আসা সেটাই বলা হল না। আপনাকে কিন্তু আমাদের ওখানে একবার যেতেই হবে। আমি কথা দিচ্ছি, আপনার কোনরকম অসম্মান বা অপ্রস্তুতে পড়বার কোন কারণ ঘটবে না। আর কিছুর জন্যে নয়, আমার শাশুড়ীর কথা ভেবেই আপনাকে এই অনুরোধ করছি। ছেলের এই অবস্থা দেখে দিনরাত কান্নাকাটি করছেন, তার কষ্টই আমাদের বড় বেশী বিচলিত করেছে। আপনি শুধু একবার গিয়ে দুটো সান্ত্বনার কথা বললেই উনি মনে অনেকখানি জোর পাবেন। আপনি কথা দিন আপনি আসবেন।

ভদ্রলোকের অমায়িক কথাবার্তা ও ব্যবহারে আন্তরিকতার কোন কার্পণ্যই ছিল না, আন্তরিকতা আপনা থেকেই গড়ে উঠেছিল। তাই আর দ্বিরুক্তি না করে কথা দিলাম। যতই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি হোক, মুখখামুখি হয়ে। দেখাই যাক না কি হয়।

আমি বললাম-বলুন কবে যেতে হবে।

খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে ভদ্রলোক বললেন—আপনার যেদিন সুবিধা আসুন। বিনয়বাবু আমাদের বাড়ি চেনেন, তিনি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে আপনাকে নিয়ে আসবেন।

স্থির হল রবিবার সন্ধ্যা ছটায় ওঁদের বাড়ি যাব।

সে-সময় রবিবার আমাকে অফিসে যেতে হত। ছুটির দিনে অফিসে লোক জনের সমাগম কম হয় বলে সন্ধ্যার পর আটকা পড়ার সম্ভাবনা থাকে না। সুতরাং রবিবার দুপুরে বিনয়বাবু যেন অফিসে টেলিফোন করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে নেন।

কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ভদ্রলোক বিদায় নিলেন। মনে হল ওর মন থেকে মন্তবড় একটা বোঝা নেমে গেল। আমিও অনুভব করলাম যে আমারও মন যেন হালকা হয়ে গেছে। দুঃখের দিনে মানুষকে খুশী করতে পারার মধ্যে তৃপ্তি আছে, আমার দিক দিয়েও তো আমি কম লাভবান হই নি।

 

রবিবার দিন দুপুরে অফিসে একা বসে কাজ করছি, টেলিফোন বেজে উঠল। বিনয়বাবুর কণ্ঠস্বর।

–আজ সন্ধ্যায় আসছেন তো?

–নিশ্চয় যাব। কিন্তু আপনার সঙ্গে কখন কোথায় দেখা হবে?

বিনয় ঘোষ বললেন–আমি তো হাজরা রোডের কাছেই থাকি আর আপনাকে এদিকেই আসতে হবে। কেন না ওদের বাড়ি এ-পাড়াতেই। সুতরাং আমি উজান বেয়ে আপনার অফিসে না গিয়ে সন্ধ্যা ছটা নাগাদ আপনি হাজরা নোড আর বসা রোডের উত্তর-পূর্ব কোণের পানের দোকানটার সামনে আমাকে পাবেন। ওখান থেকে দু-মিনিটের রাস্তা।

বিকালে বড়বাজার থেকে চার নম্বর বাসে চড়ে ঠিক ছটার সময় হাজরার মোড়ে নেমেই দেখি গেরুয়া পাঞ্জাবি পরে বিনয় ঘোষ আমারই জন্যে অপেক্ষা করছেন।

আমাকে দেখতে পেয়ে বিনয়বাবু আশ্বস্ত হয়ে বললেন–যাক, আপনি এসেছেন, আমি নিশ্চিন্ত হলাম। এই একটু আগেই ওদের বাড়ি থেকে আসছি। ওদের বলে এসেছি যে আপনি ছটার সময় আসছেন, শুনে সবাই খুশী শুধু দিব্যেন্দুই একটু লজ্জা পাচ্ছিল আপনার সঙ্গে দেখা করতে। আমি বিশেষ করে বলে এসেছি ও যেন থাকে, বেরিয়ে না যায়।

আমি বললাম–সে কি, আমি আরও উল্টোটাই শুনেছি। সে নাকি পকেটে ছোরা নিয়ে হন্যে হয়ে আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমার অপরাধ, প্রভাতের গল্প আমি ছেপেছি।

বিনয়বাবু দুঃখের সঙ্গে বললেন–ছি ছি ছি, তা কখনও সম্ভব? দিব্যেন্দু উত্তেজনার বশে একটা অন্যায় কাজ করে ফেলেছে, তার জন্যে অনুশোচনার শেষ নেই। কোন লজ্জায় তাদের কাছে মুখ দেখাবে বলে অফিস যাওয়া বন্ধ করেছে, আর ঠিক একই কারণে সে আপনার সামনেও উপস্থিত হতে লজ্জা পাচ্ছে। তবু আমি অনেক করে বুঝিয়ে বলে এসেছি যে আপনি আমাদেরই একজন, আপনার কাছে লজ্জা পাবার কিছু নেই।

হাজরা রোড ধরে পশ্চিম দিকে কথা বলতে বলতে আমরা এগিয়ে চলেছি, হঠাৎ বাঁদিকের একটা রাস্তায় মোড় নিয়েই বিনয়বাবু বললেন–আমরা এসে গিয়েছি, এই যে এই বাড়ি।

রাস্তার উপরেই সদর দরজা, ছোট্ট একতলা বাড়ি। বিনয়বাবু কড়া নাড়তেই দরজা খুলে গেল, হাসিমুখে সেই ভদ্রলোক আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। পরনে মালকোচা দেওয়া ধুতি, গায়ে আস্তিনগোটানো শার্ট। মুখে সেই সরল আন্তরিক হাসি।

রাস্তা থেকে সিঁড়ি দিয়ে উঠেই ছোট একটি ঘরে প্রবেশ করলাম। ঘরের মাঝখানে একটা সাদা পর্দা টাঙানো, পর্দার এ-পাশে অর্থাৎ রাস্তার দিকে ছোট্ট একটি টেবিল আর খান দু-তিন চেয়ার পেতে বসবার ঘর করা হয়েছে। আসবাবপত্রর বাহুল্য কিছুই নেই, সাধারণ গৃহস্থঘরের প্রয়োজনীয় যেটুকু সে-টুকুই আছে। বসবার ঘরের এক পাশে একটা কেরোসিন-কাঠের শেলফ এ পকেটবুক এভিশানের কিছু ইংরিজী বই, কিছু বাংলা বইও আছে আর আছে একতাড়া পত্রপত্রিকা ও খবরের কাগজ।

মেয়েলী-হাতের ফুললতাপাতার নক্শা ভোলা টেবিলক্লথ তোরঙ্গ-ঢাকনি। দেয়ালে অমাবশ্যা-পূর্ণিমা-একাদশী নির্দেশিত বাংলা ক্যালেণ্ডার।

ঘরে ঢুকেই বিনয়বাবু একটা চেয়ারে বসলেন, ওঁর গা ঘেষেই পাশের চেয়ারে আমি বসে পড়লাম। বিনয়বাবু বললেন–কই, দিব্যেন্দুকে দেখছি না কেন? পালিয়েছে বুঝি।

ভদ্রলোক বিনয়বাবুকে বললেন–আপনিও বেরিয়েছেন, মিনিট পনেরো বাদে সিগারেট কিনবার নাম করে ও বেরিয়েছে। ফেরে কিনা সন্দেহ। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—ওকে আমি কত বললাম যে আপনার কাছে লজ্জা পাবার কোন কারণ নেই, তবু বেরিয়ে গেল।

ভদ্রলোকের কথা শেষ হতে না হতেই সাদা কাপড়ের পার্টিশনটা সরিয়ে একটি তরুণী আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, নিটোল স্বাস্থ্য, ধীর স্থির দুটি কালো চোখের চাহনিতে যেন স্বপ্ন মাখানো। চওড়া লাল-পাড়ের সাদা শাড়ি সাধারণ ভাবে পরা। মাথার মাঝখান থেকে ঘোমটাটি এমনভাবে টেনে আনা যেন লাল-পাড়ের ফ্রেম-এর মাঝে পটে আঁকা একখানি ছবি। দা-ভিঞ্চির মোনালিসা-র হাসি আপনারা সবাই দেখেছেন। সে-হাসির অর্থ নিয়ে দুই শতাব্দী ধরে অনেক গবেষণাই রসিক সমালোচকরা করেছেন, আজও করছেন, তবু সে-হাসির রহস্য অজানাই থেকে গিয়েছে। আমার সামনে মূর্তিমতী যে নারী এসে দাঁড়ালেন তার মুখের স্মিতসুন্দর হাসির ব্যাখ্যা করা আমার কলমের সাধ্য নয়। শুধু মনে হয়েছিল মোনালিসার সেই অপার রহস্যময়ী হাসির জীবন্তরূপ নিয়ে তিনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। . বিস্ময়ের ঘোর কাটল যখন, তখন ভদ্রলোক বললেন—এই হচ্ছে দিব্যেন্দুর বোন, আমার ইয়ে

ভদ্রমহিলা খিলখিল করে হেসে উঠলেন, বললেন—আহা, পরিচয় করিয়ে দেবার কি ছিরি। স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন–যাও তো, হাজরা পার্কে গিয়ে একবার খুজে এস। দাদা নিশ্চয় পার্কে বসে আছে।

ভদ্রলোক দিব্যেন্দুর খোঁজে বেরিয়ে যেতেই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—জানেন, দাদাকে নিয়েই আমাদের যত মুশকিল। বাড়ি থাকতে ভাল লাগে না, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। রাত্রে ঘুমোত পারে না, এই হিমের মধ্যে পার্কে গিয়ে বসে থাকে রাত বারোটা পর্যন্ত। শেষকালে এই ভদ্রলোককেই গিয়ে পার্ক থেকে দাদাকে ধরে আনতে হয়। আমি তো দাদাকে সব সময় বলছি—তুমি এবার বিয়ে কর, এসব ব্যক্তি তোমার বউ এসেই সামলাক। মা বুড়ো মানুষ, কেবল চিন্তা ছেলে বুঝি পাগল হয়ে গেল। আমার কর্তাটির কথা আর বলবেন না। বিশ্বকুঁড়ে। আপনার কাছে যেতে কি চায়? আমিই তো জোর করে সেদিন সকালে আপনার বাড়ি পাঠিয়ে ছিলাম। কি বিনয়দা, ঠিক কথা কি না বলুন।

ভদ্রমহিলার স্বতঃস্ফুর্ত ও সপ্রতিভ কথাবার্তায় আমার আড়ষ্টতা কেটে গেছে। বিনয়বাবু কিছু বলবার আগেই আমি বললাম-এটা ঠিক যে, উনি সেদিন সকালে আমার বাড়ি না গেলে এখানে আসার আমি কোন উৎসাহই পেতাম না। ওঁর একটা মস্ত গুণ, অল্প আলাপেই অচেনাকে চির-চেনা করে ফেলতে পারেন।

ভদ্রমহিলা কপট কোপ প্রকাশ করে চোখ ঘুরিয়ে বললেন–ই, গুণ না ছাই। আচ্ছা পেলে বিশ্বসংসার ভুলে যান, আমি তো কোন ছার। এই নিয়ে আমার সঙ্গে নিত্যি খটাখটি লেগেই আছে।

আমি বললাম—ভাগ্যিস খটাখটি লাগে, তা না হলে জীবনটা আলুনি তরকারির মত স্বাদহীন হয়ে যেত।

এই সময় ভদ্রলোক পার্ক থেকে একাই ফিরে এলেন। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন–কি, ওঁর কাছে আমার নিনে করা হচ্ছিল বুঝি।

আমি বললুম-তা নয়। সে দিন আমার বাড়িতে আপনি যেমন ওঁর গুণের প্রশংসা করছিলেন, উনিও আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

বিস্ময়ের ভান করে ভদ্রলোক বললেন—তাই নাকি, এ যে আপনি নতুন খবর শোনালেন। আমি কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা ওঁর গঞ্জনা শুনতে শুনতে ঝালাপালা হয়ে গেছি। একেক সময় মনে হয় দুর্ভোর বলে লোটা-কম্বল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।

বিনয়বাবু বললেন–থাক হয়েছে। তোমাকে আর লোটাকম্বল নিয়ে বেরোতে হবে না। উপস্থিত মা-কে একবার ডেকে দাও।

ভদ্রমহিলা বললেন–মা ওঁর জন্যে চায়ের জল চাপিয়েছেন, আমি গিয়ে এক্ষুনি ওঁকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

ভদ্রমহিলা পর্দার আড্ডালে চলে যেতেই আমি প্রমাদ গুনলাম। একটা কঠিন পরীক্ষার সামনে মুখোমুখি আমাকে দাঁড়াতে হবে! মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরেই পর্দার ওপার থেকে এক বৃদ্ধা বেরিয়ে এলেন। স্নান বিষগ্ন মুখ, বেদনার ছাপ সারা চেহারায় পরিস্ফুট।

দাঁড়িয়ে উঠে নমস্কার করতেই বৃদ্ধা বললেন—বোস বাবা, বোস। তুমি তত বিনয়ের বন্ধু, আমার ছেলেরই মতন। কিন্তু আমার ছেলের এ কী হল? খায় না, ঘুমোয় না, কারুর সঙ্গে কথাও বলে না। আজ সাতদিন হয়ে গেল অফিস যাওয়া বন্ধ করেছে। ও যখন এতটুকু তখন এই দুটি ছেলেমেয়েকে নিয়ে আমি বিধবা হই। কি দুঃখের দিন গেছে আমার। অনেক কষ্টে ছেলেকে লেখা পড়া শিখিয়েছি, চাকরিও করছে। ভাবলুম, দুঃখের দিন পার হল। হঠাৎ এ কি হল বল তো? কি হবে? চাকরি যদি যায়, আবার আমাকে পথে দাঁড়াতে হবে। ওই ছেলে ছাড়া আমার তো আর কোন সম্বল নেই।

বলতে বলতে বৃদ্ধা ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে আছি, কি বলব ভেবে পাচ্ছি না। বিনয় বাবুর দিকে চেয়ে দেখি উনি ঘড় হেঁট করে মাটির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।

বৃদ্ধা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বললেন–এই দেখ না। ছেলেকে কত করে বললাম থাকতে। বেরিয়ে গেল। কত রাত্রে ফিরবে কে জানে। এ রকম করলে ও-যে পাগল হয়ে যাবে। কান্নায় বৃদ্ধার কথা রুদ্ধ হয়ে এল।

আমার স্নায়ুর উপর এতটা চাপ পড়বে আমি কল্পনা করি নি। ইচ্ছে হচ্ছিল ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যাই। মনে মনে অভিসম্পাত দিচ্ছিলাম প্রভাতকে, যে আমাকে আজ এমন একটা অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্যে এনে ফেলেছে। পরিচিত বন্ধুকে নিয়ে যদি বাস্তব গল্পই লিখতে গেল তবে পরিণতিতে এভাবে কল্পনার কালি ঢালতে গেল কেন! এ অবস্থায় আর চুপ করে থাকা যায় না, কিছু একটা বলতেই হয়। কিন্তু আমার দিক থেকে বলবার-কীই বা থাকতে পারে। তবু এই বৃদ্ধার ব্যাথাতুর অন্তরে যদি কিছু সান্ত্বনার প্রলেপ দিতে পারি এই আশায় আমি বললাল—যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এ নিয়ে আর দুঃখ করে লাভ কি। আমার দিক থেকে এটুকু অন্তত বলতে পারি যে, আমাদের পত্রিকায় যে-গল্প প্রকাশিত হয়েছে তার সত্যতা সম্বন্ধে আমি বিন্দুবিসর্গ জানতাম না। আজ আমি আপনাদের মতই বেদনা বোধ করছি, কিন্তু এখন তো আর প্রতিকারের কোন পথ নেই। আপনাদের কর্তব্য এই গল্প নিয়ে যাকিছু ঘটেছে তা মন থেকে নিঃশেষে মুছে ফেলা। আপনারা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবার চেষ্টা করুন, দেখবেন আপনার ছেলেও আগের মতনই আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। আমার শুধু একটি অনুরোধ, আপনার ছেলেকে বলবেন যেন এক মাসের একটা ছুটির দরখাস্ত করে দেয় আর যে ঘটনা ওর অফিসে ঘটেছে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে একটা চিঠিও যেন দেয়। তাহলে আমার বিশ্বাস চাকরি সম্পর্কে আর কোন গোলযোগ হবে না।

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে একটা দমবন্ধ আবহাওয়া থেকে যেন মুক্তি পেলাম। বৃদ্ধার চোখ দিয়ে তখনও অঝোরে জল ঝরছে, থান ধুতির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বললেন–বাবা, সবই তো বুঝি কিন্তু মন মানে না। আমার ছেলেকে যদি তুমি একটু বুঝিয়ে বলতে পারতে ভাল হত।

বিনয়বাবু বৃদ্ধাকে ভরসা দিয়ে বললেন–আপনি ভাববেন না। দিব্যেন্দুকে আমিই বুঝিয়ে দরখাস্ত দুটো কালই পাঠাবার ব্যবস্থা করব।

এমন সময় সেই মেয়েটি দু হাতে দু কাপ চা এনে মায়ের সামনে ধরে বললেন–মা, চা-টা ওঁদের এগিয়ে দাও।

ছোট একটি কাপে চা, পিরিচে দুটি বিস্কুট বসানো। মেয়ের হাত থেকে কাপটা নিয়ে যে-আঁচলে চোখ মুছছিলেন সেই আঁচলেই পিরিচের তলাটা মুছে আমার সামনে ফুলের নকশা ভোলা টেবিলক্লথটার উপর রাখলেন। চায়ের প্রতি তখন আমার একটা বিবমিষা দেখা দিয়েছে। মনে হচ্ছিল এ তো চা নয়, এক পেয়ালা চোখের জল যেন আমার সামনে ধরে দেওয়া হলো। কিন্তু বৃদ্ধার এই সস্নেহ আতিথেয়তা আমি সেদিন উপেক্ষা করতে পারি নি। গলা দিয়ে চা নামতে না চাইলেও তা নিঃশেষ করে বিদায় চাইলাম। বৃদ্ধা বললেন–আরও একটু বোস বাবা, আমার ছেলে হয়তো এখুনি এসে যাবে।

বিনয়বাবু আমার মানসিক অবস্থাটা অনুমান করে আমাকে উদ্ধার করলেন, বললেন–রাত হয়ে এসেছে, ওঁকে আর আটকে রাখা ঠিক নয়। আমি বরঞ্চ এখন থেকে যাই, দিব্যেন্দুকে যা বলবার আমিই বুঝিয়ে বলব।

সদর দরজা খুলে যখন বাইরে এসেছি, বিনয়বাবু আর দিব্যেন্দুর ভগ্নিপতি রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দেবার জন্যে সঙ্গে এলেন। রাস্তায় নেমে দিব্যেন্দুর বোনকে নমস্কার জানিয়ে বিদায় চাইলাম। প্রতি নমস্কার করে প্রসন্ন হাসির আভা ছড়িয়ে বললেন–বাড়ি তো চিনে গেলেন, আবার আসবেন।

আমি বললাম-যদি কখনও আমার সাহায্যের প্রয়োজন হয়, জানাবেন, নিশ্চয়ই আসব।

হাঁটতে হাঁটতে হাজরার মোড় পর্যন্ত এসে ট্রামের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। টালিগঞ্জের কত ট্রাম এসে চলে গেল আমার হুঁশ নেই। আমি শুধু ভাবছিলাম সেই বৃদ্ধার কথা, দিব্যেন্দুর কথা, ওর ভগ্নিপতির কথা। আর চোখের সামনে ভেসে উঠছিল সেই হাস্যোজ্জ্বল একটি মুখ, পরনে লাল পাড় ঢাকাই শাড়ি, সিঁথিতে সিদুর।

 

কিছুদিন বাদে মালা গ্রাম থেকে প্রভাত কলকাতায় ফিরে এল। খবর পেয়ে ডেকে পাঠালাম ওকে আমার বাড়িতে। ওর গল্প নিয়ে যা-ঘটেছে তা খুলে বলার পর ওকে যখন জিজ্ঞাসা করলাম এমন গল্প সে কেন লিখল। কোন উত্তর নেই। অনেক অনুরোধ-উপরোধের পর সে যা বলল তা আরেক বিরাট কাহিনী, সে কাহিনী আপনাদের বলতে আমি চাই নে। তাছাড়া তার সঙ্গে সাহিত্যের কোনও সম্পর্ক নেই বলেই এক্ষেত্রে তা নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক।

এই ঘটনার পর কালস্রোতে অনেকগুলি বছর পার হয়ে গেছে। পুরনো দিনের অনেক ঘটনাই স্মৃতির অন্তরালে আজ অবলুপ্ত। হাজরা রোডের একটি সন্ধ্যার সেই মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতাও হয়তো মন থেকে চিরকালের জন্য মুছে যেত, কিন্তু তা যায় নি একটি মর্মান্তিক খবরে।

বড় বাজারের বর্মণ স্ট্রীট ছেড়ে আমাদের অফিস উঠে এসেছে চৌরঙ্গী পাড়ায়। একদিন দুপুরে নিরিবিলি অফিসে বসে কাজ করছি, হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল। বিনয় ঘোষের কণ্ঠস্বর। বললেন–একটা দুঃসংবাদ আপনাকে দিই, দিব্যেন্দুর বোনটি মারা গেছে।

স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে ছবির মত ভেসে উঠল একটি হাসিখুশি মুখ, ঢাকাই শাড়ির চওড়া লাল পাড় নিটোল দুটি গাল ছুঁয়ে আছে, কপালে সিঁদুরের টিপ। রিসিভারটা কানে ধরা ছিল, দুদিক থেকেই কোন কথা নেই। খানিক বাদে ওপাশ থেকে খট করে আওয়াজ হতেই সম্বিৎ ফিরে এল, বিনয় বাবু ততক্ষণে টেলিফোন ছেড়ে দিয়েছেন।

দিব্যেন্দুর বাড়ির কারুর সঙ্গেই আর কোনদিন আমার দেখা হয় নি, দিব্যেন্দু আজও আমার অপরিচিত। আমার এই কাহিনী এইখানে শেষ করার আগে পাঠকদের কাছে একটি অনুরোধ জানিয়ে রাখি। যদি আপনাদের কারুর সঙ্গে দিব্যেন্দুর অথবা তার ভগ্নিপতির কখনও কোনদিন দেখা হয় তাকে আমার অন্তরের গভীর সমবেদনা ও সহানুভূতি জানিয়ে দিয়ে শুধু এই কথাটুকু বলে দেবেন, আমি ওদের আজও ভুলি নি, কোনদিনও ভুলব না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *