০৯. অজয়কে বুঝিয়া উঠা ভার

অজয়কে বুঝিয়া উঠা ভার। সেই যে সেদিন দুই হাতে করিয়া কতকগুলি বই পায়ের কাছে নামাইয়া দিয়া চলিয়া গিয়াছে, তাহার পর আর দেখা হয় নাই। অথচ এমন কতকগুলি মুহুৰ্ত্ত খুঁজিয়া পাওয়া কখনই মুস্কিল হইত না যখন উদ্যত শাসনের উপদ্রব একটু শিথিল ছিল। একদিন এমন করিয়া সমস্ত হৃদয়ে সংশয়ের ঝড় তুলিয়া সহসা নির্লিপ্ত হইয়া যাইবার কারণ কি, নমিতা কিছুই বুঝিতে পারিল না। নিজে গিয়া যে অজয়কে কিছু জিজ্ঞাসা করিবে, তাহা ভাবিতেও তাহার ভয় করে—সমস্ত সংসারের চোখে সেটা একটা বীভৎস অবিনয় মনে করিয়া সে নিবৃত্ত হয়, দ্বিগুণ মনোযোগ দিয়া বইগুলিকে আঁকৃড়াইয়া ধরে। সুমিকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল,—“তোর জয়-দা কি করছে রে?”

সুমি বলিল,—“কাল রাতে বাড়ি ফেরে নি। দু’দিন আমার সঙ্গে দেখা নেই।”

অজয়ের জন্য নমিতার মনে উদ্বেগ ও সহানুভূতি পুঞ্জিত হইয়া উঠিল। সংসারের দৈনন্দিন চলা-ফেরার সঙ্গে তাহার একটুও মিল নাই, দূর হইতে অজয়ের ব্যবহারের এই প্রকাণ্ড অসঙ্গতিটা নমিতা লক্ষ্য করিয়াছে। কখন যে অজয় বাড়ি আসে তাহার ঠিক নাই, দুই দিন হয় ত’ আসিলই না, স্নান না করিয়াই হয় ত’ ভাতের থালা লইয়া গিলিতে বসে, মধ্যরাতে কল হইতে জল পড়িতেছে শুনিয়া কাকিমার আদেশে কল বন্ধ করিতে আসিয়া দেখিয়াছে, অজয় স্নান করিতেছে— আর অগ্রসর হয় নাই। এই সব নিয়মবহির্ভূত আচরণে দিদির মুখে তিরস্কারেরও আর বিরাম ছিল না, তবু এই ছেলেটি সমস্ত অভিযোগ আলোচনায় কান না পাতিয়া দিব্যি আত্মসম্মান লইয়া এই বাড়িতেই কালাতিপাত করিতেছে। অজয়কে নমিতার মনে হয় অসাধারণ, কোনো অভ্যাস বা নিয়মের সঙ্গেই সে নিজেকে খাপ খাওয়াইতে পারিবে না। তাহাকে দেখিয়া মনে হয় সে যেন কি-এক কঠোর সাধনায় লিপ্ত, একা-একা সংগ্রাম করিতে তাহার নিজের শক্তি যেন আর কুলাইতেছে না—তাহার ললাটে প্রতিজ্ঞার তীব্র দীপ্তি থাকিলেও দুই চোখে একটি ঔদাস্যময় ক্লান্তির ভাব আছে। ক্ষণেকের জন্যও সংসারের কাজকর্মের ফাঁকে অজয়কে দেখিতে পাইলে নমিতা যেন তাহার অন্তরের এই অন্তহীন ক্লান্তিকর সংগ্রামের ইতিহাস এক মুহুর্তেই পড়িয়া নেয়। মনে হয় অজয়কে কোনো কাজে সাহায্য কবিতে পারিলে সে ধন্য হইয়া যাইত। কিন্তু যে দুই হাতে সবেগে নাড়া দিয়া তাহাকে এমন করিয়া জাগাইয়া দিল, সে সহসা আবার অপরিচয়ের অন্ধকারে ধীরে-ধীরে অপসৃত হইয়া যাইবে, ইহা ভাবিতে নমিতা চোখে যেন অন্ধকার দেখিতে লাগিল।

সেদিন দুপুরের খাওয়া-দাওয়া চুকিয়া গেলে প্রায় একটার সময় এক মাথা রুক্ষ চুল লইয়া অজয় আসিয়া নীচের উঠানটুকুতে দাঁড়াইয়া হাঁক দিল : “দিদি হাঁড়িতে ভাত আছে?”

দিদি তখন দিবানিদ্রা ভোগ করিতেছিলেন, তাই এক ডাক যথেষ্ট নয়। অজয় আবার ডাক দিল। পাশের ঘরে নমিতা দেয়ালে পিঠ রাখিয়া অভিধানের সাহায্যে একটা রুষীয় উপন্যাসের মৰ্ম্মোদঘাটন করিবার চেষ্টা করিতেছিল, ক্ষুধিত অজয়ের ডাক শুনিয়া সে ধড়মড় করিয়া উঠিল। তাড়াতাড়ি গিয়া ঘুমন্ত কাকিমার পায়ে নাড়া দিয়া তাঁহাকে জাগাইয়া তুলিল। এই ব্যবহারটাও যে তাহার নীতিশাস্ত্রের ঠিক অনুযায়ী হয় নাই তাহা সে জানিত, কিন্তু ক্ষুধার সময় অজয় দুইটা ভাত চাহিতে আসিয়াছে, এই খবর পাইয়া সে কিছুতেই নিশ্চেষ্ট উদাসীন হইয়া বসিয়া থাকিতে পারিল না।

কাকিমা উঠিয়া জানালা দিয়া মুখ বাড়াইয়া তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন,—“এই অসময়ে কে তোর জন্যে ভাতের থালা নিয়ে বসে থাবে শুনি? রাতে কোথায় পড়ে ছিলি? তুই তোর খুসি-মত যা-তা করবি, কখন খাবি কখন খাবি নেবসে বসে’ কে তার হিসেব রাখবে? আমি বাড়িতে বাবাকে লিখে দিচ্ছি—এরকম হলে তোমার এখানে আর পোষাবে না। সংসারের সুবিধে না দেখে নিজের খেয়ালমাফিক চলা-ফেরা করতে চাও, হোটেল আছে।”

এত কথায়ও অজয়ের স্থৈর্য্য একটুও টলিল না—এ-সব কথা যেন তাহার একেবারেই গ্রাহ করিবার নয়। সে পরিষ্কার সহজ গলায় কহিল,—“বেশ ত’ নাই পেলুম ভাত—চৌবাচ্ছায় জল আছে ত’? স্নান করতে পারলেই আমার অর্ধেক খিদে যাবে। যাঃ, জলও নেই। আমি এখন আবার বেরুচ্ছি, দিদি। সন্ধ্যের সময় আসতে পারি, তখন দু’মুঠো ভাত পেলেই আমার চলবে।” বলিয়া অজয় সেই অভুক্ত অবস্থায়ই বাহির হইয়া গেল।

বিড়বিড় করিতে করিতে কাকিমা জানালা হইতে ফিরিয়া আসিয়া আবার শয্যা লইলেন, কিন্তু নমিতার মনে কোথায় বা কেন যে ব্যথা করিয়া উঠিল, তাহা সে ভাল করিয়া বুঝিতে পারিল না। কাকিমার এই ব্যবহারে তাহার নিজেরই আর লজ্জার শেষ ছিল না—এ-সব ক্ষেত্রে প্রতিবাদ বা প্রতিবিধান করিবার তাহার কোনোই অধিকার নাই। তবু যতদূর সম্ভব কণ্ঠস্বর কোমল করিয়া সে কহিল, “না খেয়ে বাড়ি থেকে চলে গেলেন। সামান্য দুটো ফুটিয়ে দিলে হত না?”

একে নমিতাই অকারণে তাঁহার সুখনিদ্রার ব্যাঘাত হইয়াছে, তাহার উপর তাহার মুখের উপর অজয়ের হইয়া সে ওকালতি করিতে চায়—কাকিমা জ্বলিয়া উঠিলেন : “তোর আবার আদর উথলে উঠলো কেন? তুই যে দিন-কে-দিন বড় বেহায়া হচ্ছি।”

নিজের উপর সমস্ত তিরস্কার ও লাঞ্ছনা নমিতা নীরবে সহ্য করিয়াছে, কিন্তু অজয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করিয়া এই হীন বাক্যযন্ত্রণা সে সহিতে পারিল না। তবু স্বভাবসুলভ বিনয় করিয়াই কহিল,—“না খেয়ে বাড়ি থেকে কেউ চলে গেলে বাড়ির মঙ্গল হয় না শুনেছি—সংসারে শ্রী থাকে না।”

কথার তাৎপর্যে যতটা না হোক, নমিতা যে আবার তাহার কথার প্রতিবাদ করিল, এই অশ্রদ্ধা দেখিয়া কাকিমা রাগে একেবারে বিছানার উপর উঠিয়া বসিলেন; সুর চড়াইয়া দিতে হইল : “বাড়ির মঙ্গল হবে না মানে? তুই আমার সমস্ত বাড়িকে শাপ দিচ্ছিস নাকি? নিজে স্বামী খেয়ে শাকচুন্নি সেজে পরের মঙ্গলে তোমার হিংসে হচ্ছে।” ধীর-কণ্ঠে নমিতা কহিল,—“অমন যা-তা বলল না কাকিমা।”

—“কেন বলবো না শুনি? সংসারে শ্রী থাকবে না? শ্ৰী আছে তোমার কপালে!”

গোলমাল শুনিয়া নমিতার মা উঠিয়া আসিলেন। তাহাকে শুনাইবার জন্য কাকিমা গলায় আরো শান্ দিতে লাগিলেন : “আমার ভায়ের জন্য এতই যদি তোর মন পুড়ছিল হতভাগী, নিজে গিয়ে মাছ মাংস বেঁধে দিলি নে কেন? ক্ষীরের পুলি তৈরি করে দিতি বসে’ বসে।”

নমিতা নিঃশব্দে নিজের ঘরে ফিরিয়া আসিল। শুনিতে পাইল মা-ও কাকিমার পক্ষ লইয়া তাহাকেই মন্দ বলিতেছেন। মা’র এই অসহায় অবস্থায় কাকিমার বিরোধিতা করিবার উপায় ছিল না, তাই তাহাকে বাধ্য হইয়া কাকিমার এই কটুবাক্যে সায় দিতে হইতেছে। আর-আর দিন তিরস্কৃত হইয়া নমিতা নিজেকে একান্ত ব্যর্থ মনে কবিয়া চোখের জল ফেলিত, আজ সে বুঝিল, এইভাবে এই অন্যায় বরদাস্ত করা তাহার আত্মসম্মানের অনুকূল হইবে না। নারী এবং পরাবলম্বী হইয়াছে বলিয়াই যে, তাহাকে মাথা পাতিয়া চিরকাল এই ঘৃণ্য নির্যাতন সহিতে হইবে এবং আত্মসম্মানে জলাঞ্জলি দিয়া একটা প্রতিবাদ করিবার জন্য পর্যন্ত ভাষা পাইবে না, তাহা ভাবিতে তাহার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জ্বালতে লাগিল। কিন্তু সম্প্রতি তাহার কোনো প্রতিকার নাই—তবু মনে মনে এই একটা বিদ্রোহতাব পোষণ করিয়া তাহার তৃপ্তির আর অবধি রহিল না।

মা নমিতার সঙ্গে কোনো কথা না কহিয়া বালিশে মুখ গুঁজিয়া কাদিতে লাগিলেন; নমিতাও নিঃশব্দে বইয়ের উপর মুখ গুঁজিয়া রহিল। এই অবরোধ হইতে তাহারা কবে মুক্তি পাইবে? প্রদীপ সেই যে একটু বন্ধুতার আশ্বাস দিয়া পলাইয়াছে, আর তাহার দেখা নাই। পরের কাছ হইতে আশ্রয় বা সাহায্য নিতে গেলে কত বিপদ, কত ভয়, নমিতাকে নিজের পায়ে দাঁড়াইতে হইবে। কত নিন্দা, কত গ্লানি, কত অখ্যাতি—নমিতা শিহরিয়া উঠিল। সংসারে বন্ধুরূপে কাহাকেও স্বীকার বা গ্রহণ করাও বাঙালি মেয়ের নিষিদ্ধ,স্বামী যদি মরিল, তবেই তুমি অব্যবহৃত ছিন্ন জুতার সামিল হইয়া উঠিলে। এক বেলা আলোচাল খাইয়া তোমাকে ইহজীবন সার্থক করিতে হইবে। কোথায় একটা লোক মরিল, আর অমনি তোমার দেহ ও আত্মা একসঙ্গে পক্ষাঘাতে অসাড় হইয়া উঠিবে : এই বিধান মাথা পাতিয়া নিতে তাহার আর ইচ্ছা হইল না, অথচ প্রদীপ একটু স্নেহাতিশয্যে তাহার হাত ধরিয়া ফেলিয়াছিল বলিয়া, শ্বশুর-মহাশয় তাহাকে কেবল মারিতে বাকি রাখিয়াছিলেন। এমন কি, সেখানে তাহার চিত্তবিভ্রম ঘটিবার সুযোগ আছে বলিয়া, তাহাকে কাকার বাড়িতে পাঠাইয়া দেওয়া হইয়াছে।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সমস্ত বাড়ি নিঝুম হইয়া গিয়াছে। নমিতা বই মুড়িয়া রাখিয়া চুলের খোঁপাটা বাঁধিয়া লইয়া নীচে নামিতে লাগিল। এই তাহার প্রথম বিদ্রোহ। ভয় যে করিতেছিল না তাহা নয়, তবু যে-লোক সামান্য দুইটি ভাত চাহিয়া না পাইয়া ফিরিয়া গিয়াছে, তাহার প্রতি সে কেন যে একটি মধুর সমবেদনা অনুভব করিতেছে বুঝা কঠিন। সুমি কাকিমার ছেলেপিলেদের সহিত তাস নিয়া ঘর-বানানোর খেলাতে মত্ত ছিল, দিদিকে লক্ষ্য করিল না। নমিতা সোজা অজয়ের ঘরের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল।

দরজা দু’ফাঁক হইয়া রহিয়াছে, বেশ দেখা গেল ঘরে কেহ নাই। ঘরে কেহ নাই ভাবিয়াই নমিতা আসিতে পারিয়াছে, নচেৎ তক্তপোষের উপর অজয়কে শুইয়া থাকিতে দেখিলে বিদ্রোহিনী নমিতা লজ্জায় জিত, কাটিয়া ধীরে ধীরে প্রত্যাবর্তন করিত হয় তো।

ঘরের চেহারা দেখিয়া নমিতা ছি ছি করিয়া উঠিল—এই ঘরে মানুষে থাকে! তক্তপোষের উপর ছেড়া একটা মাদুর পাতা—তাহার উপর একটা তোষক আছে বটে, কিন্তু সেটাকে একটা কথা বলিলেও অত্যুক্তি করা হয়। মশারির তিনটা কোণ ছিঁড়িয়া গিয়া বিছানার উপরই বিস্তৃত হইয়া আছে, ছেড়া বালিশের তুললাগুলি মেঝেয় ও বিছানায় এলোমেলো হইয়া হাওয়ায় উড়িতেছে। সদ্য-কাচাননা কয়েকটা ধুতি মেঝেয় ধূলার উপরই পড়িয়া আছে—ঘরে কতদিন যে। ঝট পড়ে নাই, তাহার চেয়ে আকাশে কয়টা তারা আছে বলা সহজ। টেবিলটার উপর স্তুপীকৃত বই, খাতা, ওষুধের শিশি, দাড়ি কামাইবার সরঞ্জাম—যেন একটা প্রকাণ্ড বাজার বসিয়াছে। নমিতা যেন হঠাৎ একটা কাজ পাইয়া গেল। এই বিশৃঙ্খল ঘরে যে-লোকটি বাস করে, সে কোন নিয়মের অনুগত নয় বলিয়া তাহার মনে ক্ষোতের সঙ্গে সঙ্গে স্বচ্ছ একটি স্নেহ জমিয়া উঠিতে লাগিল।

অতি যত্নে নমিতা এই নংরা ঘরকে মার্জনা করিতে বসিল। ঝাঁটা কুড়াইয়া আনিয়া ধূলা ঝাড়িল, টেবিলটা ভদ্রলোকের ব্যবহারের উপযুক্ত করিয়া তুলিল এবং টেবিলের কাছে যে চেয়ার আছে, নিজের অলক্ষিতে তাহারই উপর বসিয়া সামনের আয়নায় নিজের মুখ হঠাৎ দেখিতে পাইয়া লজ্জায় রাঙা হইয়া উঠিল। তাড়াতাড়ি চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া বিছানাটার সংস্কার করিতেছে, বলা-কহ নাই, হঠাৎ খোলা দরজা দিয়া সেই একমাথা রুথু চুল নিয়া অজয় আসিয়া হাজির!

 

 

বিস্ময়ের প্রথম ঘোরটা কাটিতেই অজয় চেয়ারে বসিয়া পড়িয়া শ্রান্তকণ্ঠে কহিল,—“যতই কেন না নাস্তিকতা করি, ভগবান বারে বারে প্রমাণ করে দিচ্ছেন যে, তিনি আছেনই আছেন। এখান থেকে ভাত

পেয়ে একবার ভাবছিলুম বেলেঘাটায় যাব, বাস্-এও উঠেছিলুম, কিন্তু হঠাৎ জ্বর এসে গেল। ভীষণ জ্বর!” বলিয়া নিজেই নিজের কপালে হাত রাখিল। কহিল,—“ভাব ছিলুম ঘরে ত’ ফিরে যাব, কিন্তু বিছানা-পত্র যে রকম নোংরা হয়ে আছে শোব কি করে? বিছানা গুছোবার প্রবৃত্তি আমার কোনো কালেই ত’ নেই।”

মশারির একটা কোণ, হাতে ধরিয়া নমিতা চিত্রাপিতের মত দাঁড়াইয়া আছে। বিস্ময়ের সঙ্গে বেদনা মিশাইয়া কহিল,-“জ্বর হ’ল?”

—“কত অত্যাচার আর সইবে বল? তখন যে ক্ষুধার সময় ভাত পেলুম না, স্নানও যে করতে পারলুম না—ভালোই হয়েছে। অসুখটা তা হলে আরো বাড়ত—আমার অসুখ বাড়তে দিলে চলবে কেন? আমার যে কত কাজ—কী প্রকাণ্ড দায়িত্ব আমার হাতে।” একটু থামিয়া আবার সে প্রশ্ন করিল,—“কিন্তু তুমি হঠাৎ এ-ঘরে কেন, নমিতা?”

বিছানাটা ক্ষিপ্রহাতে যথাসম্ভব গুছাইয়া নিতে নিতে নমিতা কহিল, —“আপনিই ত’ তার উত্তর দিয়েছেন। আপনাকে নাস্তিকতা থেকে রক্ষা কতে।”

একটা নিশ্বাস ছাড়িয়া অজয় বলিল,-“হবে।”

বিছানাটাকে শুইবার মত উপযুক্ত করিয়া নমিতা কহিল,—“আপনি। কাপছেন, শিগগির শুয়ে পড়ুন।”

অজয় এক লাফে বিছানায় আসিয়া আশ্রয় নিল।

নমিতা একটু কাছে সরিয়া আসিয়া বলিল,—“খুব কষ্ট হচ্ছে?”

অজয় কহিল,—“আমাকে এক গ্লাশ জল দিতে পার? খাব।”

—“আছি।” নমিতা তাড়াতাড়ি রান্নাঘর হইতে জল নিয়া আসিল।

জল খাইয়া সামান্য একটু সুস্থ হইয়া অজয় বলিল,-“এ ক’দিন বরাদুরে ত’ আর কম ঘুরিনি। মাথাটা যেন ফেটে পড়ছে। একটু হাওয়া করবে, নমিতা? দেখ, পাখাটা বোধ হয় তক্তপোৰের তলায় ঘুমুচ্ছে।”

তক্তপোষের তলা হইতে পাখাটা টানিয়া আনিয়া নমিতা শিয়রে দাঁড়াইয়া ক্ষিপ্রহাতে বাতাস করিতে লাগিল। কহিল,—“কাকিমাকে ডেকে আনি, কেমন?”

অজয় অস্থির হইয়া কহিল,—“না না, আর কাউকে ডাকতে হবে। চেয়ারটা টেনে এনে এখেনে বসে’ তুমিই হাওয়া কর একটু।”

নমিতা না বলিয়া পারিল না : “কিন্তু কেউ দেখতে পেলে কি বলবেন ভাবুন দিকি।”

নমিতার মুখের উপর স্থির দুইটি চক্ষু তুলিয়া অজয় বলিল,–“তোমাকে মন্দ বলবেন? কিন্তু মন্দ তুমি ত’ কিছু করছ না। কছ? রোগীর প্রতি যদি একটু পক্ষপাতিত্ব দেখাও, তার ত’ একটা বড়ো রকম প্রশংসাও আছে।”

—“কিন্তু যারা নিন্দা করবেন তারা ত’ আমার এই সেবাটুকুকেই দেখবেন না, দেখবেন অন্য কিছু।”

—“লোকে যদি ভুল দেখে তার জন্যে তুমি শাস্তি নেবে কেন? তুমি নিজে যদি অন্যায় বা অসঙ্গত বা অশিষ্টাচার মনে কর, দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে চলে যাও—কিন্তু লোকেব তুচ্ছ মিথ্যাকে ভয় করে যদি পালাও, তা হলে আমার দুঃখ থেকে যাবে। আমাকে একটু হাওয়া করা কি তোমার অন্যায় মনে হচ্ছে?”

তাড়াতাড়ি চেয়ারটা টানিয়া শিয়রের কাছে বসিয়া নমিতা কহিল, —“এখন আপনি চুপ করে একটু শুয়ে থাকুন তো, বিকেলে হয় ত’ জ্বরটা নেবে যাবে।”

একান্ত বাধ্য ছেলেটির মত অজয় চোখ বুজিয়া পড়িয়া রহিল। কয়েক মিনিট পাখা চালাইবার পর অজয় ঘুমাইয়া পড়িয়াছে ভাবিয়া, নমিতা চারিদিকে একবার ভাল করিয়া চাহিয়া নিল। তারপর চোরের মত অতি সন্তর্পণে তাহার ডান-হাতখানি অজয়ের কপালের উপর রাখিয়া, তাড়াতাড়ি তখুনি আর সরাইতে পারিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *