০৭. আমাদের বৈঠকের গাল্পিক কথা

আমাদের বৈঠকের গাল্পিক কথা-সাহিত্যিক বললেন–আপনার গল্পে কবি নিশিকান্তকে একবার ছুঁইয়েই ছেড়ে দিলেন। সেই ইঁদুরের মাংস খাওয়ার ঘটনাটা? সেটা তো ধামা চাপা পড়ে গেল।

আড্ডার সেই ক্ষীণকায় সব্যসাচী লেখক টিপ্পনী কেটে বললেন—ধান ভানতে শিবের গাজন। কোথায় পড়ে রইল নিশিকান্তর খাওয়ার গল্প, নিজের কথাই সাত কাহন।

হক-কথা। স্মৃতি মন্থন করে যারাই গল্প বলেন তাদের প্রধান দোষ বা মুদ্রা দোষই বলুন, অপরের কথা বলতে গিয়ে নিজের কথাকে সামনে তুলে ধরা। তবু আমি চেষ্টা করেছিলাম শৈশবে যে-পরিবেশে আমরা মানুষ হয়েছিলাম, এবং যে-পরিবেশে নিশিকান্তর সাহিত্য-সাধনার সুত্রপাত, সেই পরিবেশটি শ্রোতাদের কাছে তুলে ধরতে।

রঙ্গমঞ্চে অভিনয় কালে কোনও চরিত্রকে দর্শকদের সামনে ফুটিয়ে তুলতে হলে পটভূমিকার পরিবেশ সৃষ্টি করে তার উপর আলো নিক্ষেপ করতে হয়। আমারও ছিল সেই একই উদ্দেশ্য। অর্থাৎ আমার কাজ ছিল নিশিকান্তর উপর আলো নিক্ষেপ করা। কিন্তু অনবধানতাবশত নিজেই যে কখন সেই আলোর সামনে এসে গেছি তা টের পাই নি। সবিনয়ে বন্ধুদের কাছে মার্জনা চেয়ে বললাম-নিশিকান্তর কথা বলতে গেলে খানিকটা নিজের কথাই এসে, পড়বে—আমি নিরুপায়। ছেলেবেলা থেকেই নিশিকান্তর সঙ্গে আমার নিবিড় বন্ধুত্ব। তার কবি-প্রতিভার প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা শৈশবকাল থেকেই। শান্তিনিকেতন আশ্রম ছেড়ে পণ্ডিচেরীর আশ্রমের আশ্রয়ে তার চলে যাওয়ার পিছনে যে বিরাট ট্র্যাজেডী ছিল। আমি ছাড়া আর দ্বিতীয় ব্যক্তির জানবার কথা নয়।

গাল্পিক বন্ধু আমার কথাটা থামিয়ে দিয়ে বললেন–আপনার কাছে আমরা ভোজনরসিক নিশিকান্তর গল্প শুনতে চাইকবি নিশিকান্তর নয়।

আড্ডার তরুণ কবি বললেন—তা কেন। কবি নিশিকান্তর শান্তিনিকেতন ছেড়ে পণ্ডিচেরী চলে যাওয়ার রহস্যটাই আমাদের জানবার আগ্রহ বেশী। আপনি সেটাই বলুন।

দুই বন্ধুকেই থামিয়ে বললাম—দুজনের কথাই রাখতে চেষ্টা করব। ভোজনরসিক ও কাব্যরসিক—নিশিকান্ত চরিত্রের এই দুই রূপ আপাতবিরোধী মনে হলেও একটি আরেকটির পরিপূরক। নিশিকান্ত যখন আহারে বসে তখন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেন তার কাছে বিলীন হয়ে যায়। ওর মত একাগ্রচিত্তে তদতভাবে আহার্য-বস্তুকে উপভোগ করতে আমি আর কাউকে দেখি নি। আবার যখন কবিতা রচনায় সে বসে তখনও দেখেছি তার সেই একই রূপ। স্নানাহার ভুলে কাব্যরসে এমন তন্ময় হয়ে ডুবে যাওয়া এক নিশিকান্তকেই আমি দেখেছি।

কবিতার ছন্দ, আঙ্গিক, শব্দচয়ন ও বিষয়বস্তু নিয়ে নিশিকান্ত নিত্যনিয়ত যেমন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করত তেমনি চলত তার রান্না নিয়ে নানারকমের এক্সপেরিমেন্ট। নিশিকান্ত ছিল ঘোরতর মাংসাসী।

শান্তিনিকেতনের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সাঁওতালদের প্রায়ই দেখা যেত শীতকালে ধানকাটা হয়ে যাবার পর ধানক্ষেতে ছেলে বুড়ো সবার ইঁদুর ধরার উল্লাস। পাঁচদশটা ইঁদুর যদি ধরতে পারল তো পরব লেগে গেল। সন্ধ্যায় হাড়িয়ার সঙ্গে ইঁদুরের মাংস, তারপরে মাদল বাজিয়ে নাচ। বর্ষাকালে ছিল তাদের ধানক্ষেতের ব্যাঙ-গেলা ঢোড়াসাপ ধরবার পালা। ৪৫ হাত লম্বা একটা সাপ ধরতে পারলে সেদিন পরব চলবে সারারাত আর হাড়িয়া চলবে কলসী কলসী।

এই সব অভিজ্ঞতা থেকেই নিশিকান্তর থিয়োরী ছিল যে, সাঁওতালরাও মানুষ, আমরাও মানুষ। ওরা যা খেতে পারে আমরা তা পারব না কেন? সুতরাং পরীক্ষাটা ইঁদুরের মাংস দিয়েই প্রথম শুরু হয়ে যাক। খাওয়ার ব্যাপারে নিশিকান্তর কোনও বাছ-বিচার ছিল না। এ-বিষয়ে ও ছিল সম্পূর্ণ সংস্কারমুক্ত। আর তা হবে না-ই বা কেন। ওর দাদা সুধাকান্ত রায়চৌধুরী ছিলেন আরও এক কাঠি সরেস। সুধাকান্তদার কাহিনী শুনলে খাবার ব্যাপারে নিশিকান্তর বেপরোয়াপনা বুঝতে অসুবিধা হবে না।

শান্তিনিকেতন থেকে মাইল চারেক দূরে তালতোড় বলে এক জায়গায় একবার বাঘের উৎপাত দেখা দিল। গ্রামবাসীদের গরু-ছাগল প্রায়ই মারা পড়ছে এ-খবর আমরা রোজই পাচ্ছিলাম। একদিন বাঘের কামড়ে জখমহওয়া এক সাঁওতালকে শান্তিনিকেতনের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য এনে হাজির করল। সাঁওতালটির অবস্থা দেখে উচুক্লাসের ছাত্ররা স্থির করল বাঘ মারতেই হবে। নেপালবাসী নরভূপ ছিল আশ্রমের আদ্যবিভাগের ছাত্রদের দলপতি, যেমন বিশাল তার চেহারা তেমনি বলশালী। তালতোড়ের এক পুকুর ধারে বাঘ গরু মেরে ফেলে গেছে, এই খবর পেয়ে নরভূপ কোমরে নেপালী কুকরি আর সন্তোষচন্দ্র মজুমদারের ঘেয়ে কুকুর-মারার দোনলা বন্দুকটা কাঁধে নিয়ে চলল বাঘ মারতে। সঙ্গে ছিল তার সমবয়সী দুঃসাহসী আটদশজন সতীর্থ। তাদের হাতে লাঠি, হকিস্টিক, বাঁশ ইত্যাদি। মাস্টার মশাইদের অনুমতির অপেক্ষা না রেখেই দুপুরবেলা চলে গেল পশ্চিম প্রান্তের প্রান্তর পেরিয়ে তালতোড়ার দিকে, আমরা দূর থেকে তাদের চলে যাওয়াটাই দেখলাম। আশ্রমময় সে কী উৎকণ্ঠা।

সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পূর্বে হঠাৎ দেখা গেল মেঠো রাস্তার ধুলো উড়িয়ে বিরাট দল আশ্রমের দিকে এগিয়ে আসছে। সঙ্গে এক ছল্পর হীন গরুর গাড়ি, তার উপর পাশ ফিরে শুয়ে আছে সেই বাঘ।

আশ্রমসুদ্ধ সবাই ভেঙ্গে পড়ল বাঘ দেখবার জন্যে। হাসপাতালের সামনে গরুর গাড়ি থেকে মৃত বাঘকে নামান হল, দেখা গেল বাঘের গলাটা ভোজালী দিয়ে এপাশ ওপাশ কাটা। আর নরভূপদার দুই কঁধ বাঘের থাবার আঁচড়ে ক্ষত-বিক্ষত।

কুকুর-মারা বন্দুকের গুলিতে বাঘ মরবে কেন। একটা গুলী ছুড়তেই বাঘ ঝাঁপিয়ে পড়ল নরভূপদার উপর। নরভূপদা দুই বলিষ্ঠ হাতে সেই যে বাঘের গলা টিপে ধরলেন আর ছাড়লেন না। অন্য ছেলেরা প্রাণের দায়ে বাঘের মাজা লক্ষ করে সমানে চালালেন লাঠি আর হকিস্টিক, যতক্ষণ, বাঘের শিরদাঁড়াটা না ভাঙ্গল। বাঘ একটু ঘায়েল হতেই নরভূপদা চিৎকার করে বললেন, ভোজালিটা দাও। কোমর থেকে ভোজালিটা টেনে বার করে ওর হাতে দিতেই তা চালিয়ে দিলেন বাঘের কণ্ঠনালীর উপর।

আমরা সবাই বাঘের চারিদিক ঘিরে বাঘে মানুষের লড়াইয়ের লোমহর্ষক কাহিনী উদগ্রীব হয়ে শুনছি, এমন সময় একটা মাংস কাটা ছুরি হাতে সুধাকান্তদা সেখানে এসে হাজির। বললেন—বাঘের ছাল ছাড়িয়ে সামনের পায়ের রান থেকে মাংস চাই। বাঘ মানুষের মাংস খায়, আজ আমি বাঘের মাংস খাব।

সুধাকান্তদার এই উদ্ভট সংকল্প শুনে কে একজন বলে উঠলেন বাঘের মাংস খেলে মানুষ পাগল হয়ে যায়।

সুধাকান্তদা তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন-বাঘের মাংস খেলে পাগল ভাল হয়ে যায়।

সুধাকান্তদার নানারকম পাগলামী খেয়ালের জন্য শান্তিনিকেতনে সবাই ওঁকে পাগল বলেই ঠাট্টা করত।

সেই রাত্রেই সুধাকান্তদা প্রচুর পেঁয়াজ রসুন সহযোগে বাঘের মাংস রান্না করেছিলেন, কিন্তু একটুকরো মুখে দিয়েই ফেলে দিতে হয়েছিল। বাঘের মাংস যে এতটা তেতো হবে তা তিনি আগে বুঝতে পারেন নি।

গল্পের এখানেই বৈঠকের একজন বললেন–ওরেফ ফাদার! এ হেন বড় সুধাকান্তর ছোট ভাই নিশিকান্ত। তাহলে ব্যাপারটা বুঝুন। ইঁদুরের মাংস দিয়ে যার শুরু তার শেষটা কোথায় একবার অনুমান করুন।

আমি বললাম–এ আর কি শুনলেন। নিশিকান্তর বাদুড়ের মাংস খাওয়ার গল্পটা তা হলে বলি। আমার সহপাঠী বর্মী ছেলে টুনাং নিশিকান্তর মাংস খাওয়ার উৎসাহ দেখে বললে, বর্মা দেশে বাদুড়ের মাংস নাকি খুব প্রিয় খাদ্য। যাঁহাতক শোনা-নিশিকান্তরও রোখ চেপে গেল সে-ও বাদুড়ের মাংস খেয়ে দেখবে। এখন বাদুড় কোথায় পাওয়া যায়? অবশেষে টুনা এসে খবর দিল, নীল কুঠিয়াল চীপ সাহেবের পরিত্যক্ত কুঠির বাগানে সন্ধ্যের পর নাকি ঝাঁকে-ঝাকে বাদুড় বসে। চীপ সাহেবের কুঠি ছিল শ্রীনিকেতন থেকে মাইল দুই উত্তরে বল্লভপুর গ্রামের কাছে। শ্রীনিকেতনে তখন এক জাপানী সপরিবারে থাকতেন, নাম তার কাসাহারা। হনুমান নিকেতনের চাষের ফসল নষ্ট করত বলে এলমহাস্ট সাহেব তাকে একটা বন্দুক দিয়েছিলেন। টুনাং কাসাহারাকে পটিয়ে-পাটিয়ে বন্দুক যোগাড় করে সন্ধ্যার আগেই সাইকেলে চেপে চলে গেল চীপ সাহেবের কুঠি।

আমরা মাংস রান্নার যাবতীয় মালমশলা সংগ্রহ করে টুনাং-এর জন্য অপেক্ষা করছি, এমন সময় টুনাং সাইকেলের ব্যাণ্ডেল-এ একজোড়া বাদুড় ঝুলিয়ে এসে হাজির। রান্না হল বটে কিন্তু খাওয়া গেল না। যা আঁশটে গন্ধ!

নিশিকান্ত দমবার পাত্র নয়। বললে-ভিনিগারে একরাত ভিজিয়ে রাখতে পারলে গন্ধ মারতে পারতুম। ঠিক আছে। আরেকদিন হবে।

আমাদের উৎসাহ অবশ্য সেদিনই ধামাচাপা পড়ল।

নিশিকান্তর পাল্লায় পড়ে নাজেহাল হবার দৃষ্টান্ত একাধিক। তার মধ্যে দুটি গল্প আপনাদের শোনাই।

 

১৯৩০ সালের কথা। আমি তখন শান্তিনিকেতন কলেজে ফাস্ট ইয়ারে পড়ি, নিশিকান্তর কবিখ্যাতি তখন শান্তিনিকেতনের চৌহদ্দি পেরিয়ে কলকাতার পরিচয় বিচিত্রা পত্রিকার মাধ্যমে বাংলাদেশেও ছড়িয়েছে। সে তখন শান্তিনিকেতন কলাভবনের ছাত্র। কবিতা লেখার মত ছবি আঁকাতেও সে ট্রাডিশন ভেঙেচুরে নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তন্ময়।

শান্তিনিকেতনে তখন পূজোর ছুটি, সকাল-সন্ধ্যেয় শীতের আমেজ তখন সবে শুরু। একদিন সকালে একটা হলদে আলোয়ান মুড়ি দিয়ে নিশিকান্ত আমার বাড়ি এসে বললে—সাগর, চটপট একটা আলোয়ান গায়ে দিয়ে বেরিয়ে আয়। আমার সঙ্গে চল্।

কোথায় যেতে হবে, কী হয়েছে, শীত না পড়া সত্ত্বেও আলোয়ান গায়ে দিতে হবে কেন, এসব প্রশ্ন করা বৃথা। সঙ্গে যেতে হবে যখন তখন যেতেই হবে। আমার ছিল একটা লাল রঙের আলোয়ান, তাই গায়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

পথে যেতে যেতে নিশিকান্ত বললে—উত্তরায়ণের পশ্চিম দিকের ভুট্টা খেতে বড় বড় ভুট্টা হয়েছে। চল পেড়ে আনি, ভেজে খাওয়া যাবে।

প্রস্তাবটা আমার কাছে খুব মনঃপূত হল না। চিন্তিত হয়ে বললামবাগানের মালীরা ঘোরাফেরা করে। তাছাড়া

এক ধমক দিয়ে নিশিকান্ত বললে—ওসব তোকে ভাবতে হবে না। আমি সব খোঁজ নিয়েছি। সকালে মালীরা উত্তরায়ণের পুব দিকের গোলাপ বাগানে থাকে। তোর যদি এতই ভয়, তুই চলে যা। আমি একাই যাব। তারপর যখন উনুনে সাঁতলে গাওয়া ঘি মাখিয়ে কঁচা লঙ্কা দিরে খাব তখন চাইতে আসিস।

পৌরুষে ঘা লাগল। নিশিকান্ত আমাকে এতই ভীতু মনে করবে? তাছাড়া ভুট্টা খাবার বর্ণনাটাও ততক্ষণে রসনাকে বসিয়ে তুলেছে। দ্বিরুক্তি করে ওর সঙ্গেই পা চালালাম।

উত্তরায়ণের পশ্চিম দিকের তারের বেড়া টপকে দুটি হলদে আর লাল আলোয়ান বিরাট ভুট্টা খেতের মধ্যে মিলিয়ে গেল। গোটা তিন চার কচি ভুট্টা পেড়ে আলোয়ানের মধ্যে লুকিয়ে খেত থেকে বেরিয়েই দেখি উত্তরায়ণের উড়িয়া খাস চাকর নাথু, পান দোক্তা খাওয়া কালো দাঁত বার করে হাসছে।

নাথুকে দেখেই নিশিকান্ত ফিসফিস করে আমাকে বললে—খবরদার, ঘাবড়াস নে। কি বলে শোনা যাক।

নাথু আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললে—বউঠান আপনাদের দুজনকে ডাকছেন।

বউঠান ডাকছেন! শুনেই তো মাথায় বজ্রাঘাত। কী লজ্জার কথা। ভুট্টা চুরি করতে এসে ধরা পড়ে গেলাম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এই শেষ, নিশিকান্তর সঙ্গে আর কোন দিন কোথাও যাচ্ছিনা।

নিশিকান্ত কিন্তু নির্বিকার। নাথুকে বললে-চল যাচ্ছি।

নাথুকে সঙ্গে নিয়ে উত্তরায়ণের দিকে যেতে যেতে মোলায়েম স্বরে নিশিকান্ত বললে-হারে নাথু, বউঠান কি আমাদের ভুট্টা ক্ষেতে ঢুকতে দেখতে পেয়েছেন? না কি তোরা দেখতে পেয়ে বউঠানকে বলে দিয়েছিস?

নাথু বললে—আমি ঘরের ভিতর ঝাড়পোঁছ করছিলাম। বউঠান ডেকে বললেন–আপনাদের দুজনকে নিয়ে আসতে।

উত্তরায়ণের পশ্চিম দিকের বারান্দায় ঢুকে দেখি বউঠান গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূকে শান্তিনিকেতনের সকলেই বউঠান বলেই সম্বোধন করে থাকে। নিশিকান্ত সামনে, আমি পিছনে মাথা নীচু করে অপরাধীর মত বউঠানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বউঠান স্বভাব-স্নিগ্ধ কোমল কণ্ঠে বললেন—ভুট্টাগুলি আমার হাতে দাও।

নিশিকান্ত আলোয়ানের ভিতর থেকে দুটো ভুট্টা বের করে বউঠানের হ্রাতে দিল, ওর দেখাদেখি আমার দুটোও বার করে দিলাম। কোন কথা

বলে ভুট্টাগুলি হাতে করে ভিতরে চলে গেলেন, যাবার সময় শুধু বলে গেলেন—তোমরা বোস, আমি আসছি।

বসে আছি তো বসেই আছি। এক-একটা মুহূর্ত তখন আমার কাছে এক-এক ঘণ্টা। মনে তখন দুশ্চিন্তাও ঘনিয়ে এসেছে। বউঠান যদি রথীদাকে বলে দেন। যদি এই ব্যাপারটা গুরুদেবের কানে ওঠে! নিশিকান্তকে ভয়ে ভয়ে বললাম-চল পালাই।

নিশিকান্ত আবার ধমকে উঠল—চুপ করে বোস্। দেখাই যাক না শেষ পর্যন্ত কী হয়। তোর যদি এতই ভয়, তাহলে আমার সঙ্গে এলি কেন।

অগত্যা চুপ করেই বসে রইলাম। নিশিকান্ত উনেত্র হয়ে নিশ্চিন্ত, নীরবে চেয়ারে গা এলিয়ে বাঁ-পায়ের উপর ডান-পা তুলে নাচাচ্ছে। ভাবখানা যেন কবিতার একটা আইডিয়া সদ্য মাথায় গজিয়েছে, শুধু ছন্দে গেঁথে তোলাই বাকি।

এমন সময় প্রতিমা দেবী আবির্ভূত হলেন। দুই হাতে দুটি থালা। একটি থালায় গোটা আষ্টেক ডবল সাইজের পান্তুয়া, অপর থালায় সুন-ঘি মাখানো চারটি ভুট্টা। ভুট্টাগুলি আগুনের তাপে তখনও তেতে আছে।

সামনের টেবিলের উপর থালা দুটি রেখে বললেন–সব কিন্তু খেতে হবে। কিছু ফেলা চলবে না।

 

আমি ততক্ষণে লজ্জায় কাঠ হয়ে গেছি। নিশিকান্ত মুহূর্তমাত্র দ্বিধা না করে পান্তুয়াগুলি তুলে টপাটপ মুখে ফেলতে লাগল। অধোন্মীলিত চোখে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভুলে পান্তুয়া চিবিয়ে চলেছে—শব্দ হচ্ছে চপ, চপ, চপ।

বউঠান আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন–কী, লজ্জা করছ কেন, খাওয়া শুরু কর। তা না করলে, তুমিই ঠকবে। নিশি তোমার জন্যে কিছুই বাকি রাখবে না। ওকে তো তুমি জানো।

ততক্ষণে নিশিকান্ত ভাবের ঘোরে নিজের ভাগের চারটা পান্তুয়া শেষ করে আমার ভাগের উপর হামলা চালিয়ে আর দুটো শেষ করেছে। আমি তখন নিরুপায় হয়ে থালাটা নিজের কোলের উপরেই টেনে নিলাম। নিশিকান্ত ভুট্টার থালায় হাত বাড়াল।

খাওয়া শেষ করে আমরা যখন যাবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছি, বউঠান বললেন–যেদিন তোমাদের ভুট্টা খাবার ইচ্ছে হবে সোজা আমার কাছে চলে এসো। আমিই খেত থেকে আনিয়ে তোমাদের খাওয়াব।

সেদিনের পর অবশ্য আমি আর কোনদিন বউঠানের কাছে ভুট্টা খেতে যাই নি। নিশিকান্ত গিয়েছিল কি না জানি না। গিয়ে থাকলেও সে কি আর আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে? আর আমিই কি ওর সঙ্গে আর কখনও যেতাম?

তবু আরেকবার ওর সঙ্গে যেতে হয়েছিল। এবার বউঠানের কাছে নয়, দিনদার কাছে। রবীন্দ্রনাথের সকল গানের ভাণ্ডারী দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি ছিলেন শান্তিনিকেতনের সকল আনন্দোৎসবের উৎস। তার কাছে ছেলে-বুড়ো সবারই ছিল অবারিত দ্বার। বিশেষ করে আশ্রমের বালক-বালিকাদের উনি খুব ভালবাসতেন। ছেলেদের বাড়িতে ডেকে এনে খাওয়ানো-দাওয়ানো, তাদের সঙ্গে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নানারকম মজার গল্প করা এবং গানে অভিনয়ে সকলকে মাতিয়ে রাখা ছিল তার চরিত্রের একটি বিশেষ গুণ।

নিশিকান্তর সঙ্গে কথা হল—পরদিন খুব ভোরে উঠে দুজনে খেজুর গাছের রস খেতে যাব গোয়ালপাড়ার গ্রামে। শীতের রাত। ভোর সাড়ে চারটায় উঠে গোয়ালপাড়ায় যখন পেীছেছি তখন গাছ থেকে সবে হাঁড়ি পাড়া হচ্ছে। রস যেখানে জাল দেয় সেখানে আগুনের ধারে বসে নিশিকান্ত একাই এক হাঁড়ি রস খেয়ে দুবার ঢেকুর তুলল। আমি চেষ্টা করেও দু গেলাসের বেশী আর খেতে পারলাম না।

গোয়ালপাড়ার রাত ধরে আমরা যখন উত্তরায়ণের কাছাকাছি ফিরেছি তখন পুবদিকে রেল লাইনের ধারে তাল গাছের মাথায় সবে সূর্য যেখা দিয়েছে। রাস্তার ডানদিকে উত্তরায়ণ, বাঁদিকে দিনদার বাড়ি। নিশিকান্তর মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চাপল। বললে—চল, দিনদার বাড়ি যাই।

আমি বললাম-সে কী, এই ভোয়ে দিনদার বাড়ি? উনি হয়তো বুম থেকেই ওঠেন নি। এখন গিয়ে উৎপাত করাটা কি ঠিক হবে?

নিশিকান্ত বললে—তুই জানিস না। দিনদা এতক্ষণে চায়ের পাট নিয়ে সেছেন। কাক কোকিল ডাকবার আগেই উনি ঘুম থেকে ওঠেন। এখন গেলে বাসি মাংস খাওয়া যাবে।

অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—বাসি মাংস? সে আবার কি?

নিশিকান্ত বললে-রাত্তিরে ওঁর জন্যে কাবাবের মত পেঁয়াজ রসুন দিয়ে মাংস রান্না করে অল্প আঁচের উনুনে রেখে দেওয়া হয়। সকালে চায়ের সঙ্গে পাউরুটি দিয়ে খান। আর মজা হচ্ছে এই, এ-সময় যে যায় সেই ভাগ পায়।

আমি বললাম—এ সংবাদটি তুমি ছাড়া আর বোধ হয় কেউ জানে না।

নিশিকান্ত হেসে বললে—জানলে কি আর রক্ষে ছিল। এতক্ষণে দেখতে পেতিস প্রাতঃভ্রমণকারীরা দিনদার বাড়ির সামনে লাইন দিয়েছে।

কথা বলতে বলতে আমরা দিনদার বাড়ির পশ্চিম দিকের কাঁকর-ঢালা উঠোনটায় এসে পড়েছি। নিশিকান্ত যা বলেছিল ঠিক তাই। দিনদা অশখ গাছের নীচে একটি আরামকেদারায় বসে আছেন, কোলের উপর একটা বাঁধানো খাতা, হাতে পেন্সিল। গুনগুন করে সুর ভাজছেন আর খাতায় কি টুকছেন। আমাদের দুজনকে দেখেই সোৎসাহে বলে উঠলেন—এই যে মানিকজোড়, আয় আয়। তা এত সকালে কী মনে করে?

নিশিকান্ত বললে-গোয়ালপাড়ায় রস খেতে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে ই ভাবলাম একবার আপনার সঙ্গে দেখা করে যাই।

তা বেশ করেছি। বলেই দিনদা হাঁক দিলেন-ওগো শুনছে, মানিকজোড় এসেছে। এবার আমাদের চা দাও।

আমাদের দুজনকে সর্বত্র একসঙ্গে দেখা যেত বলেই বোধ হয় দিন আমাদের সব সময় মানিকজোড় বলেই ডাকতেন।

নিশিকান্তর বাক্য দেখছি অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। দিনার স্ত্রী কমল বউঠান যেন সাং অন্নপূর্ণা চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে এলেন, সঙ্গে এল পুডিং তৈরীর প্যান-এ ঠাসা এক প্যান বাসি মাংস। নিশিকান্ত চোখে আমার দিকে তাকাল। ভাবখানা যেন-কেমন, যা বলেছি ঠিক কি না দ্যাখ।

আমাদের নির্লজ্জ খাই-খাই অভাবটা ঢাকা দেবার জন্যে বললাম-দিনদী, আপনি খাতায় কি লিখছিলেন?

দিনদা বললেন–আর বলিস কেন। রবিদার কাণ্ড। শেষ রাত্রে আমায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন একটা সদ্য রচিত গান তুলে নেবার জন্যে। গানটা কাল রাত্রে বিছানায় শুয়ে রচনা করেই সুর দিয়েছেন। সারারাত ঘুমোন নি পাছে ঘুম থেকে উঠে সুর ভুলে যান। ভোর চারটের সময় নীলমণি এসে হাজির, বললে বাবুমশায় এখুনি ডাকছেন। এই তো একটু আগে রবিবার কাছ থেকে ফিরলাম। সুরটা স্বরলিপি করে খাতায় টুকে রাখছি।

কথা বলতে বলতেই দিনদা রবীন্দ্রনাথের সদ্য রচিত গানটি গুনগুন করে গেয়ে উঠলেন—

কাল রাতের বেলা গান এল মোর মনে,
তখন তুমি ছিলে না মোর সনে।

গান থামিয়ে দিনদা বললেন–তোরাই বল, গানটা যদি রাতের বেলায় এসেছিল তাহলে তখনই আমাকে ডেকে পাঠালেই তো হত। তা নয়, সারারাত না ঘুমিয়ে জেগে রইলেন কখন আমি যাব। রবিদাকে নিয়ে আর পারা গেল না।

রবীন্দ্রনাথ ও দিনেন্দ্রনাথ দাদামশায় ও নাতি সম্পর্ক। রবীন্দ্রনাথের বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের দৌহিত্র হলেন দিনেন্দ্রনাথ, দীপুবাবুর পুত্র, যে-দীপুবাবুর গল্প আগেই আপনাদের নিয়েছি।

ইতিমধ্যে কমল বউঠান চা ও খাবার সবাইকে পরিবেশন করেছেন। নিশিকান্ত এক স্লাইস পাউরুটির উপর পুরু করে মাংস ঢেলে তার উপর আরেক পিস রুটি চাপিয়ে স্যাণ্ডউইচ বানিয়ে পরমানলে খেয়ে চলেছে। যেন ও অনেক দূরের মানুষ, আমাদের সঙ্গে যেন ওর কোন সম্পর্কই নেই। মুখের খাদ্যবস্তু এক টেকে উরাৎ করে নিশিকান্ত মুখ খুলল। বলল-আপনি গুরুদেবকে বলেন না কেন যে যত রাতই হোক আপনাকে ডেকে পাঠাতে?

দিনদা হাসতে হাসতে বললেন–সে কি আর বলি না। বহুবার বলেছি, আজও বলেছি। কিন্তু ওঁর ওই এক কথা। ধূ শখিয়ে আমাকে ডাকলে নাকি আমার কষ্ট হবে। অথচ নিজে জেগে থেকে কষ্ট করবেন সারারাত। একথা বলেই দিনদা আপন মনে আবার গানটি গেয়ে উঠলেন।

আমরা তন্ময় হয়ে শুনছি। এমন সময় দিনদার সর্বাধিক প্রিয় পাত্রী অমিতা সেন আমাদের চায়ের আসরে এসেই টিপ করে দিনদাকে প্রণাম করল।

শশব্যস্ত হয়ে দিনদা বলে উঠলেন—এই যে নাইটিঙ্গেল, সকাল বেলায় এসেই প্রণাম করলি? কি ব্যাপার, সুখবর কিছু একটা আছে নিশ্চয়ই।

অমিতা সেন, যাকে খুকু বলেই শান্তিনিকেতনের সবাই চিনত, তার ছিল ঈশ্বরদত্ত গাইবার ক্ষমতা। তার কণ্ঠস্বর ছিল যেমন সুরেলা ও মধুর তেমনি ছিল উদাত্ত। ছেলেবেলা থেকে অদ্যাবধি রবীন্দ্রনাথের গান বহু মেয়ের কণ্ঠেই শুনেছি কিন্তু খুকুর মত এমন সহজ সরল কণ্ঠের প্রাণঢালা গান আমি আর কোথাও শুনি নি। খুকু দেখতে ছিল কালো, কিন্তু যখন গান গাইত, অপরূপ হয়ে উঠত সে নিজে, অপরূপ করে তুলত চারিদিকের পরিবেশ। দিনদা তার এই প্রিয় শিষ্যাকে সব সময়ই আদর করে নাইটিঙ্গেল বলে ডাকতেন এবং এই ডাক যে কতখানি সত্যি তা খুকুর গাওয়া ফিরে ডাক দেখি-রে পরাণ খুলে ডাক রেকর্ডটি যারা শুনেছেন তারাই উপলব্ধি করতে পারবেন। খুকু অকালে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে এবং ওর চলে যাবার সঙ্গে চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল সেই কোকিল-কষ্ঠীর গান।

দিনদা ও কমলা বউঠানকে প্রণাম করেই খুকু বললে-আজ আমার জন্মদিন। ঘুম থেকে উঠে সবার আগে আপনার পায়ের ধুলো নিতে এসেছি।

খুশীতে উচ্ছসিত হয়ে দিনদা বললেন—খুব আনন্দের কথা। কিন্তু আগে জানাতে হয়। তোর জন্মদিনে একটা কিছু উপহার দিতে হবে তো। কী চা তুই আমার কাছে বল।

খুকু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল—এই মাত্র যে-গানটা গাইছিলেন সেইটা শিখিয়ে দিন।

দিনদা বললেন–এ গান তো তোদর গাইবার জন্যই, এ তো শিখবিই। আমার কাছে আর কী তুই চাস বল।

খুকু একটু ভেবে আমতা-আমতা করে বলল-আপনি যদি কথা দেন যা চাইব দেবেন, তবেই চাইব।

বড় বড় চোখ করে দিন বললেন–ওরে বাবা! এ যে দেখছি রামায়ণের মুনিঋষিদের দেবতার কাছে বর চাওয়ার ব্যাপার। তা তোর তপস্যার জোর আছে, তুই বর চাইতে পারিস। কথা দিলাম, যা চাইবি দেব।

খুকু বললে—আপনার লেখা কবিতার বই নীরব বীণা একখানা চাই।

নিমেষের মধ্যে দিনদা যেন চুপসে গেলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কমল বউঠানকে বললেন একখানা বই বাক্স থেকে নিয়ে আসতে। বই এল। বইয়ের প্রথম পাতায় লিখে দিলেন কল্যাণীয়া খুকুকে দিনদার স্নেহাশীর্বাদ।

বই পেয়ে খুকুর আর আনন্দ ধরে না। আরেকবার দিনদা আর বউঠানকে প্রণাম করে সে বিদায় নিল। দিনদ। সেই যে গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন আর কোনও কথা বললেন না।

বড়ই অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। যে মানুষ এতক্ষণ হাসি-ঠাট্টায় গানে-গল্পে চায়ের আসর মাতিয়ে রেখেছিলেন হঠাৎ কেন নীরব হয়ে গেলেন, এ-রহস্য কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। নিশিকান্তর দিকে চাইতেই সে ইশারা করল উঠে পড়তে; আমরা দুজন উঠে পড়তেই দিনদা শুধু একটি কথাই বললেন–আবার আসিস।

রাস্তায় বেরিয়ে নিশিকান্তকে জিজ্ঞাসা করলাম—ব্যাপরটা কি বল তো?

নিশিকান্ত বললে-খুকু দিনদার একটা দুর্বল জায়গায় ঘা দিয়েছে। পরিহাসরসিক সদাহাস্যময় দিনদার ভিতরে একটি কবি-মন লুকিয়ে আছে। আগে কবিতা লিখতেন, এখনও লেখেন কিন্তু কখনও তা ভুলেও প্রকাশ করেন না। এই নীরব বীণা কবিতার বইটি দিনদা তার যৌবনকালে অতি সঙ্কোচের সঙ্গেই ছাপিয়েছিলেন। সেই সময় সাহিত্য মাসিক পত্রিকার সম্পাদক সুরেশ সমাজপতি এই বই সম্পর্কে তার পত্রিকায় টিপ্পনী কেটে লিখেছিলেন; দাদামহাশয় ও নাতি উভয়ে মিলিয়া যেভাবে সরবে নীরব বীণা বাজাইতেছেন তাহাতে মনে হইতেছে গড়ের বাদ্যের আর প্রয়োজন হইবে না। এই মন্তব্যই কাল হল। দিনদা এসব ব্যাপারে স্বভাবতই লাজুক। তার উপর সমাজপতির রবীন্দ্রনাথকে জড়িয়ে মন্তব্য করায় সেই যে আঘাত পেলেন তার ফলে দোকান থেকে সব বই চেয়ে এনে পুড়িয়ে ফেলতে যাচ্ছিলেন। কমল বউঠান তা করতে না দিয়ে বাক্স বন্দী করে রেখেছেন। এ-বই কাউকেই উনি কখনও দেখান নি এবং দেন নি। খুকু অনেক দিন ধরেই বইটি আদায়ের মতলবে ছিল। শেষে জন্মদিনের নাম করে আদায় করল।

নিশিকান্তর শেষ মন্তব্যটুকু আমার কাছে আপত্তিজনক মনে হতেই বললাম—জন্মদিনের নাম করে আদায় করল-এ-কথা তুমি কেন বলছ।

প্রমাণ চাস? সাতদিনের মধ্যে তোকে প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেখিয়ে দেব। এ-কথা বলেই নিশিকান্ত হনহন করে হাঁটা দিল।

দিন সাতেক বাদে এক ছুটির দিনে ভোরে সূর্যোদয়ের আগেই নিশিকান্ত আমার বাড়ি এসেই বললে-চ, এক্ষুনি বেরোতে হবে।

সাত সকালে দু মাইল হেঁটে আবার রস খেতে যেতে হবে ভেবেই তো চক্ষুস্থির। আমি ঘোরতর আপত্তি জানিয়ে বললাম—রস কিন্তু আমি খেতে যাব না।

নিশিকান্ত বললে-না রে না, রস খেতে নয়। তুই চল না আমার সঙ্গে।

নতুন কিছু একটা মতলব নিয়ে নিশিকান্ত এই ভোরে বেরিয়েছে সেটা অনুমান করতে দেরি হল না। নিশিকান্তর সব কাজেই আমার কৌতূহল অপরিসীম। ওর সঙ্গে আর কোথাও যাব না এ-প্রতিজ্ঞা বহুবার করেও তা ভাঙ্গতে হয়েছে, শুধু এই কৌতূহলের জন্যে। সেদিনও বিনা বাক্যব্যয়ে ওর সঙ্গী হলাম।

নিশিকান্তর সঙ্গে সোজা এসে হাজির হলাম দিনদার বাড়ি। যথারীতি অশথ গাছের তলায় দিনদা তখন চায়ের আসর সাজিয়ে একাই বসে আছেন।

আমাদের দেখতে পেয়েই হাঁক দিলেন-আরও দুটো কাপ পাঠিয়ে দাও, মানিকজোড় এসেছে।

নিশিকান্ত আমাকে পিছনে ফেলে হনহনিয়ে হেঁটে গিয়ে দিনদাকে এক প্রণাম ঠুকেই বললে—আজ আমার জন্মদিন।

আমি তো অবাক। আমি যেমন আমার জন্মদিন কবে তা আজও জানি, নিশিকান্তও তার নিজের জন্মদিনের খবর কোনকালেই রাখে না বলেই আমার ধারণা। সরল মানুষ দিনদা, তা-ই বিশ্বাস করে বসলেন। ব্যস্তসমত হয়ে বললেন–অই তো, তোর জন্মদিন। কী দিই তোকে বল তো। তোর তো আবার পছন্দ মত জিনিস হওয়া চাই–

নিশিকান্তর জন্মদিনে কি উপহার দেবেন এই সব নিয়ে যখন দিনা মাথা ঘামাচ্ছেন ঠিক সেই সময় বাড়ির চাকর কাঠের বাক্সর খাঁচা থেকে এক ঝাক হাঁস ছেড়ে দিয়েছে। বান্ন থেকে ছাড়া পেয়েই হাঁসগুলি মহালয়কে ছুটে চলে এসেছে আমরা যেখানে বসে ছিলাম সেইখানে। দিনদার সমস্যায় সমাধান হয়ে গেল। নিশিকান্তকে বললেন–তুই তো আবার মাংস খেতে খুব ভালবাসিস। ঝাক থেকে একটা হাঁস নিয়ে যা, তোর জন্মদিনের উপহার।

দিনদার মুখ থেকে কথা বেরোতে না বেরোতেই চক্ষের নিমিষে নিশিকান্ত গায়ের আলোয়ানটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ঝাঁকের মধ্যে সবচেয়ে পুরুষ্ট, সাদা ধবধবে হাঁসটার উপর। ইস্ট বেঙ্গলের গোল রক্ষক কে দত্ত যেন বডি-খে। করে রসিদের পায়ের উপর থেকে বলটা ছিনিয়ে নিল।

হাঁসটাকে আলোয়ানে মুড়ে বগলদাবা করে গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে নিশিকান্ত বললে—আজ তা হলে চলি দিনা। চা আজ আর খাব না, আরেকদিন আসব।

দিনদা নিশিকান্তর রকমসকম দেখে কেমন যেন গভীর হয়ে গেলেন। ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বললেন–সাদা হাঁসটাই নিলি। ওটা আমার বড় প্রিয় হল। ছিল রে-কি যেন ভাবতে ভাবতে দিনদা আবার বলে উঠলেন—তা তোর যখন ওইটাই পছন্দ তুই নিয়েছিস, বেশ করেছিস।

দিনদার বাড়ির চৌহদ্দি পার হতেই আমি উন্মাভরা কণ্ঠে বললাম—এটা কি উচিত হল? স্রেফ ভাঁওতা দিয়ে একটা হাঁস নিয়ে এলে?

নিশিকান্ত আমার কথার কিছুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে বলল-প্রমাণ দেব বলছিলাম, তাই দিলাম। তাছাড়া এখন আমার মাথায় ঘুরছে কোথায় স্টোভ, কোথায় তেল-নুন-ঘি-আলু-মশলা, কোথায় ডেকচি। তোর নীতিবাক্য শোনবার সময় নেই আমার।

সেই রাত্রে বিরাট ভোজ হল। নিশিকান্ত সারাদিন তার রান্নার যাবতীয় অতিজ্ঞতা দিয়ে বেঁধেছিল চমৎকার। কিন্তু খাবার সময় প্রতিমুহূর্তে দিনার সেই কথাটা মনের মধ্যে কাটার মত খচখচ করে বিঁধছিল—আমার বড় প্রিয় হাঁস ছিল রে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *