ঘনাদা কুলপি খান না

ঘনাদা কুলপি খান না

ঘনাদা বললেন, না।

আমরাও সবাই হাঁ।

ঠাণ্ডা গরম কোনও রকম লড়াই চলছে না, বাইরে সাদা মেঘের হ্যান্ডবিল হড়ানো শরতের আকাশ যেন পুজোর বাজারের মতো প্রসন্ন, কদিন ধরে আমাদের বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেনের আবহাওয়াও তাই।

এই গোলমেলে সময়েও শিবু ট্রেনে করে প্রথমে গড়িয়াহাট, তারপর সোনারপুর, শেষে ক্যানিং পর্যন্ত ধাওয়া করে চিংডি, ভেটকি, এমনকী গাঙের ইলিশ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। সরষের তেলের অভাবটা বাদাম তেলে সরষের গুঁড়ো মিশিয়ে টের পেতে দেওয়া হয়নি। শিশির একটা করে নতুন সিগারেটের টিন একদিন অন্তর খুলে আর হিসেব রাখছে না, ঘনাদা দুবেলা আমাদের আড্ডাঘরে নিজে থেকে হাজিরে দিয়ে এ-পর্যন্ত গালগল্পের দু-চারটে মাত্র ফুলঝুরি ছাড়লেও, তুবড়ি পটকার আশায় আমরা সমানে জল-উঁচু জল-নিচু মেপে তাঁর সঙ্গে তাল দিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ তাহলে ঘনাদার এমন ঘাড় বাঁকাবার কারণ কী?

আর বেঁকে দাঁড়ালেন কীসে? শহরের সেরা আইসক্রিমে!

অনেক ভেবেচিন্তে এ-আইসক্রিমের ব্যবস্থা করেছিলাম। পাড়ার বিখ্যাত তেলেভাজার ওপর আর ভরসা নেই। সরষের তেল যখন মহাজনের গোডাউনে নারকেল তেলের টিনে অজ্ঞাতবাস করছে, তখন তেলেভাজা খেতে মোবিল না সায়ানাইড কী পেটে যাবে ঠিক কী? বড় রাস্তার রেস্তোরাঁর চপ কাটলেটও চোখ বুজে আর মুখে ফেলবার নয়। সামনেই কাঠের আড়ত। আর কিছু না হোক সেখানকার করাতের গুঁড়ো এ বাজারে কাজে লাগতেও তো পারে।

অনেক বিচার-বিবেচনা করে তাই শহরের সেরা কোম্পানির কুলপি মানে আইসক্রিম আনিয়েছিলাম আজ বিকেলে।

এ কুলপিতে ছিটেফোঁটার বদলে গল্পের একটা বড় চাঁই যদি জমে এই আশা। বনোয়ারি বড় ট্রেতে আইসক্রিমের প্লেটগুলো সাজিয়ে আনতেই ঘনাদার চোখে একটু ঝিলিক দেবে ভেবেছিলাম।

তা তো নয়ই। একসঙ্গে দু-দুটো টুটি্যুটি সমেত সবচেয়ে বড় প্লেটটা তাঁর দিকে এগিয়ে দিতেই ঘনাদা যেন রবিবর্মার ছবির বিশ্বামিত্রের মতো মেনকার কোলে শকুন্তলাকে দেখে শিউরে উঠে নিষেধের হাত তুলে মুখ ফেরালেন।

সে কী ঘনাদা! শিশির অবাক হয়ে বললে, আইসক্রিম খাবেন না?

একেবারে বাজারের সেরা কুলপিবরফ, শিবু পঞ্চমুখ হয়ে উঠল, ম্যাগলিটি থেকে স্পেশ্যাল অর্ডার দিয়ে আনানো। জিভে ঠেকতে না ঠেকতে প্রাণ মন জুড়িয়ে যায়। এ কুলপি খাবেন না।

না।ঘনাদার এই সংক্ষিপ্ত যুক্তাক্ষরবর্জিত প্রত্যাখ্যানেই আমরা একেবারে হাঁ।

গৌর তবু একবার ওকালতি করে দেখল, এ আর সেই মাটির হাঁড়ির ময়দা আটা টিনের খোলের নোংরা কুলপি নয়। দস্তুরমতো বৈদ্যুতিক যন্ত্রে তৈরি। হস্ত দ্বারা অস্পষ্ট। একটু শুধু চোখেই দেখুন না।

ভবি তবু তোলবার নয়। সামনে যেন নিমের পাঁচন ধরা হয়েছে এমনইভাবে মুখ বেঁকিয়ে ঘনাদা হাতের শুধু কনিষ্ঠা, অনামিকা ও মধ্যমা নেড়ে সরিয়ে নিয়ে যাবার ইঙ্গিত করলেন।

বরফ খেলে দাঁত কনকন করে বুঝি? মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে যেতেই তটস্থ হয়ে উঠলাম। ঘনাদার বাঁধানো দাঁত ধরা পড়ার সে কেলেঙ্কারি তো ভোলবার নয়। তারপর থেকে সাবধানে সে-উল্লেখ আমরা এড়িয়েই যাই। আজ হঠাৎ আমার ভুলেই na ঘনাদা আরামকেদারা ছেড়ে উঠে পড়েন।

বেফাঁস কথাটা সামলাতে যাচ্ছি, হঠাৎ শিশির যেন আমার বেয়াদবির খেই ধরেই উলটো হাওয়া দিয়ে বসল।

না না, দাঁত কনকন নয়, ঘনাদা ওই পেল্লায় ম্যাগনাম সাইজ দেখেই ভয় পাচ্ছেন। বরফ তো নয়, যেন একজোড়া কোলবালিশ!

ঘনাদা আর অত বড় বরফ দেখেননি কখনও? শিবু শিশিরকে বকুনি দেওয়ার ছলে একটু খোঁচা লাগল।

দেখবেন না কেন? গৌর আর একটু ফুটিয়ে দিলে, বরফের দোকানে কাঠের গুঁড়ো মাখানো চাঁই দেখেছেন। তার বেশি তো কিছু নয়।

কেন? আমি সরল প্রতিবাদ জানালাম, দুনিয়া এসপার-ওসপার করে ঘনাদা একটা আইসবার্গও দেখেননি কখনও! এই তো সেবার সেই ছড়ির কল্যাণে দক্ষিণ মেরু থেকে বেঁচে ফেরবার পথে আইসবার্গের ওপরই পড়েছিলেন।

আকাশে আজ দু-চারটে হালকা সাদা মেঘ ছাড়া কিছু নেই। কালো মেঘগুলো সব ঘনাদার মুখেই এসে জমছে টের পাচ্ছিলাম। আমি শঙ্কিত হলেও গৌর কিন্তু তাতেও যেন ভ্রুক্ষেপ না করে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললে, হ্যাঁ, ওই আইসবার্গ পর্যন্তই বলতে পারো!

আইসবার্গটা বুঝি কিছুনা! ঘনাদার নাম বাঁচাতে আমাকেই কোমর বাঁধতে হল, সেটা কত বড় হবে, ঘনাদা?

উৎসুকভাবে ঘনাদার দিকে চোখ কপালে তোলবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে তাকালাম। আইসবার্গটা এভারেস্ট না ছাড়াক, আলপস কি অ্যান্ডিজকে লজ্জা দেবে-ই নিশ্চয়।

কিন্তু একেবারে যেন থাবড়া দিয়ে বসিয়ে দিয়ে ঘনাদা নিজেই নিতান্ত অবজ্ঞার সুরে বললেন, কত আর! শ-দুই ফুট উঁচু হবে বড় জোর। সঙ্গে সঙ্গে ঘনাদা উঠে পড়েন আর কী!

আমি এবার হতাশ, কিন্তু প্রথম হেঁকা যে দিয়েছিল সেই শিশিরই মলম লাগিয়ে নরমে-গরমে এমন বাজিমাত করবে কে ভেবেছিল!

হঠাৎ খুক খুক করে দুবার কেশে নিয়ে শিশির বললে, গলাটা কেমন খুসখুস করছে। যা ডেঙ্গুর মরম চলছে। গলার জন্য একটা কিছু খেলে হয়।

আমার ঘরে থ্রোট প্যাস্টিল আছে। আনাব নাকি, ঘনাদা?

ঘনাদা প্রায় উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। আবার আরাম-কেদারায় একটু সোজা হয়ে বসে বললেন, তা থাকে যদি আনাও।

আর ভাবছি—শিশির এখন রাস্তা পেয়ে গেছে বোঝা গেল। দু-গ্রাসে নিজের প্লেটের আইসক্রিমটা সাবাড় করে মুখচোখের কাহিল অবস্থাতেই করুণ সুরে বললে, এসব বরফ-টরফ এখন না খাওয়াই ভাল। বাজারের কিছুতে তো বিশ্বাস নেই। রামভুজকে না হয় ক-টা অমলেট ভাজতেই বলি।

বলো। ঘনাদা এবার আরাম-কেদারায় গা এলিয়ে দিলেন যেন নির্লিপ্তভাবে। সেই সঙ্গে ককাপ গরম কফি! গৌর ফরমাশ করলে।

ঘনাদার মুখ থেকে আষাঢ়ের মেঘগুলো সরছে বলেই মনে হল। হঠাৎ আবার শিশিরের বেয়াড়া খোঁচা।

ঠাণ্ডাটা আপনার সয় না, না ঘনাদা? ঘাটে লাগতে লাগতে নৌকো বুঝি বানচাল হয়ে যায়। কিন্তু বিপরীতেই হিত হয়ে গেল যেন ফুসমন্তরে।

ঘনাদা তাঁর সেই পেটেন্ট নাসিকাধ্বনি ছেড়ে বললে, হ্যাঁ, তেমন আর সয় কই! শুনেছি দক্ষিণ মেরুর অভিযানে রাশিয়ানরা ভোস্টকে মাইনাস একশো পঁচিশ ডিগ্রি পেয়েছে। সেটা আমার দেখবার সৌভাগ্য এখনও হয়নি। তবে পারার থার্মোমিটার পাথর হয়ে জমে অচল হয়ে গেছল।

থার্মোমিটারের পারা জমে গেছল! স্বাভাবিক বিস্ময়ের সঙ্গে উসকানি দেবার জন্যও মুখব্যাদান করতে হল, কত ঠাণ্ডা তাহলে?

কত ঠাণ্ডা বুঝবেন কী করে! গৌর ধমক দিল, শুনছিস থার্মোমিটার জমে গেছল!

না, পারার থার্মোমিটার জমলেও ঠাণ্ডা মাপা যায়! ঘনাদার অনুকম্পা-অবজ্ঞার দৃষ্টি যত জোরালো আমাদের আশাও সেই অনুপাতে প্রবল, পারা জমে শক্ত হয়ে যায় ৩৮তে, তারপর অ্যালকোহল থার্মোগ্রাফ দরকার হয়। সে অ্যালকোহল থার্মোগ্রাফে তখন মাইনাস সত্তর।

মাইনাস সত্তর! গৌর বিনা চেষ্টাতেই চোখ কপালে তুলল, কোথায়?

দ্রাঘিমা ৪২.১২ পূর্ব-অক্ষাংশ উত্তর ৭২.৩৫।

বলা বাহুল্য ঘনাদার এই সরল সংক্ষিপ্ত সমাচারে আমরা সবাই অথই পাথারে।

শিবুই প্রথম সামলে উঠে দুবার ঢোক গিলে জিজ্ঞাসা করলে, উত্তর অক্ষাংশ বলছেন না? তার মানে আলাস্কা-টালাস্কা কি ল্যাপল্যান্ড-আইসল্যান্ড বুঝি?

না। গ্রিনল্যান্ডের উত্তর-পুবে সাড়ে-আট হাজার ফুট, যাকে আইস ক্যাপ বলে সেই বরফের একটা চাঁইয়ের ওপর।

সাড়ে-আট হাজার ফুট বরফের চাঁই। ঘনাদা গৌরের বেয়াদবির জবাব দিলেন বুঝে বিস্ফারিত নয়নে জিজ্ঞেস করলাম, সেখানে মানুষ থাকে?

না, থাকে না। প্রায় পঞ্চাশ হাজার বর্গমাইলের মধ্যে মানুষের বসতি নেই বললেই হয়। জায়গাটা সুমেরুবৃত্তেরও চারশো মাইল উত্তরে। গ্রিনল্যান্ডের সবচেয়ে দক্ষিণের ঘাঁটি ফেয়ারওয়েল অন্তরীপ থেকে প্রায় হাজার মাইল। উত্তর মেরুও হাজার মাইলের কিছু বেশি। সেটা আই. জি. ওয়াই, মানে ইন্টারন্যাশন্যাল জিওলজিক্যাল ইয়ার বলে কয়েক মাসের জন্য এই বরফের শ্মশানে একটি বৈজ্ঞানিকের দল কাছাকাছি কোথায় একটা ঘাঁটি বসিয়ে একটা রাত কাটাতে এসেছে। এইটুকু শুধু জানতাম।

ঘনাদা ভাষণ থামিয়ে আমাদের মুখের ওপর একবার চোখ বুলোলেন। তাঁর ঠোঁটের বাঁকা হাসিটুকুর মানে না বুঝে আমি বেশ একটু অবাক।

গৌরই আমাদের মুখরক্ষা করলে। ভুরু কুঁচকে বললে, কয়েক মাস ধরে এক রাত কাটাচ্ছে, মানে ওখানে সেই ছ-মাস দিন, ছ-মাস রাত তাহলে?

ঠিক ধরেছ।ঘনাদা কিঞ্চিৎ প্রসন্ন হয়ে বললেন, তখন সেই রাত দুপুর চলছে। সূর্যের মুখ দেখা যায় না, শুধু একবার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আকাশটা একটু পরিষ্কার হয়। তবে মাঝে মাঝে উত্তর আকাশে যেন বৈদ্যুতিক আতসবাজির উৎসব লেগে যায়।

অরোরা বোরিয়ালিস! শিশির তার বিদ্যা জাহির করেই বোধহয় বিবাদ বাধালে।

হ্যাঁ, ওই বোরিয়ালিসের ভুতুড়ে আলোয় এক বিশাল সাসজির ওপর দিয়ে তখন দূরের এক নুনাটাক লক্ষ করে চলেছি।

দাঁড়ান। দাঁড়ান। শিশিরের বাহাদুরির খেসারত দিতে বাধ্য হয়েই অজ্ঞতা স্বীকার করে ঘনাদাকে থামাতে হল, ওসব শাস্ত্রীজি আর নুন-টুন আবার কী?

শাস্ত্রীজি নয়, সাসজি, আর নুন-টুন নয়, নুনাটাক। ঘনাদা কৃপা করে ব্যাখ্যা করলেন, সাসক্রজি হল ঢেউ খেলানো বরফের প্রান্তর আর নুনাটাক হল পাহাড় গোছের পাথুরে ঢিবি। প্রথম কথাটা রুশ ভাষার, দ্বিতীয়টা এস্কিমোদের থেকে পাওয়া। ওই কথাগুলোই এখানে চালু।

একটু থেমে আমাদের কুপোকাত অবস্থাটা উপভোগ করে ঘনাদা বলতে শুরু করলেন, গায়ে ভালুকের চেয়ে বোক্কড় পোশাক—পশমের পা-গেঞ্জি, হাত-গেঞ্জি, তার ওপর পশমের শার্ট পাজামা, পর-পর দু-জোড়া গরম মোজা, ভেতরে রেশমের লাইনিং দেওয়া পশমের পাকা, তার ওপর ক্যারিবো হরিণের নোমওয়ালা চামড়ার প্যান্ট আর বলগা হরিণের লোমশ চামড়ার বড় পার্কা আর মাথাঢাকা টুপি, পায়ে সিলের চামড়ার জুতো, দুহাতে পশমের দস্তানার ওপর বলগা হরিণের চামড়ার আর একটা দস্তানা, মুখে তুষার বাঁচাবার গগল্স-আঁটা মুখোশ—তা সত্ত্বেও মুখে গলায় যেখানে একটু ফাঁকা সেখানে যেন অসংখ্য অসাড় করা ছুঁচ ফুটছে।

গ্রীনল্যান্ডের এই বরফের প্রান্তরে ঠিক তুষারপাত যাকে বলে তা খুব কমই হয়। সাদা ঢেউ খেলানো শূন্যতার ওপর দিয়ে সারাক্ষণ অসহ্য একটা গোঙানি ভোলা ঝোড়ো হাওয়া এলোমেলো ভাবে বয়, আর তাতে একটু ফুটলেই কালিয়ে-দেওয়া বরফের অগুনতি ছুঁচ যেন সূক্ষ্ম খ্যাপা ভোমরার ঝাঁকের মতো উড়ে বেড়ায়।

এইভাবে কয়েক পা আরও এগিয়েই সামনের সেই ফাটলটা দেখতে পেলাম। বরফের প্রান্তর দুফাঁক করে কত হাজার ফুট অতলে যে নেমে গেছে তার ঠিক নেই। ওপরেই ফাটলটা এদিক থেকে ওদিক প্রায় চোদ্দ ফুট চওড়া।

আমার পেছনে পেরীনও যে এসে দাঁড়িয়েছে অরোরা বোরিয়ালিসের ভুতুড়ে আলোর ফেলা ছায়া দেখেই বুঝলাম।

পেছন না ফিরেই জিজ্ঞাসা করলেন, এবার কী করবেন, সেনর পেরীন? এ ক্রেভ্যাস কতদূর লম্বা কিছু তো বোঝবার উপায় নেই। অথচ এটা পার না হলে তো আপনি যে নুনাটাক দেখাচ্ছেন সেখানে পৌঁছোনো যাবে না। এই দু-মনি পোশাক নিয়ে পারবেন লাফ দিয়ে পার হতে?

লাফ দেবার দরকার হবে না। স্নো মাস্ক এর ভেতর দিয়েই সেনর পেরীনের জলদগম্ভীর গলা শোনা গেল, এখান থেকেই ফিরে যাব ভাবছি, আর একলাই ফিরব।

একলাই ফিরবেন! যেন কথাটা ঠাট্টা মনে করেই গ্রাহ্য না করে হেসে উঠে নিচু হয়ে তার দিকে পিছন ফিরে বসে অতল ফাটলটা ভাল করে পরীক্ষা করতে করতে বললাম, কী ভয়ংকর ফাটল দেখেছেন। মনে হয় সোজা আট হাজার ফুট সেই পাতালে নেমে গেছে।

হ্যাঁ। পেছন থেকে আমার প্রায় ঘাড়ের ওপরে পেরীনের বাজখাঁই গলা শোনা গেল এবার, একটা কেলে গুবরে পোকার পক্ষে গোরটা একটু বেশি জমকালো হয়ে যাচ্ছে। সাড়ে আট হাজার ফুট বরফের পিরামিড মিশরের ফারাওরাও ভাবতে পারেনি।

যেন রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়ে এবার উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আপনার হঠাৎ এ-রকম ঠাট্টার মানে তো বুঝতে পারছি না, সেনর পেরীন। আপনার প্রাণ সংশয় বলে সাহায্য করবার জন্য আমায় ডেকে নিয়ে এলেন। তখন গোপনে বললেন যে এস. এ. এস.-এর এই ট্র্যান্স-পোলার ফ্লাইটের জেট হঠাৎ বিকল হয়ে এভাবে আইসক্যাপের ওপর নামার পেছনে ভয়ংকর ষড়যন্ত্র রয়েছে। প্লেনটা প্রায় নিরাপদেই নামলেও প্রথম ধাক্কায় আপনার পাশের সিটের ভদ্রলোক মি. হিগিন্‌সের হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক নয়। আপনাকে ঘায়েল করতে গিয়েই শত্রুরা সামান্য ভুলে নাকি মি. হিগিন্সকে জখম করে বসেছে। শত্রুরা প্লেনের ভেতরেই যাত্রী না কর্মচারী সেজে আছে আপনি বুঝতে পারেননি বলেই তাদের ভয়ে আপনি প্লেন ছেড়ে পালাবার এই ভয়ংকর ঝুঁকি নিয়েছেন। এখানে আই, জি, ওয়াই.-এর বৈজ্ঞানিকদের একটা ঘাঁটি বসেছে বলে আপনার জানা আছে। প্লেন সামান্য যেটুকু জখম হয়েছে তা সারাবার ফাঁকে আপনি আমার সাহায্য চেয়েছেন সেই ঘাঁটি খুঁজে বার করবার জন্য। সীমাহীন তুষারের এই ধুধু জনমনিষ্যিহীন তেপান্তরে সে অজানা ঘাঁটি খুঁজে না পাওয়ার মানে যে কী তা বুঝেও জেনেশুনে এত বড় বিপদ ঘাড়ে নিয়ে আপনার সঙ্গী হয়েছি, আর আপনি কিনা এ-রকম বিশ্রী ঠাট্টা করছেন!

আচ্ছা, ঠাট্টা আর করব না তাহলে। অরোরা বোরিয়ালিসের ভুতুড়ে আলোর রং-বেরঙের মায়া-পর্দা দোলানো সেই গাদা তুষারের অসীম মহাশ্মশানে ছুঁচ-ফোটানো হাওয়ার অবিরাম গোঙানি ছাপিয়ে যেন সাক্ষাৎ যমদূতের মতো পেরীনের বুক কাঁপানো হাসি শোনা গেল। তারপর হাসি থামিয়ে সে চাপা গর্জন করে বললে, শোন তাহলে, হতভাগা। বরফের পিরামিডের তলায় কবর দেবার আগে তোকে সত্যি কথাগুলো শুনিয়ে দি। তুই আমায় চিনতিস না, কিন্তু তুই যে হিগিন্সকে পাহারা দেবার জন্য এ-প্লেনে যাচ্ছিস তা আমি জানতাম। এ-জেট প্লেন যে হঠাৎ বিকল হয়ে এই আইসক্যাপের ওপর নেমেছে সে আমাদেরই কারসাজিতে। এ-প্লেনের ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার আমাদের হাতের মুঠোয়। তারই কৌশলে প্লেনের ইঞ্জিন হঠাৎ বিগড়ে গেছে।

কিন্তু প্লেনের ইঞ্জিন বিগড়ে দিয়ে এই জনমানবহীন বরফের রাজ্যে নামতে বাধ্য করায় লাভটা কী? আমি যেন হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।

লাভটা এখনও বুঝতে পারিসনি? পেরীন হায়নার হাসি হেসে বললে, লাভ এক ঢিলে দু-পাখি সাবাড় করা। প্লেনটা বেকায়দায় নামাবার সময় সামান্য যেটুকু ঝাঁকুনি লেগেছে তারই সুযোগ নিয়ে পাশে থেকে মাথায় ঘা দিয়ে বুড়ো হিগিন্সকে বেহুঁশ করেছি। তারপর গোলমালের মধ্যে তার অ্যাটাচিটাই তুলে নিয়ে টয়লেটে গিয়ে ঢুকেছি। সেখানে যা দরকার বার করে নিয়ে তার জায়গায় অন্য কাগজপত্র রেখে অ্যাটাচিটা আবার যথাস্থানে রেখে দিয়েছি। ফ্লাইট অফিসার আর ইঞ্জিনিয়াররা তখন প্লেন থেকে নেমে বাইরে মেরামতের কাজে লেগেছে। এবার তোর একটা ব্যবস্থা না করলে নয়। বাইরের পোশাকগুলো এয়ার ব্যাগে ভরাট ছিল। আর-একবার টয়লেটে গিয়ে সেগুলো পরে ফেলেছি। প্লেনের ভেতরে যেখানে সত্তর ডিগ্রি তাপ বাইরে সেখানে মাইনাস সত্তর। ওই গোলমাল না হলে অফিসাররা কেউ বাধা দিত। একজন স্টুয়ার্ডেস চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু পোশাক দেখিয়ে তাকে বুঝিয়ে নীচে নেমেছি। তুই যে আগেই নীচে নেমেছিস তা দেখেছি। নীচে তোকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে এই আজগুবি বিপদের কাহিনী শুনিয়েছি। এত সহজে আহাম্মকের মতো তুই এ-ফাঁদে পা দিবি তা সত্যি আশা করিনি। তখন রাজি না হলে অন্য উপায়ে তোকে সাবাড় করবার ব্যবস্থা করতে হত।

তাহলে আপনার বিপদ, আই, জি, ওয়াই-এর ঘাঁটি খোঁজার কথা, সব মিথ্যে! আমি যেন দিশাহারা।

তোর মতো একটা গবেটকে যারা হিগিন্সকে আগলাবার জন্যে পাঠিয়েছে তাদের বুদ্ধিকেও বলিহারি! পেরীন যেন গায়ে থুতু দেবার মতো করে বললে, এই পঞ্চাশ হাজার বর্গমাইল ধুধু বরফের রাজ্যে আই. জি. ওয়াই.-এর একটা কুঁড়ের মতো আস্তানা খুঁজে বার করা খড়ের গাদায় ছুঁচ খুঁজে বার করার চেয়ে যে শক্ত সে হুঁশটুকুও তোর হয়নি। কিন্তু আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। প্লেন বোধহয় এতক্ষণে চালু হয়ে এসেছে। তোর কবরের ব্যবস্থা করে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে এবার।

সত্যি একলাই ফিরে যাবেন। আমি যেন সমস্ত ব্যাপারটা এখনও বিশ্বাস করতে পেরে ভ্যাবাচ্যাকা—ওরা যখন আমার কথা জিজ্ঞাসা করবে?

আমায় জিজ্ঞেস করবে কে? পেরীন ঘেঁকিয়ে উঠল, আমার সঙ্গে তোকে আসতে কেউ দেখেছে! তুই যে নেই এ-গোলমালে তা কেউ খেয়ালই করবে না। খেয়াল পরে কোনও সময়ে অবশ্য হবে, কিন্তু তখন প্লেন উত্তর মেরু পেরিয়ে বোধহয় প্রশান্ত মহাসাগরের নাগাল পেয়েছে। তুই তখন সব খোঁজাখুঁজির বাইরে।

এই ফাটলেই তাহলে ফেলে দেবেন বলছেন! হতাশ করুণ সুরে বলে ফাটলটা আর একবার দেখবার জন্যই যেন পেরীনের দিকে পিছু ফিরলাম।

সেই মুহূর্তে পেরীন বুনো মোষের মতো পেছন থেকে সজোরে ঠেলা দিলে।

তৈরিই ছিলাম। তবু হাত বাড়িয়ে ধরে না ফেললে পেরীন সেই হাঁ করা পাতালে বোধহয় তলিয়েই যেত।

ধরে-ফেলা তার হাতটা ফাটলের পাড়ে বরফের একটা ধাঁজে লাগিয়ে দিয়ে বললাম, শক্ত করে ধরুন, সেনর পেরীন। আপনার যা দু-মনি বালির বস্তার মতো লাশ তাতে আগেই যদি বরফের পাড় ধসে না যায় তা হলে মিনিট পাঁচেক অন্তত টিকে থাকতে পারবেন।

প্রাণপণে দু-হাতে বরফের খাঁজটা ধরে অতল ফাটলের ওপর ঝুলতে ঝুলতে পেরীন ভয়ে কাঁপা ধরা গলায় কোনও রকমে বললে, আমি—আমি

হ্যাঁ, আপনি আমার জন্য ভাল সমাধিরই ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু আমার মতো সামান্য একটা পোকামাকড়ের পক্ষে এমন সমাধি একটু বেমানান নয়? বরফের পিরামিডটা আনার কবরেরই মান রাখবে।

আমি আর ধরে থাকতে পারছি না। এবার একটু দম পেয়ে পেরীন আর্তনাদ করে উঠল, আমায় বাঁচাও। এবার আমি তোমাকে অনেক অনেক টাকা দেব। এত টাকা তুমি ভাবতে পারো না।

সত্যি বলছেন? আমি যেন একটু দোমনা, কিন্তু টাকার আমার ভাবনা কী। আপনার পকেটেই যেকটা কাগজ চুরি করে রেখেছেন সেগুলো পেলেই তো আমি টাকা রাখবার জায়গা পাব না।

পাড়ের ধার থেকে ঝুঁকে পেরীনের পার্কা থেকে শুরু করে সাতপুরু জামার তলায় হাত চালিয়ে তার শার্টের ভেতরের পকেট থেকে খামে-ভরা কাগজগুলো বার করে নিয়ে বললাম, কিছু মনে করবেন না। কখন আপনি এফাটলে তলিয়ে যান কিছু ঠিক নেই তো, তাই এগুলো আগেই বার করে নিলাম।

আমার হাত অবশ হয়ে আসছে। পেরীনের এবার প্রায় ড়ুকরে কান্না। আপনাকে দিব্যি গেলে বলছি, নিজে থেকে আমি ধরা দেব, সব ষড়যন্ত্রের কথা কবুল করে যারা যারা এর ভেতর আছে ধরিয়ে দেব। আমায় বাঁচান।

দেখুন দিকি! বড় ফাঁপরেই যেন পড়লাম। আট হাজার ফুট ফাটলে নামিয়ে দিচ্ছিলেন, এখন আবার তুই থেকে আপনিতে তুলে লজ্জা দিচ্ছেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রের কথা জানাবার জন্য আপনাকে বাঁচাবার দরকারই নেই যে! আপনার মতো নিরেট আহাম্মক বেইমানকে যারা এ শয়তানি কাজ হাসিল করতে নিয়েছিল তাদের বুদ্ধিকে বলিহারি। আপনি কি ভাবেন ষড়যন্ত্রের কথা জানতে আমাদের কিছু বাকি আছে? হিগিন্সকে আগলাতে নয়, আপনার ওপর নজর রাখবার জন্যই আপনার পেছনের সিটে জায়গা নিয়ে চলেছি। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার আপনাদের হাতের মুঠোয় বলে ইঞ্জিন বিগড়ে দিয়ে এই বরফের শ্মশানে প্লেন নামাবার ব্যবস্থা করেনি। সে যাকে বলে ডাবল এজেন্ট, মানে আমাদেরই চর। আপনাদের দলের লোক সেজে এতদিন আপনাদের ধোঁকা দিয়েছে। এ অমূল্য কাগজ চুরির ষড়যন্ত্রের কথা জানা থাকলেও হাতেনাতে ধরবার জন্যেই যেন আপনারই সুবিধে করতে প্লেন এখানে নামানো হয়েছে। ঘটে যদি আপনার একটু বুদ্ধি থাকত তাহলে আমায় প্লেনের বাইরে এই সব পোশাকে দেখেই আপনার সন্দেহ হত। সাধারণ প্লেনের যাত্রী হয়ে গ্রিনল্যান্ডের ওপর ঘোরাফেরার পোশাক কেউ সঙ্গে রাখে না। এ আইসক্যাপে আই. জি. ওয়াই. এর ঘাঁটি যে এখন ধারেকাছে নেই তা আমি জানি। আপনার মিথ্যে ধাপ্পা অত সহজে বিশ্বাস করে যে আপনার সঙ্গে এসেছি সে শুধু আপনার দৌড় দেখবার জন্য। মি. হিগিনও আপনার চোরা মারে অজ্ঞান হননি। এই রকম কিছু হতে পারে আন্দাজ করেই তাঁর গায়ে বুলেট প্রুফ বর্ম আঁটা, আর মাথায় শক্ত ইস্পাতের আঁটো টুপির ওপর পরচুলা লাগানো। তিনি শুধু অজ্ঞান হবার ভান করে ছিলেন। কিন্তু আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আপনার হাত দুটো অসাড় হয়ে এসেছে বুঝতে পারছি। ভাবছি এত কষ্ট যার জন্য করলেন সেটা থেকে আপনাকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। এ-ক্রেভ্যাস কত গভীর জানি না। যতই হোক, তলায় গিয়ে খামটা খুঁজে নিতে পারবেন।

লেফাফাটা তারপর সেই ফাটলের মধ্যেই ফেলে দিলাম।

অ্যাঁ। ওই অমূল্য কাগজগুলো ফেলে দিলেন! আমাদের সকলের চোখই ছানাবড়া।

হ্যাঁ, ঘনাদা নির্বিকার, ফেলে দিতে ওই অবস্থাতেও পেরীনও প্রায় আর্তনাদ করে উঠেছিল। তাকে অবশ্য শেষ পর্যন্ত ফাটল থেকে তুলে প্লেনে নিয়ে গিয়ে হাতকড়া পরাবার ব্যবস্থা করেছিলাম।

কিন্তু সেই দামি কাগজগুলো? আমাদের বিমূঢ় জিজ্ঞাসা।

আসল কাগজ তো ছিল আমার পকেটে! ঘনাদা ঈষৎ দন্ত বিকাশ করলেন, মি. হিগিনসের অ্যাটাচিতে যা ছিল তা ফাঁকি।

কিন্তু ও-অমূল্য কাগজে ছিল কী? আমি কৌতূহল চাপতে পারলাম না।

স্পেস রকেটের নতুন নকশা। শিবু আঁচ করলে।

নিউট্রন বোমার অঙ্ক। গৌরের কল্পনা।

উঁহু, আধুনিক ক-টা ছবি! শিশিরের মন্তব্য।

না, ঘনাদা আমাদের সংশষ মোচন করলেন, ছিল লেজের-এর নতুন কূট কৌশল।

লেজের-এর! আমরা হতভম্ব।

হ্যাঁ, ঘনাদা সদয় হয়ে ব্যাখ্যা করলেন, এল. এ. এস. ই. আর.। মানে, লাইট অ্যাম্পলিফিকেশন বাই স্টিমুলেটেড এমিসন অফ রেডিয়েশন। সংক্ষেপে ইংরেজি আদ্যক্ষরগুলো নিয়ে লেজের, একারটা খাটো। আর বর্গীয় জ-টা জানতি পার নার মতো। আজগুবি বিজ্ঞান কাহিনীর লেখকরাও যা কল্পনা করতে পারেনি, লেজের এযুগের মাত্র সেদিনের, ১৯৬০ সালের, সেই যুগান্তকারী আবিষ্কার ও উদ্ভাবন। এ এমন তীব্র তীক্ষ্ণ আলোর রেখা যে দশ মাইল দূরে ফেললেও কয়েক ফুট মাত্র ছড়ায়। এ আলো দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে সুর্যের লক্ষ লক্ষ গুণ উত্তাপ সৃষ্টি করা যায়। এ আলোর রেখা মারফত বেতারের চেয়ে ভালভাবে মানুষের কণ্ঠ আর যে-কোনও ছবি পাঠান যায়। একটা এ-আলোর রেখা এই ভারতবর্ষে এই মুহূর্তে যেখানে যত টেলিফোনের আলাপ হচ্ছে সব বইতে পারে। প্রথম যেলেজের যন্ত্র তৈরি হয় তাতে চুনির ভেতর দিয়ে শুধু একটি রঙের লাল আলোই বার হত। আর্গন, ক্রিপ্টন গোছের গ্যাস ব্যবহারের কৌশলে এখন অন্তত ষাট-সত্তর রঙের লেজের আলো বার করবার উপায় উদ্ভাবিত হয়েছে। সেই আশ্চর্য উদ্ভাবনের খসড়া নিয়েই মি. হিগিন্স বিলেত থেকে আমেরিকায় যাচ্ছিলেন। এ অমূল্য কাগজ চুরি যাবার ভয়েই সঙ্গে থাকতে হয়েছিল আমায়।

কিন্তু এ আশ্চর্য উদ্ভাবনের কৌশল শুধু ওই কটা কাগজেই লেখা থাকবে কেন? গৌরের বেয়াড়া প্রশ্ন, সঙ্গে করে তা নিয়ে যাবারই বা দরকার কী? টপ সিক্রেট ডাকেই তো তা পাঠাবার কথা।

ঘনাদার কাছে কোনও উত্তর আর পাওয়া গেল না। বনোয়ারি তখন রামভুজের সদ্য ভাজা গরম অমলেটের প্লেট নিয়ে হাজির হয়েছে।

ঘনাদা তারই ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন।

গলা ব্যথার লঞ্জেসও রয়েছে, ঘনাদা। শিশির জানাল।

ঘনাদার ভর্তি গাল থেকে যে অস্পষ্ট আওয়াজ বেরুল, তা মনে করিয়ে দেওয়ায় খুশির, না ধরে ফেলায় বিরক্তির ঠিক বোঝা গেল না।